নারীর নিজের মুক্তির জন্য, নিজের স্বাধীনতার জন্য নিজের উপর নিজেকে আস্থা রাখতে হবে, লড়াইটা নিজেকেই করতে হবে। নারীবাদ বলি কী নারী স্বাধীনতা বা নারী মুক্তি- অর্জন না করলে পাওয়া যাবে না। নরওয়ে নারী-পুরুষের সমতার জন্য একটি পারফেক্ট দেশ বলা চলে। তারপরও এই দেশেও তেমন নারীর সাক্ষাৎ মেলে যে নিজে ডাক্তার হয়েও ডাক্তার স্বামীর ভয়ে তটস্ত থাকে।স্বামী শুধু স্যান্ডউইচ দিয়ে লাঞ্চ করতে চায় না বলে স্ত্রীকে সাথে স্যুপও বানাতে হয়। আর এই স্যুপ বানানোটা ভালোবেসে বানানো না রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে বানানো। এর জন্য নিজের অফিসিয়াল কাজ শেষ কোথাও বসে দু’দণ্ড জিরায় না, পাছে বাসার কাজে দেরী হয়ে যায়। অথচ নরওয়ের সমাজে স্বামী-স্ত্রী সপ্তাহের দিনগুলো ভাগাভাগি করে রান্নাসহ ঘরের যাবতীয় কাজ করার নিয়ম। দেখা যাচ্ছে, আইন থাকলেও সব নারী তা যথাযথ নিতে পারছে না। এমন শিক্ষিত নারীকে কে নারী-স্বাধীনতা এনে দেবে বা তার কাছে নারী স্বাধীনতা বা নারীমুক্তির সংজ্ঞা কী কে জানে! ’ইরাবতীর কথা’ ধারাবাহিকে ইরাবতীকে নারীর অনেক না বলতে পারা কথায় ও রূপে সাজিয়েছেন বিতস্তা ঘোষাল আজ থাকছে ইরাবতীর কথা ধারাবাহিকটির শেষ পর্ব।
হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পর প্রায় মাস খানেক বাড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল ইরাবতীর গতিবিধি। যদিও সে সম্পূর্ণ রূপেই এখন সুস্থ তবু প্রান্তি আর বেদভ্যাস এই ক’দিন অন্য জায়গায় যাওয়ার প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।আর একটি কারন নীলের গোপনসূত্রে পাওয়া খবর, যাতে বলা হয়েছে তার উপর আবার হামলা হতে পারে। সবমিলিয়ে বাড়িতে ইরাবতী। এ’কদিন তার মনে হচ্ছিল এইভাবে থাকার চেয়ে মরে গেলেই ভালো হত।প্রান্তি হবার সময় শেষ বারের মতো সে এতদিন বাড়ি ছিল। বাড়ি মানেই তার কাছে জেলখানা। দিনরাত একই কাজের পুনরাবৃত্তিতে সে মানসিকভাবেও ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল।
অবশেষে বাইরে যাবার অনুমতি পেল সে। কাল রাতে হোয়াটস আপে একটা অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেয়ে নীলকে জানিয়ে বেরোল।
অডিটোরিয়ামে নির্ধারিত সময়ের বেশ কিছুটা আগেই পৌঁছে গেল সে। মঞ্চের উপরটা সাজানো হচ্ছে। সে চারপাশে চোখ বোলালো। অজস্র নামী মুখের ভিড়।টিভির পর্দায়, সংবাদপত্রে সর্বত্র এদের দেখা যায় নিয়মিত। কিন্তু আমন্ত্রণ কর্তার মুখটা চোখে পরল না।এমনকি কোনো পরিচিত মুখও নেই।
সে আবার চারদিক তাকিয়ে একটা সিটে বসল।তখনি হন্তদন্ত হয়ে মন্ত্রী অনন্ত বাবু ঢুকলেন। তিনি হলের চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে মঞ্চের উপরের ঘোষককে ইশারা করতেই শুরু হয়ে গেল সম্মান জ্ঞাপন অনুষ্ঠান। ঘোষক এক এক করে সকলকে ডেকে নিয়ে মন্ত্রীকেও ডাকলেন।
অত্যন্ত দ্রুত গতিতে তিনি ডায়াসে উঠে সকলের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করলেন। ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা হাসি। ঘোষক তাঁকে কিছু বলার অনুরোধ করলে খুবই সংক্ষিপ্ত একটা বক্তব্য রাখলেন।
তারপর পিছনের সারিতে গিয়ে দাঁড়ালেন।
বিরক্তিকর একটা চূড়ান্ত অসংগঠিত পরিকল্পনাহীন অনুষ্ঠান।সে মন্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছিল, ভদ্রলোক ভীষণ বিরক্ত। সে এতদিনে যতটুকু চিনেছে তাকে, কাজের বিষয়ে ভীষণ খুঁতখুঁতে একটা মানুষ সে। সব সময় লক্ষ রাখেন যত অল্পই কাজ হোক না কেন তাতে যেন কোনো ফাঁকি না থাকে।এই মুহূর্তে সে রেগে যাচ্ছে এটা এতদূর থেকেও অনুমান করতে পারলো ইরাবতী। ঠোঁটগুলো অনাবশ্যক ভাবেই বেঁকে যাচ্ছিল, আর তাতে একচিলতে হাসি ধরে রাখার চেষ্টা।তবু নিয়ম মেনে মঞ্চে দাঁড়িয়ে একবার এদিকে একবার ওদিকে তাকাচ্ছিল সে।
আরো কিছুক্ষণ দেখে বাইরে বেরিয়ে এল ইরাবতী। শীত যাই যাই। অথচ একটা হালকা আমেজ।বসন্ত আসছে।শহরে বসন্ত কী আসে? পলাশ, শিমুলের দেখা মেলা ভার।এই চত্বরে অনেকগুলো ছাতিম গাছ ছিল।কিন্তু এখন সেগুলো কেটে কংক্রিটের জঙ্গল।
গায়ের চাদরটা জড়িয়ে নিয়ে সে সামনের দিকে এলোমেলো হাঁটল কিছুটা। মন্ত্রীকে বলে আসা হয় নি।একবার ভাবলো ফিরে গিয়ে বলে আসবে, পরমুহূর্তে একটা এস এম এস করে দিল।
দু’পা অন্তর জোড়ায় জোড়ায় বসে।বিশেষ করে যেদিকগুলোতে আলো কম ।প্রথম প্রথম অসয়স্তি হতো এসব দৃশ্যে। আবার কখনো মনে হত, সে নিজে যা করতে পারেনি কখনো, তা অন্যরা স্বাধীন ভাবে করতে পারছে, হোক পরিবারকে লুকিয়ে, তবু তো বহুর মাঝে, এর একটা অন্য উত্তেজনা আছে। এমন এক জীবনের স্বাদ থেকে সে বঞ্চিত।
সে একটু দূরে দেখল,তার পরিচিত একটি মেয়ে তার পুরুষ বন্ধুটির কোলের মধ্যে ।দুজনের ঠোঁট যেন একসঙ্গে শুষে নিচ্ছে যাবতীয় উষ্ণতা।
তার শরীরে খানিক শিরশিরানি জেগে উঠল। সেদিক থেকে তাড়াতাড়ি চোখ ঘুরিয়ে নিল।
কত বছর হয়ে গেছে এই একা জীবন। অথচ কখনো কখনো শরীরও জল চায়, ঘাম চায়, স্পর্শ চায়। চাইলেই সেও পেতে পারে এমন সুখ।
সুযোগ ও আহ্বান যে আসে না তাতো নয়। তবু কোথায় যেন একটা বোধ কাজ করে।ভালোবেসে যে কামনা জাগে, সেই একই অনুভূতি কী শুধু শরীরে আসে! এই জায়গাতেই সে আটকে যায়। অথচ. . . ।
সবার জন্য সবকিছু নয় ইরাবতী।নিজের মনে বিড়বিড় করল ।
এই মুহূর্তে তার মাথায় ঐহিক, মন্ত্রী অনন্ত, নীল, প্রান্তি, কেউ নেই। সে নিজেকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করতে চাইল। তার মনে হল আসলে জীবন ভীষণ সুন্দর। সে এতদিন তার রূপ রস গন্ধ অনুভব করতে পারেনি। এবার থেকে সে সব কিছুর বাইরে গিয়ে শুধু নিজের জন্য বাঁচবে। বাঁচার মধ্যই খুঁজে নেবে জীবনের অপূর্ন ভালোবাসার রসদ।
এসব ভাবতে ভাবতেই আরো খানিকক্ষণ এদিক ওদিক এলোমেলো হাঁটার পর এক কাপ চা খেয়ে চত্বর থেকে বেরিয়ে এল এক আনন্দময় ভালবাসাময় জীবনের খোঁজে।
বিতস্তা ঘোষালের এই ধারাবাহিকটির আগের পর্বগুলো ও অন্যান্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন।
কবি,কথাসাহিত্যিক,সম্পাদক ও প্রকাশক