এইটটিন ফিফটি সেভেন, এ্যা আনফোল্ড লাভ স্টোরি
ব্যারাকপুরের কুঠির এইদিক টি একেবারে নির্জন প্রায় নদী ছোঁয়া। ঘন সবুজ গাছের বিস্তার। নীল আকাশ নুঁয়ে পড়েছে সোজা নদীতে। শার্লটের এই নদীটিকে খুব পছন্দ হয়েছে। নাম গাঞ্জেস। শার্লটের প্রথম থেকেই মনে হতো নদীটি মেয়ে। তাই এতো রুপবদল করে। গায়ের রঙ বদলে যায় বারে বারে। ইংলন্ডের টেমস, ব্রুক এর মতো নয় শহরের গা দিয়ে ধীরস্থির ভাবে বয়ে চলেছে, না ফ্রান্সের সেইন নদী স্বচ্ছ সলিলা নীল বসনা, এই নদীটি একদম অন্যরকমের। কখোনো ধূসর, কখনো ঘোলা মাটি রঙ। ভীষন দুরন্ত।
— মেমসাহেব চা এনেছি। আর্দালির ডাকে লেডী শার্লট ক্যানিং চোখ তুলে তাকালো।
কুঠি বাড়ীর সামনের খোলা ফুলের বাগিচা পেরিয়ে ঢুকল লর্ড আর্ল ক্যানিং এর জুড়িগাড়ি।
— শুভ সন্ধ্যা প্রিয়তমা!
আর্ল কিন্তু অন্যমনস্ক, চোখের কোলে মেঘ, শার্লট উঠে এল ভেতরে। কানাঘুষোয় আগে সে শুনেছে ব্যারাকের সিপাহীরা আর কালাপানি পেরোতে চাইছে না তারাও মাঝে মাঝেই উলটো মারধোর দিচ্ছে রেজিমেন্টের ইংরেজ সেনাদের। শুধু কলকাতা নয় দিল্লী আগ্রা উত্তরপ্রদেশেও হাঙ্গামা হয়েই চলেছে। সাঁতারা ঝাঁসি বেরিলিতে রাজারা বিদ্রোহ করেছে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে। আর্ল চিন্তিত, মহারাণী ভিক্টোরিয়া যদি ব্যবস্থা না নেন কি করে সে সামলাবে একা হাতে। আর্ল আর যাইহোক নিষ্টুর নয় হিউস্টন রোজভিলারদের মতো। সে চায় শান্তি থাকুক ভারতবর্ষে। জয় হোক মহারানীর।
— আমি দু:খিত প্রিয়তমা তোমাকে নিয়ে এলাম এমন সুন্দর সন্ধ্যা, দিনগুলি কাটাবো বলে এখানে! কিন্তু এখানকার ব্যারাকে নেটিভদের আর জেনারেলরা সামলাতেই পারছে না প্রায়! আমি নিরুপায়!
— কলকাতার লাট হাউসে আমার দম বন্ধ লাগে প্রিয়তম! এত নিয়ম কানুন মানামানি, রাজা মহারাজা ব্রিটিশ অফিসারদের ভিড় আমার ভালো লাগে না। যেদিকে যাই, সেদিকেই পাহারা।
— হা হা হা, তুমি যে বড়লাটের স্ত্রী! লেডী ক্যানিং!
— সেই যে কি যেন উপহার দিল আমায় মিষ্টিটা! কি সুস্বাদু খেতে!
— লেডী কেনি! আর্ল এসে জড়িয়ে ধরলেন শার্লটকে। ঠোঁটে ঠোঁট দিলেন। মুহূর্তের জন্যই, তারপর ফিরে গেলেন তার লাইব্রেরি ঘরের টেবিলে।
শার্লট এসে বসলেন নদীছোঁয়া ছড়ানো বারান্দার প্রিয় কেদারাটিতে। কি সুন্দর দিন গুলো ছিল বাকিংহাম প্যালেসে। রাণী ভিক্টোরিয়ার কাছের আর কাজের মানুষ ছিল সে।
— শার্ল, প্রিয় কন্যা আমার, তোমার বিবাহ স্থির হয়েছে। স্বয়ং মহারাণীর মতামতেই, রাজদরবারের কমন্সের রাজনীতিবিদ!
— পিতা, আমি যদি সারাজীবন রানীর সেবা করে যাই শুধু!
— স্বয়ং মহারাণী তোমার বিবাহ ঠিক করেছেন কন্যা! না বলা অসম্মান করা হবে তাঁকে।
শার্ল ভালোবাসত তার আর্ট কলেজের ফরাসী শিল্পী দুপ্লেকে! কিন্তু মহারানীর পছন্দের পাত্রকে না করার সাধ্য কার! বাবা ছিলেন ফ্রান্সে ইংলন্ডের রাষ্ট্রদূত তারা সবাই ফ্রান্সে কাটিয়েছে বহু বছর। সেখানেই প্যারীর লুভ্যর মিউজিয়ামে দেখা হয়েছিল ডুপ্লেরসাথে। শার্লট আঁকতো নিজের মনে আর ডুপ্লে ওর পোট্রেট! এই অসম সম্পর্কে রক্ষণশীল সমাজের আগেই ছুরি বসালো, ইংলন্ড আর ফ্রান্সের তীব্র রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আর যুদ্ধ। আর শার্লটের বাবা, প্যারিস ছেড়ে ফিরলেন ইংল্যন্ডে। সে হারালো তার দুপ্লেকে, প্রিয় নদী সেইন কেও। জল, জলরঙ দুইই মুছে গেল শার্লটের জীবন থেকে।
— পিতা আমি প্রস্তুত বিবাহের জন্য কিন্তু আমাকে মহারাণীর পার্শ্বচারিকার পদ থেকে ইস্তফা দিতে বললে এ বিবাহ সম্ভব নয়।
— এ আর এমন কি! ভুলে যেওয়া না, তোমার হবু স্বামীও রাণীর মন্ত্রীসভার সম্মানিত সদস্য। মহারাণীর সেবক।
আর্ল কানিং প্রেমময় সুভদ্র হলেও কাজপাগল পুরুষ, রাজপুরুষ বলে কথা, ইয়র্কশায়ারে তাদের বিরাট বড় এস্টেট রয়েছে। প্রথমে ইংল্যন্ড পরে ভারতে গভর্ণর জেনারেল হয়ে চলে এলেন। শেইনের পর টেমসকেও ছাড়তে হলো কিন্তু সন্তান সম্ভবা শার্ল ভীষণ খুশী ছিল। দুর্ভাগ্য শার্লটের, ভারতে আসার আগেই তার সন্তান ভূমিষ্ট হবার আগেই চলে গেল পৃথিবী থেকে। শার্লট কুঁকড়ে গেলো দু:খে শোকে ভয়ে! ভারতে এসে লাট বাড়িতে ভিড়ের আর নিয়মের শেকলের মধ্যে দম আটকে এলেও, এই বাগান বাড়িতে সে ধীরে ধীরে জীবন ফিরে পাচ্ছিল যেন! তার আর একটি কারন ব্যারাকের বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাহী অর্জুন শিবালকর!
অর্জুন বেঙ্গল ব্যারাকের সেপাহী হলেও লাটসাহেব এলে তার তার ঘোড়ার পাশে বা চার ঘোড়া জুড়িগাড়ির সামনে কোচবক্সে তাকে বসতে হয়। শার্লট গাড়িতে উঠতে গিয়ে পাথরে কোঁদা ঘন কালো চোখের মণি আর ভ্রমর কৃষ্ণ চুলের মানুষ দেখল, পেছন থেকে তার ডুপ্লে বলে ভুল হলো…
অর্জুন চোখ তুলতে পারলে না, তবুও মেঘ রঙা চোখ আর রাজহাঁসের মত ধবধবে মরাল গ্রীবা ওলা, বাদামী চুলের নারীকে দেখে এই প্রথম বড় বিস্মিত হলো। গাড়িতে ওঠার সময় যে নিজেই নিঃসংকোচে হাত বাড়িয়ে দেয় সাহায্যের জন্য। সে একটা কথা বুঝেছে মেমসাহেব বড় একা, ঘোড়ানিয়ে নিজেই গঙ্গার ধার পেরিয়ে আরো দূরের গ্রামের দিকে চলে যেতে চায়। একা একা ভাবেন, আঁকেন, চুপ করে বসে থাকেন। কিন্তু পরিস্থিতি খারাপ, অর্জুনের হুকুম নেই চোখের আড়াল করার। তাই সে প্রাণপনে তার ঘোড়াও ছোটায় মেমসাহেবের পাশে। মেমসাহেব যেন চোখ দিয়ে সব মেপে নেন বাড়ী ফিরে রঙ তুলি ধরেন। মেমসাহেব ব্যস্ত থাকলেই সে লুকিয়ে বাঁশিটা বার করে বাজাতে থাকে।
— তুমি এতো ভালো বাজাও কি করে!
ভয়ে অর্জুনের কথা বন্ধ হয়ে গেল। কি আশ্চর্য সুন্দর মোমের তৈরি মুখ ! চোখ দেখলে ঘোর লেগে যায়। নিঃশ্বাস আটকে গেল।
শার্লট মন্ত্রমুগ্ধের মত বসে থাকল পাশে। অর্জুনের চোখ, মায়াবী টান, কোঁকড়া চুল তাকে বারবার সেইন নদীর কাছের দিন গুলি মনে পরিয়ে দিচ্ছে।
আর্ল তার স্বামী,তার কত সম্মানের জায়গা, কিন্তু প্রেম কই! প্রেম! কি শূন্য তার জীবন! সন্তান টিকেও খুইয়ে এলেন।
অর্জুন বিস্মিত হয়ে দেখলেন লেডী কানিং কাঁদছেন। নীল চোখ ছাপিয়ে জল বেয়ে পড়ছে।
— মেমসাহেব, বাড়ি চলুন, সন্ধ্যা হয়ে আসছে। সাহেব ফিরবেন।
— আর এক্টু বসি, উনি এসে আবার লাইব্রেরীতে কাজ করবেন। তোমার গল্প বলো!
— আমি! আমার গল্প!
— তোমার বাড়ি কোথায় আরজুন
— অনেক দূরে সেই বেরিলিতে!
— বাড়ি যেতে ইচ্ছা করেনা?
অর্জুন চুপ করে রইল! জেনারেল হিউম সাহেবের চাবুকের কথা মনে পড়ে গেল তার!
— যবে থেকে ব্যারাকে এসেছি বাড়ির মুখ দেখিনি মেমসাহেব! সামান্য টাকা বেতন তাই পাঠাতে পারি!
— শার্লট অতি কষ্টে জানতে চাইল, তোমার স্ত্রী নেই? তার যেন মনে হচ্ছিল না থাকলেই ভালো। কেন এমন হচ্ছে তার!
— অর্জুন মাথা নিচু করে থাকল। কোনমতে মাথা লাড়ল। নেই!
শার্লট শ্বাস ছাড়লো গভীরে।
বাঁশি শুনে অনেক দেরী করে শার্লট বাড়ি ফিরলে। এসে দেখলে তার স্বামী কাজে গভীর ভাবে মগ্ন! সুন্দর ভাবে ভারতবর্ষ চালালে ইংলন্ডে ফিরে লর্ড উপাধিতো বাঁধা!
শার্লটের মন জুড়ে তখন অখ্যাত অনামী ব্যারাকের এক সামান্য সেপাহী।
— আমাকে তরবারি চালাতে শিখিয়ে দাও আর্জুন
— অর্জুন পড়ল মহাবিপদে, এই ভারি ধারালো তরবারি নরম হাতে ধরবেন কি করে মেমসাহেব! তার উপরে লাটসাহেব নেই, ফিরে গেছেন কলিও২২কাতার লাট ভবনে। মেমসাহেবকে দেখার দায়িত্বতো তাদেরই!
— তুমি কেন সিপাহীর জীবন বেছে নিলে! তুমি তো।শিল্পী! এই যুদ্ধ, রক্তপাত তোমার ভালোলাগে!
— আমরা বীর ছত্রপতি শাহু শিবাজীর বংশধর! যুদ্ধে আমরা ভয় পাবো কেন!
আর্জুর কাছে সেদিন শিবাজীরাজের গল্প শুনতে শুনতে সন্ধ্যা নেমে এলো। শার্লট ঘন হয়ে এলেন। ফেরার সময় এক ঘোড়াতেই উঠলেন দুজনে। মেমসাহেবের ঘোড়া একা একা পাশে চললো। সিন্থিয়া লেডী কানিং এর পার্শ্বচরী, মেমসাহেবের এই পরিবর্তন তার চোখ এড়ালো না। এই সেই নারী, ব্যাকিংহাম প্যালেসের দরবার কক্ষের দুই লক্ষ আলোর ঝাড়বাতির থেকেও যিনি উজ্জ্বল হয়ে মহারানীর পাশে থাকতেন! ডিউক অফ এডেনবার্গের স্নেহধন্যা কন্যা। রাজকীয় কেতা দুরস্ততায় যার কোনো ভুল ত্রুটি কেউ ধরতে পারে নি! তিনি আজ এক অতি সামান্য ধুলোর মত এক সিপাহীর সাথে সময় কাটাচ্ছেন।
হাজারহোক তারা বিদেশী প্রভু, নেটিভরা তাদের বিশ্বাস করবে কেন! চারিদিকে উতপ্ত হাওয়া চলছে, দিল্লী, সাঁতারা ঝাঁসি রায়বেরিলি সব জ্বলছে৷ মহারাষ্ট্রে এ আগুন প্রায় ছুঁই ছুঁই! সিন্থিয়ার ভ্রু কুঞ্চিত হলো।
—লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিউসন আপনার সাথে দেখা করতে চান লর্ড!
— আসতে বলো
— মাই লর্ড! বেঙ্গল ব্যারাকের অবস্থা খুব খারাপ। বেঙ্গল রেজিমেন্ট আর মারাঠা রেজিমেন্ট কাজ করতে চাইছে না তারা অন্য সিপাহীদের খেপিয়ে তুলছে।
— তারা কারা? লক্ষ্য রাখুন! শুনুন জেনারেল হিউসন এখন মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। এত সামান্য সংখ্যা সেপাহী দিয়ে পুরো বিদ্রোহ থামানো যাবে কি করে! ইংলন্ড এত কাছের রাস্তা নয়! আমাদের প্রচুর সেনার প্রয়োজন। প্রয়োজনে আমাদের দেশীয় রাজাদের সাহায্য নিতে হবে!
জেনারেল হিউসন মাথা নিচু করে থাকলেন। উত্তর দিলেন গর্ভণর জেনারেলের সচিব হিউম
— মাই লর্ড, লর্ড ডালাহৌসি যে সব রাজ্যের দত্তক পুত্রদের উত্তরাধিকার বাতিল করেছেন তারা শুধু নয়, অন্য রাজারাও মেনে নিতে পারেনি তার এই নির্দেশ! মাই লর্ড ভারতবর্ষের ইতিহাসে দত্তক পুত্র বরাবর বৈধ! শুধু সিপাহি নয়, প্রজারা এমনকি যারা আমাদের হাতের মুঠোয় ছিল, তারাও বেরিয়ে যাচ্ছে মুঠো ছেড়ে!
হিউম অধৈর্য হলো! নেটিভ দের সে সহ্য করতে পারে না। ব্যারাকের সৈন্যদের বিদ্রোহ কড়া ভাবে দমন করতে হবে! আপনি হুকুম দিন, দরকারে তোপের মুখে উড়িয়ে দেব!
লর্ড কানিং বিস্মিত হলেন, তার কিছু বলার আগেই হিউম বলে উঠল, শূকরের চর্বির টোটা এদেশে আনা হলো কেন! এনফিল্ড রাইফেল ছাড়া কি উপায় ছিল না আর!
— মহাসচিব হিউম! আপনি কি এবার যুদ্ধ, যুদ্ধ নীতি, অস্ত্র এই সব নিয়ে ভাববেন! আপনি সম্ভব হলে রাজাদের সামলান! ভাবুন তাদের কি করে ব্রিটিশ রাজের হাতে করবেন আবার!
— সংযত হোন আপনারা! জেনারেল হিউসন, মনে রাখবেন ব্যারাকে হিন্দু মুসলিম দুই সেনার সংখ্যা বেশী ব্রিটিশ সৈন্যর চেয়ে! সাহায্য আসার আগে পর্যন্ত আপনাকে ধৈর্য ধরতেই হবে।
অনেক দূরে তখন ব্যারাকের থেকে বেরিয়ে দুই বন্ধু বেড়াচ্ছিল ঘাটে।
— তুই এখন বড়লাঠের ডিউটি করিস শিবালকর! তাই ভেতরের কথা কিছুই জানিস না, বেঙ্গল রেজিমেন্ট জ্বলছে। শয়তানের বাচ্ছা হিউম এনফিল্ড রাইফেলে ভরার জন্য শূকরের চর্বির টোটা এনেছে।
–;সেকি! এতো হারাম! মুসলমান সিপাহীরা কিছুতেই মানবে না!
— আমরাও কি মানব! রোটি সব্জি খাওয়া হিন্দু ব্রাক্ষ্মণ আমরা, মা ভবানীর ভক্ত! বাঙালী সিপাহীরাও উপায় খুঁজছে! কালাপানি পেরোলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় তাদের ধর্মে! এর আগে আমরা কালাপানিও পেরিয়ে এসেছি! আর কতো! জানিস দলিত সেপাহিরা আমাদের জাত গেছে বলে রটিয়ে দিয়েছে গ্রামে!
— উপায় কি!
— পুড়িয়ে দেব সব! সব কটাকে কুঁচিয়ে দিতে হবে। শোন, নানা সাহেব তাঁতিয়া টোপী ফিরছে আবার! হিন্দু রাজ্য হবে এবার। তোর একটা কাজ আছে কিন্তু!
— কি কাজ বল?
— লাট সাহেবের কুঠিতে আগুন লাগানো! পুড়িয়ে দিতে হবে তোকে!
শিবালকর স্তব্ধ হয়ে গেল! শার্লট! তার মেমসাহেব!
সে জানে তার মেমসাহেব মা হচ্ছে আবার। তার প্রথম বাচ্ছা পৃথিবীর আলো দেখতে পায়নি! না না, সে কক্ষোনো এমন করতে পারবেই না! মেমসাহেব তার কাছে দেবী! মঙ্গলের ডাকে তার সম্বিত ফিরলো।
— শোন, যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। ব্যারাকের বিদ্রোহের দিন ই এই কুঠিতে আগুন জ্বলবে! আসল জায়গায় আঘাত করলে সব ঠান্ডা! ইংলন্ড থেকে সেনা নিয়ে আসার আগেই যা করার করতে হবে। পরশু দিন নানা সাহেবের দিল্লী পৌছানোর কথা। আজিজুল্লা খান বুড়ো মুঘল বাদশাহের মুখপাত্র হয়েছে। এখন বাদশা বাহাদুর শাহ, মুসলমানদের একমাত্র আশা।
শিবালকর চুপ করে থাকল! মেমসাহেবকে যেমন করে হোক আগেই বড়লাট হাউসে পাঠিয়ে দিতে হবে। প্রাণ থাকতে সে ক্ষতি হতে দেবে না! সে জানে, একটি শিশুর প্রাণ তার মধ্যে!
সেই রাতেই সিপাহী ব্যারাকের লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিউসন আর কর্ণেল চার্লস রাটফ্লে কথা বলছিলেন। নিশুত রাতের এই সাক্ষাৎকার স্বয়ং বড়লাট ও জানেন না। জেনারেল হিউসন ক্রুর দুরাভিসন্ধি সম্পন্ন মানুষ। অন্ধ নেটিভ বিদ্বেসী! চারিদিকে চর ছড়িয়ে রেখেছে সিপাহীদের মধ্যে। যারা ওপরে দেখাচ্ছে বিদ্রোহী সিপাহী,কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারাই ইংরেজদের পদলেহী চাকর! এতদিনে হিউসন বুঝেগেছে ভারতে সৈন্য পরিচালনা করতে গেলে ডিভাইড আন্ড রুল ভালো বুদ্ধি সবচেয়ে। এদেশে মীরজাফরের অভাব কই! উত্তেজিত হয়ে পদচারণা করছিলেন লেফটেন্যান্ট পাশে চার্লস তাকে লক্ষ্য করছিলেন একমনে। দুজনেই একমত, লর্ড আর্ল কানিং যে ভাবে চলছেন সেখানে সিপাহী বিদ্রোহকে খতম করা অসম্ভব! নেটিভ দের হাতে দেশ তুলে দিয়ে পালাতে হবে!
— কি ঠিক করলেন তাহলে! চার্লস বলল!
— আমার কাছে খবর আছে অনেক! বেঙ্গল ব্যারাকের সিপাহী মঙ্গল পান্ডে সবাইকে জমায়েত করছে। দিল্লী আসছেন নানা সাহেব! দিল্লী রেজিমেন্ট হাতে অস্ত্র তুললেই, বেঙ্গল ব্যারাকে আগুন জ্বলবে। লক্ষ্ণো মমহারাষ্ট্র, ঝাঁসি সিতারা জৌনপুর জ্বলছে। রেঙ্গুন থেকে সিপাহী রওনা দিয়েছে তবুও বসে থাকলে চলবে না আমাদের!
— মঙ্গল পান্ডে! জেনারেল গডফ্রেকে একবার বলুন না, গডফ্রে ওকে ভালো করে চেনে!
— উপায় নেই! কেন্টের কারখানার কারট্রিজ ওরা দেখে নিয়েছে! গডফ্রের হাতে নেই! আর খবরদার! গডফ্রে এইসব নেড়িভদের মাথায় তুলেছে! ওকে এড়িয়ে যান যেমন করে!
লেফটেন্যান্ট এর দরজায় টোকা পড়তেই দুজনের হাতই পিস্তলে চলে গেল।
হুজুর, আমি নানাসুকা!
— এতো রাতে!
— হুঁজুর, খবর এমন মারাত্মক না দিলে হবে না, শুধু তাই নয়, এরা আমাকে সন্দেহ করছে!
— কি খবর নানাশুকা!
— আজ্ঞে, যে দশজন সিপাহী বড়লাটের দেহরক্ষী করে পাঠিয়েছিলেন,
— হ্যাঁ তো,
— আজ্ঞে তার মধ্যে অর্জুন শিবাল কর মঙ্গল পান্ডের কথামতো কুঠি বাড়িতে আগুন জ্বালাবার পরিকল্পনা করেছে!
— সেকি! দুজনেই চমকে গেলেন!
— কবে! কোথায়! হিউসন চেঁচিয়ে উঠতেই চার্লস ইশারা করলো চুপ করতে!
— ঘোড়া প্রস্তুত রাখো, আজ ভোরেই আমি বেরিয়ে যাব ব্যারাকপুর কুঠিতে। হিজ ম্যাজেস্টিকে এখন কিছু জানানোর প্রয়োজন নেই।
— হুঁজুর উনি নেই! মেমসাহেব একাই আছেন।
— হিউসন বলল, এই সুযোগ, গভর্ণর এলেই, সব চাপা দিতে বলবেন! আজ রাতেই খতম করতে হবে!
শিবালকর কুঠির আস্তাবলের পাশের ঘরে শুয়ে ছিল। সারারাত তারমনেও ঘুম নেই! সেই সেদিনের দুর্বল মুহূর্তের নীল নির্জনতা, ঘনিষ্ট স্পর্শ, চরম আকাঙখা, তাকে বিহবল করে রেখেছে সেই দিনটি থেকেই। অতি কাছের মুহূর্তে সে কতো আপন! কতো !
ঠক ঠক করে খুব মৃদু একটা আওয়াজ পেলো সে দরজায়। ছোট্ট ঘরটায় তেমন জানলাও নেই! মুঠিতে তরোয়াল নিয়ে সে দরজা খুলেই সামান্য আলোতে শানিত ছোরা দেখতে পেলো।
— নানাসুকা!
মুখ তুলতেই দেখল ঘোড়ার উপর বসে হিউসন সাহেব।কিছু বোঝার আগেই, রক্তে ভেসে গেল অর্জুন শিবালকার!
নি:শব্দে ফিরে গেল হিউসন আর নানাসুকা। আগুনে পুড়ল সেই ঘর!
— ডাক্তার সাহেব কেমন বুঝলেন!
— ডা: হারবার মাথা নাড়লেন। ভালো না! সদ্য অন্ত:স্বত্তা হয়েছেন। নিতান্তই ভ্রুণ অবস্থা, এত দুর্বল! আপনি ইংলন্ডে বরং ফেরাবার ব্যবস্থা করুন লর্ড!
— দেখি! অনেকবার বলেছি কিন্তু রাজী হচ্ছেই না শার্লট, এখানেই ওর সন্তান হবে! জিদ ধরে বসে আছে। সেই যে কুঠি বাড়িতে আগুন লাগার দিন অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল, তার থেকে থেকে থেকেই জ্ঞান হারায় শুধু আতঙ্কে।
তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। বিদ্রোহী সিপাহীদের রক্ত স্রোতে ভেসেছে ভারতবর্ষ। ইংলন্ডেশ্বরী হলেন ভারতের ভাগ্য বিধাতা। মুছলো মুঘল, হিন্দু মারাঠা মঙ্গল পান্ডের মতো অসংখ্য নির্ভীক সৈনিক। লর্ড কানিং গর্ভণর জেনারেল থেকে ভাইসরয় হয়েছেন। রাণী খুশি ইয়র্কশায়ারে এস্টেট দিয়েছেন উপহার। দেশেও তিনি ব্যারন, আর শার্লট কানিং ব্যারনেস!
আর্ল কানিং কাল জাহাজে উঠবেন। ফিরবেন তার প্রিয় মাতৃভূমিতে স সম্মানে! তার এখানের কাজ শেষ। মহারানী ভিক্টোরিয়া তার কাজে খুব সন্তুষ্ট। আসছেন এবার লর্ড মেয়ো।
সিন্থিয়ার কোলে খেলা করছে আর্ল আর শার্লটের পুত্র সন্তান, হ্যারী আর্ল কানিং। পেছন থেকে পুত্রের নিস্পাপ মুখশ্রী, মাথা ভর্তি কালো কোঁকড়ানো চুল অনিমেষ নয়নে দেখছেন আর্ল! তিনি কই খুশী! সম্পূর্ণ ভগ্ন হৃদয় নিয়ে তাকে দেশে ফিরতে হচ্ছে। তার আদরের প্রিয়তমা পত্নী সন্তানকে জন্ম দেবার সাময় মারা যান।
— মাই লর্ড, লেডী শার্লটের অনেক আঁকা এই ঘরেও আছে। আর্দালি মাথা নিচু করলো!
— খুব সাবধানে নিয়ে এসো। সব ছবি বেঁধে নাও, থাকবে তার প্রাসাদের নিজের ঘরটিতে।
আর্দালি সমস্ত ছবি বার করছিল এক এক করে। হঠাৎ আর্লের একটি ছবিতে চোখ পড়ে যেতেই–
–রাখো রাখো তো ফ্রেম টা– ছবিটা দেখেই বিস্ময়ে স্তব্ধ গেলেন তিনি!
নদীর দিকে মুখ করে ঘনিষ্ট ভাবে বসা নারী ও পুরুষ। নারীটির মুখের আদলটি তার বড় চেনা, মাথায় ভর্তি বাদামী সোনালী চুল, আর পুরুষটির মাথায় একরাশ কোঁকড়ানো কালো চুল—