ধারাবাহিক উপন্যাস: অগ্নিশিখা (পর্ব-২) । দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়
বাবা স্নানে যেতে কল্যাণ বেশ কিছুটা সময় পায়। বাবা নদীতে অনেকক্ষণ সময় কাটাবেন। তার ইস্কুল আছে। তার আগে কিছুটা সময় সে রামবাবুর বাগানে কাটায়। সে শুনেছে অনেকদিন আগে এখানে নাকি রামবাবু বলে একজন লোক থাকত তার বাগান এটি । কিন্তু এখন তার কোনো অস্তিত্ব নেই। শুধু নামটা রয়ে গেছে।বিরাট বাগানটা পরিচর্যার অভাবে এখন ঘন জঙ্গল ও আগাছায় ভর্তি।
কল্যানের এখন বয়স ষোল। সে বেশ লম্বা কিন্তু চেহারা ভাল নয়। সে রোগা। তার নিজেরও সেকারণে দুঃখ আছে।সে মাঝে মাঝে আক্ষেপ করে ব্রজদার মতো তার কেন চেহারা নয়? ব্রজদা তার চেয়ে তিন বছরের বড়। তাদের তিনভাইএর মধ্যে তাকে দেখতে বেশী সুন্দর।
শুধু তাই নয় ব্রজদা তার চোখে একজন সাহসী মানুষ। সে সব পারে। তরতর করে গাছে উঠতে পারে। মাঠে নেমে খেলতে পারে। কোথাও গোলমাল হলে নির্ভয়ভাবে যেতে পারে। পাড়ায় যে কোন কারুর বিপদে ও দৌড়ে যায়।মাথাও ভীষণ পরিস্কার তার। একটা পড়া মুখস্ত করতে গেলে সে যেখানে হাঁপিয়ে পড়ে ও নিমেষে তা মুখস্ত করতে পারে। কিন্তু সব ভাল হলেও একটা গন্ডোগোল আছে। ওর ধৈর্য কম।সে কারণে ওকে বাবা বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
ব্রজদার কথা মনে পড়তে তার মন খারাপ হল।এই জঙ্গলে ওর সঙ্গে সে বেশ কয়েকবার এসেছে। বীথিদিও আসত। আসতে না চাইলেও ব্রজদা তাকে জোর করে আনত।
রামবাবুর বাগান বাইরে থেকে মনে হয় ঘন,কিন্তু ভেতরে ঢুকলে ফাঁকা জায়গাও আছে। দিব্যি সেখানে বসে থাকা যায়। একবার মনে আছে বীথিদি ঘর থেকে খাবার করে এনেছিল। তারা এখানে বসে খেয়েছিল।
কল্যাণ একা বসে থাকার ছেলে নয়। ব্রজদা সঙ্গে থাকলে সে অনেকক্ষণ থাকতে পারত। একা একা জঙ্গলের মধ্যে বেশীক্ষণ থাকাও ঠিক নয়। তাছাড়া তার পড়া আছে। ইস্কুলে যাবার আগে সে পড়ে নেবে।
খানিকক্ষণ জঙ্গলের মধ্যে সময় কাটিয়ে সে ঘরে ফিরতে শুরু করল। একটা শর্টকাট পথ আছে। এখান থেকে ভেতরে ভেতরে ফেরা যায়। জঙ্গলের অন্য প্রান্তে পড়বে বীথিদিদের নতুন ঘর।ছোটবেলায় ওরা তাদের বাড়ির পাশে থাকত। কিন্তু সেই বাড়িঘরের চিহ্ন এখন কোথাও নেই। সেই জায়গাটা এখন তাদের বাড়ির পাশে পড়ে আছে। বাবা নাকি জায়গাটা কিনে নিয়েছেন। বাবা চারধারে প্রাচীল দিয়ে তাতে একটা বাগান করেছেন। বীথিদিরা অবশ্য বাগানে যায়। মায়ের সঙ্গে মিলে অনেক গাছ পোঁতে। কখনো কখনো সেও থাকে।
এখন যদি বীথিদি বাড়িতে থাকে তাহলে কল্যান তাকে চমকে দিতে পারে। পরক্ষণে সে ভাবল এ সময় ও মন্দিরে চলে যাবে। বাড়িতে থাকার সম্ভাবনা কম। তার মনে পড়ল বীথিদি পড়াশুনোয় ভাল ছিল। তাকে অনেকবার অঙ্ক শিখিয়েছিল।পরে আর বেশী পড়াশুনো করতে পারে নি। মা মারা যাবার পর প্রভাতকাকা তাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সেখানে থাকতে পারে নি। বছর দূয়েক আগে ফিরে এসেছে।
সে জঙ্গলের গভীরে ঢুকে যায় । গাছগুলো ছোট হয়ে গেছে। সে তাদের মাথা ছুঁতে পারে। কখনো পাতা ছিঁড়ে ঘ্রান নেয়। সুগন্ধ হলে চিবায়। সব গাছ সে চেনে না। তবু কিছু কিছু চেনে। সামনে ওই মস্তগহ্বর থাকা গাছটা রয়েছে তার নাম অশ্বথ। গহবরটা প্রকান্ড আর ওর মধ্যে কেউ লুকোলে তাকে দেখতে পাওয়া সম্ভব হবে না।
ভোরের আলোয় গাছের পাতাগুলো নরম ও সুন্দর। ওদের ঘুম ভাঙছে। সদ্য ফোঁটা কুঁড়ির সামনে সে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। ওদের কিছু শিখতে হয় না। আপনা আপনিই ফোটে। সেও যদি আপনা হতে ফুটত! আরো কিছু ভাবতে যাচ্ছিল । কিন্তু তার ভাবনা হঠাৎ থমকে গেল। দুর থেকে দেখল গাছটার কাছে একজন শুয়ে আছে।
কল্যাণের বুক ধুকপুক করল। অরন্যের একটা মৃদু শব্দ আছে । দূর থেকে নদীর স্রোতের হালকা আওয়াজ আসছে। চারদিক অদ্ভুত নির্জন। তারমধ্যে একজন মানুষ শুয়ে আছে অথচ তার ধারেকাছে কেউ নেই ভেবে সে ভয়ে অস্থির হয়ে গেল।লোকটা উপুড় হয়ে শুয়ে আছে।
আরো পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস: অগ্নিশিখা (পর্ব-১) । দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়
লোকটা বেঁচে আছে না মরে গেছে নাকি এমনিই শুয়ে আছে ! উপুড় হয়ে শুয়ে আছে বলে সে কিছু বুঝতে পারছে না। তার মনে হল মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। সে যেমন এসেছে তেমন চুপচাপ চলে যাবে। জঙ্গলে অনেকসময় কাঠকুড়াতে লোক আসে তেমনই কেউ হয়ত হবে। তার ভেবে কাজ নেই। তার মনে পড়ল বীথিদি একদিন বলছিল একটা লোক নাকি এখানে মাঝে মাঝে আসে সে নাকি গাছগাছড়া তোলে। সে লোকটাকে এখনও চোখে দ্যাখে নি । ভেবে সে একটু থমকাল। সে লোকটা হতে পারে! হয়ত শরীর খারাপ হয়েছে বা বিশ্রাম নিচ্ছে। সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না তার করণীয় কি! এমন ভাবে একজনকে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে চলে যেতেও তার ইচ্ছে করছে না। এজন্য সারাদিন মনে মনে সে অপরাধ বোধে ভুগবে।
লোকটার দিকে আরো কিছুক্ষণ কল্যাণ চেয়ে রইল। গাছের ফাঁক দিয়ে সকালের রোদ পড়েছে। একটু কাছে এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে হল। শ্বাসপ্রশ্বাস পড়ছে কিনা দেখার জন্য সে কাছে এগিয়ে গেল। কিছুটা এগোতেই উপুড় হওয়া মানুষটাকে সে একনিমেষে চিনতে পেরে গেল। মানুষটাকে সে ছোটবেলা থেকে দেখছে। তার সব অঙ্গভঙ্গী তার চেনা। ব্রজদা!
ব্রজদা এখানে কি করে এল? ওর কি শরীর খারাপ? তাছাড়া ওর এখন কলকাতায় থাকার কথা! আর যদি ফিরে আসে তাহলে বাড়িতে না গিয়ে এখানে ও শুয়ে আছে কেন? সে হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।তারপর সে দুচারবার ব্রজদাকে ডাকল কিন্তু কোনো সাড়া পেল না। সে এবার গায়ে ঠেলা দিয়ে ডাকল।
ব্রজদা ধড়ফড় করে উঠল। চোখে কেমন একটা উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। চুল উস্কোখুস্কো। তার হাত চেপে ধরে ও অশ্বত্থ গাছের গুঁড়ির উপর বসে পড়ল। তার দিকে তাকিয়ে চুপ করতে ইশারা করল।
কল্যাণ তবু থামল না। সে অবাক হয়ে বলল ‘ তুমি এখানে ? বাড়ি যাও নি কেন?’
ব্রজ সে কথার উত্তর দিল না। সে বলল ‘ বাবা কোথায়?
‘স্নানে।‘
‘বাবাকে বলিস না আমি ফিরেছি।‘
সে অবাক হয়ে বলল ‘ বলব না?’ ’
‘ না। আমি ওখান থেকে পালিয়ে এসেছি। কলকাতায় থাকতে ভাল লাগছে না।‘
সে জিজ্ঞেস করল ‘ কেন দাদা?’
ব্রজ বলল ‘ উফ! সারাদিন শুধু কাজ আর কাজ।“
কাজ মানে তো পড়াশুনা! সে বলল ‘ সে তো কাজ করবেই দাদা। পড়াশুনার জন্যই তোমাকে বাবা পাঠিয়েছে।‘
ব্রজ বলল ‘ হু। তাই। পড়াশুনোর নামেই বাবা পাঠিয়েছে। কিন্তু কাকার বাড়িতে সকাল বিকেল নামেই পড়াশুনো করতে হত। আমাকে দিয়ে হাজারটা কাজ করাত”
সে বলল ‘ বাবাকে এসব বল নি কেন?
‘বাবা দুঃখ পাবে। বাবাকে এসব কথা বলা যাবে না।‘ ব্রজ একটু থামল। তারপর বলল ‘বাবার কথা ভেবেই তাও মানিয়ে নিচ্ছিলাম। কিন্তু কাকার ছেলেটা মহা বদ। আমারই বয়সী। সবসময় হুকুম দেয়।সে এমন কুঁড়ে একটা গ্লাস জল তুলে খায় না।‘
‘তারপর?’
‘দুচারদিন সহ্য করেছি। কাল মেজাজ দেখাচ্ছিল দু চার থাপ্পড় মেরে চলে এলাম”
কল্যাণ শুনে চমকে উঠল। সে ব্রজদার দিকে তাকাল। ও সবকিছুতে এমন সাহস পায় কি করে? সে এমন কথা ভাবতেই পারে না।পাড়ায় ওইজন্য ব্রজদার চেনাজানা বেশী। তার বন্ধুরাও ব্রজদার সুখ্যাতিতে পঞ্চমুখ। রতন যেমন। সে এখন থেকেই ওর সবকাজে সহচর। ওকে দেখে তার রীতিমত হিংসে হয়। ব্রজদা এখান থেকে চলে গেছে বলে রতন খুব দু;খ পেয়েছে।
সে বলল ‘তাহলে তুমি আর পড়বে না?’
‘উহু। কলকাতায় পড়ব না”
‘তাহলে?’
ব্রজ গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বলল ‘ দেখি।“
সে বলল ‘ বাবা খুব রেগে যাবেন।“
ব্রজ হেসে বলল ‘ তা তো জানি।ওইজন্যই বাড়ি যাই নি। তুই একবার বাবাকে বল।‘
সে বলল ‘ আমি? আমি কি বলব?’
ব্রজ বলল’ সে বাদ দে। এখন কিছু খাবার আনতে পারবি?’
‘এখানে?’
‘হ্যাঁ।‘
সে চিন্তিত হয়। এত ভোরে সে কোথা থেকে খাবার আনবে? সে ভাবে। বীথিদির কথা মনে হয়।ওর কাছে চাইতে পারে । পরক্ষণে মনে হল ও এখন মন্দিরে। তাহলে! সে বলল ‘ ব্রজদা। তুমি বাড়ি চল”
ব্রজ মাথা নাড়ল। তার দিকে চেয়ে বলল ‘ ঠিক আছে। তুই যা এখন। মাকে কিছু বলিস না ‘
সে তবু ভেবে যায় খাবার আনবার কথা। এটুকু কাজ ও তাকে বলেছে সে পারবে না ভেবে নিজের খারাপ লাগছে। খানিকক্ষণ চিন্তার পর তার মনে পড়ে মন্দিরে একটুপরেই বাবা পুজোতে বসবেন। প্রতিদিনই কেউ না কেউ পুজো দেয়। সেখান থেকে কিছু ফল সংগ্রহ করতে পারে। সে বলল ‘ তুমি দাঁড়াও। ব্রজদা। আমি আসছি।‘
কল্যাণ দৌড়ল।মন্দির এখান থেকে অনেক ভেতরে। বাগানের ওপ্রান্তে। বীথিদির ঘর ছাড়িয়ে আরো অনেকটা পথ। তবে বাবার চেয়ে সময় বেশি লাগবে না। তিনি স্নানে সময় নেবেন। তাছাড়া তিনি আসবেন মূল রাস্তা ধরে। তার আগেই সে মন্দিরে পৌছে যাবে। বীথিদির কাছ থেকেই সে কিছু ফল চেয়ে নেবে।
দেড় দশক ধরে সাহিত্যচর্চা করছেন। পেশা শিক্ষকতা। নিয়মিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখেন। ‘কাঠবেড়ালি’ নামে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়তে। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস : ‘চার অঙ্গ’, ‘তিথির মেয়ে’, গল্পগ্রন্থ : ‘গল্প পঁচিশ’, ‘পুরনো ব্রিজ ও অন্যান্য গল্প’। ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘বীজমন্ত্র’ নামে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখেছেন।