আধুনিক যুগের জন্ম কাহিনি (পর্ব -১)। হোমেন বরগোহাঞি
লেখক পরিচিতি-
১৯৩২ সনে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’,‘বিভিন্ন নরক’,‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১২ মে ২০২১ সনে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়।
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ‐– বাসুদেব দাস
১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের কথা। ভারতে তখনও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন চলছে। অর্থাৎ ইংরেজ সরকার তখন পর্যন্ত ভারতের শাসনভার আনুষ্ঠানিকভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে নিজের হাতে নেয়নি। কিন্তু ভারতের শাসনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না হলেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজকর্মের ওপরে ইংরেজ সরকারকে সব সময় নজর রাখতে হয় কারণ তার সঙ্গে সমগ্র ইংরেজ জাতির স্বার্থ জড়িত রয়েছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হল মূলত একটি ব্যাবসায়িক কোম্পানি। কিন্তু ইংল্যান্ডে ইতিমধ্যে শিল্প বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার ফলে সেখানে যে নতুন শিল্পপতি শ্রেণির উত্থান ঘটল, তারা সেই দেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত হল। তাদের চোখের সামনে ভারতে এক নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে গেল। তারা ভারতকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য মাত্র একটি বাজার বলে না ভেবে একটি স্থায়ী উপনিবেশ রূপে কল্পনা করতে আরম্ভ করল। প্রধানত তাদের প্রভাবে পড়েই ইংরেজ সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজকর্মে আগের চেয়ে বেশি করে হস্তক্ষেপ করতে আরম্ভ করল। ভারতের প্রতি ইংরেজ সরকারের এই পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গির ফল স্বরূপ ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সংসদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে এই বলে নির্দেশ দিল যে ভারতের শিক্ষা বিস্তারের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বছরে এক লক্ষ টাকা খরচ করতে হবে।
শিক্ষা বলতে আমরা আধুনিক অর্থে যা বুঝি সেই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থার কোনো অস্তিত্ব তখন ভারতে ছিল না। সমাজের মুষ্টিমেয় শ্রেণির লোকের জন্য কেবল জায়গায় জায়গায় সংস্কৃত এবং ফার্শি শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। তাই যখন ভারতীয়দের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য বছরে এক লক্ষ টাকা খরচ করার প্রস্তাব উঠল, তখন স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া হল যে এই টাকা প্রথমত খরচ করা হবে সংস্কৃত এবং ফার্সি শিক্ষার জন্য। এই বিষয়ে আলোচনা চলতে থাকা থাকীন রাজা রামমোহন রায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে একটি চিঠি লিখে এই বলে দাবি করলেন যে শিক্ষার জন্য প্রস্তাবিত এই সমুদায় ধন খরচ করতে হবে ভারতীয়দের গণিত, প্রাকৃতিক দর্শন, রসায়ন, শরীরবিদ্যা এবং অন্যান্য ব্যবহারিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য।সংস্কৃত শিক্ষার জন্য কখনও নয় ।
রাজা রামমোহন রায়কে ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত এবং আধুনিক ভারতের জন্মদাতা বলে বলা হয়। কেন তাকে তা বলা হয় সে কথা বোঝার জন্য বেশিদূর যেতে হবে না।ওপরে উল্লেখ করা কথাটার তাৎপর্য অনুধাবন করার চেষ্টা করলেই সে কথা অতি সহজেই বোঝা যায়। এই কথা ঠিক যে সংস্কৃত একটি অতি প্রাচীন এবং সমৃদ্ধিশালী ভাষা; সংস্কৃত ভাষা এবং সাহিত্য বহু যুগ ধরে ভারতের সভ্যতা- সংস্কৃতিকে নিজের বুকে ধারণ করে আসছে। কিন্তু প্রায় তিনশো বছর আগে ইউরোপে আরম্ভ হওয়া যে আধুনিক ভাব বিপ্লব মানব সভ্যতার ইতিহাসে নতুন যুগের সূচনা করেছে তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য সংস্কৃত শিক্ষা ভারতীয়দের কোনো সহায় করতে পারে না। ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অনেক ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতা গড়ে উঠেছে। এই প্রতিটি সভ্যতার উৎকৃষ্ট ফসলগুলি সমগ্র মানবজাতির সম্পত্তি। বাতাস যেভাবে কোনো ভৌগোলিক বা রাষ্ট্রীয় সীমান্ত মানে না, চারপাশে প্রবাহিত হয় এবং প্রাণীকুলের প্রাণ রক্ষা করে, ঠিক সেভাবে মানুষের সভ্যতার সংস্কৃতিও কোনো ভৌগোলিক বা রাষ্ট্রীয় সীমান্ত না মেনে নিজে নিজেই চারপাশে বিচ্ছুরিত হয়ে সমস্ত মানুষকে নিজের সুফল বিতরণ করে। বিশ্ব নাগরিক রামমোহন রায় এই কথা ভালোভাবে জানতেন যে আধুনিক সভ্যতার পীঠস্থান হল ইউরোপ। ইউরোপে যে নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনা চলছে সেই জ্ঞান- বিজ্ঞান মানব সভ্যতার ইতিহাসে যুগান্তর এনেছে। মানুষ যে পৃথিবী এবং যে জীবনধারাকে বহু হাজার বছর ধরে চিনতে পেরেছিল, সেই পৃথিবী এবং সেই জীবনধারাকে ইউরোপের নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞান মাত্র ৩০০ বছরের ভেতরে চিনতে না পারার মতো পরিবর্তিত করে ফেলেছে। এখন পৃথিবীর সমস্ত দেশের মানুষকে এই ইউরোপীয় জ্ঞান সাধনার সমস্ত সুফল আত্মসাৎ করে উন্নতির পথে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতে হবে। তা যে বা যারা করবে না, তারা বন্দি হয়ে থাকবে সভ্যতার পরিত্যক্ত ডোবায়। সেই জন্য যে মুহূর্তে ভারতে শিক্ষা বিস্তারের জন্য বছরে এক লাখ টাকা খরচ করার প্রস্তাব উঠল, সেই মুহূর্তে সেই সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ ভারতীয় দাবি করলেন:‘ আমাদের কেবল সংস্কৃতি শিক্ষা চাই না; আমাদের চাই গণিত, রসায়ন, শরীরবিদ্যা প্রাকৃতিক দর্শন।‘
সেই মুহূর্তে ভারত ও আধুনিক যুগে প্রবেশ করল।

অনুবাদক