| 27 জানুয়ারি 2025
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক উপন্যাস: অগ্নিশিখা (পর্ব-৩) ।  দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

 

বীথি দাঁড়িয়ে আছে মন্দিরের সামনে।  অনন্তদেব আসার আগে সে সব গুছিয়ে রাখে। তার সকালের কাজ সারা। ভোরে এসেই সে মন্দির প্রাঙ্গন পরিস্কার করেছে। চারদিক থেকে  ধুলো ময়লা আসে। গাছগাছালি ভর্তি চারপাশে। পাতা উড়ে এসে প্রাঙ্গন, চাতাল  ভরিয়ে দেয়।

কাজ মেটার পর সঙ্গে সঙ্গে সে পুকুরে গিয়ে স্নান সারে। পরিছন্ন হয়ে এসে এবার ভক্তদের কাছ থেকে  পুজোর থালা নেয়। রোজ যে থালা পড়ে তা নয়। এক একদিন  কোনো উদযাপন থাকলে লোক সমাগম বেশী হয়।

অনন্তদেব আসবেন। তার জন্য বীথি একটা বালতিতে জল ভরে রেখেছে। পা ধুয়ে  তিনি ভেতরে প্রবেশ করবেন। সে ফুল তুলেও রাখে। অনন্তদেবের বাড়ির পাশে বাগান। সেখান থেকে  সাজি ভরিয়ে রেখেছে ফুলে।

আজ বিশেষ দিন নয়। তবু  বেশ কয়েকটা পুজোর থালা জমা পড়েছে।   বাড়ির বউরা  ভোর ভোর এখানে থালা  তার কাছে জমা দিয়ে চলে যায়।  পূজা শেষ হবার পর তারা  এসে প্রসাদ নিয়ে যায়। যেটা সবচেয়ে বেশী তাতে সে  চোখ রাখল । এটা হৃদয়ের নতুন  বউ এসে দিয়ে গেছে। তাকে দেবার আগে বলে গেল,  মানত রাখা ছিল তো তাই!’ বীথির চোখে অবাক  দৃষ্টি দেখে ও  একপলকে বুঝে ফেলেছিল।

অবাক হবার মতো কান্ড বটে। থালা দেখে সে  চমকে উঠেছিল। গোটা কয়েকটা আম, কলা, পেয়ারা  একটা গামছা। মিষ্টি। হৃদয় সম্পর্কে সবাই জানে সে খুব কিপটে। তাই  এমন পূজার থালা দেখে  সে হেসে বলেছিল ‘ হৃদ-দার বউ ভাগ্য ভাল বলতে হবে!’

নববধূ লজ্জা পায়। সে  চলে যায়  বাড়ির দিকে।

‘তোমার নাম কি গো?’

‘নিরু- নিরুপমা’ বউ  আলতো স্বরে উচ্চারণ করে।

‘পরে একদিন সময় করে এসো গল্প করব’

নিরুপমা  মাথা নাড়িয়ে ফিরে গেছিল।

 বীথি  বউটার কথা ভাবল। তার মতোই  উনিশ-কুড়ি বয়স অথবা তার চেয়ে একটু কম। কি সুন্দর পানপাতার মতো মুখ। তার সঙ্গে  ঘোমটা ফাঁক রেখেই কথা বলছিল। মাথা ভর্তি সিঁদুরের জৌলুসটা খুব বেশি। ঠিক জড়োসড়ো হয়ে পুতুলের মতো চারদিক দেখছিল বউটা। বরের খুব সোহাগ খাচ্ছে এখন।  এ জীবনে সে সুখ তার নেই!

অনন্তদেবের আসতে কিছুটা সময় আছে। বীথি চাতালে এসে বসল। চারদিকে ভোর ফুটে গেছে।  আলোয় মন্দিরটা সুন্দর লাগছে। বসে বসে সে  সামনের দিকে তাকিয়ে ছিল। ও পথেই ঠাকুরমশাই আসবেন।

‘ বীথি দি?’

সে পেছনে ফিরে দেখল পেছনের  বনজঙ্গলের পথ ধরে কল্যাণ এসে তাকে ডাকছে। সে একটু অবাক হল।ওর গলায় উৎকন্ঠার রেশ। ও খুব শান্ত ছেলে। সে তাড়াতাড়ি উঠে ওর কাছে গেল। সে জিজ্ঞেস করল ‘ কি বলছ?’         

কল্যাণ   থালা দেখিয়ে  বলল ‘  আমাকে কিছু ফল দাও’

‘এখনো পুজো হয় নি।‘

‘ওই থালায় অনেক ফল আছে দাও না।কল্যাণ  হৃদয়ের থালার দিকে  আঙ্গুল তুলে দেখায়।

তার  বিরক্তি লাগল।  সে ফল দেবে কি করে? সে একটু অবাকই হয়। ও এরকম করে না।ওকে দেখে তার মনে হয়  ও যেন খুব চিন্তায় রয়েছে।

‘কে খাবে? তুমি?’

 ও সে কথার জবাব দিল না।

সে  আবার জিজ্ঞেস করল ।

ও থাকতে না পেরে বলল ‘  ব্রজদার জন্য”

সে চমকে উঠল। ব্রজ! সে তো কলকাতায়!  ও  আবার ফিরল কবে!  সে বলল ‘ ব্রজ?’

‘হ্যা।তুমি দাও না”

‘ও কোথায়?’

‘পরে বলছি। তুমি দাও আগে”

বীথি ইতস্তত করে। সে কোত্থেকে ফল দেবে? এগুলো সব পুজোর থালা। সে ভাবে কিছুক্ষণ। একটা ব্যাগের মধ্যে  তার মধ্যে কিছু ফল বোধহয় আছে। সে বলে ‘ দাঁড়াও দেখি”

কল্যাণ  ধৈর্য রাখতে পারল  না। ও টুক করে ভেতরে ঢুকল।সে  বারণ করার আগেই  কটা ফল তুলে নিল।

সে দেখল হৃদয়ের বউয়ের দেওয়া থালা থেকে ও  ফল তুলেছে । বীথি হা হা করে উঠে  বলল ‘ ওটা থেকে নিও না কল্যাণ”

 শোনার অবস্থায় নেই ও।   ফল গুলো নিয়ে   জঙ্গলের মধ্যে দৌড়াতে শুরু করল কল্যাণ।

সেদিকে তাকিয়ে তার  কান্না পেয়ে গেল।

অনন্তদেব জানতে পারলে সে কি উত্তর দেবে? নিরুপমা  যখন থালা নিতে আসবে সেও কি আশ্চর্য হবে না? প্রসাদী থালায় কোনও ফল না দেখে?


আরো পড়ুন: অগ্নিশিখা (পর্ব-২) ।  দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়


সে  থালাটার দিকে তাকাল এখন। সে ভেতরে ঢুকে আসে।  থালাটা দেখলে বোঝা যায় একটা কিছু ছিল তা পরিস্কার। ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। তা ঠিক করার জন্য সে ঝাঁকিয়ে দেয়।

ঠিক সেসময়ে অনন্তদেব  হাঁক দেন। ‘ বীথি”

সে চমকে ওঠে। তাড়াতাড়ি  বাইরে আসে।

পুজো শুরু হবার পরে  বীথি  সময় পায়।অনন্তদেব একাই সবকিছু সামলাতে পারেন।তিনি বলে দিয়েছেন ‘ তুই যেতে পারিস। আবার ঘন্টাখানেক পরে আসিস” । তাছাড়া মুকুন্দদাও থাকে। অসুবিধা হয় না। সে কোনওদিন যায়, কোনদিন যায় না।  এক ফাঁকে  সংসার দেখে আসে।  কিন্তু আজ মন্দির ছেড়ে যেতে তার মন চাইছিল না।নিরুপমা যখন  থালা  নিতে আসবে  তখন একফালি ফলও না  দেখে  কি কিছু বলবে না? সে না বলুক নিরুপমার জা শিখা তাকে কিছু না কিছু বলবে।

তবে সে  সেকথা বেশীক্ষণ ভাবতে পারল না। তার মাথায় এখন ব্রজের কথা ঘুরে গেল।  ব্রজ ফিরে এসেছে অথচ  বাড়ি যায় নি কেন?  কল্যাণ ফল নিয়ে যখন  রামবাবুর বাগানের দিকে দৌড়াল তার মানে  ওরা এদিকেই আছে। সে অনুমান করে ভেতরে ফাঁকা জায়গাটা আছে সেখানেই এখন ওরা রয়েছে।  

জঙ্গলের পথ ধরে সেখানে পৌঁছাল বীথি।  কিন্তু পৌঁছে কারুকে দেখতে পেল না। ওরা দুজনেই তাহলে বাড়ি  ফিরে গেছে।

সে  কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার ঘরে ফিরতে শুরু করল।

 তাদের নতুন ঘর  এর বয়স বেশী নয়। বছর চারেক। বাবা সব খুইয়ে অনন্তদেবের কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করেছিল। তিনি এই ব্যবস্থাটুকু করে দিয়েছেন।  কিন্তু তিনি যে তার চেয়ে অনেক বেশি নিয়েছেন তা বীথিরা ছাড়া কেউ জানে না। সকাল সকাল সেসব মোটেই ভাবতে ইচ্ছে করল না তার।

   প্রভাত একটা বাঁশ চাঁচছিল।  এখন তেমন কাজ নেই।  অনেকদিন সে একা ছিল। চিন্তাভাবনা ছিল না। কিন্তু মেয়ে ফিরে আসার পর  তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। মেয়েকে মারধর করেছিল। শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাবার জন্য অনেকবার বলেছিল।  বীথি যায় নি। এমন কি কি কারনে  ফিরেছে তাও বার করতে পারে নি।

ফেরার পর  শ্বশুরবাড়ি  মেয়ে  যায় না বলে এলাকায় একটু শোরগোল পড়েছিল। দু চারজন এলাকার মাতব্বর  তাকে  উপদেশ দিয়েছিল। তারা নানারকম ভয় দেখিয়েছিল। সে বুঝেছিল  মেয়েকে নিয়ে ঘোট পেকেছে।  এসব ভেবে সারারাত দুর্ভাবনায় ঘুম আসত না। তারপর   প্রভাত  বুঝল একটাই উপায় আছে। অনন্তদেবই  এখন  তাকে বাঁচাতে পারেন। ঠাকুরমশাই ওকে নিরাপত্তা দিয়েছেন। যদিও দুচারজন  এখনো তাদের নিয়ে কথা বলে। এখনো মাঝেমাঝে জল ঘোলা করে। ঠাকুরমশাই-এর  জন্য কেউ কিছু বলতে পারে না।  বীথি কে দেখে  এখন  প্রভাত  বলল ‘ এই। এটা একটু ধর তো”

বীথি  একবার দাঁড়াল।  বাঁশের আগাটা ধরে সে বলল ‘ তাড়াতাড়ি কর। মন্দিরে যাব”

‘হ্যাঁ। সারাদিন ওই কর।‘

একথার  ভেতরে এক কথা আছে। বীথি জানে। বাবা সামনে যতই শ্রদ্ধা করুক  অনন্তদেবকে খুবই অপছন্দ করে। সে বাবার কথার উত্তর দিল না। কাজ মিটিয়ে  মন্দিরের দিকে রওনা দিল।

দুপুরের দিকে বীথির কিছু করার থাকে না। তার ঘুমও আসে না। বাবাও বেশীরভাগ দিন বাইরে চলে যায়। সেও কি করবে ভেবে রামবাবুর বাগানে  কিছুটা সময় কাটায়।  অথবা নদীঘাটে চলে যায়। আর কেউ না থাকুক তারাসুন্দরীদি থাকবেই।  ওর কেউ কোথাও নেই। জন্মের পরপর  বাপ-মা মারা গেছে। এলাকায়  মানুষজনের  ফাইফরমাশ খাটে। তাদের  যখন অবস্থা সচ্ছল ছিল তখন তারাদি  বাড়িতে মাকে কাজে সাহায্য করত। মা রোজ যত্ন করে খেতে দিত। বছরে  শাড়ি বাঁধা ছিল।

সে কতদিন আগের কথা তারাদি তা ভোলে নি।  একবার না একবার কথাটা তুলবেই। মা চলে যাবার পর বীথিকে ও অতিরিক্ত স্নেহ করে।

কিন্তু  তার ঘাটে যেতে ইচ্ছে করছে না।  ভাল হলেও তারাদি  খুব নিন্দুক স্বভাবের। এখন তা শুনতে ইচ্ছে করছে না। ও একবার না একবার তার শ্বশুরবাড়ির কথা জিজ্ঞেস করবে।

 ও কথা শুনতে তার  ইচ্ছে করে না। সে  পানিহাটিতে  ফিরবে না আর। শ্বশুরবাড়ি  থেকে  তাকে কেউ তাড়িয়ে দেয় নি। সেই বরং ফিরে এসেছে। স্বামীর কুৎসিত রূপ সে দেখে নিয়েছে।

তার কি যেন মনে হল!   ইচ্ছে হল  একবার সে অনন্তদেবের বাড়ি যাবে। সে সময় পেলে যায়। খুড়িমা অনেক গল্প করে তার সঙ্গে।বাগানে ফুলগাছ করে। এখন যাবে ব্রজ সত্যি  ফিরেছে কিনা তা জানার জন্য।

ও  ফিরলে লাভ না ক্ষতি ! বীথি জানে না। তবু ওকে দেখতে ইচ্ছে করছে তার!

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত