ধারাবাহিক উপন্যাস: অগ্নিশিখা (পর্ব-৮) । দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়
কানাই খুব চিন্তায় পড়ে গেল। সে বলল ‘ কি বলছ কি প্রভাতদা?’
প্রভাতদা বলল ‘ আমি বলছি না, সবাই বলছে। জিজ্ঞেস কর।‘
কানাই হতভম্ব হয়ে সবার মুখের দিকে তাকাল। এমন কি সম্ভব? সন্ধ্যে সাতটার পর নাকি মদ পাওয়া যাবে না! ভাবা যায়! অথচ তাই নাকি আইন হচ্ছে!
গ্রামের শেষ প্রান্তে বড়দীঘির ধারে এক ছোট একটা ঝুপড়ি মতো আছে।বেশ নিরিবিলি জায়গা।সন্ধ্যে থেকেই লোক জমতে শুরু করে। তারপর দু-তিন পাত্র মদ খেয়ে খানিক হইহল্লা করে সবাই বাড়ি ফেরে। সন্ধে পড়তে না পড়তে সেও আজ টুকটুক করে চলে এসেছিল।কিন্তু নতুন আইনের কথা শুনে মাথা গুলিয়ে গেছে। এ কেমন আইন রে বাবা! এমন আইন কে করল? সে নিশ্চয় মদ সম্পর্কে জানে না। মদ কি সকালে খাওয়ার জিনিষ ! মদ খেতে হয় রাতে। সন্ধ্যে ছটা সাতটার পরেই মদের নেশা জমে। যত রাত তত নেশা!
কানাই এক গেলাস টেনে সাৎ করে টেনে একটু মেজাজ দেখিয়েই বলল‘ অ্যা! কে করেছে ? এ নিয়ম? ইংরেজরা?’
‘ধুর। ইংরেজদের আর কাজ নেই। এসব এখানকারই মাতব্বরদের কাজ। তারাই করেছে’
এসব অঞ্চলে অনেকজনই মাতব্বর আছে। কেষ্ট মুখুর্জে, বিনোদবিহারী, আরো সব লোকজন। বেশ বড়লোক তারা। কারুর কলকাতায় উপরমহলে যোগাযোগ আছে। কেউ বা এখানকারই নামডাকওলা লোক। সে বলল ‘ ওরা তো সব ইংলিশ খায়। আর আমরা দেশী খেলেই দোষ”
প্রভাতদারা ফিরে আসার সময় কেষ্ট মুকুর্জে খুব বেগড়বাঁই করেছিল।দশজন লোককে ডেকে তাদের ভিটে-ছাড়া করতে চেয়েছিল। অনন্তদেবের জন্য তা হয় নি। সে তাই বলল ‘ এসব কেষ্ট মুকুর্জের কাজ। বড় নেতা হয়েছে তো”
কানাই জানে না কেষ্ট মুকুর্জে কেমন নেতা। কিন্তু তার সঙ্গে নাকি অনেক বড় বড় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। তার সম্পত্তিও যথেষ্ঠ। তার সঙ্গে থানার লোকদের সঙ্গেও যোগাযোগ আছে। সে বলল ‘ হতে পারে। কেষ্টবাবু করতে পারে। তবে এই আইন করা কি ঠিক হল?
প্রভাত দা বলল ‘ তোর ভাই হৃদয়কে গিয়ে জিজ্ঞেস কর”
প্রভাতদা খোঁচা দিল। হৃদয় এখন কেষ্ট মুখুর্জের লোক। মিলেও তার প্রতিপত্তি। আবার এলাকাতেও। লোকজন ভাইকে একটু ভয়-ই পায়। সে আর সেকথা বাড়াল না।কানাই রেগে উঠতে যাচ্ছিল। সবসময় খোঁচা ভাল লাগে না। কিন্তু প্রভাতদা বলেই সে কিছু বলল না। হাজারহোক ও বীথির বাবা! সে বলল ‘ যাকগে। যখন আইন হবে। এখন তো খাই।‘
প্রভাতদা বলল ; হুম”
বেশ রাতে সে ও প্রভাত একসঙ্গে ফিরতে শুরু করল।চারদিক নিঝুম হয়ে গেছে। তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না। এমন অভিজ্ঞতা তাদের আছে। বেশ কয়েকটা কুকুর চিৎকার করে। তারপর এমনি এমনি থেমে যায়।
তারা দুজন বাড়ি ফিরতে রওনা দিল। অনেকটাই পথ। টলতে টলতে ফেরার সময় ধীরে ধীরে নেশাটা কাটতে শুরু করল।দুজনে বেশ কিছুক্ষণ নীরবে হাঁটল। সামনে কিছুটা পরে প্রভাতদা একদিকে বেঁকে যাবে। আর সে যাবে অন্যদিকে। প্রভাতের পথ দিয়েও যাওয়া যায়।
সেই রাস্তা এসে গেলে প্রভাত বলল ‘ যা এবার।‘
কানাই অন্য রাস্তা ধরে। কিন্তু সে বলল ‘ না। তোমার সঙ্গে আমি সোজাই যাব।‘
প্রভাত বলল ‘ ওই রাস্তা দিয়ে যাবি?’ আমি তো ঢুকে যাব। তারপর?’
সে একটু থমকাল। যে রাস্তার কথা বলছে তা দিনের বেলায় একরকম।প্রভাত ঢুকে গেলে সে মুস্কিলে পড়ে যাবে। ওখানে একটা বিশাল বটগাছ আছে। জনশ্রুতি ওই গাছের আশেপাশে অশরীরীরা থাকে। অনেকদিন আগে বটগাছে কুসুম বলে একটি মেয়েকে গলার দড়ি দিয়ে মরেছিল। সে আত্মহত্য করেছিল নাকি তাকে কেউ মেরে ফেলেছিল তা জানা যায় নি। তারপর থেকে এ পথে রাতে কেউ আসে না। ছোটবেলায় কুসুমকে একবার দুবার সে দেখেছিল। সে মুখ ঝাপসা মনে আছে তার। কিনতু এখন সে নেশার আমেজে সেসব ভাবল না। সে বলল ‘ ও কিছু না। চল তো”
প্রভাতদা আর কিছু বলল না। সে হাঁটতে শুরু করল।
যেতে যেতে কানাই মাথা দুলিয়ে বলল ‘ তোমার মেয়েটার কথা ভেবে বড় দু;খ হয়।এইটুকু দেখেছি। এইটুকুন ছিল। ওর দু;খের কথা বউএর কাছে শুনেছি বড্ড কষ্ট পেয়েছি।‘
প্রভাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ‘আমার কপাল।‘ নইলে আর কি?’
‘হুম।
প্রভাত বলল ‘ আমার মেয়ের কিন্তু কোনো দোষ নেই।‘
সে মাথা নাড়িয়ে বলল ‘তা আর বলতে।‘
প্রভাত বলল ‘পালিয়ে না এলে ওকে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা মেরে ফেলত”
‘বেশ করেছে। তা ওর স্বামী খোঁজ নেয় নি’?
‘স্বামী নয় ভেড়া।আমিও খুঁজে পেতে এমন লোকের সঙ্গে বিয়ে দিলাম!’
কানাই কিছু বলল না। প্রভাতদার কথা শোনার জন্য সে উপোষ নয়নে চেয়ে ছিল। ওর পেটের কথা বার করার তালে আছে সে। সে জানে ও কথা লুকোচ্ছে। বীথিকে ওর স্বামী তাড়িয়ে দিয়েছে। ওর স্বামী নাকি অন্য মেয়েমানুষ পুষেছে। এ নিয়ে কম আলোচনা হয় নি। সে তবু বলল ‘ ভাগিস। তোমার মেয়ের ছেলেপুলে হয় নি।‘
কথাটার মধ্যে একটা ব্যাথা টের পেল প্রভাত। বীথির ছেলে না থাকার জন্য কটাক্ষ করল কানাই। দুটোর মধ্যে একটা যোগসুত্র আছে তা প্রভাত অল্পেই বুঝে গেল। সে চটে গেল কানাইর উপর। অপ্রসন্ন স্বরে বলল ‘ হলে আবার কি হত? ওর গলা টিপে জলে ভাসিয়ে দিতাম। একে রামে রক্ষা নেই সুগ্রীব দোসর।‘
‘আমিও তাই বলি’
‘তোকে কিছু বলতে হবে না। তুই যা এখন’ বলে প্রভাত হনহন করে পা চালাল।
প্রভাতদা চলে যেতে কানাই একা হয়ে পড়ল।চারদিক ছমছমে অন্ধকার। অবিশ্রান্ত ঝিঁঝিঁর ডাক শোনা যাচ্ছে। তার মধ্যে সে একা। এখন পুরোটা তাকে একা যেতে হবে। ভেবেই একটু চিন্তায় পড়ল সে। খানিকটা হাঁটার পর বট গাছের সামনে আসতে থমকে দাঁড়াল। বটগাছটা অন্য গাছের মতো নয়। এই অন্ধকারেও তার গায়ে কিসের আলো লেগে আছে! সে আলো কিসের তা সে বুঝতে পারে না।
সে সভয়ে বটগাছটাকে দেখল। বটের পাতা, কান্ড এমন কি মাটির নীচ পর্যন্ত সে আলো দেখতে পায়। আলো যেন রাতের নয় দিনের নয়। সেই আলোর উৎস খুঁজে সে গাছের উপরে তাকাল। আর তখনই সে দেখতে পেল আলোয় আলোয় কুসুম ভাসছে!
সেই কবেকার কুসুম ! স্পষ্ট তার মুখ!
কুসমকে দেখার পরই কানাই চিৎকার জুড়ল। গরু যেমন পথ না পেয়ে ডাকে তেমন জোরে সে চিৎকার করল । তার ডাক মিশে গেল পথের প্রান্তে। সে পায়ে একটা গতি আনার চেষ্টা করল । কুসুমের পা যেখানে ঝুলছে তার নীচ দিয়ে ঝুঁকে যদি সে বেরোতে পারে তবে সে বাঁচবে। । বাঁ-পা সামনে রেখে সে দৌড়াতে যাবে কুসুম তার দিকে চেয়ে হাসল!
আর একবার চিৎকার করার জন্য সে মুখ খুলল। কিন্তু তাকে বোবায় পেল। একবারে সাদা হয়ে গেছে ও। কোমর টলে উঠল তার। দুই হাঁটু দুদিকে ছেঁদড়ে গেল।আর শক্তি নেই।সে মাটিতে বসে পড়ে। তারপর বসারও জোর রইল না।। সে ধপাস করে শুয়ে পড়ল।
একটু পরে ভয়ে বা নেশার ঘোরে আচ্ছন হয়ে রইল। তারপর তার দুই চোখ জূড়ে গেল। যেখানে সে পড়েছিল সেখানে একটা উঁচু ঢিপি ছিল। পায়ের চাপে ঢিপি ভেঙ্গে গেল।ওতে উই বাসা বেঁধেছিল। তার পা বরাবর কতগুলি উই হাঁটু পর্যন্ত চলে এল। ভাগ্য ভাল ঢিপিটা পিঁপড়ের ছিল না!
ঘুম একটু পরেই জমে উঠল তার। শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে গেল।গলার মধ্যে যেখানে শ্বাস আটকে গেছিল স্বর ফুটছিল না। এবার ঘুম এসে তা এক ধাক্কায় সরিয়ে দিল। সে একদিকে কাত হল। ঠিক বাড়ির কায়দায়। এবার ঘুম হলে তার ভারী স্বপ্ন আসে।
কানাই বীথিকে স্বপ্নে দেখল।

দেড় দশক ধরে সাহিত্যচর্চা করছেন। পেশা শিক্ষকতা। নিয়মিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখেন। ‘কাঠবেড়ালি’ নামে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়তে। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস : ‘চার অঙ্গ’, ‘তিথির মেয়ে’, গল্পগ্রন্থ : ‘গল্প পঁচিশ’, ‘পুরনো ব্রিজ ও অন্যান্য গল্প’। ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘বীজমন্ত্র’ নামে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখেছেন।