আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিটঅনেক দিন ঘ্যান ঘ্যান করার পর মন্তরটা আজ হোয়াস্ অ্যাপে তিনি পাঠালেন। তিনি মানে তৃষ্ণাদি। চিনলে না? সাহিত্যিক তৃষ্ণা বসাক। যিনি অদ্ভুত ও আজগুবি গল্প লিখে একটা বই করে ফেললেন। মহাকাশ, অন্তরীক্ষ, স্পেস, গ্রহমানুষ, অতিমানুষ মায় ভূতেদের নিয়ে তাঁর আইডিয়ার শেষ নেই। নিরন্তর গবেষণা করে চলেছেন। সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, এত আইডিয়া কোথায় পাও? বললে, আমার মেয়ের থেকে। ও প্রচুর বিদেশী সাইন্স ফিকশনের বই পড়ে। আমাকে বলে। আমি লিখি। তুমি তো জানো প্রচুর লেখার চাপ থাকে। লিখলেই টাকা। সেদিন যেমন জগঝম্প পত্রিকা লেখা চাইল। লিখলেই কড়কড়ে পাঁচ হাজার। শুনেই আমার চোখ ছানা বড়া! লিখে তো জীবনে পাঁচ টাকাও পাইনি। পাঁচ হাজার! বললাম, তারপর কী করলে?
তৃষ্ণাদি বললেন, মেয়েকে বললাম, আইডিয়া চাই আইডিয়া চাই কন্যা। কিন্তু মেয়ের মাথায় তখন আইডিয়া ছিল না।
-তারপর?
তারপর সেই মন্তরটার কথা মনে পড়ল।
-কোন মন্তরটা?
-আরে ভাই, মঙ্গল গ্রহের ওই প্রাণীটা কী যেন নাম…
-মঙ্গলম্ বি টু।
-হ্যাঁ হ্যাঁ। ও একটা মন্তর দিয়েছিল। বিপদে পড়লে ওই মন্তরটা পড়লে মঙ্গলম্ বি টু এসে গল্পের প্লট দিয়ে যাবে।
-এসেছিল ?
–হ্যাঁ, আসবে না কেন? আমি ডেকেছি। ইয়ার্কি! গত অমাবস্যায় ডাকলাম। তিনি এলেন। প্লট বললেন। উফ্! অমিতাভ যা লিখেছি না! একবার ছাপা হোক, কেল্লা ফতে। পাঁচ হাজার টাকা। আর মঙ্গলমের কথানুযায়ী আগামী বার উপন্যাসের বরাত পাচ্ছি।
-আহা! আহা কী আনন্দ বললাম আমি। এই আনন্দে আমাকে একদিন কফি খাইয়ো দিদি। হাসির একটা ইমোজি দিয়ে বললেন তৃষ্ণাদি, ব্রাদার শুধু কফি নয়; ভীমনাগের সন্দেশ, পুঁটিরামের কচুরি, কে সি দাসে রসগোল্লা তোমাকে খাওয়াবোই। পেটে জায়গা থাকলে ভজহরিতেও যেতে পারি আমরা।
আনন্দে আবেগে তখনি আমার খিদে পেয়ে গেল। নিজেকে সামলে বললাম, দিদি ভাইটার কথাও একটু ভাবো। আমার কাছে কত পত্রিকা কল্পবিজ্ঞানের লেখা চায়, দিতে পারি না। তুমি একটু হেল্প করো প্লিজ।তৃষ্ণাদি বললে, বাইরের জার্নাল পড়’। সত্যজিৎ পড়’। কত লেখা হচ্ছে। তারপর তুমি হলে কবি। কল্পনার লেভেলটা বাড়াও। এই তো সেদিন পড়লাম তোমার গল্প! কী যেন নামটা… বললাম, ‘সবুজ রঙের পদ্ম’। কী ভালো লিখেছ! এবার একটা অবুঝ রঙের পদ্ম লেখ তো বাছা। বললাম, তোমার সব কিছুতেই মজা। আত্মারামের নতুন খাঁচার মজাগুলো আমার মধ্যে এপ্লাই করছো। গুড হিউমর সিস্টার বলতেই তৃষ্ণাদি হেসে ফেললেন। আদতে ভদ্রমহিলা গম্ভীর প্রকৃতির। কম কথা বলেন। তবে যখন বলেন নির্ভেজাল মজা নিয়েই বলেন। তাঁর সেইসব মজার মধ্যেও রহস্য থাকে।সবটা পরিষ্কার নয়। মানে তোমার ব্রেনটাকেও এপ্লাই করতে হবে। যাইহোক, যে কথা বলছিলাম, সেদিন খুব করে বললাম মন্তরটা লিখে পাঠানোর জন্য। কিছুতেই আর বলে না। হোয়াটস অ্যাপে নেই। বোঝা গেল।
আধঘন্টা পর রিপ্লাই এলো, সরি অমিতাভ ওই মন্তর দেওয়া যাবে না। অসুবিধা আছে কিছু। পাশে রাগের ইমোজি দেওয়া। আমিও উত্তর দিলাম দিতে হবে না। কথা বন্ধ। সম্পর্ক শেষ। আমার কাছে প্যাংলো আছে। ওর অনেক ক্ষমতা। সেই আমাকে আইডিয়া দেবে। তৃষ্ণাদি লিখলেন, প্যাংলোটা আবার কে?
-আমার পালিত বিড়াল। প্যাংটিটলো গ্রহ থেকে এসেছে। মানুষের ভাষায় কথা বলে। ও অনেক তথ্য দেয়।
-তথ্য দেয়? যেমন? খুব আগ্রহী হয়ে উঠল তৃষ্ণাদি।
-যেমন মঙ্গল গ্রহে যে সাহিত্য সম্মেলন হবে এই করোনা পর্ব কেটে গেলে সেখানে তোমরা চার-পাঁচজন ডাক পাবে। সে তালিকায় আমিও ছিলাম পুরুষ বলে বাদ দিয়েছে।মহিলা সাহিত্য সম্মেলন কিনা। শুনলাম তোমাদের আদলে ওঁরা মঙ্গলে সাহিত্যিক -কবি তৈরী করতে চায়। তৃষ্ণাদি এবার জানতে চাইলেন, প্যাংলো কিছু বললে, কারা কারা মঙ্গলম্ সাহিত্যম্ মিটম্-এ ডাক পেয়েছে?
-বললে তো! তুমি, ইন্দিরা মুখার্জি, শ্যামলী আচার্য, প্রিয়াঞ্জলি দেবনাথ আর কী যেন নাম ভদ্রমহিলার! ওই যে চন্দননগরে থাকে…
-কাকলি দেবনাথ। বললেন তৃষ্ণাদি।
-এই তো তুমি সব জানো। তাহলে আবার জিজ্ঞেস করা কেন? বেশ রাগ হল আমার।তৃষ্ণাদি বললেন, সব কথা এভাবে হোয়াটস্ অ্যাপে লিখে হয় না ব্রাদার। ফোন করো ফোনের ওপ্রান্ত থেকে তৃষ্ণাদি বললেন, তোমার কাছে যথার্থ-ই প্যাংলো আছে। প্যাংলো অবিশ্বাস্য রকমের মেধাবী। প্যাংলো প্রজাতির কুকুরও আছে। নাম: বুক্কন B। স্পেস নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে নামটা পেয়েছিলাম। সুইডেনের এক বিজ্ঞানী এলবার্ট রবিন স্টু-এর কাছে একটা বুক্কন B ছিল। এরা অনেক কিছু আগে থেকে জানতে পারে। কবে কোথা থেকে এদের আবির্ভাব কবে কখন এদের তিরোভাব হয় বোঝা যাবে না। যে কথা বলছিলাম, করোনা-আবহ কাটলে তোমার বাড়ি যাবো প্যাংলোকে দেখতে। খুব ইচ্ছে করছে। আচ্ছা শোনো, প্যাংলোর কথা শোনার পর মনে হচ্ছে মহাজাগতিক অনেক বিষয় তুমি জানো বা ধীরে ধীরে জানতে পারবে। তাই মন্তরটা তোমাকে দেওয়াই যায়।
আমি তো আনন্দে প্রায় নেচে উঠলাম। আরে বাবা, প্যাংলো অনেক খবর দেয় তবে কল্পলোকের নানান তথ্য বা আইডিয়াতো দেবে না। তৃষ্ণাদির থেকে মন্তরটা পেলে দু-চার পিস সাইন্স ফিকশনের গল্প লেখা যাবে। আমি তো উদগ্রীব মন্তরটা শোনার জন্য। দিদি বললে, হোয়াটস্ অ্যাপে মন্তরটা পাঠিয়েছি। তবে শোনো, এই মন্তর যখন -তখন, যেদিন-সেদিন পাঠ করলে চলবে না। অমাবস্যার গভীর রাতে পাঠ করতে হবে। অকুতভয়ে। শ্মশানে হলে খুব ভালো। সাহসে না কুলোলে নিজের বাড়ির ছাদে। আর হ্যাঁ, কাকপক্ষীতেও যেন টেন না পায়।
-ভালোই হল, কাল ভাদ্রমাসের অমাবস্যা, কাল সেই শুভদিন। বলে আনন্দে-আবেগে ফোন রেখে দিলাম।
এখন রাত ঠিক তিনটে বাজে। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। গুটিগুটি পায়ে সোজা ছাদে চলে এলাম। ছাদের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে মোট ১০৮ বার মন্তরটা অস্ফুট স্বরে পাঠ করলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি কালো ধুমসো মতো একটা লোক আমার সামনে কখন যেন এসে দাঁড়িয়েছে। মোটা গলায় বললে, কী চাই? ডেকেছ কেন ভাই?
চোখ খুলে আনন্দিত আমি বললাম , তুমি কি মঙ্গল গ্রহ থেকে এসেছ?
-এসেছি। ডাকলে তো?
-(আমি মনে মনে বলি, আহা, কী আনন্দ)
-তুমি মঙ্গলম্ বি টু?
-আজ্ঞে।
-তুমি আমাকে গল্পের আইডিয়া দিতে পারবে?
-পারব। তোমাদের এই বঙ্গের অনেক লেখককে আইডিয়া দিয়ে থাকি। সম্পূর্ণ নিখরচায়।
-আচ্ছা। কী ভালো তুমি! বললাম আমি।
সে বললে, পৃথিবীর সঙ্গে মঙ্গলের অদৃশ্য যে সেতুটা হয়েছে, তা আমিই আপাতত দেখভাল করি। এই তো সামনেই মঙ্গলম্ সাহিত্যম্ মিটম্ হবে। কয়েকজনকে নিয়ে যাচ্ছি। বললাম, ঠিক ঠিক। ওদের নিয়ে যাচ্ছ কেন? আরো কত সাহিত্যিক আছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মঙ্গলম্ বি টু বললে, এমনি এমনি নিচ্ছি না। কারণ আছে…
কী কারণ? জানতে চাইলাম আমি।
সে বলতে থাকে, ইন্দিরা মুখার্জি ভালো গল্প লেখে সত্যি। সেই সঙ্গে ওঁর স্টকে প্রচুর রান্নার রেসিপি। সেগুলি আমাদের মঙ্গল গ্রহে চাই। তারপর ধরো, শ্যামলী আচার্য- ভালো গল্প লিখলেও অসাধারণ এক বাচিক শিল্পী। ওঁর থেকে আবৃত্তি ও শ্রুতি নাটকের তালিম নেবে আমাদের মঙ্গলের ছেলেপুলেরা। প্রিয়াঞ্জলি দেবনাথ গল্প লিখলেও, আদতে আর্টিস্ট। দুর্দান্ত ছবি আঁকে। ওঁকে দিয়ে মঙ্গলে ছবি আঁকার ট্রেনিং দেওয়াবো।
এসব শুনে বেশ ভয় ভয় লাগছে। এঁদের কী ওঁরা মঙ্গলে আটকে রাখবে নাকি? আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে মঙ্গলম্ বি টু বললে, না না যা ভাবছ তা নয়। যেখানে মানুষ সেখানে কোন্দল। ওঁদের ভালোটুকু নিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়ে আবার দেব, কবে কীভাবে জানতেও পারবে না। শুনে আশ্বস্ত বোধ করি। বললাম, আর কাকলি দেবনাথ?
-হ্যাঁ । গল্পটা ভালোই লেখে । কীর্তন নিয়ে ওঁর একটা পড়াশুনো আছে। সেইটে মঙ্গলে এপ্লাই করতে চাই, তাই সাহিত্য মিটে ওঁকেও ডেকেছি।
বৃষ্টি হয়েই চলেছে। একটু একটু ভোরের আলো ফুটছে। দেখি মাথার ওপর গোলাকার ধোঁয়ার মতো একটা যন্ত্র। ভালো দেখা যায় না। বললাম , এটা কী?
-মূর্খ। এটা আমার যন্ত্র। মানে আমার বাহন। এইটে চরে আসি আর যাই। মুহূর্তে। চোখের পলকে, কল্পনাও করতে পারবে না। এই প্রথম মঙ্গলম্ বি টু আমাকে মূর্খ বলল। সে বলুক গে, ও নিজে মূর্খ! ও জানে আমি কতগুলো সাহিত্য পুরস্কার, পদক, সম্মান পেয়েছি! আমার চাই গল্পের আইডিয়া। মঙ্গলগ্রহের ভেতরের খবর। শুনেছি মৃত্যুর পর টেনিদা মঙ্গলে একটা স্পেস-রেস্টুরেন্ট খুলেছে। বললাম, একটা ইউনিক আইডিয়া দাও তো। জমিয়ে গল্প লিখি। যা কেউ কখনো লেখেননি।
মঙ্গলম্ বি টু মনে হয় বিরক্ত হল। কন্ঠস্বর বেশ গভীর। বললে, এতক্ষণ যা কথা হল তাই তো আইডিয়া মূর্খ তা নিয়ে লেখ। বলে মাথায় একটা চাটি দিয়ে অদৃশ্য হলেন। মাথার ওপর থেকে একটা লাল বলের মতো আলো ক্রমশ বৃষ্টিভেজা আকাশে মিলিয়ে গেল।
হঠাৎ বিড়ালের ম্যাও ম্যাও ডাকে চমকে উঠলাম। দেখি প্যাংলো কখন যেন ছাদে উঠে এসেছে। পায়ের কাছে বসে মুখ দিয়ে আমার পাজামা ধরে টানছে ।
কবি , গল্পকার ও প্রাবন্ধিক । জন্ম-কর্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়াতে । পড়াশুনো হাবড়া হাই স্কুলে। শ্রীচৈতন্য মহা বিদ্যালয়ে কলেজ জীবন । বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর । পেশায় গৃহশিক্ষক , নেশায় লেখক । কিছু কবিতা , ছোটগল্প , অণুগল্প ও প্রবন্ধের বই প্রকাশিত । এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ২৫টি । সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে কাব্যোপন্যাস ” পাখি-যাপনের জার্নাল ” । ২০১৯ এ প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ” বিষাদ-সুন্দরী ও লালপদ্ম ” গল্পগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন ” অনিলা দেবী সাহিত্য সম্মান ” । এছাড়াও পেয়েছেন বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ পুরস্কার , সুতরাং সাহিত্য সম্মান , টেগোর ভিলেজ সাহিত্য পুরস্কার সহ আরো কিছু পুরস্কার ও সম্মান । ১৯৯৬ সাল থেকে সম্পাদনা করে আসছেন ‘ অবগুণ্ঠন সাহিত্যপত্র’টির । প্রকাশিত হয়েছে নির্বাচিত কবিতা ” নির্বাচিত ১০০” । মূলত লিটিল ম্যাগাজিনের লেখক বলতেই গর্ববোধ করেন । তবে বেশ কিছু বানিজ্যিক কাগজেও লিখেছেন । অণুগল্পের বই ” ছক্কুমামা , কর্নেল কাপুর ও অন্যান্য গল্প ” যথেষ্ট জনপ্রিয় ।
Related