ধারাবাহিক উপন্যাস: অগ্নিশিখা (পর্ব-৫) । দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়
অনন্তদেব এখন বড় ছেলে মন্মথের বাড়ি যাচ্ছেন। জরুরী তলব। একজনকে দিয়ে ও খবর পাঠিয়েছে যাবার জন্য। সে লোক অবশ্য কিছু বলতে পারে নি। তিনি চিন্তায় পড়েছেন। মন্মথের যে ঘরে বিয়ে হয়েছে সে পরিবার সচ্ছল। বিস্তর জমি জায়গা আছে। এক মেয়ে। তারা ঘরজামাই-এর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি পরিস্কার অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু মন্মথ নিজে থেকেই রাজি হয়ে গেল। ও দেখল এখানে থেকে লাভ নেই। শ্বশুরবাড়ি থাকাই শ্রেয়।
তিনি আটকানোর চেষ্টা করেন নি। মন্মথ প্রথম থেকেই সতর্ক, হিসেবী। তাকে বারণ করলেও শুনবে না। সুতরাং বিয়ে করার পর ও তল্পিতল্পাসমেত চলে গেল।
এরপরেও তিনি নিস্কৃতি পান নি। আবেদন, নিবেদন, অভিমান সব পদ্ধতি অবলম্বন করে মন্মথ দুদিক থেকেই সাহায্য পায়। এ বিষয়ে হিরন্ময়ীর ভুমিকা আছে। তাঁর ঠিক বিপরীত হিরন্ময়ী। বড়ছেলের সঙ্গেই বেশী সখ্যতা।
তিনি সে কথা তুলে মাঝে মাঝে খোঁটা দেন। তিনি বলেন ‘ এত যে টান ছেলের উপর? তোমাকে কবার দেখতে আসে সে?’
হিরন্ময়ী বলেন ‘ এই তো এল গতমাসে”
‘গতমাসে নয় বল দুমাস আগে। আর এসেছিল কি কারণে বল? ফসলের হিসেব নিতে। নারকেল গাছে কটা নারকেল ছিল তার হিসেবও মুখস্ত!’
হিরন্ময়ী আড়াল দেবার চেষ্টা করেন । তিনি বলেন ‘ না। মোটেই ও অত হিসেব করে না”
তিনি আরো কিছু কথা বলেন। তারপর থেমে যান। ওকে কোনো কথা বিশ্বাস করান যাবে না।
তাই মন্মথের শ্বশুরবাড়িতে যেতে তাঁর ভাল লাগে না।। তাছাড়া কেনই বা যাবেন? বেয়াই- এর আচরণ তাঁর পছন্দ হয় না। তাঁর বৃত্তি নিয়ে অবজ্ঞাই করেন। যেন তিনি লোক ঠকাচ্ছেন! দু-চারজন অশিক্ষিত পুরোহিত পাওয়া যাবে না তা নয়। তা বলে সবাইকে একই বন্ধনীতে ফেলে দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু বেয়াই ঠোঁট-কাঁটা। মন্মথের ঘরজামাই হওয়া নিয়েও তাঁর সঙ্গে ঠাট্টা করেন। সেগুলো শুনতে বেশ গায়ে লাগে। তিনি হিরন্ময়ীকে জানিয়েছিলেন তাঁর যাবার ইচ্ছে নেই।
হিরন্ময়ী বলেছিলেন ‘ সে কি! ওরা কেমন আছে জানবে না? কারুর যদি শরীর খারাপ হয়? ওইজন্য বুঝি আসছে না।‘
‘ব্রজকে পাঠিয়ে দি?’
হিরন্ময়ী হাঁ হা করে উঠে বলেছিলেন “ ব্রজ কি বুঝবে?’ ওইটূকু ছেলে।‘
‘ ব্রজ’র কুড়ি পেরোতে চলল। ”
‘সে হোক। মন্মথ তোমাকেই যেতে বলেছে। ‘
তিনি চুপ করে গেছিলেন। এ নেহাত কথার কথা। তিনি নিজেই যাবেন। কিন্তু বিরক্তি চাপতে পারছেন না। ভেতরে বড় ছেলে সম্পর্কে একটা ক্ষোভ তাঁর আছে। তা কিভাবে তিনি গোপন রাখবেন? তিনি বলেছিলেন ‘ কি জানি! দেখি কি বলে!’
হিরন্ময়ী খাবার বেড়ে দিয়ে বলেছিলেন ‘ প্রভাত কি তোমার সঙ্গে যাবে?’
“ও কেন যাবে?’
‘না। এতদুর পথ। কিছু জিনিষপত্র পাঠাব।তাই প্রভাত যদি যেত”
আজ থেকে ক বছর আগে হিরন্ময়ী এ কথা ভাবতে পারতেন না । প্রভাত একদা তাঁর প্রতিবেশী ছিল। বীথিকে নিজের মেয়ের মতোই দেখতেন হিরন্ময়ী। কিন্তু প্রভাতদের জীবন বদলে গেছে। তারা একপ্রকার তাঁর আশ্রিত। ওইজন্যই প্রভাতকে মোট বইবার কাজে হিরন্ময়ী ব্যবহার করতে বলছেন।সম্পদ না থাকলে জীবন বদলে যায়। তিনি নিজেও কি খানিকটা তাই হন নি? প্রভাতের সবকিছুই তাঁর কাছে বন্ধক । ওর অবস্থা কোনদিন ফিরলে তিনি তা ফেরত দেবেন। কিন্তু তিনি জানেন ও কোনদিন তা পারবে না। তাই ধীরে ধীরে ওর বাড়িটা ভেঙ্গে দিয়ে বাগান করেছেন। ওদের আশ্রয় দিয়েছেন রামবাবুর বাগানের এক প্রান্তে।লোকজন তা নিয়ে আপত্তি তুলেছিল। বিশেষত বীথির বিয়ে করা তারপর ফিরে আসা নিয়ে খুব টালবাহানা হয়েছিল। এতো আর সম্পুর্ণ শহর নয় যে লোকজন কিছু বলবে না। তবু তিনি ওদের আশ্রয় দিয়েছেন। এর পেছনে ওই জমিটা একটা বড় ব্যাপার। তিনি মনের অস্বস্তিটা এভাবে কাটাতে চেয়েছেন। তাই হিরন্ময়ীর মুখে প্রভাতের প্রসঙ্গ শুনে তাঁর ভাল লাগে নি। তিনি বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন ‘ না। ও যাবে কেন? মুকুন্দকে বলা আছে। সে যাবে”
হিরন্ময়ী মাথা নেড়ে বলেছিলেন ‘ আচ্ছা!
তিনি খেতে খেতে বলেছিলেন ‘ ব্রজ কি কলেজ বেরিয়ে গেছে?’
‘হু’
ব্রজ বছরখানেক ফিরে এসেছে। পান্নালালের সঙ্গে সম্পর্কটা একরকম খারাপ হয়ে গেছে তাঁর। ব্রজ ফিরে আসার পর পান্নালাল তাকে একটা চিঠি লিখেছিল। তাতে সে উল্লেখ করেছিল ব্রজের নানারকম দুস্কর্মের কথা। পান্নালালের ছেলের গায়ে সে হাত দিয়েছে। ইচ্ছে করলে পান্নালাল ওকে পুলিশের হাতে দিতে পারত। কিন্তু স্রেফ বন্ধু বলে সে ছাড় দিয়েছে। ভবিষ্যতে কোন রকম যোগাযোগ করার চেষ্টা না করে। চিঠি পড়ার পর তিনি অপমানে মূক হয়ে গেছিলেন। এই অপমান জীবনে প্রথম ঘটল। তাঁর নিজেকে আঘাত করার ইচ্ছে হয়েছিল। চিঠি পড়তে পড়তে আর্তনাদ করে উঠেছিলেন। হিরন্ময়ী শশব্যস্ত হয়ে ছুটে এসেছিলেন। তিনি উৎকন্ঠিতস্বরে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘ কি হল?’
তিনি চিঠি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। হিরন্ময়ীর মুখ নিমেষে বদলে গেছিল।তিনি স্থির থাকতে পারেন নি। কাঁদতে শুরু করেছিলেন।
আরো পড়ুন: অগ্নিশিখা (পর্ব-৪) । দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়
তিনি বলেছিলেন ‘ কোথায় ব্রজ?’
ব্রজ ঘর থেকে বেরিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তিনি স্থির থাকতে পারেন নি। তিনি ওকে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করেছিলেন। প্রভাত কোত্থেকে এসে তাকে আটকেছিল।
তিনি এখন খাওয়া মিটিয়ে বললেন ‘ ও ঠিকঠাক কলেজ যাচ্ছে তো?’
‘হু। যায় তো”
অনন্তদেব মুখে একটা ‘হুম’ বলে শব্দ করলেন। ফিরে আসার পর উপায়ান্তর না দেখে ব্রজকে ওপারের একটি কলেজে ভর্তি করে দিয়েছেন। বছর খানেক হতে চলল তা। কলেজটি খারাপ নয়। এদিককার আরো কিছু ছেলে যাতায়াত করে। কিন্তু তাঁর দু;খ কাটে নি। চোখের সামনে একটা সম্ভাবনার মৃত্যূ দেখছেন। সবচেয়ে বড় কথা ও মনে হয় রোজ কলেজ যায় না। তাকে অনেকদিনই বাড়িতে দেখেছেন। ওকে খুব একটা পড়াশুনাও করতেও তিনি দ্যাখেন না।
সন্তান যদি ইপ্সিত লক্ষ্যে না পৌছোতে পারে তাহলে পিতার কষ্ট আরো বেশী।তিনি তা অনুভব করছেন। তিনি ব্রজকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘ তুমি অধ্যাপক হবে তো ব্রজ?’
ব্রজ নিরুত্তর ছিল।
তিনি বলেছিলেন ‘ খুব কঠিন পথ। ব্রজ। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি তোমার মধ্যে সে গুন আছে।‘
ব্রজ চুপ করেই ছিল সেদিন। তাকে ভীষণ সমীহ করে তা জানেন। তিনি নিজেকে প্রশ্ন করেছিলেন , ও কি চায় সেটা আগে জানা দরকার। সেটা ভেবে জিজ্ঞেস বলেছিলেন ‘ আচ্ছা! তুমি অধ্যাপক হবে না? তাই তো! কি হবে তাহলে?’
‘জানি না”
তাঁর মাথায় আগুন জ্বলে যাচ্ছিল। তবু শান্তভাবে বলেছিলেন ‘ তোমার যা বয়স ধারণা থাকা কি অনুচিত?’
ব্রজ শান্ত স্বরে বলেছিল ‘ আমি পড়াশুনা শেষ করি বাবা। তারপর একটা না কিছু করব”
অনন্তদেব বেরোলেন। মুকুন্দ অনেক আগেই ষ্টেশন চলে গেছে। সে টিকিট কেটে রাখবে। প্রথমে যাবেন নৈহাটি ষ্টেশনে। সেখানে থেকে আবার ট্রেন ধরে দুচারটে পরের ষ্টেশনে নামবেন।
যেতে যেতে তাঁর মনে এল পরিমলের কথা। ও এইসব অঞ্চল নিয়েই এখন কাজ করছে। গতসপ্তাহে এসেছিল। সময় পেলেই ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে। বইপ্ত্র ঘাঁটছে। সেদিন ও বলেছিল এইসব জনপদগুলো ছোট হতে পারে কিন্তু এক কালে নামজাদা লোকের বাস ছিল। তারা কেউ কেউ জগৎবিখ্যাত। রামপ্রসাদ সেন,ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কেশবচন্দ্র সেন , প্রতাপ মজুমদার তো ছিলেনই তারা ছাড়াও আরো অনেকেই ছিলেন এসব জায়গায়। তাঁর ভাল লেগেছিল শুনতে। তিনি বলেছিলেন ‘এসব অঞ্চলের নামও তো আগে অন্য ছিল তাই না?’
পরিমল মাথা নেড়েছিল। সে বলেছিল ‘ হ্যাঁ। কাঁচরাপাড়া ছিল কাঞ্চনপল্লী, হালিশহর ছিল কুমারহট্ট, নৈহাটি ছিল নটহট্টি, আর এই গরিফার নাম ছিল গৌরীভা।‘
যেতে যেতে হঠাৎ অনন্তদেব দাঁড়িয়ে পড়লেন। একটা ভুল হয়ে গেল তাঁর। প্রভাতদের কিছু জানানো হয় নি। তিনি আজ সন্ধ্যের আগে ফেরার চেষ্টা করবেন। কিন্তু যদি রাত হয়ে যায় তাহলে রাধামোহনকে দিয়ে নিত্যপুজোটা করিয়ে নিতে হবে।। রাধামোহন কাছেই থাকে। সে এদিকওদিক পুজো করে। ওকে সকালসকাল না বলে রাখলে বিপদ। প্রভাতরা জানিয়ে না এলে সমস্য হবে। কথাটা বলার জন্য প্রভাতদের ঘরের দিকে তিনি রওনা দিলেন ।
অনন্তদেব জঙ্গলের ভেতরে ঢুকলেন। ভেতর দিয়ে একটা সরু পথ।তারপর জঙ্গল শুরু হয়েছে। ওই পথ ধরে প্রভাতদের ঘর। কল্যাণরা এ পথ দিয়ে নাকি যাতায়াত করে। নদীতে পৌঁছাতে তাড়াতাড়ি হয়। ঘরটি তৈরী করার সময় তিনি এসেছেন। কারণ প্রভাতদের থাকা নিয়ে একটু অসুবিধা হচ্ছিল। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটা পায়ে চলা পথ। তাঁর যেতে অসুবিধাই হয়। কোনরকমে ঘরের কাছে পৌছান তিনি। প্রভাতদের ঘরের সামনে পৌছানোর পর তিনি কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে যান।মাটিতে বসে কিছু একটা করছে প্রভাত ।তাকে সাহায্য করছে বীথি আর একটু দূরে হাতে বই নিয়ে ব্রজ বসে আছে !
অনন্তদেবের মাথা কাজ করে না। কিছক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে থাকেন। তারপর তিনি ভ্রু- কুঁচকে জিজ্ঞেস করেন ‘ তুমি এখানে?’
ব্রজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল ‘ ফেরী ধরতে পারি নি। ওইজন্য!’
তিনি বললেন ‘ ওইজন্য এখানে কেন? ঘাট তো বেশ দূর! পরেরটা ধরবে কি করে?’
ব্রজ মাথা নেড়ে বলল ‘ ভেতর দিয়ে একটা পথ আছে। খুব তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়।‘
অনন্তদেব খুশী হলেন না। পেছন দিয়ে যাবার একটা রাস্তা আছে।তিনি কল্যানের মুখে শুনেছেন। তিনি কোনদিন যান নি। কিন্তু ঘাটে না বসে এখানে বসে থাকা তাঁর পছন্দ নয়। তাছাড়া ওদের সঙ্গে ব্রজর কি এমন সম্পর্ক যে এখানে এসে বসে থাকবে? একটা অন্যকিছুর ইঙ্গিত টের পেলেন তিনি। রাতে এ বিষয়ে ব্রজর সঙ্গে কথা বলবেন। তিনি বললেন ‘ কলেজে যদি যেতে চাও। এখানে থেক না। ঘাটে যাও’
বাধ্য ছেলের মতো ব্রজ উঠে চলে গেল।
অনন্তদেব বীথির সঙ্গে মন্দিরের বিষয়ে প্রয়োজনীয় কথা সারলেন। সে চলে যেতে প্রভাতকে আলাদা করে কাছে ডাকলেন। সে দৌড়ে তাঁর কাছে এসে দাঁড়াল।
তিনি গম্ভীরস্বরে বললেন, তুমি খেয়াল রেখো। ব্রজ যেন এখানে না আসে। ও এলে আমাকে জানাবে।‘
প্রভাত মাথা নাড়ল।

দেড় দশক ধরে সাহিত্যচর্চা করছেন। পেশা শিক্ষকতা। নিয়মিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখেন। ‘কাঠবেড়ালি’ নামে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়তে। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস : ‘চার অঙ্গ’, ‘তিথির মেয়ে’, গল্পগ্রন্থ : ‘গল্প পঁচিশ’, ‘পুরনো ব্রিজ ও অন্যান্য গল্প’। ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘বীজমন্ত্র’ নামে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখেছেন।