| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
খবরিয়া

আশা ও আশঙ্কায় অকুতোভয় জেন-জির অভ্যুত্থান । নাভিদ সালেহ

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

চলতি মাসের ৫ আগস্ট তথা ‘৩৬ জুলাই’ আমরা যে প্রজন্মকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম, তা দেশে-বিদেশে অনেককেই বিস্মিত করেছে। একটি ন্যায্য দাবি ঘিরে, নিজ ভবিষ্যতের কাণ্ডারি হিসেবে ঘোষণা দিয়ে রাষ্ট্রের কাছে অধিকার দাবি এবং এর বিপরীতে রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যায় বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, এমনকি জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করার এমন স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তার চেয়েও বড় কথা, যে দাবিটি প্রথমে পেশাগত গণ্ডি থেকে শুরু হয়েছিল, তা রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পরিমার্জিত হয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের একটি অভ্যুত্থানে বিস্ফোরিত করার এমন ক্ষমতা নিশ্চয় আশাসঞ্চারী।

ছাত্র-জনতার আজকের এই প্রজন্ম ১৯৯৭ এবং তৎপরবর্তী সময়ে জন্ম নেওয়া। এই জেন-জি কিশোর-তরুণদের মনস্তত্ত্ব এবং দর্শন অনেকটাই আলাদা। এই নতুনের আবির্ভাবের পেছনে রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকা। চারপাশের জাতীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিও তাদের মননকে গড়েছে; আলোড়িত করেছে। এ কারণেই একদিকে যেমন এই প্রজন্মের ভেতর ঘরকুনো ডিভাইস-নির্ভরতা লক্ষ্য করা যায়, অন্যদিকে ওদের থেকেই উঠে আসতে দেখা যায় বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার গ্রেটা থুনবার্গকে। ওরা একাধারে পরিবেশ ও সমাজসচেতন, কর্তৃত্ববিরোধী; অন্যদিকে ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে অপরিচিত ও অর্ধপরিচিতের পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত। তারা প্রগাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে ভার্চুয়ালি; পরম আবেগে ভালোবাসে ইথারে ইথারে। প্রযুক্তির না-ছোঁয়া জগতের বাসিন্দা এই প্রজন্মের ভাবনা ভিন্ন, আচরণ অচেনা, সাহস অদেখা, অপরিসীম। ওরা যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনের জন্য প্রতিবাদ করে, গ্রেপ্তার হয়। ওরা সুইডেনে ধরিত্রীর জন্য অনশন করে। আর বাংলাদেশে ওরা আবু সাঈদের জন্য, মুগ্ধের জন্য, ফারহানের জন্য, দীপ্তের জন্য, এমনি আরও অচেনা সব জেন-জি ভাইবোনের জন্য বন্দুকের সামনে বুক চিতিয়ে ধরে। যে স্বৈরাচারী সরকার আমাদের দেশটির ওপর জেঁকে বসেছিল দেড় দশকেরও বেশি, তাকে কেবল তিন সপ্তাহের ভেতর সুড়ঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছে এই অকুতোভয় তরুণের দল।

 

এই প্রজন্ম নিটশের উবারমেঞ্চ তত্ত্বের চেয়েও বেশি শক্তিমান– প্রচলিত চর্চা ভেঙে নতুনের জন্ম দিতে পারে সে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উন্মুক্ত তথ্য আর উপাত্তের যুগে বেড়ে ওঠা এই শিক্ষার্থীর দল এমনই জানেওয়ালা যে, ওরা রুশোর ‘এমিল’-এ বর্ণিত শিক্ষার আলোয় যেন উদ্ভাসিত। সমাজের শৃঙ্খল ভাঙার যে রূপরেখা রুশো দিয়ে গেছেন, ওরা তারই প্রবক্তা। এ প্রজন্ম গ্রামসির ‘অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল’দের মতো প্রলেতারিয়েতের কারাগারের ছাদ ফুঁড়ে, সমাজের প্রচলিত ধারা ভেঙে নতুন সমাজ গড়ার দুঃসাহস দেখায়। ওরা সেই প্রজন্ম। ওরা জেন-জি! এই নির্ভীক, বন্ধুবৎসল অথচ অদ্ভুত প্রজন্মকে বুঝতে হলে ওদের অন্তরের ঔদার্যকে বুঝতে হবে। তা বোঝার জন্য মনস্তত্ত্ব ও দর্শনের শরণাপন্ন হতে হবে।

 

জেন-জির তারুণ্যের সাহসের বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখেছি রাজপথে, মিছিলে মিছিলে। এ সাহস একদিকে যেমন সামষ্টিক, অন্যদিকে এর একটি ব্যক্তিগত অস্তিত্ব রয়েছে। আবু সাঈদ যখন লাঠি হাতে পুলিশের সামনে বুক পেতে দেন কিংবা মুগ্ধ যখন ‘পানি লাগবে, পানি?’ বলে পথে পথে ছুটে বেড়ান, জীবন দেন, তখন একটি অমিত ব্যক্তিগত সাহসের আগুনে পুড়তে দেখি ওদের। এ আগুন যখন নায়কোচিত বীরত্বের দোরগোড়ায় গিয়ে হাজির হয়, তখন সামষ্টিক দাবানলে রূপান্তরিত হয় তা। তবে ব্যক্তিগত অগ্নি বা সামষ্টিক বিস্ফোরণ, যার কথাই বলি, তার ঘৃতাহুতি হিসেবে কাজ করেছে পরম ক্ষমতাধর স্বৈরাচারী সরকারকে নিরস্ত্র হাতে অপসারণের অ্যাবসার্ড বা পরাবাস্তব স্বপ্ন। সর্ন কিয়ের্কেগার্ড তাঁর ১৮৪৩ সালে প্রকাশিত ‘ফিয়ার অ্যান্ড ট্রেম্বলিং’ নামক দার্শনিক রচনায় ‘লিপ অব ফেইথ’ বা বিশ্বাসের ওপর ভর করে ঝাঁপ দেওয়ার ধারণার উল্লেখ করেন। এই ধারণায় অনিশ্চিত কোনো ভবিষ্যতের তোয়াক্কা না করে, হবে কি হবে না– এই সম্ভাব্যতার স্কেলে একটি কর্মকে না মেপে কোনো একটি কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার দুঃসাহসের কথা বলা হয়। জেন-জির তারুণ্য মহাশূন্যের অসম্ভব সব অভিযানের এতটা কাছাকাছি আজ যে, ওরা আমাদের ছায়াপথ মাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী ছায়াপথ পরিক্রমণের সংকল্প করে। শেখ হাসিনার একনায়কত্বের জুজুর ভয় তাই ওদের স্পর্শ করেনি। আমার বিশ্বাস, লিপ অব ফেইথ নেওয়ার ক্ষমতা আর অ্যাবসার্ড লক্ষ্যের প্রতি বিশ্বাস এই প্রজন্মে এতটাই প্রবল যে, পরিবর্তনকে ওরা ভয় করে না, আর তাই অঘটন ঘটাতেও পটীয়ান ওরা। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে কেন্দ্রে চলে আসে বন্ধুবাৎসল্য এবং ‘গ্ৰুপ বিহেভিয়ার’ বা গোষ্ঠীগত আচরণের ধারণাটি।

১৯ শতকের গোড়ার দিকে ইংরেজ মনস্তাত্ত্বিক উইলফ্রেড বিয়োন গ্ৰুপ বিহেভিয়ার-এর ধারণা নিয়ে কাজ করেন। তিনি বলেন, গোষ্ঠীবদ্ধ আচরণের পেছনে পরস্পরনির্ভরতা এবং সামষ্টিক ধারণার প্রতি আনুগত্য প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। যেহেতু জেন-জি প্রজন্ম ভিন্নমতের প্রতি বেশি সহনশীল এবং অপরিচিতকে বন্ধুতে পরিণত করতে উৎসাহী, ব্যক্তি থেকে সমষ্টির দিকে এগোতে ওদের বাধা থাকে অল্পই। আর সমষ্টির অংশ হয়ে দাঁড়ানোর পর গ্ৰুপ বিহেভিয়ার অনুসরণ, গ্ৰুপের বিশ্বাসকে ধারণ করার সংকল্প ওদের জন্য সেকেন্ড নেচার হয়ে দাঁড়ায়। জুলাই অভ্যুত্থানে তরুণ প্রজন্মের এই মনস্তত্বই হয়তো কাজ করেছে।

 

বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে একটি পবিত্র স্থান অধিকার করে রয়েছে। তবে এটিও মানতে হবে যে, আজকের নতুন প্রজন্ম আর তাদের পিতামাতার অধিকাংশই জন্মেছেন, বড় হয়েছেন একটি স্বাধীন বাংলাদেশে। তাদের লিভড এক্সপেরিয়েন্স বা জীবিত অভিজ্ঞতায় মুক্তিযুদ্ধ একটি কেন্দ্রীয় চেতনা হিসেবে থেকে গেছে সত্য, তবে সেই গৌরবোজ্জ্বল সময়, সেই সময়ের নেতৃত্ব এবং আত্মত্যাগ তাদের কাছে মূলত ‘ইতিহাস’। আর ইতিহাস যেহেতু অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলির সমন্বয়, সে কারণে অনেক ক্ষেত্রেই তার অন্তর্নিহিত মূল্য অনুধাবন করা ততটা সহজ থাকে না। ইউভাল হারারি রাষ্ট্র ও জাতীয়তাকে বিমূর্ত কনসেপ্ট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সে বিচারে বিগত সরকারের কেন্দ্রীয় মূলমন্ত্র আসলে এই বিমূর্ত ধারণার ওপর ভর করেই দাঁড়িয়ে ছিল। ছাত্রদের লিভড এক্সপেরিয়েন্স যদি বৈষম্য, দুর্নীতি কিংবা নিপীড়নের অভিজ্ঞতায় ভারী হয়ে ওঠে, তবে মূর্ত হয়ে দাঁড়ানো এই অসংগতিগুলো বিমূর্ত চেতনাকে ছাপিয়ে উঠতেই পারে। তখন রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে তৈরি কৃত্রিম স্বৈরাচারী চাপ থেকে মুক্তিই হয়ে দাঁড়ায় মূল লক্ষ্য। আর এই লক্ষ্যকে ছাত্রসমাজের গোষ্ঠীগত অনুভবের কেন্দ্রে স্থাপন করা ও তা অর্জনের সংগ্রামে এই পালাবদল ঘটাতে সক্ষম হয়েছে জেন-জি।

এবার আমাদের এই অকুতোভয় প্রজন্মের জন্য কিছু সতর্কবাণী। এই রক্তক্ষয়ী অর্জন তখনই সার্থক হবে, যখন পুরো সমাজে সত্যিকার অর্থেই বৈষম্যের অবসান হবে। তবে বৈষম্য নির্মূল করার যাত্রায় আইনের শাসন, দুর্নীতির অপসারণ যেমন জরুরি, তেমনি জনগণের ভেতর সংহতি থাকাও অত্যাবশ্যক। সংখ্যাগুরু ছাত্রসমাজের বিশ্বাসের বাইরে যদি দেশের একটি অংশের মানুষ থাকে, তবে তাদের সে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেন খর্ব না হয়। এই সংগ্রামে আমরা যেন আমাদের ইতিহাস ধ্বংস না করি; মুক্তিযুদ্ধের শক্তি হারিয়ে না ফেলি; ধর্মীয় সম্প্রীতি না খোয়াই, আর আমাদের বাঙালিত্ব জলাঞ্জলি না দিই। এই দেশ আমাদের সবার। এই দেশের ইতিহাস আমাদের গর্ব। এ ভূখণ্ডের সংস্কৃতি আমাদের সম্পদ। তোমরা যেভাবে অভ্যুত্থান শেষে রাজপথ নিয়ন্ত্রণ করছ; উচ্চকণ্ঠ হচ্ছ বিচারের দাবিতে; পেশ করছ জাতীয় নীতিমালা; সেভাবেই পরমতসহিষ্ণুতার ধারণাকে তোমাদেরই প্রচার করতে হবে। তোমাদের অমিত সাহস ও অর্জন তবেই সার্থক হবে।

 

 

 

নাভিদ সালেহ: অধ্যাপক, পুরকৌশল, স্থাপত্য ও পরিবেশ কৌশল অনুষদ, ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট অস্টিন, যুক্তরাষ্ট্র

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত