| 25 ফেব্রুয়ারি 2025
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অনুবাদ গল্প: পিশাচ । আকাশ দীপ্ত ঠাকুর

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

আকাশ দীপ্ত ঠাকুরলেখক পরিচিতি—১৯৭৩ সনে জন্ম।যোরহাট বালিগাঁও নিবাসী,জগন্নাথ বরুয়া মহাবিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক আকাশদীপ্ত ঠাকুর সাম্প্রতিক অসমিয়া সাহিত্যের ইতিহাসে একটি পরিচিত নাম।উপন্যাস, ছোটো গল্প,কবিতা,শিশু সাহিত্যের ক্ষেত্রে শ্রীঠাকুর উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছেন।উপন্যাসগুলি যথাক্রমে ‘উপকূল’,‘আরোহী’,‘সিপারে যমুনা’এবং ‘সাঁজর তরা’।ছয়টি গল্প সঙ্কলনেরও রচয়িতা লেখকের একটি অন্যতম শিশু উপন্যাস ‘বেলিফুলর রঙ’।

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ- বাসুদেব দাস


 

      চারপাশে কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার। মুক্ত মাঠটার শেষ প্রান্তে থাকা জঙ্গলটা থেকে মাঝেমধ্যে ভেসে আসে নিশাচর পাখির চিৎকার। গ্রামটা সেই কবেই শুয়ে পড়েছিল। হাতে জ্বলন্ত মশালটা নিয়ে অপূর্ব একা সেই গভীর রাতে অন্ধকারে জঙ্গলের এক প্রান্তে শ্মশানের কাছে শুইয়ে রাখা শবটার দিকে এগিয়ে আসছিল। মশালের ক্ষীণ আলো চারপাশের গভীর অন্ধকার ভেদ করতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল। সামনের রাস্তাটার কিছুটা অংশ কেবল আলোকিত হয়ে উঠেছিল। অপূর্ব আন্দাজে বুঝতে পারছিল আরও কিছুটা দূর যেতে হবে। ভয়ঙ্কর রাতটিতে চারপাশে অন্য কোনো সাড়াশব্দ নেই ।

      শ্মশানের কাছে অপূর্ব পৌঁছে গেল। অদূরে সংস্কারের জন্য শবটা পড়ে রয়েছে; কিন্তু মশালের স্থিমিত আলো সেই জায়গাটায় পৌঁছাতে পারছে না। অনুমানের ওপর নির্ভর করে এগিয়ে চলা অপূর্ব কেবল বুঝতে পারছিল—শবটা ওখানটাতে রয়েছে। হঠাৎ…তার কানে এলএকটা আশ্চর্য শব্দ; ঠিক যেন কেউ কোনো কিছু চিবোচ্ছে—খচ খরচ খরচ…। অপূর্ব কান খাড়া করে রইল—কোথা থেকে আসছে শব্দ। দুটো মুহূর্ত দাঁড়িয়ে ভালোভাবে শুনতে চেষ্টা করল। পুনরায় সেই একই শব্দ…। হ্যাঁ অপূর্ব ঠিকই অনুমান করতে পারছে—ওখান থেকেই আসছে শব্দটা; যেখানে শবটাকে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। অপূর্ব ভয় পেল, বোঝাতে না পারা ভয়…; কিন্তু ভয় করে থাকলে তো হবে না। পিতার মৃত দেহটার কাছে ভাই অবনীকে সে পাহাড়া দেওয়ার জন্য রেখে গিয়েছিল, যাতে পাশের জঙ্গল থেকে কোনো বন্যজন্তু এসে শবদেহ ভক্ষণ করতে না পারে। হাতের মশালটার ক্ষীণ আলোতে সে বুঝতে পারছে না ওটা কিসের শব্দ। আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে অপূর্ব ডাকল —‘অবনী…;কী করছিস তুই?’

      অবনীর কোনো সাড়া শব্দ নেই।অপূর্ব আরও কিছুটা এগিয়ে গেল। মশালটার আলোতে এবার সেই জায়গাটা দেখা গেল। সেই শব্দের উৎস। আর…এটা কী দেখল সে!… এটা…এটা একটা পিশাচ। বাবার শব্টা খচখচ করে ভক্ষণ করতে থাকা পিশাচ। তার মুখে রক্তের দাগ…বীভৎস! কে…কে এটা? অবনী? না সত্যিই একটা পিশাচ!

      মুহূর্তের মধ্যে একটা বিকট চিৎকার করে জায়গাতেই ঢলে পড়ল অপূর্ব।

      পরেরদিন পুরো গ্রামটাতে কথাটা জানাজানি হয়ে গেল—গ্রামে একটা পিশাচ বেরিয়েছে।ধনেশ্বর কেওটের ছোটো ছেলে অবনী আর মানুষ নেই।একটা পিশাচ হয়ে পড়ল সে।সৎ্কারের জন্য রেখে দেওয়া বাবার শবটা ভক্ষণ করা সে একটি পিশাচ।চারপাশে হইচই শুরু হয়ে গেল।ছোটো ছেলেমেয়েদের মা-বাবা বাড়ি থেকে বেরোনো নিষেধ করে দিল—পিশাচ খেয়ে ফেলবে,ঘরের ভেতরে থাক।ঘরের জলটুকু রাস্তার পাশের বড়ো পুকুর থেকে এনে রাখব বলে ভেবেও বাড়ির বৌয়েরা দল বেঁধে যেতে হল।সন্ত্রাস,ভয়,শঙ্কায় প্রত্যেকেই জড়োসড়ো হয়ে পড়ল।

      আর অবশেষে গ্রামপ্রধানকে বলে সভার আয়োজন করতে হল—‘আপনারা সবাই জানেন গ্রামে পিশাচের প্রাদুর্ভাব হয়েছে।রাত দুপুরে বাবার শবদেহটা চিবিয়ে খাওয়াটা সাধারণ কথা নয়।ভয়ানক কথা।অবনীকে আমরা শৈশব থেকে দেখছি।সে কী ধরনের ছেলে সে কথা গ্রামের কাউকে আলাদাভাবে জানানোর কোনো প্রয়োজন নেই।এখন সে যে ধরনের আচরণ করছে তা সে নিজে থেকে করছে না।তার শরীরে পিশাচ ভর করেছে।পিশাচ কখন কাকে ভক্ষণ করবে তার ঠিক নেই।তাই…।’

      গ্রামপ্রধান কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে পাশে বসে থাকা জ্যেষ্ঠ সদস্য মুহিরামের দিকে তাকাল।জনতার মধ্যে চলতে থাকা চাপা উত্তেজনাটা একটা গুঞ্জন ধ্বনির রূপ নিয়ে সভার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল।গ্রামপ্রধান এবং মুহিরাম নিজের মধ্যে কিছু আলোচনা করার পরে গ্রামপ্রধান পুনরায় জনগনের দিকে তাকাল—‘জনগন,কলরব করবেন না,চুপচাপ থাকুন।আমার কথা মন দিয়ে শুনুন।যদিও আমরা প্রত্যেকেই জানি ধনেশ্বর কেওটের পরিবারকে একঘরে করে রাখা হয়েছে;তবুও এখন সেই ছোটো ছেলেটার শরীরে ভর করা পিশাচটা তো জানে না—কে একঘরে,কে সঙ্গের।অপকার করব বলে পিশাচ কাউকে ক্ষমা করে না;হলে সবারই হবে।কী ঠিক,কে জানে তার শরীরে ভর করা পিশাচটা তার বাবাই হয়তো।হতে পারে,আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু নেই।ধনেশ্বর মরেও তাই ছোটো ছেলের গায়েই ভর করেছে।’গ্রমাপ্রধান কিছুক্ষণর চুপ করে রইলেন।এবার জনগনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলেন।–‘আচ্ছা জনগন,এখন বিপদের সময়।তাই গ্রামটির কথা ভেবে আমরা পিশাচ তাড়ানোর ব্যবস্থা করা উচিত।বাঁধের ওপারে ঐ শিবথানের পাশের রাঙা বেজের কাছে…

      অপূর্ব শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।ভাবার মতো শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল।ভেতরের ঘরে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে একমাত্র ভাই অবনীকে।সে বারবার কিছু আশ্চর্য,অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকা অপূর্ব দেখতে পাচ্ছে।গত রাতে যা হয়েছিল,সেটা সে পুনরায় ভাবতেও পারছে না,কিন্তু এখন সে যা দেখছে,সেটাও তো স্বাভাবিক নয়।ছোট্ট ঘরটাতে তাকে আলাদাভাবে সরিয়ে রাখার সুবিধা নেই যদিও সেখানে অন্য একটি ঘরে তাকে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে।মেঝেতে বসে পড়ে সে একদৃষ্টে কিছু একটার দিকে তাকিয়ে থাকে।মাঝে মধ্যে মাথা নেড়ে মুখদয়ে গোঁ গোঁ শব্দ করে।এত আদর করে ডাকলেও সে প্রত্যুত্তর দিতে ভুলে গেছে।অন্য একটি ঘরের মেঝেতে পেতে রাখা পাটিটাতে বসে নিয়ে ওদের মা বাখরী কেবল কাঁদছে,হাউমাউ করে কাঁদছে।ওদিকে গ্রামে বিচার সভা পাতার কথাও অপূর্ব শুনেছে।হয়তো বা দুই তিনজন ওঝা এসে অবনীকে ঝাঁড়-ফুক করবে।কতদিন এসব চলবে অবনী জানে না।যদি অবনী পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে,তাহলে কোনো কথা নেই,আর যদি স্বাভাবিক না হয়…তাহলে…।

      তাহলে কী ধরনের পরিস্থিতি হতে পারে অপূর্ব ভাবতেই পারে না।ধীরে ধীরে আরও অনেক কথাও ভবতে না পারা হয়ে পড়ে সে।যেভাবে আমি এখন কিছুক্ষণ পর্যন্ত কিছু ভাবতে না পারা অবস্থায় বসে আছি।এই সত্য কাহিনিটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে একটা নিটোল গল্পের রূপ দেবার জন্য আমি বারবার দিশাহারা হয়ে পড়তে চলেছি।অনেক কথাই মনের মধ্যে আসা যাওয়া করছে।কোন পরিবেশটাকে আমি কীভাবে সাজাব?এতটুকু পর্যন্ত লিখে আমি থমকে গেছি।এটা মূল কাহিনির মাঝখানটা শুধু।কাহিনিটার সামনের দিকটা লিখব বলে অপেক্ষা করে ভাবছি-সেদিনের সেই পরিবেশটা পুনরায় মনে করি,যেখানে আমরা ছয়জন গল্পকার বসেছিলাম।গ্রন্থমেলার মাঠে অনুষ্ঠিত হওয়া ‘গল্পের আমেজ’অনুষ্ঠানটিতে।একবার চোখ বুজে ফেললাম আমি।পরিবেশটা মনে ভেসে এল…।একজন জ্যেষ্ঠ গল্পকার ডঃগায়ত্রী বরচেতিয়া অনুষ্ঠানটা সঞ্চা্লন করতে গিয়ে ঠিক যেন গল্পের মতোই বলে যাচ্ছিল—‘ …আজ আমি গল্প বলব,আপনারা শুনবেন।কিন্তু গল্প কোথায় আছে?কোথায় আছে গল্পগুলি?গল্পগুলি কেবল এই জায়গায় আবদ্ধ হয়ে থাকে নি।প্রকৃ্ত গল্প আছে ঐ ওখানে…এই অস্থায়ী প্রেক্ষাগঘের ওপারে…ঐ সারি সারি করে থাকা ছোটো ছোটো মণি এবং বালা বিক্রি করা দোকানগুলিতে,ঐ মাটির ছোটো পাত্রে ভরে দেওয়া চায়ের কাপের আমেজে,ঐ জলের ফোয়ারাটার ওপারে সেই মানুষগুলির  মধ্যে,ঐ ফাস্টফুডের দোকানে চাউমিন খেতে থাকা প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলের চাহনিতে…

।এই যে শিশুটি মায়ের আঁচল ধরে টানছে ঐ পুতুল বিক্রি করা দোকানটার দিকে—গল্প তাতে আছে,সেটা ঐ রিক্সাওয়ালাটি বয়স্ক মহিলাকে যে গ্রন্থমেলার দ্বারে নামিয়ে রেখে চলে গেল,মানুষটা এদিকে ওদিকে একবার তাকিয়ে প্রবেশদ্বার দিয়ে চলে এল—গল্প সেখানে আছে।গল্প আপনার বুকে রয়েছে,আমার আত্মায় আছে,অনুভূতিতে আছে।আলাদা ভাবে আমি আর কী গল্প বলব…?’

      আর সেই সঞ্চালকের গল্প বলে মনে হওয়া কথাগুলির মধ্যে মধ্যে আমরা গল্পের বিষয়ে বলতে প্রস্তুত হয়েছিলাম।আমরা,মানে আমি –ডঃ বন্দিতা গোহাঁই,গীতাশ্রী সোনোয়াল,জয়জিৎ বরুয়া,ডঃনীলাভ ভট্টাচার্য,লয়নীতা কৌশিক এবং প্রীতি উজীর।আমরা গল্প কেন লিখি,কীভাবে লিখি,কীভাবে প্রথম গল্পটি শুরু হয়েছিল…সেইসবই ছিল আলোচনার বিষয়।আমি বলেছিলাম কীভাবে আমি গল্প লিখতে শুরু করেছিলাম।চোখের সামনে দেখা একটি স্পর্শকাতর ঘটনাকে ভবিষ্যতে একদিন গল্পের রূপ দেব বলে কীভাবে সুদীর্ঘ সময় অন্তরে সঞ্চিত করে রেখেছিলাম,অবশেষে একদিন সেই গল্প প্রকাশিত হয়েছিল,পাঠক সাদরে বরণ করে নিয়েছিল সেই সৃষ্টিকে এবং সেভাবেই একদিন বন্দিতা  গোহাঁই নামের একজন অধ্যাপক হয়ে পড়ল বোধহয় গল্পকার…।আমাকে গীতাশ্রী পরে বলেছিল—একটা পৌ্রানিক কাহিনিকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল জীবনের প্রথমটি গল্প;জয়জিত বলেছিল পথে ঘাটে সাক্ষাৎ করা অসংখ্য কাহিনির কোনটি কীভাবে একটা সৃষ্টিতে পর্যবেশিত হয়…।আর শেষে প্রীতি এবং উজীরের পালা পড়েছিল।

      মনে করতে চেষ্টা করলাম –কীভাবে আরম্ভ করেছিল প্রীতি…?—‘এই যে আমরা গল্পের কথা বললাম,এই যে আমরা চোখের সামনে দেখছি এক একটি সমাজ;হয়তো সেটা দেখে থাকতেই আমাদের সীমাবদ্ধ হয়ে থাকতে পারে আমার ধারণা।সীমার ওপারের অনেক অকথিত কাহিনি আছে—সেইসব আমরা জানি কি?কখনও জানার চেষ্টা করেছি কি? আমি যদি আজ আপনাদের এইধরনের একটি সমাজের বিষয়ে বলি,হয়তো আপনাদের বিশ্বাসই হবে না।একটি গ্রাম…কত ভেতরের গ্রাম আমি দেখেছি?কতটা ভেতরের গ্রাম বিষয়ে আমি জেনেছি?যা দেখেছি,সেটা অসাধারণ।কিন্তু অসাধারণ হতে পারে সেই একটি গ্রাম—যেখানে আমাদের ঠাকুরমারা পিসিদের শিখিয়েছিল—পুরুষের চোখের দিকে তাকাবি না,পুরুষ হল সূর্য।নারী হল চন্দ্র,যার নিজের আলো নেই।পুরুষের আলোতে উদ্ভাবিত হওয়া উচিত নারী।সেটাই ধর্ম,সেটাই রীতি।’দুশো মানুষে পরিপূর্ণ হয়ে থাকা নিস্তব্ধ সভাগৃহ।প্রীতি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেছিল।পুনরায় অন্য একটি সুরে বলে গিয়েছিল—‘মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কাহিনি শুনে সেটাকে গল্পরূপ দেওয়া যেতে পারে,উপন্যাস সৃষ্টি করা যেতে পারে;কিন্তু দুঃখের শিকড় কত গভীরে থাকে…আমরা হয়তো অনুমান করতে পারব না।আমি পারি,কারণ আমি দেখেছি।আমার শৈশবে আমার ঠাকুরমা পেছনের বারান্দায় কয়েকজন মানুষকে ভাত বেড়ে দিচ্ছিলেন।ভাত খেতে থাকার সময় প্রতিটি গরাসে মানুষগুলির হেৎকি উঠছিল।আমাকে অবাক হতে দেখে ঠাকুরমা আমাকে বলেছিলেন –কিছুই বলবি না ,ওরা দিনের পর দিন উপোস করার পরে আজ এতদিনে ভাতের মুখ দেখেছে,আমরা বুঝতে পারি।তাই…।’

      অপেক্ষা করছি আমি।মূল কাহিনিটার উৎস হারিয়ে ফেলেছি নাকি?না;প্রীতিও উৎস হারায় নি।বরঞ্চ সেদিন প্রীতি যেন নিজেকে অনন্য রুপে আত্মপ্রকাশ করার জন্য এগিয়ে গিয়েছিল।তন্ময় হয়ে শুনতে থাকা শ্রোতা দর্শককে সে বলেছিল—‘আপনাদের আমি একটা কাহিনি বলব।হয়তো বিশ্বাস করবেন না,কিন্তু সম্পূর্ণ সত্য এই কাহিনি।এই কাহিনি সেই গ্রামের,যেখানে আমি শৈশব অতিক্রম করেছিলাম।যে গ্রামের বিষয়ে একটা আভাস কিছুক্ষণ আগে আপনাদের জানিয়েছিলাম।আসলে এটা সাজিয়ে গুছিয়ে বলা অলীক কল্পনা নয়।এই কাহিনি সেই গ্রামের,যেখানে খোলা মাঠের সীমানায় থাকা বটগাছের গোড়ায় ব্রহ্মদৈত্য দেখে এসে বাড়ির উঠোনে রক্তবমি করা মানুষ আমরা দেখেছিলাম।ডোবায় ভোরবেলা ভূত মাছ খাচ্ছিল।বুকের মধ্যে চোখ থাকা কন্ধকাটা থাকা ভূত জেলের গায়ে চেপে বসেছিল…।’

      লিখতে বসে আবার ভাবছি—কী করা ভালো হবে?প্রীতির মুখের কথাটা আমি এখন মনে করার চেষ্টা করছি।যদি সত্যিই আমি গল্পরূপ দেব বলে ভাবছি,তাহলে কথাগুলিতে কিছু রঙ মাখানো উচিত হবে কি? না হলে এটা গল্প হবে কি?প্রকৃতই এটি সত্য ঘটনা।হতে পারে সেই পরিবেশ আমাদের কাছে অপরিচিত, কিন্তু প্রীতি দেখে এসেছে সেই পরিবেশ। সে যাই হোক না‌ লিখে যাই কথাগুলি। পৃথিবীর মুখের কথাটা লিখে যাওয়ার সময় একটু তো পরিবর্তিত হবেই; হওয়াটাই স্বাভাবিক।

      … বহুবছর আগেই গ্রামটি ধনেশ্বর কেওটের পরিবারকে এক ঘরে করেছিল। এই যে এক ঘরে করার কথা বলা হয়েছে, সেটা আমরা  দেখা এক ঘরে করার মতো নয়।এক ঘরে মানে এক ঘরে। সবকিছু কেবল সেই ঘরের লোকজনকে করতে হবে। অন্য মানুষ আপদে-বিপদে ফিরেও তাকাবে না। দুই পুত্র অপূর্ব অবনী আর স্ত্রী বাখরী— এরাই ছিল ঘরটির মানুষ। সেই রাতে  ধনেশ্বর কেওটের মৃত্যু হল।বাখরীও হৃদয় ভাঙ্গা কান্না কাঁদল। সেই কান্নায় অনেক কথাই ছিল। মানুষটা চলে গেল, সৎকার করতে হবে দুই ছেলে। তাও মাঝরাতে। কেঁদে গাছের পাতা ঝরালেও গ্রামের কোনো একজন এগিয়ে আসবে না, আসতে পারে না।

      তাই অপূর্ব নিজেকে যতটা পারে সামলে নিল। মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়া ভাই অবনীকেও সেই সামলাল। দুই দাদা ভাই একসঙ্গে ধনেশ্বরকে উঠোনে বের করে নিল। বাগানের বাঁশ কেটে চিতা তৈরি করল। সৎ কাজের জন্য যাবতীয় সমস্ত কিছু জোগাড় করার পরে মশাল জ্বালাল। সেই আগুনের মিটমিটি আলোতে দুজনেই কাঁধে পিতার শবটা কোনরকমে নিয়ে গেল সেই ভয়ঙ্কর জঙ্গলের পাশের শ্মশানে।

      তবে শ্মশানের আশেপাশে পৌঁছাতেই মশালের আগুনটা নিভে গেল।ঘুটঘুটে অন্ধকার জায়গাটা  ঘিরে ধরল। উপায় বিহীন হয়ে দুজনেই কাঁধ থেকে শব দেহটা নামাল। মশালটা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পুনরায় জ্বালিয়ে আনা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। দুজনেই একসাথে বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়,শব দেহটা কোনো বন্য পশু ভক্ষণ করে ফেলতে পারে। ধৈর্য হারিয়ে কাজটা সমাধা করতে চাওয়া অপূর্ব অবনীকে বলল–’ তুই শব দেহটার কাছে থাক। আমি চট করে বাড়িতে গিয়ে মশালটা জ্বালিয়ে আনি।’

      আর…সেই সময়টাতে…অপূর্ব বাড়িতে  গিয়েমশালটা জ্বালিয়ে পুনরায়  তার কাছে ফিরে আসার সময়টুকুতেই মানুষ থেকে পিশাচ হয়ে গেল অবনী।

       আর পারা যায় না। আমি বসে থাকা চেয়ারটাতে মাথাটা পেছনে হেলান দিলাম। কাহিনিটা এখনও শেষ হতে বহু বাকি। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে প্রত্যেকে শুনছিলাম প্রীতির কথা। পিতার শব দেহ ভক্ষণ করে অবনীর পিশাচ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু কাহিনিটা এখানে সমাপ্ত হল না। উদগ্রীব হয়ে পড়া প্রত্যেকের সামনে প্রীতি শেষ পর্যন্ত বলে গিয়েছিল সমগ্র কাহিনিটা। নিরক্ষর অন্ধবিশ্বাস কুসংস্কারে পরিপূর্ণ গ্রামের দুই দাদা ভাইয়ের সেই করুণ কাহিনি।

      আমিও সম্পূর্ণ করব সেই কাহিনি। ঠিক এইখান থেকে আমি প্রীতিকে রেহাই দেব। প্রীতি দেওয়া পরিসমাপ্তিকে আমি পরিবর্তন করব না, কেবল আমার ধরনে সাজিয়ে নেব। এটা এক নির্মম সত্য ঘটনা,তার মধ্যে রং চড়ানো যাবে না; কিন্তু গল্পের আকার দিতে পারব নিশ্চয়।

       ঘরের ভেতর আবদ্ধ করে রাখা অবনীর শরীরে আশ্রয় নেওয়া পিশাচটাকে দূর করার জন্য জনতা ওঝা পাঠাল।পিশাচের হাত থেকে রক্ষা না পেলে সে কার উপর কিভাবে অত্যাচার করবে তার ঠিক কী। সেদিন পিতার শব ভক্ষণ করল, পরে মানুষকে জীবন্ত ভক্ষণ করবে। ওঝার মন্ত্র, ঝাড়ফুঁকে অতিষ্ঠ হয়ে পড়া অবনী মাঝেমধ্যে  উন্মাদের মতো আচরণ করতে লাগল। বাখরী  ভয় পেয়ে গেল। অসহায় হয়ে  সবকিছুই অপূর্বকে তাকিয়ে দেখতে হল।

      একদিন পার হয়ে যাবার পরেও কোনো ভালো ফল না পাওয়ায় দূর থেকে লক্ষ্য করতে থাকা জনগণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। অপূর্ব চিন্তিত হয়ে পড়ল। ভেতরে ভেতরে সে একটি বিশেষ কারণে ভয় পেল যে কারণটা সে কাউকে মুখ ফুটে বলতে  পারবে না,অথচ সেটাই যে হবে সেই সম্পর্কে সে নিশ্চিত।

      পরের দিন পুনরায় ওঝার ঝাড়ফুঁক শুরু হল। রুদ্রমূর্তি ধরা ওঝা পিশাচ তাড়ানোর জন্য অবনীর শরীরের উপরে নির্মম অত্যাচার আরম্ভ করল। ভেতরে যাই থাকুক না কেন, মূল মানুষটা অত্যাচারে কঁকিয়ে উঠল।

      কিছুক্ষণ পরে সেখানে আরও একজন ওঝা এল—তান্ত্রিক মহারাজ।জনগণ বাইরে হাঁটু গেড়ে বসল। তিনি গম্ভীর কণ্ঠে ভেতরে এলেন। অবনীর দিকে একবার তাকিয়ে রঙ্গা ওঝাকে কী যেন ইঙ্গিত করলেন। রঙ্গা ওঝা উঠোনে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করলেন ।

      তান্ত্রিক মহারাজ আগুনে কীসব ছিটিয়ে সমস্ত পরিবেশটাকে ধোঁয়াময় করে তুললেন।চিৎকার করে করে উন্মাদের মতো আচরণ করলেন। তারপরে ভীষণ ভঙ্গিমায় উঠোনে পড়ে থাকা অবনীকে  মারধর করতে উদ্যত হলেন। দূর থেকে সমস্ত কিছু দেখতে থাকা অপূর্ব দুই চোখ বন্ধ করে ফেলল।

       হঠাৎ কে যেনতান্ত্রিক মহারাজের হাতটা পেছন থেকে থাবা মেরে ধরল। কিছু একটা আভাস পেয়ে বারান্দায় বসে চোখের জল ফেলতে থাকা অপূর্ব এবার মাথা তুলে তাকাল।

       জয়ন্ত! কী আশ্চর্য! হঠাৎ যেন নেমে এল স্বর্গের একজন দেবদূত। জয়ন্তের পা জড়িয়ে ধরল অপূর্ব—’ আমার ভাইটিকে বাঁচাও পোণাদা সে মরে যাবে …।হাউমাউ করে কেঁদে উঠল অপূর্ব।

মুহূর্তের মধ্যে একটা হুলুস্থুল লেগে গেল। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা জনগণের চোখ কপালে উঠল— কে এল এটা?  তান্ত্রিক মহারাজের হাত ধরে!রঙ্গা ওঝাকেও  চোখ দেখায়?এত সাহস? 

‘বন্ধ কর তোদের ভন্ডামি। ভালোয় ভালোয় বের হয়ে যা বলছি—, বেরিয়ে যা।। এখনই বের হ এখান থেকে।’ রুদ্রমূর্তি ধরে গর্জে উঠল জয়ন্ত। তান্ত্রিক মহারাজ লাল চোখ দেখিয়ে কিছু একটা বলতে চাইছিলেন, জয়ন্তের সামনে সাহস করলেন না। এক এক করে ওঝা এবং সাঙ্গোপাঙ্গরা  চলে যাবার পরে দূরে দাঁড়িয়ে  দেখতে থাকা  গ্রামের মানুষগুলোও  চলে গেল।

 জয়ন্ত এগিয়ে গিয়ে উঠোনে পড়ে থাকা অবনীর কাছে পৌঁছাল। অপূর্বর দিকে ফিরে তাকাল সে—‘এসব কী হচ্ছে অপূর্ব? মেসো…তার মানে…? তোর চিঠিটা আমি গত সপ্তাহে পেয়েছি। আমি একটা খবর নিয়ে যাবার জন্য এসেছিলাম।’

অপূর্বর মনে পড়ল— সে নিরুপায় হয়ে মায়ের দিদি,তিলেশ্বরী মাসির ছেলে  জয়ন্তের কাছে একটা চিঠি লিখেছিল। বংশ পরিবার কেউ ওদের কাছে আসতে পারবে না। জয়ন্ত যদি একবার আসে…।ওদের একটা বিরাট বিপদ ঘনিয়ে আসছে। বাবার শরীর খুবই খারাপ…।এতটুকুই।

 জয়ন্ত চলে এল। এসেই দেখল সেই নাটকীয় পরিবেশ। ভেতর থেকে বাখরী বেরিয়ে এসে জয়ন্তকে জড়িয়ে ধরল। জয়ন্ত কাঁদতে থাকা বাখরীকে এক পাশে অপূর্বের কাছে বসতে দিল। অপূর্ব পুরো ঘটনাটাসংক্ষেপে জয়ন্তকে বলল।

 জয়ন্ত অবনীর দিকে তাকাল। মেঝেতে চাপড় মেরে পেছন থেকে অবনীর শরীরে একটা হাত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে চমকে উঠল।  জড়োসড়ো হয়ে বসল সে,ভয়ার্ত চাহনিতে জয়ন্তের দিকে তাকাল।

‘অবনী…আমি, আমি পোণাদা। চিনতে পেরেছিস কি?দেখ ভালো করে।’ জয়ন্ত যতই তার কাছে যেতে চাইল, সে ততই ভয় পেয়ে দূরে সরে গেল।

 জয়ন্ত সবাইকে আশ্বাস দিল— অবনীর চিকিৎসা করতে হবে।সুস্থ ছেলেটির হঠাৎ এমন কী হতে পারে!সে তার সঙ্গে অবনীকে নিয়ে যাবার কথা ভাবল।

 রাত হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে অপূর্বর ভয় আর শঙ্কা বেড়ে চলল—’ তুই জানিস না পোণাদা।  মানুষগুলি কোনো কথা মানতে চায় না। কেউ যদি উস্কানি দেয়, ওরা অবনীকে ডাইনি বলে ভেবে মেরে ফেলবে। আমাদের ঘরবাড়ি সমস্ত কিছু জ্বালিয়ে দেবে। আমরা কি করব?আমি…আমি সেই প্রথম থেকেই এই ভয়টাই করছিলাম।’ অপূর্ব।ফুঁপিয়ে উঠল।

      জয়ন্ত ভেবে দেখল— হঠাৎ সে  এসে সমস্ত বন্ধ করে দিয়েছে ।তাই জনগণ ক্ষুন্ন হয়ে যেকোনো কাজ করতে পারে। ওঝা তান্ত্রিকও উস্কানি দিতে পারে। এতগুলি মানুষ হলে সে আর অপূর্ব একা কী করবে? কাকে বাধা দেবে?

 একটি ভয়াবহ রাত অপূর্ব এবং জয়ন্ত ঘরটাকে পাহারা দিয়ে বসে থাকতে হল। ভোর বেলায় তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে জয়ন্ত যাত্রা করল। বাড়িটা থেকে বেরিয়ে বাখরী একবার ফিরে তাকিয়েছিল–’ওরা আমাদের না পেয়ে যদি বাড়িটা জ্বালিয়ে দেয়?’

 অপূর্ব মাকে একহাতে ধরে নিল—’ দিলে দেবে মা। কী করবি? খড় বাঁশ দিয়ে পুনরায় ঘর তৈরি করব ।অবনীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখ। কত শান্ত হয়ে রয়েছে এখন। বিষয় সম্পত্তি চেয়ে সে …তার জীবনটা বড়ো নয় কি?’

 জয়ন্ত এক হাতে অবনীকে ধরে রেখেছিল।

*              *               *             *

 মানসিক রোগের চিকিৎসক ডাক্তার শৈলধর চেতিয়া অপূর্বর মুখে সমস্ত কথা শুনল। তার সহযোগী দুজন ডাক্তার সেই সময় অবনীকে পরীক্ষা করে  দেখছিল। তারা সমস্ত রিপোর্ট আদি ডক্টর চেতিয়াকে দেখাল।

 ডক্টর চেতিয়া কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে রইলেন। তিনি অপূর্ব এবং জয়ন্তের দিকে তাকালেন। ধীরে ধীরে ডক্টর চেতিয়া মন্তব্য করতে লাগলেন—’ আপনার ছোটো ভাই অবনী আপনার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোটো নয় কি? আপনার এখন সাতাশ বছর বয়স, অর্থাৎ তার বয়স বাইশ বছর।বাড়ির সবচেয়ে ছোটো সে। প্রত্যেকের আদরের। নয় কি? ‘

অপূর্ব সায় দিল—’ হ্যা স্যার মা-বাবা ওকে খুব ভালোবাসে…মানে, বাবা খুব ভালোবাসত। ‘

‘আপনাদের গ্রামটি আমি দেখিনি, কিন্তু বুঝতে পারছি। আপনার বাবা অনেকদিন শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে রইলেন,গ্রামের কেউ এগিয়ে এল না। আসতে পারে না, কেননা আপনারা এক ঘরে হয়ে রয়েছেন। হঠাৎ সেদিন রাতে আপনার পিতার মৃত্যু হল। তখনও কেউ এল না। মনের দুঃখ ভোলার জন্য মানুষের বন্ধুর প্রয়োজন, সমাজের প্রয়োজন।কিন্তু আপনাদের ক্ষেত্রে দুঃখের সমভাগী হওয়ার জন্য ছিলেন কেবল আপনারা তিনজন। আপনার ছোটো ভাই হয়তো জানে না গ্রামটি কেন আপনাদের এক ঘরে করেছে,জানলেও হয়তো বোঝে না।কবে কখন কে অপরাধ করেছিল, ভোগ করতে হল আপনাদের। সেদিন রাতে পিতার মৃত্যু হল, দুঃখ করতে না করতে শব দেহটা বাইরে বের করার জন্য তাকে সাহায্য করতে হল। চিতা তৈরি করা হল। মশাল জালালেন। ঘুরঘুটে অন্ধকারে কাঁধে পিতার শবদেহ বহন করে সেও জঙ্গলে গিয়ে পৌঁছাল। আর সেখানে গিয়ে মশালটা নিভে গেল। সেই অন্ধকারে জঙ্গলের কাছে ফেলে রেখে আপনি বাড়িতে এসে পৌঁছালেন মশালটা জ্বালানোর জন্য। একবার ভেবে দেখুন— তার মনের অবস্থাটা কী হতে পারে? একটা অবুঝ শিশু হলে সে চিৎকার করে কাঁদতে পারত। আপনার বয়সের হলে হয়তো সে নিজেকে সামলে নিতে পারত। কিন্তু তার যে বয়স সে সমস্ত বুঝে, সমস্ত কিছু জেনেও কিছুই করতে পারল না। শুধু অন্ধকারে পিতার শবদেহটা পাশে নিয়ে বসে বসে সেই গভীর রাতে সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল।সে সমস্ত কিছু ভুলে গেল …ধীরে ধীরে সে উন্মাদের মতো আচরণ করতে শুরু করল।’ 

ডক্টর চেতিয়ার  কথার শেষের দিকে  অপূর্ব কেঁদে ফেলল। জয়ন্ত তাকে বাধা দিতে চাইল যদিও ডক্টর চেতিয়া ইঙ্গিতে মানা করলেন— কাঁদুক, যত পারে কেঁদে নিক।অন্তত অপূর্ব সুস্থ হয়ে আছে। যেকোনো মানুষই পাগল হয়ে যেতে পারত এরকম একটা পরিস্থিতিতে।

 অপূর্ব শান্ত হওয়ার পরে ডক্টর চেতিয়া বললেন—’ দেখুন, এইসবের জন্য আপনারা দায়ী নন। দায়ী সেই সমাজ যেখানে এরকম একটি পরিবেশে সৃষ্টি হয়েছে। অবনীর এই আচরণ আসলে সাময়িক। কিছু চিকিৎসার পরে সে পুনরায় সুস্থ হয়ে উঠতে পারার সমস্ত সম্ভাবনা আছে। হয়তো একটা দুটো শক দিতে  হতে পারে। আমরা চেষ্টা করব।’

 অপূর্ব  ডাক্তারের পায়ে পড়তে চাইছিল। তিনি বাধা দিলেন। মুচকি হেসে বললেন—’ অবনীর গায়ে থাকা পিশাচটাকে আগে তাড়িয়ে নিই। পরে সেবা সৎকার যা করার করতে থাকবেন।’

 অপূর্বদের বাসে তুলে দিতে এসে জয়ন্ত বাখরীকে বলল- –’নিজের শরীরের দিকে লক্ষ্য রাখবি মাসি।, আমি গিয়ে রেখে আসব ভেবেছিলাম, তোরা শুনলি না। হঠাৎ যদি গ্রামটি…।’

বাখরী মুচকি হাসল। বহুদিন পরে যেন এই হাসিটা দেহ মনের নিচ থেকে ঠোঁটে উঠে এল ।—’লাগবে না পোণা। গ্রামটা কিছুই করবে না, যারা করে তারা হল জনগণ।ওরা তো আমাদের অনেক আগেই একঘরে করেছে। মানুষটাও চলে গেল।ওরা দুজন আছে তো। এখন এটা আমাদের  যুদ্ধ। আমরা একাই লড়াই করব। ঘর জ্বালিয়ে দিলেও ভিতটা তো থাকবে।সেখানেই নতুন করে আবার ঘর তৈরি করব।’

হাসতে হাসতে বাখরীর চোখে জল চলে এল।আঁচল দিয়ে চোখ মুছে সে বলল’তুই যা করলি বাবা সেটা আমরা বেঁচে থাকতে কোনোদিনও ভুলে যাব না।’ 

বাসে ওঠার আগে অপূর্ব জয়ন্তের ডান হাতটা নিজের দুই হাতের মুঠিতে নিয়েছিল। নির্বাক ঠোঁট, সজল চাহনিতে ছড়িয়ে পড়ছিল কৃতজ্ঞতার ভাষা।

 বাস চলতে শুরু করল। জানালার কাছে বসা অবনী জয়ন্তের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে হাত নাড়ল—’ পোনাদা গ্রামে একবার আসিস…।’

কাহিনিটা শেষ করে  কয়েক মুহূর্ত পুনরায় একই জায়গায় বসে রইলাম। প্রীতিকে সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম—’তোর এই কাহিনিটা আমি লিখলে খারাপ পাবি নাকি? কাহিনিটা আমাকে  প্রচন্ডভাবে নাড়িয়ে দিয়ে গেল।’ সে আমার হাতটা খামচে ধরেছিল—’ লেখ বন্দিতা। তোর কল্পনায় উঁকি দিয়ে দেখতে চাই আমার শৈশব, আমার গ্রামটি …আর সেই জীবন্ত কাহিনিটা ।’

 

 

      

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত