গীতরঙ্গ: আমি কলকাতার রসগোল্লা । তপশ্রী পাল
আমার এই নিবন্ধের বিষয় বাঙ্গালীর গানে ‘মিষ্টান্ন’ বা ‘মিষ্টি’র কথা। সত্যি কথা বলতে, বাঙ্গালী এবং মিষ্টি যেন সমার্থক। বাঙ্গালীর সব শুভ কাজে মাছ এবং মিষ্টির আগমন ঘটে। বাঙ্গালী হলো পেটুকের জাত। আর সেই পেটপুজো অসম্পূর্ণ থাকে মিষ্টি ছাড়া। শেষ পাতে মিষ্টি বাঙ্গালীর চাইই চাই। তা, যে মিষ্টি, বাঙ্গালী জীবনে এমন ছাপ ফেলেছে তা যে কাব্যপ্রিয় বাঙ্গালীর কবিতায় এবং গানে অনুপ্রবেশ করবে তাতে আর আশ্চর্য কী? মিষ্টি এতো প্রিয় বলেই বুঝি বাঙ্গালী সব কিছুর তুলনা করে মিষ্টির সঙ্গে, মিষ্টি হাওয়া, মিষ্টি সকাল, মিষ্টি ব্যবহার, মিষ্টি মেয়ে এমনকি বৃষ্টি অবধি মিষ্টি ! আসুন দেখে নেওয়া যাক তেমন কিছু গান।
সন্ধ্যা মুখার্জীর গলায় নায়িকা সংবাদ ছবি থেকে :-
“কী মিষ্টি দেখো মিষ্টি কী মিষ্টি এ সকাল
সোনা ঝরছে ঝরে পড়ছে কী মিষ্টি এ সকাল”
সোনার খাঁচা সিনেমা থেকে লতা মঙ্গেশকরের গলায় :-
বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি এ কোন অপরূপ সৃষ্টি
কত মিষ্টি মিষ্টি মিষ্টি
আমার হারিয়ে গেছে দৃষ্টি!
কিংবা উৎপলা সেনের গলায় একটা ভারী মিষ্টি আধুনিক গান :-
ছোট্ট একটা মিষ্টি মেয়ে নামটি সোনালী
আর একটা দুষ্টু ছেলে নামটি তাহার সুমন্ত
ওরা ভারী দুরন্ত ।।
সর্বত্রই মিষ্টির ছড়াছড়ি! তাই তো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ছোট্টবেলাতেই লিখে ফেলেছেন সেই ছড়াঃ
আমসত্ত্ব দুধে ফেলি তাহাতে কদলী দলি
সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে
হাপুস হুপুস শব্দ চারিদিক নিঃশব্দ
পিঁপীড়া কাঁদিয়া যায় পাতে!
ছড়াটি শুনলেই, চক্ষু মুদে কবিগুরু খাচ্ছেন পরম আনন্দে, এই রূপটি যেন চোখে ভেসে ওঠে! আহা যদি সুর দিয়ে যেতেন ছড়াটিতে, বড় জমতো!
কিন্তু শুধু ‘মিষ্টি’ কথাটি তো নয়, বাংলা গানে রস বা নানারকম মিষ্টির নামের অভাব আছে নাকি?
এবার দেখা যাক কান্তকবি শ্রী রজনীকান্ত সেন কী এক অপূর্ব গান বেঁধেছেন মিষ্টি নিয়ে! পুরাতনী কীর্তনাঙ্গ সুর যেন আরো রসময় করে তুলেছে গানটিকে।
যদি কুমড়োর মতো চালে ধরে র’ত পান্তুয়া শত শত
আর সরষের মতো হতো মিহিদানা, বুঁদিয়া বুটের মতো
বিশ মণ করে ফলতো গো প্রতি বিঘা, আমি তুলে রাখিতাম
বুঁদে মিহিদানা গোলা বেঁধে আমি তুলে রাখিতাম
বেচতাম না হে, গোলার চাবি আমি কাছে রাখিতাম, বেচতাম না হে
যদি তালের মতোন হতো ছানাবড়া, ধানের মতো চসি
আমি বুনে যে দিতাম, ধানের মতোন ছড়িয়ে ছড়িয়ে বুনে যে দিতাম
এক কাঠা দিলে দশ মণ হতো বুনে যে দিতাম
আর তরমুজ যদি রসগোল্লা হতো দেখে প্রাণ হতো খুশী
কুঁড়ে বেঁধে আমি পাহারা দিতাম, তামাক খেতাম আর পাহারা দিতাম
খ্যাকশিয়াল আর চোর তাড়াতাম, তামাক খেতাম আর পাহারা দিতাম
যেমন সরোবর মাঝে কমলের বনে শত শত পদ্মপাতা
তেমনই সরসীতে শত শত লুচি, রেখে দিতো যদি গো বিধাতা
আমি নেমে যে যেতাম, ক্ষীর সরোবর ঘন জলে আমি নেমে যে যেতাম
গামছা পরে আমি নেমে যে যেতাম
একটু চিনি যে নিতাম, সেই চিনি ফেলে দিয়ে ক্ষীর লুচি আমি মেখে যে খেতাম
যদি বিলিতি কুমড়ো হতো লেডিকেনি, পটলের মতো পুলি
আর পায়েসের গঙ্গা বয়ে যেতো পান করতাম দুহাতে তুলি
আমি ডুবে যে যেতাম, সেই সুধাতরঙ্গে ডুবে যে যেতাম
গিন্নীর কথা ভুলে ডুবে যে যেতাম,
আর উঠতাম না হে, গিন্নী ডেকে ডেকে কেঁদে মরতো তবু উঠতাম না হে
গিন্নী হাতে ধরে করতো টানাটানি তবু উঠতাম না হে
সকলি তো হবে বিজ্ঞানের বলে নাহি অসম্ভব কর্ম
শুধু এই খেদ কান্ত, আগে মরে যাবে, (আর) হবে না মানব জন্ম
কান্ত আর খেতে পাবে না, মানব জনম আর হবে না
কান্ত যে আর খেতে পাবে না
শিয়াল কি কুকুর হবে, সবাই খাবে তাকিয়ে দেখবে
শিয়াল কি কুকুর হবে, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইবে
শিয়াল কি কুকুর হবে, সবাই তাড়াহুড়ো করে খেদিয়ে দেবে
খেতে পাবে না, খেতে পাবে না, এমন মিষ্টি আর খেতে পাবে না
এহেন মিষ্টির গান এবং এতে সায়েন্স ফিকশন অর্থাৎ ভবিষ্যতের কথাও মিশে আছে, আর মিশে আছে কবির সেইদিন আর বেঁচে না থাকার দুঃখ। নাঃ, বিজ্ঞান আজও মিষ্টিকে মাঠে চাষ করে সৃষ্টি করতে পারেনি। তাই সেইদিন যখন আসবে আমরাও বেঁচে থাকবো না হয়তো। বরং আপনাদের একটু শোনাই অভিনব গানখানা শ্রদ্ধেয় শ্রী নিশীথ সাধুর কন্ঠে –
মিষ্টি মানেই হলো রস! রসে ভরপুর বা টইটুম্বুর হলে মিষ্টির স্বাদ যে দ্বিগুণ হয় তা আর কে না জানে? কখনো বা সে রস প্রেমিক বা রসিকের প্রাণে এসে লাগে চিটে গুড়ের মতো মিষ্টি হয়ে! সে আর নড়তে চড়তে পারে না। কে ভুলতে পারে লোকসঙ্গীতের আঙ্গিনায় পূর্ণদাস বাউলের গাওয়া সেই বিখ্যাত বাউল গান –
গোলেমালে গোলেমালে পীরিত কইরো না
পীরিতি কাঁঠালের আঠা লাগলে পরে ছাড়ে না
গোলেমালে গোলেমালে পীরিত কইরো না
পিরিতির রীতি জানো না
আরে করলে পীরিত হয় বিপরীত,
পরে ঘটবে যন্ত্রনা
যেমন চিটে গুড়ে পিঁপড়ে পড়লে
ও যেমন চিটে গুড়ে পিঁপড়ে পড়লে
ও পিঁপড়ে নড়তে চড়তে পারে না
গোলেমালে গোলেমালে পীরিত করো না
সেই যে মিষ্টি চিটে গুড়ে লেগে রইলো বাঙ্গালীর মন, সে আর ছাড়লো না। ও হ্যাঁ, গুড়ের কথায় মনে পড়লো আরেক বিখ্যাত লোকগান! আহা শীতকালের নলেন গুড় আর তা দিয়ে তৈরী পায়েস, গুড়ের রসগোল্লা, গুড়ের জলভরা তালশাঁস সন্দেশ, গুড়ের গন্ধ মাখা জয়নগরের মোয়া! ভাবলেই জিভে জল আসে। আর এ সবের মূলে যে খেজুরের রস তাই নিয়েই এই গান।
খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধো মন
নইলে রস গড়িয়ে গোড়া ফেটে
অকালে হবে মরণ।।
সুরসিক গাছি যারা, গাছের ওপর ওঠে তারা
করে রসাস্বাদন
গাছের জোয়ার আসিলে, গাছ কাটো কৌশলে
গাছের দড়ি ছিঁড়ে যেন পোড়ো না তলে
অরসিক গাছি যারা গাছের ওপর ওঠে তারা
ডোনার দড়ি ছিঁড়ে তাদের অকালে হয় মরণ
খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধো মন
ফিরে আসি সত্যজিতে। গুপী গাইন বাঘা বাইন সিনেমার সেই অসাধারণ গানের সিকোয়েন্স, যেখানে গুপি বাঘা হাল্লার সেনাদের বিরুদ্ধে শুন্ডির হয়ে লড়ে, কোন রক্তপাত না ঘটিয়ে শুধু গান গেয়ে যুদ্ধজয় করলো আকাশ থেকে ভূতের রাজার বরে শত শত মন্ডা মিঠাই বুভুক্ষু সৈনিকদের সামনে বৃষ্টির মতো ঝরিয়ে। সেনারা যুদ্ধ ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়লো সেই সব কিং সাইজ মন্ডা মিষ্টির ওপর আর হাল্লার খেলা হলো শেষ! আসুন শুনে নিই সেই অডিও ক্লিপ।
ওরে হাল্লা রাজার সেনা তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল
আয় আয়, আয় রে আয়, আয় রে আয়, আয় রে বোঝাই হাঁড়ি হাঁড়ি
মন্ডা মিঠাই কাঁড়ি কাঁড়ি আয় –
মিহিদানা পুলিপিঠে জিভেগজা মিঠে মিঠে
আছে যতো সেরা মিষ্টি এলো বৃষ্টি এলো বৃষ্টি এলো বৃষ্টি ওরে –
এবার চলে আসি বর্তমানে। বাঙ্গালীর সব মিষ্টির রাজা হলো রসগোল্লা। রসে টইটুম্বুর শ্বেতবর্ণ গোলাকার রসগোল্লা রাজভোগ, কমলাভোগ কিংবা আজকের বেকড রসগোল্লা যাই হোক, বাঙ্গালীর না নেই। তা এহেন রসগোল্লা নিয়ে তো শুরু হলো এক লড়াই। কোন রাজ্য পাবে এমন অপূর্ব মিষ্টি প্রথম সৃষ্টির কৃতিত্ব। বাংলা বলে আমি তো উড়িষ্যা বলে আমি। কিন্তু বাংলা তো ছাড়ার পাত্র নয়। নিজেদের এমন সম্পদ প্রথম সৃষ্টির কৃতিত্বের লড়াইতে অবশেষে বাংলার জয় হলো। সাব্যস্ত হলো যে কলকাতার নবীন চন্দ্র দাস বা নবীন ময়রাই হলেন এর সৃষ্টিকর্তা। পাওয়া গেলো প্রথম সৃষ্টির জি আই ট্যাগ। এই আবহে, ২০১৮ সালে পাভেল তৈরী করলেন নবীন চন্দ্র দাসের জীবন ও রসগোল্লা তৈরীর ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র “রসগোল্লা”। এর সঙ্গীত সৃষ্টির ভার ছিলো শ্রদ্ধেয় শ্রী কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য মহাশয়ের হাতে। কিন্তু তিনি এই কাজ সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। তাঁর মৃত্যুর পরে মুক্তি পেলেও খুব জনপ্রিয় হয় সিনেমাটি এবং তার গানগুলি, যদিও সে গানে মিষ্টির উল্লেখ আলাদা করে সেভাবে ছিলো না, যেহেতু গোটা সিনেমাটিই মিষ্টি তৈরীর ওপর। কিন্তু এই সিনেমার প্রমোশনের জন্য একটি অসাধারণ রসগোল্লা অ্যানথেম তৈরী করেন শ্রী অনুপম রায়। গানটিতে বেড়ে রসগোল্লা বন্দনা করা হয়েছে পুরাতনী ও আধুনিক মিলিয়ে। নীচে দিলাম গানটির অডিও ক্লিপ।
জীবন জটিল বড় কোথায় যে সুখ
কী খেলে জুড়াবে প্রাণ থাকবে হাসিমুখ
রহস্য জাল ছিঁড়তে জানে, সে আসল রসিক
ভালো থাকার মন্ত্র নাকি একদম বেসিক
গোল্লা গোল্লা গোল্লা গোল্লা
গোল্লা গোল্লা গোল্লা গোল্লা
কে মন্ত্র জানে এমন শক্তিশালী
যাতে রসেবশে থাকে সব বাঙ্গালী
বাঙ্গালীদের গর্ব এটা বাংলার সম্মান
গপগপিয়ে খাচ্ছে দেখো হিন্দু মুসলমান
গোল গোল গোল রসগোল্লা
গোল গোল গোল রসগোল্লা
শেষ করছি একটি গান দিয়ে যেটি নেচে গেয়ে আপাতত সারা হচ্ছে দাদামণি, বৌদিমণিরা । সেই রসে টইটুম্বুর গানটি হলো ‘রক্তে লেখা’ সিনেমাতে কবিতা কৃষ্ণমূর্তির কন্ঠে “আমি কলকাতার রসগোল্লা”। সঙ্গে নৃত্যে ছিলেন দেবশ্রী রায়।
নমস্কার, কোথায় যাচ্ছেন একটু সাবধান
কারো পকেট বড়, কারো পকেট ছোট
কেউ লম্বা বেশী, কেউ একটু খাটো
আমি বলি সবাই সাবধান
আমি কলকাতার রসগোল্লা
হো আমি কলকাতার রসগোল্লা
কখনো বালিগঞ্জে, কখনো টালিগঞ্জে
কখনো শ্যামবাজারে, কখনো বাগবাজারে
আমি বলি সবাই সাবধান
আমি কলকাতার রসগোল্লা
হো আমি কলকাতার রসগোল্লা
দাদু তুমি কি হাদু, রাখোনি আমার কোন খবর
লালু খেয়েছো নাড়ু, বুঝবে না তো রসের কদর
আমি রসগোল্লা রসে টইটুম্বুর
হো আমি রসগোল্লা রসে টইটুম্বুর
নই তো শুকনো গজা, আমি নই মোতিচুর
আমি বলি সবাই সাবধান
আমি কলকাতার রসগোল্লা
হো আমি কলকাতার রসগোল্লা
এমন মিষ্টির নামযুক্ত আরো গান মনে পড়লে কমেন্ট বক্সে জানাতে ভুলবেন না পাঠকেরা। এখন তো সুগারের বাড়বাড়ন্তে আর ডাক্তারের চোখ রাঙ্গানিতে বাঙ্গালীও তার চিরন্তন ভালোবাসা ভুলে যেতে বসেছে। অবশ্য জ্ঞানপাপী এখনো প্রচুর! যে কোন উপলক্ষ্যে মিষ্টির দোকানে ভীড় দেখলে এখনো ভিরমি খেতে হয়! এহ বাহ্য! আমাদের এই গানগুলি শুনেই সুখ!