| 5 ফেব্রুয়ারি 2025
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক উপন্যাস: অগ্নিশিখা (পর্ব-৪) ।  দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

কানাই বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভোর দেখছে। কানে শুনছে একটার পর একটা কাজের শব্দ।

গোয়ালে লক্ষ্মী প্রথমে ডাক দিল। এবার  শিখা উঠে পড়বে। বাসি কাপড় ছেড়ে ও কাজে  ঢুকে পড়বে। ঘর থেকে যাবার সময়  সনাতনদের ঠেলেঠুলে সরিয়ে দেবে। তার দিকে চেয়ে  বলবে ‘একটু উঠতে তো পারো! জেগে জেগে শুয়ে শরীরে বাত ধরে গেল ‘

সে   সাড়া শব্দ দেয় না। দিলে বিপদ।   লক্ষ্মী নামের গোমাতাকে এখন সেবা করতে হবে। কিন্তু তাতে  মুস্কিল লক্ষ্মী তাকে পছন্দ করে না। তাকে দেখলেই এমন রাগি চোখে তাকায় সে  ভয়ে সিঁটিয়ে যায়।

শিখা অবশ্য তা বিশ্বাস করে না। ওর বিশ্বাস সে ফাঁকি মারার জন্য বলছে।  লক্ষ্মীর  মতো শান্ত  গরু দেখা যায় না। শিখার আদর সে চোখ বুজে খায়।

আসলে গণ্ডোগোলটা তার-ই।  সে যখন হাট থেকে  লক্ষ্মীকে কিনেছিল সেসময়  আনার সময়   খুব বেগ দিয়েছিল। সে শুধু কথার মধ্যে সহচর রামুকে বলেছিল ‘ দেখছিস কি!  দুটো ঘা দে। ঠিক যাবে।‘

শোনার পর থেকেই লক্ষ্মী রণচন্ডী মুর্তি ধারণ করেছিল। কোনোরকমে ওকে  বাড়ি নিয়ে আসতেই   লক্ষ্মী  শিখাকে  দেখে আশ্চর্য শান্ত হয়ে গেছিল।

শিখা বাইরে যেতে সে  একবার উঁকি মেরে দেখে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। এই সময় তার কিছুতেই উঠতে ইচ্ছে করে না।কাজ নেই বলা যাবে না। তার কীর্তনের দল। সেই দল নিয়ে মাঝে মধ্যে এখানে ওখানে বায়না পায়।

গত সপ্তাহেই সে ঘুরে এসেছে চাকদা থেকে। সেখানে তিন দিনের অনুষ্ঠান ছিল। তারা দশজন ছিল। খাতির কম পায় নি। খাওয়াদাওয়াও ভাল ছিল। শিখা তার সঙ্গে মাঝে মাঝে জুটে যায়। তবে ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে এখন আর পারে না।

বাকি  সময় কানাই কি যে করে ভেবে পায় না।এ  অঞ্চলে মাটির কাজে নাম আছে। সে মাঝে-মাঝে   সে -কাজেও নেমে যায়। মাটির কলসী কুঁজোর কাজে সে হাত লাগায়। তবে সে খুব একটা  সড়গড় নয়। তবু ঠেকনো দেয়।

শুয়ে শুয়ে সেসব কথাই ভাবছিল। তাছাড়া সে ভাবছিল কখন একটু বেলা হবে। প্রভাতদা, দিবাকর, রামুরা   সব আসবে বড় দীঘির ধারে হাতে অল্প টাকা পয়সা আছে। একটু জুয়া খেলা হবে।তাসের জুয়া। সে কোনদিন জেতে নি।কিন্তু সে একবার এক জ্যোতিষী্কে  হাত দেখিয়েছিল। জ্যোতিষী  তার হাতের উপর মোটা আতস কাঁচ রেখে বলেছিল ‘  আছে”

‘কি আছে?’

জ্যোতিষী   কররেখারগুলোর  দিকে তাকিয়ে বলেছিল ‘  কিছু একটা লাভ হবে তোর”

কি লাভ তা অবশ্য   বলে নি। সে বুঝে গেছে। জুয়াতে ছাড়া আর কি সে লাভ? সুতরাং  সে আশায় আছে। কোনদিন না কোনদিন লাভ হবে তার।

 জানলা দিয়ে কানাই  বাইরেটা দেখল। কাঁঠালগাছটার উপর রোদ পড়েছে।  শিখা লক্ষ্মীর  কাজ মিটিয়ে এবার কাঁঠাল গাছ নিয়ে পড়ল।

এ গাঁয়ে এতবড় কাঁঠালগাছ  আর কোথাও নেই। মোটা গুঁড়িটা যেমন উপরে মাটির ভেতরও একইভাবে ঢুকে গেছে। বড় বড় কাঁঠালপাতা  চত্বর জুড়ে ছায়া দেয়।  গাছে পাখীও এসে জটলা করে।   তারাও বোধহয় জানে এমন সুখ আর তারা কোথাও পাবে না।

গাছের বাকল খসিয়ে তার ভেতর  মুখ ডুবিয়ে পাখিরা গাছের রস খায়। এ অঞ্চলের ছেলেমেয়েরা  ওর উপর দৌঁড়ঝাঁপ করে।  কেউ কেউ আবার গাছের গায়ে ছাগল বেঁধে দিয়ে চলে যায়।

 গাছটা তাদের নয়।  বাড়ির লাগোয়া। তবু ওই ভরা গাছ গাছালিতে কেউ গরু- ছাগল বাঁধলেই  শিখার   গায়ে লাগে ।  ও ঝগড়াঝাঁটি শুরু করে দেয়। গাছে ফল হলে অবশ্য  গাঁয়ের লোকদের যেচে খাওয়ায়।

 কানাই-এর ছোট ভাই  হৃদয়ের গা কুটকুট করে।  বেশ কয়েকবার  কানাইকে ও বলেছিল, বৌদিকে বারণ কর।  লোকদের এত দেওয়ার কি আছে? এর  চেয়ে বিক্রি করা কি ভাল নয়?’

সে   বলেছিল’  ও কি আমাদের গাছ?যে দেব না?’

হৃদয় বিরক্ত স্বরে বলেছিল ‘আমাদের না তো কি?’

সে  চুপ করে গেছিল। হৃদয় তার চেয়ে বেশ ছোট। কিন্তু বিষয়বুদ্ধি খুব।  তার উপর একটু রুক্ষ প্রকৃতির। এলাকায় মারকুটে বলে খ্যাতি আছে। এখন থেকে আবার এলাকার উঠতি মাতব্বরদের সঙ্গে চেনাজানা হয়েছে।তাছাড়া  সদ্য সদ্য বিয়ে হয়েছে ওর।  সংসারের দায়িত্ব হয়েছে। ওকে তো ভাবতেই হবে।

হৃদয়ের বউ নিরুপমা খুব ঠান্ডা। সারাক্ষন মাথায় ঘোমটা।বিয়ের আগে আগেই  শিখার পরামর্শ শুনে হৃদয়কে আলাদা করে দেওয়া হয়েছিল। ঘরের পাশেই একটা ঘর তুলেছে হৃদয়। উঠোনে দুটো উনুন।পাশাপাশি।

একটু আগে নিরুপমাকে সে মন্দির থেকে ফিরে আসতে দেখল। মন্দিরে পুজো দিতে গেছিল। শিখা  কদিন আগে বলছিল নিরু নাকি পুজো দেবে। হৃদয় নাকি  মত দিয়েছে। বলার পর শিখা খুব হাসাহাসি করেছিল। হৃদয়কে সবাই চেনে।  সে কি পুজো দেবে জানা আছে!  শিখার হাসাহাসি নাকি নিরু শুনেছে। তারপর থেকে ও অভিমানে শিখার সঙ্গে কথা বলছিল না।

এখন অবশ্য নিরু  শিখার সঙ্গে দিব্যি কথা বলছে। তা হলে মান-অভিমান মিটে গেছে। দেখে ভাল লাগল তার। নিরু ফিসফিস করে ওকে কিছু বলছে। সে একবার কান পাতল কিন্তু  কিছু শুনতে পেল না।

আচমকা সে  শিখার উঁচু গলা পেল! সে সভয়ে বাইরে তাকাল। এই একটা জিনিষই আছে ওর। গোলগাল চেহারার শিখার গলার জোর। পাড়ার বউরা ওকে সাধে  ভয় পায় !

নিরুর সঙ্গে কথা যদি  ঝগড়ায় গড়ায় তাহলে খুব মুস্কিল। নিরু ঠাণ্ডা প্রকৃতির। কিন্তু হৃদয় ছেড়ে কথা বলবে না। তখন তার খুব সমস্যা হয় । সে কোনদিক থাকবে  বুঝতে পারে না।

হৃদয় ঘর করার সময়ও রাগ দেখিয়েছিল।  সে লোক এনে মাপ করিয়েছে। দাদা- বৌদির কথা বিশ্বাস হয় নি। সেও ও নিয়ে মাথা ঘামায় নি। শিখাই যা দেখার দ্যাখে। প্রয়োজন হলে সে তার নিজের দাদাকে ডেকে আনবে।

জল  বেশীদুর গড়ায় নি। এমনিই মিটে গেছিল। কাঁঠালগাছ নিয়ে এখনো   দ্বন্দ্ব আছে। ওটা তাদের কারুরই নয় , কিন্তু হৃদয় দাবী করছে ওটা তার দিকে। কাঁঠাল গাছটা ওর ঘরের সামনে। কাঁঠালগাছটা কেটে দেওয়ার খুব ইচ্ছে হৃদয়ের।

শিখা তাই নিয়ে ফোঁস ফোঁস করেছে। তেমন করলে সে  দক্ষযজ্ঞ বাঁধাবে। সে ওকে বলেছে’ ধুর। ধুর! ও কথার কথা!

কিন্তু আজ এই সকাল সকাল গোলমাল শুরু হলে কানাইএর ভাল লাগে না। কি নিয়ে দুজনের মধ্যে লাগল কে জানে? সে ভাল করে কথায় কান পাতল।


আরো পড়ুন: অগ্নিশিখা (পর্ব-২) ।  দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়


একটু পরে সে মাথা নাড়ল। ‘উহু’। ওদের দুজনের মধ্যে কোন  ঝগড়া নয়। বরং অন্য কোন ব্যাপার! মন্দির বিষয়ে কোন কথা বলছে ওরা দুজনে।ওখানেই কিছু একটা ঘটেছে।কি ঘটতে পারে সে অনুমান করার আগেই  তার  কানে শিখার গলা এবার সজোরে  আছড়ে পড়ল। ও চেঁচিয়ে  বলল ‘ ওই বীথি তো! খুব ছ্যাঁচড়া। পরেরবার যখন যাবি আমাকে ডাকিস”

বীথি নামটা শুনেই কানাই-এর বুক ধুকপুক করল। একটু অস্থির হয়ে পড়ল সে। প্রভাতদার  মেয়েটা কি আবার করল! শিখাকে জিজ্ঞেস করার সাহস নেই তার। তার  একটু মেয়েদের দেখলে  ঢলে পড়ার বাতিক আছে। শিখা তা লক্ষ করেছে। কানাই নিজেও তা অস্বীকার করতে পারে না।  তার মন খুব নরম। কোনো মেয়ের দুঃখ দেখলে সে  স্থির থাকতে পারে না।

তার চেহারা ভাল নয়। অল্প বয়সেই একটু বুড়িয়ে যাওয়া চেহারা। বছর পঁয়তাল্লিশের মধ্যেই   মুখ  বসে গেছে।  চোয়ালের দুটো দাঁত নেই। দুটো দাঁত  পড়পড় করছে। ভাঙা দাঁত ও চেহারা হলেও  কানাইর কীর্তনের নামডাক আছে। রোগাসোগা চেহারায় সে যখন গান গায় তখন সে একরকম বদলে যায়।

  এক হাটে সে একবার দেখেছিল তার গান শুনে একটা মেয়ে হাপুস নয়নে কাঁদছে। অন্যরা তার দিকে চেয়েছিল। কানাইও কীর্তন থামিয়ে  অবাক হয়ে চেয়েছিল।

 সেই মেয়েটাই বীথি!  সে কি গান শুনে কেঁদেছিল তার মনে নেই। তার মন খারাপ হয়ে গেছিল। ওর নাম শুনেই সে কথা মনে পড়ল। সেদিন সে ওকে চিনতে পারে নি।  লম্বাপানা মুখ। ফরসা। টানা চোখ। একবার তাকালে সে মুখ থেকে চোখ ফেরানো যায় না। একে ওকে সে মেয়েটার কথা জিজ্ঞেস করেছিল। একটু একটু করে সে চিনতে পেরেছিল। প্রভাতদার  মেয়ে বীথি!

 কত ছোট ছিল মেয়েটা!  খুব দু;খের জীবন। ছোটবেলায় মা মরল। প্রভাতদার ব্যবসাও দেনায় ডুবে গেল। ওই সচ্ছল অবস্থা থেকে প্রভাতদা এখন   দিন আনে দিন খাই জীবনে চলে এল। তার  সঙ্গে সে জুয়া খেলে। মদ খায়। তবু কষ্ট করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল। তা সইল না।

 কীর্তন হলেই বীথি আসে। ও এলে তার খুব ভাল লাগে। ও না থাকলে তার কেমন একটা অভাব লাগে।

সে আবার কান পাতল। কিন্তু বন্ধ হয়ে গেছে কথা। শিখা ও নিরুর কথা থেমে গেছে। বীথি কি করেছে ও জানতে পারল না। শিখা যাই বলুক ও কোনও খারাপ কাজ করতে পারে না!

কানাই উঠবে উঠবে করছিল কিন্তু  বীথির কথা মনে আসতে  ওঠা হল না। সে আবার চোখ বন্ধ করল।  মনে মনে  সে একটা আসরের কথা ভাবল। আসরে সে  গান ধরেছে । তার পাশে এসে বসেছে বীথি! গাইতে গাইতে ভাবের ঘোরে   ওর গায়ে গা ঠেকছে । এমন দৃশ্য কখনোও ঘটে নি তবু তার দেখতে ভাল লাগে।  ব্যাপারটা খারাপ লাগছে না ! কিন্তু চারপাশের লোক দেখছে যে!সে একটু সরে সরে আসে।

‘বাবা”

সে চোখ খুলে দেখল বিন্দি তার দিকে অবাক চোখে চেয়ে আছে। বিন্দি বলে ‘ শুয়ে শুয়ে সাঁতার কাটছ কেন বাবা?’

সে  ধমক দিয়ে বলে ।‘ যা”

বিন্দি পালায়।

 কানাই উঠে পড়ল। আর শুয়ে থাকা যাবে না। একটা নি”শ্বাস ফেলল সে। এসব  বুড়ো বয়সের নোলা।  মাঠের দিকে যেতে যেতে সে থমকে দাঁড়াল। চারদিকের ভেজা তুলতুলে আকাশ  তাকিয়ে তার মনে হল প্রভাতদাকে একটা ভাল তামাক খাওয়াবে ও। কেউ বুঝবে না। কেউ জানবে না! 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত