| 7 অক্টোবর 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অনুবাদ গল্প : জেসি ও মেরিবেথ । অ্যালিস মানরো

আনুমানিক পঠনকাল: 21 মিনিট

অনুবাদ: হাসান জাহিদ

[অ্যালিস অ্যান মানরো (Alice Ann Munro ) জন্ম-১০ জুলাই, ১৯৩১) কানাডার অন্টারিও প্রদেশের উইংহ্যামে জন্মগ্রহণকারী বিশিষ্ট গল্পকার। সামগ্রিকভাবে তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি ২০১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। এর আগে ২০০৯ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার অর্জন করেন। তিনি তাঁর সরস গল্প রচনার জন্য তিনবার কানাডার গভর্নর জেনারেল পুরস্কার পেয়েছেন।
অ্যালিস মানরো’র ম্যান বুকার প্রাপ্তির আগে পর্যন্ত কানাডা এবং প্রতিবেশী যুক্তরাষ্ট্রে খানিকটা পরিচিতি পেলেও বহির্বিশে্ব তেমন পরিচিত ছিলেন না তিনি। এর কারণ মানরো উপন্যাস নয়, গল্প লেখেন, যাকে আমরা বলে থাকি বড় গল্প। মানরো’র সাহিত্যকর্ম বলতে আমরা বুঝি উপন্যাসের ব্যপ্তি নিয়ে তৈরি হওয়া মানরো’র গল্পগুলোকে।
মানরো’র গল্পের চরিত্রেরা ঐতিহ্যের গভীরে প্রোথিত নিয়ম-নীতি ও আচার-আচরণের মুখোমুখি হয়। মানরো’র গল্পগুলোকে ‘শর্ট ফিকশন’ বলা হয় সঙ্গত কারণেই। কারণ তাঁর গল্পগুলো থিম ও বর্ণনায় উপন্যাসের সমকক্ষ অথচ ব্যপ্তিতে বড় গল্পের চেয়ে বড় নয়। ঠিক নারীবাদী লেখিকা বলতে যা বোঝায়, অ্যালিস মানরো তেমন কোনো অভিধা না পেলেও, মেয়েরাই তাঁর প্রায় সব গল্পের প্রধান চরিত্র হয়ে ওঠে।
তার মেয়ে চরিত্রগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশ জটিল এবং আধুনিক; যদিও গ্রামীণ এক ধরনের সহজবোধ্যতা যেন তাদের পরিচিতির বিশেষ ছাপ। তাঁর আগের দিকের গল্পগ্রন্থ ‘দি প্রোগ্রেস অব লাভ’ থেকে ‘জেসি ও মেরিবেথ’ গল্পটি অনুবাদ করা হয়েছে। অনুবাদক]


হাইস্কুলে মেরিবেথ ক্রোকার নামের একটি মেয়ের সাথে আমার বন্ধুত্ব হলো। বন্ধুত্বটা হলো মিউজিক ক্লাসে। গানের বইয়ের স্বল্পতার কারণে ছেলে এবং মেয়ে আলাদা দলে বিভক্ত হয়ে বই ভাগাভাগি করে পড়ছিলাম।
আমি কাউকে খুঁজছিলাম, যার বিশেষ কোনো বন্ধু ছিল না। এই সময় মেরিবেথ এসে আমার পাশে বসল। সে স্কুলে নতুন। সে ওর বোনের সাথে বাস করতে এসেছে, ওর বোন বিয়েট্রিস স্থানিয় হাসপাতালে নার্সের কাজ করে। তাদের মা মারা গেছে আর বাবা আবার বিয়ে করেছে।
মেরিবেথ ছোটখাটো আর নাদুশনুদুশ হলেও দেখতে সুন্দর। বড় বড় দুই চোখ-হালকা সবুজাভ বাদামি থেকে গাঢ় বাদামি রঙের। মুখে কেমন হতবুদ্ধি ভাব আর তাতে যেন অসন্তোষ ছড়িয়ে থাকে।
পরের দিনগুলোতে আমি সকালে জেগে উঠতাম খুশি মনে, কারণ না জেনেই। তারপর আমি বন্ধুত্ব হবার মুহূর্তটা স্মরণ করতাম। খুশির কারণ এটাই।
মেরিবেথ আর আমি বন্ধুত্বটা নিয়ে আলোচনা করতাম। সে জানাল, আমার সিটের দিকে আসতে তার বুক ধুকপুক করত। আর সে নাকি নিজেকে বলেছিল-হয় এখনই, নয়তো কখনও নয়।
শৈশবে বইতে পড়েছি মেয়েরা অটল বন্ধুত্বে বাঁধা পড়লে নিখুঁতভাবে পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকে। তারা প্রতিজ্ঞা করে একজন অন্যজনের গোপন কথা ফাঁস করবে না বা কিছু লুকোবে না। আর অন্য কারো সাথে বন্ধুত্ব গাঢ় করবে না। এমনকি বিয়ে হলেও তাদের বন্ধুত্বে কোনো ব্যত্যয় ঘটে না। তারা বড় হয়, কারো প্রেমে পড়ে, বিয়েও করে। তবে তাদের হৃদয়ে বন্ধুত্বের স্থান সবার আগে থাকে। তারা তাদের মেয়েদের নাম রাখে বান্ধবীর নামে। আর অসুখে-বিসুখে পরস্পরের সেবা করে।
মেরিবেথ আর আমি সেরকম প্রতিজ্ঞাই করেছিলাম। মেরিবেথ সেভাবেই চলছিল। তার স্বভাব কোমল ছিল। মেরিবেথ কোনোভাবে বিষণ্ন হলে বা ভয় পেলে আমার শরীর ঘেঁষে থাকত, আমার হাত ধরত।
সেই প্রথম শরতে আমরা রেললাইন ধরে হেঁটে শহরের অনেকটা বাইরে চলে গেলাম। পরস্পরের জীবনের অসুস্থতা, দুর্ঘটনা বা কীসে আমরা ভয় পেতাম সেসব আর কার কী প্রিয়‒রঙ, রতœ, সিনেমার তারকা, ডেজার্ট, কোমল পানীয়, আইসক্রিমের ফ্লেভার‒এসব নিয়ে ভাব বিনিময় করলাম। আমরা ঠিক করলাম কয়টা আর ছেলে না মেয়ে নেব এবং তাদের কী নাম হবে। স্ব স্ব স্বামীর চুল আর চোখের রঙ কী হবে আর তারা জীবিকার জন্য কী কাজ করবে, সব ঠিক করে ফেললাম। মেরিবেথ মাঠের গোরু আর আমাদের চলার পথে কোনো সাপ পড়ে কিনা, সেই আশঙ্কায় থাকত। আমরা মিল্কউডের১ শুঁটি ফেটে বের হওয়া বিস্ময়কর নরম শাদা রোঁয়া হাতের মুঠোয় নিয়ে উড়িয়ে দিতাম‒সেগুলো হালকা তুষারের মতো উড়ে উড়ে বুনো আগাছার ঝাড়ে গিয়ে পড়ত।
কখনো কখনো আমরা মেরিবেথ যে বাড়িটায় তার বোন বিয়েট্রিসের সাথে একটা রুমে শেয়ার করে থাকে, সেখানে যেতাম। আমরা পোর্চে বসে সেলাই কর্ম করতাম বা রুমে যেতাম। বাড়িটা ছিল বড়, হলুদ আর শাদাসিধে। অযত্নের ছাপ তাতে। ঠিক মেইন রোডের ওপরেই ছিল বাড়িটা। বাড়ির মালিক ছিল এক অন্ধ লোক আর তার স্ত্রী। বাড়ির পেছন দিকে তাদের কামরাগুলো ছিল। অন্ধ লোকটি বসে থাকত বা স্ত্রীকে আলু ছিলে দিয়ে সহায়তা করত।
লোকটির স্ত্রী বাইরে বেরুলে বাড়ির কয়েকটি মেয়ে লোকটার কাছে দৌড়ে আসত নিছক আমোদ লাভের জন্য বা কথা বলতে। তারা ব্রা আর প্যান্টি পরে, কখনো বা কিছু না পরেই লোকটার সামনে যাবার সাহস দেখাত। লোকটা আন্দাজ করার চেষ্টা করত, মেয়েগুলো কোন্ খেলা খেলছে! সে বলত, এদিকে এসো। আরো কাছে এসো, শুনতে পাচ্ছি না। অথবা বলত, এসো। তোমার পোশাক স্পর্শ করতে দাও। দেখি আন্দাজ করে রংটা বলতে পারি কিনা।
মেরিবেথ কখনো এমনটি করত না। এমনকি এরকম শুনতেও সে ঘৃণাবোধ করত। সে ভাবত-এসব মেয়েরা বিরক্তি উদ্রেককারী। সে যে মেয়েগুলোর সাথে বাস করছিল, তারা একটা না একটা কিছু করছেই সবসময়। এই শত্রুতা, তো এই বন্ধুত্ব। আর কথা না বলার বাতিক ছিল। একবার একটা মেয়ে সামান্য নেইল পলিশ নিয়ে তর্কাতর্কি করে অন্য একটা মেয়ের চুল ছিঁড়ে দিয়েছিল।বাথরুমের কেবিনেটে লেখা থাকত:
সুয়েটার শুকোতে হবে যার যার রুমে। কারণ উল ড্রায়িং বাজে গন্ধ ছড়ায়। অ্যাটেনশন: এ. এম এবং এস. ডি।
যার জন্য প্রযোজ্য: আমি তোমার গায়ে আমার ‘ইভনিং ইন প্যারিস’-এর গন্ধ পেয়েছি। আমি অ্যাপ্রিশিয়েট করতে পারছি না। তুমি নিজেই একটা কিনে নিতে পারো। ইয়োরস সিনসিয়ারলি-বি.পি.।
সবসময়ই কিছু না কিছু ধোয়া হচ্ছে-মোজা, ব্রেসিয়ার, সুয়েটার। আর অবশ্যই চুল। আর বাথরুমে কোনো একটা ঝুলানো কিছুর ঝাপ্টা না খেয়ে ঘুরা যেত না।
রান্না করা হতো হট প্লে¬টে২। যে মেয়েগুলো টাকা জমিয়ে বিয়ের প্রস্তুতির জন্য জিনিসপত্র কিনছিল তারা ক্র্যাফ্ট ডিনার (মোটা বাদামি কাগজে মোড়া) বানাত। অন্যরা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, হ্যামবার্গার, হট ডগ কিনে আনত। যে মেয়েরা ডায়েটিং করত তারা সিঁড়িতে খাবারের গন্ধ পেয়ে অভিশাপ দিত, ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিত।
সময়ে সময়ে মেরিবেথের বোন বিয়েট্রিসও ডায়েটিং করত। সে ভিনেগার পান করে খিদে দূর করত। আর হাতের আঙুলের নোখ মজবুত করতে গ্লি¬সারিন পান করেছিল।
‘বিয়েট্রিস একটা বয়ফ্রেন্ড পেতে চাচ্ছে। বিষয়টা আমাকে অসুস্থ করে তুলছে।’ মেরিবেথ একদিন বলল।
মেরিবেথ আর বিয়েট্রিস একে অন্যের কাপড় ব্যবহার করত, একসাথে বিছানায় জড়াজড়ি করে শুতো। কিন্তু তারা যখন ঝগড়া করত, দু’জন কথা বলত না তখন। আর মেরিবেথ হট প্লে¬টে খাবার তৈরি করে খাবারের পাত্রটা বিয়েট্রিসের নাকের সামনে ধরত। তারপর আমি আর মেরিবেথ মিলে সেটা খেতাম। অথবা মেরিবেথ স্টোরে গিয়ে মার্শম্যালো৩ কিনে আনত। মার্শম্যালো বিয়েট্রিসের প্রিয় খাবার ছিল। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল সেগুলো বিয়েট্রিসের সামনে খাওয়া।
মেরিবেথের বাবা চাইত না মেরিবেথ তার সাথে বাস করুক। কিন্তু বাবা ওকে কাপড় কেনার জন্য প্রচুর টাকা দিয়েছিল। মেরিবেথের স্কুইরাল কলারের গাঢ়-নীল রঙের একটা শীতের কোট ছিল‒যেটা খুব বিলাসবহুল বলেই আমার কাছে মনে হয়েছিল। ওর হাল ফ্যাশনের নানা বর্ণের অনেক ড্র স্ট্রিং ব্লাউজ ছিল। আমি ওর এসব জিনিসগুলোকে ইর্ষা করার বদলে সমীহের চোখেই দেখতাম। ওর বালাগুলো হাতে নিয়ে দেখতাম আর ওর পাউডার পাফ আর আইব্রাও-চিমটা নেড়েচেড়ে দেখতাম। আমার ভুরু প্ল¬াক করার অনুমতি ছিল না। স্কুলে যাবার পথে টাউনহলের ওয়াশরুমে গিয়ে মেকাপের কাজ সারতাম। স্কুলের বছরগুলোতে আমি শহরে আন্ট এনার সাথে থাকতাম, তিনি খুব কড়া ছিলেন।
টরোন্টোতে ওর বাবা আর সৎমায়ের সাথে গ্রীষ্মের ছুটি কাটিয়ে এসে মেরিবেথ জানাল‒রেলওয়ে সড়ক ধরে আর হাঁটাটা ঠিক হবে না। বদনাম হতে পারে। সে আরো জানাল যে, চুলের ওপর স্কার্ফ পরাটা এখন নতুন স্টাইল‒এমনকি রোদ˜গ্ধ দিনেও। সে কতগুলো স্কার্ফ এনেছে। সেখান থেকে সে আমাকে একটা পছন্দ করতে বলল। আমি গোলাপি রঙের একটা পছন্দ করলাম। মেরিবেথ আমার পছন্দের তারিফ করে চেঁচিয়ে উঠল‒‘এটা সবচে’ সুন্দর স্কার্ফের একটা!’ আমি ওকে স্কার্ফ ফিরিয়ে দিতে চাইলাম। অনেক যুক্তিতর্কের পর আমাকে সেটা নিতে হলো।
সে টরোন্টোর গল্প করল। ইটন’স আর সিম্পসন’স-এ যেসব কিনতে পাওয়া যায়, এস্কেলেটরে ওর হিলে হোঁচট খাওয়া আর তার সৎমা তাকে যেসব নির্দয় কথা বলেছেÑসেসব বলল। যেসব মুভি সে দেখেছে, সেগুলোর কাহিনি সংক্ষেপে শোনাল আমাকে।
মেরিবেথ যখন কথা বলত, কখনো কখনো মনে হতো সরে যাই। স্কুলে কঠিন অঙ্ক সমাধানের সময় বা চার্চে নসিহত শুরু হবার আগে দীর্ঘ প্রার্থনার সময়টার মতো লাগত। এরকম যে, আমি অন্য কোথাও চলে যাই বা এমনকি একাকী হয়ে থাকি। আমি উপলব্ধি করলাম বন্ধুত্ব বুঝি এরকমই।
আমরা আমাদের নামের বানান পরিবর্তন করতে চাইলাম। আমার নামের বানান Jessie -এর পরিবর্তে Jesse এবং ওরটা MaryBeth -এর বদলে Meribeth করা হলো। আমরা স্কুলের টেস্টপেপারে এই দু’টি নাম সই করলাম।
শিক্ষিকা আমার পেপারটা মেলে ধরে বললেন‒‘আমি একে মার্ক দিতে পারছি না, কারণ ও কে-সেটা আমি জানিনা। কে এই Jesse ?’ তিনি নামের বানানটা উচ্চস্বরে বললেন, ‘এটা একটা ছেলের নাম। কেউ কি Jesse নামের কোনো ছেলেকে চেনো?’
Meribeth নামটা নিয়ে একটা কথাও উচ্চারিত হলো না। বিষয়টা টিপিকেল। মেরিবেথ সবার কাছে প্রিয়। তার ভাবভঙ্গি, পোশাক, তার চলন-বলন ইত্যাদি কারণে। কর্কশ মেয়েরা আর বিদ্রুপাত্মক শিক্ষক-সবাই মেরিবেথের পক্ষে।
আমি আমার নামের বানান পরিবর্তন করতে না পারায় মেরিবেথ তার নামেরও পরিবর্তন করল না। কিন্তু আমরা আমাদের নতুন নামের বানান চালাতে লাগলাম নোট সাইন করায় এবং চিঠিপত্রে।
আন্ট এনা আমাকে একটা জবে দিয়ে দিলেন। আমাকে ক্রাইডারম্যানস-এ কাজ করতে হবে। স্কুলের পর সপ্তাহে দুইদিন। ক্রাইডারম্যানস-এর সাথে আন্ট এনার সুসম্পর্ক ছিল, আন্ট এনা সেখানে ক্লিনিং-এর কাজ করতেন। আমার দায়িত্ব ছিল ইস্ত্রি করা, গোছানো আর রাতের খাবারের জন্য ভেজিটেবল তৈরি করা।
‘কাগজে-কলমে এটাই ওদের ডিনার।’ আন্ট এনা বললেনÑএমন সুরে যেÑবুঝা গেলনা তিনি ক্রাইডারম্যানদের মেকি স্বভাবের কথা বললেন, নাকি তাদের তিনি ওপরের স্থানে রাখলেন। আন্ট এনা আসলে আমার বাবা’র আন্ট, তিনি ততটাই বৃদ্ধা ছিলেন। একজন ক্লিনিং লেডি হলেও যথেষ্ট সম্মানিত ছিলেন তিনি।
তিনি, তাঁর মেয়ে ফ্লোরিস, আর তাঁর ছেলে জর্জ একটা সঙ্কীর্ণ কিন্তু পরিপাটি বাসায় থাকতেন। রাস্তার এত লাগোয়া ছিল বাসাটা যে, সাইডওয়াক থেকে হাত বাড়ালেই এর পোর্চ-রেলিং ছোঁয়া যেত। রাস্তাটা ছিল খাড়া আর অপ্রশস্ত। বাড়িগুলো একটার সাথে আরেকটা লাগানো। আমার রুম ছিল কিচেনের পেছনে, একটা সাবেক প্যান্ট্রি৫। হালকা সবুজ দেয়াল। প্যান্ট্রিটাতে হিটিং-এর কোনো ব্যবস্থা ছিলনা। শীতকালের সকালে আমাকে বিছানায় সমস্ত কাপড় জড়ো করতে হতো। বিছানার কভার পর্যন্ত গায়ে জড়াতে হতো।
আন্ট এনা শহরে তাঁর দাপট খাটিয়ে তারপর বাড়ি ফিরে আসতেন। সেটা আমাদেরÑমানে ফ্লোরিস, জর্জ আর আমার ওপর প্রয়োগ করতেন। আমাদেরকে বুঝিয়ে দিতেন আমরা সবাই উৎকৃষ্ট, আমাদের দারিদ্র সত্ত্বেও। এই অর্থে যে, নিয়মিত জুতো পরিষ্কার করে, ঠিকভাবে বোতাম সেলাই করে, আর ধূমপান না করে (মেয়েদের ক্ষেত্রে)। আর অ্যালকোহল স্পর্শ না করে (সবার ক্ষেত্রে), কর্কশ বা বাজে কথা না বলে। এরকম সাবধানতা আর নিয়মানুবর্তিতার কঠোর শাসনের কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি। আমিও না। কিন্তু আমি জানতাম কীভাবে কিছু নিয়ম এড়িয়ে চলতে হবে। তবে খুব একটা ভুগছিলাম, তা নয়। আমি জানতাম কোনো সুপিরিওরিটি একেবারেই না থাকার চাইতে এসবের কিছু নিয়ম পালন করে সুপিরিওর থাকাটা অনেক ভালো। আসলে ফ্লোরিস আর জর্জের মতো আমারও প্ল¬্যান ছিল না এখানে থাকার।
ফ্লোরিসের বিয়ে হয়েছিল, তবে ক্ষণস্থায়ি ছিল সেটা। আর ফ্লোরিস সেই বিয়ের কোনো গুরুত্বই বুঝতে পারেনি। ফ্লোরিস একটা জুতোর দোকানে কাজ করত আর ধর্মসঙ্গীতের চর্চা করত। সে জিগসো পাজলে৬ আসক্ত হয়ে পড়ে। যদিও আমি অনেক বিরক্ত করেছি তাকে সব বলতে কিন্তু সে তার রোমান্স, তার বিয়ে বা তার জোয়ান স্বামীর রক্তে বিষজনিত কারণে মৃত্যু সম্পর্কে কোনো সন্তোষজনক জবাব সে দিতে পারেনি।
জর্জ স্কুলে গ্রেড ফোরও পার করেনি। সে একটা পিয়ানো ফ্যাক্টরিতে কাজ করত। সে ছিল লাজুক আর চুপচাপ। সে ম্যাগাজিন থেকে ছবি কেটে তার রুমের ভেতরে স্থানে স্থানে গেঁথে দিত। অর্ধ উলঙ্গ কোনো সুন্দরী মেয়ের ছবি না। প্লে¬ন, চকোলেট কেক, গোরু‒এসবের ছবি। সে চায়নিজ দাবা খেলতে পারত। আমাকে খেলতে আমন্ত্রণ জানাত। আর আমি বলতাম যে, আমি খুব ব্যস্ত।
আমি যখন মেরিবেথকে সাপারের জন্য নিয়ে এলাম বাড়িতে, আন্ট এনা টেবিলে মেরিবেথের বালার শব্দে বিরক্তি বোধ করলেন আর অবাক হলেন দেখে যে এই বয়সের একটা মেয়ে ভুরু প্ল¬াক করেছে। তিনি আরো বললেন‒জর্জকে শুনিয়ে যে, আমার বন্ধু মাথায় খুব একটা বুদ্ধি ধরেনা। আমি বিস্মিত হইনি। আমি বা মেরিবেথ কেউই বড়দের এই হামবড়া ভাব থেকে তেমন কিছুই আশা করলাম না।
ক্রাইডারম্যান হাউসকে তখনো স্টিউয়ের হাউস বলা হতো। এই কিছুদিন আগে পর্যন্তও মিসেস ক্রাইডারম্যান ইভাঞ্জেলিন স্টিউয়ের ছিলেন। বাড়িটা তার বাবা ড. স্টিউয়ের বানিয়েছিলেন। রাস্তা থেকে পেছনে ফেরানো চত্বরযুক্ত মসৃণ একটি বাড়ি। শহরের অন্যান্য বাড়িগুলো থেকে আলাদা। আসলে বাড়িটা এ পর্যন্ত আমার দেখা বাড়ি থেকেও আলাদা। ছাতের চারধারে ঝুলনো বারান্দা, আর ছাতের প্রতি কোণে আর্ন৭। বাড়ির সামনের সিঁড়ির দুই পাশেও আর্ন বসানো। ঝুলন্ত সিঁড়ি আর আর্নগুলোতে অফ-হোয়াইট রং করা।
আমি সেখানে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে যাতায়াত শুরু করলাম। আর্নগুলো বরফে ঢেকে গিয়ে পাত্রে রাখা আইসক্রিমের মতো দেখায়। আর উঠোনের বিভিন্ন প্রজাতির ঝোপঝাড়গুলোকে দেখে মনে হয় যেন পোলার ভালুকের চামড়া দিয়ে সেগুলো ঢেকে দেয়া হয়েছে।
মি. ক্রাইডারম্যান বেলচা দিয়ে বরফ সরিয়ে ফেলেন না, কারণ তিনি ভাবেন সেটা স্থায়ি না। মিসেস ক্রাইডারম্যান বললেনÑতিনি মনে করেন যে তিনি একদিন সকালে উঠে দেখবেন-সব বরফ চলে গেছে।
বাড়িটার ভেতরে ঢুকলে বাইরে দৃষ্টি যাবার উপায় নেই। শুধুমাত্র কিচেনের সিঙ্কের ওপরের জানালাটা ছাড়া। লিভিংরুমে মিসেস ক্রাইডারম্যান সোফায় শুয়ে সমস্ত দিন অতিবাহিত করেন। তার চারপাশে কুশন থাকে। অ্যাশট্রে, কাপ, গ্ল¬াস আর ম্যাগাজিন থাকে। তিনি অন্তঃসত্ত্বা।
আমার প্রথম কাজ হলো সবকিছু পরিপাটি করা। মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা খবরের কাগজগুলো তুললাম। কুশনগুলো টুকিয়ে চেয়ারে আর সোফায় রাখলাম। কফি আর চায়ের কাপগুলো অবশিষ্ট কফি বা চা-সহ কিচেনে রেখে এলাম। ভেজা ভারি ফল, মদের তলানি‒সব কিচেনে আনলাম। কিচেনে এসে আমি অবশিষ্ট সব পানীয় পান করে ফেললাম, ভেজা ফলগুলো চুষলাম মদের অদ্ভুত স্বাদ পেতে।
মিসেস ক্রাইডারম্যানের বাচ্চা আশা করা যাচ্ছে শেষ জুন বা জুলাইয়ের প্রথমে। তারিখের অনিশ্চয়তার কারণ তার মেনস্ট্রুয়্যাল সাইকেলে অনিয়মের কারণে। (এই প্রথম আমি কাউকে ‘মেনস্ট্রুয়্যাল’ বলতে শুনলাম)। আমরা বলতাম ‘মাসিক’ বা ‘অভিশাপ’। মিসেস ক্রাইডারম্যান নিশ্চিত যে, যে রাতে তিনি শ্যাম্পেনে ডুবে ছিলেন মি. ক্রাইডারম্যানের জন্মদিনে, সে রাতেই তিনি অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন। উনত্রিশে সেপ্টেম্বর। মি. ক্রাইডারম্যানের তেত্রিশতম জন্মদিন। আর মিসেস ক্রাইডারম্যানের বয়স তখন চল্লি¬শ। তিনি বললেন, তাকে মূল্য দিতে হচ্ছে। গর্ভবতী হবার জন্য চল্লি¬শ খুব বেশি বয়স। তাঁরা ভুল করেছেন।
তিনি তার ক্ষতিগুলো দেখালেন। প্রথমত, মুখে আর ঘাড়ের দাগগুলো দেখালেন। তারপর তিনি তাঁর ফুলে ওঠা শিরা দেখালেন, যা তাঁকে সোফায় শুইয়ে রাখছে। তাঁর পায়ে জেগে ওঠা সবুজ পি-গুলো দেখালেন। মেঝেতে পা রাখার আগে তাকে রাবারের লম্বা, আঁটো ব্যান্ডেজগুলোতে পা রাখতে হতো।
‘আমার উপদেশ গ্রহণ করো আর অল্প বয়স থাকতেই বাচ্চা নাও।’ তিনি বললেন, ‘বাইরে বেরিয়ে পড়ো আর চটজলদি প্রেগনেন্ট হও, যদি সম্ভব হয়। আর আমি ভাবি, আমি এইসব কিছুর উর্র্ধ্বে।’ হা-হা।
মনে হয় তাঁর মাত্রাবোধও আছে। কারণ তিনি বললেন, ‘তোমার আন্টকে বলো না যেন আমি এভাবে বলেছি।’
যখন মিসেস ক্রাইডারম্যান ইভাঞ্জেলিন স্টিউয়ের ছিলেন তখন তিনি এই বাড়িতে থাকতেন না। মাঝেমধ্যে বন্ধুবান্ধবদের সাথে এখানে বেড়াতে আসতেন। শহরে তাঁর আগমন ছিল সংক্ষিপ্ত এবং লক্ষণীয়। আমি তাকে তার পেজ-বয়৮ মার্কা চুলের ওপর কমলা রঙের স্কার্ফ পরে, গাড়ির ছাত উঠিয়ে ড্রাইভ করতে দেখেছি। আমি তাকে দেখেছি ওষুধের দোকানে, শর্টস আর পেছন উন্মুক্ত জামা পরা। আমি তাকে চার্চে দেখেছি সিল্কের গোলাপ ফুল লাগানো জালির হ্যাট পরা।
তিনি আমাদের এখানের বাসিন্দা ছিলেন না। তিনি ছিলেন অন্য জগতের একজন। যে জগতটাকে আমরা ম্যাগাজিন আর মুভিতে দেখে থাকি। এক ধরনের বর্ণিল তুচ্ছতার জগত। কমেডিয়ান, বলরুমের মিউজিক, ককটেল গ্ল¬াস। তিনি ছিলেন সেই জগতের সাথে আমাদেরকে সংযোগকারি একটা মাধ্যমÑআমাদের সাক্ষি তিনি যে, এরকম একটি জগত আছে। এই জগতের মাত্রাহীন পাপ আর নিষ্ঠুর বিলাসিতা‒এসব আমাদের কাছ থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন ছিলনা। বাড়িতে তার ঘূর্ণি পরিদর্শনের মাধ্যমে তিনি আমাদের জগতের সাথে সম্পর্ক রাখতেন। তাকে সবাই ক্ষমার চোখেই দেখত। এমনকি আন্ট এনাও ইভাঞ্জেলিন স্টিউয়েরকে কিছু অনুগ্রহ প্রদর্শন করে বসলেন।
কিন্তু এখন ইভাঞ্জেলিন স্টিউয়ের কী করেছেন? তিনি একজন মিসেস হয়েছেন, অন্য যে কোনো রমণীর মতো। তিনি একটি স্থানিয় নিউজপেপার কিনে নিলেন, তার হাজব্যান্ডকে দিয়ে সেটা চালানোর জন্য। হয়েছেন সন্তানসম্ভবা। তিনি তার অনুষ্ঠান হারিয়ে ফেলেছেন। তার সবকিছু লেজেগোবরে হয়ে গেছে।
‘আমার দিকে তেমন মনোযোগ দেবার প্রয়োজন নেই, জেসি। আমাকে কখনো এমনভাবে বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়নি। আমি সবসময় কিছু না কিছু নিয়ে থাকতাম। ডাক্তার যে ছাইয়ের কাজ করে, তা হলো সে বলে, আমার নাকি একটু ভালো কিছু হবার আগে একটু খারাপ থাকতে হবে। যা ভেতরে যায়, সেটা বের হবেই। মাত্র পাঁচ মিনিটের আনন্দ অথচ নয়টা মাসের যন্ত্রণা। আমি ডাক্তারকে বলেছিলাম।’
তিনি মনোযোগ দিতে নিষেধ করলেও আমি দিলাম। অতটা চোখ-কান খোলা রেখে আগে কখনো মনোযোগ দিইনি। মেরিবেথকে সবকিছু খুলে বললাম। বললাম লিভিংরুম, মিসেস ক্রাইডারম্যানের পোশাক-পরিচ্ছদ, কিচেনের কাউন্টারে নানা রংবেরঙের বোতল সম্পর্কে। কাবার্ডে টিনভর্তি খাবার‒ভাঁপের ঝিনুক, রূপালি হেরিং মাছ, চেস্টনাট আর বড় টিনে শুয়োরের রানের গোশত, ফলের পুডিং‒এসব খুঁটিনাটির বিবরণ দিলাম।
আমি মেরিবেথকে মিসেস ক্রাইডারম্যানের ফুলে ওঠা শিরা, পায়ের পি-, ব্যান্ডেজÑএসবের কথা জানালাম। তিনি তাঁর সমস্যাগুলোর কথা ফোনে তার বন্ধুদের বলছিলেন, আমি শুনতে পেয়েছিলাম। তার বন্ধুদের নাম-বান্ট, পুকি, পাগ আর স্পিটি। সুতরাং বুঝা যাচ্ছিল না তারা মহিলা না পুরুষ। ওদের মধ্যে তার নিজের নাম ছিল জেলি।
আন্ট এনা লক্ষ করলেন যে, আমি খুব বেশি ইস্ত্রি করছিলাম না। বললাম, ‘এটা আমার ত্রুটি না। মিসেস ক্রাইডারম্যান লিভিংরুমে আমার সাথে কথা বলে আমাকে দেরি করিয়ে দিয়েছেন।’
‘তাঁকে কথা বলতে দাও, কিন্তু তুমি তোমার কাজ করে যাবে। সেজন্যই তো তোমাকে বেতন দেয়া হচ্ছে। আমি তোমাকে লিভিংরুমে ইস্ত্রি করার কাজটা করতে দিচ্ছি। কিন্তু তোমাকে মি. ক্রাইডারম্যান বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে কেটে পড়তে হবে। তিনি যেখানে থাকেন, তিনি তাঁর আশেপাশে কাজের লোক থাকাটাকে পছন্দ করেন না।’
মিসেস ক্রাইডারম্যান জানালেন যে, মি. ক্রাইডারম্যান অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে জন্মেছেন এবং বড় হয়েছেন কলাগাছ পরিবেষ্টিত একটি বিশাল বাড়িতে। মি. ক্রাইডারম্যান অষ্ট্রেলিয়া ত্যাগ করেন এবং সিঙ্গাপুরে এসে সাংবাদিক হন। বার্মায় জাপানিদের হাতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনি পরাজিত হবার পর তাদের সাথে তিনি ছিলেন। তিনি হেঁটে বার্মা থেকে ইন্ডিয়ায় যান।
অল্প কয়েকজন ব্রিটিশ সেনা, কিছু আমেরিকান কয়েকটি স্থানিয় মেয়ে, আর নার্সদের একটা দলের সাথে মি. ক্রাইডারম্যান চললেন। মেয়েগুলো যা করত সেটা শুধু স্তোত্রগীত করা। তাদের সবাইকে খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করা হয়।
তাদের পক্ষে আর চলা সম্ভবপর ছিলনা। তারা আহত আর অসুস্থ ছিলেন‒দিনের পর দিন তীব্র গরমে হেঁটেছেন, বুনো হাতিদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন। মি. ক্রাইডারম্যান একটা বই লিখতে যাচ্ছেন। তাঁরা সেখানে ম্যালেরিয়ার শিকার হন। তাঁদেরকে ভেলা বানিয়ে নদী পার হতে হয়েছিল। তারা হিমালয়ের অঞ্চল পার হয়েছিল হেঁটে। তারা ছিল বীর। অথচ কেউ তাদের সম্পর্কে কিছু জানত না।
‘কেমন সন্দেহজনক,’ ভাবলাম আমি, ‘হিমালয় অঞ্চলে প্রচ- গরম! হিমালয় তো চির তুষারাবৃত!’
তিনি বলে চললেন‒‘আমি বান্টকে বললাম‒এরিক বার্মায় ব্রিটিশদের হয়ে যুদ্ধ করেছিল। আমার কথায় বান্ট বলল, ব্রিটিশরা বার্মায় যুদ্ধ করেনি বরং জাপানিরাই তাদের পাছা ঘষেছিল ব্রিটিশদের ওপর। কী বলব তোমাকে? মানুষজন কিছুই জানেনা। বান্ট হেঁটে ইয়ঙ্গ স্ট্রিটের শেষ মাথায় যেতে পারবে কিনা সন্দেহ।’
তিনি আরো বললেন, ‘প্রায় সিকি শতাব্দী পরে, আমি সেই যাত্রা সম্পর্কে পড়লাম যেÑজেনারেল স্টিলওয়েল তাঁর দলবল নিয়ে বার্মা থেকে ইন্ডিয়া পাড়ি দেন চিনদুইন নদী ধরে। তাঁর সাথে নোংরা আর অনাহারে প্রায়-মৃত কিছু ব্রিটিশ কমান্ডো ছিল। মি. ক্রাইডারম্যান তাদের একজন হতে পারেন।’
মি. ও মিসেস ক্রাইডারম্যানের দেখা হলো যখন মিসেস ক্রাইডারম্যান তার টরোন্টোর অ্যাপার্টমেন্ট সাবলেট দিতে চাইলেন। মি. ক্রাইডারম্যান কানাডায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার পরিকল্পনা করছিলেন তখন। আর মিসেস ক্রাইডারম্যান বন্ধুদের সাথে মেক্সিকো ভ্রমণের পরিকল্পনা করছিলেন। মি. ক্রাইডারম্যানকে দেখার পর মিসেস ক্রাইডারম্যান তাঁর প্রেমে পড়ে গেলেন। বন্ধুরা তাঁকে মি. ক্রাইডারম্যানকে বিয়ে করতে না করল। মি. ক্রাইডারম্যান তাঁর চেয়ে সাত বছরের ছোট, তালাকপ্রাপ্ত। তাঁর স্ত্রী আর সন্তান অষ্ট্রেলিয়ার কোনো এক স্থানে বাস করছিল। আর তাঁর কোনো টাকাপয়সা ছিলনা। সবাই বলত, মি. ক্রাইডারম্যান একজন অভিযাত্রী। কিন্তু মিসেস ক্রাইডারম্যান দমলেন না মোটেও। তিনি ছয় সপ্তাহের মাথায় মি. ক্রাইডারম্যানকে বিয়ে করলেন আর বন্ধুদের কাউকে সেই বিয়েতে নিমন্ত্রণ করলেন না।
আমি ভাবলাম তাঁর এই বর্ণনায় আমার কিছু যোগ করা দরকার। তাই বললাম, ‘মি. ক্রাইডারম্যান অভিযাত্রী হওয়ায় কেন আপনার বন্ধুরা এতে অমত করলেন?’
‘হা। হা।’ মিসেস ক্রাইডারম্যান বললেন, ‘শুধুমাত্র সেটাই তারা বুঝায়নি। তারা বুঝাতে চাইল যে, সে বোধহয় আমার টাকার লোভে আমাকে বিয়ে করতে চাইল। তার অভিজ্ঞতার ওপর বই লেখার সময়টাতে আমি তাকে জীবন ধারণের জন্য টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করতে চেয়েও তাঁকে রাজি করাতে পারিনি। সে স্বাধীন ও মুক্ত থাকতে চায়।’
যেইমাত্র দরজায় মি. ক্রাইডারম্যানের আগমন টের পেলাম, আমি পূর্বের নির্দেশমতো ইস্ত্রি করার সরঞ্জাম নিয়ে দৌড়ে গেলাম কিচেনে। মিসেস ক্রাইডারম্যান মিষ্টি, নরম আর আদুরে গলায় বললেন-‘এটা কি আমার সোনামণি ঘরে এলো? আমার ছোট্ট লর্ড ফন্টলেরয়? এটা আমার সেই পাগল ডিঙ্গো?৯’
মি. ক্রাইডারম্যান হলে ঢুকে জুতো খুলতে খুলতে উত্তর দিতেন এভাবেÑএটা ডিক ট্রেসি, বা নাবিক বার্নাকল বিল। তারপর তিনি লিভিংরুমে আসতেন আর সোজা চলে যেতেন সোফায়, যেখানে মিসেস ক্রাইডারম্যান দুই হাত ছড়িয়ে শুয়ে থাকতেন। তাঁরা মাতালের মতো চুমু খেতেন।
‘মি. ক্রাইডারম্যান মিসেস ক্রাইডারম্যানকে টাকার জন্য বিয়ে করেছেন।’ আমি মেরিবেথকে বললাম। মেরিবেথ জানতে চাইল মি. ক্রাইডারম্যান দেখতে কেমন।
‘পাঁক থেকে তুলে আনা কোনো কিছু।’ আমি আন্ট এনার উদ্ধৃতি দিয়ে বললাম। তিনি যখন মি. ক্রাইডারম্যানকে প্রথম দেখেন তখন তাঁর কাছে এমনই মনে হয়েছিল। আমি আন্ট এনার বলাটা পুনরাবৃত্তি করলামÑকারণ তাঁর বলার ঢংটা আমার মনে ধরেছিল। যদিও মি. ক্রাইডারম্যানকে তেমন মনে হয়নি। তবে এটা সত্যি যে, তিনি ঢ্যাঙ্গা আর পাতলা আর পাংশুবর্ণের। পেন্সিলে আঁকার মতো গোঁফ, ঠা-া-তীর্যক চাহনি আর শ্লে¬ষাত্মক হাসি।’
‘ঘাসের মধ্যে কোনো সাপের মতো।’ আমি শুধরে দিয়ে বললাম।‘মিসেস ক্রাইডারম্যান মি. ক্রাইডারম্যানকে বললেন যে, আমি নাকি ইতিহাসে রীতিমতো জিনিয়াস। এজন্য যে, তিনি একটা ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়ছিলেন আর আমি সেখানে সরলভাবে ব্যাখ্যা করে কিছু অংশে তাঁর বিভ্রান্তি দূর করে দিলাম। আমি ব্যাখ্যা করলাম পিটার দি গ্রেট কীভাবে ক্যাথেরিন দি গ্রেটের সাথে সম্পর্কিত হলেন।’
‘সেই রকমই কী?’ মি. ক্রাইডারম্যান জানতে চাইলেন। তাঁর উচ্চারণে তাঁকে কানাডিয়-এর চেয়ে অপেক্ষাকৃত কোমল কিন্তু আলুথালু মনে হলো। ‘তোমার প্রিয় লেখক কে?’ তিনি জানতে চাইলেন।
‘দস্তয়েভস্কি ( Dostoyevsky )।’ আমি বললাম বা বলেছিলাম বলে ভাবলাম।
‘দস্তয়Ñভেৎস্কি ( Dostoy-vetsky), ),’ বললেন মি. ক্রাইডারম্যান চিন্তাশীল ভঙ্গিতে। ‘তাঁর বইয়ের মধ্যে তোমার প্রিয় বই কোন্টি?’
আমি তাঁর এরকম অনুকরণে থতমত খেলাম।
বললাম, ‘দি ব্রাদার্স কারামাজভ।’ (দস্তয়ভস্কির লেখা ওই একটা বই-ই পড়েছিলাম)।
‘সেখানে তোমার কাছে সবচে’ প্রিয় ভাই কোন্টা?’ মি. ক্রাইডারম্যান হাসছিলেন, আমাকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছেন মনে করে।
‘মিতিয়া।’ বললাম। আমি তেমনটি নার্ভাস হইনি। আর আমি প্রস্তুত ছিলাম ব্যাখ্যা করতে কেন এমন যেÑআলিওশা খুব বেশি দেবদূতের মতো, ইভান খুব বুদ্ধিমানÑইত্যাদি। বাড়ি ফেরার পথে কল্পনা করলাম যে, আমি ব্যাখ্যা করেছি তাঁকে। আর আমি যখন বলছিলামÑমি. ক্রাইডারম্যানের মুখভাব পরিবর্তিত হলো আর সেখানে ফুটে উঠল সমীহভাব। কিন্তু পরে উপলব্ধি করলাম যে, আমি উচ্চারণে ভুল করেছিলাম।
‘আমি সুযোগ পাইনি ব্যাখ্যা করতে, কারণ মিসেস ক্রাইডারম্যান সোফা থেকে চিৎকার করে উঠলেনÑফেভারিট, ফেভারিট! সবার কাছে প্রিয় একজন বয়স্ক প্রেগনেন্ট মহিলা কে? আমি সেটাই জানতে চাচ্ছি।’
যাহোক, ক্রাইডারম্যাদের নিয়ে আমি খুব মজা করলাম মেরিবেথের সাথে। যাই করি না কেন, আমি তাঁদের কাছে কিছু চাচ্ছিলামÑমনোযোগ আর স্বীকৃতি। আমি মিসেস ক্রাইডারম্যানের ‘আমি ইতিহাসে জিনিয়াস’ কথাটা বলা পছন্দ করেছিলাম।
মেরিবেথেরও নতুন কিছু বলার ছিল। বিয়েট্রিসের একটি ছেলে বন্ধু ছিল। ওদের এনগেজমেন্ট হতে পারে। মেরিবেথ বলল যে ওরা ফাটাফাটি রকমের চালিয়ে যাচ্ছে।
বিয়েট্রিসের বয়ফ্রেন্ড ছিল একজন শিক্ষানবিশ ক্ষৌরকার। বিয়েট্রিস হাসপাতালে শিফট ডিউটি করে ফিরে এলে সে বিয়েট্রিসের সাথে বিকেলগুলোতে দেখা করতে লাগল, তার ক্ষৌরকর্মে স্থবিরতা বিরাজ করছিল।
বিয়েট্রিসের মাঝে কর্মচাঞ্চল্য দেখা গেল। সে রুম সাজাতে আর বিছানা গুছাতে লেগে গেল। বিছানার সব কভার তুলে ফেলল। একটা অ্যাবজর্ভেন্ট কটন প্যাড স্থাপন করে আমাকে স্মরণ করিয়ে দিল যে, আমি আগে বেহায়ার মতো রাবারের ওপর ঘুমোতাম। আমি মাঝেমধ্যে বিছানা ভেজাতাম।
সে বিছানার কাভার বদলাল। বাথরুমে গেল। বিছানাটা যেভাবে গুছিয়েছে, সেভাবে নিজকে গুছাতে। তার মধ্যে একটা সাংঘাতিক গৃহিণীপনা ভাব জেগে উঠল। সে তখনো আমাদেরকে কিছুই বলেনি। বাথরুমে পানি পড়ছিল। কী করছে বিয়েট্রিস? সম্ভবত স্পঞ্জ করছে। আমরা বাথরুমের পাশ দিয়ে নিচে যাবার পথে মেরিবেথ চিল্লি¬য়ে বলল, ‘আমরা বিস্মিত হবো না সে এগিয়ে গেলে বা আমাদের সামনেই কাজটা সারলে।’
আমরা বারান্দার ধাপে বসলাম।
‘ওর লজ্জা নেই।’ মেরিবেথ বলল, ‘আর আমাকে ওর সাথেই বিছানায় শুতে হবে। সে এই প্যাডটা হাসপাতাল থেকে চুরি করেছে। তুমি কখনো তাকে বিশ্বাস করতে পারবে না। সে ছোটোকাল থেকেই এমন। একবার আমরা ঝগড়া করলাম। এরপর সে বলল, চলো মিটমাট করে ফেলি আর হ্যান্ডশেক করি। আমি যেইমাত্র শেক করার জন্য ওর হাতটা ধরলাম, দেখলাম তার হাতে একটা কটা ব্যাঙ! ব্যাঙটা লাফিয়ে পড়ে ওর বাথরুমেই চলে গেল।’
‘তখনো বরফ পুরোপুরি যায়নি। কনকনে ঠা-া বাতাসের সাথে জলাভূমির গন্ধ আসছিল শহরে। সেই নাপিতের আনাগোনা চলল। সে তার শাদা ওভারওল পড়ে, মাথা নিচু করে চটপট চলে এলো। কিন্তু সে আমাদেরকে সেখানে আশা করেনি।’
‘হাই দেয়ার!’ সে নার্ভাস কন্ঠে বলল।
মেরিবেথ ওর কথার উত্তর দিল না। আমিও না। মেরিবেথ দেয়নি বলেই। আমরা বারান্দা থেকে উঠলাম না। সরে গিয়ে ওর যাবার পথ করে দিলাম। আমি দরজা খোলা ও বন্ধ করার শব্দ শুনতে চাইলাম। শুনতে পেলাম না।
ভাবছিলাম সেই মুহূর্তে কী চলছে? অভিবাদন, দৃষ্টিবিনিময়? তারপর কাপড় খোলা?…খুলে ফেলো। হ্যাঁ। এখন শুয়ে পড়ো। তোমার পা দু’টো ফাঁক করো। শান্ত আদেশ, বোবা আনুগত্য। বিয়েট্রিস আজ্ঞানুবর্তী। নাপিতদের নবিশÑহাড্ডিসার, ঘাড়ে দাগযুক্ত, উদ্ধত হয়ে বেড়ে ওঠা নাপিত এখন তার বিকৃত শক্তি প্রয়োগ করতে যাচ্ছে। এখন…।
‘একবার, একটা ছেলে আমাকে এই কাজ করতে বলেছিল।’ মেরিবেথ বলল, ‘আর আমি তাকে প্রায় এক্সপেল্ড হওয়ার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলাম।’
মেরিবেথ জানাল, কীভাবে গ্রেড সেভেনের একটা ছেলে একটা নোটে UÑDo you want to F – .? লিখে ওর কাছে পাঠাল। মেরিবেথ শিক্ষককে সেই নোটটা দেখিয়েছিল।মেরিবেথ বারান্দার ধাপ থেকে লাফিয়ে নেমে আমার মুখোমুখি হলো। আমার হাঁটুতে হাত রেখে বলল, ‘আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম-আমরা আমরা একে অন্যের কাছে সবকিছু বলবো।’
আমি মাথা নাড়লাম।
‘কিন্তু তুমি আমাকে কিছু বলোনি, সেটা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে।’
ওর কথায় আমি ঠোঁট ঘষলাম। যেন গোপন বিষয়টা আর চেপে রাখতে পারলাম না। বললামÑ‘আসলে সে আমার প্রেমে পড়েছিল।’
‘জেসি! আমাকে খুলে বলো।’
মেরিবেথ প্রতিজ্ঞা করেছিল যে তার ‘এভারশার্প’ পেন্সিল সে স্কুলে একটা পুরো বছরে ব্যবহার করতে দেবে। সে বলেছিল যে, আমি তার ফাউন্টেন পেনও ব্যবহার করতে পারি। সে প্রতিজ্ঞা রাখেনি-পেন্সিল আর ফাউন্টেন পেন, দুই ক্ষেত্রেই।
আমি প্ল¬্যান করেছিলাম যে আমি তার সাথে আরো কিছুটা সময় মশকরা করে যাব। তারপর বলবো যে, এটা একটা জোক ছিল।
‘জেসি, আমি তোমাকে একটা বালা দেব। ধার না। একদম দিয়ে দেব। তুমি যেটা চাও।’
‘আমি যদি তার নাম বলি, সেটা বালা পাওয়ার জন্য বলবো না।’
‘ঈশ্বরের দিব্যি। বলো আমাকে।’
‘মি. ক্রাইডারম্যান,’ আমি কোমল কন্ঠে বললাম। আমি মিথ্যেটা বলে ভারাক্রান্ত হওয়ার বদলে হালকা অনুভব করলাম।
মেরিবেথ আমার হাঁটু থেকে হাত সরিয়ে সোজাসুজি বসল। বলল, ‘তিনি তো বয়স্ক। আর তুমি বলেছিলে তিনি দেখতে কুৎসিত। তিনি বিবাহিত।’
‘আমি কখনো বলিনি তিনি কুৎসিত,’ বললামÑ‘তাঁর বয়স মাত্র তেত্রিশ।’
‘এমনকি তুমি তাকে পছন্দও করো না!’
‘যখন তুমি প্রেমে পড়ো, সেটা সেখানেই শুরু হয়।’
আমি একজন বৃদ্ধ মহিলাকে জানতাম, যিনি তার জীবন সম্পর্কে বলতে গিয়ে একটা সময় আমাকে বলেছিলেনÑতিনি তিনটি বছর কাটিয়েছিলেন রবার্ট ব্রাউনিং-এর সাথে প্রেম করে। ভদ্রমহিলা জরাগ্রস্ত ছিলেন না। আত্মবিশ্বাসী আর সোজাসাপ্টা বৃদ্ধা ছিলেন। তিনি ব্রাউনিং-এর কবিতার প্রেমে পড়েননি বা সেসব নিয়ে পড়ে থাকতেন না। তিনি বলেছিলেনÑতিনটি বছর তিনি ব্রাউনিং-এর প্রেমে মজে ছিলেন। তিনি আমাকে কিছু বলেননি বা ব্যাখ্যা করেননি। তার কল্পনায় তিনি এমনভাবে মজেছিলেন যে, এমনকি এটা যে তার কল্পনা, সেটাও তিনি বলাটা নিষিদ্ধ ভাবতেন।
সেই বসন্তে আমি মি. ক্রাইডারম্যানের সাথে যে প্রেম চালালাম‒সেটা আমার জীবনে আর মেরিবেথের সামনেÑতেমন গুরুত্ববহ কিছু না। কিন্তু সে কাজটা আমাকে ব্যস্ত করে রাখল। মেরিবেথকে অনেক কিছুই বানিয়ে বলে যেতে লাগলাম। কিন্তু একটা সময় আর কল্পনায় সবকিছু সাজাতে পারলাম না।
আমি কিছু বিপরীতমুখি কাজ করলাম। আমি বেল্ট আঁটো করে না বেঁধে, মেকাপ না করে আন্ট এনার ঢিলেঢালা ব্ল¬াউজ পড়ে স্কুলে যেতে লাগলাম। মেরিবেথকে বললাম যে, মি. ক্রাইডারম্যান আমাকে এভাবেই ড্রেস করতে বলেছেন আর চুল বিনুনি করে রাখতে বলেছেন। তিনি আর কেউ আমার চুলের দিকে বা আমার বুকের পাশের উন্মুক্ত স্থান দেখে ফেলুক সেটা তিনি চাইতেন না।
আমার কল্পনায়, তিনি সাহসী হয়ে উঠলেন। তিনি হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগলেন, ফিসফিসিয়ে কথা বললেন, আমার চোখের পাতায় চুমু খেলেন।
বাস্তবের মি. ক্রাইডারম্যান? বাস্তবে আমার কল্পনার সব ফানুস উড়ে গেল। কোনো আকর্ষণীয় আলাপচারিতার আর কোনো সম্ভাবনা খুঁজে পেলাম না।
মেরিবেথ আমাকে সমর্পণ করতে না করল। ‘তুমি কি মিসেস ক্রাইডারম্যানকে বিষয়টা জানাতে পারো না?’ সে বলল।
‘জানানো মানে তাঁকে হত্যা করা। তিনি মরে যেতে পারেন যেখানে তাঁর পেটে বাচ্চা রয়েছে।’
‘তিনি মরে গেলে কি তুমি মি. ক্রাইডারম্যানকে বিয়ে করবে?’
‘আমার বয়স কম।’
‘তিনি অপেক্ষা করতে পারেন। তিনি যেমন বলছেন, তেমনভাবে যদি তিনি তোমাকে ভালবাসেন। বাচ্চা লালন-পালনের জন্য তার কাউকে দরকার হবে। তিনি কি মিসেস ক্রাইডারম্যানের সব টাকাপয়সা পাবেন?’
বাচ্চা’র উল্লে¬খ আমাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনল। ক্রাইডারম্যান-পরিবারে যা ঘটছে এখন বাচ্চাকে ঘিরে, সেটা কেমন অস্বস্তিকর আর অরুচিকর। মিসেস ক্রাইডারম্যান আমাকে ডাকলেন আর পেটের ভেতরে বাচ্চা যে লাথি চালাচ্ছে, সেটা দেখালেন। তিনি সোফায় শুয়ে ছিলেন। তিনি কুশনে তার তলপেট ঢেকে রেখেছিলেন। বললেন, ‘দেখো! কেমন লাফায়!’ দেখে আমার কপালে ঘাম জমল। আমার গলায় যেন কী আটকে গেল। তিনি হেসে উঠলেন আর কুশনটা পড়ে গেল। আমি দৌড়ে কিচেনে চলে গেলাম।
‘জেসি, তুমি কীসের ভয় পাচ্ছো!’ তিনি বলে উঠেছিলেন।
ক্রাইডারম্যানদের বাড়িতে আরো দু’টি দৃশ্য:
মি. ক্রাইডারম্যান আগে ফিরে ফিরেছেন বাড়িতে। স্কুল থেকে ফিরে সেখানে পৌঁছে মি. ও মিসেস ক্রাইডারম্যানকে একত্রে দেখলাম লিভিংরুমে।
মিসেস ক্রাইডারম্যান সমস্ত পর্দা বন্ধ করে রেখেছেন, যদিও বাইরে বসন্তের দিন। মে’র গরম হাওয়া। পর্দা দিয়ে রাখার কারণ হলো কেউ যেন তার বর্তমান আকার না দেখতে পারে।
বাইরের গরম হাওয়া থেকে ভেতরে এলাম আমি। পর্দা ফেলা বদ্ধ ঘরে ধুনা পুড়ছিল। সেখানে দুই ক্রাইডারম্যান মদ পান করছিলেন আর ফিকফিক করে হাসছিলেন। মি. ক্রাইডারম্যান সোফায় বিড়ি পাকিয়ে বসে ছিলেন।
‘আমাদের উদযাপনে যোগ দেয়ার সময়!’ মি. ক্রাইডারম্যান বললেন, ‘এটা আমাদের বিদায় পার্টি! জেসি। ফেয়ারওয়েল, গুডবাই।’
‘নিজকে সামলাও।’ মিসেস ক্রাইডারম্যান তাঁর নগ্ন গোড়ালি দিয়ে মি. ক্রাইডারম্যানের পায়ে বাড়ি দিয়ে বললেন‒‘আমরা এখনো যাইনি। আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে, এই দানবীয় শিশুটার জন্মগ্রহণ পর্যন্ত।’আমার মনে হয়েছিল ওঁরা মদোন্মত্ত।
‘এরিক বইটা লিখতে যাচ্ছে।’ তীক্ষèস্বরে বললেন মিসেস ক্রাইডারম্যান। তিনি ফের গোড়ালি নাচালেনÑ‘আর আমরা এই দানব জন্মাবার সাথে সাথে এখান থেকে চলে যাচ্ছি।’
‘সত্যিই একটা দানব?’ মি. ক্রাইডারম্যান জানতে চাইলেন‒‘তার দু’টি মাথা থাকবে? আমরা কি ওটাকে দু®প্রাপ্য কোনো শো-তে দিয়ে বিস্তর পয়সা উপার্জন করতে পারব?’
‘আমাদের পয়সার দরকার নেই।’
‘আমার আছে।’
‘আমি জানিনা এর দুইটি মাথা থাকবে কিনা। তবে আমার মনে হয় এ পঞ্চাশ ফিট হবে। এ সেদিন জেসিকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল।’
তিনি তখন বললেন আমি কীভাবে দৌড়ে পালিয়েছিলাম।
‘ভয় পেলে চলবে না। তোমাকে এসব ব্যাপারে অভ্যস্ত হতে হবে।’ মি. ক্রাইডারম্যান বললেন, ‘পৃথিবীর কোনো কোনো অংশে তোমার বয়সি মেয়েদের দুই তিনটা বাচ্চা থাকে। তুমি প্রকৃতির সাথে প্রতারণা করতে পারোনা। ছোটো তামাটে বর্ণের মেয়েরা, বাস্তবিক নিজেরাই বাচ্চা‒তাদেরও ছেলেপুলে থাকে।’
‘আমি নিশ্চিত।’ মিসেস ক্রাইডারম্যান বললেন, ‘জেসি ভেড়ার মতো হও। তুমি জানো জিন কী? জানো না? একটা গ্লাসে সামান্য জিন ঢালো, আর কিছু পরিমাণ ওরেঞ্জ জুস মেশাও। সেটা ভিটামিন সি হয়ে যাবে।’
মি. ক্রাইডারম্যান চেষ্টা করলেন উঠে যেতে সেখান থেকে কিন্তু মিসেস ক্রাইডারম্যান তাঁকে বসিয়ে দিলেন। তারপর মি. ক্রাইডারম্যান আবার বললেন, ‘আমার সিগারেট। মনে হয় সেগুলো বেডরুমে আছে।’
তিনি বেডরুম থেকে ফিরে এসে কিচেনে এলেন, লিভিংরুমে না। আমি তখন সিঙ্কের ওপর আইস কিউব ট্রে রেখে তাতে পানি ভরছিলাম।
‘পেয়েছো?’ সোফায় শুয়ে মিসেস ক্রাইডারম্যান উচ্চস্বরে জানতে চাইলেন।
‘এখানে দেখছি।’ মি. ক্রাইডারম্যান জবাব দিলেন।
মি. ক্রাইডারম্যানের হাতে সিগারেটের প্যাকেট। অথচ তিনি কিচেনে এসে এটাসেটা ঘেঁটে প্রচুর শব্দ করে সিগারেট খুঁজতে থাকার ভান করছেন। তিনি আমার গায়ে গা লাগালেন। আমার কাঁধে আর পিঠে হাত বুলালেন। আমি আইস কিউব ট্রে হাতে জানালার বাইরে তাকিয়ে গস্পেল হলের পাশে পার্ক করা একটা পুরনো বাস দেখতে লাগলাম।
আমার গলায় মি. ক্রাইডারম্যানের আঙুলের ডগা চলতে শুরু করেছে। প্রথমে খুব হালকাভাবে। তারপর গভীরভাবে। তারপর এতটাই গভীরভাবে যে মনে হলো আমার গলায় দাগ বসে যাবে।
‘হ্যাঁ, পেয়েছি সিগারেট।’
আমি যখন মিসেস ক্রাইডারম্যানের পানীয় নিয়ে এলাম, মি. ক্রাইডারম্যান স্ট্যান্ড-আপ অ্যাশট্রের পাশে আর্মচেয়ারে বসে আছেন।
‘তুমি যেখানে বসেছিলে, সেখানে এসেই বসো না।’ মিসেস ক্রাইডারম্যান মিষ্টি গলায় বললেন।
‘আমি ধূমপান করছি।’ তিনি বললেন।
…আর এদিকে আমার গলাটা কেমন যেন টনটন করছিল।
দ্বিতীয় দৃশ্যটি কয়েকদিন পরের, ক্রাইডারম্যানদের বাড়িতে আমার চাকরগিরির আরেকটি দিনে:
মি. ক্রাইডারম্যান বাগানে কাজ করছিলেন। তখনো তিনি টাই পরে ছিলেন। নিড়ানি হাতে তিনি সেখানে কাজ করছিলেন। তিনি আমাকে সতর্ক কন্ঠে ডাকলেন, আমি তাঁর কাছে এলে তিনি আমাকে বললেন, ‘মিসেস ক্রাইডারম্যান ভালো নেই। ডাক্তার ওকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন। বলেছেন যে, আমার আজ বাড়ির ভেতরে না যাওয়াই ভালো।’
আমি তাঁর কাছ থেকে কয়েক গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছি। তিনি বললেন, ‘এদিকে এসো। এখানে, হ্যাঁ। তোমাকে আমার কিছু জিজ্ঞেস করার আছে।’
আমি কম্পিত পদক্ষেপে কাছে গেলাম। তিনি যেটা দেখালেন সেটা তাঁর পায়ের কাছে তাজা পত্রশোভিত লাল কা-ের একটা চারা।
‘এটা কী গাছ, তুমি জানো? আমি কি উপড়ে ফেলব এটা? আমি জানিনা কোন্টা এখানে আগাছা আর কোন্টা না।’
এটা ছিল পীতমূলী গাছ।
কিন্তু আমি বললাম, ‘আমি জানিনা।’
‘তুমি জানো না। আমার কী কাজে আসছো তুমি তবে, জেসি?’ তিনি পুরনো সামারহাউসকে উল্লেখ করে বললেন‒‘আমি জানিনা কীসের জন্য এটা তৈরি করা হয়েছিল। বামুনদের জন্য? এত ক্ষুদ্র প্রবেশদ্বার!’ তিনি কিছু লতা ধরে সরিয়ে, ছিন্ন করে আমাকে বললেন‒‘ভেতরে ঢুকো।’
আমি ঢুকলাম। ভেতরটা একটা ভীষণ গোপনীয় স্থান। ছায়াচ্ছন্ন আর অযতেœ ভরা। মাটির অসমান মেঝেÑপাতার জঞ্জালে পূর্ণ। ছাতটা খুব নিচু। আমরা দু’জনেই নুয়ে প্রবেশ করলাম।
‘তোমার গরম লাগছে?’ মি. ক্রাইডারম্যান জিজ্ঞেস করলেন।
‘না।’ বললাম।
আসলে শীতল দোলা অনুভব করছিলাম আমি। দুর্বলতা আর এক ধরনের আতঙ্কের দোলা।
‘হ্যাঁ। তোমার গরম লাগছে। তোমার চুলের চারপাশটা ঘেমে গেছে।’ তিনি অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে, যেন দেখছেন কতটা আমি ঘেমেছি‒এমনভাবে আমার চুলে আর চিবুকে হাত বুলালেন।
‘এমনকি তোমার কপালও ঘামছে।’ তিনি আবার বললেন।
আমি তার আঙ্গুলে সিগারেটের গন্ধ পেলাম। আর পেলাম সংবাদপত্র অফিসের কালি আর ম্যাশিনের মিশেল গন্ধ। সেই যে সিঙ্কে মি. ক্রাইডারম্যান প্রথম আমার গলা স্পর্শ করার পর থেকে আমি আমার মিথ্যে বলা আর অলীক ভাবনার ফল হাতেনাতে পেয়ে গেলাম। আমি এমন একজন যার জাদুকরি ক্ষমতা আছে কিন্তু অসহায়। কোনো কিছু করার নেই পরিণতিতে সমর্পণ করা ছাড়া। ভাবছিলাম‒আবেগের আক্রমণটা এখানেই, কোনো প্রস্তুতি ছাড়া, পাতার নিচে কোনো ইঁদুর বা পাখির মৃতদেহের সাথে, এই মাটির মেঝেতে হতে যাচ্ছে কিনা।
‘তুমি কি মনে করো জেসি যে আমি তোমাকে চুমু খেতে যাচ্ছি?’ মি. ক্রাইডারম্যান বললেন, ‘ঠিক আছে, জেসি। চলো বসি।’
সামারহাউসের দেয়ালে কিছু বোর্ড থরে থরে বসানো ছিল, সেগুলো বেঞ্চির মতো কাজ করল। কতগুলো ভেঙ্গে গেছে। আমি একটা বোর্ডের ওপর বসলাম। তিনি আরেকটায়। তিনি আমার হাঁটুতে আর স্কার্টে হাত রাখলেন।
‘তোমার কী মনে হয় জেসি, মিসেস ক্রাইডারম্যান আমাদেরকে এখানে দেখে খুশি হবেন?’
বললাম, ‘না।’
তিনি পাতলা কটনের ওপর দিয়ে আমার পায়ে হস্তবিক্ষেপ করলেন। ‘তুমি আবেগী মেয়ে, জেসি। এইরকম ভেতরের স্থানে কোনো পুরুষের আহবানে তোমার আসাটা ঠিক না। তোমার উচিৎ না তাকে চুমু খাওয়ার এরকম সুযোগ তৈরি করে দেয়া। তুমি আসলে প্রচ- আবেগোদ্দীপ্ত। তাই নয় কী? তোমার শিক্ষা হওয়া উচিৎ।’
এভাবেই চলতে লাগল। তিনি একই সাথে লেকচার আর হস্তবিক্ষেপ চালিয়ে যেতে লাগলেন। তিনি বলতে লাগলেন আমি দায়ি, এজন্য। আর তাঁর এই কথাগুলো আমার ভেতরে কম্পন তুলছিল। তাঁর শুষ্ক কন্ঠ ভর্ৎসনা করছিল। তাঁর হাত আমাকে সাড়া দিতে সাহায্য করছিল আর তাঁর কথা আমাকে লজ্জা দিচ্ছিল।
আমি একই সাথে লজ্জা, দ্বিধা আর আকাক্সক্ষা অনুভব করছিলাম। কিন্তু যা তিনি বলছিলেন, সে কারণে আমি লজ্জিত ছিলাম না। আমি লজ্জা অনুভব করলাম আমার বোকামিতে। এরকম একটি নিন্দা আর অবমাননার ফাঁদে জড়িয়ে। আর আমি এখন এটা থামাতে পারছি না।
‘তোমাকে একটা বিষয় জানতে হবে, জেসি। অন্য লোকদের সম্পর্কে জানা। সেই বাস্তবতাকে বুঝা। এটা শুনতে সাধারণ মানের, কিন্তু বিষয়টা কঠিন হতে পারে। বিশেষ করে তোমার ক্ষেত্রে।’
তিনি হয়তো তার স্ত্রী’র উদাহরণ টানছেন। যাঁকে আমি বিবেচনায় আনিনি। কিন্তু সেটাকে আমি অন্যভাবে দেখছি। এটা কি ঠিক না যে, এ পর্যন্ত যত লোককে আমি জানি তারা আমার কল্পনায় রসালো মদদ দাতা ক্রীড়নক ছাড়া খুব বেশি কিছু না? এটা সত্যি।
তিনি একটা পরিবর্তন অনুভব করলেন। তিনি তাঁর হাত সরিয়ে নিলেন। উঠে দাঁড়ালেন। তিনি আমাকে তাঁর সামনে থেকে চলে যেতে বললেন। বাড়িতে যেতে বললেন। তিনি হয়তো আরো কিছু সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। কিন্তু আমি শুনছিলাম না।
মেরিবেথ বলল যে, সে বিশ্বাস করে না।
‘প্রথমে বিশ্বাস করেছিলাম। তারপর বিস্মিত হলাম।’ মেরিবেথ বলল।
‘আমরা আলাদা হয়ে গেছি। বিষয়টা সেখানেই শেষ।’
‘আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না।’ মেরিবেথ বলল রাগ, ভয় আর করুণার মিশ্রস্বরে। সে মাথা নেড়ে বলল, ‘আমার মনে হয় না তোমার আর তাঁর মধ্যে কোনো কিছু হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি না। বলতে বাধ্য হলাম: পাগলের প্রলাপ বকো না।’
উত্তর দিলাম না। আমি দ্রুত হাঁটতে লাগলাম। আমরা স্কুলে যাচ্ছিলাম। বরাবরের মতো ডোমিনিয়ন ব্যাংক কর্ণারে দেখা করলাম। সে তিনটি ব্ল¬ক আগে অপেক্ষা করছিল, আমাকে সে তার কথাটা জানাবার আগে। এখন আমার সাথে হাঁটায় তাল মেলাতে মেরিবেথ রীতিমতো দুলকি চালে চলছিল। সেইসময় আমি আরো ক’টি মেয়েকে দেখলাম, তাদের নাম ধরে ডাকলাম‒তাদের সাথে উচ্ছ্বসিত ভাব প্রকাশ করলাম আর মেরিবেথের দিকে বক্রভাবে তাকালাম। একজন বিশ্বাসঘাতকের যা প্রাপ্য, তেমন দৃষ্টি দিয়ে তাকালাম। আমার মনে হলো এটা তার প্রাপ্য।
সে ভুল করেছে‒আমার আর মি. ক্রাইডারম্যানের মধ্যে অনেক কিছু হয়েছে। মেরিবেথও তার দৃষ্টিকোণ থেকে ঠিক ছিল অবশ্যই। কিন্তু ওর প্রতি আমার অভিমানের তীব্রতা সবকিছু ছাপিয়ে গেল।আমি মেরিবেথের সাথে কথা না বলার সিদ্ধান্ত নিলাম। মেরিবেথ ক্লোকরুমে১০ এলো, আমি সেখানে ছিলাম। সে নরমভাবে বলল, ‘আমরা কি একসাথে বাসার দিকে যাব, জেসি?’ আমি জবাব দিলাম না। সে আমার সাথে সাথে হাঁটতে লাগল, ওকে না দেখার ভান করলাম। পরীক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছিল, আমাদের সময়সূচিতে গোলমাল হয়ে গেল। সুতরাং আমার পক্ষে ওকে সহজেই এড়িয়ে যাবার পথ তৈরি হলো।
একটা চিঠি। আমার ফ্রেঞ্চ ভাষার বইয়ে ভাঁজ করা। আমি সেটা পড়েও দেখলাম না।
সে বলল যে, আমার আচরণ ওকে কষ্ট দিচ্ছে। সে ঘুমোতে পারছে না, খেতে পারছে না। সে ক্ষমা চাইল। সে তার মুখ বন্ধ রাখার ইচ্ছে পোষণ করল। সেটা সে কেমন করে করবে যেখানে আমরা কথাই বলছি না! সে বুঝতে পারল যে, কখনো আমি তার সাথে যে আচরণ করছি তেমনটি সে আমার সাথে করতে পারবে না।
আমি চিঠিটায় চোখ বুলিয়ে এক জায়গায় দেখলাম দু’টো পরস্পরগ্রন্থিত হার্ট আঁকা। তাতে আমাদের দু’জনের নাম লেখা‒জেসি ও মেরিবেথ। আমি আর পড়লাম না চিঠিটা।ওর কাছ থেকে ছাড়া পেতে চাইলাম। আমি ওর অভিযোগ, তার সুন্দর মুখ, ভদ্রস্বভাব প্রভৃতিতে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। তার কাছ থেকে দূরে সরে পড়লাম। কিন্তু আরো ছিল। ওর ফোলা চোখ, ওর করুণ চাহনি আমার ভেতরে সন্তুষ্টি ছড়িয়ে দিল। আমি ওকে আঘাত করে আরো ভালো অনুভব করলাম। ক্রাইডারম্যানদের সামারহাউসে যেটুকুই হারিয়েছিলাম, তার খানিকটা যেন ফিরে পেলাম।
***
কয়েক বছর পর। আমার কাছে খুব বেশি লম্বা সময় না, কিন্তু তখন অনেকটা সময় পর, আমি যে শহরের স্কুলটায় পড়তাম, সেই শহরের মেইন রোড ধরে হাঁটছিলাম। তখন আমি গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট। স্কলারশিপ পেয়েছিলাম আর দস্তয়ভস্কি উচ্চারণে ভুল করতাম না। আন্ট এনা মারা গেছেন।
মারা যাবার সময়টায় তিনি কাজ করছিলেন। একটা ফ্লোরে মোম ঘষে তারপর তিনি বসলেন এবং মারা গেলেন।
ফ্লোরিস বিয়ে করেছিল। প্রতীয়মান হয় যে, জুতোর দোকানের পাশের ওষুধের দোকানের ড্রাগিস্ট গোপনে অনেকটা বছর ওকে প্রণয় নিবেদন করে আসছিল। কিন্তু আন্ট এনা ড্রাগিস্টকে তাঁর আপত্তির কথা জানান, তিনি তাকে পছন্দ করতেন না। সে মদ্যপ আর ক্যাথোলিক।
ফ্লোরিসের কাছাকাছি বয়সের দু’টি ছোটো ছেলে ছিল। জর্জ ফ্লোরিসের সাথে বাস করত। সে ফ্লোরিসের বাচ্চাদের দেখাশোনায় সাহায্য করত।
ফ্লোরিস আগের মতো বিরক্তিকর ছিলনা। সে বন্ধু হতে চাইল। সে ড্রাগস্টোর থেকে আমাকে লিপস্টিক, লোশন, প্রভৃতি এনে দিত।আমি মেইন রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম। ইনস্যুরেন্স এজেন্ট অফিসের জানালা থেকে টাইপিংয়ের খটখট শব্দ আসছিল। আর যে শব্দটা করছিল সে মেরিবেথ। সে সেখানে কাজ করত। সে স্কুলের শেষের দিকে টাইপিং ও বুককিপিং শিখেছিল। সে বিয়েট্রিস ও তার বরের সাথে বাস করছিল, তার বর খুব তাড়াতাড়িই নিজের একটা চুলকাটার দোকান করে ফেলেছিল। সেই বছরটায় মেরিবেথ আর আমার সাথে ভাব করতে আসেনি, যদিও রাস্তায় আমাদের দেখা হতো। তারপর তো সে এই অফিসে যোগ দিল।
ক্রাইডারম্যানরা আগেই চলে গিয়েছিলেন। তারা বাড়ি তালাবদ্ধ করে টরোন্টো চলে গিয়েছিলেন বাচ্চা জন্মাবার আগেই। সেখানেই বাচ্চা হলো। ছেলে বাচ্চা। স্বাভাবিক জন্ম। আন্ট এনা ভীষণ বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন তাঁরা ঠিকভাবে বাড়িঘর আটকে যাননি বলে। তিনি বলেছিলেন, নির্ঘাত ইঁদুরের আস্তানা হবে বাড়িটা। কিন্তু তাঁরা বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছিলেন, পত্রিকাও। পরিপূর্ণভাবে চলে গেলেন তাঁরা।মেরিবেথ আমাকে ইশারা করল ভেতরে আসতে।
‘কত বছর পর!’ মেরিবেথ বলল, ‘আমরা শান্তিপূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলাম।’ সে বৈদ্যুতিক কেটলের প্ল¬াগ লাগাল ইন্সট্যান্ট কফি তৈরি করতে। ইন্স্যুরেন্স এজেন্ট ভদ্রলোক তখন অফিসের বাইরে ছিলেন।মেরিবেথ আগের চাইতে মোটা হলেও তখনো সে সুন্দর। আগের মতোই চমৎকার ড্রেস। সে তার ড্রয়ারে চকোলেট আর ফলের চাটনি রাখত। সে আমাকে মার্জিপ্যান১১ দিল। জিজ্ঞেস করল আমি স্কুলে যাচ্ছি কিনা আর কোনো কোর্স করছি কিনা। আমি জানালাম আমার স্টাডি আর আমার উচ্চাকাক্সক্ষা প্রসঙ্গে।
‘ওয়ান্ডারফুল!’ সে কোনোরকম ভণিতা ছাড়াই বলল, ‘আমি জানতাম তুমি সবসময়ই স্মার্ট।’ তারপর সে আন্ট এনা’র মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করল আর ফ্লোরিসের ব্যাপারে খুশি হলো। সে শুনেছিল ফ্লোরিসের বাচ্চা দু’টি খুব কিউট হয়েছে।
‘বিয়েট্রিসেরও দু’টি বাচ্চা হলো, দু’টি মেয়ে। তারাও কিউট।’দু’জনেই একমত হলাম যে, আমরা খুব লাকি‒দু’জন দু’জনকে খুঁজে পেয়েছি। আর আমরা একসাথে কোনো সময় মিলিত হবার প্রতিজ্ঞা করলাম। সে আমার অ্যাংগোরা১২ স্কার্ফ-এর প্রশংসা করল আর জানতে চাইল এই শহরে এটা পাওয়া যাবে কিনা।
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ। তবে একটাই সমস্যা, প্রচ- লোম ঝরে।’
‘সারারাত ফ্রিজে রেখে দিয়ো। কারণটা জানিনা কিন্তু কাজ করে।’যাবার জন্য আমি দরজা খুললাম। রাস্তা থেকে হাওয়া বয়ে এলো।
‘মনে আছে আমরা কেমন ক্রেজি ছিলাম?’ অনেকটা খেদমাখা সুরে বলল মেরিবেথ।
আমার মাথায় খেলে গেল মি. ক্রাইডারম্যানের কথা। আমার বলা সব মিথ্যা আর সামারহাউসে আমার অগাধ দোদুল্যমান অবস্থা।
‘সেই দিনগুলো আর কোনো দিন ফিরে আসবে না।’ ডেস্ক থেকে তার জিনিসপত্র তুলে নিতে নিতে মেরিবেথ বলল।
আমি হাসলাম, দ্রুত দরজাটা বন্ধ করে বাইরে এলাম। মেরিবেথের উদ্দেশ্যে হাত নাড়লাম। আমি তখন সেইসব পরিবর্তনগুলো অনুভব করলাম…। তার টাইপরাইটার আর তার দিন দিন সুন্দরতর হওয়া। দেখলাম মেরিবেথ ঢুকে গেল।
ক্রাইডারম্যানরা থিতু হয়েছেন অনেক দূরে। কিন্তু আমি নিজে স্বপ্ন দেখে যাই।
১. দুগ্ধস্তম্ভ-ওষধি গাছ
২. ওভেনের স্থানান্তরযোগ্য প্লে¬ট
৩. স্পঞ্জের মতো একপ্রকার তুলতুলে মিঠাই
৪. ঢিলা বা কষে বাঁধার জন্য কর্ড
৫. ভাঁড়ার-ঘর
৬. কাঠ বা বোর্ডের ওপর ছবি কেটে টুকরো করে আবার তা জোড়া দেয়ার এক ধরনের খেলা
৭. ভস্মাধার
৮. মহিলাদের চুলের স্টাইল-কাঁধ পর্যন্ত লম্বা, শেষদিকটা ভেতরে গুঁজানো
৯. অষ্ট্রেলিয়ার বুনো কুকুর
১০. কোট, জামা ঝুলিয়ে রাখার ঘর
১১. বাদাম আর মিঠাইয়ের মিশ্রণে তৈরি
১২. খরগোশ জাতীয় প্রাণির লোম থেকে তৈরি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত