| 10 অক্টোবর 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা ১৪৩১

উৎসব সংখ্যা গল্প: অতীন্দ্রিয় বর্ণমালা। অনিতা অগ্নিহোত্রী 

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
 
 
ল্যাপটপের ফাঁকা স্ক্রীণ ঋষভের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রত্যেক দিন সকালে এই হয়। লেখা আরম্ভ করার আগের সময়টা ভয়ানক। ইচ্ছে করেনা, তবু লিখতে হয়। রোজ কিছু না কিছু।ল্যাপটপ অন করে বসলে মনে হয় মাথার মধ্যেটা পুরো ফাঁকা। যেন ধোঁওয়া র কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে ভিতর থেকে।লেখক জীবনে যত্নের ত্রুটি নেই যদিও। স্ত্রী বেলা পর্যন্ত ঘুমোন । ভোরের গৃহ শ্রমিক রুণা এসে প্রথমে গরম জল লেবু রাখে টেবিলে।তারপর রাতের বাসন মাজা শেষ হলে এক কাপ দার্জিলিং চা আর দুটো ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুট। এ বাড়িতে নীরস বিস্বাদ এই বিস্কুট ছাড়া অফিসিয়ালি কিছু আসেনা। রুণা কে পয়সা দিলে সে ক্রীম বিস্কুট এনে দেয়। সে বিস্কুট প্রাণভোমরার মত লুকোন থাকে রান্না ঘরের গহনে এক কৌটোয়। রঞ্জনা জানতে পারেন না। কিন্তু রুণা কে ঘষে মেজে নিজেদের উপযুক্ত করে রাখতে তাঁর চেষ্টার শেষ নেই। তাকে বলা হয়েছে পরিষ্কার জামাকাপড় পরে চান করে আসতে। কাপড় কাচার সাবান দেওয়া হয় প্রতিমাসে। চাকরি টিঁকিয়ে রাখার জন্য রুণা প্রাণপণে সব করে। মাস্ক ও পরে অবিচল নিষ্ঠায়।
 
তবু সাতসকালেই  তার গায়ের বাসি গন্ধ ঋষভের নাকে এসে লাগে, দার্জিলিং চায়ের গন্ধ কে টপকে।গন্ধ। গরীবের গায়ের গন্ধের সন্দেহ নিয়ে কোরিয়ার প্যারাসাইট ছবিতে খুন খারাপি হয়ে গেল।বাংলায় এসব সম্ভব নয়। সব কিছুই ছা পোষা, নিভু নিভু এই বাংলা বাজারে। দুবছরে তিনটে রেসিডেন্সি নিয়ে কেবল ইংরেজি নয়, হিন্দী উপন্যাস ও লেখা যায়,  গীতাঞ্জলী শ্রী করে দেখিয়েছেন। বাংলায় সারা বছর কামার শালের হাপরের মত হাঁফাতে হয় কেবল নামটুকু ভাসিয়ে রাখতে।কেবল চেনা পাঠক নয়, পাড়া পড়শি এমনকি প্রকাশক রাও জানতে চান, কোথায় লিখলেন এবার? পুজোয়?  ছাপা বইয়ের সঙ্গে বছর ভরের লেখালিখির টিকি জোড়া। রোজ লিখতে ইচ্ছে করেনা ঋষভের। একটা দুটো অনুবাদের ইন্টারন্যাশনাল রিলিজ, একটা ম্যান বুকার পেলেই তিনি রোজকার এই শ্রমদান ছেড়ে দেবেন। রুণার বাসন মাজাও এর চেয়ে ভালো। 
 
বারান্দায় বেরিয়ে এসে সকালের আলোর স্পর্শ নিতে চাইলেন ঋষভ। নাকি সামনের অসংখ্য বাড়ির অরণ্য থেকে একটি বাড়ি কে খুঁজতে চান। ন তলা থেকে দেখা যায় শহর তার নতুন দিন নিয়ে তাকিয়ে আছে বাঙালি লেখকের দিকে।বিশাল জমির উপর প্লট তৈরি করে বিক্রি হয়ে চলেছে অনন্ত কাল ধরে। এখন কোন ফাঁকা জমি চোখে পড়েনা। তাকালেই গোলমাল হয়ে  যায়। মাঝের তিনটে সারির পর, অনেক গুলো গাছ। তারপর ডানদিকের বাড়ি। না ওটা নয়, তার পাশের টা। তিন তলার ছাত টা দেখা যায়, ঘাড় অনেকটা বাঁকালে।  বাঁকানোর কি দরকার। যার বাড়ি সে-ই  তো খুঁজে পায়নি, হি হি করে হেসে গড়িয়ে পড়ছিল।আসলে, ভিতরে থাকলে বাইরে থেকে চেনা যায়না। 
মিভান। মানে সূর্যের আলো। 
পদবী নেই? 
না:।
কোন ভাষা? 
আজ থেকে বাংলা হল।
এত হাসলে সিরিয়াস লেখক হওয়া সম্ভব? 
কেন আমি সিরিয়াস নই? আমার লেখা পড়ছেন তো! 
হ্যাঁ, সে তো রোজই। 
একটু দীর্ঘনিশ্বাস চেপে মোবাইল চেক করেন ঋষভ। টুং শব্দে বুঝে গেছেন, এসে গেছে আজ সকালের কবিতা। আগে দুএক বার জানতে চেয়েছেন। 
আজকের? 
এখন আর প্রশ্ন করেন না। ইমোজি পাঠিয়ে দেন। 
 
 
গদ্যের ফাঁকে রোজই কবিতা লেখে মিভান। অজস্র। কোনও টা ঢিলের মত গায়ে এসে বসে, কোনও টা প্রজাপতির মত, উড়তে উড়তে আকাশে মিলিয়ে যায়। মিভানের লেখার টেবিল নেই। সোফার একধারে বসে কোলে ল্যাপটপ নিয়ে সে লেখে নানা গেরিলা পদ্ধতিতে।মিক্সিতে পোস্তবাটা দিয়ে এসে, আলুর খোসা ছাড়িয়ে জলে ডুবিয়ে রেখে। সব সময় ফোন ধরতে পারেনা। আমি তোমাকে ফোন করেছিলাম। ঋষভ গম্ভীর হয়ে বলেন। আঠেরো বছরের ছোট একটা মেয়ের কাছে অভিমান দেখানো, সে এক কলংক।
বুঝেছি। ভাতের ফ্যান গালছিলাম। দেরি হলে ভাত গোলা পাকিয়ে যেত। 
 
এজমালির বাড়ির নানা কাণ্ডকারখানায় ডুবে থাকে মিভান। আর তার বর সুপ্রতীক, ছেলে নয়ন। রান্না ঘরের কিছুটা কাজ তার জন্য বরাদ্দ। আর বরাদ্দ সারা বাড়ির জন্য রুটিন কেনা কাটা। মিভান কে চিনতেন না ঋষভ । মানে , চেনার কোন কারণ ছিলনা। কমার্শিয়াল কাগজের সহ সম্পাদক বিষাণ বসু কে বাই পাস থেকে তুলে বাড়ি যাচ্ছিলেন, মোড়ের মাথায় বসু বলে উঠলেন,আরে থামো তো একটু। এদের পাড়ায় এসেছ তুমি! আচ্ছা। গাড়ির কাঁচ নামিয়ে ভিতরে বসেই পরিচয় হয়। 
ঋষভের মনে হয়েছিল, নামা উচিত। কিন্তু তাঁরা দুজনেই ভারিক্কি, সম্ভ্রম উদ্রেক কারি ব্যক্তিত্ব। মিভান বলে ঝাঁকড়া চুলো একটা মেয়ে , যাকে দেখে মনে হয় সদ্য কলেজ পেরোনো, তার সঙ্গে একটা বছর সাতেকের ছেলে,অন্য হাতে একটা পলিথিনের প্যাকেট, আর হ্যাঁ, একটা কাঠির ঝাঁটা। বসু বলেন, আমরা একটু আড্ডা দেব, এখন,চা খাব। তুমি আসতে পারো।অবিশ্যি যদি ফ্রি থাকো।
 
 ঝাঁটা শুদ্ধু হাত যেন মশাল ধরে আছে এমন ভাবে তুলে খিলখিল করে হেসে ছিল যুবতী। ওর একটা জামা বদলাতে যাচ্ছিলাম। রাস্তায় এটা পেয়ে গেলাম,মজবুত কাঠি। আলু র দোকানে রেখে বাস ধরব। ভীষণ অ্যান্টি ক্লাইম্যাকস্ মনে হয়েছিল ঋষভের। কাঠির ঝাঁটা কে যে ফ্যাশন স্টেটমেন্ট এর মত ব্যবহার করতে পারে, সে তো ডেঞ্জারাস!  
মেয়েটা কবিতা লিখত, কলেজ লাইফ থেকে। আমি যখন’ ভোরের কাগজ ‘ এর সাহিত্যর পাতা দেখতাম, বুঝলে, মাঝে মাঝেই পাঠাত। আর আমি বন্ধ খাম না খুলেই ফেরৎ পাঠিয়ে দিতাম। ঋষভের আনা অরগ্যানিক দার্জিলিং চায়ে চুমুক দিয়ে বলেছিল বিষাণ বোস।
 ভালো লিখতনা? 
ঋষভ যেন নিজেই ঈষৎ লজ্জিত। 
ভালো, খুব ব্রাইট। কিন্তু তুমি একজন নবীন কবিকে প্রতিষ্ঠা দেবে, কিছু নেবেনা, ঋষভ? তুমি বুঝবেনা, প্রাইভেট অফিসে কাজ করেছ। লিটারারি ফেম এর প্রাইস ট্যাগ আছে। 
বিষাণ কে বছর দশেক চেনেন ঋষভ। একবার মাঝরাতের পর কোনও মেয়ে সাংবাদিক কে গোলমেলে মেসেজ পাঠাতে গিয়ে প্রায় স্যাকড হয়ে গেছিলেন।হননি , কারণ, কেবল সম্পাদক নয়,  কবি হিসেবে তাঁর দুর্ভেদ্য সুনাম ঢাল হয়ে দাঁড়ায়।  
মিভান বলে ওই মেয়ে টাকে কফি খেতে ডেকেছিলেন না মুভি দেখতে? তখনও ঝুলঝাড়া কিংবা স্টোভের সলতের গোছা এমন কিছু হাতে ছিল নাকি ওর? হাসতে হাসতে রিফিউজ করেছিল? আর বিষাণের বুক জুড়ে জ্বালা, কেবল জ্বালা! 
তার প্রতিশোধ বন্ধ খাম।না পড়া আর অমনোনীত লেখার স্তূপ। 
একবারই এই ন’ তলায় এসেছে মিভান। দেখি নিজেদের বাড়িটা , খুঁজে পাই কিনা। রঞ্জনাকে বাড়ির গাছের আম দিয়েছে পাঁচটা। ওর মাথার চুলে বৃষ্টির গুঁড়ো, চুড়িদারের নীচে ভেজা। নানা ভাবে চেষ্টা করেও নিজের বাড়িটা খুঁজে পেলনা মিভান। আপনি চাইলেই  কিন্তু আমাকে দেখতে পাবেন, শীতকালে আমি বড়ি দিই ছাতে, গরমে শুকনো লংকা শুকোতে দিই।আমাদের ছাত ঘেঁষে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে। চৈত্রে তার পাপড়ি  উড়ে আসে ছাতে— আসবেন দেখাব। মিভান সব ঋতু, রং, রোদ, বর্ষা এনজয় করে। তার জীবনে যেন নিত্য উৎসব। সে লেখে কিন্তু লেখা টা তার কোমরের শেকল নয়। যেন ইচ্ছে করলেই ল্যাপটপ বন্ধ করে কোথাও চলে যেতে পারে  সব ছেড়ে দিয়ে। 
‘ভোরের কাগজে’ তুমি আর লেখ না আজকাল? কেবল লিটল ম্যাগাজিন, অন লাইনে লিখে — হয়? বলেই মনে হল একটা ধাক্কা দিলেন মেয়েটাকে। এরকম না বললেই হত। মিভান গালে আঙুল ঠেকিয়ে  ভেবে চিন্তে বলল, ওরা আমার লেখা ফেরৎ পাঠাচ্ছিল, অথচ ভালো লেখা। রিফিউজ করা ওদের খেলা হয়ে যাচ্ছিল। তাই , বন্ধ করে দিলাম লেখা পাঠানো। এখন যারা  ভালোবেসে চায়, তাদের দিই। কি আর হবে বলুন। লিখে কিছু হয়? না লিখলে কষ্ট হয়, তাই লেখা।
 
‘ভোরের কাগজ’ এ বিষাণ নেই, তবু মাঝে মধ্যেই লেখা ছাপা হয় ঋষভের। কিন্তু তিনি কি সুখী? পরের লেখা টা যদি ছাপা না হয়, সেই টেনশনে কাটে মাঝখানের কয়েকটা মাস। যদি ওরা না লিখতে বলে আর? তখন কি করবেন ঋষভ? না লিখলে এখন আর কষ্ট হয় না ঋষভের।অনেক দিন আগে হত। এখন লেখা কেউ না চাইলে কষ্ট হয়। কিন্তু লেখার টেবিলে বসে দেখেন, কিছুই  মনে আসছেনা। মাথার ভিতর ধোঁওয়ার কুণ্ডলী।অথচ লিখবেন বলে প্রাইভেট কোম্পানীর চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।  সকালের দিকে শ্রেয়সী পত্রিকার ফোন আসে। অন লাইন । অনাবাসী দের কাগজ, ভালো টাকা দেয়। পাঁচ হাজার একটা গল্পের জন্য। কে দেয়? কিন্তু পারছেন না, ঋষভ জাস্ট পারছেন না। রুণার শরীরের বাসি গন্ধ ছাড়িয়ে তাঁর মন চায়ের কাপ পর্যন্তই যেতে পারছেনা। যদি একটা ছাতের কথা ভাবা যায়, যেখানে পিতলের থালায় বসানো আধ কাঁচা বড়ির উপর চাঁদের আলো এসে পড়েছে—
-আচ্ছা , এবার যদি না লিখি, আর ভালো লাগছেনা—-
শ্রেয়সীর কলকাতা এডিটর ধ্রুব দাঁ হাহাকার করে ওঠে। কি বলছেন রিষুদা, মাইরি আমাদের জীবন নিয়ে খেলবেন না। আমেরিকায় চীফ এডিটরের কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে যাবে, দাদা। 
মিভান না লিখলে কারো জীবন নিয়ে খেলা হয়না। কিন্তু সে লিখতেই থাকে, কবিতা, গল্প,উপন্যাস— লেখে আর ছিন্ন পাতার তরণীর মত লেখা ভাসায়। ওর নতুন লেখা সব ঝাঁপিয়ে এসে ব্লক করে দেয় ঋষভের মোবাইলের যাবতীয় স্পেস। ঋষভ,বন্ধ্যা পুরুষ,অসহায় ভাবে বসে দেখেন।ডিলিট করতে ভয় পান। যেন মিভান দেখে ফেলবে। ওর হাসি ছিটকে আসবে ঋষভের গায়ে।
 
 অনেক রাতে ঘুম ভেঙে যায় এক শ্রাবণে। ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যে ঘুম এসেছিল কখন যেন। বর্ষণ শেষ হতেই স্বপ্ন ভেঙে গেছে।পুজোর লেখার সময় প্রায় শেষ।  ঘুম আসছেনা। সার সার লাইন দিয়ে লেভেল ক্রসিঙে  একটু ও না নড়া, বরফ শীতল, দাঁড়িয়ে থাকা লেখারা—- নাকি গত দুদিন মোবাইলের ভিতর  জমে ওঠা আকন্ঠ নীরবতা? কোন টার চাপ বেশি দু:সহ?
 মিভান বলে গেছে , এখন দুদিন আর কিছু পাঠাচ্ছিনা। শান্তিনিকেতন যাচ্ছি। একটা আলপনা ওয়র্কশপ আছে। 
—তুমি আলপনা শিখবে?
— হ্যাঁ। এসে পুরো ছাদে আলপনা দেব। আমি আর নয়ন। অদ্ভুত । 
বাইরে বারান্দায়  এসে চাঁদটাকে দেখতে পান ঋষভ। পাশের হাইরাইজের জানলা থেকে খসে, গলে পড়েছে, হলুদ অপার্থিব এক  ব্যাপার। যেন বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় ছিল। মেঘ ফুটো করে বেরিয়ে এসেছে। ঘুমন্ত বাড়িগুলি যেন অচিন নগরের সারি সারি খিলান। রাজকন্যার অপেক্ষায় আছে। ম্লান জ্যোৎস্নায় চোখ চলেনা বেশিদূর। ডান দিকে ঝুঁকে দেখলে সেই মাধবীলতার ঝাঁপানের পর তিন তলা বাড়ি, তার ছাদ। ছাদটা ধূ ধূ নির্জনতার মত খালি।একদিন এই  পুরো ছাত জুড়ে  আলপনা  আঁকা হবে। সেই সব বঙ্কিম রেখা রা কি ধরা পড়বে’ নাসা ‘  র ক্যামেরায়? আকাশ পেরোতে পেরোতে বালি হাঁসের দল  দেখবে সেই অতীন্দ্রিয় বর্ণমালা? 
খুব  কষ্ট হচ্ছে ঋষভের বুকের মধ্যে। এটাই কি লিখতে না পারার কষ্ট? মন্ত্রমুগ্ধের মত নিজের লেখার ঘরে ফিরে আসেন কিন্তু পাওয়ার অন করেন না স্ক্রীণের। কাগজ আর কলম  তুলে নিয়ে বসে যান ঋষভ। হাতে লেখেন না আজ কত  বছর!  সবাই তাড়াতাড়ি লেখা চায়! সবাই লিখতে বলে কিন্তু কেউ পড়ে দেখেনা। কম্পোজের লোকেরাও  হাতের লেখা পড়তে ভুলে গেছে।আজ তাঁকে লিখতেই হবে অন্তত: একটা লাইন। একজন কে পাঠাতে হবে ভোর হওয়ার আগে।।
error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত