| 9 মার্চ 2025
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক উপন্যাস: অগ্নিশিখা (পর্ব-৯) ।  দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

 

   ইদানিং  অনন্তদেব পুজো করা  বাড়িয়েছেন। সারাদিন পুজোর জন্য ঘরবার করতে হয়। পুজার্চনা করে জীবনভর অর্জন করেছেন তাতে তার পরিবারের চলে যাবে ঠিকই।  তাঁর রোজগার আরো একটু বেশী থাকলে মন্দ হত না। বড়ছেলে মন্মথের বাড়ি থেকে ফেরার পরই তা মনে হয়েছে।ওর শ্বশুরবাড়ির অবস্থা আগের মত নয়। ওখানে ওর কদর কমছে।মন্মথ নিজেও উদ্যমী নয়। তাকে শ্বশুর ব্যাবসা করার টাকাপয়সা দিয়েছিল  তা সে রাখতে পারেনি। সেসব কথাই তিনি শুনে এসেছেন। মন্মথ বড় ছেলে তার। তাকে ফেলে দিতে পারেন না। সুতরাং আয় বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই তাঁর। সেকারণে তিনি  অবস্থাপন্ন বাড়িতেও পুজো ধরছেন।

একটু আগে বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন অনন্তদেব। পরিমল এল। ও অনেকদিন পর এল। অফিসের কাজের জন্য ছয়মাস চলে গেছিল খুলনায়। কাজটায়  ও  বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে  তবু এরমধ্যেও  নিজের  সখ ছাড়ে নি। সময় পেলেই সে বারাকপুর থেকে কাঁচরাপাড়া পর্যন্ত ছুটে বেড়িয়েছে। পুরান মন্দির- মসজিদ, পুরান ঘাট, পুরান বাগান, পুরানো  লোকজনের কথা  সে   জানতে চায়। অনন্তদেবের নিজের অঞ্চলটা নিয়ে  বেশি আগ্রহ। নতুন খবর পাওয়ার জন্য তিনি উন্মুখ থাকেন।  পরিমল এসে বসার পর তিনি  জিজ্ঞেস করলেন ‘ তা কেমন আছ?’  তোমার নতুন কাজের জায়গা কেমন?

পরিমল  মুষড়ান গলায়  বলল ‘  এমনি ঠিক আছে। কিন্তু খুব সময় কমে গেছে ঠাকুরমশাই।‘

‘তা ঠিক। তবু তাঁর মধ্যে করে যাও। এটা বড় কাজ হবে।‘

‘চেষ্টা তো করছি।

তিনি   আরো কিছু কথা জিজ্ঞেস করার পর  লেখালিখির কথা জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন। তিনি  বললেন ‘ তা এর মধ্যে কি কিছু পেলে?’

পরিমলের  মুখে একটা হাসি ফুটল। সেও এখানে আসে প্রধানত এ কারণেই। দু-চারজন মানুষ তাকে উৎসাহ দেয়। নিয়মিত খোঁজ নেয়। তারমধ্যে  অনন্তদেব  একজন। সে বলল ‘  ওই একটু আধটু’

‘তা বেশ। বল শুনি”

‘নদীর পাড়ে পাড়ে একসময় কত যে ব্যবসা চলত ঠাকুরমশাই।কি বলি আপনাকে! কোনটায় মাটির জিনিষপত্র, কোনটা গুড়ের। গরুর গাড়ি করে সব গ্রাম থেকে ঘাটে ঘাটে  আসত। তারপর নৌকা করে লোকেরা কিনে নিয়ে যেত।‘

তিনি  মাথা নাড়লেন ‘ আমিও শুনেছি। চারদিক থেকে নাকি লোকে তখন এ অঞ্চলে গুড় ,মাটির পাত্র,কলস  কিনতে আসত। ‘

পরিমল বলল ‘ হ্যাঁ। শীতকালে বসত গুড়ের হাট। গাড়িগাড়ি  খেজুরের গূড় নিয়ে হাট বসত।

তিনি  বললেন  ‘ এসব কতদিন আগের কথা পরিমল?

‘হু। প্রায় দু-তিনশো  বছর হবে।‘

সত্যিই  পরিমলের  একনিষ্ঠতা আছে। ঘুরে ঘুরে ও একটা দলিল তৈরী করছে। তিনি   মানসচক্ষে দেখতে পান সারি সারি নৌকা হুগলী নদী বেয়ে চলেছে। কোনটা যায় ফরাসডাঙ্গা, কলকাতার দিকে। কোনটা সোমরা, বলাগড়ের দিকে যায়। তিনি  প্রসন্ন হয়ে   বলেন ‘ আজ কিন্তু খেয়ে যাবে পরিমল। আগের দিন খাও নি’

পরিমল মাথা নাড়িয়ে বলে ‘ আচ্ছা”

আরো কিছুক্ষন  কথা হল। তারপর  অনন্তদেব অন্য কথা জিজ্ঞেস করলেন।   তিনি বললেন ‘ তা তোমার এখন ইচ্ছে কি?  ‘খুলনাতেই থাকবে  নাকি এদিকে ফিরবে?’

পরিমল বলল ‘ ইচ্ছে তো আছে কলকাতার দিকে ফিরে আসার।এবার চাকরি ছেড়ে ভাবছি  কোনও কলেজে অধ্যাপনা করব।‘

তিনি  মাথা নাড়লেন। বুকের ভেতর থেকে চাপা একটা মনখারাপ তাকে ছুঁয়ে গেল। এমন ইচ্ছে তাঁর এখনো মাথায় ঘোরে।  কিন্তু  বজ্রের তেমন কোনো ইচ্ছে নেই। তিনি সংবাদ পেয়েছেন কলেজেও সে ঠিকমতো যায় না।  ভেবে একটু উন্মনা হয়ে যান। ব্রজকে নিয়ে আশা তাঁর এখনো যায় নি। তাঁর নিজের খানিকটা আদল ওর মধ্যে দেখতে পান। কিন্তু ওর কোনো উচ্চাকাঙ্খা নেই। সেটাই তাকে বেশি পীড়ন করে। তাছাড়া আরেকটা ভয় আছে তাঁর। বজ্র  ধুমপান করে। জানার পর থেকেই  তিনি উদবিগ্ন হয়ে উঠেছেন। তাদের পরিবারে আজ পর্যন্ত কেউ  ধুমপান করে নি।


আরো পড়ুন: অগ্নিশিখা (পর্ব-৮) ।  দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়


পরিমল বিকেল  পর্যন্ত থাকল। খাওয়াদাওয়া বিশ্রামের পর  আবার দুজন মিলে কিছুক্ষণ বসলেন।

 বেলা পড়ে আসছে। অনন্তদেবের আঙিনা থেকে  পথের কিছুটা চোখে পড়ে। কয়েকজন পড়ুয়া পড়ে ফিরছে। কল্যাণও রয়েছে। ওরা যে স্কুলে পড়ে তা বড় রাস্তার উপর। এখন সে রাস্তায় বাস চলে। সারাদিনে দুটো বাস যাতায়াত করে।

কল্যাণকে   দেখে তাঁর মুখে আবার একটা আশার ঝিলিক ঝলকে উঠল। ব্রজের মতো মেধাবী না হলেও  ও পড়াশুনা করতে চায়।  ও কি পরিমলের মতো আরো পড়াশুনা করবে? তিনি  বলেন ‘ কল্যাণ শুনে যাও”

ও দৌড়ে আসে।

তিনি বলেন ‘ আজ পড়া কেমন হল?’

‘ভাল’

‘সব পারছ তো?’

‘হ্যাঁ’

‘তুমি পরিমলদাদাকে চেন তো?

‘হ্যা”

তিনি  বলেন ‘ যখন দরকার পড়বে পরিমলদার কাছ থেকে জেনে নেবে।‘

কল্যাণ বলল ‘ আচ্ছা”

তিনি  বলেন, এবার যাও হাত মুখ ধুয়ে নাও।‘

কল্যাণ  চলে গেলে  অনন্তদেবের  মুখে একটা  হাসি ফোটে। তাঁর যেন মনে হয় এখনো আশা আছে। কল্যাণ অনুগত। পড়াশুনায় মন আছে। আগামিদিনে হয়ত সে এই পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করবে।

পরিমল এতক্ষণ কথা বলে নি। সে এবার  বলল ‘ আরো কিছু তথ্য পেয়েছি  ঠাকুরমশায়।

 তিনি  মনোযোগ হারিয়েছিলেন। ছোটছেলের  কথা ভাবছিলেন। তিনি বললেন’ কিরকম?’

 ‘এখানে চৈতন্যদেবের দুই অনুগামীও থাকতেন।‘

তাঁর  চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি  বললেন  ‘  হ্যাঁ। হ্যাঁ। আমিও শুনেছি। জানি। জানি। শ্রীকানত সেন আর বল্লভ সেন। ওরা থাকতেন বৈষ্ণব পাড়ায়।‘

 পরিমল চৈতন্যদেব সম্পর্কে আরো কিছু কথা বলল। তাঁর নাকি এ অঞ্চলে আসবার কথা ছিল।আসতে পারেন নি। তবে  এ নদী ধরেই তিনি গেছিলেন।

অনন্তদেব শুনতে শুনতে আবিষ্ট হয়ে যান।  তাঁর যেন মনে  হয় শ্রীচৈতন্যদেবকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন।  নৌকা করে  শ্রীচৈতন্য দুহাত তুলে আশির্বাদ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি  আবেগে ভেসে বলেন ‘পরিমল। খুব ভাল কাজ করছ তুমি। চমৎকার হচ্ছে।‘

পরিমল বলে ‘ আপনার আশির্বাদ ঠাকুরমশাই। আজ উঠি।‘

বেশ খানিকক্ষন আগে পরিমল চলে গেছে। অনন্তদেব নিজের মনে কিছু একটা ভাবছিলেন। এখন  খেয়াল হতে তাকিয়ে দেখলেন  চারদিক বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। তার হঠাৎ  খেয়াল  হল ব্রজ বাড়ি ফেরে নি। তিনি  হঠাৎ চিন্তার মধ্যে পড়লেন। বড় রাস্তায় আলো থাকে। কিন্তু ভেতর রাস্তায় আলোর ব্যাবস্থা এখনো  হয় নি।  রাতে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে গেলে কেউ কেউ  প্রদীপ বা মশাল ব্যবহার করে।অনুষ্ঠানে হ্যাজাক ব্যাবহার করে। কিন্তু সাধারণ সময়ে সন্ধ্যের পর চারদিক ছমছমে হয়ে যায়। লোকজন খুব বেশী বেরোয় না।কিন্তু এখনো পর্যন্ত  ব্রজ এল না কেন?  তিনি নতুন করে চিন্তায় পড়লেন।

 ঘরে ঢুকে দেখলেন  কল্যাণ বইপত্র গুছিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তিনি ভ্রু-কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন’ ব্রজ এখনো এল না কেন? জানো কিছু?’

সে  বলল ‘ না। বাবা”

তিনি  মাথা নাড়লেন। অন্য একটা বিষয়ে তিনি চিন্তিত।ব্রজ পড়াশুনা যদি না করতে চায় তাহলে ও কি করবে?’ তিনি  বললেন ‘ দাঁড়াও। আমি একবার ঘাটে খোঁজ নিয়ে আসি ফেরী এসেছে কিনা?’

অনন্তদেব বেরোতে যাবেন সেইসময়ে বাইরে থেকে কারা যেন ডাকল।  উঠোনে এলেন। ঝাপসা অন্ধকারে প্রথমে কিছুক্ষণ বুঝতে পারলেন না কারা। চোখের জ্যোতি  আগের মতো নেই। তিনি বললেন’ কে?’

‘আমরা  ব্রজবিলাসের বন্ধু”

তিনি  শঙ্কিত হলেন। হঠাৎ এই রাতে  ওর বন্ধুরা কেন? তিনি জিজ্ঞেস করলেন ‘ তা সে কোথায়?’

‘ওই যে।“

তিনি  দেখলেন  দলের মধ্যে ব্রজও দাঁড়িয়ে আছে। আশঙ্কা দুর হল তাঁর। বুক ধড়ফড়ানিটা কমেছে।এই ছেলেটাকে তিনি কেন যে অতিরিক্ত ভালবাসেন তিনি জানেন না। ওর চেহারা, হাবভাব সবকিছুর মধ্যেই একটা দামালপনা আছে। তবু কোথায় যেন ভয় হয়। তিনি বললেন ‘  হ্যাঁ। বল। কি ব্যাপার?’

‘ আপনার কাছে একটা অনুমতি চাইতে এসেছি।“

‘অনুমতি?’

‘হ্যাঁ। রামবাবুর বাগানে  আমরা  একটা ব্যায়ামাগার খুলতে চাই।“

 এইবার মনে পড়ল  তাঁর। বীথি বলছিল। কদিন আগে তাকে ও জানিয়েছিল  জঙ্গলটায় নাকি রোজ  ব্রজের বন্ধুরা  আসাযাওয়া করছে। তিনি পাত্তা দেন নি।  তাঁর বাড়ি থেকে  রামবাগানবাবুর বাগান বেশ দুরেই। সেখানে কে আসবে না আসবে তা জেনে তার লাভ কি?’ বীথি তবু শোনে নি। সে বলেছিল ‘ আপনার কাছে ওদের পাঠিয়ে দেব। আপনি যা বলবেন তাই হবে”

তিনি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেছিলেন।মন্দিরও তাঁর নয়।আশপাশের জায়গাও  তাঁর নয়। তিনি  শুধুমাত্র প্রভাতদের   একধারে  একটা ঘর করতে বলেছিলেন। সেকারণেই হয়ত বীথি  ভেবে বসে আছে তাঁর অসীম ক্ষমতা।  জঙ্গলে যে কেউ যা খুসী করতে পারে  তাঁর কাছে অনুমতি চাওয়া হাস্যকর ব্যাপার। তবু তিনি  তা  প্রকাশ্যে বললেন না। গুরুত্ব পেতে তাঁর ভাল লাগল। তাই তিনি গম্ভীরস্বরে বললেন ‘  তোমাদের কথা শুনলাম। একদুদিন পর জানাব।‘

ছেলেগুলো মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। অনন্তদেব  ঘরে ফিরলেন। ব্যায়াম করা ভাল বিষয়। বীথিকে বলতে হবে।তাছাড়া বাগান এখন বিরাট জঙ্গলে পরিনত। ব্যায়ামাগার হলে  জায়গাটাও পরিস্কার থাকবে। লোকজন যাতায়াত করবে। বীথির আপত্তি কেন কে জানে?

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত