| 12 মার্চ 2025
Categories
উৎসব সংখ্যা ১৪৩১

উৎসব সংখ্যা গল্প: গৌর বৈরাগীর রাজামশাই ও আমি । অমিতাভ দাস

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

লোকটা ঠিক এলেন ঝড়বৃষ্টির মধ্যে। সন্ধেবেলা। আকাশে মেঘ ডাকছিল গুরগুর। হাওয়া দিচ্ছিল শীতল। ধুলো উড়ছিল খানিক। লোকটা আমাদের গেটের সামনে এসে আমার নাম ধরে ডাকতেই বাইরে গেলাম। বললাম কে?

আমি রাজামশাই।

চমকে গেলাম। বললাম,  মানে, কোন রাজামশাই। এই ঝড়বাদলের সন্ধ্যায় মস্করা হচ্ছে?

মস্করা কেন হবে ভাই। আমি সত্যিই রাজামশাই। ফরাসডাঙ্গায় থাকি। সেখান থেকেই তো এলাম।

লোকটা একটু রোগাটে গড়নের। গায়ে পুরোনো আমলের পোশাক। পরনে আধ ময়লা ধুতি। গলায় একটা উত্তরীয়। কাঁচাপাকা চুল। ইয়া বড় পাকানো একটা গোঁফ। লোকটাকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে।

আরে ভাই আমি গল্পকার গৌর বৈরাগীর রাজামশাই। আমি খুব গরীব।  আমার একটু খাবার চাই। খুব খিদে পেয়েছে।

এইবার আমি চিনতে পারলাম। গৌর বৈরাগীর অনেক বইতে আমি রাজামশাইয়ের ছবি দেখেছি। বললাম, আসুন আসুন রাজামশাই। ভেতরে আসুন। কী সৌভাগ্য আমার। বলে রাজামশাইকে আমার পড়ার ঘরে এনে বসালাম।

রাজামশাই আমার সোফাতে বসলেন বেশ রাজকীয় ভঙ্গিতে।  বললেন, ভায়া তোমার সোফাটা তো বেশ খাসা হয়েছে। গদিঅলা, নরম। আমি আরাম পাচ্ছি। প্রশংসা শুনে আনন্দ  পেলাম। কিন্তু প্রকাশ করলাম না।

বললাম, আপনি বসুন। আমি ভেতর থেকে আপনার জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসি। রাজামশাই খুশি হলেন।

বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমার দক্ষিণের জানালাটা খোলাই ছিল।  দারুণ হাওয়া আসছে। তিনি আরামে চোখ বুজলেন।

 

কিছুক্ষণ পর আমি তাঁর জন্য মুড়ি আাচারের তেল দিয়ে মেখে ওপরে বাদাম আর চানাচুর ছড়িয়ে এনে টেবিলে রাখলাম। সঙ্গে এক পেয়ালা লিকার চা, চিনি ছাড়া।

রাজামশাই বললেন, একটা কাঁচা লঙ্কা হবে!

নিশ্চয়ই হবে। বলে রান্নাঘর থেকে দ্রত একটা লঙ্কা এনে দিলাম।

দেখলাম তিনি মনের আনন্দে মুড়ি মাখা খাচ্ছেন। বললেন, মুড়ি মাখাটা ভালোই হয়েছে। আমি এসব সাধারণ খাবার খেতেই পছন্দ করি। গৌরবাবু আমাকে খুব সাধারণ এক রাজামশাই হিসেবেই গড়ে তুলেছেন। তবে তোমাকে বলি,  শোনো : এককালে আমার বিরাট দাপট ছিল। বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খেতো। মন্ত্রী সেনাপতি পাত্র মিত্র সব ছিল। আজ কালের নিয়মে কিছুই নেই। বাপ-ঠাকুর্দার রাজবাড়িটা আছে বটে, তবে তা বসবাসের অযোগ্য। হয়ত কোনোদিন প্রোমোটার নিয়ে নেবে। সেখানে ফ্ল্যাট হবে। শপিং মল হবে। আরো কীসব যেন হবে শুনছিলাম।

আমি বললাম, আপনি এখন কোথায় থাকেন রাজামশাই?

ডুপ্লে প্যালেসের একটা ঘরে। কখনো কখনো গৌরবাবুর বাড়িতেও চলে যাই। ওঁর তেতলার লাইব্রেরী রুমে থাকি। তিনি জানেন। কিছু বলেন না।

বললাম, ডুপ্লে প্যালেসের কোথায় থাকেন?

কেন যে ঘরে ডুপ্লে সাহেবের বিরাট পালঙ্ক পাতা, সে ঘরে।

আমার ঠিক বিশ্বাস হল না। বলেন কী! ওটা ডুপ্লে সাহেবের…

তাতে কী, সাহেব আমার বন্ধু লোক। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে জানো! তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি গিয়েছ ওই প্যালেসে?

বললাম হ্যাঁ গিয়েছি। এই তো সেইদিন, গল্পমেলার বার্ষিক অধিবেশনে।

রাজামশাই চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন, বড় ভালো বানিয়েছ ভায়া। কতকাল পর এমন চা খেলাম। এখন দাম কত এসব চায়ের?

আমি একটু লজ্জা লজ্জা মুখে বললাম, এটা খাঁটি দার্জিলিং চা। আজ্ঞে বারোশো টাকা কেজি।

মনে শ প্রতি একশো কুড়ি। বাহ্ বেশ বেশ। ডান হাত দিয়ে নিজের পায়ের ওপর তবলার বোল তুলে বললেন, দামটা বড্ড বেশি। যেকথা বলছিলাম, ডুপ্লে সাহেবের সঙ্গে ওই বড় যে টি- টেবিলটা দেখেছ, শ্বেত পাথরের, ওখানে বসে আমরা চা সেবন করি। মাঝে মাঝে দাবা খেলাও চলে।

আমার কৌতূহল একটু বেশি।  বললাম, রাজামশাই তা কী মনে করে আজ আমার কুটিরে  আপনার পদধূলি পড়ল?

বাইরে এখনো বৃষ্টি হচ্ছে। ফাল্গুন মাসে এমন বৃষ্টি মূলত হয় না। রাজামশাই পর্দার আড়াল দিয়ে বৃষ্টি দেখছেন। এই যা, কারেন্ট চলে গেল। আমি মোমবাতি জ্বালতেই রাজামশাইয়ের চোখ দুটি আনন্দে চকচক করে উঠল। বললেন, আহা কতকাল পর মোমবাতির আলো… মনটা জুড়িয়ে গেল, চোখটাও… বলে আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, তুমি যে রাজামশাইয়ের ভক্ত। তুমি তো আমাকে পড়ো। মনে মনে অনুভব করো। যারা আমাকে ভালোবাসে আমি তাদের সঙ্গে দেখা করি। গৌরবাবু বলেছেন: রাজামশাই আপনি কেবল এই ফরাসডাঙ্গাতে আটকে থাকবেন না। দেশেবিদেশে ছড়িয়ে পড়তে হবে তো নাকি! কত লোক আপনার ভক্ত। বললাম, যেমন…

গৌরবাবু বললেন,৷ যেমন অমিতাভ। গল্প লেখে। ছোটো পত্রিকা করে। একটা সাক্ষাতকারে আপনার কথা জিজ্ঞেস করেছিল।

তাই নাকি! কী জিজ্ঞেস করেছিল। জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, জিজ্ঞেস করেছিল: আপনার গল্পে রাজামশাই কে? আমি বলে দিয়েছি, আমার গল্পে যে রাজামশাই সে হল গৌর বৈরাগী।  তাই তো আজ তোমার কাছে এলাম। দেখা করলাম। আচ্ছা ভায়া, বাইরে কি বৃষ্টি কমেছে?

বললাম, না স্যর।

রাজামশাই রাগ করলেন। বললেন, এসব স্যর-ট্যর আবার কী! বাঙালির ছেলে,  বলবে মহাশয় বা মশাই।

আমি মাথা নেড়ে বললাম, আচ্ছা।

রাজামশাই পায়ের ওপর পা তুলে বললেন, আমার বড় দুঃখ হে।

দুঃখ? কেন? জানতে চাইলাম।

আর বোলো না। আমাকে আজকাল কেউ মানে না। পাত্তা দেয় না। গরীর রাজা বলে হাসিঠাট্টা করে। আমি একদিন চলেই যাবো।

সে কী! কোথায় চলে যাবেন আপনি? জানতে।চাইলাম।

তিনি বললেন, যেদিকে দু-চোখ যায়।

আচ্ছা। তা ভালো। এই নামে গৌর বৈরাগীর একটা গল্প আছে।

আছে তো। জানি আমি। উনিই তো সে পথ দেখিয়েছেন। এখন রাজা নেই। রাজত্ব নেই। ঘোড়ার গাড়ি নেই। বাইজির নাচ নেই। ঢাল নেই। তলোয়ার নেই। গরম ভাতে গাওয়া ঘি নেই। গেয়ালে গরু নেই। গরুগুলো সব রাস্তায়। আছে কেবল রাজনীতি। সেখান না আছে রাজা,  না আছে নীতি।  জানো তো অমিতাভ,  আমার এসব একদম ভালো লাগে না।

  বলতে বলতে রাজামশাই কেমন ঝিমিয়ে পড়লেন। ক্লান্ত লাগছে তাকে।

বললাম, পরিবর্তন জীবনের ধর্ম। ওসব ভেবে মন খারাপ করবেন না। আচ্ছা রাজামশাই,  আপনি কি একটু ঠুমরি শুনবেন?

আনন্দে চকচক করে উঠল তাঁর মুখ। বললেন, বেগম আখতার আছে তোমার কাছে… বেগম আখতার…

আছে।

চালাও তো বেশ একটা গান। ওই যে ওইটে আছে, জোছনা করেছে আড়ি আসে না আমার বাড়ি…

 

 

কখন যেন বৃষ্টি  থেমে গেছে। তবে কারেন্ট এখনো আসেনি। আমার পালিত মার্জারটি বারান্দায় পাপোশের ওপর শুয়ে আরামে ঘুমোচ্ছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে বেশ রাত হয়েছে এখন। বুক সেল্ফের দিকে তাকাতেই  সাহিত্যিক গৌর বৈরাগীর গল্পের বইটির দিকে চোখ গেল। দেখলাম রাজামশাইয়ের মুখটা এখন বেশ প্রসন্ন। চোখটা বেশ উজ্জ্বল।

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত