ছাদে মাদুর পেতে রোদ মাখতে বেশ লাগে। কিন্তু কোথাও আর জায়গা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সারা ছাদময় জামাকাপড় ছড়ানো। লম্বা লম্বা মাদুর, শতরঞ্চি পেতে পুরোটা ভর্তি করে কাপড় চোপড়গুলো রোদে দিয়েছে অরুণা। শোওয়ার জায়গা নেই, মাদুরগুলো সব জোড়া করে কাপড় মেলা। তবু ভারি নয়ন সুখ হল সুরমার। অনেক বেছে বউ এনেছিলেন ছেলের। ভারি কর্মঠ বউমাটি তার। সারা বাড়ির সবার কাপড় রোদে মেলেছে। আজ বোধহয় তার ট্রাঙ্কে হাত পড়েছে। ওই তো সেই বেগুনী রঙের বেনারসিটা।
বারো বছরে বিয়ে হয়েছিল। নতুন বউটি হয়ে বেগুনী বেনারসিটি অঙ্গে জড়িয়ে কর্ত্তার পিছুপিছু এই বাড়ির চৌকাঠ ডিঙোন। তা কতদিন হয়ে গেল। সেইসব দিনগুলো কেমন ঝাপসা হয়ে গিয়েছে।
ওপাশে রোদ্দুর মাখছে একটা বাসন্তী শাড়ি। রঙটা কেমন যেন ম্যাড়ম্যাড় করছে! নতুন বৌকে সরস্বতী পুজোয় দেওয়া শ্বশুরের উপহার। শ্বশুরমশাই শেয়ালদা বাজারে হাটে যেতেন ফি শনিবার। শাড়িটি হাতে করে সরস্বতী পুজোর আগের দিন বললেন, “কাল সকালে এটি পরে অঞ্জলি দেবে, বুঝলে।”
শাশুড়ি হেসে কুটিপাটি। বুড়োর শখ দেখে আর বাঁচিনা! আমাকে তো কোনদিন এনে দেয়নি। তবু যাহোক বউমার কপালে জুটল।
কি সব দিনকাল ছিল। বাসন্তী শাড়িটি পরে সেকি আহ্লাদ! মিলের শাড়ি। কেমন একটা আনকোরা গন্ধ! সরস্বতী পুজোর ভোরে কি যে ভালো লেগেছিল! সেবার যেন অঞ্জলির স্বাদই আলাদা ছিল!
সারাক্ষণ ঘুরছেন সুরমা। নাড়ছেন এটা সেটা। সারা ছাদ জুড়ে হরেক শাড়ির মেলা। শীতের পোশাকগুলো তারই মাঝে ছড়ানো। পুরনো স্মৃতির মতই বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে। বড় বেমানান ঠেকছে চোখে।
এটা কি? চোখের দৃষ্টি এখনো সতেজ। তবে এমন আবছা দেখেন কেন? সেই কমলা রঙের অলেষ্টারটা না? কোথাও কোথাও পোকায় কেটেছে। হাত বোলান ওপরটায়। মসৃন মিহি সিল্কের লাইনিংটায় গাল ঘষেন।
শীতের সময় এই অলেষ্টারটা উনি রুনুর হাতে দেন। মেয়ের সেকি তুড়িলাফ! কতদিন ধরে আমার একটা অলেষ্টারের শখ। বাবা কি করে বুঝল বলতো?
“মা বাবা ছেলেমেয়ের সবকথাই বুঝতে পারে রে।” তিনি হেসে বলেছিলেন।
শীতের শুরুতে অলেষ্টার এলো। দিনকতকের মধ্যেই কি যে হল! মারাত্মক টাইফয়েডে মেয়েটা চলে গেল তাদের ছেড়ে। মেয়ে গেল। রয়ে গেল ওই অলেষ্টার। রুনুর পরে শুনু, বাচ্চু কতদিন আবদার ধরেছে। ওদের বাবাও বলেছেন, “দাওনা ওদেরই দিদির জিনিস। ওরাও একটু পরুক।”
প্রাণধরে কারোর হাতে তুলে দিতে পারেন নি তিনি। যার জিনিষ সেই তো পরতে পেলনা। ওদের দেবেন কি করে? ফি বছর ট্রাঙ্ক থেকে বার করে রোদ্দুর খাওয়ান। আবার তুলে রাখেন। আজ এতদিন বাদে অলেষ্টারটা ছুঁয়ে বুকের ভেতরটা আগের মতই তোলপাড় করছে। ঝাপসা চোখে হাঁতড়ে হাঁতড়ে দেখেন সুরমা, অলেষ্টারের পকেটে একটা খাওয়া কুলের আঁটি। চোখের সামনে এনে নাড়েন চাড়েন। আশ্চর্য! এটা এতদিন ধরে অলেষ্টারের পকেটেই থেকে গিয়েছে। খেয়াল পড়েনি তো।
আঁচলে বাঁধতে গিয়ে ছিটকে যায় ওটা। ছাদের মেঝেতে উপুড় হয়ে খুঁজছেন সুরমা। আলো কমে আসছে আস্তে আস্তে। সারা ছাদে ছড়ানো রঙিন কাপড়ের ফাঁকে কোথায় যে লুকোল! তাই সন্তর্পনে সবকিছু সরিয়ে খুঁজছেন তিনি। এখনো খুঁজেই চলেছেন।

ঐতিহ্যময় শহর চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক।১৯৯৬ সালে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়’দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায়।২০০১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ছাড়াও, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কুঠার’, ‘এবং মুশায়ারা’-র মতো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনেও তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা অব্যাহত। প্রকাশিত উপন্যাস পাঁচটি, গল্পগ্রন্থ চারটি, এবং কবিতার বই একটি।