| 22 ফেব্রুয়ারি 2025
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক উপন্যাস: অগ্নিশিখা (পর্ব-৬) ।  দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

আজ  ইস্কুল ছুটি। কল্যাণ সেকারণে সারাদিন পড়ছে। তার  পড়াশুনা করতে ভাল লাগে।

 দুপুরে খাওয়ার পর সে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিচ্ছিল।  ব্রজদা বাড়িতে নেই। সকালেই ওকে দেখেছিল কাঁধে ব্যাগ নিয়ে কোথাও বেরোতে। সুন্দর পোষাকে  ঝলমল লাগছে। ব্রজদা সবসময় সুন্দর থাকে। মাথাভর্তি কোঁকরানো চুল। চেহারাটা খুবই শক্তপোক্ত। সে জিজ্ঞেস করেছিল ‘ কোথায় যাচ্ছ ব্রজদা?’

ও বলেছিল ‘  একটা কাজ আছে।  আমবাগানের দিকে যাব”

 আমবাগান এখান থেকে দূর আছে। বাস ধরে যেতে হয় অথবা পায়ে হেঁটে। সে জিজ্ঞেস করেছিল ‘ তুমি একা যাবে? না আর কেউ?’

‘দু –একজন যাবে। ওই মনোজ , রতন।‘

রতনের নাম শুনেই কল্যাণ ব্যাজার হয়ে গেছিল। সে ঠাট্টা করে বলেছিল’ ‘রতন দেখি তোমার সঙ্গ ছাড়ে না”

ব্রজদা  হেসে বলেছিল  ‘তাই  তো !তোর বন্ধু অথচ আমার সঙ্গেই ঘোরে।“

সে  বলেছিল ‘ সে মোটেই আমার বন্ধু নয়।‘

ব্রজদা হাসতে হাসতে বলেছিল ‘ রাগ করছিস কেন?’

সে বলেছিল ‘ তুমি তো আমাকে নিয়ে যাও না?’

‘আরে। তুই থাকিস পড়াশুনা নিয়ে। তোর আমার কাজ পছন্দ হবে না।‘

‘কেন? তুমি পড়াশুনা কর না?’কলেজে পড়ছ তো?’

ব্রজ  সযত্নে চুল আঁচড়ায়। সে বলেছিল ‘ ওই আর কি। বাদ দে। এখন খুব শরীরচর্চা করতে ইচ্ছে করছে!’

‘মানে?’

‘মানে কিছুই নয়। আমবাগানে একটা আখড়া আছে। ওইরকম একটা ব্যায়ামগার যদি এখানে করতে পারি!  সেইসব দেখতে যাচ্ছি। তা তুই কি ব্যায়াম করবি?’

সে  বুঝেছিল ও  ঠাট্টা করছে। তার চেহারা ভাল নয়। খুব রোগা সে।খেলাধুলাও সে করে না। তার মুখ অভিমানে ভরে উঠেছিল।

ব্রজদা হেসে ঘর থেকে বিদায় নিয়েছিল।

কল্যাণ ভাবছিল একটুখানি গড়িয়ে নেবে। কাল রাতে সে অনেক রাত পর্যন্ত পড়েছে। তাই একটু বিশ্রাম নেওয়া দরকার। কিন্তু মন লাগল না। সে উঠে পড়ল। মাকে বলে সে একটু ঘুরতে বেরোল।

শীতের দুপর  দুপর। এদিক ওদিক কিছুজন বসে রোদ পোহাচ্ছে। কিছুজন ঘরের কাজে মেতে আছে। সে  চারদিক দেখতে দেখতে এগিয়ে গেল। সে  একবার ভাবল বীথিদির সঙ্গে দেখা করবে কিনা?

কিন্তু  যাওয়ার কথা ভেবে সে  একটু হোঁচট খেল। কদিন আগে বাবার কথা মনে পড়ল তার। বাবা ব্রজদাকে  সতর্ক করছিলেন। ব্রজদা নাকি কলেজ যাবার নাম করে বীথিদিদের বাড়ি গেছিল।

ঘটনাটা ঠিক। সেও এটা জানে। বীথিদির মুখ থেকেই সে শুনেছে। বাবা হয়ত একদিনের কথা জানতে পেরেছেন। কিন্তু ব্রজদা  মাঝে মাঝেই     কলেজ না গিয়ে  বীথিদির বাড়িতে বসে থাকে। বীথিদি নিজে বলেছে। সে নিজেও তার সাক্ষী।  তার কিছু মনে হয় নি। বীথিদির বিয়ের আগে  এমন সময় তারা কাটিয়েছে। কিন্তু এখন  সেভাবে কাটান সম্ভব নয়।

 বাবা সেকথাই  সেদিন ব্রজদাদাকে বুঝিয়েছিলেন। তিনি ধীরস্থির গলায় বলেছিলেন ‘ দ্যাখো ব্রজ। ছোটবেলা আর এখন একসময় নয়। লোকজন কিন্তু নিন্দা করতে শুরু করবে। সুতরাং তুমি আর ওর বাড়িতে যেও না। ব্রজদা চুপ করে শুনেছিল। সে   জানে ও সামনে কিছু না বললেও কথা শোনার পাত্র নয়। ও ঠিক যাবে বীথিদির সঙ্গে গল্প করতে।

কল্যাণ ঘুরতে ঘুরতে মন্দিরের কাছে এল। সে মন্দিরে একবার ঘুরপাক খেল। তাকে খেলতে ডাকছিল পাড়ার বন্ধুরা। সে হাসিমুখে এড়িয়ে গেল।


আরো পড়ুন: অগ্নিশিখা (পর্ব-৫) ।  দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়


মন্দিরে ঢুকে  তার  মন প্রসন্নতায় ভরে গেল। প্রাঙ্গনে প্রবেশ করে সে সিঁড়ি দিয়ে চাতালে উঠে পড়ল। মন্দির এখন বন্ধ। পেছনের দিকে একটা শিক দেওয়া জানলা আছে। সেখান থেকে  উঁকি মেরে সে  তাকাল। অন্ধকারে কিছু দেখা গেল না। সে  এবার  প্রদক্ষিন করে  ঘুরতেই দেখল রোদের দিকে মুখ করে একজন চাতালে শুয়ে আছে।  পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখল  কীর্তনের দলের বীরুদা । যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায় বীরুদা। বাড়িতে মন টেঁকে না। অনেক পালাগান মুখস্ত তার।কখনো সখনো  তাদেরও শুনিয়েছে ।

বীরুদাও তাকে দেখেছে।  ঘুমায় নি। তাকে দেখে একবার মুখ ঘুরিয়ে হাসল। কল্যাণ জানে ওকে চারপাশের অনেকলোক নানাভাবে বিরক্ত করে। ও  একটু নরম প্রকৃতির। একটু মেয়েমেয়ে ভার আছে তার। ওর দাদা-বৌদির পরিবারেও  তাই নিয়ে অশান্তি কম হয় না। সে অবশ্য কোনদিনই বীরুদার সঙ্গে কখনো ঠাট্টা ইয়ার্কি করে না।

বীরুদা তাকে দেখে একগাল হেসে বলল,’ কি ছোটকর্তা পড়তে যাও নি?’

‘উহু। তুমি কি করছ?’

‘এই দুপুরটা একটু গড়াচ্ছি। বিকেলের পর মেলা কাজ। কালপরশুই যাব সেই শান্তিপুরের  দিকে।‘

‘ সেখানে কি আছে?’

বীরুদা চোখ নাচিয়ে বলল ‘  সেখানে সংক্রীর্তন  করতে যাব গো। বড়লোকের ঘর। তিনদিন ধরে কীর্তন হবে। কাল কানাইদার সঙ্গে বায়না করে গেছে। মাসকয়েক আগে  গেছিলাম রাণাঘাট। সেখানেও খুব মজা হল’

কানাইকে চেনে  কল্যাণ। সনাতন-বিন্দির বাবা।  গানের দল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বীরুদা ওই দলেই আছে।

বীরুদা মন্দিরের দেয়ালে হেলান দিয়ে বলল ‘  তবে এবার ভাবছি আমি যাব না’

‘সে কি? যাবে না কেন?’

‘সে তুমি বুঝবে না।“

কল্যাণ আর ঘাঁটল না।বীরুদা তার চেয়ে অনেক বড়। ওর  নিশ্চয় কিছু গোপন কথা আছে। তা সে তাকে বলবে কেন? সে বরং অন্যকথা জিজ্ঞেস করল। সে বলল ‘ বীরুদা। তুমি অনেকজায়গায় ঘুরেছ না?’

‘হু। ঘুরেই তো বেড়াই। চারদিক।‘

‘ঘুরতে খুব ভাল লাগে?’

‘খুব”

কল্যানের চৌহুদ্দি বেশিদুর নয়।  একবার দুবার  সে গেছিল বড়দার বাড়িতে। আর গেছিল  রথেরমেলা দেখতে। কাঁটালপাড়ায়।ষ্টেশনের ধারে রথের মেলা বসে। খুব ভীড় হয়। ব্রজদারা এদিক থেকে বেশ আছে। নদী পেরিয়ে ওপারে পড়তে যায়। সে জিজ্ঞেস করল’ শান্তিপুর বেশ দূর না?

‘ তা দুর আছে। রেলগাড়ি করে যাব।‘

‘ কেমন জায়গা?’

‘ খুব ভাল জায়গা।‘

আরো কিছুক্ষণ কথা বলার পর বীরুদা বলল ‘ এবার উঠি গো। কাজ পড়ে আছে বিস্তর।‘

 সেও  মাথা নাড়ল।

 বীরুদা উঠে বলল  ‘ব্রজভাইএর  খবর কি গো? অনেকদিন দেখি নি। একদিন অবশ্যি  দেখছিলাম ওই যে বীথি আছে না? ওর সঙ্গে গল্প করতে। আমাকে চিনতেই পারল না দেখে!”

সে   শুকনো মুখে হাসল। একটু আগেই সে ভাবছিল  এমন সম্ভাবনার কথা। সেটাই যেন সত্যি হতে চলেছে।  সে তা চাপা দেবার উদ্দেশ্যে বলল ‘ ব্রজদা বেশিরভাগ দিন কলেজে যায়। ফেরে সেই সন্ধেবেলায়।‘

বীরুদা শুনল। ঠোঁটে একটা হালকা হাসি ফুটিয়ে বলল ‘ চলি’

কল্যাণও মন্দির ছেড়ে বেরিয়ে এল।  মেঠোপথ ধরে এগোলে সে দেখতে পায় কুমোররা  চাকে মাটির বিভিন্ন পাত্র তৈরি করছে। নদীর ধার ধরে পরপর গ্রামগুলোতেই  বেশিরভাগ জায়গায় মাটির কাজ হয়। দুর দুর থেকে লোকেরা সেখান থেকে মাটির নানারকম জিনিষ কিনে নিয়ে যায়। দেবীমুর্তিও  করে  শিল্পীরা।

এ অঞ্চলে  প্রধান পুজো একটাই হত। সেই পুজোর সব দায়িত্ব  বাবার।  সে সেই পুজো দেখেছে।  রায়বাড়ির   সামনে একটা বিশাল মন্ডপ। সেই মন্ডপেই  মা দুর্গা এসে বসেন। মন্ডপের  সামনে দিয়ে একটা একটা খোয়াই  বাঁধান রাস্তা।  রাস্তার আরেকপাশে একটা বড় পুকুর।

অনন্তদেবের  পুজোতে  একদুবার ব্রজদা  সাহা্যা করেছিল। তারপর  বাবার কাছে আসা  মুকুন্দদা,   বাবার কাছ থেকে কাজ  শিখে নিচ্ছে। এখন এলাকায়   এদিকওদিক আরো পুজো হয়েছে।

কল্যানেরও ইচ্ছে আছে বাবার কাজ শিখে নেবার। সে পুরোহিতবংশের ছেলে। কিন্তু পরক্ষণে তার মনে অন্য ইচ্ছেও পাক খেয়েছে। তার বাইরে যাওয়ার খুব ইচ্ছে। এখানকার অনেকেই  বিলেতে গেছে পড়াশুনার জন্য। তেমনই অনেক স্বপ্ন তার মুখেচোখে ভেসে বেড়ায়।  বাইরের দেশ সম্পর্কে সে যখন পড়ে তার ইচ্ছে হয় সেখানে চলে যেতে।

 খানিকটা  এগোতেই হঠাৎ  তাকে  কে যেন  ডাকল। সে পেছু ফিরে দেখল  ব্রজদার বন্ধু জগন্নাথদা। সে দাঁড়িয়ে পড়ল।

জগন্নাথদা খুব লম্বা। তার সঙ্গে মাথা উঁচু করে কথা বলতে হয়।  সে তার দিকে চেয়ে বলল’ ‘আরে। এদিকে কোথায়?”

‘কোথাও না। এমনি একটু ঘুরছি! তুমি?’

‘আমি   তোমাদের দিকেই এসেছি। একজনকে  কয়েকটা কবিতা শোনাতে যাব।‘

সে হাসল। জগন্নাথদাকে তার ভাল লাগে। হাসিখুসী। তার সঙ্গে দেখা হলেই কথা বলে। কবি হওয়ার খুব ইচ্ছে ওর।  তাকে একআধবার বলেছে, কবিতাও পড়িয়েছে। সে  তার মর্ম বুঝতে পারেনি। কিন্তু অবাক হয়েছে।  শব্দ জুড়ে জুড়ে একটা কিছু বানানো সহজ নয়। সে মাথা নেড়ে বলল’ কাকে কবিতা  শোনাবে তুমি?’

‘ বিজয়কৃষ্ণ ঘোষ বলে এক বড় কবি  ঘোষপাড়ায় থাকেন। তাঁর কাছে যাব।তোমাকে  একদিন তাঁর কাছে নিয়ে যাব।‘

‘আমি! আমি কি কবিতা বুঝি?’

‘আরে যাবে। উনি শুধু  কবি নন। অনুবাদকও। গিয়ে দেখ না ভাল লাগবে।‘

সে  মাথা নাড়ল।

জগন্নাথ ঘড়ি দেখে বলল’ ভাই। আমি আর দাঁড়াব না। চলি”

‘আচ্ছা”

জগন্নাথ যেতে যেতে একবার ঘুরে বলল ‘ ব্রজের কি খবর গো?

সকলের একই প্রশ্ন! সে দায়সারাভাবে বলল ‘সকালে কোথায়  আমবাগানের দিকে গেল।‘

‘ ও তাই তো!  ওই ব্যায়াম! ওই নিয়ে পড়েছে ও। কলেজটলেজ একদম যাচ্ছে না”

জগন্নাথদার কথায় ঠাট্টা আছে। কল্যাণ শুনল। সে উত্তরে কিছু বলল না।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত