| 27 জানুয়ারি 2025
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক উপন্যাস: অগ্নিশিখা (পর্ব-১) ।  দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

ব্রিজের  মধ্য দিয়ে এখন একটা ট্রেন যাচ্ছে। এখন ভোরবেলা। এ সময় রোজ ট্রেনটার সঙ্গে অনন্তদেবের দেখা হয়। যাওয়া পর্যন্ত তিনি তাকিয়ে থাকেন। ভারি চমৎকার দৃশ্য। ভোরের আলোয় ব্রিজটাকে কেমন একটা অপার্থিব মনে হয়।

অনন্তদেব এ  অঞ্চলের প্রধান পুরোহিত। রোজ ভোরে গঙ্গাস্নান করেন।তার আগে তিনি ভোরের ফুটে ওঠা দ্যাখেন। তাঁর মনে হয় ভোর আসলে এ পৃথিবীর কেউ নয়। সে  অব্যক্ত কিছু ইশারা ফুটিয়ে চলে যায়। তারপর পৃথিবী আবার  সাধারণ হয়ে যায়।

আজও গঙ্গার ধারে তিনি  সময়মতো এলেন। সঙ্গে কল্যাণ। এ সময়  হিরন্ময়ীও  উঠে পড়েন।   তিনি কিছুক্ষণ দরজায় দাঁড়ান। তিনি দরজায় দাঁড়িয়ে  ‘দুর্গা দুর্গা উচ্চারণ করেন।

ট্রেনটা চলে গেল। কিছুক্ষণ  গঙ্গার দিকে তিনি চেয়ে রইলেন। বৈশাখ   শেষ হতে চলেছে। একটু পরেই  চারপাশ  তেতে  উঠবে।  এখনও তার আভাস আসে নি। ভোর  চিরকাল অন্যরকম। স্নিগ্ধ, সুন্দর, মালিন্যহীন।

 স্নান সেরে   যাবেন  শিবমন্দিরে। সেখানে পূজো করবেন। ভক্তদের সঙ্গে গল্প করবেন। সেসব অবশ্য দেরী আছে।

বয়ে আনা শুকনো পোষাক  রেখে কল্যাণ চলে গেল।  তাঁর তিন ছেলে। মন্মথ, ব্রজবিলাস  ও কল্যাণ। মন্মথের  বিয়ে হয়ে গেছে। ও এখানে থাকে না। বিয়ের পর  শ্বশুরবাড়িতেই উঠেছে। মন্মথ খারাপ ছেলে নয় ঠিকই, কিন্তু  খুব তাড়াতাড়ি ও  হাতের বাইরে চলে গেছে। মাঝে মাঝে  আসে।  সম্পত্তির হালহদিস নেয়। বাড়ি থেকে চলে যাবার পর ওর মনে হয়েছে বাবা তাকে কিছু দেবেন না।

তাঁর সম্পত্তি কিছু না থাকলেও  খারাপ নেই। গ্রামের দিকে বেশ কিছুটা জমি কেনা আছে। চাষবাস হয়। সেখান থেকে  সম্বৎসর চলে যাবার পর কিছুটা বাঁচে। মন্মথও তার ভাগ নিয়ে যায়।  মন্দির থেকেও সামান্য মাসোহারা পান।

মেজ ছেলে ব্রজ । তাকে নিয়েই অনন্তদেব একটু বেশী  ভাবনাচিন্তা করেন। প্রথম থেকেই  তাকে  বেশী পছন্দ করেন। মন্মথও ওইজন্যই ভাবে সে সম্পত্তি ঠিকঠাক পাবে না।  তবে ওর দোষ নেই । ব্রজের  উপর কেন জানেন না তাঁর  পক্ষপাত খুব।  ব্রজ ছোট  থেকেই মেধাবী  বুদ্ধিমান,সব ভাল তার। যে কোন বিষয় সে মুহুর্তে মুখস্ত করতে পারে। হয়ত ও  অন্যান্যদের মতই। তবু   প্রথম থেকে ওর উপর দুর্বলতার   একটা কারণ  ব্রজ ছোটবেলায় দু-বার মরে যেতে বসেছিল। একবার জন্মের সময়, পরে তিন বছর বয়সে। মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছিল । তাই বোধহয় ওকে একটু বেশি স্নেহ, একটু অতিরিক্ত নজর রাখেন। যদিও ব্রজর এখন কুড়ি বছর বয়স। শরীর স্বাস্থ্য খুবই মজবুত। খেলাধুলা, গঙ্গায় সাঁতার কাটা থেকে সব কিছুতে সে অতিরিক্ত পারদর্শী। এখন থেকেই তিনি খেয়াল করেছেন ওর নেতৃত্ব গুণ আছে।

কিন্তু  ব্রজ পড়াশুনা নিয়ে  তিনি চিন্তায়  পড়েছিলেন। ও পড়াশুনো ঠিকঠাক করছে না। বিষয়টা নিয়ে তার অধ্যাপক বন্ধু পান্নালালের সঙ্গে কথা  হয়েছিল।

পান্নালাল এখানকার সন্তান। পড়াশুনা করার পর কলকাতার   কোন  এক কলেজে যোগ দিয়েছে।  কিন্তু যোগাযোগ রয়ে গেছে তার। চিঠিচাপাঠি চলে। পান্নালালকে বলার পর সে জানিয়েছিল, ছেলেকে তার কাছে পাঠিয়ে দিতে। ওর বয়সী ছেলে তারও। সুতরাং দুজনের পড়তে অসুবিধা হবে না।

 অনন্তদেব প্রস্তাবটি পেয়ে উল্লসিত হয়েছিলেন। এমন বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের কথা। পান্নালাল দায়িত্ব নেওয়া মানে ব্রজের উন্নতি তিনি চোখের সামনে দেখতে পেয়েছিলেন। ওকে নিয়ে তাঁর গোপন আশা সে অধ্যাপক হবে। তাঁর মনে হয়েছিল সে আশা  পূরণ হবে। কারণ পান্নালাল আছে। সে গাইড করবে। ব্রজকে পাঠিয়ে দিয়ে তিনি বারবার  পান্নালালকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। ব্রজ এখন ওর বাড়িতেই রয়েছে। এর মধ্যে কলকাতার কোনও কলেজে  সে ভর্তি হবে।

অনন্তদেব  ধীরে ধীরে জলে নামলেন।  ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে চারপাশ। যেগুলি আবছা ছিল তা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। রোজ-ই তাই হয়। অথচ তা দেখতে একঘেয়ে লাগে না। নদী- তীর বরাবর ফাঁকা জায়গা। অনেকদূরে জুটমিল,রংকল  রয়েছে। নদীর ওপারে মিল আসার পর  এপারেও তা এসেছে। সবকিছুই   স্পষ্ট হচ্ছে। তাঁর মনে পড়ে গেল পরিমলের  কথা। আজকে সে বিকেলে আসবে।

পরিমল   একটা বড় পোষ্টে চাকরী করে। কিন্তু কি একটা খেয়ালে সে চারপাশের  ইতিহাস লেখার জন্য তাড়িত হয়েছে। তিনি  শুনে অবাক হয়েছিলেন। খুশীও  হয়েছিলেন। এইসব ছোট    ছোট জনপদে অনেক কাহিনী আছে। সে যদি তার ইতিহাস লেখে  খুবই ভাল।তিনি মাথা নেড়েছিলেন।

পরিমল বলেছিল ‘হ্যা। ঠাকুরমশাই।আমি চেষ্টা করছি।‘

সে  সময় পেলে  আসে। তিনি ওর কথা শুনে চমকিত হন। এ তো আর গল্প কথা নয়। এদিকওদিক অনেকজনের সঙ্গে পরিমল কথা বলছে, পুরোন বইপত্র ঘাঁটছে। লাইব্রেরী যাচ্ছে। তিনি খুশী হন।  চাকরী করে  সময় বার করে এ কাজ করা খুব কঠিন। সে  তার কাছ থেকেও কিছু খবর নিয়েছে। তিনি বলেছিলেন ‘ আমি কি জানব ?পরিমল?’

‘সে কি! আপনি জানবেন না? আপনার চোখের সামনেই তো ব্রিজ হয়েছে।‘

 তা ঠিক।এখন ১৯২৫ সাল। আজ থেকে  চল্লিশ বছর আগে তাঁর চোখের সামনেই হুগলী নদীর উপরে  ব্রিজ হয়েছিল। তখন তিনি কুড়ি-একুশ বছরের যুবক। মহারাণী ভিক্টোরিয়ার পঞ্চাশ বছর  পুর্তি উপলক্ষে  নাম দেওয়া হয় জুবিলী ব্রিজ। সেসময় ব্রিজ হওয়া নিয়ে খুব হইচই হয়েছিল।  ব্রিজটা কোথা দিয়ে হবে তাই নিয়ে  লোকসমাজে  আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। কিন্তু শেষমেষ এখানে  দিব্যি হয়েছিল। তারা তখন বন্ধুরা কয়েকজন মিলে  ব্রিজ দেখতে যেতেন।  থামের উপর    বিশাল বিশাল  তিনটে সারি। সেগুলি  এক একটা দেখতে  অনেকটা আধখানা চাঁদের মতো। চারদিক ঘিরে রেখে তখন কাজ হত। সামনে যাওয়া নিষেধ ছিল। পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। তারমধ্যেই ব্রিজটা একদিন  তৈরী হয়ে গেল।

প্রথম যেদিন ট্রেন যাওয়ার কথা সেদিন লোকজন ভিড় করেছিল। একটা সময় ট্রেন সম্পর্কে ভয় ছিল মানুশের। পরে  ভয়ের বদলে এল   বিষ্ময়। সেই প্রথম উত্তেজনার দিন তিনিও  সাক্ষী। এখনও   সেই আনন্দের রেশ বইছেন।

ট্রেন চলে যাবার পরেই অনন্তদেব দেখলেন চারদিকে আলো ভরে উঠছে। আবছা ভাব কেটে যাচ্ছে।  নৌকা চলতে শুরু করছে।  একটু পরেই  ঘাট পারাপার শুরু হবে।  কিছু লোক  ওপারে  যাবার জন্য চলে এসেছে ঘাটে।, গঙ্গায় স্নান করার জন্য আরো দু একজন পৌঁচেছে। বয়স্ক লোকরা তাকে দেখে নমস্কার করে।

 স্থানীয় মানুষরা যে কোন ঝঞ্ঝাটে তাঁর কাছে আসে। তিনি যতটা পারেন সাহায্য করেন।এটা  পারিবারিক শিক্ষা থেকে পেয়েছেন। তাঁর পিতাও  এ কাজ করতেন। পাড়া প্রতিবেশীর সঙ্গে তাঁর সদ্ভাব ছিল। তবে এটাও ঠিক আগের মতো সবকিছু  নেই। এ অঞ্চলে এখন মাতব্বর অনেক আছে যারা তাকে নানাভাবে উত্যক্ত করার চেষ্টা করে। তবে সামনে কেউ তা করে না। আড়ালে  নিন্দা করে।

  অনন্তদেব স্নান সারলেন। ধীরে ধীরে উঠলেন। কল্যাণ  সব পোশাকআষাক রেখে বোধহয়  জঙ্গলের মধ্যে উধাও হয়ে গেছে। ওকে আর এখন প্রয়োজন নেই।

 রতিকান্ত বলে একজন প্রণাম জানিয়ে  বলল ‘ ঠাকুরমশাই। আজ কি একবার যাব? বিশেষ প্রয়োজন ছিল।‘

রতিকান্তের সোনার দোকান। ঘোরতর ঈশ্বরভক্ত।  রোজ সকালে সেও স্নানে আসে। মাঝেমাঝে তাঁর কাছে পরামর্শ নেয়। মুস্কিল হচ্ছে রতিকান্তের স্বভাব ভাল নয়, চালাক প্রকৃতির। তার সম্পর্কে রটনা আছে সে  অনেকের  সম্পত্তি দখল করেছে। তবে তাকে একটু বেশীই সমীহ করে রতিকান্ত।

অনন্তদেব বললেন ‘ ‘এখন বল যেতে যেতে শুনি’

‘এই সাতসকালে! না। ঠাকুর মশাই পরে বলব’

‘আচ্ছা। এসো”

ফেরার সময়  তাঁর মনে পড়ল  মুকুন্দ গতকাল একটা খবর দিয়েছে।মুকুন্দ তার সহকারী। সে কলকাতায়  গেছিল। প্রশান্তের সঙ্গেও দেখা করে এসেছে। সে নাকি কিছুদিনের মধ্যে আসবে বলেছে। শিবমন্দিরটা প্রশান্তদের। ওর  বাবা   রেবতীভূষণ  ছিলেন তাঁর চেয়ে কিছুটা বড়। কলকাতায়  প্রচুর জায়গাজমি।  এ অঞ্চলে একসময় বহু জমি কিনেছিলেন। সেইসব অংশ কিছু বিক্রি করেছেন, কিছু পড়ে আছে। এই  শিব মন্দিরও নির্মান করেছিলেন।    তিনি মারা যাবার পর প্রশান্ত সব দিক সামলাচ্ছে। তবে বাবার মতো সে বেশি সময় দেয় না। দৈবাৎ আসে।  সে  তাকে সমীহ করে। কাকাবাবু বলে ডাকে। তাঁর উপরেই মন্দিরের সব  দায়িত্ব দিয়েছে । সে যদি আসে খুব ভাল হয়। মন্দিরের একটা প্রাচীল ভেঙ্গে গেছে। রংও চটে গেছে। সেগুলি সারিয়ে নিতে হবে।তিনি বললে আশা করা যায় প্রশান্ত না করবে না। অনন্তদেব যেতে যেতে ভাবলেন।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত