উৎসব সংখ্যা গল্প: অধীশ্বর । অম্লানকুসুম চক্রবর্তী
খয়েরি ফতুয়া আর সাদা পাজামা পরে কাল রাতে শুতে গিয়েছিলাম। ভোররাতে উঠে দেখি তা বিলকুল গায়েব। একটু শীত শীত করছিল। সিলিং ফ্যানের হাওয়ায় তো এত ঠান্ডা লাগে না। হাল্কা করে চোখ খুললাম। দেখি, ছাদ থেকে ঝোলানো ফ্যানটা স্তব্ধ। আর ঘরের নিস্তব্ধতাকে মধুরভাবে চিরে দিচ্ছে এয়ারকন্ডিশনারের হাওয়া। স্নিগ্ধ ঠান্ডায় ভরে যাচ্ছে আমার ঘর। হাল্কা চোখ ছানাবড়া হল। তড়াক করে উঠে বসলাম। আমার ঘরে তো এসি ছিল না কোনওদিন। কুড়ি হাজার টাকার মাইনেতে এসি হয় না। এ নিয়ে আমার অবশ্য কোনও অভিযোগ নেই। মাই কোম্পানি ইজ গ্রেট। উঠে বসে আরও চমকে গেলাম। দেখি, আমার গায়ে পরানো রয়েছে একটা ট্র্যাকস্যুট। তুলোর মতো মোলায়েম কাপড়। বুকের কাছে একটা ব্র্যান্ডের লোগো। এই লোগোটা আমি দেখেছি ক্রিকেটের মাঠে, টিভিতে। চার মারার পরে বল ধরার জন্য যখন ফিল্ডাররা দৌড়ায়, তখন বাউন্ডারির বাইরের দেওয়ালে, ইলেকট্রনিক ওয়ালে এই লোগোটা কিলবিল করে, ধেইধেই করে নাচে। শপিং মলে বিক্রি হতে দেখেছিলাম এমন লোগোওয়ালা ট্র্যাকস্যুট। বোতাম থেকে যে বারকোডমাখা স্টিকারটা ঝুলছিল, তাতে লেখা ছিল ফোর নাইন নাইন নাইন। শক লাগার মতো ত্যাগ করেছিলাম ওই স্টিকার ধরার সুখ। এ নিয়ে আমার অবশ্য কোনও অভিযোগ নেই। মাই কোম্পানি ইজ গ্রেট। খাটের অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে আরও তাজ্জব বনে গেলাম। দেখি, সর্বাণীর গায়ে মাখো মাখো হয়ে রয়েছে একটা সিল্কের পোশাক। বেশ বাহারি। ঝলমল করছে। সিনেমার ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে এই ধরণের পোশাক পরা মডেলরা দাঁড়িয়ে থাকে। আমি জানি, এটাকে বলে স্লিপওয়্যার। ওর রং চটে যাওয়া হলুদ ম্যাক্সিটা কই? ওটা পরেই তো কাল রাতে আমার পাশে শুয়েছিল। ওকে এই সিল্কের স্লিপওয়্যারটা দিল কে? সর্বাণী অঘোরে ঘুমোচ্ছিল। ওর দুকাঁধ ধরে ঝাঁকালাম। চিৎকার করে বললাম, “সর্বাণী, আরে অ্যাই সর্বাণী, তোমাকে এটা দিল কে?” সর্বাণী পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। আমার গলার আওয়াজ যেন ওর কানেই যায়নি। আমি আরও জোরে চিল্লিয়ে বললাম, “উত্তর দিচ্ছ না কেন? এই দামী পোশাক তোমায় দিল কে? আমায় এই ব্র্যান্ডেড ট্র্যাকস্যুট পরালো কে? ঘরে এসি বসালো কে? জানালা থেকে এই দামী, ভারি পর্দাগুলো ঝোলালো কে? কাল শুতে যাওয়ার সময়ও তো এসব ছিল না।” এত প্রশ্ন শোনার পরে সর্বাণীর চোখটা আধবোজা হল। ঘুম ভরা গলায়, ধরা গলায়, মৃদু কন্ঠে বলল, “কি যে এত উল্টোপাল্টা বকছ সকাল সকাল? আমি সিইও-র বউ না?” এতটুকু বলে সর্বাণী আবার ঘুমিয়ে পড়ল। ঘরের কোণা থেকে ভুস করে আওয়াজ হল এবার। দেখি একটা এয়ার ফ্রেশনারের অটোমেটিক মেশিন। মুহূর্তে জুঁইয়ের গন্ধ জড়িয়ে নিল ঘর।
আমি বিছানা থেকে নামলাম। বাথরুমে গেলাম। দেখি, আমার লাল-কমলা রঙের ছেঁড়া গামছাটা যে হ্যান্ডলে ঝোলানো থাকে, সেখানে শোভা পাচ্ছে দুধের মতো সাদা একটা টাওয়েল। কমোডের পাশে বালতি আর মগের জায়গায় টেলিফোন শাওয়ার। দেওয়ালে লাটাইয়ের মতো লটকে রয়েছে টিস্যু পেপারের রোল। একটু সর্ষের তেল মাখব বলে আয়নার পাশে লাগানো প্লাস্টিকের মিনি আলমারিটা খুলে চমকে গেলাম ফের। ওখানে রাখা রয়েছে নানা বিদেশি পারফিউম, বডি স্প্রে, শ্যাম্পু। আরও কি সব যেন, আমি জীবনে দেখিনি কখনও। শাওয়ারের কলগুলো পাল্টে গিয়েছে। এদিক ওদিক ঘুরিয়ে বহু চেষ্টা করলাম। এক ফোঁটা জল বের করতে পারলাম না। শেষ পর্যন্ত কল থেকে মগে করে বারবার জল নিয়ে মাথায় ঢাললাম। বেরিয়ে এসে দেখি সর্বাণী ঘুমচ্ছে তখনও। আমি আর সামলাতে পারলাম না নিজেকে। ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে এবারে ডিজে বক্সের মতো চেল্লালাম। সর্বাণীর ঘুম ভাঙল। হাত দেখালো। মুখের সামনে কংগ্রেস পার্টির চিহ্ন। বালিশের তলা থেকে একটা ছোট্ট স্প্রে বের করল। দেখলাম, তাতে লেখা আছে, ফ্রেশেন ইওর মাউথ ইনস্ট্যান্টলি। পিচিক পিচিক করে নিজের মুখে দুবার স্প্রে করল সর্বাণী। তারপর বলল, “এত উল্টোপাল্টা বকছ কেন সকাল সকাল? আমি সিইও-র বউ না?”
কি জামা প্যান্ট পরে অফিস যাব, তা বরাবর ঠিক করে দেয় সর্বাণী। আমার আর কটা পোশাকই বা আছে! স্নান করে আসার পরে দেখি, বিছানায় ভাঁজ করে রাখা আছে পোশাক। সর্বাণী নিজেই ইস্তিরি করে রাখে। কুড়ি হাজার টাকা মাইনেয় আট টাকা পার পিস কড়ি গুণে ইস্তিরি করানো পোষায় না। এ নিয়ে আমার অবশ্য কোনও অভিযোগ নেই। মাই কোম্পানি ইজ গ্রেট। আজ স্নান সেরে বেরিয়ে দেখলাম, সর্বাণী দাঁড়িয়ে আছে, হাতে হ্যাঙ্গার নিয়ে। ওর উপরে পরিপাটি করে ঝোলানো আছে ইস্তিরি করা স্যুট। খুব দামী একটা জামা। ব্র্যান্ডেড। এই ব্র্যান্ডের অ্যাম্বাসেডর আইফেল টাওয়ারের সামনে হটপ্যান্ট পরা মেয়ের সঙ্গে ছবি দেয়। আমি গেঞ্জি পরে নিয়েছিলাম অলরেডি। দু বছরের পুরনো গেঞ্জি। ঘাড়ের কাছে ছেঁড়া। যাক গে। এমনই তো পরে এসেছি এতকাল। আমি হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এগুলো কি? মস্করা হচ্ছে?” গলা আরও তুলে বললাম, “সকাল থেকে কি সব শুরু হয়েছে আজ? মামদোবাজি নাকি?” সর্বাণী লাজুক হেসে বলল, “আমি সিইও-র বউ না?”
স্যুট পরে নিজেকে জোকারের মতো লাগছিল। ড্রয়িংরুমে যেখানে লেলিনের একটা ছবি রাখা আছে বহু বছর, সেখানে দেখলাম শোভা পাচ্ছে বুর্জ খলিফার ছবি। এটাও তাহলে বদলে গিয়েছে রাতারাতি। আমি ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসলাম। স্টিলের থালার বদলে দেখি আজ সাদা সেরামিকের প্লেট। ঝকঝকে। যে সর্বাণী এই সময় প্রতিদিন মুসুরির ডাল গরম করে, ভাতের মাড় গালে, সেই সর্বাণী আমায় বলল, “কি খাবে বলো? সসেজ আছে। সালামিও আছে। আর যদি শুধু অরগানিক ফলের জুস অ্যান্ড মুসেল্লি খেতে চাও, তাও আছে।” আমি বললাম, “ভাত নেই, ভাত?” সর্বাণী বলল, “ভাত আর ডাল খেয়ে তুমি অফিস যাবে? ছিঃ। আমি সিইও-র বউ না?”
নিমরাজি হয়ে ফলের রস খাচ্ছিলাম। কামড় দিচ্ছিলাম মার্জারিনের প্রলেপ দেওয়া মাল্টিগ্রেন পাউরুটিতে। শরীরে কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। ঠিক বোঝানো যাবে না। এমন সময় একটা ফোন এলো। নম্বর অচেনা। ধরলাম। ওদিক থেকে বলল, “স্যার, গাড়ি পৌঁছ রাহা হয়। পাঁচ মিনিট লাগেগা। রেডি থাকবেন প্লিজ।” আমি বললাম, “কৌন?” ওদিক থেকে শুনতে পেলাম, “স্যার। মজাক মত কিজিয়ে। জলদি পৌঁছ রাহা হুঁ।”
স্যুট প্যান্ট টাই পরে ঘরের বাইরে এসে দেখি, দাঁড়িয়ে রয়েছে কালো মার্সিডিজ। সাদা জামা সাদা প্যান্ট পরা ড্রাইভার আমায় সেলাম ঠুকল। আমার ব্যাগটা নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিল। আমি চোখ কুঁচকোলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “কিঁউ?” ড্রাইভার বলল, “বৈঠিয়ে, সিইও স্যার।”
আমি এই গাড়িটাকে চিনি। এই গাড়িটা আমাদের সিইও স্যারের। ওঁর নাম বলরাজ বুবনা। আমি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, “বলরাজ স্যার কই?” ড্রাইভার বলল, “ও কৌন হ্যায়? মালুম নেহি।”
গাড়িতে ইউটিউবে দেখা সুইৎজারল্যান্ডের মতো ঠান্ডা। যেন বরফ পড়ছে চারদিকে। আমি বললাম, “এত ঠান্ডা কেন? টেম্পারেচর কম করুন।” ড্রাইভার বলল, “স্যার, চিল্ রহিয়ে, চিল্। আপনি সিইও না?”
মসৃণ রাস্তার বুক চিরে নিউটাউনের অফিসে পৌঁছাল কালো মার্সিডিজ। ক্যায়াবাত সিমেন্ট। আমার কোম্পানি। হেড অফিস। যে অফিসের অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের আমি সামান্য এক কেরাণী। মাইনে মাসে কুড়ি হাজার টাকা। এ নিয়ে আমার অবশ্য কোনও অভিযোগ নেই। গাড়ি দেখেই অফিসের মূল দরজা খুলে গেল নিমেষে। বাইরে থাকা সিকিউরিটি রোবটের মতো হাত ঠেকিয়ে দিল কপালে। কপালের মধ্যে হয়তো আঠা লাগানো ছিল। গাড়ি যতক্ষণ পর্যন্ত না ঢুকল, ওদের কপালে ঠেকানো হাত আর নামলই না। লবির সামনে দাঁড়াল আমার কালো গাড়ি। ড্রাইভার হন্তদন্ত হয়ে নেমে এসে গাড়ির দরজা খুলে দিল। সেলাম ঠুকল ফের। আমি গাড়ি থেকে নামলাম। আমার সামনে চকিতে হাজির হয়ে গেল সিকিউরিটি। লিফ্টের অপেক্ষায় থাকা কর্মীদের ‘হ্যাট, হ্যাট’ বলে আমায় সবার আগে এগিয়ে দিল ওরা। সেলাম ঠুকল ফের। টপ ফ্লোর, মানে এগারো তলায় পৌঁছে গেল লিফট। একটা বিরাট কাচের ঘরের সামনে দাঁড়ালাম। দরজার সামনে, কাঠের ফ্রেমে আমার নাম লেখা। আমি জানি, এটা বলরাজ বুবনার ঘর। সিকিউরিটি দরজা খুলে দিল। আমি ভিতরে গিয়ে বসলাম। আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল।
কিছুক্ষণ পরে এইচআর এর ডিরেক্টর দুবার দরজা নক করে আমার ঘরে ঢুকল। বলল, “গুডমর্নিং স্যার।” ওর সঙ্গে কথোপকথন ছিল অনেকটা এরকম।
-লিস্টটা নিয়ে এসেছি স্যার। টোটাল ১০০ জনের নাম ফাইনালাইজ করতে বলেছিলেন। মেল পাঠিয়েছি। অ্যাপ্রুভ করে দিন।
-কিসের লিস্ট?
– একি স্যার? ভুলে গেলেন? এই যে বললেন, লাথি মেরে এমপ্লয়ি বের করো। প্রফিটিবিলিটি দেখাতেই হবে এ মাসে। বললেন, গিভ দেম হার্ড কিক।
-তাই নাকি?
-ভুলে গেলেন? গত সপ্তাহে ৪২ জনের নামের তালিকা বানিয়ে এনেছিলাম। আপনি বললেন, গেট লস্ট। অন্তত ১০০ জনের নামের লিস্ট বানাও। ভুলে গেলেন?
– মনে পড়ছে না তো।
-প্লিজ অ্যাপ্রুভ, স্যার। কাল থেকেই হাটিয়ে দিই মালগুলোকে। প্রচুর কস্ট বাঁচবে।
-করব না।
-মানে, স্যার?
-আপনার মেলটা আমি ডিলিট করে দিলাম। লোক তাড়িয়ে আবার লাভ দেখানো যায় নাকি? লোকগুলো খাবে কি? ওদের পরিবারের কি হবে?
-ইজ এভরিথিং ওকে, স্যার? আপনি সুস্থ আছেন তো?
-গেট আউট।
লোকটা আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকাতে তাকাতে আমার কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
আমার কেন জানি না, খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। শরীর ভাল লাগছিল না। কিছুক্ষণ পরে দরজা নক করে দুজন ঢুকলেন। গলায় ঝোলানো কার্ডে লেখা, ভিজিটর। ওঁদের সঙ্গে কথোপকথনটা ছিল অনেকটা এ রকম।
-অবশেষে আপনার দেখা পেলাম স্যার। গত ছমাস ধরে সিইও-র সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। ক্যায়াবাত সিমেন্টের ব্যাপারই আলাদা। হাজার হাজার কোটির ব্যবসা। আমাদের মতো এনজিও-র প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করে কে আর সময় নষ্ট করে! আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ স্যার।
মনে পড়ল, কিছুক্ষণ আগে এন্ট্রান্স গেট থেকে ফোন এসেছিল। বলেছিল, “স্যার, ওই লোকগুলো আবার এসেছে। পাঠিয়ে দেবো?” আমি অত বৃত্তান্ত জানতে না চেয়েই বলে দিয়েছিলাম, “পাঠিয়ে দিন।”
-স্যার। আমরা আন্ডারপ্রিভিলেজড শিশুদের জন্য একটা স্কুল চালাই। পুরোপুরি নন প্রফিট। আমরা এই উদ্যোগটুকু না নিলে ছেলেমেয়েগুলোর হয়তো অক্ষরজ্ঞান হত না কোনওদিন।
-গ্রেট।
-আপনাকে তো আগেও ইমেলে ব্রিফ করেছিলাম, স্যার। মেলের কোনও উত্তর পাইনি। আপনি ব্যস্ত মানুষ। হয়তো পড়ার সময় পাননি।
-তাই নাকি? মনে পড়ছে না তো।
-কোনও অসুবিধা নেই স্যার। এর আগের বার যখন এসেছিলাম, আপনাদের সিকিউরিটি বলেছিল, ফের মুখ দেখালে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবো। সিইও স্যারের থেকে এমনই নির্দেশ আছে। বলেছিল, এই কোম্পানি ফায়দা করতে এসেছে। চ্যারিটি করতে নয়। তাও আজ সাহস করে এলাম। এক লক্ষ টাকা দিয়ে যদি আমাদের একটু উপকার করেন।
আমি ফোন উঠিয়ে ফিনান্স হেডকে ডাকলাম। উনি হন্তদন্ত হয়ে মিনিটখানেকের মধ্যে আমার ঘরে এলেন। আমি বললাম, “১০ লক্ষ টাকা আজ সন্ধের মধ্যে যেন ওই এনজিও-র ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার হয়ে যায়।”
ফিনান্স হেড আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়েছিলেন। বিষ ভরা ছিল ওই চাহনি। একবার মিনমিন করে বলেছিলেন, “দিস ইজ টু মাচ স্যার।”
আমার পাল্টা চাহনিতে উনি চুপ করে যান। বললেন, “অ্যাজ ইনস্ট্রাক্টেড, সন্ধের মধ্যে ইট উইল বি ডান স্যার।” কেবিনের দরজা খুলে বেরনোর সময় আমার দিকে আরও একবার ক্রূঢ়ভাবে তাকালেন ফিনান্স হেড। আমি অবশ্য তাতে থোড়াই কেয়ার করি।
একটু পরে আরও একজন লোক এলো। মাইনেপত্রের ব্যাপারটা দেখে ও। বলল, “ইনক্রিমেন্টের ইমেলটা আজ সার্কুলেট করে দেবো স্যার। আপনি বলেছিলেন, এবছর জিরো ইনক্রিমেন্ট দিতে। কোম্পানির অবস্থা ভাল নয় টয় বলে একটা টুপিটাপা দিয়ে দিতে। বলার সময় চোখ মেরেছিলেন, মনে আসে স্যার? সেটা ড্রাফট করে এনেছি। অ্যাপ্রুভ করে দিন।”
আমি বললাম, “মনে পড়ছে না তো।”
ও বলল, “সেকি স্যার। এত তাডাতাড়ি ভুলে গেলেন? সেদিনই তো কথা হল।”
আমি বললাম, “মনে পড়ছে না তো।”
লোকটা আমার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে রইল।
আমি বললাম, “ড্রাফটের প্রিন্ট আউটটা দিন।”
ও দিল।
আমি কাগজটা ছিঁড়ে, দলা পাকিয়ে টেবিলের নিচে রাখা ওয়েস্টবিনে ফেলে দিলাম। বললাম, “গেট আউট।”
বললাম, “গত দশ বছরের মধ্যে এবারে যেন সবচেয়ে বেশি ইনক্রিমেন্ট হয়। না হলে আমি টলারেট করব না।”
লোকটা বিড়বিড় করতে করতে আমার ঘর ছেড়ে চলে গেল।
আমার শরীরটা ভাল লাগছিল না।
কয়েকটা অ্যাডভার্টাইজমেন্টের প্ল্যান নাকচ করে দিলাম। মার্কেটিংয়ের থেকে আসা বলিউডের এক নতুন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর এনডোর্স করার অনুরোধের মেল ডিলিট করে দিলাম। দুজন এমপ্লয়ির চিকিৎসার জন্য ছমাসের অ্যাডভান্স স্যালারির আবেদন মঞ্জুর করে দিলাম।
সারা দিন আমার কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় ড্রাইভার এসে বলল, “ব্যাগ দিজিয়ে স্যার। ঘর যানে কা টাইম হো গ্যায়া।”
বেরনোর সময় দেখলাম, সারা অফিস আমায় জুলজুল করে দেখছে।
বলরাজ বুবনার মার্সিডিজে উঠলাম ফের। আমি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, “বলরাজ স্যার কই? আজ দেখলাম না সারাদিন। ওর ঘরেই তো বসে থাকলাম। বোর্ডে দেখি আমার নাম লেখা।”
ড্রাইভার বলল, “কৌন রাজ? মালুম নেহি।”
গাড়িতে ইউটিউবে দেখা রাশিয়ার মতো শীত। ড্রাইভারকে বললাম, “টেম্পারেচর কম করুন। এক্ষুণি।”
ড্রাইভার বলল, “চিল্ রহিয়ে স্যার, চিল্।”
বাইপাসের এক সিগনালে গাড়িটা দাঁড়াতেই ডানদিকের কাচের বাইরে থেকে উদয় হল একটা লোক। নক করছে। পয়সা চাইছে। ভিখিরি।
ড্রাইভার বলল, “আবার এসে গেছে ওই পাগলটা। ভাগতা হুঁ জলদি।”
আমি কাচ নামালাম। ওর হাতে ধরিয়ে দিলাম একশ টাকার নোট।
ড্রাইভার বলল, “ক্যায়া কর রাহা হ্যায় স্যার?”
লোকটা নোটটা ভাসিয়ে দিল হাওয়ায়। বলল, “এসব চাই না। কবে দিয়েছিস আজ অবধি? শুধু বল্, ফোট শালা। রোজ তো বলিস। আজ আবার বল্।”
আমি কাচ ওঠালাম।
লোকটা গলা চড়াল। গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রাস্তা রুখে দিল। চেল্লালো, “বল্, বল্, বল্, ফোট শালা বল্। এই গাড়ি থেকে রোজ তো বলিস।”
ট্রাফিক পুলিশ এসে লোকটাকে সরিয়ে নিয়ে গেল। কান তাতিয়ে দিচ্ছিল পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির তুমুল হর্ণধ্বনি।
বাড়ি ফিরে দেখলাম, চ্যানেলে চ্যানেলে ক্যায়াবাত সিমেন্টের খবর। ওই এনজিও-র প্রতিনিধিরা সাংবাদিক সম্মেলন করে সিইও-র খুব সুখ্যাতি করেছেন। সর্বাণী আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি সিইও-র বউ না?”
কেন জানি না, আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। ঢেকুর উঠছিল। ঢেকুরে পোড়া গন্ধ।
সর্বাণী বলল, “কি খাবে? হট ডগ না শুধু লো ক্যালরি ইম্পোর্টেড ডেজার্ট?”
আমি চুপ করে রইলাম। কিছু খেতে ইচ্ছে করছিল না। কেমন যেন লাগছিল। আবার ঢেকুর তুললাম। ঢেকুরে পোড়া গন্ধ।
গলিয়ে নিলাম ট্র্যাকস্যুট। সর্বাণী গলিয়ে নিল সিল্কের স্লিপওয়্যার। এসির বাতাস খেলছিল জুঁইয়ের গন্ধমেশানো ঘরে। আজ গন্ধটা একটু কম। ঘুমিয়ে পড়লাম।
কটা হবে তখন? তিনটে না সোয়া তিনটে? তীব্র শব্দে বেজে উঠল আমার মোবাইল। ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। মেসেজ আসার আওয়াজ তো এত ভয়ংকর জোরে হয় না। ল্যাপটপেরও আলো জ্বলে উঠল হঠাৎ। মোবাইলের মেসেজে লেখা—সিস্টেম এরর। সরি ফর দ্য ইনকনভেনিয়েন্স। ল্যাপটপের ইমেল সফটওয়্যার খুলে গেল স্বয়ংক্রিয়ভাবে। রক্ত লাল ফন্টে লেখা, ‘সিস্টেম এরর। সরি ফর দ্য ইনকনভেনিয়েন্স।’ লেখাটা বড় হতে হতে স্ক্রিন চৌচির করে বেরিয়ে গেল। “এসব হচ্ছেটা কি” বলে চিৎকার করে উঠলাম আমি। খুব গরম লাগছিল। সিলিং ফ্যানটা ঘুরছে জোরে। হাওয়া হচ্ছে না তাও। ঘরের মধ্যে বোঁটকা গন্ধ। সর্বাণী ওর রং চটে যাওয়া হলুদ ম্যাক্সিটা পরে ছটফট করছিল গরমে। আমার গলার আওয়াজে উঠে বসল। আমি বাথরুমে গেলাম। খয়েরি ফতুয়া আর সাদা পাজামাটা খুলে ফেললাম। স্নান করলাম। লাল কমলা রঙের ছেঁড়া গামছাটা দিয়ে গা মুছলাম।
বাড়ির জানলার কাচে একটা ঢিল পড়ল হঠাৎ। কাচ ভেঙে গেল। ভাঙা জায়গাটা দিয়ে ফের উড়ে এল একটা পাথরের চাঁই। বাইরে কোলাহল। তুমুল কোলাহল। দেখি সারসের মতো গলা উঁচিয়ে আমার জানলার দিকে তাকিয়ে রয়েছে বেশ কয়েকটা লোক। আরে! ওই তো বলরাজ বুবনা। ওই তো এইচআর-এর ডিরেক্টর। ওই তো ফিনান্সের লোকটা। ওরা সবাই রাস্তা থেকে ইঁট তুলে, পাথর তুলে তাক করছে আমার জানালার দিকে। যে কথাগুলো উড়ে আসছিল তা অনেকটা এরকম।
-শালা, কোম্পানি বেচ দিয়া।
-ফোট্ শালা।
-এনজিওকে দান করেছে। মার শালাকে মার।
-মেডিক্যালে অ্যাডভান্স দিয়েছে! ভাগা দো ইসকো।
একটা ভারী পাথর ঠাঁই করে লাগল আমার কপালে। কপাল থেকে বেরিয়ে পড়ল অনেকগুলো তার। বেরিয়ে ঝুলতে লাগল। সর্বাণীর ডান চোখের নিচে গাল ছেঁচড়ে চলে গেল আরও একটা পাথর। বেরিয়ে পড়ল তার।
অথচ ঠিক এক দিন আগে শেভ করতে গিয়ে চিবুকে কেটে গিয়েছিল আমার। রক্ত দেখেছিল এক দিনের অধীশ্বর। সিইও। বহুকাল পরে।
পরের দিন সকালে একটা ইন্টারনাল অ্যানাউন্সমেন্ট প্রকাশ করে ক্যায়াবাত সিমেন্ট। সুযোগ যখন পাওয়াই গেল, পুরোটা তুলে দেওয়া যাক। হুবহু।
‘আমাদের কর্মীদের মধ্যে সফটওয়্যার আপগ্রেড করার ক্ষেত্রে গতকাল কিছু গুরুতর ভুল হয়ে যাওয়ার কারণে ক্যায়াবাত সিমেন্ট কর্তৃপক্ষ লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী। আপনারা অবগত আছেন, আমাদের নিউটাউনের মুখ্য কার্যালয়ের সব কর্মীই রোবট। কোম্পানির পলিসি অনুযায়ী আমরা মানুষদের চাকরি দিয়ে তাঁদের কৃত্রিম মেধাসম্পন্ন রোবটে কনভার্ট করে দিই, সপরিবারে। এর ফলে উৎপাদনশীলতা বেড়ে যায় বহুগুণ। অত্যাধুনিক এই প্রযুক্তিতে কর্মীরা আপাতভাবে মানুষই থাকেন। তবে তাঁদের মনন ও মেধা সম্পূর্ণভাবে পরিচালনা করে ক্যায়াবাত সার্ভার। সফটওয়্যার আপগ্রেডেশন চলাকালীন কিছু সিস্টেম এরর দেখা যাওয়ায় এক জনের জন্য প্রযোজ্য কোড অন্য কর্মীর সার্কিটে ঢুকে যায়। ভুল কোডের স্রোত কমবেশি ছড়িয়ে পড়ে সংস্থার আনাচে কানাচে, সর্বত্র। এর ফলে সংস্থার দৈনিক রুটিন সার্বিকভাবে ব্যাহত হয়। কোম্পানির মিশন ও ভিশন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সব চেয়ে আশঙ্কার বিষয় হল, প্রোগ্রামিংয়ের ভুলে কিছু কর্মচারী ক্যায়াবাত কপিরাইটেড রোবটমন থেকে মানুষমনের দিকে যাত্রা শুরু করে দিয়েছিলেন। হ্যালুসিনেটেড অবস্থায় তাঁদের কয়েকজনের দিনের অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়। আমরা লজ্জিত। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করে ভুল সংশোধন করে দিয়েছি। ভবিষ্যতে এমনটি আর না ঘটার জন্য আমরা বদ্ধপরিকর। ধন্যবাদ।’
মধ্য তিরিশের যাত্রী। জন্ম ও বড় হওয়া সবই কলকাতায়। কলেজ জীবন থেকে লেখালেখি। গল্পের থেকে ফিচার ও উত্তর সম্পাদকীয় লিখেছেন বেশি। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই। বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত।