কাঠগড়ায় জিউস
এক
এই ভীড় ভাট্টায় প্রতিমার খুব কাছাকাছি যাওয়া খুব কঠিন একটা ব্যাপার। তারপর যদি সঙ্গে থাকে ছয় বছর বয়সি পুচকে পুত্র অরুণ। এত মানার করার পরেও সে গো ধরেছে। মা দুর্গাকে সে নিজ চোখে দেখবে। কিন্তু এক মাইল পথ হেটে এসে মাকে দেখতে আসা এত সহজ কাজ নয়। এই খবরটি রাখেন অরুণের পিতা বরুণ। অর্থাৎ সিদ্ধিরগঞ্জের বরুণ কুন্ডু। আর এখন করোনার সময়। খুব সাবধানে পা ফেলতে হয়। তারপরও আবার পূজা মন্ডমে হাজার রকম মানুষের মেলা। কেউ নাকে মাস্ক বেঁধে এসেছে আবার কারো নাকে মুখ কিছুই নেই। কেন নেই কে জানে? হয়তো তাদের মৃত্যুর ভয় নেই। অথবা এই নিয়ে কোন গা করে না। ভাইরাসটাকে দেখা যায় না। তাই অদেখা শক্তিতে বিশ্বাস নেই মানুষের। কিন্তু মা দুর্গার প্রতি সেই বিশ্বাস সবার আছে। মা আছেন বলেই এই বিশ্ব এখনো টিকে আছে। করোনাকে এই পৃথিবীতে লেলিয়ে দেওয়ার পেছনেও যে অশুরের একটা হাত আছে সে বিষয়েও নিশ্চিত বরুণ। তবে করোনাকে যে মা দুর্গাই তাঁর কঠিন হাতে একদিন ঠিক বসে নিয়ে আসবে সে বিষয়েও বরুণের স্থির বিশ্বার রয়েছে। রাণীগঞ্জ বাজারের সার্বজনিন শারদীয় দূর্গামন্ডপ এই অঞ্চলে বিখ্যাত। দূর দুরান্ত থেকে এখানে লোক আসে মা দূর্গাকে এক নজর দেখতে এবং তাঁকে পূজো দিতে। পূজাকে কেন্দ্র করে এখানে তখন চারদিকে সাজ সাজ উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। হিন্দু মুসলমান সবাই সেইসব উৎসবে অংশ নেয়। মা দূর্গাকে প্রণাম করে এই উৎসবে আসতে কার না সাধ জাগে?
বরুণ কুন্ডুর বয়স চল্লিশ এর কাছাকাছি। দারিদ্রের অতিরিক্ত বোঝায় তার শরীর এখন নুয়ে পরেছে। কিন্তু মনটা এখনো বেশ সজীব। চুলে এই বয়সেই পাক ধরেছে। মুখটা চাঁদের মত গোলগাল আর চোখেমুখে কোথায় যেন একটা বিস্ময় তার লেগেই থাকে। এখনও সে বিশ্বাস করে “পৃথিবীতে ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি। অতএব ধৈর্য হারা হলে চলবে না। এই পৃথিবী থেকে অত্যাচার আর সব জ্বালা যন্ত্রনা একদিন বিদায় নিবেই।
“বাবা, এই কি দেবতা?” অরুণ দূর থেকে মা দুর্গাকে দেখতে পেয়ে ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে বলে।
” হ্যারে, এইতো মা দুর্গা। প্রণাম কর বাবা।”
অরুণ বাবার কথায় সায় দিয়ে দু হাত বুকের কাছে এনে মাথাটা একটু নীচু করে প্রণাম করে।
বাবা!
বল
মা দূর্গা কত সুন্দর তাই না? কত ফর্সা!
হুম।
কিন্তু দ্যাখো মানুষগুলো কিন্তু মোটেও সুন্দর না।
কে বলেছে তোকে? শুধু গায়ের রং ফর্সা হলেই বুঝি মানুষ সুন্দর হয়?
তাহলে?
অন্তরটা সুন্দর হতে হবে। অন্তর সুন্দর হলেই মানুষটা সুন্দর।
সত্যি? তাহলে অন্তর সুন্দর কীভাবে হয় বাবা?
এই ধর, জগৎের সব প্রাণীদের ভালোবাসতে হবে, মানুষকে ভালোবাসতে হবে, সৃষ্টিকে ভালোবাসতে হবে। তাহলেই মানুষ সুন্দর হবে।
বাবার এত কঠিন কথা ছয় বছরের শিশুর আত্মা ধারণ করতে না পেরে সে তাৎক্ষনিক আবার প্রশ্ন করলো
তাহলে তুমি কি সুন্দর বাবা?
অবশ্যই। আমি সুন্দর, তুই সুন্দর, তোর মা সুন্দর। আমরা সবাই সুন্দর।
তাহলে আমরা সবাই দেবতা?
নারে আমরা দেবতা হতে যাবো কেন? আমরা মানুষ। তবে মানুষও দেবতা হতে পারে। দেখবি তুইও একদিন বড় হয়ে দেবতা হয়ে যাবি।
সত্যি?
সত্যি।
এবার অরুণ একটু চুপ হয়ে মুর্তি দেখতে শুরু করে।
বাবা এবার অরুণকে আদর করে আরেকটু কাছে টেনে নিয়ে আসে। খুব মোলায়েম ভাবে প্রশ্ন করে তার ছেলেকে।
”কিরে অরুণ কি অত হা করে দেখছিস?”
বাবা দেবতাকে দেখছি।
”হুম, মনে রাখিস একটা কথা। দেবতা শুধু দেখলেই হয় না। নিজে দেবতা হতে হয়।” কি মনে থাকবে তোর কথাটা?
হ্যা, বাবা মনে থাকবে। আমিই বড় হয়ে দেবতা হব।
হুম, দেবতা হতে হলে অনেক ভালো কাজ করতে হবে। পারবি সেই কাজগুলো করতে?
পারবো। এই বলে অরুণ তার বাবার পেটে মাথা ঘষে।
বাবা, এই যে দ্যাখো কি সুন্দর একটা সিংহ! মা দুর্গা সিংহের পিঠে চড়ে বসেছে!
”কি বলছিস অরুণ! এতো সাধারণ কোন সিংহ নয়! এত দেবতা!
সিংহও দেবতা?
হুম। সিংহের আত্মায় আছে বিষ্ণু, শিব তাদের আত্মা! প্রত্যেক মানুষের ভেতরই একটা পশু বাস করে আছে বুঝলি! সেই পশুভাব কাটিয়ে উঠতে হয়। তাহলেইতো জীবন স্বার্থক! কি কিছুই বুজলি না?
আচ্ছা ঠিক আছে । তোকে এখনই এত কঠিন কথা বুঝতে হবে না। চল পূজো থেকে কিছু নারকেল এর নাড়ু কিনে খাই।
সত্যি?
অবশ্যই। চল আমার সঙ্গে।
পূজা মন্ডপের কিছু দুরেই রয়েছে শীতলক্ষ্যা নদী। সেই নদীর পাড়ে বড় একটি বট গাছ। বটগাছেকে ঘিরে হাজার রকমের মানুষের ভীড় সেখানে। কমলা রঙ এর কাপড় পড়ে সেখানে এক জটাধারী বাউল আপনমনে গান গাইছে। বরুণ তার ছেলের জন্যে আর তার নিজের জন্যে কিছু নারকেল এর নাড়ু কিনে বটগাছটার নীচে একটু জায়গা করে গিয়ে বসলো।
বাউলের চোখ তখন বন্ধ। বাম হাত তার আসমানে আর ডান হাত উচিয়ে সে ধরে আছে তার একতারা। তার কন্ঠ থেকে ভেসে আসছে এক মোহময় সংগীত।
” মানুষ ধরো মানুষ ভজো
শোন বলিরে পাগল মন ।
মানুষের ভিতরে মানুষ
করিতেছে বিরাজন ।
মানুষ ধরো…
মানুষ কি আর এমনি বটে
যার চরণে জগত ওঠে
এইনা পঞ্চভূতের ঘটে
হেরিতেছেন নিরাঞ্জন।
চৈদ্দ তালার উপরে দালান
তার ভিতরে ফুলের বাগান ।
বরুণ চোখ বুজে গা দুলিয়ে কন্ঠ মেলাচ্ছে বউলের সঙ্গে। অরুণ বাবার এই মগ্নতাকে অবাক হয়ে দেখে আর নাড়ু খেতে ব্যাস্ত হয়ে পরে।
দুই
মহাপ্রভু জিউস তার প্যান্থিওন প্রাসাদে মুখ গোমরা করে বসে আছেন। ইদানিং কি যেন একটা হয়েছে তার। কোন কিছুতেই মন নেই। এমনকি স্ত্রী হেরার প্রতিও তার কোন আগ্রহ নেই। চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে সে এখন্ ক্লান্ত।মেজাজটাও সারাক্ষণ খিটিমিটি হয়ে থাকে। শুধু মনে হয় অতিতের শত শত কুকাজের কথা। আহা! দেবি আলমিন, ক্যালিস্টো সবার কথাই মনে পড়ছে। ক্যালিস্টোকে ঘুমন্ত অবস্থায় ধর্ষণর ঘটনা মনে হলে এখনো জিউস উত্তেজিত হয়ে উঠে। আহা! কত খাসা ছিল সেই সোনালি দিনগুলো? আবার যদি ফিরে পাওয়া যেত? কিন্তু যত সব ঝামেলা লাগিয়েছে এই পৃথিবীর মানুষের দল। সিসিফাসের কাঁধে পাথরের বোঝা চাপিয়ে শাস্তি দিয়েছি, প্রমিথিউসকে ঈগল প্রতিদিন ছিড়ে ফেড়ে খাচ্ছে অথচ পৃথিবীর মানুষগুলো এখনো কি সুন্দর ভালো আছে? তারা তাদের নিজেদের দেবতাদের নিয়ে বেশ আরামেই আছে? এসব ভাবতে ভাবতেই জিউসের হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে আসে। চোখ দিয়ে তখন তার তখন আগুন বেড় হয়্। চিৎকার দিয়ে বলে উঠে, “ তাহলে কি মানুষের জয় হবে? আমার এত শক্তি। এই পুচকে বেজন্মা মানুষের কাছে আমি হেরে যাব? প্রমিথিউসের জয় হবে? না না। তার আগে আমার যেন মরণ হয়। “
জিউস নিজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেন। ধুপ ধাপ শব্দ করে প্যান্থিওন রাজপ্রাসাদের এ মাথা ও মাথা চক্কর দিতে শুরু করেন।
এদিকে ঠোঁটে লরিয়েল কোম্পানীর লাল টকটকে লিপস্টিক লাগাতে লাগাতে রাজ প্রাসাদে প্রবেশ করলেন স্ত্রী হেরা। এক নজর হেরাকে দেখে জিউজের পিত্তি যেন আরো জ্বলে উঠল। মনে মনে শুধু বললো
“বুড়ো মাগিটার ঢং দেখ? এক পা কবরে আর সেকিনা ঠোট লাল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে!”
জিউসের কাছাকাছি এসে হেরা পাশের শেত পাথরের চেয়ারে বসে জিঞ্জেষ করল।
“হাগো! আপনি আমাকে দেখতে পেয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলছিলেন।কি বলছিলেন ডারলিং? শুনতে পাবো?”
“বলছিলাম তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে।” জিউস ছাদের দিকে তাকিয়ে হেয়ালি মিশিয়ে বললো কথাটা।
কিন্তু হেরা তার স্বামীকে খুব ভালো করেই চেনে। জিউসের আত্মায় যে কিছু একটা অঘটন ঘটেছে সে তা ঠিক বুঝতে পারছে। কিন্তু কি সেই ঘটনা?
“আচ্ছা জাহাপনা জিউস, আপনার কি হয়েছে বলুনতো? গত কয়েক দিন ধরে দেখতে পাচ্ছি আপনি ঠিক সময় মত ঘুমাতে পারছেন না। নাওয়া খাওয়ায় মন নেই। আমাকেও আর তেমন সময় দেন না। হয়েছেটা কী আপনার?
জিউস দুহাতে একটা পিংপং বল শূণ্যে ছুড়তে ছুড়তে জবাব দিলেন,
হেরা, তোমাদের শান্তি দেখে আমার খুব হিংসা হয়। তোমরা কত আরাম করে ঘুমাও আর আমি কিনা দিনরাত সজাগ থাকি। চিন্তায় চিন্তায় অস্থির?” জিউসের কন্ঠে ক্রোধ আর অভিমানও।
কেন আপনার এত চিন্তা? আপনি হলেন মহাপ্রভু। সব কিছু চলে আপনার অঙুলি নির্দেশে। আপনি যা চান তাই হয়। আপনার কথার কেউ অবাধ্য হলে তাদের কপালে জোটে কঠিন শাস্তি। সিসিফাস দিনরাত পাথর টেনে পাহাড় উঠায়, প্রমিথিউসকে সারা দিন হিংস্র ঈগল এসে ঠুকরে ঠুকরে খায়। সবাই আপনার ভয়ে তটস্থ। তাহলে আপনার আত্মায় কিসের ভয়? আপনি কেন ভয় পাচ্ছেন?
এবার জিউস যেন একটু নরম হলেন। ধীরে ধীরে স্ত্রী হেরার পাশের খালি চেয়ারটা টেনে বসলেন।
“তোমরা কি বুঝতে পারছো পৃথিবীতে কি ঘটনা ঘটছে? এই কিছুক্ষণ আগে খবর পেলাম সেখানে দুর্গা পুজো হচ্ছে। এই দেখ, ছবিটা দেখ। শীতলক্ষা নদীর পাড়ে রাণীগঞ্জ বাজারে বটগাছের নীচের কত শত মানুষের ঢল! সেখানে এক বাউল গান গাইছে। ”মানুষ ধর মানুষ ভোজ…। যত্তসব! এত কিছুর পরও সেখানে মানুষের বন্দনা? আমার নাম কয়জন নয় হেরা? কয়জন এই মহাশক্তি প্রভুকে স্মরণ করে? কয়জন?
হেরা জিউসের অলৌকিক আয়না দিয়ে পৃথিবীতে চোখ রাখলেন। তিনি দেখতে পেলেন জিউসের কথা সত্য। সেখানে মানুষের জয় জয়কার। পুজোয় মানুষ দেবীকে প্রণাম করছে, কেউ প্রাসাদ বিতরণ করছে, অরুণ বরুণ নামে বাপ বেটা কত সুন্দর করে নারকেলের লাড়ু খাচ্ছে আর বাউলেরর গান শুনছে।
কি দেখলে হেরা? বল কথা সত্য?
হুম কথা সত্য মহাপ্রভু।
তাহলে এখন আমার কি করা উচিৎ?
হুম কিন্তু কেউ যদি আপনাকে না মানে, আপনার উদ্দেশ্যে কেউ যদি কোন গান না বাধে তাহলে আপনি কি তা জোড় করে করাতে পারবেন? আমার মনে হয় আপনি বরং মানুষের সাথেই একটা চুক্তিতে চলে আসুন। তাদের অধিকারকে ফিরিয়ে দিন। তাদেরকে স্বাধীনভাবে কথা বলতে দিন। তাদেরকে তাদের মত করেই থাকতে দিন।
চোপ! এবার জিউস খেকিয়ে উঠলেন। আমার সঙ্গে থেকে থেকে এই তোমার শিক্ষা? এই তোমার রুচি? আমি ভাবতেও পারছি না। যাও এক্ষুনি হেফাস্টাসকে ডেকে পাঠাও। দেবী এথিনাকেও চাই। আমি পৃথিবীর মানুষদের এক হাত দেখে ছাড়বো।
হেরা মন খারাপ করে গট গট শব্দ করে বেড়িয়ে গেলেন।
তিন
এই বোশেখ মাসেও চৈত্রের গরম পরেছে। মহাপ্রভু জিউস তার সখের গোলাপের বাগানে একটা ফুল নাকের সামনে দোলাতে দোলাতে পরিকল্পনাটা আটেন। সামনেই মাথা নীচু করে দাড়িয়ে আছেন জ্ঞানের দেবি এথিনা এবং ষান্ডা মার্কা পুত্র হেসাস্টাস। হেফাস্টাসের মগজ বলে কিছু নেই। কাকে ধরতে হবে কাকে মারতে হবে, কাকে উঠিয়ে নিয়ে আসতে এসব কাজে সে উস্তাদ। তবে ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে হেফাস্টাসের মত লোকও খুব প্রয়োজন। এই মারধর না থাকলে কি আর সমাজ টেকে? কিন্তু এথিনা বিচক্ষণ। তিনি জ্ঞানের দেবী। মানুষের মগজে ঢুকে সে নানা রকম কূট ষড়যন্ত্রের জাল তৈরি করেন। কোথায় কোন সময়ে কোন টোপ দিতে হবে তা এথিনা ছাড়া আর কে ভালো বুঝবে? জিউস মনে মনে এই দুই ক্ষমতাধর দেবতার শক্তিগুলো মনে মনে কষে নিলেন।
তারপর আধা বোজা চোখটা ধিরে ধিরে খুললেন।
”হেফাস্টাস”।
জি আব্বাহুজুর। হুকুম দেন।
শুন, কাজে নেমে পর। পৃথিবীতে ছদ্ধবেশে চলে যাও। দ্রুত কাজগুলো শেষ করতে হবে। প্রথমে সোজা চলে যাবা রাণীগঞ্জ বাজারে। সেখানে মানুষজন দুর্গা পুজায় ব্যাস্ত। পূজা মন্ডপটা ভাঙবা। কি পারবা তো?
আব্বাহুজুর, এই সামান্য কাজতো আমি চোখের পলকেই করবো। আর কি করতে হবে?
তারপর দেখবা সেখানে একটা বটগাছের নীচে এক বাউল গান গায়। মানুষের গান। তার গলা কাটবা।
কি পারবা তো?
কি যে বলেন আব্বা হুজুর! খুব সামান্য ব্যাপার। আর কি করতে হবে?
তারপর সেখানে বটগাছের নীচে বরুণ অরুণ নামের বাপপুত দুজনে মিলে মনের সুখে নারকেলের নাড়ু খাচ্ছে। দুটোকে নদীতে চুবিয়ে মারবা। কি পারবা তো?
জি হুজুর। কোন ব্যাপার না। আমার উপর ভরসা রাখেন। আমি তাহলে যাই।
না এখনই না। এথিনা আর তুমি একাসাথে যাবা। পৃথিবীতে এখন করোনা ভাইরাস। সাবধান। নাকেমুখে মাস্ক বাধবা।
এথিনা।
জি মহাপ্রভু।
তুমি কি করবা?
আপনি যেমন হুকুম দিবেন।
আচ্ছা। তুমি পুরুষদের মগজে একটা বাসা বানেয় বস। নারী দেখলেই যাতে তাদের জিভে জল আসে তেমন একটা ইচ্ছা তুমি পুরুষদের আত্মায় জাগিয়ে তোল। তারপর নারী অপহরণ, খুন ধর্ষন এসব বাড়িয়ে দাও। দেখি মানুষ কীভাবে শান্তিতে থাকে।
কি পারবা না এথিনা?
জি হুজুর। পারবো। এই নিয়ে আপনি কোন চিন্তাই করবেন না।
গুড গার্ল। নাউ এই খামটা রাখ। কোন সমস্যা হলে ম্যাসেঞ্জারে কল দিয়ো।
এথিনা মোটা একটা খাম জিউসের হাতে থেকে নিয়ে বিদায় নিলেন। পেছন পেছন মোটা কুতকুতে হেফাস্টাসও এথিনাকে অনুসরণ করলো।
চার
গোটা বাংলাদেশে এখন অশান্তির ঢেউ। মানুষ মানুষকে খুন করছে। ভাই ভাইকে মারছে। এই সেদিনও পুলিশ প্রকাশ্য দিবালোকে সেনাবাহিনীর এক অফিসারকে গুলি করে মেরে ফেলেছে, মেয়েরা রাস্তায় দিয়ে হাটতে পারছে না, কট্টর মওলানারা ওয়াজ করে নারীকে দুটুকরো করার হুমকি দিচ্ছে, সেদিন নোয়াখালির এক গৃহবধুকে তার স্বামীকে বেঁধে রেখে অমানবিক নির্যাতন করেছে। সেটি আবার ফেসবুকে ভি্ডিও করে ভাইরাল হয়েছে। এই অমানুষ গুলো কত না কান্ডই না করছে। অথচ সেদিনও মানুষগুলো কত সুন্দর ছিল। তাদের আত্মায় সবসময় প্রমিথিউসের বাণী বাস করতো। হঠাৎ কি থেকে যেন কি হয়ে গেল! জেলায় জেলায় ধর্ষকদের সংখ্যা বাড়ছে। ধর্মীয় গোড়ামী বাড়ছে। মানবতার পতন হচ্ছে। বাংলাদেশের সাধারণ শান্তিকামী মানুষ এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ফুসে উঠেছে। শাহবাগে এই নিয়ে জনতার ঢল নেমেছে।
এথেনা আর হেফাস্টাস দুজনেই তখন ছদ্মবেশে শাহবাগ মোড়ে পাবলিক লাইব্রেরির সিঁড়িতে বসে চিনেবাদাম চিবুতে চিবুতে মানুষের এই প্রতিবাদ দেখছিল।
কি হেফাস্টাস! কি মনে হয়? ধর্ষকদের সংখ্যা কি বাড়ছে?
সে আর বলতে! আপনার মগজের তারিফ করতে হয়। কীভাবে পুরুষের মস্তিষ্কে বাসা বাধলেন!
তারিফতো আপনার কাজেও করতে হয়। কীভাবে রাণীগঞ্জের বাজারের পূজা মন্ডপ ভেঙে চোখের সামনে গুড়িয়ে দিলেন! আর বাপপুতকে পানিতে ডুবিয়ে মারলেন!
সবই মহাপ্রভু জিউসের ইচ্ছা। হেফাস্টাস চোথদুটো কুতকুতে করে বললেন।
মহাপ্রভু জিউসের জয়। বাদাম চিবুতে চিবুতে বললেন দেবী এথিনা।
ততক্ষণে শাহবাগের গোল চক্কর থেকে চিকন কালো ফ্রেমের চশমা পড়া এক যুবকের কন্ঠ থেকে মাইকে একটি আওয়াজ ভেসে আসছিল।
“এই স্বৈরাচারি জিউসের পতন চাই। জিউসের শাষন আমরা মানি না। বাংলার শান্তিকামী মানুষ জিউসের হাতকে একদিন গুড়িয়ে দিবেই। ধর্ষককের শাস্তি মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হোক। মানুষের বাক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা হোক। কুক্ষাত ৫৭ ধারা বাতিল হোক, অন্যাযের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ ঘুরে দাঁড়াবেই। বাংলার মাটি হিন্দু মুসলমানদের আত্মার মাটি। এই মাটিতে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য হাজার বছরের ইতিহাস। এই ঐক্য এখন ষড়যন্ত্রের শিকার। আমরা এই ষড়যন্ত্র মানি না । জিউসকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবেই।”
জনতার ভীড় ঠেলে হেফাস্টাস আর এথিনা দুজনেই বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে শাহবাগ ত্যাগ করা বুদ্ধিমানের কাজ মনে করল। তাছাড়া খুব ভোরে হেফাস্টাস আরো কিছু ভয়ংকর কাজে লিপ্ত হয়ে যাবে। তাই আগে ভাগেই নীল নকশা তৈরি করতে হবে। এথিনাও তার নতুন এসাইনমেন্ট নিয়ে মহা ব্যাস্ত। হাজার বছরের বাঙালির ঐতিহ্যকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে এই জাতিকে ধর্ষক জাতি হিসেবে পৃথিবীতে পরিচয় করে দিতে সে এখন বদ্ধ পরিকর । অ্যাপল নোট পেডে ত্বরিৎ সে আগামীকালকের কর্ম পরিকল্পনাগুলো টুকে নিতে ব্যাস্ত হয়ে গেল।
পাঁচ
আজ ভোরটা খুব সুন্দর। এক চিলতে কচি কলাপাতার মত সবুজ রোদ প্যান্থিওন দরবারে এসে হুমরি খেয়ে পরেছে। সেই রোদটুকু কোলে নিয়ে মহাপ্রভু জিউস হেলেদুলে তার প্রাসাদে প্রবেশ করলেন। তার বাম হাতে আইফোন আর ডান হাতে একটা ম্যাকিন্টোস আপেল। মেজাজ মর্জি ভালো থাকলে জিউসকে অন্যরকম দেখায়। কিছু না ভেবেই টিবিলে রাখা একটা দৈনিক পত্রিকা হাতে নিলেন। সেখানে কয়েকটা খবরের উপর তার চোখ আটকে গেল।
দৈনিক আলোক দিশারি লিখেছে, “একদল উচ্ছৃঙ্খল যুবক রাণীগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী পূজামন্ডপটি ভেঙে মাটির সঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে। মন্ডপের পাশেই শীতলক্ষা নদীতে বরুণ আর অরুণ নামের পিতাপুত্রের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
দৈনিকি চিচিংফাক লিখেছে, “বাংলাদেশে ধর্ষকদের সংখ্যা বাড়ছে। ধর্ষকদের সর্বচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড আহ্বান জানিয়ে শাহবাগে উত্তাল অন্দোলন শুরু হয়েছে।”
দৈনিক সময়ের দাবী বলেছে, “গোটা বাংলাদেশ জিউস বিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করেছে। জিউসকে খুব শিগগীরই কাঠগড়ায় দাড়াতে হবে বলে উপস্থিত জনতা রায় ঘোষনা করেছে।”
জিউস তখন চোখ বুজে টসটসে আপেলে কামড় দিতে ব্যাস্ত। কারণ সে ভালো করেই জানে যতদিন পর্যন্ত আকাশে মেঘের গর্জন শুনা যাবে, যতদিন পর্যন্ত আকাশে বিদ্যুৎ চমকাবে ততদিন পর্যন্ত জিউসের গায়ে টোকা দেওয়ার শক্তি কারো নেই। অতএব নো চিন্তা…। কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। এই শান্তি।
শান্তি শান্তি শান্তি।
পত্রিকার প্রথম পাতায় খবর প্রকাশ হল।
“রাণীগঞ্জ বাজারেরর পুজা পন্ডপটি একদল উচ্ছৃখল মোল্লারা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে। শীতলক্ষ্যা নদীতে আজ সকালে।
লেখক এবং প্রাবন্ধিক। জন্ম ঢাকা, বাংলাদেশ। পড়াশুনা করেছেন বাংলাদেশ এবং উত্তর আমেরিকায়। উত্তর আমেরিকা থেকে ফাইনান্স এর উপর এমবিএ করেছেন। নিউইয়র্ক মুক্তধারা বইমেলা, নিউইয়র্ক ফিল্ম সেন্টার, নিউইয়র্ক সাহিত্য একাডেমিসহ নিউইয়র্ক ভিত্তিক বিভিন্ন শিল্প-সাহিত্য সংগঠনের সঙ্গে তিনি জড়িত। পেশায় আর্থনৈতিক বিশ্লেষক এবং আইটি পরামর্শক হিসেবে কাজ করলেও নেশা তাঁর লেখালেখি। ইতিহাস তাঁর প্রিয় এবং প্রধান একটি বিষয়। ভারত উপমহাদেশতো বটেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের বৈচিত্রপূর্ণ জীবন, ঐতিহাসিক রাজনৈতিক এবং সামাজিক ঘটনাবলীর উপর তাঁর রয়েছে গভীর আগ্রহ। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রš’গুলো গ্রন্থগুলো হল্: শিপ জাম্পারঃ বাঙালির আমেরিকা যাত্রা(মুক্তধারা, নিউইয়র্ক, ২০২০), অ্যাকুরিয়ামের মাছ ও হলুদ প্রজাপতির গল্প(মাওলা ব্রাদার্স, ২০১৯), চেনা অচেনা শহীদ কাদরী (মাওলা ব্রাদার্স, ২০১৮), ঔপনিবেশিক ভারতে বিলাতি নারীরা (ইত্যাদি গ্রš’প্রকাশ, ২০১৭), পূর্ব-পশ্চিমের আলো (প্রিয়মুখ, ২০১৬),আমেরিকানামা (সূচীপত্র, ২০১৫), জানা-অজানা রবার্ট ক্লাইভ (সূচীপত্র, ২০১৪) । নেশা ভ্রমণ, সিনেমা দেখা এবং বই পড়া। মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মানবতায় তিনি বিশ্বাসী।