সম্পূর্ণ উপন্যাস: একটি গ্রাম একটি নদী । অমর মিত্র
এই যে আমার অফিস। আমার অফিস, দেবাংশুর অফিস, ইলিনার অফিস। আমাদের অফিস। সেই কবে চাকরিতে ঢুকেছিলাম, মনে হয় আগের জন্মে। এই যে সেই অফিস, কত বড় বাড়ি, ব্লকের পর ব্লক। কত কত ডিপার্টমেন্ট। জেলা সদর। কলকাতার গায়ে। আসলে এই জেলাটি কলকাতার মধ্যেও ঢুকে পড়েছে অনেকটা। এখানে আমি বাইশ বছর চাকরি করেছি। তার আগে করেছি বাঁকুড়া জেলায়। তার আগে বর্ধমানে। তারপর এখানে এসে আর কোথাও যেতে হয়নি। আমার চাকরি প্রায় শেষ হয়ে এল। আর এক বছরও নেই। আমি দেবাংশুকে বললাম, কবে যাবে দেবাংশু?
দেবাংশু বলল, যাব শিগগির। আপনাকে না নিয়ে যাব না।
দেবাংশুর বয়স ফোরটি প্লাস। একচল্লিশ চলছে। এখনো উনিশ বছর চাকরি আছে। দেবাংশুর বাড়ি সুবর্ণরেখা নদীর তীরের একটি গ্রামে। তাদের গ্রামের ঐ অদ্ভূত এক নাম—একটি গ্রাম । সেটেলমেন্ট মৌজা ম্যাপে ঐ গ্রামের কিন্তু আলাদা নাম, কীরতনীয়াশোল। কিন্তু সেই নাম শুধু সরকারি নথিতেই, দেবাংশুরা বলে একটি গাঁ। বলে রবি ঠাকুর তাদের গাঁয়ের কথাই লিখেছিলেন, আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি—সেই আমাদের একটি মাত্র সুখ। দেবাংশু বলে, তাদের একটি গ্রাম খুব সুখের ছিল, এখন তো সে গাঁয়েই থাকে না, তাই জানে না সেই সুখ আর আছে কিনা।
দেবাংশু ওর গাঁয়ের কথা বলতে খুব ভালবাসে। আমার মতো আর কোনো শ্রোতাও পায়নি সে। আমি আর দেবাংশু গল্প করি। দেবাংশু যেন কথক ঠাকুর। কী সুন্দর গুছিয়ে গুছিয়ে কথা বলে। আমাদের এই অফিসের কাজ বেলা তিনটের ভিতরে শেষ। তারপরে আমাদের আড্ডা বসে। সেই আড্ডায় কখনো কখনো ইলিনা এসে বসে। ইলিনার মন সব সময় বিষণ্ণ হয়ে থাকে। কেন তা আমরা জানি। ইলিনার বর অখিলেশ সেই যে আলিপুরদুয়ার গেল বদলি হয়ে, আর ফেরে নি। তার আগেও ইলিনার বর কলকাতায় থেকেও আলাদা থাকত। সরকারী হাউজিং ছেড়ে সে বেহালার কোন শীলপাড়ার ভিতরে একটা ওয়ান রুম ডাইনিং কিচেন টয়লেট ব্যালকনির ফ্ল্যাট কিনে একটা কাজের মেয়ে নিয়ে থাকত। সেই মেয়েটি আগে ইলিনার সরকারি ফ্ল্যাটে কাজ করত। অখিল তাকে বিয়ে করেছিল কিনা জানে না। তবে সেই মল্লিকা থাকত অখিলের সঙ্গে। তারপর সেই মল্লিকার হাত থেকে রেহাই পেতে অখিল বদলি নিয়ে আলিপুরদুয়ার চলে গেল। অখিল একটা চিঠি দিয়েছিল, বলেছিল, ভুটান রাজার দেশে আছি। আসলে অখিলের এক মামাতো ভাই আছে ঐ দেশে। কালচিনির এক চা বাগানে সে ম্যানেজার। তার কাছে গেছে সে। ইলিনা আর তার দুই মেয়ের উপর কোনো টান নেই তার। এমন কোনো মানুষ হতে পারে, বিল্বদা?
আমি বিল্বমঙ্গল দত্ত। আমার কাজ শোনা। ইলিনার বয়স বিয়াল্লিশ। অখিল ওর চেয়ে বছর বারোর বড়। তার মানে অখিলের এখনো তিন বছর চাকরি আছে। আছে কি গেছে তা ইলিনা জানে না। কয়েকটা চিঠি দিয়েছিল, অখিল কোনো জবাব দেয়নি। একটা রেজিস্ট্রি চিঠি তো নট ফাউন্ড হয়ে ফেরত এসেছে। ইলিনার কথাও আমাকে আর দেবাংশুকে শুনতে হয়। দেবাংশুর কথা অফিসের সবাই শোনে। ডি-গ্রুপ কর্মচারী গোলাম মন্ডল বা বীরেন দাসও দেবাংশুর কথা শোনে। গোলামের বাড়ি হাওড়া জেলায়। দামোদরের ধারে নয়। তবে দামোদর ওদের গাঁয়ের পুবে। মরা নদী। সেই বর্ষায় ওর যা লাফানি ঝাঁপানি। তা ঝিমিয়েই থাকে সারা বছর। গোলাম কখনো কখনো জমির দালাল, কখনো এম,এল,এ-র মুন্ডপাত করে। তার বেশি কিছু নয়। আসলে কথা বলার একটা সমর্থ থাকা চাই। গোলামের তা নেই। কিন্তু সে দেবাংশুর কথা শোনে। শুনে মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব মন্তব্য প্রকাশ করে। বীরেন দাস কখনো কখনো তার গাঁয়ের কথা বলে। তার গাঁয়ের কাছাকাছি একটা নদী আছে। সেই নদীর নাম ঘাঘরা বা ঘর্ঘরা। সে ঠিক নদী নয়, ঝোরা বা ঝর্না থেকে জন্ম নেওয়া এক স্রোতস্বিনী। তা গিয়ে মিশেছে মাইল আট দূরে কংসাবতীতে। বীরেন তার গাঁয়ে যেতে কংসাবতীকে দ্যাখে, কিন্তু কংসাবতী তার গাঁয়ের নদী নয়। তার নদীর নাম ঘর্ঘরা। গোলামের নদী দামোদর। আর দেবাংশুর নদী সুবর্ণরেখা। বিল্বমঙ্গলের কোনো নদী নেই। বিল্বমঙ্গলের কোনো গ্রাম নেই। বিল্বমঙ্গলের বাপ-ঠাকুরদা তা ফেলে এসেছিল পূর্ব পাকিস্তানে। পরে পূর্ব পাকিস্তান উঠে গেছে, দেশটা স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ। বিল্বমঙ্গল সেই মুক্তিযুদ্ধের সময় ভেবেছিল নিজের গ্রাম নিজের নদী আবার ফিরে আসবে। ফিরল না যখন, দেখে আসবে। তা হয়নি। এতদিনেও হয়নি। কী করে হবে? কী করে সে যাবে ? যাওয়ার আগ্রহ দিনে দিনে কমে গেছে। দেশটা যখন আমার নয়, নদী বা গ্রাম আমার হয় কী করে ? বিল্বমঙ্গল দত্তর মনে মনে দুঃখ আছে, তার কোনো নদী তার কোনো গ্রাম নেই। গোলাম শুনে বলে, থাকলে কী হত স্যার ?
কী হত তা কি বিল্বমঙ্গল জানে ? হয়তো কিছুই হত না, কিন্তু তার নিজস্ব একটি গ্রাম নিজস্ব একটি নদী থাকত।
থেকে হাতি ঘোড়া হত স্যার, আমার তো দামোদর আছে, আঁধারকুলি গাঁ আছে, তাতে কী হয়েছে। আমি ওসব ফেলে কবে থেকে ভাবছি কলকাতায় একটা ঠাঁই করব, হচ্ছেই না, হবে বলে বিশ্বাস নেই।
বিল্বমঙ্গল চুপ করে থাকে। তারা মানে তার বাবা কাকারা একটা নিজস্ব গ্রাম এপারে করে তুলতে চেয়েছিল। বসিরহাটের কয়েক মাইল দূরে ঝাউতলা গ্রামে। সেই গ্রাম থেকে মাইল তিন দূরে ইছামতি নদী। ঐ ইছামতির ওপারে বিল্বমঙ্গলের ছেলেবেলায় ছিল পাকিস্তান। ঐ পাকিস্তানের কোথাও ছিল তার বাবা কাকাদের গ্রাম। তাদের গ্রাম। কপোতাক্ষ নদ। সাতক্ষীরে শহরের অতি নিকটেই ছিল তাদের গ্রাম আর নদী। কিন্তু তা অন্য দেশ। কিন্তু সেইটা আসল। সেখানে কপোতাক্ষ তীরের শ্মশানঘাটে তার ঠাকুরদার বাবা, তার বাবা, লক্ষীনারায়ন, যাদবচন্দ্র, তার ভাই মাধবচন্দ্র, সাত পুরুষের ছাই উড়েছিল সময়ে সময়ে। তাদের নিজ হাতে পোতা আম কাঠালের গাছ ছিল বাড়ি ঘিরে। বুড়ো ঠাকুরদা মানে ঠাকুরদার বাবার, আমার প্র-প্রপিতামহর এক মাসতুত বোন গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলেছিল ভিটের পিছনে মধুগুলগুলি আম গাছটির ডালে। শোনা কথা সে থাকত ঐ গাছে। আর তার মরণের পর গাছের আম বিষ টক হয়ে যায়। আগে নাকি ছিল খুব মিঠা। ঐ গাছের আম আর কেউ ছুঁয়ে দেখত না। মধুর স্বাদের আম গাছটি এক রাতে বুনো আমের গাছ হয়ে গিয়েছিল নাকি। অন্ধকারে তাকে দেখে ভুতের ভয় পেয়েছে কতজন। হতেই পারে, কতদিন কেউ কেউ দেখেছে, গাছের ডালে বসে পা দোলাচ্ছে একটি ষোল সতেরর মেয়ে। পায়ে আলতা, ঠোঁট লাল, পরনে লাল পেড়ে শাড়ি। কেন সে গলায় দড়ি দিয়েছিল কে বলবে ? কিন্তু সেই কাহিনি এখনো বিল্ব দত্তর পরিবারে প্রচলিত। বিল্ব দত্ত তার ছেলে মেয়েকে কত শুনিয়েছে সেই গল্প। শোনাতে শোনাতে এক সময় ঘুম পাড়িয়েছে। এখন তারা বলে, ঐ সব নিয়ে আগের দিনের মানুষ দিন কাটাত। করবে কী, অলস মস্তিষ্ক, কিছু একটা বানাতে হবে। কিন্তু বিল্ব দত্তর মনে হয়, ওসব কথা সত্যি না। ছিল ছিল সব ছিল, এখন নেই নেই, কিছুই নেই। নিজের একটি গ্রাম থাকলে নিজের সাতপুরুষের একটি ভিটে থাকলে, নিজের একটি নদী থাকলে এসবও থাকে। বিল্ব দত্ত এখনো সেই হারিয়ে যাওয়া গ্রামখানির জন্য মন খারাপ করে।
দেবাংশু বলে, আমার গ্রামে আমি তোমাকে নিয়ে যাব বিল্বদা।
২
বিল্বমঙ্গল দত্তর স্ত্রী মালবিকা। মালবিকা খুব সুন্দরী ছিল। কিন্তু নানা আধিব্যাধি তার রূপে থাবা মেরে জীর্ণ করে দিয়েছে অনেকটা। মালবিকাকে নিয়ে বিল্ব প্রতি বছর পুরী যায়। সমুদ্রের হাওয়া যদি তার হারানো স্বাস্থ্য আর ঔজ্জ্বল্যকে কিছুটা ফিরিয়ে দিতে পারে। পুরী গেছে বিল্ব অনেকবার। এ ব্যতীত দীঘা, বকখালি, মান্দারমনি, জুনপুট। বিল্ব নানা রকম ভাবে। মালবিকা যে বিমর্ষ হয়ে থাকে, তার কারণই তার নানা খুচরো অসুখ। হজম হয় না তাই কত সুখাদ্য ত্যাগ করেছে সে। চোখের পাওয়ার খুব। দাঁতের অবস্থা ভাল নয়। যন্ত্রণায় ভুগে ভুগে উপরের পাটি আর সামনের পাটির দাঁত তুলে ফেলেছে বেশ কয়েকটি করে। সেই দাঁত বাঁধানো হয়েছে। কিন্তু যখন সে খুলে ফেলে রাত্রে ঘুমের সময়, এক লহমায় তার বয়স অনেকখানি বেড়ে যায়। বুড়ি হয়ে যায় বিল্বর বউ। সারাদিন মোটামুটি মধ্যবয়সিনী থেকে রাতের শয্যায় গিয়ে যদি কেউ বুড়ি হয়ে যায়, তখন ঘুম ব্যতীত আর কি থাকতে পারে দম্পতির জীবনে। এখন তারা যে যার মত পড়েই ঘুমে ডুবে যায়। অদ্ভূত লাগে বিল্বর। সারাদিন যে নারীর সঙ্গে তার ওঠাবসা, রাতে কিনা সে আলাদা কেউ হয়ে যায়। কেউ কারোর দিকে হাত বাড়ায় না। কিন্তু তার মানে যে বিল্বর ভালবাসা নেই তা নয়। বিল্ব মালবিকার জন্য মন খারাপ করে তাকে যেন মনে মনে আরো আঁকড়ে ধরে।
বিল্ব ওঠে ভোরবেলায়। সেই সাড়ে চারটের সময়। কোনো কোনোদিন আবার আরো আগে। তখন সে বসে কম্পিউটারের সামনে। ইন্টারনেটে ফেস-বুক খুলে বসে কিংবা ইউ টিউবে গিয়ে খুঁজে খুঁজে নিজের পছন্দ মতো গান নির্বাচন করে বাজাতে থাকে। কন্ঠসঙ্গীত কিংবা যন্ত্র সঙ্গীত। বিলায়েত খান তার ঘরে বাজাতে থাকেন ভৈরবি। কিশোরী আমনকর তাঁর মধু কন্ঠে রাগেশ্রী। সে সোফায় আবার টান টান হয়ে চোখ বোঁজে। এইটুকু তার সুখ। সুখ আরো আছে। সে ইউ-টিউবের গান শুনতে শুনতে ফেস-বুক খোলে। ফেস-বুক হলো বিশ্ব ভূবন ভ্রমন। ভোরে পশ্চিমের মানুষ অন-লাইন হন। আমেরিকায় যখন আগের দিনের সন্ধে, কলকাতায় তখন পরের দিনের ভোর। আবার লন্ডনে রাত দুপুর, আগেরদিন চলে যাচ্ছে গির্জার ঘন্টা ধ্বনিতে ধ্বনিতে। কেউ কেউ অন লাইন, কেউ কেউ ঘুমিয়ে। আমেরিকার নিউজারসি নিবাসী এক পিয়াসা রহমানের পরিচয় বিল্ব দত্ত খুঁজে পেয়েছে কদিন আগে। মেয়েটি ভারি সুন্দর। চোখ দুটি কী সুন্দর! চাহনিতে কিশোরীর ছায়া। মেয়েটি খুব আদরে বড় হয়েছে। পিয়াসা সাতক্ষিরে নামে সে ফেস-বুকে এসেছে। কদিন ধরে ভাবছিল তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাবে। কিন্তু পাঠাতে গিয়েও থমকে যাচ্ছে। ফেস-বুক এক বিচিত্র জগত। এখানে নানা রকম মানুষ নানা রকম ধান্ধা নিয়ে ঘোরে। এই যে কদিন আগে প্রিয়ম্বদা নামের একটি যুবতী ফাঁস করে দিল এক কবির পাঠেনো মেসেজ। খুব খারাপ খারাপ কথা। মেয়েটিকে সেই পোয়েট কোথায় যেন দেখা করতে বলেছিল, সে যায় নি। মধ্যবয়সী কবি ডেকেছিল তার ফ্ল্যাটে, লোভ দেখিয়েছিল পুরস্কার পাইয়ে দেবে, মেয়েটি রূঢ় ভাষায় প্রত্যাখ্যান করায় পোয়েট তাকে খুব খারাপ ভাষায় আক্রমণ করেছিল। সেই প্রিয়ম্বদা সমস্ত কথোপকথন কপি করে নিজের টাইম লাইনে প্রকাশ করে দিয়েছিল। অন্তরজালে খুব হৈ হৈ হলো কদিন। কিন্তু তারপর তা মিলিয়ে গেল নতুন কথা, নতুন পোস্ট চলে আসায়। সুন্দরী মেয়েটিকে সে বন্ধুতার প্রস্তাব পাঠাবে, কিন্তু সে যদি প্রত্যাখ্যান করে ? তাই তো স্বাভাবিক। ষাট হয়ে যাচ্ছে যে মানুষটির সে কেন বছর পঁচিশের একটি মেয়ের বন্ধু হবে, সেই মেয়েই বা কেন তার প্রস্তাব গ্রহণ করবে, হাত বাড়িয়ে দেবে ? বিল্ব ভাবল, মেসেজ পাঠাবে, বন্ধু হতে চাই, সাতক্ষিরে আমার পিতৃপুরুষের দেশ, তুমি সাতক্ষিরের মেয়ে, আমাদের গাঁয়ের মেয়ে হতে পার, আমার বন্ধু হবে ? কিন্তু মেসেজ করতে তার কেমন লাগল। অচেনা কোনো মেয়েকে কি কোনো বার্তা দেওয়া যায় ? সে ভাবতে পারে, ওই সূত্র ধরে প্রবীন লোকটি তার সঙ্গে ভাব জমাতে চাইছে।
কোনো জবাব এল না সাতদিনেও। তার মানে সে রিজেক্টেড হলো। খারাপ লাগল বিল্বমঙ্গল দত্তর। সাতক্ষিরে এক মহকুমা শহর ছিল যখন তার বাবা কাকারা সাতক্ষিরের পার্শ্ববর্তী গ্রাম ধুলিহর ছেড়ে চলে আসে। পার্টিশনের পরের কথা তা। বিল্ব জানে তার ডাক্তার ছোটকাকা তারপরও বহুদিন ছিলেন ধুলিহর। শেষে ১৯৬৫র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তিনি পাকাপাকি পার হয়ে আসেন। বিল্বর জন্ম ১৯৫১ মানে বাংলা সন ১৩৫৮র ভাদ্রমাসে। আগস্টের তিরিশ তারিখে। ভাদ্রের ১৬ তারিখ। বিল্ব জন্মেছিল ঐ দেশে। বিল্ব সাত বছর পর্যন্ত বেশ কয়েকবার গেছে ধুরোলে। তার আবছা আবছা মনে আছে। কিন্তু ইদানিং যেন বেশি করে মনে পড়ছে সেই গ্রাম আর কপোতাক্ষ নদের কথা। গত কবছর ধরে ফেলে আসা গ্রাম নদী তাকে যেন উতলা করছে। সেই কারণে দেবাংশুর কাছে তার গ্রামের কথা শোনে সে। দেবাংশুর গ্রামে একবার যাবে ভেবে রেখেছে। দেবাংশুও নিয়ে যাবে বলেছে তাকে। কিন্তু দেবাংশুর তেমন সময় হয় না। কিন্তু যখন হল সময়, তখন বিল্ব অ্যাবসেন্ট। দেবাংশু আচমকা গেল চারদিনের জন্য তাদের গ্রাম একটি গ্রাম, কীর্তনিয়া শোল, তখন তিনদিনের জন্য দীঘা গিয়েছিল বিল্ব। দীঘা থেকে ফিরে শোনে দেবাংশু আসছে না। মোবাইল ফোন নট রিচেবল। দেবাংশু ফিরে এসে বলেছিল তার জেঠা খুব অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে যেতে হয়েছিল গ্রামে। ইসস ! বিল্বদা, তুমি থাকলে আমার সঙ্গে যেতে পারতে।
কদিন পর বিল্বমঙ্গল দেখল, তার বন্ধুতার অনুরোধ অ্যাকসেপ্টেড। একটি বার্তাও আছে। পিয়াসা লিখেছে, আমি অতি সাধারণ, আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানর মানে কি , আই ডোন্নো হোয়াই।
সাতক্ষিরে। উত্তর দিতে গিয়ে বিল্ব দত্ত থামল। তার সেন্টিমেন্টের মূল্য দেবে কেন যুবতি ? সাতক্ষিরে বলেই কেন সে একটি প্রায় বৃদ্ধ ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুতা করবে ? বিল্ব দত্ত কি তার মনের কথা ধরতে পারবে ? তার ছেলে কি তার বন্ধু ? না। ছেলের যে নিজস্ব কথা, কবিতা গল্প, সিনেমা, গান—তার কাছে পৌঁছতে পারে না বিল্ববিঙ্গল। সে শোনে পিঙ্ক ফ্লয়েড, রিচারড মার্ক্স…বিল্ব ওসব তার জগতে খুঁজে পায় না। কিন্তু গোপনে শুনে দেখেছে ভাল, খুব ভাল, মাদকতাময়।
বিল্ব একটু বিব্রত হল, তাই তো। ও কি জানে সে কেন তাকে বন্ধু করতে চায় ?
মেয়েটির বয়স বছর পঁচিশ। স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে গেছে ওদেশে। কিন্তু সে তো অনেকেই যায়। এই মেয়েটি তার বন্ধু হবে অন্য কারণে। ওর পৈতৃক বাড়ি সাতক্ষিরের থানার অন্তর্গত ডুমুরিয়া নামের একটি গ্রামে। বন্ধু যখন হয়েছে, তাকে এখন সে মেসেজ পাঠাতে পারে।
পিয়াসার পরিচয়ে লেখা আছে পিয়াসা সাতক্ষিরে। পিয়াসাকে সে লিখল, আমি সাতক্ষিরের সন্তান, আমাদের গাঁয়ের নাম ধূলিহর, তাই তো বন্ধু হতে চেয়েছি।
ওমা সাতক্ষিরে ! আঙ্কেল তুমি সাতক্ষিরে থাক, সাতক্ষিরের লোক, আমি যে সাতক্ষিরের লোক খুজি ফেস-বুকে বসে, কী আশ্চর্য ! চাচা আমি কিন্তু একন আসি( আছি) নিউ জার্সি, ইউ,এস, এ।
জানি তো ইউ,এস,এ, থাকো, তুমি কতদিন সাতক্ষিরে যাওনি ?
আমার আব্বা আম্মা তো থাকে ঢাকা, সাতক্ষিরে থাকে নানি আর বড় আব্বা, গ্র্যান্ড ফাদার, আমার বড়ফুফুর ধুরোলে সাদি হয়েসে(হয়েছে), সেই ধুরোল, তুমি আমারে ধুরোলের কথা শুনাবা, অদিকি মাইকেল মধুকবির কপোতাক্ষ নদ আসে(আছে) শুনিসি ?
কী আশ্চরয ! রাগ ভৈরবীর সুরে যেন কথা বলছে পিয়াসা। পিয়াসা না কিশোরী আমনকর ? পিয়াসা না মধুকন্ঠী গীতা দত্ত ! ভোরের পৃথিবী গেয়ে উঠছে একটু একটু করে। আলো ফুটিতেছে আলো ফুটিতেছে। মুক্তাফলবৎ হিম নীলাভ নভমন্ডল ধীরে ধীরে প্রকাশ্য হয়ে উঠছে। বিল্ব বহুদিন আগে সাহিত্যের ছাত্র ছিল। পত্রিকা সম্পাদনা করত। কমলকুমার মজুমদার পড়ত। অন্তর্জলী যাত্রা ছিল তার প্রিয় উপন্যাস। এখন সেই অনেক বছর বাদে সেই উপন্যাসের আরম্ভটি মনে পড়ে গেল। মনে হল সে আর একবার পড়ে। সে যেন তার যৌবনকালে ফিরে যাবে। তারও আগে। পিয়াসা রহমান সাড়া দিয়েছে। সে পিয়াসা রাহমানকে শোনাতে লাগল ধুরোল আর বড়দল ইস্টিমারঘাটার কথা। সে দ্যাখেনি, শুধু কানে শুনেছে মা আর কাকিদের কাছে। তা থেকেই সব জানে। শোন পিয়াসা শোন।
৩
বিল্ব দত্তর বহুদিনের অভ্যেস, অফিসে সকাল সকাল পৌঁছন। সে সবার আগে, তার পরে পরে আসে গোলাম। সে ট্রেনে আসে সাঁতরাগাছি, সেখান থেকে অফিস আসতে সময় অনেক কম। দ্বিতীয় হুগলি সেতু পার হয়েই তো কলকাতা। আজ গোলাম আসেনি, কিন্তু ইলিনা এসেছে। ইলিনা এত সকালে আসে না, পৌনে এগারটা হয়। ইলিনা বলল, আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছি বিল্বদা, খুব দরকারী কথা নিয়ে আলোচনা করব বলে আগে এসেছি।
ইলিনা ৪৪। ইলিনাকে দেখলে মনে হবে না তার অতখানি বয়স হয়েছে। ইলিনা পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি, অ্যাভারেজ বাঙালি মেয়েদের তুলনায় মাথায় উঁচু। গাত্র বর্ণ ময়লা ময়লা, এঁকে বলে উজ্জ্বল শ্যাম। ইলিনার মাথায় অনেক চুল, ঘন কালোর ভিতরে একটি দুটিতে রূপালি রেখা, ইলিনা তা লুকোয় না। ইলিনার মুখখানি শান্ত, চোখদুটি গভীর, ঠোঁট পুরু। ইলিনা শীর্ণকায়া নয়। স্বাস্থ্যবতী । ইলিনার ভিতরে এই বয়সেও আকর্ষণ আছে। বিল্ব টের পায় ইলিনা অফিসে না এলে তার ভাল লাগে না। বিল্ব এও জানে, দেবাংশুও ইলিনাদি না এলে অন্যমনস্ক হয় বারবার। ইলিনা দুই মেয়ে নিয়ে একা থাকে সরকারী হাউজিঙে। একা থাকার বিপদ কম নয়, বিশেষত যার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছে আর এক রমণীর কাছে। ইলিনার কাছে এখনো প্রস্তাব আসে। সে অফিসের বস থেকে কেরানি, পাড়ার রিটায়ার্ড একজিকিউটিভ থেকে সফল ব্যবসায়ী। এখনো আসে। আর ইলিনাকে তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করতে হয়। কেউ কেউ আবার তার দরজায় গিয়ে হাজির হয় ছুতোনাতায়। অথচ আর কদিন বাদেই তো ইলিনা বীজ ধারন করার শক্তি হারিয়ে ফেলবে । অরক্ষিত মেয়েমানুষের দিকে পুরুষের প্রবল আকর্ষণ। মনে হয় ইলিনা আবার কোনো প্রস্তাব পেয়েছে। সমস্যায় পড়লে বিল্বমঙ্গল তার ভরসা। ইলিনা বলল, আমি খুব সমস্যায় পড়েছি বিল্বদা, আপনার কাছে পরামর্শ নেব।
অখিল
বলতে পারেন, আবার নাও পারেন, কিন্তু এও ঠিক অখিলেশ থাকলে আমার এত চিন্তা একা করতে হত না।
বিল্ব চুপ করে থাকে। বোঝাই যাচ্ছে আবার কেউ ইলিনাকে ডেকেছে সিনেমা বা থিয়েটারে যেতে। কিংবা তার ফ্ল্যাটে। ইলিনা বলল, বিল্বদা, অখিল ভাল নেই।
কী বলছ !
হ্যাঁ বিল্বদা।
বিল্ব জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে ?
আমি তো জানি না বিল্বদা, কিন্তু সে ভাল নেই।
অমন আগুনের পিছনে ছুটলে কি কেউ ভাল থাকে, বিয়ে করেছিল না শুনেছিলাম।
হ্যাঁ বিল্বদা, একটি পাহাড়ি মেয়েকে।
কৃতী পুরুষ, বউ মেয়ে থাকতে নির্বাসনে গিয়ে পাহাড়ি বিয়ে করে এখন বলছে ভাল নেই !
হি ইজ সাফারিং ফ্রম সিরিয়াস ডিজিজ।
চিঠি দিয়েছে ?
না বিল্বদা, ইন্টারনেটে ফেস-বুক।
বিল্ব দত্ত চুপ করে থাকল। তার মনে হল এখন অখিল অসুখে ভুগছে, ভুগতেই পারে। যৌন রোগ হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। আর তা নিয়ে ইলিনার উদ্বেগ! কোনো কিছুই কোনো কিছুর সঙ্গে মেলে না। ঘৃণা করা উচিত। কী ভাবে মেয়েদুটি আর বউ ফেলে অখিল কাজের মেয়েকে নিয়ে আর এক জায়গায় চলে গেল। এই শহরেই। ইলিনা ওকে শেষ করে দিতে পারত। অভিযোগ করে চাকরি খেয়ে দিতে পারত। কিছুই করেনি, অখিলের পাঠান টাকা প্রত্যাখ্যান করেছে। সি ইজ আ সিঙ্গল মাদার। বিল্ব ইলিনাকে দেখছিল। কবছর আগে আগুনের মত রূপ ছিল ইলিনার। সেই রূপ নিয়ে ও অহঙ্কারিও ছিল খুব। এখন সেই অহঙ্কার ফুরিয়ে যাচ্ছে বীজ ধারণের ক্ষমতা অবসানের দিন ঘনিয়ে আসায়। ইলিনার শরীর ভাঙে নি, তবে ভাঙবে তো। বিল্বর ভয় করে ভাবতে। মন খারাপ হয় ভাবতে। বিল্ব জিজ্ঞেস করল, তুমি কী করতে চাও ইলিনা ?
ও ওর মেয়েকে বলেছে, ইনার সঙ্গে ওর ফেস-বুকে যোগাযোগ আছে।
তুমি তো কম্পিউটারে বস না।
না, আমার ভাল লাগে না, ভারচুয়াল রিয়ালিটি, কাউকে চোখে দেখিনি অথচ গল্প করে যেতে হবে আগডুম-বাগডুম, আর বসেই থাকতে হয়, আমি যেচে কারো সঙ্গে কথা বলতে পারি না।
অখিলেশ কি ওর নামেই আছে ?
তাই তো থাকবে, অন্য নামে থাকবে কেন?
বিল্ব হাসে, বলে, কত যে ফেক আই-ডি আছে।
আমি জানি না। বিড়বিড় করে বলল ইলিনা।
মেয়েদের জিজ্ঞেস করে দেখ তো।
ইনা বলবে না, নিনা কী বলে দেখি।
ইনা নিনা ওর দুই মেয়ে। ইনা বড়। বাবার সঙ্গে ইনারই যোগাযোগ। ইলিনা সারচ করে দেখেছে, অখিলেশ—বা অখিল দে নামে অনেকজন আছে। কোনো ছবি তাদের অখিলেশের নয়। আবার অখিলেশ দে নামের ফেস-বুক আই,ডি,তে মাসলম্যানের ছবিও যেমন আছে, গোলাপের ছবিও আছে, ফেক বিদেশির ছবিও আছে, কী করে বোঝা যাবে কোনটা ইলিনার হাজব্যান্ড অখিলেশ। তাদের সাতজনের বাস আবার ইংল্যান্ড-আমেরিকায়। একজন থাকে ইতালি। ইলিনার স্বামী অখিলেশ কি আলিপুরদুয়ার থেকে ইতালি কি আমেরিকা চলে গেল ? আবার এমনও হতে পারে অখিলেশ আলিপুরদুয়ার বা তার আশপাশে ডুয়ারসের কোথাও থেকে ঠিকানা দিয়েছে ইতালি বা আমেরিকা।
বিল্ব বলল, অসুখের কথা কে বলল ?
ইনা, কিন্তু অসুখ কিনা তাও বলছে না।
কেন বলবে না ?
তার বাবা বারণ করেছে।
এসব কথার তো কোনো মানে নেই, তাহলে সে তোমাকে বলল কেন?
বিল্বদা আমার মনে হচ্ছে ওর খুব বড় একটা অসুখ করেছে।
অন্য কিছু তো হতে পারে। বিল্ব বলল।
অন্য কী হবে বিল্বদা ?
পাহাড়িয়া মেয়েকে বিয়ে করেছিল না ?
ভূটিয়া মেয়ে।
তুমি যেমন ছেড়ে দিয়েছ অখিলকে, ভূটিয়া কিংবা লেপচারা ছাড়বে ?, জানি না কী যে হবে ওর, ওকি ভূটান পাহাড়ে চলে গেল ?
তোমার মেয়েদের জিজ্ঞেস করো।
ইনাকে আমি জিজ্ঞেস করছি, ও শুধু মাথা নাড়ছে। লিনা মানে ওর পরের বোন বলছে দিদি বাবার স্মবন্ধে কোনো কথা বলবে না, বাবা জানতে পারলে ব্লক করে দেবে দিদিকে, ওই শর্তেই বাবার সঙ্গে ওর ফ্রেন্ডশিপ হয়েছে।
লিনার ফেস-বুক আই-ডি নেই ?
না, ও কম্পিউটার পছন্দ করে না, মাঝে-মধ্যে গুগুল সারচ করে কিছু তথ্য জেনে নেয়।
সত্যি কি নেই, ওর বয়সীরাই তো সব চেয়ে বেশি আসে ফেস বুকে।
না, থাকলে তো আমি জানতে পারতাম, বিল্বদা আমার দুই মেয়ে দুই রকম, ইনা দোষ দেয় আমাকে, আর লিনা বলে তার বাবা দুশ্চরিত্র, বাবার কথা ভাবাই উচিত না, বলছে বাবার যা হয় হোক, মা যেন এই নিয়ে দিদির সঙ্গে কথা না বলে।
বিল্বমঙ্গল দত্ত চুপ করে থাকে। দুই মেয়ের কেউ বেঠিক না। বাবার উপর মেয়ের টান হবেই, ইনার সেই টান। আবার অখিলেশ তো ঘৃণ্য। কাজের মেয়েকে নিয়ে আলাদা বাড়ি ভাড়া করে এই শহরেই। তার পিছনে দেদার টাকা খরচ করত, তা বলেছিল ইলিনাই। শেষে তার খাঁই না মেটাতে পেরে আর নেশা কেটে যেতে থাকে। সে পালায় কলকাতা থেকে। না পালালে ওলাই চন্ডী বস্তির লোক এসে তাকে ছিঁড়ে খেত। শোনা যায় সেই মল্লিকা নামের মেয়েটি অখিলের অনুপস্থিতিতে ফ্ল্যাটে মেহফিল বসাত প্রেমিক এলে। তার প্রেমিক ছিল আন্তরাজ্য পন্য পরিবহনের ট্রাক ড্রাইভার। এক দেড় মাস বাইরে থেকে ক্ষুধার্ত হয়ে আসত। তখন এমনও হয়েছে রাতে এসে থেকে গেছে সেই ড্রাইভার। সবই শোনা কথা। ইলিনা শুনতে চায়নি কিন্তু অখিল পালালে ধারের টাকা পাওয়ার জন্য তারা এসেছিল ইলিনার কাছে। অখিল দে নাকি বলে গিয়েছিল সব টাকা ইলিনা দেবে, সে এনে দেবে কদিনের ভিতর। সেই সময় সাসপেন্ড হয়ে ঘরে বসেছিল অখিল। দুপুরে বেরত সাস্পেনশন রদ আর বদলির তদ্বিরে। ইলিনার সঙ্গে তার দেখা হত না। ইলিনার অফিসে সে আসত না। এই করতে করতে সে উধাও। সাউথ বেঙ্গলের লোকের কাছে নর্থ বেঙ্গল পানিশমেন্ট পোস্টিং। সাস্পেনশন উইথড্র করিয়েছিল অখিল নর্থ বেঙ্গল যাবে বলে। সে ডুয়ারসের জঙ্গলে গিয়ে লুকোল। কোন পাহাড়তলীতে গিয়ে ভূটিয়া কন্যার সঙ্গে ঘর বাঁধল। খুব সাহসী পুরুষ অখিলেশ।
৪
দেবাংশুর গ্রাম ‘একটি গ্রাম’, কীর্তনিয়া শোল, ওই একটি গাঁয়ের ধারে একটি নদী সুবর্ণরেখা । দেবাংশুর ছেলেবেলায় ঐ নদীর উপরে ব্রিজ ছিল না। অনেক পরে হয়েছে সিধু-কানহু সেতু। কিন্তু সেতু অনেকটা পুবে। দেবাংশুদের গ্রাম বাস রাস্তা থেকে অনেকটা হেঁটে যেতে হয়। তা প্রায় মাইল চার। এক ঘন্টা তো লাগে। রাস্তা মোরামের। গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ। দেবাংশুরা সাইকেলে যায় আসে। দেবাংশুর কাছে তার গ্রামের কথা শুনতে শুনতে বিল্ব দত্ত একটা ছবি মনে মনে এঁকে ফেলেছে। বিল্ব জিজ্ঞেস করে, যেখানে বাস থেকে নামো, ঐ জায়গাটার নাম কি দেবাংশু ?
দেবাংশু বলে, তালগ্রাম স্টপেজ।
বাস আর কতদূর যায় ?
কেন সিধু-কানহু সেতু দিয়ে সুবর্ণরেখা পার হয়ে ওপারে অনেক দূর।
ওপারে কী আছে ?
জঙ্গল মহল, ওড়িশা বর্ডার।
কী অদ্ভূত! দেবাংশু সব তোমার—তোমাদের ?
দেবাংশু স্মিত হাসে, বলে, হ্যাঁ, বলতে পার বিল্বদা, ঐ ওপারে পশ্চিমে, আমাদের বাড়ির কোণাকুণি, তা ধরো, মাইল পনের হবে বংশীধরপুর, আমার বড় পিসির বিয়ে হয়েছে সেই গ্রামে, বড় পিসিদের বাড়ি থেকে আবার মাইল ছয় হল হাতিবাড়ি, সেখানে সুবর্ণরেখা রকি, আমার বাবা বলেন প্রস্তরময় তার দুই তীর। হাতিবাড়ির ফরেস্ট বাংলোটি খুব সুন্দর, আমি একবার কোজাগরী পূর্ণিমার পরেরদিন ছিলাম ঐ বাংলোয়, আমি আর অভিষিক্তা, তখন আমাদের সবে বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর প্রণামের রেওয়াজ আছে আমাদের, আমার বিয়ে হল শ্রাবণে, কিন্তু সময় করে উঠতে পারিনি। আর অতদূর কি যাওয়া যায় ! আমরা বাসে করে হাইওয়েতে আবার বাস ধরে ছিলাম বারিপদার। এসে নেমেছিলাম জামশোলা ঘাটে। সুবর্ণরেখার উপর ওখানে ব্রিজ। পশ্চিমে সিংভূমের নীল পাহাড়। আমি ফরেস্ট বাংলো বুক করে গিয়েছিলাম,রাতে থাকব, পরেরদিন সকালে পিসির ছেলে গরুর গাড়ি নিয়ে আসবে। মোটর সাইকেলে যাওয়া যায়, কিন্তু অভিষিক্তা যাবে কী করে? আমরা মোটর সাইকেল নিয়ে তো আসিনি। আসলে আমার ইচ্ছে হয়েছিল গরুর গাড়িতে যাওয়া। তাহলে অভিষিক্তা সবটা দেখতে পারবে। সে মেদিনীপুর শহরের মেয়ে। তার বাবা মেদিনীপুর কলেজে অধ্যাপনা করতে এসে থিতু হয়েছিলেন ওখানেই।
দেবাংশু খুব গুছিয়ে বলে। তার কথার ভিতরে কোনো ফাঁক থাকে না। অভিষিক্তাদের আসল বাড়ি ফরিদপুর জেলা। ওরা বাঙাল। ও আমাদের গ্রাম আগে দ্যাখেনি। শোনো বিল্বদা, হাতিবাড়ি ফরেস্ট বাংলোর কথা শোনো। ওখান থেকে পিসিরবাড়ি সাত মাইল। পিসির ছেলে নভেন্দু সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল। আমাদের ও রিসিভ করেছিল জামশোলা বাস স্টপেজে।।
বিল্ব দত্ত ভাবে দেবাংশুর গল্পের সঙ্গে তার মা-কাকিদের গল্পের মিল আছে অনেক। কোন গল্প ? যা সে শুনেছে ছেলেবেলায়। মায়ের পিসির বাড়ি মাগুরায়। মাগুরা একটা থানা। সেখানে নবগঙ্গা বলে এক নদী। নবগঙ্গা দিয়ে নাকি কপোতাক্ষ নদে পড়া যেত। মায়েদের যাতায়াত সব হত গাঙে গাঙে। পিসির এক ছেলে ছিল পাগল। সে সারাদিন চুপ করে বসে থাকত। মাঝে মাঝে বলত, ও মা, খেত দিবিনে।
তাকে খেতে দিলে সে সন্তুষ্ট। বাড়িতে কারা এল, এল না তা নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা ছিল না তার। পারটিশনের পর পিসি এপারে আসেনি। এসে কোথায় যাবে ? গাঁয়ের মুসলমানরা বলেছিল,অই পাগল ছাবালরে নে কুথায় যাবা ঠাইরন, তুমি থেকে যাও।
পিসি ছিল বালবিধবা। অল্প কিছু জমি ছিল, তার কিছুটা তার দেওর মেরে খাচ্ছিল। পারটিশনেরপর দেওর চলে আসে এপারে, পিসির জমি গাঁয়ের লোক উদ্ধার করে দেয়। হ্যাঁ এইটা সত্য যেমন, তেমনি আর এক সত্য হল ১৯৬৫র দাঙ্গায় পিসির ঘর পোড়ে। ইন্ডিয়ার কাশ্মীরে কী হল, তার জন্য মাগুরা থানার নবগঙ্গার কূলবর্তী শ্রীপুর গাঁয়ে পিসির ঘর পুড়ল। তা ছাড়া ঢাকায় ভাষা নিয়ে কী হল, তার জন্য পিসির ঘর পুড়ল। এমনিই প্রায়ই পোড়ে, তুলসি মঞ্চ ভাঙে, দুর্গা মন্ডপ ভাঙে। কিন্তু তা আবার গাঁয়ের অন্য কিছু লোক মেরামত করে দেয়। পিসি দেশত্যাগ করে না। মা-কাকিরা এপারে থেকেও যে কী ভাবে ওপারের সব খবর পেয়ে যেত। আসলে বসিরহাট আর মাগুরা, সাতক্ষিরের তফাৎ কতটা ? পনের বিশ তিরিশ মাইল। বসিরহাট দেশ ভাগের অনেক আগে ছিল খুলনা জেলাতেই। সাতক্ষিরের মানুষের আত্মীয়স্বজন এদিকে বসিরহাটে ছিল। আসা যাওয়া ছিল। মানুষের আসা যাওয়া মানে খবরেরও আসা যাওয়া। পিসির গল্প যেভাবে করত মা-কাকিরা, পিসির কথা বলতে বলতে এক একজনের চোখে যেমন জল চলে আসত। দুই ননদের বড়জনের ভাগ্য মন্দ, তাই ওপারে তাকে থেকে যেতে হয়। ইন্ডিয়ায় কিছু হলে তার ঘর পোড়ে। তুলসি মঞ্চ একদল ভাঙে, আর তা আর একদল গড়ে দেয়। পিসির পাগল ছেলে নিজে নিজেই নাকি বলে, মা আবার কবে আগুন লাগবে ?
কিন্তু এই গল্পের সঙ্গে দেবাংশুর গল্পের মিল কোথায় ? একটুও নেই। কিন্তু নেই যে তাই বা বলে কী করে বিল্ব দত্ত ? দেবাংশুর কথা শুনতে শুনতে তার মনের ভিতরে নবগঙ্গা, পিসির বাড়ির ঘাট, পিসির পাগল ছেলে রামপ্রসাদ, পিসির বাড়ির উঠনের তুলসি মঞ্চ, ঠাকুরদালান সব মনে পড়ে যায় কেন ? দেবাংশুর সঙ্গে তার তফাৎ হলো দেবাংশুর সব আছে। বাস্তব। সব জীবিত আছে। তার কিছুই নেই। সে দ্যাখেনি নবগঙ্গা, পিসির বাড়ি। পিসির মুখও তেমন মনে নেই। পিসির কোনো খোঁজ নেই ১৯৭১-এর পর থেকে। কেউ বলে পিসি এসেছিল এপারে, বসিরহাটের কোন রিফিউজি ক্যাম্পে আট মাস কাটিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় রাজাকরদের হাতে পড়ে কচুকাটা হয়। ঢাকায় পাক-বাহিনি আত্মসমর্পণ করলে কী হবে, গাঁয়ে শান্তি কমিটির নামে রাজাকরের দল সক্রিয় ছিল আরো ক’দিন। মরণ কামড় দিচ্ছিল। পিসি আর পাগল রামপ্রসাদ মরেছিল এক সঙ্গে। এই কথা এক কথা, আর এক কথা হল, গাঁয়ের সব লোক পাক মিলিটারির হাতেই কোতল হয়েছিল। গাঁ সাফ করে দিয়েছিল তারা। হিন্দু বাড়ি মুসলমান বাড়ি বাদ যায়নি। কিন্তু দেবাংশু যখন তার বড় পিসির কথা বলে, বিল্ব দত্তর কত কথা মনে পড়ে যায়, মনে পড়ে যায়। বিল্ব বলে, বলো দেবাংশু তারপর কী হলো।
দেবাংশু বলে, শোনো বিল্বদা, তুমি যদি হাতিবাড়ি যাও, টের পাবে কী সুন্দর, ঐ জায়গাটির নাম ষাটিদহ, বন্যার সময়, মানে যখন উপরে ঝাড়খন্ডের পাহাড়ি এলাকায়, ছোটনাগপুরের মালভূমিতে বৃষ্টি হয়, সেই জল নেমে সুবর্ণরেখা প্লাবিত করে ভাসিয়ে দেয় দু’কূল। সেই বন্যার আগমন সংবাদ ষাটিদহের রাজা জানিয়ে দেন, জানো কি?
এরপর দেবাংশু সেই লোক-কাহিনির অবতারণা করে। পিসির মুখে ছেলেবেলায় শোনা। ষাটিদহের রাজা থাকেন সুবর্ণরেখার জলের ভিতর। সেই ষাটিদহ নামের প্রস্তরময় নদী গর্ভে। নদী গর্ভে তিনি তাঁর প্রাসাদ সহ প্রবেশ করেছিলেন পৃথিবীতে মানুষের পাপের ভার বেড়ে গেলে। এখনো কোনো কোনো জেলে জলে ডুব দিয়ে জলের তলায় ঐ প্রাসাদ দেখে পাগল হয়ে নদীর ভিতর থেকে উঠে আসে। এই রকম পাগল আছে বেশ কয়েকজন দেবাংশুর পিসিদের গ্রামের আশপাশে।
ইলিনা শুনতে শুনতে বলে, এই রকম কাহিনি আমি আগে শুনেছি দেবাংশু।
শুনতে পারো ইলিনাদি, কিন্তু এইটা সত্যি, একটা পাগলকে আমি দেখেছি, দ্যাখো আমার বড় পিসির গ্রাম হল বাংশীধরপুর, হাতিবাড়ি থেকে মাইল পাঁচ।
দেবাংশু একই কথা রিপিট করে। কিন্তু তা হলো অন্য কারণে। সে বলে ষাটিদহের রাজা নদীতে বন্যা এলে তাঁর প্রাসাদের ঘন্টা বাজিয়ে দেন, সেই ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পায় বংশীধরপুরের মানুষ। সতর্ক হয়। তাদের বাসও তো নদীর ধারে। উপর থেকে নেমে আসা জলের ঢলে গ্রামে বন্যা আসে। দেবাংশুর পিসি নাকি কতবার শুনেছে সেই ঘন্টাধ্বনি। ঘন্টাধ্বনি শুনতে শুনতে ইলিনা ডাকে বিল্বমঙ্গলকে।
৫
ইলিনা বলল, আমার বাড়ি যাবে বিল্বদা ?
কেন ? বিল্ব জিজ্ঞগেস করে। বোঝে ইলিনা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে , দেবাংশুর গল্প তাকে যে কোনো কারণে টানছে না।
মেয়েটার কাছ থেকে যদি জানতে পারো কিছু, অখিলের কী হয়েছে, ও আছে কোথায়, আমার মন কু ডাকছে বিল্ব্বদা, আমার ভয় করছে।
বিল্বমঙ্গল বুঝতে পারল। সে অবাক হলো না। অখিলকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল ইলিনা। অখিল তাকে ছেড়ে গেলেও, অখিল বার বার অন্য নারীতে অনুরক্ত হলেও তার ভালবাসা শেষ হয়ে যায়নি। বিল্ব একটু বিরক্ত হলো ইলিনার উপর। তার মনে হচ্ছে ইলিনার এই দুবর্লতাই অখিলের মূলধন। বিল্ব কথাটি বলতে গিয়েও বলল না। ইলিনা চল্লিশ পার হয়ে গেছে অনেকদিন। ইলিনা এতদিন ধরে যা লালন করেছে মনের ভিতর তা কি তার কথায় মুছে ফেলবে ? বরং ইলিনার প্রতি তার সমর্থন থাকা উচিৎ। বিল্ব বলল, তুমি বললে যাব, কিন্তু ওরা কি আমাকে বলবে ?
ওরা না, ও, মানে ইনা, ওর সঙ্গেই তো বন্ধুতা ওর বাবার।
বিল্ব বলল, আমি ফেস-বুক সারচ করলাম, নাহ, কোনও অখিল দে-ই সে নয়, আমার মনে হয় ও ফেক-আইডেন্টিটি নিয়ে রয়েছে।
তার মানে, তা কী করে হয় ?
বিল্ব বলে সে হয়তো অন্য নাম দিয়ে তার ফেস-বুক অ্যাকাউন্ট খুলেছে।
তা করলে ওর মেয়ে ওকে চিনল কী করে ?
ও নিজেই ধরা দিয়েছে মেয়ের কাছে, এমন হয় কত।
তখন বিল্ব বোঝাতে বসল ইলিনাকে। তুমি ইলিনা দে, তুমি যদি পিহু রায় নামে অ্যাকাউন্ট খোলো ফেস-বুকে, কে দেখতে যাবে ?
এমনি করা যায় ?
খুব যায়, পুরুষরা মেয়েদের নামেও ফেক অ্যাকাউন্ট খোলে পযর্ন্ত ।
কী হয় তাতে ? ইলিনা জিজ্ঞেস করল’
হবে আবার কী, মেয়ের ছদ্মবেশে সে মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুতা করে, এ হলো ভারচুয়াল রিয়েলিটির জগত, এর কিছুই পরম সত্য নয়, আপাত সত্য, তুমি যা বলবে, তাই সত্য, তুমি যদি বল তোমার নাম সৌরভ তেন্ডুলকার, লোকে তাই বিশ্বাস করবে, তুমি যদি ওখানে যাদব কুন্ডুর ফোটো লাগাও, লোকে বলবে, ঐ লোকটার নাম সৌরভ তেন্ডুলকার, প্রিয়াঙ্কা চোপরার ছবি যদি লাগাও তোমার অ্যাকাউন্টে, লোকে বিশ্বাস করবে ঐটি তোমারই ফোটো।
ইলিনা বলল, অখিল কী নামে আছে ?
সে তোমার মেয়ে জানবে।
তুমি আমার সঙ্গে চলো প্লিজ।
বিল্ব চলল। ইলিনার সঙ্গে তার বছর পনেরর বন্ধুতা। তার চাকরি প্রায় শেষ হয়ে এ্ল। ইলিনার এখনো বছর ষোল বছর বাকি। অখিলের সঙ্গে ইলিনার তফাৎ ঐ বছর দশ। আর অখিল হচ্ছে নারী ভোগ্য পুরুষ। ওর দিকে পতঙ্গের মতো নারীরা যেন ধাবিত হয়। অখিল—অখিলেশ দে এই ডিপার্টমেন্টেই ছিল। ইলিনাকে বিয়ের পর আচমকা এই চাকরি ছেড়ে ব্যাঙ্কে ঢোকে। সেই ব্যাঙ্কেই তার থাকার কথা যদি চাকরি না গিয়ে থাকে। সাসপেন্ড তো হয়েইছিল টাকার হিসেবে গোলমাল করে ফেলায়। অখিলের কী দেখে যে ইলিনা ওকে বিয়ে করেছিল। অখিল তেমন সুপুরুষ নয়। অসুন্দরও নয়। ইলিনা পাঁচ ফুট চার, অখিল পাঁচ ফুট সাত। ইলিনা ছিল দীপ্যমান আলো, কী ঝলমল তার যৌবন, তার প্রেমে পড়েছিল তাদের এক বস,রীতিমত সিনিয়র একজিকিউটিভ। কিন্তু ইলিনা তখন সাধারণ চাকুরে অখিলের প্রেমে ডুবেছে। আর এই বিল্বমঙ্গল দত্ত, সে তখন বিবাহিত পুরুষ, তার বউ মালবিকাও সুন্দরী। সে ইলিনার চেয়ে বছর ষোলর বড়, কিন্তু কতদিন ধরে যে সে গোপনে ইলিনায় মুগ্ধ কে জানে। ইলিনায় তার গোপন মুগ্ধতা ছিল বলেই যেন মালবিকা নিজে নিজে তার রূপ ঝরিয়ে ফেলতে লাগল। মালবিকা বুড়ি হয়ে যেতে লাগল আচমকা। কতদিন বাদে সে ইলিনার পাশে বসে ট্যাক্সিতে করে বেহালার হাউজিঙে চলেছে। সেখানে দুই মেয়ে নিয়ে থাকে ইলিনা দে। আগে ছিল মুখোপাধ্যায়। মালবিকাকে সে ফোনে জানিয়ে দিয়েছে যেতে দেরি হবে, এক কলিগের অসুখ। মালবিকার কৌতুহল কমে গেছে। অসুখবিসুখে জেরবার হয়ে মালবিকা নিজেকে যেন শামুকের মতো এক কোটরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এখন মালবিকা টিভি সিরিয়াল দেখে যাবে। অন্যদিন হলেও সে তাই করত। বিল্ব দত্ত ইন্টারনেটের বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাট করত। আড্ডা দিত। বিল্বর কত রকম বন্ধু, ষোল সতেরর বালিকা থেকে বছর ষাটের প্রবীনা পযর্ন্ত। আবার বছর কুড়ির যুবক থেকে পঁচাত্তরের প্রাচীন। বিল্ব তাদের কারো না কারোর সঙ্গে কথা বলেই যায় সমস্ত সন্ধে। গুড ইভনিং তার কথারম্ভ। গুড নাইট বলে সে কম্পিউটারের সামনে থেকে ওঠে।
ইলিনা বলল, সারাজীবন ওঁকে যেন কুগ্রহ তাড়া করে বেড়িয়েছে।
ও একটা অপরাধী।
বলতে পার বিল্বদা, কিন্তু ও কি ওর সেই অপরাধের জন্য শাস্তি পায় নি ?
আমি জানি না ইলিনা, সে তার সংসার ফেলে, ফুলের মতো ছেলেমেয়েদের ফেলে একটা খারাপ মেয়েকে নিয়ে আলাদা ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠল।
জানি বিল্বদা, তখন খুব কষ্ট হয়েছিল আমার, খুব ঘৃণা, কিন্তু সেই মেয়েটা ওকে ছিবড়ে করে দিয়েছিল, টাকা টাকা টাকা, ও ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট ভেঙেছিল তাকে টাকার জোগান দেওয়ার জন্য।
তুমি কি ওঁকে ফেরত নিতে চাও ?
ও কি আসবে ?
তোমার মেয়েকে জিজ্ঞেস করো, ইফ হি কামস উইথ হিস ভূটিয়া ওয়াইফ অ্যান্ড চিল্ড্রেন, তুমি কী করবে ?
ইলিনা চুপ করে থাকল। আর কথা হল না। ওরা সেই হাউজিঙে পৌঁছতে পৌঁছতে অন্ধকার গভীর। খুব পরিপাটী করে গোছান দুকামরার ফ্ল্যাট। ইনা একুশ। থার্ড ইয়ার কম্পিউটার অনার্স। লীনা ষোল, মাধ্যমিক দিয়েছে। লীনা মায়ের পক্ষে। ইনা তার ল্যাপটপে বাবাকে লুকিয়ে রেখেছে। ল্যাপটপটা ও নিজে ব্যবহার করে। কদিন মায়ের ফেস-বুক অ্যাকাউন্ট খুলে মাকে শেখাতে চেষ্টা করেছিল। পারে নি। মায়ের কোনো ইন্টারেস্ট ছিল না। পরেও হয়নি। ইনা তার মাকে গতকাল বলেছে, মা যদি ফেস-বুক চালু রাখত, বাবার সঙ্গে মায়ের দেখা হয়ে যেত ঠিক, হি ইজ সাফারিং ফ্রম অ্যা সিরিয়াস ডিজিজ, বাবা খুব কষ্ট পাচ্ছে মা।
বিল্বমঙ্গল বলল, ইনা, আমি তো ফেস-বুকে আছি, তুমি আমাকে বন্ধু করবে ?
নো আঙ্কেল, স্যরি।
বিল্বমঙ্গল সরাসরি প্রত্যাখ্যানে অবাক হয় না। তার ছেলে থাকে বাঙ্গালুরু, সে তার ফেস-বুক ফ্রেন্ড হয়নি। ওটা তার নিজের জগৎ। সেই জগতে একটা আগেরদিনের লোক ঢুকবে কেন? কিন্তু বিল্বর কত বন্ধু আছে কম বয়সী। তারা কী সুন্দর গল্প জোড়ে তার সঙ্গে। এক আই, টি-র ইঞ্জিনিয়ার, বছর তিরিশ, সে তার চাকরি ছেড়ে কারটুন আর ছবি আঁকা আরম্ভ করল। চাকরি ছাড়ার আগে তিন দিন ধরে তার সঙ্গে কত পরামর্শ।
একটি সতের বছরের মেয়ে অলিভিয়া প্রেমে ঘা খেয়ে শুধু পাগলের মতো বিচিত্র সব কথা লিখে দিচ্ছিল ফেস-বুক স্টাটাসে। oh god, I am paining, Boisakh is coming, my luv will marry a sweet girl soon, leaving me in a desert. Oh god, I want to be a witch, ami daini habo.
সেই সদ্য কৈশোরে পার করা যুবতি কন্যাটিকে কত বোঝাতে হয়েছে তার মন স্থির করাতে। এক রবিবারে ক্ষেপে ক্ষেপে প্রায় আট ঘন্টা তার সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে বিল্বকে। তারপর মাসের পর মাস। এক একদিন সে লিখে দিত, আমি কাঁদছিই, কান্নার জন্য আমার জন্ম, আমি কালো মেয়ে, কালো মেয়ে বলে আমার প্রেম নষ্ট হয়ে গেল।
তুমি শান্ত হও অলিভিয়া।
আমি তাকে ছাড়া বাঁচব না, বাঁচব না, আমি বিষ খাব বিল্ব।
তাতে কী হবে, সুন্দর ভবিষ্যত ছেড়ে অন্ধকারে, সে তোমার যোগ্য নয়।
আমি তাকে সব দিয়েছি বিল্ব আঙ্কেল।
থাক ওসব, ভুল করেছ।
ওকে দেখলে আমার মাথা খারাপ হয়ে যায় আঙ্কেল, একমাস আগেও দুপুরে এল, কেউ ছিল না, আমি ওর কথা মতো নিজেকে উজাড় করে দিলাম, ভেবেছিলাম ওতে আমার সুমন্ত যদি ফিরে আসে আমার কাছে, সে চলে গেল অনেক ভুলিয়ে, তখন কিন্তু ওর বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে, দেন আই ওয়াজ রেপড বাই হিম, হি রেপড মি, ভালবাসা ছাড়া মিলন কি তাই নয় ?
থাক, ওসব কথা মন থেকে উড়িয়ে দাও।
কী করে ওড়াব বিল্ব, আমার যে মনের ভিতরে সেই দুপুর পাহাড় হয়ে বসে আছে।
উড়িয়ে দাও, ওই কষ্টের দুপুরের চেয়ে পৃথিবীতে অনেক ভালবাসাময় আনন্দের দুপুর আছে, তাদের তুমিও পাবে।
সেই দুপুরও তখন আনন্দময় ছিল বিল্ব।
সেই অলিভিয়া এক অদ্ভুত মেয়ে। কী রকম অনায়াসে তার বাবার চেয়েও বয়সে বড় মানুষটিকে নাম ধরে ডাকে। বিদেশে নাকি এইটাই চল। আর বন্ধুর তো কোনোদিন বয়স হয় না। প্রথম আলাপেই তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, হাই, আর ইউ ম্যারিড ?
হোয়াই ?
আমার কোনও বয় ফ্রেন্ড নেই।
তাতে কী হল, তুমি তো খুব ছোট।
আমি বড় হয়ে গেছি বিল্ব, আমার প্রেমিক আমাকে বড় করে দিয়ে গেছে।
হাসি পায় বিল্বর, কী অনায়াসে তাকে বিল্ব বিল্ব করছে কিশোরী থেকে যুবতি হয়ে উঠতে যাওয়া কন্যাটি। পৃথিবী কী তাড়াতাড়ি বদলে গেল। মানুষে মানুষে যোগাযোগ বেড়ে যাওয়ায় মানুষের কথা আর ভাষা বদল হয়ে গেছে। সে বলছে, ইউ আর টু এজেড, বিল্ব, না হলে আমি তোমাকে প্রোপোজ করতাম, অনেক আগে জন্মে গেছ, কিন্তু তুমি আমার বন্ধু হয়ে থাক, আই লাইক ইওর ফ্রেন্ডশিপ, আমি খুব দুঃখী মেয়ে বিল্ব, আমি আমার সব দিয়েছি, সে অপেক্ষা করল না।
অলিভিয়াকে অনেকদিন বোঝানর পর সে শান্ত হয়েছে। বিল্ব বুঝিয়েছে, যা হয়েছে হয়েছে, তুমি নিজেকে গড়ে তোল, বই পড়ো, গল্পগুচ্ছ পড়েছ ?
সব পড়িনি, কিছু,ও চাইত না আমি বই পড়ি, আমি বই পড়ার অভ্যেস ত্যাগ করছিলাম বিল্ব।
ও কি বইয়ের বিরুদ্ধে ?
ও বলত, কোনো লাভ নেই, বোগাস, তার চেয়ে ফিল্ম দেখা ভাল, হরর ফিল্ম, সেক্স অ্যান্ড ভায়োলেন্স।
তুমি কী মনে কর ?
আমি পড়লেও আর ওকে বলতাম না, ও বই পছন্দ করত না, আমার মনে হচ্ছিল ওকে ভালবাসি তাই আমাকে বই ত্যাগ করতে হবে, ওর জন্য আমি তা করব, ও যা বলবে আমি তাই করব, ও যদি আমাকে বিষ খেতে বলে, আমি বিষ খাব বিকজ আই লাভ হিম, যাকে ভালবাসা যায় তার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা যায়।
শুনতে শুনতে বিল্ব শিহরিত হয়েছিল। তার চোখের সামনে ভালবাসায় উন্মাদিনী এক যুবতির মুখ ভেসে উঠেছিল। বিল্ব আমি কাল সারারাত কেঁদেছি, আমি ওকে কত যে ভালবাসি, তা ও বুঝল না।
বিল্ব বলছিল, সারাজীবনের মতো চলে গেছে, তোমার ভাল হয়েছে।
ডিয়ার বিল্ব, মাই সুইট আঙ্কেল, স্টিল আই লাভ সুমন্ত, আই লাভ হিম, লাভ হিম, লাভ হিম, আমি ওর টাচ ফিল করতে পারি সব সময়।
কী বলছ তুমি অলিভিয়া ? বিল্ব যেন ওই অলিভিয়ার বয়সে চলে গেছে।
হ্যাঁ আঙ্কেল, তুমি ভগবানের মতো এসেছ আমার বন্ধু হয়ে, ভগবান কী কাজে লাগে বল দেখি।
আমি জানি না।
ভগবানকে তুমি সব কথা বলতে পারবে, ইওর সিনস অ্যান্ড ভারচুজ, তোমার পাপ পুণ্যর কথা, যে কথা কাউকে বলা যায় না, ভগবানকে বলা যায়, তোমাকেও আমার সব বলতে ইচ্ছে হচ্ছে।
তুমি কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না।
আই ফিল হিম ইন মায় ড্রিম, রাতে ওকেই স্বপ্ন দেখি, ওহ গড, আমি কী করে বাঁচব, আমার রক্তে যে আগুন জ্বেলে দিয়েছে ও, আমার চিবুকে একটা কালো তিল আছে, আর আছে কোমরে, হি লাইকড দোজ ভেরি মাচ। আমি তিলগুলো ঘসে ঘসে তুলে ফেলব, ব্লেড দিয়ে কেটে দেব, ওখানে ওর চুমু লেগে আছে, ও গড।
বিল্ব বুঝতে পারছিল সদ্য যুবতির ভিতরে প্রবল ভালবাসা আর দেহের আকাঙ্ক্ষা বুনে দিয়ে গেছে সেই যুবক। সে তাই বলতে চাইছে। সে বুঝিয়েছিল, এমন হয়, ও তোমাকে ইউজ করেছে, তুমি অনেক বড় হবে, অনেক অনেক, তোমার সঙ্গে ওকে মানাত না, যে বই পড়তে বাঁধা দেয়, সে খুন করতে পারে।
কিন্তু খুনীরা কি বই পড়ে না ?
এখন সে থেমেছে শোক প্রকাশ করা থেকে। তার মনে যা আসে সে ফেস-বুকের দেওয়ালে লিখে দেয়। তা বন্ধ হয়েছে। বিল্ব জানে সেই অলিভিয়া কোনোদিন ভুলতে পারবে না তার প্রতারক প্রেমিককে। সে তাকে ব্যবহার করেছে একটি বছর। তার চেয়ে বছর এগারর বড়। বিল্ব ইনাকে বলল, আমার অনেক বন্ধু আছে যারা তোমার চেয়ে ছোট।
নো আঙ্কেল, আই ডু নট লাইক ওল্ড এজেড ফ্রেন্ড, দে আর নট পিওর।
সকলেই তাই ?
জানি না আঙ্কেল, আমি তাদের সঙ্গে কী কথা বলব, দুটো ওয়েভ লেংথ আলাদা। বিল্ব বলেছিল, তুমি না হয় কথা বল না, চ্যাট করবে না, কিন্তু বন্ধুতা কি তাতে হয় না?
নো আঙ্কেল নো, তুমি আর রিকোয়েস্ট করো না, আমি প্রতিদিন দশটা করে এজেড পারসনের রিকোয়েস্ট পাই, আমি আমার এজেই থাকতে চাই, আমার বয়সকে কাউকে ধার দিতে চাই না।
তার মানে ? বিল্ব অবাক হচ্ছিল মেয়েটির দৃঢ়তায়।
ইনা বলল, একজন আমাকে লিখেছিল সে আমার সঙ্গে মিশে যৌবন ফিরে পাবে, কী অদ্ভূত এই ওল্ড ম্যানরা,এমন কি হয়, হতে পারে ?
৬
ইনা আর বিল্ব বসে। ইনার পরনে পায়জামা আর টি শার্ট। মেয়েটি তার মায়ের মতো সুন্দরী। একেবারে মায়ের মতো। ইনা তাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করবে তা ভাবেনি বিল্ব। দিনকাল বদলে গেছে, পৃথিবী বদলে গেছে। নতুন প্রজন্ম নিজের কথা নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে চায় বেশি। আগের দিন হলে বরতে যেত বিল্ব, সে এককথায় অভিভূতের মতো সায় দিত বড়দের কথায়, কিন্তু এখন তারা যা মনে হয়, বলেই দেয়। বিল্ব তবু বলল, আমার ফ্রেন্ড লিস্টে কত কম বয়সীরা আছে , তুমি কি আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট রিফিউজ করবে ?
ইনা বলল, অনেক মেয়ে আছে, ওল্ডম্যানদের পছন্দ করে, দে থিঙ্ক দ্যাট ওল্ড মেন আর সেফ, আই ডু নট থিঙ্ক শো।
ইনার কথা শুনে হেসে ফেলল বিল্বমঙ্গল, আমাকে কি আন সেফ মনে হচ্ছে তোমার, আমি তোমার মায়ের কলিগ।
নো আঙ্কেল, আমি চাই আমাদের ভিতর থাকতে।
ঠিক আছে, তাই করো, আমি রিকোয়েস্ট করব না।
থ্যাঙ্কিউ আঙ্কেল, আমি আমার এজ গ্রুপ ছাড়া ফ্রেইন্ডশিপ করি না, বাট আই গেট ফ্রেইন্ড রিকোয়েস্টস ফ্রম ওল্ড মেন রেগুলারলি ।
রিফিউজ করো ?
হাঁ আঙ্কেল, কিন্তু আমি বলছি তারা কেন পাঠায় তুমি বলো দেখি ?
আই ডোন’ নো।
নো, ইউ নো ইট ভেরি মাচ, তুমি ভাল করে জান।
হেসে ফেলে বিল্বমঙ্গল, বলল, আমি বুঝি না, আমি কাউকে কাউকে রিকোয়েস্ট যে পাঠাই না তা নয়, কিন্তু তা তার পোস্ট দেখে, কী ভাবতে পারে সে তা দেখে, বাট ইট ইজ নট আ রেগুলার প্র্যাক্টিস, আমি বলব কী করে ?
দ্যাখো আঙ্কেল, আমি তোমার ফেসবুক ফ্রেইন্ড হলাম, তারপরই তোমার ওল্ড ম্যান বন্ধুরা আমাকেবলবে ইন-বক্সে এস, তার মানে ক্লোজ হতে চাইবে, থাক।
এবার বিল্বমঙ্গল সরাসরি জিজ্ঞেস করল, তুমি কি অখিলেশ দের সঙ্গে আছ বন্ধুতায় ?
আমার বাবা ? মুগ্ধ স্বরে উচ্চারণ করল ইনা, দ্যাট ইল ফেটেড ম্যান !
সে কী নামে আছে ?
আমি বলব না আঙ্কেল, আমাকে জিজ্ঞেস করো না।
তার কী হয়েছে ?
উফ, কাল থেকে একবারও আসেনি সে, তার মোবাইলও চুপচাপ।
কোথায় আছে সে ?
আমি জানি না।
তোমাকে বলেনি ?
না, কেন বলবে ?
তাহলে কি রকম বন্ধুতা ?
সে আমাকে বলেছে সে খুব বিপযর্য়ের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে, দিস মাচ, আমি আর কিছু বলব না, হি ডাজ নট লাইক ইলিনা দে।
বিল্বমঙ্গল অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে। ইলিনা কত সহ্য করেছে। কী অসহায় হয়ে থেকেছে দিনের পর দিন। অখিলেশ যেন তার কাছে কু-গ্রহের মতো এসে পড়েছিল। অখিলেশকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল ইলিনা। সেই ভালবাসার পরিণতি এই। মেয়েটাকে বড় করল, এখন মেয়েটি তার মায়ের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে। তাকে টেনে নিচ্ছে অখিলেশ দে।
সে কি নিজের নামে আছে ?
আমি বলব না আঙ্কেল, আই প্রমিসড।
তাহলে তুমি ঐ কথাটি বললে কেন, সে বিপযর্য়ের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে ?
আমি বলে ফেলেছিলাম লিনাকে, লিনা ডাজ নট লাইক হার ফাদার অখিলেশ, বাট আই লাভ মাই ফাদার অখিলেশ দে, লিনা কথাটা মাকে বলে দিল, মা তারপর থেকে চাপ নিয়ে বসে আছে, কিন্তু চাপ নেওয়ার কিছু নেই, এতদিন কোনো যোগাযোগ নেই, এখন যোগাযোগ করে লাভ কী, কিন্তু আমরা ছোট ছিলাম, এখন আমরা বড় হয়েছি, আমরা কেন যোগাযোগ করব না বাবার সঙ্গে, অ্যাম আই ক্লিয়ার ?
বিল্বমঙ্গল চুপ করে বসে থাকল। ইনা উঠল তার মোবাইল খুট খুট করতে করতে। মোবাইলেও নেট-ফেসবুক করা যায়। বিল্ব মাঝে মধ্যে খুলে ফেলে নেট। গুগুল সার্চ করে মোবাইলে। ফেসবুক দেখে নেয়। ছবি তুলে পোস্ট করে। মোবাইল যেন বড়দের খেলনা। কত কী হয় তা দিয়ে। ইনা উঠলে লিনা এল, হাই আঙ্কেল, কেমন আছ ?
লিনা ইলিনার মতো হয়নি। তার গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম। তার ভিতরে অখিলেশ রয়েছে আবার ইলিনাও আছে। সে বিল্বর সামনে বসেছে। এবার এইচ, এস, দিয়েছে। দিদির সঙ্গে তার বছর পাঁচের তফাৎ। লিনা বলল, ও বলবে না, বলেনি তো ?
তুমি অ্যাড্রেসটা বার করতে পারছ না ?
না আঙ্কেল, ও এখন একা শোয়, আর বাবার সঙ্গে ওর যোগাযোগ হয় রাতে, গভীর রাতে।
তুমি কেন বাবার ফ্রেইন্ডশিপ নিচ্ছ না ?
ও আমাকে দেয়নি নামটা।
সে অখিলেশ নামে নেই ?
মনে হয় নেই।
বিল্বমঙ্গল বলল, তোমার মা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে।
মা এতটা চাপ নেবে তা আমি বুঝতে পারি নি, আমি বাবাকে লাইক করি না, হি ইজ আ ফ্রড, ওম্যানাইজার, দুশ্চরিত্র দায়িত্বহীন একটা লোক, সন্তানদের প্রতি তার কোনো দয়া মায়া নেই, মা তার জন্য সারাজীবন খুব কষ্ট পেয়েছে, বাট ইলিনা দে স্টিল লাভস হিম, এটা কী করে হয়, জানলে বলতাম না।
তোমার বাবা তোমার বন্ধু হল না কেন ?
দিদি মনে হয় হতে দেয়নি, আমার তো অনেক বড় বন্ধু আছে, দে আর ফোরটি, ফিফটি, অ্যান্ড সিক্সটির জেঠুও আছে, যোগেন, বিলাশ, কুমুদ। কে, রয় মানে কার্ত্তিক রয়, নাম দেখেই তুমি ধরতে পারবে, দে আর এজেড ফ্রেইন্ড, কিন্তু অখিলেশ রায় আসেনি।
অখিলেশ তো ঐ নামে নেই।
দিদি বলছে বটে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না।
তাহলে তুমি সার্চ করে দ্যাখো, অন্তত আইডেন্টিফাই করো।
মাথা নাড়ে লিনা, আমি কি করিনি, আই থিঙ্ক আই হ্যাভ বিন ব্লকড বাই অখিলেশ দে, অ্যান্ড ইলিনা দে ইজ অলসো ব্লকড।
ব্লক করলে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না ফেস বুকে। আর খোঁজার একটি উপায় তো ফেসবুক যখন সে আছে তার ভিতর।
বিল্বমঙ্গল জিজ্ঞেস করল, তুমি দিদির কাছে কী শুনেছিলে ?
তিনি খুব খারাপ আছেন।
খারাপ আছেন মানে ?
এইটুকু বলেছে আমাকে, আর কিছু না।
অসুখ ? বিল্ব জিজ্ঞেস করে।
হতে পারে।
ফিনান্সিয়াল ট্রাবল ?
হতে পারে।
সে কি এখন একা ? বিল্বর মনে হয় লিনা কিছু জানলেও জানতে পারে।
হতে পারে।
সে তো আবার বিয়ে করেছিল। বিল্ব বলল। তার ভাল লাগছিল এই মেয়েটিকে। মেয়েটি রিজনেবল। যুক্তি দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছে গোটা ব্যাপার। সেএবার কথা ঘোরায়, বলল, তুমি সায়েন্স না আর্টস ?
সায়েন্স, কিন্তু আমি ইংলিশ লিটারেচর পড়ব।
গুড, কিন্তু আমাকে সত্যি করে বল দেখি তোমার বাবা কোথায় থাকতে পারেন ?
সত্যি করে বলব কী করে, আমি তো সত্যিটা জানি না।
আন্দাজ ?
লিনা বলল, দিদি জানে সব, কিন্তু বলবে না, আমার মনে হয় নর্থ বেঙ্গল।
সে তো আমাদেরও মনে হয়।
লিনা বলল, পুরুলিয়াও হতে পারে।
পুরুলিয়া না মেদিনীপুর ?
তাও হতে পারে।
নর্থ বেঙ্গল থেকে পুরুলিয়া মেদিনীপুর হল কেন ? জিজ্ঞেস করল বিল্ব।
দিদি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, এই সময়ে পুরুলিয়া বাঁকুড়ার পাহাড়ি এলাকায় টেম্পারেচর খুব ওঠে কিনা।
পুরুলিয়া বাঁকুড়া বলেছে ?
হাঁ আঙ্কেল।
তাই থেকে তোমার মনে হল ?
হাঁ। বলে মাথা নামিয়ে কী যেন ভাবে লিনা।
সে উত্তর বঙ্গ থেকে দক্ষিন পশ্চিমে কবে এল ?
আই ডোন নো আঙ্কেল, কিন্তু দিদি সব জানে, ও গভীর রাতে কথাও বলে মনে হয়।
কিন্তু কেন আসবে সে পুরুলিয়ায় বা বাঁকুড়ায় বলতে পারো ?
আমিও তাই ভাবছি আঙ্কেল, না হতেও পারে, দিদি হয়তো এমনিই বলেছে, জাস্ট কথার কথা।
৭
কথার কথা কেন ? পুরুলিয়া বাঁকুড়া কেন ? লিনা বলল, সে চেষ্টা করবে দিদির কাছ থেকে বের করতে, কিন্তু না বের করলেও কিছু হত না। বাবাকে নিয়ে তার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। বাবার কষ্ট হোক, দুঃখ হোক, তার ভিতরে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। বাবা তাদের কথা ভেবেছে কোনোদিন ? তারা মরল না বাঁচল, সে খোঁজ নিয়েছে ?
লিনার সঙ্গে আরও কথা হয়। তার এখন নিজস্ব মতামত হয়েছে। সে পরিষ্কার করে বলল, শুধু মায়ের জন্যই তাকে মাথা ঘামাতে হচ্ছে, ইলিনা দে খুব ক্ষমাশীলা, দয়াশীলা। কবে লোকটা চলে গেছে, এখনো তার জন্য মন খারাপ করে। কিন্তু সে তো দুশ্চরিত্র, সে মা ইলিনার সুখ দেখতে পারে না। তাই ইনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে যাতে মা বিব্রত হয়। মা ইলিনার ঘুম যায়। পুরুষমানুষ খুব নিষ্ঠুর হয় মনে হয়, ডোন্ট মাইন্ড আঙ্কেল, ইন ফ্যাক্ট আই ডু নট নো ইট, আমি কী করে জানব, আমরা তিনটি মেয়ে একসঙ্গে থাকি, তোমার কি মনে হয় আঙ্কেল ?
বিল্বমঙ্গল চুপ করে থাকে। সে এই বয়সী কোনো মেয়ের সঙ্গে এই ভাবে আগে কখনো কথা বলেনি। তার শালির মেয়ে শালার মেয়ে আছে, ইনার মতো, লিনার মতো, কিন্তু তারা মেসো পিসে বলে প্রণাম করে সরে যায়। তাদের মাসি পিসির সঙ্গে তাদের আড্ডা। কিন্তু তা দীপিকা পাড়ুকন, প্রিয়াঙ্কা চোপরা—সঞ্জয় দত্ত, ইমরান খান, বিরাট কোহলি—এইসব নিয়ে। লিনা তাকে জিজ্ঞেস করছে পুরুষ মানুষ নিষ্ঠুর হয় কিনা। কদিন আগে ইন্টারনেট-ফেসবুকে সে দেখেছে একজন লিখেছে মেয়েরা খুব নিষ্ঠুর হয়। তা নিয়ে রাজ্যের বেটা ছেলে নানা রকম মন্তব্য করেছে। তাকে সমর্থন করেছে বহুজন, আবার বিপক্ষেও কেউ কেউ লিখেছে। একজন লিখেছে, এ নিশ্চয়, প্রেমে ঝাড় খেয়েছে, কতবার হল, হা হা হা।
বিল্বমঙ্গল বলল, যা চারদিকে ঘটছে, তোমার কথাই সত্য।
তখন ইনা আর ইলিনা এল চায়ের কাপ নিয়ে, ইনা কথাটা শুনেছে, বলল, নো আঙ্কেল, যা ঘটছে, ওগুলো ব্যতিক্রম বলতে পারো, আই লাইক মেন, পুরুষরা অনেক সহ্য করে, শত আঘাতেও অবিচল থাকে, তারাই তো মেয়েদের বাঁচায়।
বিল্ব উত্তর দিল না। তার সংস্কারে লাগছিল। এইটুকু সব মেয়েদের সঙ্গে এই নিয়ে সে কী কথা বলবে ? সে এদের চল্লিশ বছর আগে জন্মেছে। এরা যে ভাবে জীবনটাকে দেখছে, সেই ভাবে সে দেখতে জানে না। তারা এই ভাবে বড় হয়নি। তারা ঐ বয়সে অত বয়সের মানুষের সামনেই আসত না। ফেসবুক- ইন্টারনেট সমস্ত পুরোনো ধ্যান-ধারণা ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু সেই জগৎ তো ভার্চুয়াল ওয়ারল্ড। বাস্তবতার থেকে অনেক দূরে। তার যে বালিকা—কিশোরী, সদ্য যুবতী বন্ধুরা আছে অনেক বন্ধুদের ভিতর, তাদের কেউ কেউ তাকে বিল্বদা, কেউ আবার হাই বিল্ব বলে ডাক দেয়। বিল্বর মনে হয় তাদের কোনো অস্তিত্ব এই মাটির পৃথিবীতে নেই। তারা সব ভিন গ্রহের বাসিন্দা। তারা সব আকাশের পরি, অক্ষয় যৌবনা। তাদের যে মুখের ছবি রয়েছে ফেসবুকে, তা পরমা সুন্দরীদের। সেই সব সুন্দরী কন্যারা একদিন এই পৃথিবীতে এসেছিল বুঝি কোনো এক জ্যোৎস্নাময়ী রাতে। ফিরেও গেছে, ফিরে গিয়ে আবার সেই দূর নক্ষত্র থেকে, অ্যান্ড্রোমিডা নক্ষত্র থেকে বুঝি তাকে ডাক দেয়, হাই বিল্ব, বিল্ব স্যার। একজনের নামই তো আছে অ্যান্ড্রোমিডা সেলিনা।
বিল্ব বলল, আমি এবার উঠব।
কেন আঙ্কেল, আর একটু থাক। ইনা বলল।
না, তুমি তো আমার বন্ধু হলে না।
তুমি মায়ের ফ্রেন্ডশিপ নিয়েছ ? ইনা জিজ্ঞেস করে।
তোমার মা তো আমার কলিগ আর বন্ধুও।
ফেসবুক ফ্রেন্ড ?
না, তোমার মা তো অন লাইন হয় না।
মায়ের ইন্টারেস্ট নেই। বলে ইনা আচমকা চলে গেল, ডাকল লিনাকে, এই এদিকে আয়।
লিনা উঠে যেতে ইলিনা জিজ্ঞেস করল, কোনো কথা কি জানতে পারলে বিল্বদা ?
বিল্বমঙ্গল মাথা নাড়ে। ইলিনা বলল, ইনা অদ্ভূত, যদি না বলবে আমাকে বলল কেন ওইসব কথা, ওকি চায় ওদের মা মরে যায়।
বিল্ব বলল, ইমোশনাল হয়ো না। আমার মনে হয় উল্টোও হতে পারে।
উল্টো কী হবে ?
ওরা কেউ চায় না তুমি আর ওদের বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করো।
কিন্তু তাহলে কথাটা বলল কেন, খুব বিপযর্য়ের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে অখিলেশ।
বিল্বর কী মনে হল, বলল, সে তো উত্তরবঙ্গে ছিল।
হ্যাঁ, একটা ভূটিয়া মেয়েকে বিয়েও করেছিল, না হলে লিভ টুগেদার করছিল, ওদের বাচ্চাও হয়েছিল শোনা যায়।
আচ্ছা বাঁকুড়া বা পুরুলিয়াতে সে যেতে পারে ?
চমকে ওঠে ইলিনা, বলল, এ কথা কে বলল?
যে হোক বলেছে।
সে তো ডুয়ারসে ছিল, আমি ডুয়ারস থেকে খোঁজ এনেছিলাম, তার চাকরি ছিল না।
ব্যবসা করছিল ?
চা বাগানে ঢুকেছিল, চায়ের ব্যবসা হতে পারে, ওর তো বাঁধা মাইনেতে চলত না, উপরি আয় করতে গিয়ে সরকারি চাকরি গেল ওর।
বাঁকুড়া পুরুলিয়ায় কি যেতে পারে ?
কেন, কে বলল ?
বল না তুমি। বিল্ব বলে।
আমার শ্বশুরবাড়ি ন’পাহাড়ি।
জায়গাটা কোথায় ? বিল্ব জিজ্ঞেস করে।
পুরুলিয়া বাঁকুড়া সীমান্তে, পাহাড়ি এলাকা, অখিলদের পৈতৃক বাড়ি। বিনবিন করে বলল ইলিনা, সে ভারি সুন্দর জায়গা।
তুমি গেছ ?
হ্যাঁ বিল্বদা, দু-তিনবার গেছি, খুব সুন্দর জায়গা।
আমি শুনেছিলাম অখিলরা ইস্ট বেঙ্গলের লোক, আমাদের মতো ওপারে ছিল ওদের বাড়ি।
হ্যাঁ, ভৈরব নামের একটি নদীর ওপারে বাগেরহাটে।
তা আমি তোমার আর অখিলের কাছে শুনেছি।
ন’পাহাড়িতে ওর বাবা ইস্কুল টিচার হয়ে যান, ওখানেই সেটল করেন ফিফটিজের মাঝের দিকে, অখিলের জন্ম ওখানেই, ও বলত ওটাই ওর নেটিভ ভিলেজ, তুমি কেন এই সব কথা তুলছ, ওকি সেখানে আছে ?
তোমার মেয়েরা জানে।
ওরা বলেছে ন’পাহাড়ি ?
না, বাঁকুড়া পুরুলিয়া।
পুরুলিয়ার বর্ডারে, উত্তর-পশ্চিম বাঁকুড়া। বলল ইলিনা, ন’টা টিলা পাহাড়ে ঘেরা, কী অপূর্ব এক জায়গা, দূরে বিহারীনাথ পাহাড়, কাছেই গন্ধেশ্বরী নদীর জন্মস্থল, শাল আর পলাশের বন।
তুমি কবে গিয়েছ ইলিনা ?
বিয়ের পরপর, বিহারিনাথে পুজো দিয়েছিলাম, তারপরেও গিয়েছি, ওদের বাড়ির নাম পাহাড়তলী।
বাহ ! বিস্মিত হল বিল্ব।
ওখানে অদ্ভূত এক সূযোর্দয় দেখা যায় বিল্বদা, জায়গাটায় অনায়াসে বেড়াতে যাওয়া যায়, পাহাড় জঙ্গল, শাল পিয়াল পলাশ মহুয়া—কত রকম গাছ, আবার লালমাটির ডাহি-প্রান্তর আছে, দেখলে কী রকম শূন্য মনে হয় সব।
ওখানে কি ও ফিরতে পারে ?
ভূটিয়া বউ নিয়ে, ভূটিয়া মেয়ে কি আসবে এদিকে ? সন্দেহ প্রকাশ করল ইলিনা।
যেতে পারে ন’পাহাড়িতে।
ওখানে তো আর কিছু নেই বিল্বদা।
কেন কী হলো ?
ও সব বেচে দিয়েছিল, অর দিদি আর বোনদেরও কিছু দেয় নি, ওর এক বোন থাকে বেড়ো গ্রামে, সেখানেও আমি গিয়েছি।
ইলিনা আর বিল্বমঙ্গল কথা বলছিল। বিল্বর সামনে খুলে যাচ্ছিল আর এক মহাপৃথিবী।
৮
ইলিনা বলে, শোনো দেবাংশু, আমি ভুলেই যাচ্ছিলাম, কাল বিল্বদা যেন ধরিয়ে দিল, আমার হাজব্যান্ড অখিলের বাড়ি বাঁকুড়া আর পুরুলিয়ার সীমান্তে, সে খুব সুন্দর জায়গা।
ইলিনার কথা আরম্ভ হল অফিসের কাজের ফাঁকে ফাঁকে। শ্রোতা দেবাংশু, বিল্বমঙ্গল, বীরেন, গোলাম—সকলে। শুনতে শুনতে বিল্বর মনে হয়, তাহলে অখিলের মতো একটা খারাপ মানুষেরও নিজস্ব এক গ্রাম ছিল। অথচ অখিলরা তো এসেছিল বাগেরহাট থেকে। সেই নদী নালা বনবাদাড়ের দেশ থেকে গিয়েছিল এক নির্জলা রুক্ষ পাহাড়ি এলাকায়। আর সেই ন’পাহাড়িকে নিজের গ্রাম বলে মেনে নিয়েছিল অখিলের বাবা। তাঁর ছেলে মেয়েরা। অখিলের দিদি বোনের বিয়ে হয়েছে ঐ জেলা আর পুরুলিয়ার এখানে ওখানে। ইলিনা বলছে ন’পাহাড়ির পাশের বেড়ো গ্রামের কথা। সেই গ্রামে পৌষ সংক্রান্তিতে খুব বড় মেলা বসে। সেই মেলায় যদি যাও দেবাংশু, কী অসামান্য !
দেবাংশু বলল, পৌষ সংক্রান্তিতে আমাদের ওদিকে কত মেলা তার কোনো হিসেব নেই, আর সুবর্ণরেখায় টুসু ভাসানো হয় সংক্রান্তির ভোরে।
ইলিনা বলে আমার ননদের বাড়ি যে পুরুলিয়ার যে গ্রামে, তার পাশেই কাঁসাই নদী, আমি একবার পৌষ সংক্রান্তিতে কাঁসাই-এ টুসু ভাসানো দেখেছি, কী সুন্দর, টুসুর গানও আমি জানতাম, অনেকদিন আগের ব্যাপার তো, ভুলে গেছি।
বিল্বমঙ্গল মনে মনে বলে, সে দেবাংশুদের গ্রামে টুসু ভাসানো দেখতে যেতে পারে, দেবাংশুর এসব আছে, তার নেই।
ইলিনা বলে, টুসু কেন বিল্বদা, একবার ভাদ্রমাসের সংক্রান্তির আগেরদিন আমি ন’পাহাড়িতে ভাদুগান শুনে ছিলাম, অপূর্ব।
ভাদু আমাদের ওদিকে নেই। দেবাংশু বলে।
ইলিনা কী দেখেছিল সেই কথা বলে। প্রায় সারারাত জেগে বাউরি পাড়ায় বসে ভাদু শুনেছিল সে অখিলের সঙ্গে। সে কী অপূর্ব দিন ছিল। বলতে বলতে ইলিনার চোখে জল এসে যায়। মেয়েরা অদ্ভূত। সেই কবে অখিল তাকে ছেড়ে চলে গেছে। চলে গিয়ে একটা ভূটিয়া মেয়েকে বিয়ে করে সংসার পেতেছে, অথচ সে সব মনে রেখেছে। কিছুই ভোলেনি। বলে যাচ্ছে তার ননদ আর তার শ্বশুরবাড়ির গ্রামের কথা। কিন্তু তা তো আর তার নেই। অখিলও নাকি ন’পাহাড়ির সব একাই বেচে ওখানকার পাট শেষ করেছিল। আর তার পরেই ইলিনার মন থেকে ন’পাহাড়ি সরে যেতে থাকে। অথচ বিয়ের আগে থেকে অখিল ন’পাহাড়ির কথা বলে, ন’পাহাড়ির গল্প বলে বলে তাকে মোহিত করে রাখত। ন’টি পাহাড়ে ঘেরা এক এক গঞ্জ—গ্রাম। তার কাছেই জন্ম নিয়েছে গন্ধেশ্বরী নদী। সেই নদী নেমেছে পাহাড়ের বুকের এক ঝর্নার সঙ্গে। সেই জায়গাটি শালবনে ছাওয়া। খুব নির্জন। তুমি যখন যাবে দেবাংশু, কত দূর থেকে শুনতে পাবে নদীর নেমে আসা ছল ছল শব্দ। চলচ্ছল ধ্বনি। শুনতে শুনতে বিল্বমঙ্গলের মনে হয়, ঐ ভার্জিন স্প্রিং বুঝি সে কোনো একদিন দেখে এসেছিল। গভীর এক ছায়ায় ঢাকা পাহাড়ের কোলে পৌঁছে। সেখানে এক ভিন গাঁয়ের সাধুর আশ্রম। তিনি চান না ঐ নির্জনতা ভেঙে যাক। প্রকৃতি যে স্তব্ধতা দিয়েছে তা বুঝি পদ্মপাতায় জলের মতো। মৃদু বাতাসেই ভেঙে যাবে। কিন্তু তা নয়, প্রাকৃতিক যত শব্দ তা জুড়ে গেছে ঐ নিস্তব্ধতার সঙ্গে।
ইলিনা বলে, সাধুর আশ্রমে পৌঁছতেই, সাধু নিজের ঠোটে তর্জনী ছোঁয়ালেন, চুপ। আমরা চুপ করে বসে থাকলাম। জায়গাটা কী ঠান্ডা ! অথচ তখন, ছিল বৈশাখ মাস। সেদিন ছিল চৈত্র পূর্ণিমা।
এবারও চৈত্র পূর্ণিমা বৈশাখে পড়েছে। বীরেন বলল।
আমরা শুনেছিলাম বৈশাখী পূর্ণিমায় গন্ধেশ্বরী নদীর জন্ম। বলল ইলিনা।
বাহ! অভিভূতের মতো বলল দেবাংশু।
বিল্বমঙ্গলের মনে হয়, এই কথাও সে শুনেছে। আরো কিছু শুনেছিল সে। মনে পড়ে যায়। অবাক করা কথা বলছে ইলিনা। ইলিনা যেন পাহাড় ফাটিয়ে সেই চলচ্ছল ঝর্নার মতো বেরিয়ে আসছে। কথায় পেয়েছে তাকে। কথা কথা আর কথা।
বিল্ব জিজ্ঞেস করল, এমন সুন্দর সেই ন’পাহাড়ি ?
হ্যাঁ বিল্বদা, সেই লোকটা, সেই অখিলেশ আমাকে ন’পাহাড়ির গল্প বলে বলে বশ করেছিল, আমাকে সে বলেছিল গন্ধেশ্বরী নাকি আমি, আমিই সেই ঝর্না। বলতে বলতে মাথা নোয়ায় ইলিনা। চুপ করে যায়। ধীরে ধীরে শ্বাস নিচ্ছিল সে।
বিল্বর সঙ্গে আলাপ ছিল অখিলের। অখিল খুব সুন্দর কথা বলতে পারত। ওর বাংলা ইংরিজি দুই ভাষাতেই ছিল অপূর্ব দক্ষতা। হিন্দিও খারাপ বলত না। অখিল তার কথায় মুগ্ধ করতে পারত যে কোনো মানুষকে। মুগ্ধ করেছিল ইলিনাকে। অথচ ইলিনার প্রেম-প্রত্যাশী ছিল এক আই, এ, এস, অফিসার। এক ডব্লিউ বি সি এস অফিসার। সে তো ছিল পরম রূপবতী। এই যে বিল্বমঙ্গল, সে কি এখনো ইলিনার উপস্থিতিতে আনন্দময় হয়ে ওঠে না ? ইলিনার উপস্থিতি যেন এক মধুর বাতাস। ওর ভিতরে যে স্নিগ্ধতা আছে তা সকলকে স্পর্শ করে।
ইলিনাকে গন্ধেশ্বরীর উৎস দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল অখিল। বলেছিল, বৈশাখী পূর্ণিমার চন্দ্রোদয়ের মুহূর্তে পাহাড় ফাটিয়ে নেমে এসেছিল গন্ধেশ্বরী নদী, সেই কুমারী ঝর্না, ভার্জিন স্প্রিং। কথাটা ছিল প্রচলিত লোকবিশ্বাস। ওইদিনই সেই নদীর উৎসের কাছে অনেক মানুষ যায় সন্তান কামনায়। সারা বছরে ওই একদিনই স্তব্ধতা ভাঙে। আর সেদিন সাধু তাঁর আশ্রম বন্ধ করে সরে যান বনের গভীরে। তিনি জানেন অনেক বছর আগে আর এক সন্ন্যিসী এই উৎস স্থলে এক মেলা বসিয়েছিল। কিন্তু সেই মেলা যে কুমারী মৃত্তিকা, কুমারী ঝর্না ঘিরে যে নীরবতা তা চূর্ণ করবে সে কথা ভাবেননি সন্ন্যিসী। দেখেছিলেন একদিনের জনসমাবেশ শেষ করে দিয়েছে বনভুমির ঈশ্বরত্বকে। তিনি দুঃখে বনের গভীরে প্রবেশ করে আর ফেরেননি। আত্মপীড়িত হয়ে তিনি টের পেয়েছিলেন কুমারী ঝর্ণার পবিত্রতা ধ্বংস করে দিয়েছেন তিনি মেলা বসিয়ে। পাপবিদ্ধ সন্ন্যাসীকে আর খুঁজে পায়নি কেউ। অনেকদিন বাদে এক কাঠুরিয়া খুঁজে পেয়েছিল হাড়-কঙ্কাল। তা জড়িয়ে ছিল গেরুয়া বস্ত্রের মতো কিছু। সাধু বনভূমির ভিতরে গিয়ে নিজেকে ধীরে ধীরে বিলিয়ে দিয়েছিলেন প্রকৃতির ভিতরে। বনভূমির নীরবতার ভিতরে নীরব হয়েছিলেন তিনি।
ইলিনার কথা শুনতে শুনতে বিল্বমঙ্গল বলল, আমি একবার যাব সেই ভার্জিন স্প্রিং দেখতে।
কবে যাবে বিল্বদা ?
বিল্ব বলল, তুমি কবে যাবে বলো।
আমি যাব বিল্বদা, কিন্তু আমার মেয়েরা দুজনেই এ ব্যাপারে এক কাট্টা।
কী বলছে তারা ?
তারা বলছে না যেতে হবে না, কোথায় যাব কার কাছে যাব?
কাল তো কথা হল মাত্র, এর ভিতরে ?
হ্যাঁ বিল্বদা, কাল রাতেই আমি লিনাকে বলেছি ন’পাহাড়ি যাওয়ার কথা, সে তীব্র আপত্তি জানাল, আর ইনা বলল, কভি নেহি, গেলে ওদের একা রেখে যেতে হবে।
কেন, ওদের আপত্তি কিসে ?
ইনা বলছে, ওখানে আমাদের কেউ নেই, কেন যাব?
আর লিনা ?
লিনা বলছে, কিছুই নেই যখন, কোথায় গিয়ে উঠব আমরা ?
বিল্ব বলল, একই কথাই বলছে প্রকারান্তরে, তাই তো ?
হ্যাঁ বিল্বদা, আমি যত বলি গন্ধেশ্বরী নদীর কথা, ইনা বলছে অল আর বোগাস, রাবিশ, সব মিথ্যে।
তুমি কী বললে ?
আমি যে সত্য বলে জানি বিল্বদা, ইলিনা বলে, তুমি ইনাকে একবার ফোন করবে।
বিল্ব বলল, সে তো এজেড পারসনদের পছন্দ করে না।
না করে না, ওর ফ্রেন্ড লিস্টে অন্তত পনেরজন ওল্ড ম্যান।
তুমি কী করে জানলে?
লিনা বলেছে, তার ভিতরে একজন প্রবীন অভিনেতা, আর একজন লেখক, লেখক আবার হিন্দিতে লেখেন, বেনারসে থাকেন।
ও হিন্দি জানে ?
ইংলিশে কথা বলে।
আমাকে যে রিফিউজ করল, বলেই দিল অ্যাকসেপ্ট করবে না।
তুমি যে মায়ের কলিগ, তাই, কিন্তু ফোন নিশ্চয় ধরবে তোমার, তোমার নাম্বার ওর কাছে আছে, ও বলেছে আঙ্কেল ইজ সুইট, সুইট আঙ্কেল।
৯
দেবাংশুর বড় পিসি থাকে যে বংশীধরপুর, সেখানে বংশীধর কৃষ্ণও উঠে এসেছিলেন সুবর্ণরেখা নদী থেকে। বন্যায় ভেসে এসেছিলেন দেবতা ! হ্যাঁ, কষ্টিপাথরের কৃষ্ণ। দেবাংশু বলে, পিসিদের গৃহদেবতা ঐ কৃষ্ণ। বংশীধর। গৃহদেবতার নামে গ্রামের নাম। তাদের পিসেমশায়দের ফ্যামিলি খুব রেস্পেক্টেড। পিসিদের বাড়ির দোলযাত্রা খুব বিখ্যাত। সাত গাঁয়ের মানুষ আসে দোলোৎসব দেখতে। দোল হয় প্রতিপদে অর্থাৎ কৃষ্ণ পক্ষের আরম্ভে। সে হৈ হৈ কান্ড। দেবাংশু ছোটবেলায় বছর বছর যেত। কী ভাবে যেত ? না সুবর্ণরেখার তীর ধরে হেঁটে। নদী বাঁধে বাঁধে। দেবাংশু বলে সেই যে যাওয়া তা কোনোদিন সে ভুলবে না। দরকারে পরজন্মেও যেন মনে থাকবে। বাঁদিকে কত বড় নদী। বালি চিকচিক করছে। ফাগুন মাস। রোদের তেজ বেড়ে ওঠার আগে আগে কাঁটাবনির কাছ থেকে পার হয়ে যেতে হবে নদী। তেজ বাড়লে নদী পার হওয়া বিপজ্জনক। শীতের পর নদীর এপার ওপার বালি আর বালি। শুধু মধ্যিখানে একটুখানি অংশে জল। সেই জল কোথাও বেশি, কোথাও কম। কাঁটাবনির কাছে মধ্যনদীর জলের গভীরতা কম। সেখানেই হেঁটে পার হয় মানুষ। তারপর আবার নদীর ধার ধরে হাঁটা। কখনো গাছের ছায়ায় বসে মুড়ি খেয়ে নেওয়া। দেবাংশুর বাবা বলেন, বংশীধরপুরের কৃষ্ণ খুব জাগ্রত। কতবার যে দোলপূর্ণিমার রাতে ঘুম ভেঙেছে দেবাংশুর বাবার। বংশীধর বেরিয়েছেন গ্রাম পরিক্রমায়। তখন ঘরে থাকাই বিধি। দেবতা নাচার মানুষের জন্য আশীর্বাদ নিয়ে আসেন দুয়ারে দুয়ারে। কত মানুষ যে তাঁর দয়ায় সমস্ত দুঃখ থেকে মুক্তি পেয়েছে। কত কাহিনি আছে তার।
দেবাংশু তুমি কি শুনেছ বাঁশির শব্দ ?
দেবাংশু বলে, মনে হয় শুনেছি বিল্বদা, আমার বউ মৃত্তিকাও শুনেছিল সেবার।
ঘুমের ঘোরে এমন শোনা যায়। বিড়বিড় করল বিল্ব, কিন্তু তার কথাটা শুনতে দিল না কাউকে। বলল, কী শুনেছিলে ?
বাঁশির শব্দ, আড় বাঁশি, রাখালিয়া বাঁশি।
নতুন বউ নিয়ে দোলের সময় প্রণাম করতে গিয়েছিল সেবার। কিন্তু ঐ শেষ যাওয়া। তারপর আর বংশীধরপুরে যায়নি। কেন যায়নি ? দেবাংশু বলে যাওয়া হয়নি। হাতিবাড়ি অবধি গেছে, কিন্তু ফরেস্ট বাংলোয় থেকে ফিরে এসেছে। মৃত্তিকা যেতে চেয়েছে, দেবাংশু যায়নি। তার ভাল লাগেনি। যেতে ইচ্ছে হয়নি। দোলের সময় সে ঐ বংশীধরপুর যাওয়ার কথা এখন আর ভাবতে পারে না। শুনতে শুনতে বিল্ব বলে, তুমি যদি না যাও, আমি কী করে যাব দেবাংশু ?
দেবাংশু বলে, হাতিবাড়ি গিয়ে তুমি যাওয়ার উপায় পেয়ে যাবে, এখন আর আগের মতো দুর্গম নেই, যা শুনেছি ট্রেকার চলে, রাস্তা হয়েছে।
থাকব কোথায় ?
দেবাংশু বলে আমার পিসির বাড়ি, ফোন করে দেব, মোবাইল ফোন সব জায়গায় পৌঁছেছে, কলকাতা থেকে পিসির সঙ্গে কথা বলা যায়।
তুমি চল দেবাংশু, এমনি ঘুরে আসি, দোল পূর্ণিমায় আর যাব কী করে, তখন আমি চাকরিতে থাকব না।
থাকবে না তাতে কী হয়েছে, যাবে ঘুরে আসবে, আমি পিসির ছেলেকে বলব, সে তোমাকে নিয়ে আসবে হাতিবাড়ি থেকে, বাইরের লোক গেলে ওরা খুব খুশি হয়, ওরা চায় বংশীধর ঠাকুরের কথা দশদিকে ছড়িয়ে যাক, ঐ গোপীবল্লভপুরের বাইরের মানুষ জানুক পিসিদের ঠাকুরের কথা।
ঐ জায়গা কি গোপীবল্লভপুরে?
হ্যাঁ বিল্বদা।
নকশাল আন্দোলনের সেই গোপীবল্লভপুর ?
হ্যাঁ বিল্বদা।
বিল্বমঙ্গল বলে, ট্রাইবাল বেল্ট শুনেছি।
হ্যাঁ, আদিবাসী গ্রাম চারদিকে, সাঁওতাল তারা, লোকে বলে জংলি।
কেন বলে ?
আমরাও বলতাম বিল্বদা ছেলেবেলায়, পরে বুঝেছি বলাটা কতবড় অন্যায়।
শুনতে শুনতে ইলিনা বলল, তুমি একদিন আমার ফ্ল্যাটে চল দেবাংশু, তুমি তোমার গল্প বলে আমার মেয়েদুটোকে যদি রাজি করাতে পারো ন’পাহাড়ি যেতে।
এগুলো গল্প নয় ইলিনাদি, সত্যি কথা, শোনো বিল্বদা, তোমাদের সেই নকশাল আমলে পিসি পিসে আর বাড়ির সবাই বংশীধরের বিগ্রহ নিয়ে বারিপদা চলে গিয়েছিল পিসের বোনের বাড়ি।
বারিপদা মানে ওড়িশা ?
হ্যাঁ, পিসের দুই বোন বারিপদায় থাকে, তাদের মস্ত অবস্থা, কিন্তু ওদিকে তেমন নকশালি ছিল না।
তুমি তো তখন খুব ছোট।
দেবাংশু বলে, আমার তখন জন্ম হয়নি, আমি এসব বড় হয়ে শুনেছি, তখন না পালালে পিসে বেঁচে থাকত না ।
ইলিনা আবার বলে, চল দেবাংশু আমার ফ্ল্যাটে চল।
যাব ইলিনাদি, আজ হবে না, কাজ আছে।
বিল্ব বলে, তোমার পিসেদেরও অনেক সম্পত্তি ?
হ্যাঁ, বংশীধর ঠাকুরের নামেই সব, দেবোত্তর, পিসেরা সেবায়েত ছিল।
এখন কি সেবায়েত নন।
সেবায়েত তো নিশ্চয়, কিন্তু জমি নিয়ে নানান মামলা মোকদ্দমা চলছে, তবে পিসেদের আছে অনেক, জমি যে কী ভাবে থাকে তা যে রাখে সে জানে।
দেবাংশু যেন কথক ঠাকুর। ওর মতো গুছিয়ে কথা কেউ বলতে পারে না। আর দেবাংশু সে তাদের সুবর্ণরেখা আর ডুলুং নদীর কথা যখন আরম্ভ করে তখন যেন কথা ওর ভিতর থেকে পাহাড় ফাটিয়ে বেরিয়ে আসা স্রোতস্বিনী। সুবর্ণরেখা, তার তীরের গ্রাম, গ্রামের দেবতা, সাঁওতাল বসতি, টিলা বনপাহাড়—সব একটু একটু করে তার রূপ পরিগ্রহ করতে থাকে। দেবাংশুর এমন একটি গ্রাম আর সেই গ্রামের শৈশব আছে যে সে তাকে অবিরত খনন করতে পারে। বিল্ব পারে না। বিল্বর নেই। হয়তো হতো, কিন্তু হয়নি পার্টিশনের কারণে। বিল্ব তাই দেবাংশুর কথা শুনে যেন বুঝে নিতে চায়, তার ফেলে আসা গ্রাম নদী অন্যরকম হলেও এই রকম। প্রায় এই রকম। তার পিসিরও বিয়ে হয়েছিল চট্টগ্রামের ছেলের সঙ্গে, আর তা এপারে এসে। ওপারে যদি হতো বিল্ব সাতক্ষিরে থেকে চিটাগাং যেত পিসির বাড়ি। বঙ্গোপসাগর, কর্ণফুলী, চাকমা উপজাতি, পাহাড় পর্বত আর বড় জোতের মালিক পিসে নিয়ে কত কথা না বলতে পারত। সে শুনেছে তার পিসেদেরও বহু ভূ-সম্পত্তি ছিল। সব ফেলে আসতে হুয়েছিল চাটগাঁইয়া ভাষা সম্বল হয়ে। ভাষাই সঙ্গে আনতে পেরেছে তারা ওপার থেকে আসার সময়।
বিল্ব জিজ্ঞেস করল, কী ভাবে সম্পত্তি রাখে দেবাংশু ?
দেবাংশু বলে, মুনিষ কামিনগুলোর নামে রেখেছে শুনি, যত সব ফিক্টিসাস নামে জমি।
তোমাদের নেই এমন ?
না বিল্বদা, আমাদের হলো নদীর এপারে, এদিকে মানুষ অনেক কনসাস।
দেবাংশু তুমি আমাকে একবার বংশীধরপুর নিয়ে চল।
দেবাংশু বলল, আমি গেলে অভিষিক্তাও যেতে চাইবে, আমি যাব না বিল্বদা।
ওকে নিয়ে চলো সঙ্গে।
না, ওকে আমার পিসি পিসে বড় একটা পছন্দ করে না।
ও জানে ?
ও জানে, কিন্তু ও বিশ্বাস করে না।
কেন পছন্দ করে না ?
পিসির ননদের মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিল পিসি, বাবা মাও রাজি ছিল, আমি বেঁকে বসেছিলাম।
তোমাদের প্রেমের বিয়ে ?
হ্যাঁ বিল্বদা, আমি চাই না ও যাক বংশীধরপুরে, পিসে খুব রেগে গিয়েছিল বিয়েটা না হওয়ায়, তারা ময়ূরভঞ্জ জেলাতেই থাকে, বারিপদার সাতমাইল পশ্চিমের গ্রামে, আমাকে তিরিশ বিঘে ধান জমি দেবে বলেছিল, আর তিন লাখ ক্যাশ।
তুমি সেই মেয়েকে দেখেছ ?
হ্যাঁ, কতবার, দোলের সময় আসত পিসির বাড়ি, সুন্দরী, কিন্তু আমি কেন ঐ সব নিয়ে বিয়ে করব ?
তাহলে তো অভিষিক্তার না যাওয়া ভাল। ইলিনা বলল।
চুপ করে থাকে দেবাংশু। বাইরে বেলা ঘন হয়ে এসে পড়েই গেল তখন। ছ’টা বেজে গেল। এরপর লিফট বন্ধ হয়ে যাবে। কথা তাই থামল।
১০
দেবাংশুর পিসির ননদের সেই মেয়েটি যার নাম অভিমানিনী, তার সঙ্গে দোলেই দেখা হত। দেবাংশু সব বার যেত না, কিন্তু যে কবার গেছে, সে থাকত। সে বলত মামাঘর তাকে খুব টানে।
অভিমানিনী তার নাম ! বিস্মিত হল বিল্বমঙ্গল।
হ্যাঁ বিল্বদা, আর তাদের গ্রামের নাম কুঞ্জবন।
কুঞ্জবন কোনো গ্রামের নাম ?
হ্যাঁ, তো কুঞ্জবন থেকে সে বসন্ত পূর্ণিমায় বংশীধরপুর আসত, আমার সঙ্গে দেখা হত, সে আবার ইংলিশ মিডিয়াম, পিসে তার মামা, মামার সঙ্গে খাঁটি ওড়িয়ায় কথা বলে, আমার সঙ্গে ইংলিশ বলতে আসে, আমি ইংলিশে তখন কথা বলতে পারি না, ভয় লাগত মেয়েটাকে।
কিন্তু বারিপদার সাত মাইল পশ্চিমের গাঁয়ে ইংলিশ মিডিয়াম ইস্কুল আছে ?
তাকে কটকের ইস্কুলে রেখে পড়াত তার বাবা, অগাধ টাকা, তাকে দেখে মনে হত রূপকথার রাজকন্যে।
কিন্তু তার তো অনেক বড় বড় পাত্র আসার কথা, তুমি এমন কি ভাল ?
কে জানে, পিসে ঠিকই করে রেখেছিল আর পিসি মত দিয়েছিল, আমার বাবার সঙ্গে যখন কথা বলেছিল বাবা অবাক, আমি তখন ফুল বেকার, চুপ করে ছিল।
দেবাংশু এসেছে তার ফ্ল্যাটে। তারা ব্যালকনির অন্ধকারে বসে আছে তিনজন। মালবিকা দেবাংশুর অনেক কথা শুনেছে বিল্বর কাছে, কিন্তু বিল্ব কি আর দেবাংশুর মতো বলতে পারে ? বিল্ব বললে অবধারিত ভাবে কিছু বাদ যাবে আবার দেবাংশুর না বলা কথা কিছু ঢুকেও যাবে বিল্বর কল্পনা মতো। মালবিকা তার টেলিভিশন বন্ধ করে দেবাংশুর মুখোমুখি বসেছে। দেবাংশু বলছে, সেই অভিমানিনীর বিয়ে হয়েছে ঐ গাঁয়ের আর এক বড় জোতের মালিকের ছেলের সঙ্গে। ছেলেটি ওকে নিয়ে নিউজিল্যান্ড চলে গেছে।
খুব ভাল হয়েছে তো তাহলে। মালবিকা বলল।
না মালবিকাদি, তা নয়, পিসি বলেছে আমার মাকে, অতটা সম্পত্তি আমার না হয়ে অন্য ঘরে গেল, পিসির ননদের ঐ একটি মেয়ে, তাকে গাঁয়ে না রেখে ভিনদেশে পাঠিয়ে কী সুখ হল মা বাপের, অত জমি অত টাকা, দুখানা বাস থাকতে কোন ঠান্ডার দেশে সে পড়ে আছে, সেখেনে না আছে রাশ পুন্নিমে না আছে দোল পুন্নিমে, না আছে পৌষ সংক্রান্তি না আছে টুসু ভাসানো। শুনতে শুনতে মালবিকা বলল, ওসব তো আমাদেরও নেই, দোল পূর্ণিমা আছে, কিন্তু তোমার পিসির বাড়ির বংশীধর নেই তো, আমাদের এখন কোনো গৃহ দেবতা নেই।
মালবিকারাও ছিল খুলনা জেলার। সেই একই সাব-ডিভিশন। তাদের থানা আলাদা ছিল। বিল্বদের ছিল সাতক্ষিরে থানা, মালবিকাদের ছিল দেবহাটা থানা। সাতক্ষিরে হলো বসিরহাটের কাছে, আর মালবিকাদের গ্রাম দেবহাটা বসন্তপুর টাকির উল্টো দিকে। মালবিকার জন্ম এদেশে। তাদের বিয়ে হয়েছিল সম্বন্ধ করে। আর সম্বন্ধ করার সময় মাল্বিকার বাবা খুঁজেছিলেন সাবেক খুলনার পাত্র। সাতক্ষিরে মহকুমা হলে আরো ভাল। পাত্র চাই বিজ্ঞাপনটি তেমনি ছিল। তা দেখে বিল্বমঙ্গলের বাবা যোগাযোগ করেছিলেন। মালবিকা বলল, তাদেরও গৃহদেবতা ছিল, শুনেছে বাড়িতে ফুল দোল হতো, রাধামাধব কৃষ্ণের গায়ে ফুল ছুঁড়ত কুমারী মেয়েরা, তাদের বলা হত গোপিনী আর রাধার গায়ে ফুল ছুঁড়ত ছেলেরা। সে নাকি রীতিমতো মহোৎসব হতো, রং মাখামাখি আর রঙে স্নান, এমন কি পুকুরঘাটে বস্ত্র হরণের পরবও ছিল নাকি উৎসবের অন্তর্গত।
শুনতে শুনতে দেবাংশু আচমকা বলল, আমি এবার যাব বিল্বদা।
কেন, এখন তো সাড়ে সাতটা।
না যাই, ক্লান্ত লাগছে। দেবাংশু বলল।
হঠাৎ যে উঠছ ? মালবিকা বলল।
দেবাংশু বলল, আমার ঐ দোল-রাধাকৃষ্ণ ভাল লাগছে না, পিসির মেয়ের গল্প শোনাতেও ভাল লাগছে না, আমি তাকে একদমই পছন্দ করতাম না।
মালবিকা বলল, ঠিক আছে দেবাংশু বলতে হবে না।
দেবাংশু চুপ করে থাকল। তিনজনেই চুপ। সুর কেটে গেল যেন। মালবিকা উসখুস করছিল। তার কথা তো শেষ হয়নি। এমন গল্প করা তার হয়ে ওঠে না। সে সব সময় নিজের কল্পিত অকল্পিত অসুখ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আর তা থেকে মুক্তি পেতে টিভি সিরিয়াল। টিভি খুলে নির্বাক হয়ে চেয়েই থাকে মালবিকা। সিরিয়ালও এক ঘেয়ে। দুপুরে বই পড়ে। খবরের কাগজ ঘাঁটে। আজ একটু ব্যতিক্রম হয়েছে সন্ধেটা। দেবাংশুর কথা সে অনেক শুনেছে বিল্বর কাছে। দেবাংশু আজই এ বাড়িতে এল প্রথম। রাতে খেয়ে যাবে কথা হয়েছে। দেবাংশুর বউ মৃত্তিকা গেছে বাপের বাড়ি বারাসত। আজ ফিরবে না। সঙ্গে তার ছেলেও গেছে। মৃত্তিকা ফোন করেছিল অফিসেই। মৃত্তিকার এক মাসী এসেছে ইন্দোর থেকে। না গেলে দেখা হবে না। মাসী আগামী কাল সকালের ফ্লাইটে শিলিগুড়ি, তারপর সেখান থেকে দার্জিলিং। পনেরদিন শুধু ওখানে থাকবে। প্রতি বছরই কোনো না কোনো হিল স্টেশনে যায় বড় মাসী ইন্দোরের দুঃসহ গরমের হাত থেকে কদিন বাঁচতে। এবার দার্জিলিং। সুতরাং দেবাংশুর বাড়ি ফাঁকা। বাড়ি এখনই ফিরে সে কী করবে ?
দেবাংশু বলল, আমার পিসে বড় অদ্ভূত, ঐ জমির জন্য আমাকে নাকি মেয়েটাকে বিয়ে করতে হবে, আমাকে ওরা ঘর জামাই করে রাখত।
বিল্ব বলে, ভাল করেছ, বেঁচে গেছ।
মালবিকা বলে, যাক, আমার কথাটা শেষ হলো না, আমি শেষ করি।
দেবাংশু বলে, আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না মালবিকাদি, মানে তুমি কি বলছিলে গোপিনীর বস্ত্র হরণ ও হতো মোচ্ছবে ?
মালবিকা বলল, আমি তো দেখিনি দেবাংশু, মায়ের কাছে শুনেছি, কিন্তু মা খুব নিন্দে করেই বলত।
দেবাংশু বলে, নিন্দে কেন ?
পুরুষলোকের বদমায়েসি এসব, তাদের কাজ ছিল না, জমি চষত নমঃশূদ্র চাষারা, ধান উঠত খামার থেকে গোলায়, অলস লোকগুলোর তাস-পাসা যাত্রা থিয়েটার আর ধম্মো-কম্মো নিয়ে থাকত, আর ধম্মো-কম্মো নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছিল তারা, নষ্টামি যতসব।
দেবাংশু বলে, সে ইংলিশ মিডিয়ামকে আমি কেন বিয়ে করিনি মালবিকাদি তা জিজ্ঞেস করলে না ?
বললে তো, মৃত্তিকার সঙ্গে প্রেম।
সে তো পরে, বেকার অবস্থায় আমি না বলে দিলাম কেন ?
কী হয়েছিল দেবাংশু ?
দেবাংশু বলে, সে আমি বলব না।
না বলতে ইচ্ছে হয় তো বল না।
দেবাংশু চুপ করে থাকে কিছু সময়। অন্ধকারে দখিনা বাতাসের বয়ে যাওয়ার শব্দ শুনছিল তারা। দেবাংশু বলতে চায়, কিন্তু সংস্কারে আটকাচ্ছে তার, এমন মনে হয় বিল্বমঙ্গলের। সংস্কার মানে মালবিকা। মালবিকার সামনে বলতে হয়ত লজ্জা পাচ্ছে সে। হতেই পারে। অল্প বয়সে যা হয়ে থাকে তাই হয়েছিল হয়তো। অ্যাডোলেসেন্স পিরিয়ডের এমন কথা সব পুরুষ সব নারীর থাকে। দেবাংশু সেই কথা বলবে হয়তো। মালবিকা তা আন্দাজ করে বলল, আমি খাবার গরম করি, তোমরা কথা বল।
মালবিকা চলে যেতে দেবাংশু বলল, আসলে মালবিকাদির মা ঠিক বলেছিলেন, পুরুষের নষ্টামি, আমার পিসিদের বংশীধর ঠাকুর বংশী বাজিয়ে নাকি ডাক দেন, আর সে ডাক শুনে নাকি দুই রাতে, বসন্ত পূর্ণিমা আর পরের দিন, প্রতিপদে, অভিসারে বেরিয়ে পড়ে যুবতী থেকে প্রৌঢ়া যে কেউ। বাঁশি তো সবাই শুনতে পায় না, কেউ কেউ পায়, যে পায় সে মহাভাগ্যবতী। বংশীধরের সঙ্গে তার দেখা হয় চন্দ্রালোকে।
তুমি কি বিশ্বাস করবে বিল্বদা, এমনি কারণে সেই দোলোৎসব হল সব চেয়ে আকর্ষণীয়, সাত জায়গার লোক আসে সেখানে, সেই গাঁয়ের ভিতরে, কেউ যদি ডাক শোনে।
বিল্ব বলল, হতেই পারে, ধর্মবিশ্বাস থাকলে তার কোনও নিন্দা হয় না।
সেই অভিমানিনী আমাকে বলেছিল, তাকে কি বাঁশি বাজিয়ে ডাকবে রাধামাধব ?
তার মানে ?
সে বংশীধর কৃষ্ণের বাঁশির ডাক শুনবে বলে নাকি মামার বাড়ি আসে সব ফাগুনি পূর্ণিমায়, রাধামাধব বংশীধর কৃষ্ণের ডাক শুনবে বলে কত যুবতী মেয়ে বউ রাতে ঘুমোয় না সেই গ্রামে, ইন ফ্যাক্ট মেয়েদের রাত জাগা একটা ধর্মীয় রীতি হয়ে গিয়েছিল ওখানে। রাত জেগে তারা বংশীধর ঠাকুরের কথা ভাবত। সেই রাতে স্বামী সংসর্গ নিষিদ্ধ। সেই নারী আলাদা ঘরে শোয়, সঙ্গে থাকে অন্য নারীরা।
১১
এই কথা কি সত্যি ? বিল্বমঙ্গল জিজ্ঞেস করে অনেকটা স্তব্ধতার পর। তাদের কথার ভিতরে এখন নীরবতা এসে প্রবেশ করছে একেকবার। সেই নীরবতার নিষ্ক্রমণ না হলে যেন কথা ফুটছে না কারো মুখে। খুব নিচু গলায় কথাগুলি বলছে দেবাংশু।
আমি জানি না, কিন্তু আমিও যেন বাঁশির ডাক শুনেছি বিল্বদা।
শব্দ বিভ্রম, শ্রুতি বিভ্রম। বিল্বমঙ্গল বলে।
হয়তো তাই। বিনবিন করে বলল দেবাংশু, কিন্তু তুমি না গেলে বুঝতে পারবে না কী হয় বা হত সেখানে, কত জাগ্রত বংশীধর ঠাকুর।
বিল্ব বলল, সত্যিকারের জাগ্রত না হলেও মানুষের মনে তা জাগ্রত সত্য।
দেবাংশু বলল, তুমি জমির কথা জান বিল্বদা ?
না,কী করে জানব, আমাদের জমি ছিল ওপারে, এপারে বাঘা যতীন কলোনি, তারপর এই ফ্ল্যাট।
পিসেদের ছিল অনেকটা দেবোত্তর জমি, তুমি কি জানো ঐ জমির মালিক বংশীধর ঠাকুর, জমি রাখতে দেয় সরকার দেবসেবার জন্য।
তা তো আগেই বলেছ তুমি।
দেবাংশু বলে, মাঝে মাঝে দেবোত্তর এনক্যোয়ারি হয় জমি সত্যি দেবতার সেবায় ব্যবহার হচ্ছে কিন তা জানতে, দেবতার জনপ্রিয়তাও থাকে তদন্তের বিষয়, দেবতা কতটা মানুষের বিশ্বাসের মূলে আসন পেতে বসে আছেন।
দেবাংশু যা বলতে চায় তা হলো বংশীধর ঠাকুরকে নিয়ে যে বিশ্বাস তাকে অটুট না রাখতে পারলে দেবোত্তর সম্পত্তি রক্ষা হবে না। তার পিসেদের রায়তি জমি বেশি ছিল না ফ্যামিলি সিলিঙের আওতায় পড়ে। একান্ন বিঘে। জমি হল নেশা। ঐ সব অঞ্চলে জমির পরিমানেই সব কিছু নির্ধারণ হয়। আভিজাত্য, ক্ষমতা। সুতরাং বংশীধর ঠাকুরও হয়ে উঠেছিলেন পিসেদের ক্ষমতার আধার। ঠাকুরকে নিয়ে মিথ হয়ে উঠেছিল সত্য। তার বাঁশির ডাকের জন্য রাত জেগে থাকত রমনীরা। আর পুরুষের চোখেও ঘুম আসত না। দেবাংশুর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল মধ্যরাতে। মনে হয় বাঁশির ডাকে। কিন্তু বাঁশি তাকে ডাকবে কেন। বাঁশি তো ডেকে বের করবে ঘরের মেয়ে বউকে। রাধার অন্তরকে নিয়ে যাবে তমালতলে।
কী ডাক শুনে ঘুম ভাঙল দেবাংশুর তা সে জানে না। কিন্তু ঘুম ভেঙেছিল। চাঁদের আলো এসে প্রবেশ করছিল তার বিছানায়। সে জানালা দিয়ে দেখেছিল দূরে মৌবনির ঝোরা পার হয়ে যাচ্ছে কেউ একজন। সেই ঝোরা বা ঝর্না গাঁয়ের জলের বড় উৎস। মৌবনি হল জঙ্গল এলাকা। সেখানের কোন টিলা থেকে বেরিয়েছে ঝোরা, কয়েক মাইল বয়ে গিয়ে মিশেছে সুবর্ণরেখার সঙ্গে। দেবাংশু ঘরে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে। দেখল সদর আগে থেকে ভেজানো। তার মানে কেউ বেরিয়েছে। সে নদীর দিকে দ্রুতপায়ে হাঁটতে থাকে। আর হাঁটতে হাঁটতে মৌবনির ঝোরা পার হয়ে যেতে যেতে তার মনে হয় তার ঘুম ভেঙেছিল হয়তো পায়ের শব্দে। কিংবা খিড়কি দুয়ার খোলার শব্দে।
দেবাংশু বলে কী নিঃসীম নিস্তব্ধতায় রাত বয়ে যাচ্ছিল। পরিপূর্ণ চাঁদ মধ্যগগন থেকে পশ্চিমে ঢলেছিল সবে। রাতজাগা কীটপতঙ্গরা শুধু একটানা অস্পষ্ট কিছু গেয়ে যাচ্ছিল এক সুরে। আমি দেখলাম সে। কুঞ্জবনের অভিমানিনী। অভিমানিনী ঘুরে দেখল আমাকে। আমার কোনও লুকনোর জায়গা ছিল না। অত উদার প্রকৃতির ভিতরে কোনও কিছুই লুকোনোর জায়গা থাকে না। আমি দেখলাম সে নদীর ধারে পৌঁছে গেছে। মাটি ওখানে, মানে ঐ বংশীধরপুরে সটান নেমে গেছে জলে। নদীর কূলে চিকচিকে বালি চরা। সেই চরার উপর চাঁদের আলো। সেই আলো যেন বাসর জাগিয়ে রেখেছিল সর্ব চরাচরে। সে আবার ঘুরল। তারপর সেই চন্দ্রালোকে ধীরে ধীরে হাতের মুদ্রা রচনা করল, আকাশের দেবতাকে যেন আহ্বান করল। সে ছিল উজ্জ্বল শ্যাম। তার মাথায় ছিল ঘন মেঘের ছায়ার মতো চুলের ঢাল। সে তখন পরিপূর্ণ যুবতী হয়ে উঠেছিল যে তা দুপুরে রং মাখামাখির সময়ে আমি টের পেয়েছিলাম। টের পেয়েছিলাম ক্রমশ রসস্থ হয়ে উঠেছে সে। ভরে গেছে তার দুকুল। সত্যি বলতে কী দুপুর থেকে আমি চঞ্চল হয়ে পড়েছিলাম। আমাকে ডাকতে হয়নি, আমি নিজেই যেন জেগে উঠেছিলাম সেই রাতে। সে ছিল ভয়ানক সাহসী। দুপুরে পরেছিল উজ্জ্বল হলুদ আর লালে মেশানো এক স্কারট আর শাদা ব্লাউজ। ব্লাউজ সব সময়ই শাদা। রঙের দেওয়া নেওয়ার সময় বাগানের গাছের আড়ালে গিয়ে আচমকা ব্লাউজের বোতাম খুলে দিয়ে বলেছিল, মাখিয়ে দাও রং। বলতে বলতে থামল দেবাংশু। ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে লাগল। তার গা দিয়ে যেন এতকাল বাদেও আগুন বেরিয়ে আসতে লাগল।
তারপর কী হল দেবাংশু ? বিল্বমঙ্গল জিজ্ঞেস করল।
দেবাংশু বলল, আমার সামনে সে তার সদ্য ফোটা গোলাপের মতো, শিশিরে ভেজা গোলাপের মতো দুই স্তন মেলে ধরে রঙ মেখে নিয়েছিল। চাপা গলায় বলছিল, এমন করে মাখাও যেন কিছুতেই না ওঠে, পরের দোল অবধি থাকে। তারপর পালিয়ে যেতে যেতে চাপা গলায় বলেছিল, খুব অসভ্য, আমি পিসিকে বলে দি ?
রাতে কী হল ?
আমি লুকিয়ে গিয়েছিলাম বালিয়াড়ির আড়ালে। সে কি আমার দরজায় টোকা দিয়েছিল ? আমি জানি না, হয়তো। কিন্তু তার প্রতি আমার ভালবাসা জন্মেছিল তখন। সমস্তদিন কতবার যে আমায় ভয় দেখিয়ে গেল। চাপা হাসিতে খিলখিল করতে লাগল। তাকে দেখে আমার ভয় করতে লাগল। আবার শিহরিত হতে লাগলাম। পিসের খুড়তুতো বোনের ছেলে, পাশের গ্রাম আটাঙ্গীর মাধবদা, মাধব দন্ডপাট পড়াশুনো ছেড়ে দিয়েছে। সেই জমিজমা দ্যাখে আর কোন এক ইনসুরেন্সের এজেন্ট। মাধব আমাকে বলল, জিজ্ঞেস করল, মেয়েটা খুব বড়লোকের ঘরের ?
কেন ?
কটকে থাকে?
কেন, কী দরকার ?
বড় একটা পলিসি যদি করে।
তাহলে তুমি কুঞ্জবনে যাও।
হ, কুঞ্জবনে মাধব যাবে। মাধব বলল।
আমাকে বিকেলে অভিমানিনী জিজ্ঞেস করল, মাধবদা কী বলছিল তোমাকে ?
কিছু না।
কিছু না মানে, মাধবদা কি দেখেছিল ?
কী ? আমার বুকটা ধক করে উঠেছিল।
কী তুমি জান না, ভাল ছেলে! কটাক্ষ হেনেছিল অভিমানিনী। বলেছিল, তুমি আমার ওখানে রঙ মাখালে আর মাধব দঁডপাট তা দেখল।
আমার ভিতরে ভয় ঢুকে গিয়েছিল। সেই ভয় আর প্রথম কোনও যুবতীর শরীর স্পর্শের শিহরণ আমাকে মগ্ন করে দিচ্ছিল নিজের ভিতরে। আবার কুঞ্জবনের মেয়ে খিলখিল হাসিতে কতবার যে কঁপিয়ে দিচ্ছিল আমাকে। আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল পিসির কাছে, বলল, অংশুদাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে এস না একবার মামি।
যাবে অংশু যাবে, কিন্তু তুই তো থাকিস হোস্টেলে। দেবাংশুর পিসি, অভিমানিনীর মামি বলেছিল।
সামার ভ্যাকেশনে আস, আমি এবার না হয় ঊটি যাব না এডুকেশনাল ট্যুরে।
কুঞ্জবনের মেয়ে সামার ভ্যাকেশনে যেত হিল-স্টেশনে। তাদের মিশন স্কুলে ওইটাই রীতি। আমি তার প্রেমে পড়লাম। সেও আমার প্রেমে পড়েছিল মনে হল। আমাদের বিয়ের কথা তখন আমি শুনিনি। সে শুনেছিল। সেই মেয়ে।
দেবাংশু বলল, শোনো বিল্বদা, আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম সেই চাঁদের আলোর ভিতরে সে নৃত্যে মগ্ন হয়ে যেতে লাগল। সেই বয়সে প্রকৃতি উজাড় করে দেয়। তাকেও দিয়েছিল। আমি এমন আর দেখিনি। চাঁদের আলোয় যেন গগনবিহারী পরী নেমেছে অফুরান উল্লাসে। সে যেন এই মহাব্রহ্মান্ডের সেরা যুবতী, সেরা সুন্দরী, সেরা নর্তকী। এই মহা বিশ্ব মহা ব্রহ্মান্ডের কাছে নিজেকে যেন নিবেদন করছে নৃত্যের ভিতর দিয়ে। যেন তার সামনে আছে কেউ, তার প্রতিই অনুরাগে সে তার মুদ্রা রচনা করছে। সে ভালবাসা নিবেদন করছে। আর তখনই বাজল আড় বাঁশি। বাতাসে ভেসে ভেসে ঢেউ খেলে খেলে সেই বাঁশির শব্দ এগিয়ে আসতে লাগল নদীর দিকে। বংশীধর ঠাকুর বেরিয়েছেন পরিক্রমায়। সেই কুঞ্জবনের নৃত্যের ভঙ্গিমায় দেহখানি নুয়ে তাকিয়ে আছে চাঁদের দিকে। সেবার বসন্ত পূর্ণিমা পড়েছিল চৈত্রমাসে।
তারপর কী হয়েছিল দেবাংশু ? দেবাংশু থামলে জিজ্ঞেস করেছে বিল্বমঙ্গল।
দেবাংশু বলল, ঐ বাঁশির জন্য রাত জাগে বংশীধরপুরের মেয়েরা। তারা তখন বংশীধরের কাছে মনে মনে নিজেদের নিবেদন করে। বাঁশি যত এগিয়ে আসতে লাগল, সেই কুঞ্জবনের মেয়ে এক একবার মাথা তুলে দেখতে লাগল, কে বাজায়, ওগো শোনো কে বাজায়। সে এসে গেল। এসেই বাঁশিওয়ালা তার সমুখে দাঁড়াল। সে দুই হাতে পাঁচ পাঁচ দশ আঙুলে রচনা করতে লাগল নতুন মুদ্রা।
১২
দেবাংশুর কথা এখানেই থেমে গিয়েছিল। রাত হয়েছিল। তাকে ফিরতে হবে। এর পর অবশ্য কথা আর কতটা থাকতে পারে। বংশীধর ঠাকুরের কাছে নিজেদের নিবেদন করতে তো রাত জাগে সেই গ্রামের মেয়েরা। কুঞ্জবনের মেয়েও নিবেদিত হয়েছিল। ঠাকুর তাকে গ্রহণ করেছিলেন। দেবাংশু পরের দিন অফিস যায়নি। তার পরের দিন দেখা হয়েছিল বিল্বর সঙ্গে। বিল্ব কিছু বলেনি। জিজ্ঞেস করেনি। কতকাল আগের কথা, কী হবে আর জিজ্ঞেস করে। যা হবার তাই হয়েছিল। দেবাংশু তিন দিন বাদে বলেছিল, সে ছিল সেই মাধব দঁডপাট। তারা সেই বালির চরে, চাঁদের আলোয়, সেই নির্জনতায় মিথুন মূর্তি হয়ে গিয়েছিল। কী অদ্ভূত ভঙ্গিমায় তাকে নিজের কাছে টেনেছিল মাধব। দেবাংশুর দুঃখ আর কান্না সব ঢাকা পড়ে গিয়েছিল বিপুল বিস্ময়ে। সে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারেনি। এখনো বিশ্বাস হয় না। যা দেখেছিল তা কি সত্য ? তারা আগে ফিরে গিয়েছিল। সে সমস্ত রাত জেগে বসেছিল নদীর তীরে। বালিতে কোনও চিহ্ন ছিল না। হুটপুটির সব দাগ বাতাস এসে মুছে দিয়েছিল।
পরদিন সে তার মুখোমুখি হতে চায়নি, কিন্তু সে এসেছিল। সে বারবার বলেছিল, সামারে যেন অংশুদা যায় কুঞ্জবনে।
মাধব দন্ডপাট আসেনি আর। তারা যে যার বাড়ি ফিরে এসেছিল পর দিন। তার আগে সেই মেয়েকে সে জিজ্ঞেস করেছিল সে আগের রাতে বংশীধর ঠাকুরের বাঁশি শুনেছিল কিনা।
অভিমানিনী বলেছিল, না শোনেনি তো। এক ঘুমে রাত পার। তখন চুপ করে গিয়েছিল দেবাংশু। তাহলে কি সে যা দেখেছিল সব স্বপ্ন। ভোর রাতে ফিরে এসেছিল ঘরে। সে যদি সত্য না দেখে থাকে তাহলে নদীর ধারে বসে কাঁদবে কেন ? খুব কেঁদেছিল। সে যদি না দেখে থাকবে তাহলে তার স্খলন হয়ে যাবে কেন সেই অপার্থিব সঙ্গম দৃশ্যে ? তারা সম্পূর্ণ অনাবৃত করেছিল একে অপরকে। সেই মহাব্রহ্মান্ডের নীচে তা ছিল খুব স্বাভাবিক। কিন্তু দেবাংশুর যে স্খলন হয়ে গিয়েছিল। স্খলনের চিহ্ন তার পায়জামায় ছিল, ভোরে এসে তা জলে ভিজিয়ে দিয়েছিল দেবাংশু।
দেবাংশুর এখন যেন মনে হয় সবটাই ছিল দুঃস্বপ্ন। আসলে তেমন কিছুই যেন ঘটেনি। থাক বিল্বদা, থাক। আর বলব না। বলবে না দেবাংশু, কিন্তু বিল্ব তো জেনে নিতে চায় অন্য আর এক কথা। বিল্ব জানে দেবাংশুর জীবনে যা ঘটেছিল তা ওর জীবনেই ঘটতে পারে। তার একটা গ্রাম আছে। তার পিসিদের একটা গ্রাম আছে। দেবাংশুর একটা নদী আছে। ভরা পূর্ণিমা আছে। নদীর গগনে চাঁদ আছে। তার এসব কিছুই নেই। সে ঐ বয়সে নদীর চরায় বসে কাঁদেনি কখনো।
ইলিনা এ সব শোনেনি। ইলিনা বলে, দেবাংশু আমার মনে হচ্ছে অখিল ন’পাহাড়িতে আসতে পারে। থাকতে পারে। আমাকে একবার ন’পাহাড়ি যেতে হবে।
কোথায় থাকবে ইলিনাদি, তোমাদের না কিছু নেই।
বিহারিনাথ পাহাড়ের কোলে গেস্ট হাউজ হয়েছে শুনেছি, আমি যাব দেবাংশু, কিন্তু মেয়েরা যেতে দেবে না, দুজনেই না বলছে, তুমি যদি গিয়ে একটু বোঝাতে পারো।
দেবাংশু বলল, ওক্কে ইলিনাদি, সানডেতে যাই।
এস তাই, সকালে এস তুমি আর বিল্বদা।
বিল্ব বলল, না আমি পারব না, আমার বাড়িতে কেউ একজন আসবে।
কে আসবে ? ইলিনা জিজ্ঞেস করে, বলে, মালবিকাদিকে নিয়েই আসুন।
বিল্ব মাথা নাড়ে। তখন দেবাংশু বলে, তাহলে স্যাটার ডেতে চলো বিল্বদা।
বিল্ব বলে, ইনা আর লিনা, দুজনেই আমাকে রিফিউজ করেছে, আমি এই ব্যাপারে আর যাব না।
ইস, অইটুকু-টুকু মেয়ে, তারা রিফিউজ করেছে, এমন তুমি বলো না বিল্বদা।
এ তুমি বুঝবে না, ফেসবুকের বন্ধুতা প্রার্থনা করেছিলাম। না করেছিল ইনা আর লিনাকে কতবার জিজ্ঞেস করলাম বাবার সম্পর্কে কী জান বল, সে কিছুই বলল না। অস্বীকার করবে তো তোমাকে বলল কেন যে অখিল আছে বিপযর্য়ের ভিতর।
ও জানে না।
আমার বিশ্বাস হয় না। বিল্ব বলল।
জানলে আমাকে বলত।
বিল্ব বলল, না, বলবে না, যে কারণে ইনা বলবে না, তার বিপরীত কারণে লিনা বলবে না।
ইলিনা কথা বলল না। এরপর আর কথা হল না। পরদিন ইলিনা এলনা। দেবাংশু এক সময় জিজ্ঞেস করে, তোমার কথাটা আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবে বিল্বদা, লিনা কেন বলবে না।
বিল্ব বলল, ইনা ভালবাসে তার বাবাকে। বাবাকে ভালবাসে বলে বাবার কথা মাকে জানতে দেবে না। সে মনে করে বাবা যে তাদের ছেড়ে অজ্ঞাতবাসে আছে, তার কারণ তাদের মা। মা তাদের বাবাকে ত্যাগ করেছে বলেই বাবা তাদের ছেড়ে গিয়েছিল।
দেবাংশু বলল, এ কথা কি তোমাকে বলেছে ইনা ?
না বলবে কেন, আমার মনে হয়েছে তেমন।
দেবাংশু বলে, মনে হওয়া দিয়ে কিছু বলা যায় ?
বিল্ব উত্তর দিল না। বিল্ব ফেসবুক দেখেছে ইনার। মনে হয় তার বন্ধুরা সবাই অল্প বয়সী। তাদের সব অদ্ভূত নাম। জোজো জোজা কামিনে। এই নামের মানে কী ? তার বন্ধু একজনের নাম পাগলা দাসু। একজন গুঙ্গা ভাই তুঙ্গা। তারা সবাই আত্মগোপন করে ফেলেছে ওই সব নামের আড়ালে। ইনার ওয়ালে বিচিত্র সব কথা লিখে রেখে গেছে। যেমন জোজো লিখেছে, সে বাই সেক্সুয়াল। সে নিজেই স্বামী নিজেই স্ত্রী। ফলে স্ত্রী তাকে তাড়িয়ে দিতে পারবে না। স্ত্রী খারাপ ব্যবহার করতে পারবে না। আবার স্বামীও মনের দুঃখে অজ্ঞাতবাসে যেতে পারবে না। ঐ জোজো মনে হয় ইনা নিজে। ইনার ফেক-আই, ডি। ফেস-বুকে এমন হয়। একজনের দুটো তিনটে আই,ডি আছে। কম বয়সীরা এটা করে আর করে মধ্য বয়স পার করা পুরুষ। মধ্যবয়সীরা অল্প বয়সী সেজে কম বয়সীদের ভিতর ঢুকে পড়ে। বিল্ব সেদিন সরাসরি ইনার কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েও একটি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে বসে আছে। রিজেক্টেড হয় নি, আবার অ্যাক্সেপ্টেডও হয় নি। সে আশা করছে ইনা তার ফেসবুকের বন্ধু হবে। তখন তাকে একটু একটু করে যদি নরম করে দেওয়া যায়। আর সেই যে ইলিনা বলল, ইনার নেই নেই করে পনেরজন এজেড ফ্রেন্ড আছে, অভিনেতা, হিন্দি লেখক, তাহলে সে হতে পারবে না কেন ? ইনার ফ্রেন্ড লিস্ট ব্লকড, বন্ধু না হয়ে তা দেখার উপায় নেই।
বিল্ব গেল না শনিবার। দেবাংশু গেল। ইলিনা তাকে বারবার অনুরোধ করছিল। না গিয়ে তার উপায় ছিল না। দেবাংশু পৌঁছতে ইনা লিনা দুই বোন সহাস্যে তাকে অভ্যর্থনা জানাল। দুজনেই বড় হয়ে উঠেছে। দুজনেই সুন্দর হয়ে উঠেছে। দুজনের ভিতরই ভরে উঠছে এখন। বসন্তে যেমন গাছ ভরে ওঠে ফুলে পাতায়, তেমনি। ঝলমলে। তারা দুজনেই বলল, আঙ্কেল তোমার জন্য সারাদিন ওয়েট করছি, তুমি বলেছিলে লাঞ্চ করবে, বাট ইউ ডিডন্ট, হোয়াই ?
দেবাংশু হকচকিয়ে গেল। সে ভেবেছিল দুটি মেয়েই খুব গম্ভীর। তারা তাকে দূর থেকে দেখবে। সামনে আসবে না। কথাই বলবে না। ইনা মানে ছোটমেয়েটা বললেও, বড় লিনা বলবে না। কিন্তু তা হল না। দেবাংশুর মনে হলো দুজনেই বুদ্ধিমতী। দুজনেই আন্দাজ করেছে কেন আসছে মায়ের কলিগ। তারা মুখে কুলুপ এঁটে থাকলে বরং লোকটির ধারণা করতে সুবিধে হবে। দেবাংশু যে দেরি করে বিকেলে এল, তাতে তারা হতাশ হয়েছে। ইলিনা বলল, আসলে আমাদের বাড়ি বিশেষ কেউ আসে না দেবাংশু, আমার একটা বদনাম আছে আমাদের আত্মীয় স্বজনের ভিতর, আমি নাকি তাড়িয়েছি অখিলেশকে, দে বিলিভ ইট। এমন কী আমার বোন সেলিনা সেই কথা শুনিয়েছে আমার বড় মেয়েকে, শুনিয়ে শুনিয়ে আমার উপর ওকে বিদ্বিষ্ট করেছে। সমাজটা খুব ভাল নয় দেবাংশু।
দেবাংশু বলে, এ কথা তো আগে বলনি ইলিনাদি।
ইলিনা বলল, সব কথা কি বলার ?
ইলিনার সঙ্গে চা নিয়ে যখন কথা বলছে, জানালার বাইরের পৃথিবীতে তখনো আল আছে। দিনভর খুব উত্তাপ গেছে, এখন জগত ঠান্ডা হতে লেগেছে একা একা এক নিবিড় নিঃঝুমতায় যেন। দুই বোন ওঘরে। ইলিনা বলল, আসলে আমি ওর চেয়ে সুন্দরী, মেধাবী, চাকরি করি আমি অনেক মাইনের, স্বাধীন, তাই ছোট থেকেই ওর ঈর্ষা।
বোনে বোনে এমন হয় ?
হয়, আমি চাকরি করি, ও করে না, তাই ওর ঈর্ষা, আমি দুই মেয়ে নিয়ে একা থাকি, তার জন্য ওর ঈর্ষা, ওর হাজব্যান্ড আর একটি জায়গায় রিলেটেড, ও মনে মনে একা হয়ে যেতে চায়, সিঙ্গল মাদার হতে চায় আমার মতো, কিন্তু উপায় নেই, তাই মনে হয় ইনাকে ও-ই বিষিয়ে দেয়, ওদের ফোনে যোগাযোগ আছে। যাকগে, আমি ওদের ডাকছি, তুমি কথা বলো দেবাংশু, ওরা তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। বলতে বলতে ইলিনা উঠল। আর সে উঠতেই দুই বোনের কল-কাকলি শোনা গেল। দুটি পাখি যেন কিচ কিচ কিচ করতে করতে ঢুকে পড়ছে ভিতরে।
১৩
ইনা পরেছে জিন্স আর পাঞ্জাবি, লিনা পরেছে ব্ল্যাক শার্ট আর লাল টুকটুকে পায়জামা। দুজনের চুলে পনি টেল। ইনা সামনের সোফায় বসতে বসতে বলল, আঙ্কেল আমরা তোমার গ্রামের কথা শুনব, ইওর নেটিভ ভিলেজ, ইওর রিভার।
সে তোমাদের ভাল লাগবে না।
লিনা বলল, কী করে বুঝলে, আমরা কি বড় হই নি ?
এইচ এস দিলে কি বড় হয়ে যায় ?
অফ কোর্স যায়। লিনা খিলখিল করে হাসে আর কত বড় হলে আমরা বড় হব আঙ্কেল।
ইনা বলল, নাদের আলি, আমি আর কত বড় হবো ? আমার মাথা এই ঘরের ছাদ
ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায় তিন প্রহরের বিল দেখাবে ?
বাহ! দেবাংশু বলে, তুমি কবিতা পড় ?
পড়ি আঙ্কেল, আমাদের তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে চলো।
দেবাংশু বলে, আমি কি নাদের আলি ?
ইনা বলল, ইয়া, তুমি নাদের আলি তুমি কথা দিয়েছিলে।
এই ভাবে কথা আরম্ভ হল। ইনা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায় পড়ে, জয় গোস্বামী পড়ে। জীবনানন্দ দাস ওর প্রিয় কবি, বলল, তোমার গ্রাম খুব সুন্দর, মা বলে তোমার গ্রামের গল্প, আমরা সেই থেকে মাকে বলছি তোমাকে লাঞ্চে ডাকতে, আমরা বেশি টাইম পেতাম তখন, কিন্তু দেরি করে এসেছ যখন, তোমাকে ডিনার করে যেতে হবে আর তোমার গ্রামের গল্প বলতে হবে।
দেবাংশু বলে, আমার গ্রামের গল্প তোমাদের ভাল লাগবে না ইনা লিনা।
লাগবে লাগবে, প্লিইজ আঙ্কেল। লিনা বলল।
দেবাংশু বলে, এর চেয়ে ন’পাহাড়ির গল্প অনেক ভাল, দেয়ার আর নাইন হিলকস ফ্যান্টাসি।
তার মানে, কিসের ফ্যান্টাসি ?
নটি টিলা পাহাড়ের।
নো নাদের আলি নো, সেখানে কোনো মায়া নেই।
মায়া নেই! বিস্মিত হয় দেবাংশু, কী সুন্দর কথাটি বলল ইনা, সে তাকিয়ে থাকল।
জায়গাটা একটা খারাপ গঞ্জ, বিচ্ছিরি, ওখানে এখন হয়তো পাহাড়গুলো ভাঙা হচ্ছে, স্টোন ক্র্যাশার জান তুমি আঙ্কেল ?
পাথর ভাঙে, আই মিন ক্র্যাশ করে ?
ইনা বলল, তাই, বাতাসে খুব দূষণ, পাথরের ধুলো উড়ছে, জঙ্গল কেটে সাফ করে দিয়েছে, এখন একটা ঘোস্টদের দেশ হয়ে গেছে আঙ্কেল, প্রেতের দেশ।
কে বলল এই সব কথা ? দেবাংশু জিজ্ঞেস করে। দেবাংশুর মনে হচ্ছে ইনা তার কথার ফাঁদে পা দিয়েছে। বলছে ন’পাহাড়ি নিয়ে। কিন্তু ও বলছে কী করে ? তাহলে কারোর কাছে শুনেছে। কে সে ? ওদের বাবা অখিলেশ—অখিল শুনিয়েছে ? তাহলে ইলিনাদির সন্দেহ সত্য। সে বলল, তুমি কার কাছে শুনেছ ?
মাসি। বলে পায়ের পাতা দোলাতে লাগল ইনা। চেয়ে থাকল দেবাংশুর দিকে। দেবাংশু জিজ্ঞেস করে, তোমার মাসির নাম কি?
মায়ের বোন মাসি, দুধ কলা দিয়ে পুষি। বলে লিনা খিলখিল করে হাসতে থাকে। তার মানে ইলিনার বোন সেলিনার কথা বলছে। সেলিনার কথা যে তার পছন্দ হয়নি, তা প্রকারান্তরে বলে দিল লিনা, ইলিনার ছোট মেয়ে। এরা দুজনই তীক্ষ্ণধী। একে অন্যকে টক্কর দিতে পারে। এবং দিতে আরম্ভ করেছে। দেবাংশু জিজ্ঞেস করে, তোমার মাসি কি গিয়েছে ন’পাহাড়িকে।
গিয়েছে আবার যায় নি, মাসি ওই ন’পাহাড়ি দিয়ে কতবার গেছে এসেছে, মাসি ত জানবেই। বলল ইনা।
ন’পাহাড়ি দিয়ে কোথায় গিয়েছে ?
তা আমি জানি না, পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশনে মাসির ছেলে পড়ে, ওর নাম দিব্যজ্যোতি। বলল ইনা, সেই যাওয়ার পথে দেখে থাকবে হয়তো।
লিনা বলল, সে তো মাসি ট্রেনে যায়, ন’পাহাড়ি কি ট্রেনের পথে পড়ে ?
ইনা বলল, ট্রেনে যায় আর বাসে ফেরে, বাস ন’পাহাড়ি দিয়ে আসে।
বাস থেকে সব দেখা যায় ? লিনা বলে।
আন্দাজ করা যায় ইনা কথাটা জোর দিয়ে বলে।
না, ভুল করা যায়, বাস থেকে কী দেখা যায়, রাস্তার দুপাশে যেটুকু সেইটুকু, তার বেশি কিছু না। লিনা খুব যুক্তি দিয়ে বলল।
মোটেই না, ন’পাহাড়ির কী বদল হয়েছে তা ওইটুকু দেখলেই হবে। বলল ইনা, ওখানকার পাহাড় জঙ্গল সব লিজে নানা কোম্পানিকে দিয়ে দিয়েছে গভর্নমেন্ট। ইনা বলল, অনেকদিন হয়েছে এটা, গেলে তুমি খুব কষ্ট পাবে আঙ্কেল।
তোমার মাসি এটাও জানে ? দেবাংশু জিজ্ঞেস করে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না ইনার কথা। এতটা কি বাস থেকে জানা সম্ভব ?
উ ক্যান আস্ক ইট টু আওয়ার মাদার, মা জানে।
মা বিশ্বাস করেনি মাসির কথা। লিনা বলল, মাসি কী করে জানবে ? লিনা বলল।
দেবাংশু জিজ্ঞেস করে, মাসি কবে বলল ?
ইনা বলল, অনেকদিন বলেছে, আবার আজ সকালে বলল মাকে ফোন করে।
লিনা এবার আচমকা উঠে পড়ে, বলে, মাসি আগবাড়িয়ে বলতে গেল কেন, মা তো জিজ্ঞেস করে নি, আমি বিশ্বাস করছি না।
ইনা বলল, তুই উঠছিস কেন, এমনই হচ্ছে সবদিকে, ওড়িশার নিয়মগিরিতে কী হচ্ছে তুই জানিস ?
দেবাংশু অবাক। সেই ঘটনার কথা সে জানে। বিশাল পাহাড়শ্রেনী বিদেশি কোম্পানিকে লিজে দিয়ে দিয়েছে ওড়িশা সরকার, মাইকা বক্সাইট ওর এক্সট্রাক্ট করবে তারা, এ নিয়ে ট্রাইবালরা সরকারের বিরুদ্ধে চলে গেছে, তাদের দেবতার পাহাড় ওই নিয়মগিরি, তারা পাহাড় ফাটাতে দেবে না, মাও বাদি গেরিলারা এই ঘটনাকে তাদের আধিপত্য বিস্তারে কাজে লাগিয়েছে, তারা আদিবাসীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে রীতিমতো গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু ন’পাহাড়িতে তো তা হয় নি। তুলনা আসছে তবুও। ইনা বলছে, আঙ্কেল, তুমি যেতে যেতে দেখবে স্পঞ্জ আয়রন ফ্যাক্টরি হয়েছে দু কিলোমিটার অন্তর, ওই সুন্দর প্রকৃতিকে কীভাবে নষ্ট করেছে তা, গাছের পাতা পযর্ন্ত কালো হয়ে গেছে, পৃথিবীতে সুন্দর জায়গা আর থাকবে না।
দেবাংশু মুগ্ধ হলো ইনার কথায়। ইনা এইভাবে ভাবতে পারে তা তার ধারণাতেই ছিল না। তার মনে হচ্ছিল ইনার কথা অসত্য না হতেও পারে। বাঁকুড়ার স্পঞ্জ আয়রন ফ্যাক্টরি নিয়ে একটি বড় প্রতিবেদন পড়েছিল সে কোন এক ম্যাগাজিনে। টিভি রিপোর্ট দেখেছে এই বিষয়ে ন্যাশনাল চ্যানেলে। দেবাংশু জিজ্ঞেস করে, এতটা জানলে কী করে?
জেনেছি। ইনার সংক্ষিপ্ত জবাব।
আচমকা তার মনে হল ইনা কি তার মতো সেই রিপোর্ট দেখেছে পড়েছে ? নিয়মগিরি নিয়ে তো টিভিতে কত রিপোর্ট না হয়েছে। ইনা কি তার সঙ্গে ন’পাহাড়িকে মিলিয়ে দিয়েছে। মাসি বলে নি, সে বানিয়েছে। মনে হতেই দেবাংশু বলল, আর কী জেনেছ বলো।
ইনা বলল, এই রকম, পৃথিবীকে ধ্বংস করার ব্লু-প্রিন্ট অলরেডি তৈরি হয়ে গেছে, মাল্টি ন্যাশানালস আর কামিং টু ক্যাপচার দ্য সি, দ্য হিলস দ্য রিভারস দ্য ফরেস্টস, আঙ্কেল তুমিও পার পাবে না।
চমকে ওঠে দেবাংশু, কী বলছ ?
তোমার রিভার তোমার গ্রাম কিন্তু অন্যরকম হয়ে যাবে, বেটার তুমি আমাদের শুনিয়ে দাও তোমার নেটিভ ভিলেজের কথা, বালি চিকচিক সুবর্ণরেখা। ইনা বলল।
তোমাদের মা বলেছে আমার নদীর কথা ?
হাঁ আঙ্কেল, সে নদীর বালিতে নাকি সোনা পাওয়া যায়, সোনার কুচি ?
শুনেছি তাই, সেই ছোটনাগপুর মালভূমির কোন এক পাহাড়ে নাকি ওর জন্ম, সেখানে নাকি সোনার আকরিক মিশে আছে মাটিতে, পাথরে।
উফ, তুমি বলো আঙ্কেল তোমার সোনার নদীর কথা।
১৪
কী আশ্চর্য! দেবাংশু যে কারণে এসেছিল, মেয়েদুটির কাছ থেকে কথা বের করবে বলে, তা হলো না, সে কিনা তার নিজের গ্রাম নিজের নদীর কথা বলতে বসল। ইনা বলছে, বলে দাও আঙ্কেল, না বললে আর বলতে পারবে না, কিছুই থাকবে না।
লিনা খুব একমত নয় তার দিদির সঙ্গে, কিন্তু সে নিজেও শুনতে চায় দেবাংশুর গ্রামের কথা। তাদের মা ইলিনা প্রায়ই বলে দেবাংশু আঙ্কেলের গল্প। তারা কোনোদিন গ্রাম দ্যাখেনি। কী করে দেখবে ? তাদের বাবার যে নিজস্ব গ্রাম ছিল ন’পাহাড়ি সেখানে আর কেউ থাকে না। আর বাবাই তো হয় নিরুদ্দেশ না হয় আত্মগোপন করে আছে কোথাও। তারা ন’পাহাড়ি দ্যাখেনি কোনোদিন।
লিনা বলে, না আমরা দেখিনি, কিন্তু না দেখে আমরা ধরতে পারি জায়গাটা কেমন, ন’টি পাহাড় কেমন করে ঘিরে আছে জায়গাটিকে, ইন ফ্যাক্ট, ট্রেনে করে সেবার এম,পি, গেলাম, মনে হল ন’পাহাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছি।
কথাটা ধরে নিল দেবাংশু, বলল, তাহলে চল একবার দেখে আসি।
না আঙ্কেল, ওখানে আমাদের কিছুই নেই আমাদের বাবারই কোনো খোঁজ নেই, আমরা কোন মুখে যাব সেখানে, গিয়ে করবই বা কী ?
দেখে আসবে। দেবাংশু বলল।
লিনা মাথা নাড়ল, যেমন কল্পনা করেছি, তেমন হবে না নিশ্চয়, কল্পনা ভেঙে গেলে দুঃখ হবে।
তুমি যেমন ভেবেছ, তার চেয়ে সুন্দর হতে পারেও তো।
ইনা এই কথায় কথা বলছিল না, সে এবার অধৈর্য হয়ে ওঠে, লিভ ইট আঙ্কেল, লিভ ইট, তোমার নদীর গল্প আরম্ভ কর, এই বোন তুই থামবি ?
আমাদের নদী আছে দুটি। দেবাংশু আরম্ভ করে।
দুটি নদী, ওমা, আগে তো শুনিনি। ইনা বলে।
আগে কী শুনেছ ?
হাতিবাড়ির জঙ্গল, সুবর্ণরেখা নদী, প্রস্তরময় তার দুই তীর, জঙ্গলের মাথায় চাঁদ, বন মোরগ, খরগোস—এই সব। ইনা বলে।
লিনা বলে, আর তোমার পিসির বাড়ি, সেখানে দোল পূর্ণিমার উৎসব, জাগ্রত বংশীধর ঠাকুর…এই সব, আমাদের পিসি ছিল শুনেছি, দুজন তাঁরা পুরুলিয়ার কোন কোন গ্রামে থাকেন, আমরা আমাদের পিসিদের কোনোদিন দেখিনি। লিনা বলে। ইনা বলল, কিন্তু নদী তো একটা শুনেছি, মা তো দুটোর কথা বলে নি কোনোদিন।
দেবাংশু বলে, দুই পিসির বিয়ে হয়েছে দুই নদীর ধারে, বড় পিসির নদী সুবর্ণরেখা, আর ছোট পিসির নদী ডুলুং।
ডুলুং একটা নদী ! বিস্ময়ে উজ্জ্বল হয়ে যায় দুই বোনের মুখ, আমরা তো ডুলুং নদীর কথা শুনিনি আঙ্কেল, খুব বড় নদী হবে কি?
দেবাংশু বলে, না, ছোট নদী, ডুলুং বেশিদূর বয়েও যায়নি, কিছুটা বয়ে সুবর্ণরেখায় গিয়ে মিশেছে রোহিণী নামের এক গ্রামের কাছে।
রোহিনী একটা গ্রামের নাম ! লিনা অভিভূত হয়, আঙ্কেল তুমি কত ভাগ্যবান, তুমি কি তোমার ছোট পিসির গল্প শোনাবে ?
দেবাংশু এক অদ্ভূত মানুষ। সে তার গ্রামের কথা শোনাতে পারলে, তার স্বজন পরিজনের কথা শোনাতে পারলে, কেউ তার কাছে শুনতে চাইলে বর্তে যায়। সে কোন কাজে এসেছে তাও ভুলে যায়। আর দেবাংশু এটাও জানে, সে যদি ইনা লিনার খুব বন্ধু হয়ে উঠতে না পারে, তাহলে ইনা লিনাও বলবে না তাদের ভিতরে লুকিয়ে রাখা কথাগুলো। আগে তাকে আস্থা অর্জন করতে হবে দুই বোনের। তারপর তাদের কাছ থেকে বের করে আনতে হবে তাদের কথা। অখিলেশ দের কথা। আস্থা অর্জন করতে তাকে দুই বোনকে ডুলুং নদীর কথা শোনাতে হবে। সে ডুলুং নদীর কথা বলতে লাগল। আসলে ডুলুং নয়, সে তার ছোট পিসির গল্প শোনাতে লাগল। পিসির গ্রামের নাম কুসুমডি। কুসুমডি ডুলুং নদীর পাড়ে। ডুলুঙের জন্ম উত্তর-পশ্চিমে। কতটুকু তার পথ। কিন্তু এসেছে যেন নদীহীন পথের মানুষকে জল দিতে দিতে। উত্তর-পশ্চিমের দিকটা খুব অনার্দ্র, শুষ্ক, জল অপ্রতুল। কুয়ো কাটতে হয় জলের জন্য। অবশ্য কুয়ো আমাদেরও কাটতে হয়। জল সঞ্চিত থাকে মাটির অতলে। কিন্তু সেই জল তো বাতাস ঠান্ডা করতে পারে না। সে জন্য নদীর দরকার হয়। আমাদের সুবর্ণরেখা আমাদের বাঁচায়। ওদিকটা বাঁচায় ডুলুং। যেন ওদিকের মানুষকে শীতলতা দিতে ডুলুঙের জন্ম। ঐদিকে কানাইশোর পাহাড়, ঐদিকে ঘন বন, পাথুরে মাটি, কোথাও জলের তেমন উৎস ছিল না ডুলুং জন্মাবার আগে।
ডুলুং কবে জন্মেছে আঙ্কেল ? জিজ্ঞেস করল লিনা।
আমি কী করে জানব ? হাসল দেবাংশু, তারপর বলল, হয়তো তখন ওই বন-পাহাড়ের মানুষ আকাশের দেবতার কাছে প্রার্থনা জানিয়েছিল একটি নদীর জন্য। নদী মায়ের জন্য। সব নদীই মা।
ইনা বলল, খুব সুন্দর বললে, আমিও তাই বলি, লেকিন নদীও বাঁধা পড়ে যাচ্ছে আঙ্কেল, ডু ইউ নো ইট ?
দেবাংশু বলল, জানি।
মধ্যপ্রদেশে একটা নদীকে গভর্নমেন্ট লিজ দিয়ে দিয়েছে একটা কোম্পানির কাছে, তো নদীর অনেকটা অংশে, লম্বায় বিশ মাইল না পঁচিশ মাইল, এপার ওপার কোম্পানির পজেশনে, নদীর দুই ধারের মানুষ নদীর কাছে যেতে পারে না, কিন্তু নদী তো ওদের মা, দেবী, খুব গোলমাল লেগে গেছে, কোম্পানির বিরুদ্ধে মানুষ প্রতিদিন বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, কী সব হয়ে যাচ্ছে দিনদিন।
তুমি এসব কোথা থেকে জেনেছ ?
ইন্টারনেট থেকে। ইনা জবাব দিল।
দেবাংশু বলল, ডুলং এখনো ভাল আছে বলেই জানি, তেমন কিছু হলে জানা যেত, তবে এটা সত্যি নদী আর পাহাড়ে কর্পোরেটের নজর পড়েছে।
হ্যাঁ, তাই তো বলছি, এখনো হয়নি, কিন্তু হতে পারে তো, আঙ্কেল ডুলুঙের কথা বলো। লিনা বলে।
দেবাংশুর মনে হয় তাই ই হয়েছিল। সেই কোন দূর অতীতে বন-পাহাড়ের মানুষ কুয়ো খুঁড়তে খুঁড়তে জল না পেয়ে হতাশ হয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে লুটিয়ে পড়তে তাদের গাঁও বুড়ো, সব চেয়ে প্রাচীন মানুষটি একা একা আকাশের দেবতার কাছে জলের জন্য প্রার্থনা জানালে, মাটি ভেদ করে বেরিয়ে এসেছিল এক নদী। সারাদিন তারা কোদাল গাঁইতি মেরেই গেছে, পাথরে ঠং ঠং শব্দ হয়েছে, কিন্তু জল বেরোয় নি। জল এল পাতাল থেকে, আর সেই জল বন্ধ হল না। বেরিয়ে আসতেই লাগল। সেই জল বয়ে যেতে লাগল। নদী গেল নদীর সন্ধানে। যতদূর নদী না পায়, সে বয়েই যাবে। ডুলুং বয়ে গেছে নদীহীন প্রান্তর আর গ্রামের ভিতর দিয়ে। ডুলুঙের দুই তীরে জন্ম নিল নতুন নতুন গ্রাম। সেই গ্রামের একটি হল কুসুমডি। দেবাংশুর ছোট পিসির বিয়ে হয়েছে সেখানে। আর কুসুমডি ছাড়িয়ে কয়েক মাইল গিয়ে ডুলুং পেয়ে গেছে সুবর্ণরেখার সন্ধান। সে মিশে গিয়েছে বড় নদীর সঙ্গে। বড় নদীর কাছে এসে তার কাজ ফুরিয়েছে, তাই মিশে গেল। ডুলুঙের তীরে প্রহরাজ রাজাদের রাজবাড়ি, সেই গ্রামের পাশের গ্রাম কুসুমডি। সে নাকি এক পাগলের গ্রাম। সব ঘরেই এক একজন পাগল আছে।
তার মানে ? ইনা জিজ্ঞেস করল।
লোকে তো বলে তাই।
সেই গ্রামে তোমার পিসির বিয়ে হল কেন ?
দেবাংশু বলে, বিয়ে ওরা নিজেরা করেছে, মানে ছোট পিসি পড়ত ঝাড়্গ্রাম রাজ কলেজে, আর পিসে তার দু ইয়ার উপরে, ফার্স্ট ইয়ার আর থার্ড ইয়ার, আমার ছোট পিসে খুব রূপবান, তাকে দেখেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিল পিসি, জানত না কুসুমডির ঘরে ঘরে পাগল। দেবাংশু থামে। শ্বাস নেয়।
তারপর ? ইনা জিজ্ঞেস করে, থামলে কেন, বলো।
১৫
দেবাংশু যখন তার ছোট পিসির গল্প আরম্ভ করেছে তার দুই মেয়ের সঙ্গে, ইলিনা তখন ল্যাপটপ খুলে বসেছে। সে তার ফেসবুক খুলেছে বহুদিন বাদে। দেখল ওদিকে অন লাইনে বিল্বমঙ্গল। বিল্ব অবাক। এই সময় তো ইলিনার ফ্ল্যাটে দেবাংশুর থাকার কথা। দেবাংশু আছে, অথচ ইলিনা অন লাইন ! ইলিনা বলল, দেবাংশু ওর গ্রামের কথা বলছে আমার মেয়েদের, আমি কী করি, তুমি এলে ভাল হত।
বিল্বমঙ্গল বলল, না, তোমার মেয়েরা দেবাংশুর কাছে মুখ খুলবে, দেবাংশুর একটা গ্রাম একটা নদী আছে, বলার মতো গল্প আছে।
গল্প সবার আছে বিল্বদা, আলাদা আলাদা।
বিল্ব বলল, কলকাতার উপকন্ঠের কলোনি এলাকা, দরমার দেওয়াল, টালির চালা, গায়ে গা লাগানো ঘরবাড়ি, আমার যখন খুব ছোটবেলা, কলোনিতে আলো আসেনি, হেরিকেন জ্বলত ঘরে, মনে আছে একবার কেরোসিনের খুব আকাল, দিনের আলো থাকতে থাকতে সব কাজ সেরে নিতে হত মাকে। রাতে পড়া বন্ধ। এদিকে দিনমানে মিটিং মিছিল লেগেই থাকত। লাল পতাকার মিছিল, পুলিশের তাড়া, চালের দর পাঁচটাকা, দিনেও রুটি, মা বলত আবার বুঝি তেরশো পঞ্চাশ এল……।
ইলিনা বলে, আমি শুনেছি, ওই সময়েই আমার জন্ম।
দেখ ইলিনা, এই গল্প কি আসলে গল্প, এখানে উদার আকাশ নেই, নদী নেই, বংশীধর ঠাকুর নেই, আছে উদবাস্তু কলোনি, কিছু সব হারিয়ে আসা মানুষের কান্না, আমার ঠাকুমা কাঁদত, ফিরে যাবে ফিরে যাবে করত, হা হুতাশ করত সারাদিন, এই গল্প কি বলা যায়, শুনবে কে ?
ইলিনা বলল, তুমি কেন বলবে, তোমাকে বলতে বলেছে কে ?
দেবাংশুকেও আমরা বলতে বলিনি ইলিনা, কিন্তু সে বলছে, আর সে বলার পর আমরা তার কথায় মুগ্ধ হয়ে শুনতে চাইছি। বিল্বমঙ্গল বলে।
ইলিনা বলে, তোমার ঐ কথাও শুনবে কেউ না কেউ।
না ইলিনা, সেই যে উনিশশো পঁয়ষট্টি-ছেষট্টির খাদ্যের আকাল, আমার তখন বারো তেরো, আমাকে মা শোনাত তেরশো পঞ্চাশের মন্বন্তরের কথা, ফ্যান মেগে মেগে মানুষ ঘুরে বেড়াত গেরস্তের দুয়ারে দুয়ারে, শহরে গঞ্জে মানুষ মরে পড়ে থাকত, সে ছিল এক ভয়ানক দুর্ভিক্ষ, মা আমাকে সেই কথা স্মরণ করাত যেন, আমি যেন দেখতে পেতাম সব, মনে হত আমি যেন সেই দুর্ভিক্ষে মরেছিলাম কোনো এক গঞ্জে শহরে।
ইলিনা বলে ওঠে, বালাই ষাট, দুর্ভিক্ষের কথা বন্ধ করো তো, তুমি তখন জন্মাওনি।
বিল্ব বলল, এই সব কথা কি কেউ শুনবে ?
শোনাতে বলেছে কে ?
এ তো আমার ছোটবেলা।
মোটেই তোমার ছোটবেলা নয়, ছোটবেলাতে যত কষ্ট হোক, পরে তা মধুর লাগে বিল্বদা, বাদ দাও।
দেবাংশু এক আশ্চর্য শৈশব পেয়েছিল, এমন আমি পাইনি।
ইলিনা বলে, তুমি যা পেয়েছো, দেবাংশু তা পায়নি, দেবাংশু তো কলোনি দ্যাখেনি, দুঃখ কষ্ট ছিল না ওর শৈশবে।
চুপ করে থাকে বিল্বমঙ্গল। দুঃখ ছাড়া জীবন হয় ? বিল্ব জানে সেই ছোটবেলায় কলোনি মিছিল পুজোয় নতুন জামা কাপড়ের অভাব নতুন ক্লাসে নতুন বই-এর অভাব এই সব দুঃখ এখন সুখে পরিণত হয়েছে। ছোটবেলার দুঃখগুলো এমনি হয়ে যায়। কিন্তু একটা দুঃখ সে বড় হয়ে অর্জন করেছে, তার কোনো গ্রাম নেই তার কোনো নদী নেই, তার পিসির ননদের মেয়ের সঙ্গে ভালবাসা হয়নি কখনো। সে কখনো নদীর পাড় ধরে বাবার সঙ্গে হাঁটেনি। হেঁটে পার হয়নি নদী। জ্যোছনা রাতে নদীর বালিয়াড়িতে লুকিয়ে বংশীধর ঠাকুরের লীলা দ্যাখেনি। যে দেখেছে তার একটা শৈশব ছিল। তার কোনও শৈশব ছিল বলে মনে হয় না। কিন্তু এও সত্য এসবের জন্য কান্নাকাটির কোনো মানে হয় না।
ইলিনা বলে, দ্যাখো বিল্বদা, আমার কথাটা ভাব, আমার মন খুব উতলা হয়েছে অখিলের জন্য, আমি তাকে একবার দেখতে চাই।
তোমার মেয়েরা বোধ হয় দেখতে চায় না ? বিল্ব বলল।
মেয়েরা কী চায় তা আমি ধরতে পারি না, আর আমার বোন সেলিনাও কি চায় আমি বুঝি না, আমার মেয়েদের বিষিয়ে দিয়ে আমাকে কষ্ট পাইয়ে ওর লাভ কী ?
আমি একবার সেলিনার সঙ্গে কথা বলব, ওর ফোন নম্বর দেবে ?
দেব, কিন্তু ও যদি তোমাকে অপমান করে ?
সে আমি বুঝে নেব, ও কি ফেসবুকে আছে ?
আমি জানি না, তুমি ফোন করো, অ কি জানে কোথায় আছে অখিল, কেমন আছে অখিল, কী করছে অখিল।
ইলিনা তার পরের বোন সেলিনার নম্বর দিল বিল্বমঙ্গলকে। আর সেই নম্বর পেয়ে বিল্বমঙ্গল অফ লাইন হল। ইলিনাকে বলে গেল, সে তার বোনকে ফোন করবে এখনই। বিল্ব তা করলও। ফোনে বেজে চলেছিল শ্রাবনী সেনের গলায় এস শ্যামল সুন্দর……রবীন্দ্রনাথের গানের দুই চরণ।
ওপার থেকে ডাক এল, হ্যালো, কে বলছেন ?
আমার নাম বিল্বমঙ্গল চৌধুরী, আমি শ্রীমতী সেলিনা রায়ের সঙ্গে কি কথা বলছি ?
বলছেন, আমার দিদি আপনাকে নম্বরটা দিয়েছে ?
আপনি কী করে জানলেন ?
আপনি দিদির কলিগ বিল্বমঙ্গল তো ?
আপনি জানেন আমাকে ?
খুব জানি, আপনি কি জানতে চান, ন’পাহাড়ি নিয়ে না অখিলেশ দেকে নিয়ে ?
দুটোই জানতে চাই, আমার খুব দরকার।
সেলিনা রায় বলল, আপনার দরকার না দিদির দরকার ?
আমার।
খিলখিল করে হাসে সেলিনা রায়, আপনার কি দরকার বিল্ববাবু, সত্য গোপন করে কি লাভ, দিদি কেন আমার কাছে জানতে চায়নি ?
আমার অখিলেশকে দরকার। বিল্ব ঢোক গেলে।
পনের বছর নেই লোকটা, হঠাৎ তাকে কি দরকার ?
আপনি কি আমাকে জানাবেন কোনো সূত্র ?
সেলিনা হাসে আবার, আমি যে জানি এ খবর পেলেন কোন মন্ত্রে ?
বিল্ব বলল, আপনার দিদি ভেঙে পড়ছে ক্রমশ, আপনি কি জানেন কোনো খবর ?
সেলিনা বলে, সুন্দরী তো আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারত বিল্ববাবু।
বিল্বমঙ্গল চুপ করে থাকে। বুঝতে পারছে সেলিনা রায় তাকে লেজে খেলাচ্ছে। বলবে না বলছে না, আবার বলবে যে তাও বলছে না। আর কেনই বা বলবে তাকে। গোপন যখন রেখেছে, গোপনই রাখবে। সেলিনা বলছে, দিদির প্রেম এতদিন বাদে উথলে উঠল বিল্ববাবু, কী দরকার জেনে, ভালই তো আছে পাঁচটা পুরুষ লোক নিয়ে।
এসব আপনি কি বলছেন, পাঁচটা পুরুষ লোক মানে ?
সে যে বোঝার সে ভালই বুঝবে, দিদি জানে সব, ওসব হল দিদির ভান, নেকামি, মেয়েদের কাছে সাধু সাজা, সারাজীবন নষ্টামি করে গেল, অহঙ্কার ! রূপের অহঙ্কার ! দিদি কি ভেবেছে অখিলদা তার টাকার ভাগ ওকে দেবে ?
কিসের টাকা ? বিল্ব জিজ্ঞেস করে কথাটা ধরে নিয়ে।
চুপ করে থাকে সেলিনা। তারপর আচমকা তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিল্বমঙ্গল চুপ করে বসে থাকে। তার মনে হয় অখিলেশের সঙ্গে যোগাযোগ আছে সেলিনার। আছে আছে, না থাকলে অত দাপটের সঙ্গে কথা বলতে পারত না। আর টাকা ? অখিলেশ দয়ে কি অবসর নিল ? অবসর নিলে তো তার অনেক টাকা। সেই টাকায় কি ভাগ বসিয়েছে সেলিনা রায়। সেলিনার অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল। ইলিনার চেয়ে অনেক ভাল। সেলিনার স্বামী ব্যাঙ্কে বড় চাকরি করে। ম্যানেজার হয়ে গেছে এতদিনে। আর তার শ্বশুরবাড়ির অবস্থা ভাল। ইলিনার তো চাকরিটি ব্যতীত আর কিছুই নেই। খুব কষ্ট করছে দুই মেয়ে নিয়ে। তবু সেলিনার রাগ যায় না। দিদি শুধু রূপেই জিতে যাবে ? ঈর্ষায় তার ঘুম আসে না যেন। বিল্ব আবার যোগাযোগ করতে চাইল সেলিনার সঙ্গে। কিন্তু বিজি পেল একবার আর একবার নট রিচেবল। মোবাইল ফোন বড় অদ্ভূত। নানা রকম সিগনাল দেয়। বিল্ব ফোন হাতে করে বসে থাকল। সেলিনাকে সে আবার ফোন করবে। অখিল কবে অবসরে গেল, এখন কোথায় আছে ? যা শুনেছিল তাকি সত্যি? একটি ভূটিয়া কন্যাকে বিয়ে করেছিল অখিল ? সেই বউ কোথায় ?
১৬
দেবাংশুর দিকে ইনা আর লিনা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। দেবাংশু বলেছে ডুলুং নদীর জন্ম কথা। তারপর বলেছে ডুলুং নদীর তীরে একটি গ্রামে প্রহরাজ রাজাদের প্রাসাদের কথা। সেই বাড়ি এখন নিঃঝুম হয়ে পড়ে থাকে। রাজবংশের কে কোথায় কে জানে ? ছোট পিসির গ্রাম কুসুমডি সেই প্রহরাজ রাজার গ্রামের গায়ে গায়ে। সেই গ্রামের সব ঘরে এক একজন পাগল।
ইনা বলল, কেন গো, পাগল কেন ?
দেবাংশু বলে ডুলুঙের হাওয়া।
হাওয়া, কী হাওয়া ? লিনা জিজ্ঞেস করল।
কী হাওয়া তা আমি বলব কী করে ? দেবাংশু হাসে, ছোট পিসি জেনে শুনেও ওই কুসুমডির ছেলেকে বিয়ে করল, ঠাকমা খুব কেঁদেছিল, বলেছিল কুসুমডি যাওয়ার আগে আমার মেয়েটা পাগল হলো গো, না হলে ওই গাঁয়ে বিয়ে করে!
তারপর ? লিনা জিজ্ঞেস করল।
ইনা বলল, ছোট পিসি কি পাগল হয়ে গেল আঙ্কেল ? ইনা বিষণ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করে।
না, তা কেন হবে, আবার হতেও পারে, কুসুমডির কে পাগল কে পাগল নয় তা ধরা যায় না, যারা বোঝে তারা বোঝে। দেবাংশু বোঝাতে চায় এই ভাবে।
বুঝতে না পারলে সে যে পাগল তা বলবে কেন ?
দেবাংশু বলে, ডুলুং তো ছোট নদী, ডুলুং জন্মেছিল যে পথে নদী নেই, সে পথে বয়ে যাওয়ার জন্য, সেই পথে নির্মল বাতাস নীয়ে নিয়ে ঘোরার জন্য।
বুঝলাম না আঙ্কেল।
ডুলুঙের বাতাস বন থেকে নদীর প্রবাহে প্রবাহে আসা, সেই বাতাস গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় আনন্দে মাতাল হয়, কী তার ঝাপট তখন, কী তার ঢেউ, সেই বাতাসে কোনো কোনো মানুষের মন এলোমেলো হয়। দেবাংশু বলতে বলতে থামে। ইনা বলে, ওহ আঙ্কেল, আই কান্ট আন্ডারস্ট্যান্ড, এত হিজিবিজি কথা বলছ তুমি।
লিনা বলে, আমি তো বুঝতে পারছি দিদি।
নো নো, তুইও বুঝতে পারছিস না, এটা বোঝার কথা নয়, কী বুঝলি বল।
দেবাংশু বলে, ওক্কে, আমি প্রাঞ্জল করে বলছি, ওই হাওয়ায় পাগলামির বীজ আছে, সন্ধে বেলায় গায়ে লাগলে কেউ কেউ সারারাত সারাদিন জেগে থাকে খাতা কলম নিয়ে, ওই গ্রামে সমস্ত ঘরে একজন না একজন কবি।
ইনা বলল, এক্সপ্লেন ইট, কবি মানে কি পাগল ?
না না, তা কেন হবে। দেবাংশু বলে।
তুমি তো তাই বলছ আঙ্কেল, ওই গ্রামের সব ঘরে একজন করে পাগল, সব ঘরে একজন করে কবি। ইনা বেশ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে, ডুলুঙের হাওয়া গায়ে লাগলে কবিতা লিখতে বসে, এসব কী কথা ?
দেবাংশু বলল, আমার কথা তো শেষ হয়নি ইনা।
লিনা বলল, তুমি শেষ করো আঙ্কেল।
দেবাংশু দেখল ইনা খুব গম্ভীর হয়ে গেছে। সে বলল, যে কবিতা লেখা হয়, তা আবার ডুলুঙের তীরে ছিঁড়ে ছিঁড়ে উড়িয়ে দেয় কবি পরদিনই, একে তুমি কী বলবে ইনা।
ইনা বলল, হতেই পারে, আমিও তো কত পাতা ছিঁড়ে ফেলি।
তুমি কবিতা লেখ ?
নো নো, আমি লিখি না, আমার বন্ধু সৌর লেখে, সৌরদীপ, সে বলে কতবার যে ছিড়ে ফেলতে হয়, পাতার পর পাতা ফেলে দিতে হয়, সে অবশ্য বানিয়ে বানিয়ে গল্প লেখে।
বাহ, সে কোথায় থাকে ? দেবাংশু জিজ্ঞেস করে।
যেখানে হয় থাকে, ইনফ্যাক্ট সৌরদীপ তার নাম নয়, এটা তার পেন নেম, তার আসল নাম অন্য।
লিনা অধৈয হয়ে বলল, আঙ্কেল তুমি ডুলুঙের গল্প কি আজ শেষ করতে পারবে না ?
দেবাংশু বলে, শেষ করছি, আমার ছোট পিসি কিন্তু সেখানে খুব সুখে আছে।
তাহলে পাগলের কথাটা রটনা। ইনা বলে।
হবে হয়তো, কিন্তু তাতে গ্রামের লোকের কোনো প্রতিবাদ নেই, তাদের গ্রাম থেকে বছর বছর মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিকে ১০০ জনের ভিতরে ২জন থাকবেই, কিন্তু গ্রামের নাম কুসুমডি কবিসভা।
লিনা জিজ্ঞেস করে, সেখানে কী হয়েছিল ?
কী হবে, কিছুই না, আমার পিসের ভাই সারাজীবন ধরে একটা মহাকাব্য লিখছে সেই কবিসভা কুসুমডিতে বসে।
মহাকাব্য ! ইনা বিস্মিত হয়।
হ্যাঁ মহাকাব্য।
কী করেন তিনি ?
মহাকাব্য লেখেন।
চাকরিবাকরি ?
দেবাংশু মাথা নাড়ে, বলে, ওইটাই তাঁর কাজ, গ্রামের লোক সেই জন্য খুব গর্ব্বিত সেই প্রাবৃট মহাপাত্রকে নিয়ে।
কী সুন্দর নাম ! ইনা বলে ওঠে, প্রাবৃট মানে তো মেঘ।
দেবাংশু বলে, তাঁর স্ত্রী চলে গেছে ছেলে নিয়ে, তিনি সারাদিন যা লেখেন, সন্ধে বেলায় তা পড়ে শোনান গাঁয়ের লোককে কবি সভায়।
কবি সভা ?
দেবাংশু বলে, ওই গাঁয়ে একটা মজলিশ আছে, তার নাম কবিসভা, আবার ঐ গাঁয়ের একটা ডাক নাম আছে, সেও কবিসভা।
গাঁয়ের ডাক নাম হয় ? লিনা বলে ওঠে, আঙ্কেল তুমি যা বলছ তা সত্যি ?
আবার সেই কথা, তাহলে আমি কথা বন্ধ করি। দেবাংশু বলে।
নো আঙ্কেল, তুমি বলো। ইনা বলল, খুব ইন্টারেস্টিং।
দেবাংশু বলে, গাঁয়ের লোকের খুব গর্ব প্রাবৃটকে নিয়ে, তারা দশ বছর ধরে অপেক্ষা করছে মহাকাব্য শেষের জন্য, দরকারে আরো দশ বিশ বছর ওয়েট করবে।
উফ, তুমি কী বলছ এসব, তোমার পিসির দেওর সে ? ইনা জিজ্ঞেস করে।
না, ভাসুর, পিসে মশায়ের দু বছরের বড়।
কবে থেকে লিখছে। তা ওঁর যখন বয়স বাইশ।
তার মানে আমার এজ থেকে, আয়াম টুয়েন্টি টু নাউ।
হ্যাঁ, তাই হবে, আমার পিসির যখন বিয়ে হয়, তখন তিনি মহাকাব্য লিখতে বসে গেছেন, বলেন মহাকাব্যে তাঁর প্রাণ ভোমরা।
হোয়াট ডাজ ইট মিন, এর মানে কি আঙ্কেল ?
যেদিন মহাকাব্য শেষ হবে, সেদিন তিনি আর থাকবেন না। বলে দেবাংশু অনুমতি নেয় দুই বোনের কাছ থেকে, ক্যান আই স্মোক ?
ওহ, সিওর, আমি আস্ট্রে এনে দিচ্ছি। বলে লিনা উঠে যেতে ইনা বলে, আঙ্কেল তুমি বানাচ্ছ ?
না, সত্যি।
তুমি কী জানতে এসেছ, তা জানতে পারবে না, ইলিনা দে তোমাকে ফিট করেছে।
তোমার মা।
আই নো আঙ্কেল, কিন্তু আমার বাবা সারাজীবন কষ্ট পেল যে মায়ের জন্য, স্টিল হি ইজ সাফারিং।
তুমি ভুল ভাবতে পারো। দেবাংশু বলে।
তুমিও তো ভুল জানতে পারো, বাবা অনেক টাকা নিয়ে এসেছে, মা তার শেয়ার নেবে, ফর হুইচ সি ইজ ট্রাইয়িং টু কানেক্ট হিম অ্যাট দিজ ফ্যাগ এন্ড অফ লাইফ।
ইনার কথায় চমকে গেল দেবাংশু, বলল, কোথায় এসেছে ?
তা বলব না।
তিনি ভাল আছেন ?
না নেই।
দেবাংশু বলল, তুমি তো তোমার মাকে জানিয়ে দিয়েছ তা।
হ্যাঁ, মা জানুক একটা লোক সারাজীবন একা থেকে এখন একা একা মরে যাবে।
ইনা, তুমি এসব কী বলছ !
যা বলছি ঠিক বলছি, আমি বুঝতে পারছি আঙ্কেল তুমি বানাচ্ছো, কিন্তু কতদূর তুমি বানাবে, সেই জন্য আমি বললাম আমার বাবার কথা আমি কিছু বলব না, তুমি আমাদের খুসি করার জন্য ওই গল্প আরম্ভ করেছ।
দেবাংশু বলল, না, গল্প নয় সত্যি।
সত্যি, হতে পারে ?
হ্যাঁ, ওই গ্রামকে সবাই কবিসভা বলে চেনে, আর যারা ঈর্ষা করে তারা বলে পাগলা কুসুমডি, কুসুমডি হলো সেটেলমেন্ট রেকর্ডের মৌজা নাম।
তখন লিনা ঢোকে আস্ট্রে নিয়ে। বলল, কী সুন্দর গল্পই না করতে পার তুমি আঙ্কেল, আবার চা চাই, মা জিজ্ঞেস করছে।
ইলিনাদি কী করছে ?
মা নেট সারচ করছে, ন’পাহাড়ি খুজছে গুগুল ম্যাপে, বলল, ন’পাহাড়ি নাকি সাতটা আছে।
চা করবে কে ?
লিনা বলল, আমি করছি আঙ্কেল, কত আর সময় লাগবে, বস, দিদির সঙ্গে গল্প করো, কিন্তু কবিসভার গল্প না।
১৭
লিনা যেন সুযোগ করে দিয়ে গেল। ইনা বলল, আগেরদিনে একটা প্রফেশন ছিল, গল্প বলা, ডু ইউ নো ইট ?
জানি, পেশোয়ারে কাহানি–কিসসা বলার জন্য একদল মানুষই ছিল, তারা গল্পের ঝুলি নিয়ে বসত গল্পের বাজারে, সেই বাজারকে বলত কিসসাখানি বাজার, কিসসাকাহানি থেকে কিসসাখানি। দেবাংশু বলে, তারা ছিল কথক, আমাদের দেশেও ছিল, তারা রামায়ন মহাভারত পুরাণের গল্প শোনাত গাঁয়ের মানুষকে।
ইনা বলল, তুমি যেন কিসসা কাহানির ঝুলি নিয়ে বসেছ আঙ্কেল, কিন্তু তার জন্য মনে করো না আমি কিছু শোনাব তোমাকে।
কেন বলবে না ?
বলবই বা কেন, এতদিন কোনো খোঁজ হয়নি বাবার।
তোমার বাবা উত্তরবঙ্গে গিয়ে আর একটা বিয়ে করেছিল, তুমি জান তা ?
বাবা করবে কি, বাবা একা, একবার খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে, সেই মহিলা বাবাকে সেবা করে বাঁচিয়ে তোলে, স্টোরি এইটা।
হ্যাকনিড স্টোরি, এই গল্প অনেক হয়েছে, অখিল একটা কাজের মেয়ে নিয়ে আলাদা বেহালায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিল, জান তা ?
মিথ্যে গল্প আঙ্কেল, বাবা নর্থবেঙ্গলে ট্রান্সফার হয়ে যায়, মা যেতে চায় না, কাহিনি এইটা, আমাদের ভূটিয়া মা আছে কালচিনিতে।
অখিল কালচিনি থাকে ?
গিয়ে দ্যাখো থাকে কিনা, আছে কিনা।
সে কোথায় ? দেবাংশু জিজ্ঞেস করে।
আমি তো বলব না বলেছি।
তুমি এই সব কথা কোথায় শুনলে ?
বলব না। তীক্ষ্ণ গলায় জবাব দিল ইনা।
তোমাকে এই সব কথা কে বলেছে ?
আমি জানি।
তুমি কী করে জান ?
আমি বলব না বললাম তো। ইনা চাপা গলায় বলল।
তুমি তোমার মাকে ভালবাস না ? দেবাংশু জিজ্ঞেস করে।
ভালবাসার ব্যাপার নয় আঙ্কেল, একটা লোক সারাজীবন কষ্ট করল, কষ্ট পেল, আমি তার কথা ভাবছি মাত্র। ইনার গলার স্বর আচমকা কোমল হয়ে গেল।
কষ্ট কি তোমার মা করেনি ? দেবাংশু বলে।
আমি বাবারটা ফিল করি আঙ্কেল, হি ইজ আ ডেজেরটেড পারসন, মরুভূমিতে একা। ইনা ধীরে ধীরে বলল।
সে তো তোমার মাও একা।
আমরা আছি তো।
তোমার বাবাও তো আবার বিয়ে করেছে শোনা যায়। দেবাংশু বলে।
ইনা চুপ করে থাকে। দেবাংশু বলে, তোমাদের ফেলে গেল, সেই কাজটা কি ভাল হয়েছিল ?
ইনা বলল, বাধ্য হয়েছিল।
তুমি কি ভাল করে জান বাধ্য হয়েছিল না নিজের ইচ্ছেয় চলে গিয়েছিল ? দেবাংশু জিজ্ঞেস করে।
ইনা চুপ করে থাকে। দেবাংশু বুঝতে চেষ্টা করে মেয়েটিকে। ও কি ওর নিজের কথা বলছে ? নাকি শেখান কথা বলছে ? কেউ ওকে বলে দিয়েছে যা, তা বলছে। ইনা ভাল করেই জানে, দেবাংশুকে বলা কথা তার মায়ের কাছে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবু সে বলছে। ওকি ওর মাকে ঘৃণা করে ? কেন? দেবাংশুর মন খারাপ হয়ে গেল। ইলিনাদি খুব ভাল, ইলিনাদির সম্পর্কে কোনো খারাপ কথা কেউ বলেনি। ইলিনাদি খুব স্নেহময়ী। কিন্তু এমন ভাগ্য ! ইলিনাদির কোনো দরকার নেই অখিলেশ দের মতো একটা লম্পট আর দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের জন্য উদ্বেগে কাটানো। এখন যে মনে হচ্ছে কিছুই হয়নি অখিলেশ দের। শুধু ইলিনাদির ঘুম কেড়ে নেওয়ার জন্য কথাগুলো ওর বোনের বানানো। ইলিনাদির বোন সেলিনা বিষিয়ে দিয়েছে ইনাকে। কী ভীষণ একটা ঘটনা। দেবাংশু বলল, তুমি একদম ভুল জান, যা জান তা মিথ্যা।
আমি জানতাম আঙ্কেল তুমি এই কথা বলতেই এসেছ, তুমিও তো ভুল জানতে পার, আমার মা তোমাকে ভুল কথা শিখিয়ে এনেছে।
দেবাংশু বলল, তুমি নিজের মতো করে ভাব ইনা, বড় হয়েছ, তোমাকেই ভাবতে হবে, বিচার করতে হবে, বল, কালচিনিতে আছে তোমার বাবা।
খোঁজ নিয়ে দ্যাখো। ইনা নিস্পৃহ গলায় বলল।
ন’পাহাড়িতে আছে ? দেবাংশু যেন আচমকা কথাটা ছুঁড়ে দিল। জবাব পায় না। সেই সময় লিনা ট্রেতে চাপিয়ে তিন কাপ চা নিয়ে এল, বলল, ওই গল্প আর বলোনি তো আঙ্কেল ?
না। অন্যমনস্ক জবাব দেয় দেবাংশু। আসলে সে চঞ্চল হয়ে উঠেছে ইনার কথা শুনে। মেয়েটার ভিতর বিষিয়ে দিয়েছে ইলিনাদির বোন কিংবা অখিলেশ নিজে ? সে চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করে, তোমাদের মাসি কোথায় থাকে ?
কেন ? ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে ইনা, তারপর বলে, চন্দননগর, কিন্তু মাসি কী জানে, কিছুই না।
তুমি মাসির বাড়ি যাও ? দেবাংশু জিজ্ঞেস করে।
মা যায় না তো আমরা যাব কী করে ? ইনা বলে
তখন লিনা বলল, আমার যাওয়া হয় না, কিন্তু তুই তো যাস দিদি।
ইনা মাথা নাড়ে, সে কি আর যাওয়া, আমি না বলে কলেজ থেকে তিনবার গেছি, আমার এক ক্লাস মেট চন্দননগরে থাকে, তার সঙ্গে গেছি, কিন্তু মা ফোন করে করে অতিষ্ঠ করে দেয়, রাতে থাকতে দিতে চায় না, মাসি বললেও না।
লিনা বলে, মা যে তোকে আমার চেয়েও ভালবাসে, তোকে না দেখে থাকতে পারে না।
ইনা বলে, এ সব কথার কোনো মানে নেই, আমি তো মাসির বাড়ি গেছি।
লিনা মাথা নাড়ে, তুমি তো সেই কবির সঙ্গে গেছ দিদি, মা ভয় পায়।
কিসের ভয়, আমি কি কচি খুকি ? হিস হিস করে ওঠে ইনা।
দিদি, মা ভয় পায় আমরাও যদি হারিয়ে যাই, সেই জন্য চোখের আড়ালে যেতে দিতে চায় না।
আমরা হারাব কেন ?
দিদি তুই কি মায়ের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছিস না, মায়ের কোনো দুঃখ বুঝিস ?
ইনা ফোঁস করে ওঠে, তুই বোঝ না, তুই বোঝ মায়ের দুঃখ ?
দেবাংশু বলল, এ কি কথা বলছ তোমরা, আমি কি উঠে যাব ?
নো আঙ্কেল, আমাদের দুই বোনে এমন হয়। বলতে বলতে লিনাকে জড়িয়ে ধরে ইনা। বলে, ও কিছু না, মা আমাকে যেতেই দিতে চায় না চন্দননগর, আমার বন্ধু কবি, তা মায়ের পছন্দ নয়, কিন্তু আমি মাকে ভালবাসি আঙ্কেল।
দেবাংশু বুঝতে পারছে। সেই কবি, সৌরদীপের সঙ্গে ইনা চন্দননগর যায়। মাসির বাড়ির আগে সৌরদীপের সঙ্গে বহু সময় কাটে তার। ভয় পায় হয়তো ইলিনাদি। মনে হয় তাই। ইনা কি মাসির বাড়ি থাকে, নাকি সৌরদীপের সঙ্গে ? ইনার মুখের দিকে তাকিয়ে দ্যাখে দেবাংশু। বলে, মাসির বাড়ি আমি যদি যাই, সেলিনাদির বাড়ি।
নো আঙ্কেল, মাসি আমাদের বাড়ি আসে না, আমাদেরও যাওয়া হয় না, এর ভিতরে তুমি মায়ের কলিগ, তুমি গেলে ওয়ার্ম রিসেপশন না পেতে পারো, ওদের দুই বোনের দ্বন্দ্বের ভিতর তুমি যাবে কেন ? লিনা বেশ গুছিয়ে কথাটা বলল।
আজ আর গল্প হবে না। ইনা জিজ্ঞেস করল।
মুড নেই। বলল দেবাংশু।
কবিসভার গল্প শেষ হয়নি তো। লিনা বলল।
ইনা বলল, মনে হয় বাকিটা আঙ্কেল ভুলে গেছে।
হতে পারে তা। দেবাংশু বিড়বিড় করে, বলল, অনেকদিন যাইনি ডুলুং নদীর ধারে সেই কবিসভা কুসুমডিতে ছোট পিসির বাড়ি।
মহাকাব্য শেষ হলো ?
জানি না, শুনেছিলাম প্রতি পূর্ণিমায় কিছুটা করে পড়ে শোনান, পরেরদিন কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদে ছিঁড়ে ফেলেন কিছুটা, কেন না মনের মতো হয়নি, তাই।
তাই ! ইনার চোখে বিস্ময়, আমি সৌরদীপকে বলব, ওকেও নিয়ে যাব।
নিয়ে যাবি, তারপর ও যদি আর না ফিরতে চায় ?
এমন হতে পারে নাকি ? ইনা বিস্মিত হয় আবার।
দেবাংশু বলল, পারে, ডুলুং নদীর বাতাস যদি গায়ে লাগে, সে বাতাস খুব পজেসিভ, আটকে রেখে দেয়।
ইনা লিনা দুই বোন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসে। লিনা চাপা গলায় বলে, তোদের যেতে হবে না, যদি তোরা থেকে যাস, তুই আর সৌরদা, মা যে সেই ভয় পাচ্ছে।
ইনা হা হা করে হাসল, যদি ধর আমি আর সৌর একদিন কোথাও একটা গিয়ে না ফিরি, মা কী করবে, আমি এখন আডাল্ট, আমি তা করতেই পারি, ধর আমরা দুজনে চলে গেলাম কুসুমডি কবিসভা গ্রামে, মা কী করবে ?
১৮
যেতেই পারে ইনা সৌরর সঙ্গে। গিয়ে না ফিরতেও পারে। সৌর কবি শুনে তাকে তারা বসত করাল।
বসত করাল ! লিনা জিজ্ঞেস করল, বসত করায় কী ভাবে ?
কবিই ওই গ্রামে ব্রাহ্মণ, তাকে তারা জমি দিল, ঘর বেঁধে দিল, বলল থাকো এই কবিসভায়, জমিতে চাষ কর, ঘরে বসে কবিতা লেখ, কবিতা পড়ে শোনাও গ্রাম সভায়।
ইনা বলল, সত্যি বলছ দেবাংশু আঙ্কেল ?
মিথ্যে বলে আমার লাভ ?
ইনা বলল, ছেলেরা শুধু মিথ্যে বলে।
তাই ! দেবাংশু মুখ টিপে হাসে।
হ্যাঁ তাই, তারা শুধু বানায়, মেয়েদের সামনে এমন একটা স্বর্গ এঁকে দেয় যে মেয়েরা তা বিশ্বাস করে বসে। ইনা বলল।
দেবাংশু বলল, তাহলে তো আর গল্প বলা যাবে না।
আমি তো ওইটাই জানতে চাইছি, এটা গল্প না সত্যি ?
দেবাংশু বলল, গল্প হলেও সত্যি।
বুঝলাম না। ইনা বলল।
তখন লিনা বলল, আঙ্কেল তুমি গল্পটা বল, আগে গল্পটা বল, তারপর বলা যাবে সত্যি কি মিথ্যে।
ইনা চুপ করে থেকে বোনের কথায় হ্যাঁ করল। দেবাংশু দেখল ইনা অন্য দিকে ফিরে। ইনা যে তার কথা খুব বিশ্বাস করছে তা মনে হল না দেবাংশুর। শুধু দেবাংশুর গল্পের টানে সে চুপ করে আছে। সে তার কথা আরম্ভ করল।
কবিসভা কুসুমডি গ্রামে অমন হয়। কবিকে বসত করায় তারা। পঞ্চায়েত কবিকে জমি দেয়। একজন কবি ছিলেন ওই গ্রামে, করুণাসিন্ধু কবি, তিনি ৩৬৬টি কবিতা লিখতেন বছরে। তাঁর কবিতা বহু পত্রিকায় ছাপা হত। একবার তিনি কবিরত্ন সম্মান পেয়েছিলেন কবি জয়দেবের মেলায়। অজয়ের তীরে পৌষ সংক্রান্তির ভোরে পুণ্যস্নান করে তিনি তার সম্মান গ্রহন করেছিলেন। বাউলেরা তাঁকে ঘিরে গান শুরু করেছিল।
সত্যি ! অভিভূত ইনা জিজ্ঞেস করে।
হ্যাঁ সত্যি। দেবাংশু বলল, পিসি কেন মিথ্যে বলবে ?
তা ঠিক, মেয়েরা মিথ্যে বলে না। লিনা বলল।
এই কথাটা কি সত্যি ? দেবাংশু জিজ্ঞেস করে।
মুখ টিপে হাসে লিনা। জবাব দেয় না। ইনা বোনের দিকে অদ্ভূত চোখে তাকায়, তারপর বলে, আমি কিন্তু কথাটা ভুল বলি নি, আমাদের ক্লাসের মৌমিতা একটি ছেলের প্রেমে পড়েছিল, অভিষেক একদিন তাকে দেখাল, তার একগুচ্ছ কবিতা বেরিয়েছে নাম করা এক ম্যাগাজিনে। সে যে কবিতা লেখে তা জানত না মৌমিতা। কোনোদিন তো বলে নি । অভিষেক বলল, বলে নি, সে এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করছিল, মৌমিতাকে চমকে দেবে তাই। সব ছিল প্রেমের কবিতা। আর সেই কবিতা পড়ে মৌমিতা প্রথম চুমু দেয় অভিষেককে। অভিষেককে কিছুটা অ্যালাউ করে। অভিষেক চেয়েছিল অনেক, কিন্তু সে দেয় নি। না দিয়েও তার ভালবাসা প্রবল হয়। সে পত্রিকাটি কদিন বাদে ক্লাসের সহপাঠীদের দেখায়। তাদের ভিতর থেকে একজন, কাকলি দত্ত বলে ওই অভিষেক মিত্র তার মাসির ছেলে, যাদবপুরে ইংলিশ লিটারেচরে এম,এ, পড়ে। এই নিয়ে খুব লাগে দুজনের ভিতরে। কিছুতেই মৌমিতা বিশ্বাস করে না। খুব তর্ক হলো। আর মন হলো কষাকষি। কাকলি পরদিন কবি অভিষেক মিত্রর কবিতার বই নিয়ে আসে। তাকে নিজ হাতে লিখে দিয়েছে তার মাসতুতো দাদা। কী কান্না কেঁদেছিল মৌমিতা। তার বয় ফ্রেন্ড মিথ্যে অস্বীকার করতে পারে নি। মৌমিতা তাকে ত্যাগ করেছিল। তার প্রেম চটকে মন্ড হয়ে গিয়েছিল। সেই বয় ফ্রেন্ড নাকি তাকে মোহিত করতে ঐ কথা বলেছিল। আসলে তাও নয়, তার মন পাওয়ার জন্য ওই মিথ্যে বানিয়েছিল ছেলেটা।
দেবাংশু চুপ করে থাকে। ইনা কী স্পষ্ট ভাষায় কথা বলে। লিনা বলল, এমনি হয় দিদি, কিন্তু তার মানে সবাই যে এমন তা হতে পারে না।
ইনা বলল, অনেকেই এমন।
দেবাংশু বলে, মিথ্যে কি মেয়েরা বলে না লিনা ?
কেন বলবে না, আমাদের ক্লাসের অয়নিতা বলত সৌরভ গাঙ্গুলি তাদের আত্মীয়, মায়ের পিসির ননদের ছেলে। সে সৌরভদের বাড়ি কতবার গেছে। ফাইভ-সিক্স এই বলত, সেভেন এইট তেমন বলত না, নাইনে উঠে হাসত, বলত, কেমন বানিয়ে বানিয়ে বলতাম বল, তোরাও বিশ্বাস করতিস।
ইনা বলল, এই সব মিথ্যেয় কোনো ক্ষতি হয় না কারোর, কিন্তু অভিষেক মিত্র নামের ছেলেটি চোর, অন্যের কবিতা নিজের বলে মৌমিতার কাছ থেকে ভালবাসা আদায় করেছিল, খুব খারাপ।
দেবাংশু জিজ্ঞেস করে , সে তার পিসির গ্রামের কথা বলবে কি বলবে না।
ইনা হাসে, বলবে আঙ্কেল বলবে তো নিশ্চয়ই।
যদি তা বানানো হয় ?
তুমি কতটা বানাতে পার দেখি। বলে ইনা তার মোবাইল খুটখুট করল। এত সময় মোবাইলে নেট খোলা ছিল। সে বন্ধ করল। দেবাংশু তার কথা আরম্ভ করল। দেবাংশু জানে সে যা শুনেছে তা সত্যি। পিসি কি কবিতা লিখত কোনোদিন ? পিসে মানে তুহিনচন্দ্র কবি তার দুই ক্লাস নিচে ফার্স্ট ইয়ারের মেয়ে কীর্তনিয়াশোল গ্রামের আদুরী কীর্তনিয়াকে একদিন মাত্র নিয়ে গিয়েছিল তাদের কবিসভা গ্রামে। আর ফেরে নি পিসি। মন রেখে চলে এসেছিল বাড়ি। দেবাংশু কথাটা শুনেছে বড় হয়ে। উন্মাদের গ্রামে পিসি বিয়ে করায় সবাই হায় হায় করেছিল। কিন্তু পিসি তো বেশ আছে। ওই গ্রামের হাই ইস্কুলে বাংলার টিচার। মহাকবির বউ। পিসে যে মহাকাব্য লিখছে তা কে না জানে।
দেবাংশুর এই কথা শুনে ইনা লিনা দুই বোন আবার অবাক। ইনা বলল, আচ্ছা তোমার পিসির গ্রামের কথা শুনি্নি তো, এমন কোনো গ্রাম কি আছে সত্যি ?
তোমরা শুনবে কী করে ?
ইনা বলল, নিউজ হবে তো, একটা গ্রামের ডাক নাম আছে, হাউ ফানি, এ কখনো হয়, তার উপরে গাঁয়ের ঘরে ঘরে কবি।
নিউজ হবে কী করে, কে খবর দেবে, মহাকাব্য শেষ হলে ওরা টেলিভিশন চ্যানেল ডাকবে, সবটা জানিয়ে দেবে সবাইকে।
ইনা বলল, নিয়ে যাবে, আমি আর সৌর যাব।
তোমার মাকে তো বলতে হবে।
মা তো না করবে।
দেবাংশু বলে, তাহলে তো হবে না ।
কেন হবে না, আচ্ছা তোমাকে নিয়ে যেতে হবে না, আমিও যাব না, সৌর যাবে, কী ভাবে যাবে বল।
তাও বলতে পারব না।
কেন আঙ্কেল, তুমি কি ধরা পড়ে যাবে, আর ইউ লাইং ?
শোনো, মিথ্যে হোক সত্যি হোক, আমি বলব না, বললে যদি সত্যি চলে যায় তোমার বন্ধু কবি সৌরদীপ।
হি ইজ সৌরাংশু, সৌরদীপ নয়, সৌরদীপ ওর ভাই।
দেবাংশু বলল, সে কি কবিতা লেখে না ?
না, ওরা টুইন, কিন্তু সৌরদীপ সাহিত্য কবিতা ইত্যাদির একশো মাইল দূরে।
সৌরদীপ না সৌরাংশু ?
আমার বয় ফ্রেন্ড সৌরাংশু।
দুজন একরকম, দুই সৌর ?
হ্যাঁ, আমি দেখেছি, একে অন্যের প্রতিবিম্ব। ইনা বলল।
তাহলে তুমি যে সৌরদীপের সঙ্গে বন্ধুতা করোনি সে গ্যারান্টি আছে?
ইনা বিরক্ত হলো, বলল, কী বলছ তুমি আঙ্কেল বুঝতে পারছি না।
দেবাংশু এমন। সে কথার পিঠে কথা বসাতে পারে চমৎকার। কথায় মুগ্ধ করে দেয় কতজনকে। ইনা বিরক্ত হলেও লিনা কিন্তু মজা পেয়েছে। সে মনে মনে হাসছে। দিদি পারছে না। দিদি সব সময় জিতে যায়। দেবাংশুর কাছে জেতা সহজ নয়। দেবাংশু আঙ্কেলকে খুব ভাল লাগছে লিনার। কী হ্যান্ডসাম, কী সুন্দর কথা বলে। ইচ্ছে করে রাগিয়ে দিচ্ছে দিদিকে। দাও আঙ্কেল দাও, দিদিকে আমার তরফে হারিয়ে দাও। দেবাংশু বলছে, কবিসভা কুসুমডি গ্রামে গিয়ে যদি সৌরদীপ না ফেরে।
সৌরদীপ নয়, সৌরাংশু, তুমি বারবার কেন ভুল করছ?
দেবাংশু বলল, টুইনে আমার ভুল হয়ে যায় ইনা, আমার ছোট কাকার দুই যমজ মেয়ে, তাদের ডাক নাম রাখি আর পাখি, আমি সব সময় ভুল করতাম, রাখিকে পাখি, পাখিকে রাখি, শেষে তারা আমার সামনে এলেই বলত, আয়াম রাখি, দেবুদা, আয়াম পাখি মিঃ দেবাংশু।
ওক্কে, কিন্তু তুমি এদের তো দেখছ না, কী ভাবে ভুল করছ ? বিপন্ন মুখে বলে ইনা, দুজনকে একসঙ্গে দেখলে না হয় ভুল করতে।
যেই আমি শুনেছি, আমার মনে হচ্ছে, হি ইজ সৌরদীপ, সৌরাংশু নয়, টুইনে আমার এমনি হয়, মনে হচ্ছে তোমার বয় ফ্রেন্ড সৌরদীপ, তুমি বুঝতে পারছ না।
না, না, না, তাহলে তোমাকে বলতে হবে না, ইনা যেন আরো বিপন্ন হয়ে পড়ে, বলে, সৌরদীপ কবিতা লিখতে জানে না।
হয় তো সেই জানে, সৌরাংশু জানে না, কে কোনজন তা কি তুমি জানতে ?
উফ, তুমি থামবে, তোমার কথা শুনতে শুনতে আমার মনে হচ্ছে তোমার কথাই যেন সত্যি, কিন্তু আসলে তো তা নয়, ওকে তুমি নিয়ে যাবে কবিসভা গ্রামে ?
যদি ডুলুং নদীর হাওয়া গায়ে লেগে যায়, তোমার সৌরদীপের মন বসে যায় কবিসভায়, তখন ?
হি ইজ সৌরাংশু।
সৌরদীপ ফেসবুকে সৌরাংশু নাম নিয়েছে হয়তো, ফেক আইডেনটিটি। দেবাংশু বলে।
হতে পারে তা ? লিনা নিরীহ মুখে জিজ্ঞেস করে।
খুব হতে পারে। দেবাংশু বলল, ফেসবুকেই তো এমন হয়।
না, কবিসভায় মন বসে যাওয়া, ডুলুং নদীর হাওয়া। লিনা কথাটা ঘুরিয়ে নিল সৌর নিয়ে ধন্ধের কথা ইনার কানে পৌঁছে দিয়ে।
হতে পারে, আদুরী মানে আমার পিসি যে কবিতার টানে এত বছর কাটিয়ে দিল কবিসভায়, সে কি শহরে আসতে পারত না, ঝাড়গ্রাম কিংবা মেদিনীপুর বা কলকাতায় ?
আমি একা গেলে ? ইনা জিজ্ঞেস করল।
তুমিও থেকে যাও যদি, তোমাদের জমি দেবে, ঘর বেঁধে দেবে, গাঁয়ের লোক মাসোহারা দেবে, তোমরা শুধু কবিতা লিখে যাবে, এমন যদি হয়। দেবাংশু বলল।
ইনা মাথা নাড়ে, বলে, হবে না হবে না, ওভাবে কবিতা হয় না আঙ্কেল, তুমি খুব বানাতে পার।
না, এইটা সত্যি।
লিনা বলল, দিদি তুই ফেসবুকে লিখে দে, ও লিখবে দেবাংশুদা ?
সম্বোধন বদলে দিল লিনা। ইনার সঙ্গে কবিসভা গ্রাম নিয়ে কথাবার্তায় সে মোটেই খুশি হয় নি এত সময়। সে ওই কথার ভিতরে ঢুকতে পারছিল না। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল দেবাংশু হয়তো ইচ্ছে করে তার দিদির সঙ্গে কথা বাড়িয়ে যাচ্ছে। তাই সম্বোধন বদলে দিয়ে সে নিজের কর্তৃত্ব প্রকাশ করতে চাইল। কিন্তু দেবাংশু মাথা নাড়ে, তা ঠিক হবে না, কবিসভা গ্রাম তার আড়াল ঘুঁচোতে চায় না। সে থাকতে চায় নিভৃতে। ফেসবুকে লিখে দিলে দেবাংশু নিজে আর ওই গ্রামে যেতে পারবে না। পিসির সঙ্গে তার আর দেখা হবে না।
লিনা বলল, তুমি যে প্রকাশ করেছ তা জানবে কী করে গ্রাম ?
ও ঠিক জেনে যাবে, বুঝে যাবে কবিসভা, পিসিকেও দোষারোপ করবে, আমি কবিসভার কথা তোমাদের বললাম, তোমরা আর কাউকে বল না।
লিনা জিজ্ঞেস করে, মা জানে তো?
না, ইলিনাদি জানে না, আমি বলি নি মনে হয়।
ইনা কোনো কথা বলছে না। লিনার সঙ্গে কথা হচ্ছে দেবাংশুর। তারপর আচমকা ইনা বলে দিল, ওই রকম কোনো গ্রাম হয় না আঙ্কেল, ইউ আর আ সুইট গাই, কী সুন্দর গল্প বানাতে পার, আমার বয় ফ্রেন্ড সৌরাংশু, সে সত্যি তাই, ওকে দেখলে তোমার ভাল লাগবে, ও ও খুব ভাল কথা বলে।
লিনা টের পায় সে যে তার সম্বোধন বদলে ‘দেবাংশুদা’ বলেছে তার শোধ নিল দিদি। সে বলল, মোটেই না আছে আছে, এমন গ্রাম আছে, থাকতে পারে, কী দেবাংশুদা আছে তো ?
কথাটা এক বোন বলল, অন্য জনও দেবাংশুর জবাবের জন্য তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। দুই বোন দেবাংশুকে নিয়ে মনে মনে একে অন্যের প্রতি ঈর্ষা পরায়ন হয়ে উঠছে। দুই বোন দুই বোন। তখন ইলিনা ঢুকল সেই ঘরে, বলল, দেবাংশু, একবার ন’পাহাড়ি যেতে হবে,যাবে দেবাংশু আমাদের সঙ্গে ?
তখন লিনা বলে উঠল, না না, আমি যাব না, আমার দরকার নেই ন’পাহাড়ি।
১৯
পরদিন দেবাংশু বিল্বমঙ্গলকে বলল, ইলিনাদি যেতে পারবে না, লিনাকে তো একা রেখে যেতে পারে না, আমি তুমি তো যেতে পারি বিল্বদা।
কালচিনি, সেই ডুয়ারস ?
না, ন’পাহাড়ি, আমরা যাই, খোঁজ নিয়ে আসি।
কতদিন আমার বেরোন হয় না, আমি যে তোমার গ্রামে যাব বলেছিলাম দেবাংশু।
সে যাওয়া হবে, আমি তোমাকে নিয়ে যাব। দেবাংশু আশ্বাস দেয়।
কবে নিয়ে যাবে, আমি তো রিটায়ার করে যাব ?
দেবাংশু বলে, আমি গেলে নিয়ে যাব সঙ্গে।
বিল্বমঙ্গল মাথা নাড়ে, রিটায়ার করে গেলে কি আর যাওয়া হবে ? হয় না। ধীরে ধীরে সে বিস্মৃত হবে। তাইই স্বাভাবিক। তাদের সম্পর্কটি এই অফিসের সূত্রে। তারা সারাদিন, আট ঘন্টা এক সঙ্গে থাকে। সারাদিন নানা কথার ভিতরে থাকে। একে অপরের নানা কথা শেয়ার করে। অফিসে না থাকলে সেই সম্পর্ক ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যেতে থাকবে। এই অফিসেই আগে ছিল সুবোধ পুরকায়স্ত, খুব হাসিখুসি আনন্দময় মানুষ ছিল পুরকায়স্তদা। বছর দেড় রিটায়ার করেছে, আস্তে আস্তে তার কথা ভুলতে শুরু করেছে তারা। এই মাস খানেক আগে পুরকায়স্তদা হঠাৎ ফোন করল। তার হার্টে গোলমাল দেখা দিয়েছে। খুব সাবধানে থাকে। কত কথা বলতে চাইল লোকটা। শুনতে ভাল লাগছিল না বিল্বমঙ্গলের। মনে হচ্ছিল তার ভবিষ্যতের কথাই যেন শোনাচ্ছে পুরকায়স্ত। স্ত্রী মারা গিয়েছে মাসখানেক আচমকা ভুগে। ছেলে থাকে সান-দিয়েগো। একটিই ছেলে। সে একা হয়ে গিয়েছে। শুনতে শুনতে বিল্ব ভয় পেয়ে আচমকা হ্যালো হ্যালো করতে আরম্ভ করেছিল। যেন সে শুনতে পাচ্ছে না পুরকায়স্তর কথা। পুরকায়স্ত জিজ্ঞেস করতে লাগল, শুনতে পাচ্ছ শুনতে পাচ্ছ ? সে হ্যালো হ্যালো করেই গেল। লাইন কেটে পুরকায়স্ত আবার ফোন করতে লাগল। সে ধরে আবার হ্যালো হ্যালো করে কেটে দিল। পুরকায়স্ত থামল। আসলে ঘটনাটি খুব নিষ্ঠুর, কিন্তু তা ছাড়া সে থামাবে কী করে পুরকায়স্তকে ? পুরকায়স্ত সেই তমলুক থেকে ফোন করেছিল। তার তমলুকের বাড়ি গিয়েছিল একবার বিল্বমঙ্গল। দেখে এসেছিল পুরোন বন্দর, বর্গভীমা দেবীর মন্দির। কিন্তু রিটায়ার্ড লোকটির ওই সব কথা তার ভিতরে তীব্র অস্বস্তি ধরিয়ে দিয়েছিল। সে অবসর নিলেও তার ফোন ধরে হ্যালো হ্যালো করতে থাকবে দেবাংশু। দেবাংশু তুমি বংশীধরপুর যাবে সামনের দোলে। হ্যালো দেবাংশু, হ্যালো হ্যালো।
দেবাংশু বলল, আমার মনে হচ্ছে সেই অখিলেশ দে আছে ন’পাহাড়িতে, সেও তো তার নেটিব ভিলেজ, চলো দেখে আসি।
বিল্ব বলল, ইলিনা ছাড়া আমরা কোথায় যাব ?
চলো, যদি লোকটা থাকে, আমরা খোঁজ পেয়ে যাব, হেড মাস্টারের ছেলে অখিল, খোঁজ কেন পাব না।
বিল্ব বলল, চলো, সেই নদীর উৎস দেখে আসি।
দেবাংশু আর বিল্ব ইলিনাকে বলতে ইলিনা তাদের বুঝিয়ে দিতে লাগল কী ভাবে কোন পথে ন’পাহাড়ি যেতে হবে। তারপর ইলিনা বলল, তোমাদের বলিনি দেবাংশু সব, আমার খুব ভয় করছে, আমার ফ্ল্যাটে একদিন পুলিস এসে ঘুরে গেছে।
কেন?
অখিলের খোঁজে, আমার সঙ্গে যে পনের বছর যোগাযোগ নেই তা পুলিস জানে, তবু এসেছিল, আইনি বিচ্ছেদ তো হয়ে যায় নি।
দেবাংশু অবাক। দেবাংশু আর বিল্বমঙ্গল ইলিনার এই কথা আগে শুনলে চলে যেত এতদিন। ইলিনা বলছে, আসলে যাওয়ার কথা তার, কিন্তু সে বাড়ি থেকে বেরলে তার পিছনে পিছনে পুলিস যাবে আর ধরা পড়ে যাবে অখিল।
তোমার মেয়েরা না বারণ করলেও যেতে না ? দেবাংশু জিজ্ঞেস করে।
মেয়েরা আমার কথা মতো বারণ করছে, শোনো দেবাংশু তোমাদের পাঠাব বলে এত কথা, আমরা গেলে ও ধরা পড়ে যাবে, ধরা পড়লে ওকে মেরে দেবে, ও অনেকের অনেক কথা জানে, ও কি খুন করে এসেছে, জানি না কেন লুকিয়ে গেছে।
দেবাংশুরা সব শুনল। ঠিক হলো বিল্বর গাড়ি করে দুজন রওনা হবে ন’পাহাড়ির উদ্দেশে। সঙ্গে থাকবে ইনা। হ্যাঁ, ইনা। ইনা যাবে বলছে। দেবাংশু অমত করেনি।
দেবাংশু বলল, দ্যাখো বিল্বদা, লোকটা ন’পাহাড়ি ছেড়ে চলে গেছে কবে, কিন্তু বিপদে ন’পাহাড়ি চলে এসেছে। ন’পাহাড়ি তাকে আশ্রয় দিয়েছে। তার নিজের গ্রাম, নিজের নদী নিজের বন নিজের পাহাড় তাকে ফেরায় নি। মাতৃগর্ভের ভিতরে আশ্রয়ের মতো আশ্রয় পেয়েছে যেন অখিল। যে অখিল ছেড়ে গিয়েছিল দুই কন্যা আর স্ত্রীকে সেই অখিল বিপন্ন হয়ে ওদের কাছে চলে এসেছিল ভূতগ্রস্তের মতো। তখন ইলিনা আর তার মেয়েরা তাকে এদিকে পাঠিয়ে দিয়েছে।
সবাই মিলে বলল, আমাকে দুই মেয়ে বলতে আরম্ভ করল, তারপর কাঁদতে কাঁদতে ইলিনা এসে বসল, বলল, কত লুকোব আমরা, লুকোতে গিয়ে জেরবার হয়ে যাচ্ছি, এদিকে অখিলের জন্য আমি ঘুমোতে পারি না দেবাংশু, কী ওর ভবিষ্যত।
কী হয়েছিল বলবে ? বিল্ব জিজ্ঞেস করে। কথা হচ্ছিল বিল্বর বাড়িতে বসে। তারা পরেরদিন সকালে বেরোবে। দেবাংশু সব বলছিল যা শুনেছে ইলিনার কাছে। দেবাংশু বলে, ভেবে নাও, অখিল একদিন রাত বারোটারও পর ওদের বাড়ির কড়া নাড়ে। দরজা খুলে ভূত দ্যাখে ইলিনা। কে এসে দাঁড়িয়েছে এতকাল বাদে। ইলিনার পেছনে দুই মেয়ে। তারা ভুলেই গিয়েছিল তাদের বাবাকে। ওই লোকটা তাদের বাবা ?
তুমি, কী হয়েছে ? ইলিনা কী যেন আন্দাজ করে লোকটাকে টেনে ভিতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। তখন শীত যায়নি। জানুয়ারির শেষ।
ময়লা একটা হাফ সোয়েটার আর বহু পুরোন নীল কর্ডের প্যান্ট, মাথায় ভুটিয়া টুপি। সে এসেছিল প্রায় নিরালম্ব হয়ে। ইলিনাদের দেখতে এসেছিল। বলেছিল, সে আর বাঁচবে না, বাঁচতে পারবে না, তাকে বাঁচতে দেবেও না কেউ, তাই তাদের দেখতে এসেছে।
ডুয়ারস কালচিনি থেকে ?
না, সে এসেছিল ন’পাহাড়ি থেকে, ন’পাহাড়িতে লুকিয়ে আছে সাধুর আশ্রমে।
সেই নদীর উৎসে ?
হ্যাঁ, সেই যে গেল আর খোঁজ নেই, সে আছে কি নেই তা দেখতে যাব আমরা, ইলিনাদি ভয় পাচ্ছে, ভাবছে সে নিকেশ হয়ে গেছে।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না দেবাংশু।
দেবাংশু বলে, আমিও বুঝিনি, তবে তুমি ধরে নাও এক ক্রিমিনালের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছ।
ফোনে যোগাযোগ হয় না ?
সেলিনার সঙ্গে হয় হয়তো। দেবাংশু বলে। না হতেও পারে। পুলিস নজরে রেখেছে। ফোন ট্যাপ করছে। ও কোনো মোবাইল ব্যবহার করে না ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে।
আমরা কী করতে যাচ্ছি দেবাংশু ?
দেবাংশু বলে, দেখে আসতে সে বেঁচে আছে কিনা।
বিল্বমঙ্গল বলে, তারপর ?
জানি না।
আমরা কি খারাপ খবর বলব ওদের ?
সে সাধু হয়ে আছে ওখানে।
তার ভুটিয়া বউ ছেলেমেয়ে ?
কালচিনিতে আছে। দেবাংশু বলে।
তাদের ফেলে এসেছে ? বিল্ব জিজ্ঞেস করে।
হ্যাঁ, সে ওই রকম, অনায়াসে ফেলে এসেছে, কিন্তু তাদের জন্য রেখে এসেছে, সব ব্যবস্থা করে এসেছে।
কী ব্যবস্থা করে এসেছে, কতটা কী রেখে এসেছে ? টাকা রেখে এসেছে, তারা সে টাকার সুদে খায়। দেবাংশু বলে। শুনতে শুনতে বিল্বর মনে হয় এত কথা ছিল ইলিনার ভিতর। ইলিনা বলতে বলতেও বলেনি। বলতে ভয় পেয়েছে। দেবাংশু তুমি জান কী করত অখিল, সামান্য চাকুরে কত ঘুষ খেয়েছে, কত টাকা করেছে, কত টাকা করা তার পক্ষে সম্ভব ? ইলিনাদের জন্য কত এনেছিল ? জানে না দেবাংশু। ইলিনা বলেনি।দেবাংশুও জিজ্ঞেস করেনি। দুই মেয়ে কী অদ্ভূত অভিনয় না করে। ওদের মা শিখিয়েছে। সেলিনা একবার গিয়েছিল। সে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। দেখে আসে খুব অসুস্থ। তারপর কতদিন কাটল। চার মাস। এতদিন সে কেমন আছে ? সেলিনা আর যায়নি। বারণ করেছিল অখিল। না সেলিনার সঙ্গেও কোনো যোগাযোগ নেই। সে বারণ করেছে। এক দেড়বছর লুকিয়ে থেকে আবার বেরিয়ে পড়বে। আবার ডুয়ারসে চলে যাবে। কী অদ্ভূত ! লোকটা ইলিনাদিকে তার ভুটিয়া বউ নিয়ে কত কথা না বলে গেছে। যেমন ইলিনা আর ইনা লিনার জন্য সে ফিরেছে কলকাতায় বিপদ মাথায়, তেমনি সে কালচিনিতেও ফিরবে, ফিরবে।
শুনতে শুনতে বিল্বমঙ্গল বলে, অখিল শয়তান না ভগবান ?
২০
ন’পাহাড়ি জায়গাটি বাঁকুড়ার উত্তরে। ন’পাহাড়ি পুরুলিয়ার গায়ে বলা যায়। ইলিনা রাঙামাটি নামের একটি গ্রামের চন্ডী চরণ সাহার ঠিকানা দিয়েছে। অখিলের বোনের বাড়ি। আবার ন’পাহাড়ি পার হয়ে হাই-ওয়ে দিয়ে এগিয়ে এক জায়গা থেকে ডান দিকে ঘুরে বেড়ো গ্রামে যাওয়া যায়। বেড়ো একটি পাহাড়ি গ্রাম, বড় একটি পাহাড় আছে সেখানে, সেই পাহাড়ের নামে গ্রামের নাম। পৌষ সংক্রান্তিতে সেখানে বড় এক মেলা বসে পাহাড়তলীতে। ইলিনা সেই মেলা দেখেছে বড় মেয়ে ইনাকে কোলে নিয়ে। ইনা তাই শুনে বলেছে, দেখলেই নাকি তার মনে পড়ে যাবে। তারপরে বলেছে, এখনো তার আবছা আবছা মনে আছে। সেই বেড়ো গ্রামে অখিলের এক বোনের বিয়ে হয়েছে। পুরুলিয়াতেও এক বোন। কিন্তু বোনেদের বাড়িতে পুলিসের চোখ আছে, তাই সেখানে যায়নি অখিল। তারা জানেও না সে কোথায় আছে। বিহারীনাথ পাহাড়ের গায়ের গেস্ট হাউজে উঠতে পারে তারা। গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে বলে সুবিধে হবে। অখিল আছে গন্ধেশ্বরী নদীর উৎসে। এইটুকু আন্দাজ করতে পারছে ইলিনা। আন্দাজ ভুল হলে আর কোনো উপায় নেই। তখন হয় তো ডুয়ারসে যেতে হবে তাকে খুঁজতে।
দুর্গাপুর থেকে ঘুরে দামোদর পার হয়ে বাঁকুড়ায় প্রবেশ করল গাড়ি। আর তারপর বড়জোড়া থেকে পশ্চিমে ঘুরে ন’পাহাড়ির দিকে গাড়ি ছুটল। বনভূমি আর লালমাটি দেখতে গিয়ে ইনা বলল, এ কী হয়েছে আঙ্কেল, মাসির কথা ঠিক ?
কী বলছ, কী ঠিক ? বিল্ব জিজ্ঞেস করে। সারাটা পথ ইনা বিশেষ কথা বলে নি। এত চুপচাপ হয়ে আছে মেয়েটা যে অস্বস্তি লাগছিল বিল্বর। কোনো কথাই তার ভাল লাগে না শুধু ন’পাহাড়ি নিয়ে কথা হলে মেয়েটা কৌতূহলী হয়। তাকিয়ে থাকে দুজনের দিকে।
বিল্ব বলে, কী কথা ঠিক ?
লুক আউটসাইড দ্য কার, দ্যাখো আঙ্কেল আগের দিন আমি বলেছিলাম ন’পাহাড়ি তার বিউটি নষ্ট করে ফেলেছে।
কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না। বিল্ব বলে।
দেবাংশু বলে, এখনো দেরি আছে ন’পাহাড়ি।
তা আমি জানি, জায়গাটা অনেকদূর এখনো। ইনা বলল।
তুমি কি এসেছ আগে এখানে ?
আমার জন্ম কি এখানে, ‘ বাবা-মায়ের আমি প্রথম সন্তান, আমি মাসির কাছে মায়ের কাছে শুনে শুনে বুঝে গেছি সবটা, এখন আমার খালি মনে হচ্ছে এখানে আমি এসেছিলাম আগে, আমার খুব চেনা মনে হচ্ছে,’ বলতে বলতে জানালা দিয়ে ইনা বাইরে তাকিয়ে প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে, ‘দ্যাখো আঙ্কেল দ্যাখো, গাছে গাছে আর সবুজ আছে ?’
সামনে ড্রাইভারের পাশে দেবাংশু, পিছনে বিল্ব আর ইনা। ইনার কথায় দুজনে তাকিয়ে দ্যাখে সত্যি। পথের দুপাশে ঘন জঙ্গল, তারা মেজিয়া ছেড়ে গঙ্গাজল ঘাটির পথে গিয়ে ঘুরেছে উত্তর পশ্চিমে। দ্যাখে বনের গাছের পাতা কালো হয়ে গেছে। বন পেরিয়ে মাটি কালো হয়ে গেছে। ইনা বলল, মাসি ঠিক বলেছিল আঙ্কেল, আমি বিশ্বাস করিনি, কিন্তু আসলে তা সত্যি।
দেবাংশু বলল, স্পঞ্জ আয়রণ ফ্যাক্টরির কালি ছড়িয়েছে, ওই দ্যাখো ইনা, কী রকম ধোঁয়া উগরোচ্ছে, ওই যে।
তারা দেখতে পেল। অনতিউচ্চ চিমনি ক্রমাগত কালো ধোঁয়া উদ্গীরণ করেই যাচ্ছে। ওই দক্ষিণ-পুবের আকাশ অন্ধকার হয়ে আছে। ওরা যত এগোতে লাগল, কালো মাটি কালো পাতা দেখতে যেন অন্ধ হয়ে যেতে লাগল। রীতিমতো কর্মযজ্ঞ লেগেছে এই পাহাড়ি প্রকৃতিতে। পাহাড় ভাঙছে ক্র্যাশার মেসিন। পাথর ভাঙা ধুলো উড়ছে। রোদ হয়েছে ভয়ঙ্কর। পথের দুপাশে গাছ কেটে ইউক্যালিপ্টাসের বন সৃজন হয়েছে। ইনা বলল, আঙ্কেল কী করবে, ফিরে যাবে ?
কেন তোমার ভয় করছে ? দেবাংশু জিজ্ঞেস করে।
ইয়েস আঙ্কেল, হ্যাঁ আঙ্কেল, আমি যেমন ভেবে রেখেছিলাম সব বদলে গেছে, আমি বিশ্বাস করতাম না মাসির কথা, কিন্তু মাসি যা বলেছে সব ঠিক, এখানে আমার বাবাকে আমি খুঁজে পাব না, নয়টা পাহাড় কি আছে ?
নয়টা পাহাড় কি আছে না ভেঙেচুরে সব পাথরকুচি শহরে পাঠিয়ে দিয়েছে ? ওদের গাড়ি ধীরে ধীরে উঠে গেল ন’পাহাড়ি বাজারে। অনেকটা উপরে। তারপর আবার পথ নেমেছে ধীরে ধীরে। বাজার দেখে খুব খারাপ লাগল। ঘিঞ্জি এক জনপদ, কোথাও একটি তৃণের মুখ নেই। কালো পাতা কালো কান্ড নিয়ে শুকনো গাছ, কালো হয়ে যাওয়া মাটি দেখতে দেখতে মুখ নিচু করে বসে থাকে ইনা, চাপা গলায় বলে, আমি ভেবেছিলাম সব চিনতে পারব, কিন্তু কিছুই মিলছে না, মা যা বলত তাও না।
ওরা জিজ্ঞেস করে করে পৌঁছে গেল বিহারীনাথ পাহাড়ের কোলে। এই জায়গাটার নীরবতাও ক্রমশ ভাঙছে। জেলা পরিষদের গেস্ট হাউজ ব্যতীত বেসরকারি গেস্ট হাউজ হয়েছে। সেখানে টুরিস্ট এসে মদ খাওয়া শুরু করেছে। হল্লা আরম্ভ করেছে। স্থানীয় মানুষ দু-চার পয়সার জন্য যা বলছে টুরিস্ট তা জোগাড় করতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে । ইনা গুম হয়ে আছে। দেবাংশু আর বিল্ব অন্ধকারে ব্যালকনিতে বসে কথা বলছে। ইনা ওই দূরে অন্ধকারের দিকে চেয়ে। ইনা এবার পি,জি, করে ফেলবে। ইতিহাসে এম,এ। সব সময় ঝলমল করে নিজেকে নিয়ে। শুধু ন’পাহাড়িতে প্রবেশের পর সে মুখ অন্ধকার করে আছে। আচমকা বলে, কাল ফিরে যাই চলো আঙ্কেল।
গন্ধেশ্বরীর উৎসে যাবে না ? দেবাংশু জিজ্ঞেস করে।
যা শুনেছি তা নেই মনে হয়, থাকবে ? বিনবিন করে বলে ইনা।
বেড়ো পাহাড় দেখবে না ? বিল্ব জিজ্ঞেস করে।
আমার ভয় করছে, লোকটা মানে আমাদের বাবা আমাদের ডেকেছে, তাই আসা, না হলে আসতাম না।
বাবা ডেকেছে ? দেবাংশু জিজ্ঞেস করে।
বাবা খুব বিপন্ন। ইনা বলে।
হতেই পারে, বিপন্নতা যদি কেউ ডেকে আনে, বিপন্ন হবেই। বিনবিন করে বলল দেবাংশু।
কথায় কথায় রাত গভীর হয়। ইনা তার ঘরে মোবাইলের নেটে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করে। বিল্ব আর দেবাংশুর কথা যেন ফুরোয় না। বিল্ব বলে, কলকাতায় ফিরে এবার দেবাংশুর গ্রামে যাবে, সেই সুবর্ণরেখার তীরে, ডুলুঙের তীরে। আর কতদিন অপেক্ষা করবে বিল্ব ? দেবাংশু কি নিয়ে যাবে না ? দেবাংশু চুপ করে থাকে। তারপর বলে, তারো অনেকদিন যাওয়া হয়নি, ন’পাহাড়ি এসে একটু ভয়ই করছে, তার বংশীধরপুর, হাতিবাড়ি, কীর্তনিয়াশোল, কবিসভা কুসুমডিও কি বদলে গেল অজান্তে ? গিয়ে কি দেখবে দেবাংশু ? কবিসভার মানুষ কবিতা লেখা থামিয়ে দিয়েছে ? মহাকবি তার মহাকাব্যর এক পঙক্তি ও বাঁচিয়ে না রেখে নিরুদ্দেশে গেছে।
অন্ধকারের ভিতরই কথা হয়, হয়ে যায়। পরদিন সকালে তিনজন আবার রওনা হল। খুব কাছে সাধুর আশ্রম আর গন্ধেশ্বরীর উৎসমুখের সেই পাহাড়। বিহারীনাথের কোল থেকে বেরিয়ে তারা ন’পাহাড়ি হয়ে হাইরোডের গিয়ে পড়ল। পুরুলিয়ার পথে কিছুটা যেতেই বনভূমি শুরু হলো পথের দুপাশে। গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল ঠিক জায়গাটিতে। চায়ের দোকানে জিজ্ঞেস করতে তারা দেখিয়ে দিল, বাঁ দিকে পাহাড়ি পথে যতদূর যেতে পারে গাড়ি যাবে, তারপর পায়ে হেঁটে একটু পথ।
পাহাড়ি পথ নির্জন। নিস্তব্ধ। থম থম করছে ইনা। সে একবার বলল, আমার চেনা লাগছে, এ জায়গা তেমন বদলায়নি আঙ্কেল।
তাই তো মনে হয়। বিল্ব বলল, সব কিছু বদলায় না।
হ্যাঁ আঙ্কেল, আমার বাবা কদিনই বা আমাদের সঙ্গে ছিল, তবু বাবার কথা ভাবতে গেলে চোখে জল এসে যায়।
সেই নিস্তব্ধ বনভূমির ভিতরে একটি পাহাড় ছিল ঘন বনে ঢাকা। সেখানে এক কুটির ছিল তালপাতায় ছাওয়া। সেই কুটিরের প্রাঙ্গন ছিল ফুলের বনে ঘেরা। ফুলের বনে রঙ ছিল, লাল হলুদ নীল গোলাপি শাদা বেগনি—হরেকরকম রঙ। কুটিরখানি চুপচাপ। কেউ আছে বলে মনে হয় না। যদিও কেউ থাকে সে বনের ভিতর সেঁধিয়েছে হয় তো। তিন জনে তকতকে আঙিনায় বসে পড়ল। সামনে বনভূমি, অরণ্যের নিবিড়তা। কেমন ছায়া আর অন্ধকারে ডুবে আছে সব। কুটিরের পিছনে পাহাড় উঠে গেছে। সেইদিকে ঝিরঝির শব্দ হচ্ছে। ঝর্না বেরিয়ে আসছে পাহাড় ফাটিয়ে। জলের দিকে যাবে কি তারা ? ওই জলধারাই তো নিম্নভূমিতে বয়ে গিয়ে নদী গন্ধেশ্বরী হয়ে গেছে। এখানটা যেন আগের মতো আছে সব। সেই তার ছোটবেলার আগের বেলার মতো। ভাবতে ভাবতে ইনা দেখল কুটিরের পেছন থেকে বেরিয়ে এল একটি মানুষ। কুজো মতো, গালমুখ দাড়ির জঙ্গলে ঢাকা। পরণে গেরুয়া। সাধু অখিলেশ। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দূর থেকে। চোখমুখে জেগে উঠছে ভয়। তাকে দেখে ইনা বলে ওঠে, ওই, ওই যে অখিলেশ দে, ওই ওই যে আমার বাবা, সাধু হয়ে বসে আছে এখানে।
২১
অখিলের খোঁজে এসে যে এত সহজে ওকে পেয়ে যাবে তা ভাবেনি বিল্ব। বিল্বমঙ্গল চিনত অখিলেশকে, কিন্তু ভুলে গেছে একেবারে। অখিল তুমি কি সাধু হয়ে গেলে ? ইলিনাকে ছেড়ে কামতাড়িত হয়ে একটা কাজের লোককে নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে অখিলেশ অখিল যেন জীবন পরিক্রমা শেষ করে এখানে এসে দম নিচ্ছে।
বাবা ! উঠে দাঁড়ায় ইনা।
গেরুয়াধারী লোকটা একেবারে বুড়ো হয়ে গেছে। অথচ ইলিনাদির কথা মতো অখিলেশের বয়স পঞ্চাশের সামান্য বেশি হবে। লোকটা তো সাধু হয়ে বুড়ো ! লোকটা এখানে লুকিয়ে আছে নাকি এই বেশে ? অনেকক্ষণ দেখে তারপর আত্মপ্রকাশ করেছে। দেবাংশুও উঠে দাঁড়ায়, চাপা গলায় ডাকে লোকটাকে, এদিকে আসুন, আমরা খবর নিতে এসেছি, থাকব না, চলে যাব খুব তাড়াতাড়ি।
বিল্বমঙ্গল ডাকে, এস অখিল, আমি বিল্বমঙ্গল চৌধুরী।
সাধু অখিলেশ এগিয়ে আসে। বিল্ব আর দেবাংশু এক সঙ্গে ইঙ্গিত করে ইনাকে এগিয়ে যেতে। ইনা যায় আগে আগে, তারা কয়েক হাত পিছনে। দেবাংশু ফিসফিস করে বিল্বকে বলে, কাউকে খুন করে লুকিয়েছে এখানে, এখানকার সাধু গেল কোথায় ?
হতে পারে, সাধু হওয়ার লোক না অখিলেশ …! কথা শেষ করতে পারে না বিল্ব। লোকটা আবার বনে ঢুকে যাচ্ছে। ঘুরে হাতছানি দিয়ে ডাকল মেয়েকে আর বিল্ব দেবাংশুকে আলাদা আলাদা করে। বনপথে ঢুকে গিয়ে একটি বড় শালগাছের গোড়ায় গিয়ে দাঁড়াল গেরুয়াধারী অখিলেশ, বিবর্ণ মুখ, ধ্বস্ত শরীর, ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, আমি তোমাদের কেউ না, না বন্ধু না পিতা, আমি একটা মানুষও নই, আমি একটা ঘেয়ো কুকুর, আমি বনের ভিতর ঢুকে যাচ্ছি খুকি, আমার দিকে তাকাসনে, এখানে মাটির নিচে বস্তা ভর্তি টাকা আছে, এতদিন আছে কিনা জানি না, এখানে মাটিতে উইয়ের বাসা, উই ঢিবি।
টাকা, কত টাকা ? ইনা শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে।
জানি না, কোটি হতে পারে, সব হাজার আর পাঁচশোর নোট।
কোথায় পেলে ? ইনা আবার জিজ্ঞেস করে।
বিল্ব বলে, কাদের টাকা ?
আমার কোম্পানির, আমি একটা ব্যাঙ্ক খুলেছিলাম, ডুয়ারস ইনভেস্টমেন্ট এজেন্সি, এসব আমার ব্যাঙ্কের টাকা, আমি টাকা নিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম, তুই এলি, তোকে দেখিয়ে দিলাম, এবার আমি বনের ভিতর ঢুকে যাব, গহীন বনে।
লোকের টাকা নিয়ে পালিয়ে এসেছ অখিল, কী ভয়ানক !
লোকের টাকা নয়, আমার টাকা, আরনড মানি।
কোটি টাকা তুমি উপার্জন করেছ ! বিল্ব বিস্মিত হয়।
একশো কোটির ব্যাঙ্ক, সুদ দিতাম ৩০ পারসেন্ট, সেই লোভে সব সবাই গুড়ের মাছির মতো ছুটে এল, টাকার পাহাড় হয়ে গেল, আমি এত টাকা রাখব কোথায়, কালচিনিতে আমার আর এক বউ চন্দার জন্য রেখে এসেছি বনের ভিতর এক কোটি, বাকি সব কোটি কোটি কোথায় গেল আমি জানি না, আমার জানার দরকার নেই, খুকি তোদের বাবা তোদের কথা ভুলে যায়নি একেবারে।
আমার ভয় করছে শুনতে! আর্তনাদ করে ওঠে ইনা।
বিল্ব বলল, তুমি পুলিশে সারেন্ডার করো অখিল, কত লোকের সর্বনাশ করে এসেছ সুদের লোভ দেখিয়ে।
লোকে যদি ঠকতে চায়, আমি কেন ঠকাব না ?
কত মানুষের সর্বনাশ হয়েছে অখিল।
জগত এই ভাবে চলে, একজনের সবনাশ হলে অন্যজনের মঙ্গল হয় বিল্ববাবু।
যুক্তি রাখো, সাফাই দিতে হবে না অখিল, সারেন্ডর করো।
অখিলেশ বলল, নো, নো সারেন্ডর, আমি সারেন্ডর করলে ইনা লিনা ইলিনাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে, মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না, আমার সাত পুরুষ নিয়ে টানাটানি হবে, ওদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যাবে। বলতে বলতে সেই অখিলেশ আর দাঁড়ায় না। বনের ভিতরে সেঁধিয়ে যেতে যেতে বলল, মরণ ছাড়া আমার আর গতি নেই ইনা, বনের ভিতরে মরে পড়ে থাকব, মাটিতে মিশে যাব, তোরা যা এখন, এখানে টাকা থাকল, পুলিশ ডেকে তুলে নিস পাপের টাকা, যা ছিল সব দিয়েছি, আর নেই, বাকিটা কোথায় গেল আমি জানি না, খাবলা মেরে মেরে তুলে নিয়েছে যে পেরেছে সে।
বিল্ব বলল, যাও।
না যাবে না। ইনা কান্নায় ভাঙতে ভাঙতে বলে ওঠে।
যাবে, তুমি ওকে যেতে দাও, কপর্দকহীন হয়ে যেখানে খুসি যাক।
অখিল বলল, আমাকে দেখতে পেলে পিটিয়ে মেরে দেবে ডুয়ারসের মানুষ, পুলিশ পাঠাবে ডুয়ারসে, ডুয়ারস পুলিশ মেরে দেবে, একা তো খাইনি বিল্ববাবু, আমি বেঁচে থাকলে তাদের ভয়, তারাও তো কম খায় নি আমার থেকে, কে খায় নি বল, কিন্তু ইনা লিনা ইলিনাদের গায়ে কোনো কালি নেই, আমি নিজে মরলে তবু নিজের মতো মরা যাবে।
ইনা কাঠ কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা যেমন আচমকা এসেছিল, আচমকা চলে গেল। মুহূর্তে উধাও। ইনা শালগাছের গোড়ায় বসে পড়ল। মাটিতে নখ খুঁটতে লাগল। দুচোখ দিয়ে ঝর ঝর করে জল পড়ছে। বিল্ব গিয়ে ওকে তুলল, বলল, চলো, তুমি ন’পাহাড়ি দেখলে, এবার ফিরে চলো।
দেবাংশু বলে, নদীর উৎস ?
এই তো নদীর উৎস, বিল্ব বলল, চলো, আর কিছুই দেখতে হবে না।
আমাকে মাসি বলেছিল, নদীর উৎস শুকিয়ে গেছে। মুখ তুলে বলল ইনা, কিন্তু শুকোয়নি তো।
না, প্রাণের উৎস কি শুকোয় ?
ওই শোনো, নদী ঝিরঝির নেমে আসছে। ইনা উঠে দাঁড়ায়, তারপর বলে, লোকের টাকা নিয়ে পালিয়ে এসেছে, এই লোকটা কি আমাদের বাবা হতে পারে, আমার আর লিনার, এ অখিলেশ দে নয়, এই লোকটি অন্য কেউ।
দেবাংশু হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেল। কুটির পার হয়ে দেবাংশু পাহাড়ের আরো কাছে গেল। কিন্তু পাহাড় আরো ভিতরে। দেবাংশু বলল, নদী কোথায় ?
সেই শাল মহুয়া আমলকী হরিতকী লতাগুল্মময় বনস্থলীতে নদী লুকিয়ে আছে কোথায় তা ধরার উপায় নেই। আশ্রমের সাধু নেই। তাকে সরিয়ে দিয়ে আশ্রম দখল করে বসেছিল অখিলেশ। হয়তো তাই। না হলে আশ্রমের সাধু কই ? শূন্য আশ্রম পড়ে আছে। আবার এমন হতে পারে তারা চলে গেলে অখিলেশ সাধু আবার ফিরে এসে বসবে বৃক্ষমূলে।
# #
আসলে এই কাহিনি ন’পাহাড়ির নয়। দেবাংশুর গ্রামের নয়। কুসুমডি-কবিসভা কিংবা বংশীধরপুরের নয়। কুঞ্জবনের নয়। এই কাহিনি একটি গ্রামের। যে গ্রাম ছেড়ে এসেছিল বিল্বমঙ্গলের বাবা কাকারা পূর্ববঙ্গে। বিল্বর নিজের কোনো গ্রাম নেই, সে শিকড় থেকে উচ্ছিন্ন মানুষ। বিল্ব তাই ইলিনা দেবাংশুদের কাছে তাদের গ্রামের কথা শুনতে শুনতে কোথাও একটা পৌঁছতে চায়। দেবাংশুর গ্রামে তার আর যাওয়া হয় না। সে অবসর নেয়। তার কাছে এখন শেষবার দেখা ন’পাহাড়ি আছে ধোঁয়া ধুলো আর প্রাচীন বনভূমি নিয়ে। সাধুর শূন্য আশ্রম নিয়ে। নদীর উৎস আর শালগাছের গোড়ায় পোতা কোটি টাকার বস্তা নিয়ে। এতদিনে উইয়ের ঢিবি বড় হয়ে গেছে সেখানে। সুদে যারা লাভ করবে বলে টাকা দিয়েছিল অখিলেশকে, তাদের টাকার সুদ ও আসল উইয়ে খাচ্ছে ধীরে ধীরে। পলাতক অখিলেশ ফিরে এসে দেখছে কীভাবে উইয়ের পেটে চলে গেছে সব।
২২
অবসরের পর বিল্বমঙ্গলের এখন কম্পিউটার ভরসা। সেই যে সাতক্ষিরে ডুমুরিয়ার মেয়ে পিয়াসা, যে কিনা থাকে নিউ জার্সি, তার সঙ্গে আচমকা আবার দেখা। এক সন্ধেয় সে বিল্বকে ধরল। বিল্বর সন্ধে, ওদের সকাল। সে ডাক দিল, হাই চাচা, বিল্ব আঙ্কেল, হাই বিল্ব, তোমায় একটা খবর দিই, চুপ করে শোনো।
অনেকদিন তোমাকে অন লাইন দেখিনি, কী হয়েছিল।
আমি দেশে গিসলাম চাচা, ডুমুরে সাতক্ষিরে।
আরিব্বাস তাই !
হাঁ বন্দু তাই, আমি তুমার ধুরোল গিসলাম, বড়দল গিসলাম, আমার ফুপুর ছেলের সাদি ছেল, সেই ছেলে অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা থাকে, আর বড়দলের কালু মিঞার মেয়ে ইংলিশে পি,জি, করল রাজশাহী থেকে, দুজনের সাদিতি খুব ধুমধাম হলো, আমার দাদা শুদ্ধশীল আমেদ, আমি বে তে না গেলি আড়ি করে দেবে বলল, আমারও খুব যেতি ইচ্ছে হলো, তুমার ধুরোল, বড়দল লঞ্চঘাটা, কপোতাক্ষ গাঙ দ্যাখপো, উড়ি গেলাম, পেত্থমে ঢাকা, ওখেন থেকে মোটরে করে সাতক্ষিরে, পদ্মা পার হই যেতি হল, উফ কতবড় গাঙ……।
কলকল করে কথা বলে যাচ্ছিল পিয়াসা। ভিডিও কলিং হলো। সেই দূর আমেরিকার নিউ জারসির এক এপার্টমেন্ট হাউসের একটি ঘর ভেসে উঠল। পিয়াসা এই মেয়ে ! যেন ইলিনার মেয়ে ইনা। গোলাপি পায়জামা আর গোলগলা বাদামি রঙের গেঞ্জি। গেঞ্জির উপর আমার ‘’সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’’ লেখা সোনালি অক্ষরে। পিয়াসা চামচে করে চিড়ে ভাজা খাচ্ছে। খেতে খেতে গল্প করছে ইন্ডিয়ার আঙ্কেলের সঙ্গে। চিড়ে মুড়ি নাড়ু সব মেলে এই দেশে। ইলিশ মেলে, পাতাড়ে মাছ, পুঁটি মাছ, ঝোলা গুড়, কদমা……সব মেলে আঙ্কেল এ দেশে। মেয়েটির বয়স বছর তেইশ—চব্বিশ। দ্যুতিময় চোখ। ময়লা ময়লা রঙ, হাসিতে ভরা মুখ, মাথার চুল খোলা, এক স্নিগ্ধ ভাব আছে ওর মুখ চোখে। সে বলছে, বন্দু, তুমি আমার খালুর মতো, খালু চিটাগাং থাকে, কমিশনার, খালুর ছেলে ইমদাদুল কবিতা লেখে, ও ইন্ডিয়ায় যায় কবিসভা করতে।
বিল্ব বলে, এখানে কবিসভা বলে এক গ্রাম আছে।
হয়তো ওখেনেই যায়, ওর আব্বা কত বার বলতিসে বিলেত যাতি, লান্ডান, ও যাবেই না, ও নিশ্চয় তুমাদের কবিসভায় যায়।
সে এক পাগলের গ্রাম।
তা হতি পারে, পাগলের গেরামে পাগলই তো যাবে, ওর যে কী হবে।
কী হবে, কবি হবে।
আঙ্কেল কবির কি কষ্টে জীবন যায় ?
হ্যা, কবিতা পড়ে কজন ?
কী জানি কী হবে ইমদাদুলভাইয়ের, আমি কত বললাম, ও আমারে কবিতা বুজাতে লাগল, অথচ ও পড়াশুনায় কত ভাল, কত নম্বর নিয়ে স্কুল সার্টিফিকেট একজাম পাশ করেছিল, সায়িন্সে ভর্তি হল, কিন্তু তা বন্ধ করে গেল বাংলা পড়তি, বাংলা পড়ে ওর কী হবে, মাস্টারি, মাস্টারের সঙ্গে আমার আব্বা দেবে না।
তোমাদের বিয়ের কথা।
হাঁ আঙ্কেল, আই লাভ হিম, বাট আই কান্ট মারি হিম, আমি আমার পেরেন্টস -এর কথার অবাধ্য হবো না, তুমার সেই ম্যাডম্যান’স ভিলেজ কবিসভা ওকে এরকম করে দিয়েছে, দ্যাখো না আঙ্কেল, খোঁজ নাও, ও নিশ্চয় কবি সভা যায়।
বিল্ব বলল, আমি খোঁজ নেব, কিন্তু কী হবে, তুমি তো ওকে সাদি করবে না।
হাঁ করব না, বাট সে কেন এমন হল তা আমার জানতে ইচ্ছে হয়।
বিল্ব বলল, তুমি ধুরোলের কথা বলো, দত্ত ফ্যামিলির কথা শুনলে ?
হুঁ, আমার পিসির ফাদার-ইন-ল, হি ইজ নাইন্টি নাউ, খুব স্টেডি আসেন (আছেন) , সেই বড়দাদা চিনতি পারল, তিনি বলল, হাঁ, সব খালি করে চলি গেসে, তুমাদের ভিটেয় নাকি বড় পুজো হত, গাঁর যত হিঁদু মোছলমান সেই পুজোয় ফল-ফলারি সিদে দিত, নারকোল, জাম্বুরা, প্যায়রা, ঝে যেমন পারে, সেই সব কতা বলতি লাগল, বুড়া মানষের আখি দে পানি পড়তি লাগল, ও বিল্বচাচা, আঙ্কেল শুনতিসো।
হ্যাঁরে, হ্যাঁ।
পানি সব শুকায় গেসে বিল্বদাদা।
আমি তোর আঙ্কেল না দাদা ?
খিলখিল করে হাসে পিয়াসা, বলে, তুমার বয়েসডা এট্টু কম হলি, আমি তুমার সঙ্গে প্রেম করতাম বিল্ব আঙ্কেল, বিল্ব বিল্ব বিল্ব, শোনো তুমি, এত ঝে কপোতাক্ষ কপোতাক্ষ করতিস ওদেশে বসে, সে গাঙে আর পানি নাই গো।
পানি নাই মানে।
নাই মানে নাই, তুমার সেই বড়দল ইস্টিমারঘাটাও নাই।
সে কী কথা, কোথায় গেল স্টিমারঘাটা ?
ইস্টিমার না চললি তার ঘাট কনে থাকপে বিল্বভাই।
বিল্বমঙ্গল দত্ত দু চোখ বন্ধ করে ফেলেছে কখন তা সে জানে না। অবিকল ধুরোলের ভাষায় কথা শুনতে শুনতে তার মনে হচ্ছিল নিজের মা কংবা পিসি মাসিদের কারোর গলা শুনছে সে ছেলেবেলায় বসে। মা কতদিন নেই। এখন ছবি চলে গেছে কম্পিউটারের মনিটর থেকে, কথা শোনা যাচ্ছে। বিল্ব এখন চোখ খুলে শুধু পিয়াসার গলা শুনতে পাচ্ছে। পিয়াসা না দূর অতীত থেকে তার পিসি মাসিদের কেউ ? তার বড়দি কিংবা ছোটকাকি। ছোটকাকির সেই দেশভাগের কালে হয়তো এই বয়স ছিল। বিল্ব তখন জন্মায়নি। বিল্ব যা শুনেছে সব গল্প। কপোতাক্ষ আর বড়দলের গল্প। ধুরোল আর এক লোক-দেবতা কাল ভৈরবের গল্প। সে গল্প শুনে শুনে মস্ত ইস্টিমার, ঢেউ-এ ঢেউ-এ উথাল পাথাল গাঙ কপোতাক্ষয় নিজেকে সমর্পণ করে ফেলেছে। শিকড় প্রোথিত করেছে। তার একটা গ্রাম ছিল, একটা নদী ছিল এই কথা মনে মনে ভেবে জীবনটাকে সুন্দর করতে চেয়েছে। কিন্তু কী বলছে পিয়াসা, বলছে, গাঙে পানি নাই আঙ্কেল, তুমার কপোতাক্ষ, সেই মাইকেল মধুকবির কপোতাক্ষ শুকোয় গেছে, গাঙ ধুধু করে, বালি ওড়ে।
এসব তুমি কী বলছ পিয়াসা ?
সত্যি বলতিসি আঙ্কেল, সত্যি, আমার সেই বুড়াদাদা, ফুফুর শউর বলতি বলতি কান্তি লাগল, বুড়া বলে সব খালি হই গেছে হিঁদুরা চলি যেতি, এক ধম্মো নিই দেশ হয় না, আমি মোটরে করি বড়দল ঘাট গিয়ে দেখি বালি আর বালি, মাইকেল কবির আঁখিতে পানি, আঙ্কেল, শুনতিস।
হ্যাঁ পিয়াসা।
বিল্ব বিল্ব, শুনতিস।
হ্যাঁ, শুনছি পিয়াসা।
কথার উত্তর নেই কেন বিল্বভাই, তুমারে আর দেখা যাচ্ছে না, কই তুমি ?
এইতো আমি।
হায় আল্লা, গাঙে পানি বলে তুমি চলে গেলে, আমি কী করলাম বিল্ব ?
বিল্ব বলল, আমি তো অন-লাইন আছি পিয়াসা।
কী গেরোয় পড়লাম, আমি ধুরোলের আরো কথা জানি, ভিডিও করে এনিসি আঙ্কেল, বিল্বভাই।
বিল্বমঙ্গল শুনতে পায় পিয়াসার কণ্ঠস্বর। পিয়াসা তাকে শুনতে পায় না। বিল্ব শোনে পিয়াসা ডেকে যাচ্ছে। পিয়াসা নয় সেই কপোতাক্ষ নদ, ধূলিহর গ্রাম। একটি গ্রাম। সে বলছে, আমাকে ভুল বুঝো না বিল্ব, আই লাভ ইউ, আমি যদি আরো তিরিশ বছর আগে জম্মাতাম বিল্ব, তখন কপোতাক্ষ দে ইস্টিমারে করে তুমারে নি পলাতাম গো, আমি সত্যি বলছি বিল্বদা, আঙ্কেল।
আর সহ্য করতে পারেনি বিল্ব দত্ত। অফ লাইন হয়েছে। নেট থেকে উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। বেলা হয়ে গেল। রোদে শহর জ্বলতে করেছে। ঘরে ঢুকে এসে সে বিছানায় লুটোয়।
# # # # # #
দেবাংশুর গ্রামের না জানা কথা আর বিল্বর শোনা হয় না। নিজের গ্রামের কথা জানা হয়ে গেছে। দেবাংশুকে একদিন সে ডেকেছিল বাড়িতে। আসবে বলেও আসেনি। পরে ফোন করলে বলেছিল তাকে ইনা লিনার কাছে যেতে হয়েছিল তাদের ন’পাহাড়ির কথা শুনতে। বিল্ব আর দেবাংশুকে ফোন করে না, টের পায় দেবাংশু আর তার কথায় তেমন ভাবে সাড়া দেয় না। এরপর দেবাংশুকে ডাকলে সে ফোন ধরে হ্যালো হ্যালো করতে থাকবে। কিন্তু একদিন দুপুরে আচমকা দেবাংশুর ফোন এল তার কাছে, বিল্বদা ।
বলো দেবাংশু।
বিল্বদা তুমি যাওয়ার পর আর তেমন করে শোনার মতো মানুষ নেই, আমি আমার গ্রামের কথা না বলে বলে ভুলে যাচ্ছি বিল্বদা।
আমার তো যাওয়া হলো না দেবাংশু ।
না, আমারও না, কতদিন ভেবেছি তোমাকে নিয়ে যাব আমার গ্রাম আমার নদীতে, কিন্তু হল না বিল্বদা, আমি যে নিজে আটকা পড়েছি এখানে, বন্দী হয়ে গেছি এই শহরে।
তোমার বউকে নিয়ে যাও।
ভয় করে বিল্বদা, অভিষিক্তা খালি বংশীধরপুর যেতে চায়।
নিয়ে যাও।
সাহস হয় না।
কী হয়েছিল দেবাংশু ?
সে তো ডাকাতিয়া বাঁশীর ডাক শুনেছিল বিল্বদা, আমি টের পেয়ে আটকেছি মাঝরাতে, তাকে আটকান যায় না, বলছিল, ঠাকুর বেরিয়েছেন পরিক্রমায়, ডাকছেন বাঁশিতে, ওই শোনো বাঁশি, ওগো কৃষ্ণ আছেন পথে, এই গ্রামের পথ যেন ব্রজের পথ, ব্রজের ধুলোয় বংশীধর ঠাকুরের পদচিহ্ন।
থামো, এত রাতে কেউ বাড়ির বাইরে যায়।
কী হবে, কৃষ্ণ পদে মাথা ছুঁইয়ে ফিরে আসব।
না, চুপ করে বস।
সে কাঁদতে লাগল। উফ, কী ভাবে যে কেটেছিল সেই রাত, গাঁয়ের কেউ কেউ বংশীধর হয়ে ডাক দেয়, আড় বাঁশিতে টান দেয়, তাতে কেউ না কেউ বেরিয়ে আসে, বেদম ফুরতি হয়, বিবাহিতা, অবিবাহিতা কেউ না কেউ বেরবে লুকিয়ে, এমনই সেই কাহিনির টান। এই পরকীয়ার টানে সবাই ধর্ম করতে আসে সেখানে। এতদিন গেল, তবু অভিষিক্তা বলে দোলের সময় বংশীধরপুর যাবে, কীরতনীয়াশোল গেলে বংশীধরপুর যেতে চাইবে সুবর্ণরেখার তীর ধরে হেঁটে।
বিল্বমঙ্গল চুপ করে শোনে। দেবাংশু তাকে টেলিফোনে তার গ্রামের কথা শোনায়। শোনাতে থাকে। কাহিনি গড়িয়ে যায়। গড়াতে গড়াতে যখন শেষ হয়, বিল্ব বলে, তুই একদিন আয় দেবাংশু, আমি তোকে আমাদের গ্রামের কথা শোনাব, আমাদের নদী, আমাদেরও আছে, আছে আছে। ফেলে এলেও তারা আমাদেরই আছে। সেই একটি গ্রাম একটি নদী।
কথাসাহিত্যিক
জন্ম :৩০ আগস্ট, ১৯৫১ বাংলা দেশের সাতক্ষীরার কাছে ধূলিহর গ্রামে। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। কর্মজীবন কাটে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের এক দপ্তরে। তিনি ২০০৬ সালে ধ্রুবপুত্র উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন। অশ্বচরিত উপন্যাসের জন্য ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চ শিক্ষা দপ্তর থেকে। এ ব্যতীত ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ( ভাগলপুর ), ১৯৯৮ সালে সর্ব ভারতীয় কথা পুরস্কার স্বদেশযাত্রা গল্পের জন্য। ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র পুরস্কার পান। ২০১৭ সালে সমস্ত জীবনের সাহিত্য রচনার জন্য যুগশঙ্খ পুরস্কার, ২০১৮ সালে কলকাতার শরৎ সমিতি প্রদত্ত রৌপ্য পদক এবং গতি পত্রিকার সম্মাননা পেয়েছেন। ২০২২ সালে প্রথম ভারতীয় লেখক যিনি গাঁওবুড়ো গল্পের জন্য ও হেনরি পুরস্কার পেয়েছেন।