| 6 অক্টোবর 2024
Categories
দুই বাংলার গল্প সংখ্যা

কৃষ্ণগোপাল ও সাদাগাছ

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comকৃষ্ণগোপাল গৃহী হয়ে ফিরে এলে আমরা তাকে দেখতে গেলাম। সন্ন্যাস আশ্রমে কী যেন এক বিকট নাম নিয়েছিলেন। তখন নাকি তার বিরাট দাড়ি বিরাট চুল। তিনখন্ড গেরুয়া সম্বল। তার এককোনা ঝোলার মতো গিঁট বাঁধা। কাঁধের বাঁ দিকে ঝুলত। এখন গেরুয়ার সাথে সে সব ত্যাগ করে সাদাসিধে কৃষ্ণগোপাল হয়ে ফিরেছেন। পরনে সুতির হালকা পাড়ের ধুতি ও ঘিয়ে ফতুয়া। বাইরের ঘরে তক্তপোষের ওপর বসে ছিলেন। তক্তপোষই। আজকাল বাড়িতে আর ফ্ল্যাটে  যেরকম ডিভান কি সোফা, যাতে রাতে টেনে বিছানাও করা যায়, দেখা যায়, সেরকম নয়। চারখানা পায়ার তলায় দুখান করে আটখানা ইঁট দিয়ে উঁচু করা। সে ইঁটের গায়ে বহুকাল একজায়গায় চেপে বসে থাকার কারনে শ্যাওলাটে স্তর। বহুদিন থেকে ন্যাতার মোছা খেয়ে খেয়ে নিচের ইঁটদুটি খানিক বিবর্ণতা পেয়েছে। তাদের এবড়ো খেবড়ো ভাবটিও খানিকটা গেছে। তলায় ইঁট বসিয়ে উঁচু করে দেওয়ায় তক্তাপোষের তলার ঐশ্বর্য্য দৃশ্যমান। ঐশ্বর্য্যই বটে! কেননা ঘরের ভেতরে ভীড়ের চাপে রীতিমত শ্বাসকষ্ট উদ্রেক হলেও, এই এত পেছনে প্রায় বেরিয়ে যাওয়ার দরজার কাছ থেকেও তক্তপোষের নিচে অন্তঃত দু-তিনখানি আচারের বয়াম দৃশ্যমান। তার মধ্যে একখানি নিশ্চিতভাবে লেবুর। এছাড়াও ভালো করে খেয়াল করলে বা তক্তপোষের তলাকার অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ সইয়ে আনলে দেখা যাবে, সেখানে শিশি-বয়াম বাসন-কোসন হাতাখুন্তির রীতিমত এক সুচারু রাজসভা। প্রথমে বেশ খানিকটা গোলমতন জায়গা ফাঁকা। ভালো করে নিয়মিত ল্যাপাপোঁছা করা হয়, তা বোঝা যায়। ভাবনা আর একটু গাঢ় হলে কল্পনা করে নেওয়া যায়, মহিলাটি  ওখানে বসেই মাথা নিচু ও অস্বস্তিকর রকমের বাঁকানো অবস্থায় বাসন-কোসন শিশি-বয়ামের এই রাজত্বকে যথাস্থানে বহাল রাখার জন্য যত্নবান হন। সেই যত্ন তাকে ওই খাটের তলে একখানা কাঠের তক্তা আবারও খানদুয়েক  করে ইঁটের ওপরে চাপিয়ে একধাপ উঁচু করে জিনিসপত্তর রাখিয়েছে। সে যত্নের কারন স্থানাভাব হতে পারে না। অন্তত একমাত্র কারন তো নয়ই।

কৃষ্ণগোপালের কাছাকাছি যাওয়া যায় না। সকাল বিকেল ঘোর দুপুর, যখনই যাও অন্তত আট-দশটি নানা বয়সী  নারীপুরুষ তাকে ঘিরে আছে। তারা তাঁর পায়ের কাছে বসে আছে। তারা তাঁর কোলের কাছে কিলবিল করছে। মহিলারা মাথার আঁচল ঠিক করছে। মাসীমারা বাহ্যজ্ঞান রহিত।

কৃষ্ণগোপাল তক্তাপোষের ওপর বসে থাকেন। আগের চেয়ে কৃশ হয়েছেন। যেন শরীর থেকে সংসারের বাড়তি তেলটুকু ঝরে গেছে। মুখের হাতের চামড়া খসখসেও নয় তেলতেলেও নয়। আমরা এখান থেকে তাঁকে প্রায় স্বচ্ছ দেখি। তাঁর ফিনফিনে ফতুয়ার মতন স্বচ্ছ। যার ভেতর দিয়ে তাঁর বুকের কাঁচাপাকা লোম দেখা যায়। কুঁচকে আসা দেহ ত্বকের আভাষ পাওয়া যায়। মাথার ওপর ফ্যান ঘোরে। সেই ফ্যানের নিচে বসে তাঁর মাথার পাতলা হয়ে আসা পাকা চুলের গুছি ওড়ে। ওড়ে তাঁর ফতুয়া। প্রায় স্বচ্ছ ফতুয়ার প্রান্ত। পেন্ডুলামের মতন, আদুরে কুকুরের লোমশ সাদা লেজের মতন তক্তপোষের প্রান্তে দোলে তাঁর ধুতির কোঁচা। তার সাথে তিনি ও যেন ফিনফিনে হয়ে উড়তে থাকেন। এপাশ ওপাশ হাওয়ার মর্জি মাফিক দুলতে থাকেন। আর হাসেন। তাঁকে আমরা বসে থাকা অবস্থায় হাসতে দেখি। তিনি যখন আমাদের সকলের অবিরাম কথার গলগল গালে হাত দিয়ে বড় বড় চোখ মেলে শোনেন আর তাঁর কনুইটা ভর দেওয়া থাকে নিজের থাইয়ে বা কোনও একটা বালিসে, তখন তাঁর মুখ হাসে না, তাঁর গোটা শরীর, তাঁর শরীরের চারপাশের বাতাস, ঘরের জানালা দেওয়াল, দেওয়ালে টাঙানো ফুলের টবের ছবি, সব সব হাসি হয়ে যায়। সেই হাসি আমাদের শরীরে ঢোকে আর বেরোয়। আমরা বসে থাকি। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ হাতজোড় করে থাকে। কেউ উপুড় হয়ে প্রণাম থেকে উঠে বসেছে সদ্য। কেউ সামনে যাবার জন্যে উসখুস করছে। কেউ বা ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগোচ্ছে। আমাদের সকলের মধ্যে হাসি ঢোকে আর বেরোয়। আমরা বুঝতে পারি না।

কখনও কখনও গিয়ে দেখেছি, কৃষ্ণগোপালের পাশে তাঁর ছেলে বসে আছে। নিতান্ত বালক। কৃষ্ণগোপাল যখন গৃহত্যাগ করেন তখন এ বোধহয় চিৎ থেকে উপুড় হতে শেখেনি। আজ এতদিন পরে বাবা নামক গল্পের বাসিন্দাটি তার সামনে রক্তমাংসে এসে উপস্থিত হওয়াতে সে যে খুব একটা স্বস্তি পেয়েছে এমনটা মনে হয়না। সে উসখুস করতে চায়। এত লোকের মাঝে পারেনা। বা হয়ত এত লোক তাকে, তার বাবার জন্যেই গুরুত্ব দিচ্ছে বলে যথোচিত গম্ভীর থাকার চেষ্টা করে। কে বলতে পারে! বাচ্চা ছেলের মনের ভেতরে কী যে চলে! শেষ পর্যন্ত না পারলে, বা উসখুসিয়ে উঠলে তার বাবা তাকে বলেছে, ভেতরে যাবে বাবা? যাও, ঘুরে এসো। 

আমাদের বাবারা কখনও আমাদের সাথে এভাবে কথা বলেনি। না, তারা মারধোর করলেও অকারণে বা মদ্যপান করে এসে কখনোই নয়। তারা আমাদের বিস্তর স্নেহ করেছেন। আমরা বড়ো হলে লায়েক হলে আমাদের সমীহও করেছেন। তাদের কথায় আচরণে সারাজীবন আমরা সেকথা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু, আমরা আমাদের বাবাদের মুখে, এই ভেতরে যাওয়ার মত সামান্য কথাও এমন স্নিগ্ধ স্বরে শুনিনি। সে স্বরে কিছু একটা আছেএরকম বললে কিছুই বোঝানো যায় না। খুব হালকা মিঠে সাদা ও স্বচ্ছ এবং ঠান্ডা কিছুর স্বাদ যেন জিভে ও ক্রমে গোটা শরীরে ভরে যায়। আমরা বারবার কৃষ্ণগোপালের কাছে ফিরে যেতে চাই।

কৃষ্ণগোপাল আমাদের দিকে তাকান। আমরা বুঝি, উনি বলছেন, কেন আসো তোমরা? কৃষ্ণগোপাল আমাদের দিকে তাকান। আমরা বুঝতে পারি না , উনি কি আমাদের আসতে বারণ করছেন, না কি আরও বেশী করে আসতে বলছেন।

কৃষ্ণগোপালের ঘরের মেঝেটি লাল। শুধু লাল নয়, দানা ওঠা ওঠা ও অল্প ফুটিফাটা। আমরা যখন তাঁর সামনে নিচে কোথাও বাবু হয়ে বসি, আমাদের দুপায়ের মাঝের চতুস্কোনে সেই ফুটিফাটা এক একদিন এক এক আকার নেয়। কখনও সেটা ম্যাপে দেখা গোদাবরী নদীর মতন, তো কখনও সেটা সেই সেবার সাইকেল থেকে পড়ে বুলুকাকা-র মাথায় যে সেলাইয়ের তেড়াবেঁকা দাগ হয়েছিল— সেরকম হয়ে যায়।

কৃষ্ণগোপালের বসবার ঘরের জানালাগুলি প্রায় দরজার সাইজের।তাতে লম্বা লম্বা শিকের গরাদ। সে শিক গোল নয়, চৌকোনা। তার পাল্লাগুলি খড়খড়ি দেওয়া। কাঠের শিঁড়দাঁড়াটি ধরে ওঠানো নামানো করলে ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ হয়। সেই জানালা দিয়ে সকালবেলা রোদ আসে। রোদ এসে লাল মেঝেতে পড়ে ও সেই মেঝে আরও লালহয়। সামান্য তেতে ওঠে। আমরা সেখানে হাত পেতে রেখে দেখেছি। হাত হালকা তেতে ওঠে। লালচে হয়। খুব গুঁড়ো গুঁড়ো ঘাম হয়। লোমকূপের দিকে একভাবে চোখ ফেলে তাকিয়ে থাকলে, হালকা চিকচিকে ঘাম লক্ষ্য করা যায়।

কৃষ্ণগোপাল হয়ত দুপুরে খেতে কিংবা বাথরুমে উঠে যান। বাইরের দুনিয়া যেন হুড়মুড়িয়ে ঘরটার মধ্যে ঢুকে পড়ে। প্রচুর কথা, শব্দ, ঠেলাঠেলি, বলতে চাই না, রাজনীতিও। আমরা সে সময়টা অন্যমনস্ক হওয়ার চেষ্টা করি।  জানলার গরাদের ছায়া সমেত রোদের ঢুকে আসা দেখি। রোদের হেলে পড়া কলামে কণা কণা ধুলোর লুকোচুরি। এই দেখা গেল, এই নেই— দেখি। কৃষ্ণগোপাল ফিরে আসেন। উদ্‌গার নেই, হাত ভিজে নেই, আঙুলের ডগার চামড়া কুঁচকে নেই, দাঁতের ফাঁকে ঢুকে থাকা খাবার বের করবার চেষ্টা নেই। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, আলোচনাও হয়, উনি কি আদৌ খান না কি এমনি এমনিই ভেতরে যান। যারা কৃষ্ণগোপালকে অবতার ইত্যাদি ভাবতে চান, বা অপরকে ভাবিয়ে নিজে তাঁর ম্যানেজারগোছের কিছু হয়ে বসতে চান ও সেই প্রচেষ্টাতে কৃষ্ণগোপালের খাওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে নস্যাৎ করতে চান, করুন। আমরা কিন্তু তাঁর ঢোকা বেরোনোর ফাঁকে ডালে ফোড়ন দেবার ছ্যাঁক শব্দ আর গন্ধ পেয়েছি। আমরা ওই  ফাঁকটুকুর মধ্যে দিয়ে দেখেছি, কড়িবরগার ছাত, একখানা খিলান আর সাদাটে ধোঁয়া খুন্তি কড়াইয়ের ঠুংঠাং আওয়াজের মাঝে পাক খেয়ে উঠছে। 

  কৃষ্ণগোপালের অন্দরমহলে কি রহস্য আছে? তা তো নয়। কৃষ্ণগোপাল সন্ন্যাসকালে  বাড়ির সাথে যোগাযোগ রাখতে পারতেন না। তখন তাঁর স্ত্রী কিছু অন্তরালবর্তিনী ছিলেন না। বাজার হাট না করলেও, টুকটাক এটা ওটা কাজে তাকে রাস্তায় চলাফেরা করতে প্রায়শই দেখা যেত। খুব ছোট ছোট ফুলছাপ হালকা রঙের শাড়ি ও ফিকে এয়োচিহ্ন নিয়ে তিনি সামান্য দ্রুততার সাথে চলে যেতেন। এয়োচিহ্নটা মা মাসীরা খেয়াল করত। কেউ দাঁড় করালে উনি যথোচিত ভদ্রতার সাথে কথা বলতেন। পরিচিত জনেরা জানত, উনি অন্যান্য কষ্টের সাথে আর্থিক কষ্টেও আছেন। ভাইদের সাহায্যেই একরকম করে ওনার দিন কাটছে। কিন্তু তা নিয়ে একটা কথাও কেউ তাকে কখনও কোত্থাও উচ্চারণ করতে দেখেনি।কেউ ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কৃষ্ণগোপালের প্রসঙ্গ তুললে বা তার আর্থিক কষ্টের উল্লেখ করলে, হয় উনি স্বাভাবিক উদাসীনতায় এড়িয়ে গেছেন, অথবা সরাসরি উত্তর দিয়েছেন, কোনওরকম উস্মা ছাড়াই। লোকে এর ফলে বলাবলি করতে থাকে, কৃষ্ণগোপালের জায়গায় কৃষ্ণগোপালের স্ত্রী সন্ন্যাস নিলে বা যুগলে একসাথে সন্ন্যাস নিলে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না।

কৃষ্ণগোপাল ফিরে আসার পর ওনার স্ত্রী বাইরের ঘরে জনসমক্ষে আসেন না। কৃষ্ণগোপাল চা খেতেন না। এখনও খান না। যারা তাঁর সামনে গদগদ হয়ে বসে থাকার জন্য আসে, তাদের চা দেওয়ার প্রশ্ন নেই। উনি কিন্তু কৃষ্ণগোপালকে কোনও প্রয়োজনেও ভেতরে ডেকে পাঠান না। দড়জার আড়াল থেকে শেকল ঝনঝন করা বা ঠকঠক, এমনকি ছেলেকে দিয়েও কখনও না। এতদিন না থেকে থেকে সংসারের কোনও ব্যাপারেই বুঝি আর তাঁর কোনও প্রয়োজন পড়ে না। ওনার সন্ন্যাস যেন এখনও ফুরোয় নি।

আমরা অবাক হই। কৃষ্ণগোপালের পরিবারের কি বসবার ঘরের তক্তপোষের নিচের শিশি-বয়াম, বাসন কোসন, হাতাখুন্তির রাজত্বেরও প্রয়োজন ফুরিয়েছে? সেখানে যেভাবে সুচারু ভাবে জিনিসপত্র রাখা দেখেছিলাম প্রথমদিন, আজও সেভাবেই রাখা দেখি। যেখানকার জিনিস সেখানে। একটুও এদিক ওদিক নেই। এমনকি সেই সামনের দিকের মোছা জায়গাটুকুও সেরকমই পরিস্কার। সারাদিন কৃষ্ণগোপালের কাছে লোকের আনাগোনা। সারাদিন কি ওনার এই তক্তাপোষের তলার সংসার থেকে কোনও জিনিসেরও প্রয়োজন পড়ে না? তাহলে উনি এত যত্ন করে থাকে থাকে এই  তক্তাপোষের তলার সংসার সাজিয়েছিলেন কেন? কার জন্যেই বা পা ছেঁচড়ে ঢুকে ঘাড় বেঁকিয়ে হাত টানটান করে অত্যন্ত বেকায়দা ভঙ্গীতে বসে এই বাসন-কোসন, শিশি-বয়াম মুছে মুছে রাখতেন? কেন এখনও রাখেন?

আমরা কেন কৃষ্ণগোপালের কাছে যাই? আমাদের কী নেই? কী পেতে যাই? আমাদের জীবনে একটুর জন্য পেতে পেতে  ফস্কে যাওয়া চাকরি আছে। আমাদের বাবাদের কাছে গল্প আছে, কোন্‌ নেতা তাদেরই বন্ধুর রিক্সা চড়ে আশ্বাস দিতে  দিতে গিয়ে অন্য লোককে চাকরি দিয়েছে। সে বন্ধু নাকি শেষ পর্যন্ত রিকশাই চালিয়েছে। আমাদের হাতের উন্নতিরেখা কিছুতেই লাইফলাইনের সাথে মিলছে না। চুলের মত একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। আর সেই চুলের মতন ফাঁক দিয়ে আমাদের পড়াশোনা চাকরি সংসার আমাদের ম্লান প্রেমিকা সব গলে চলে যাচ্ছে। আর আমাদের মধ্যে যারা ভাগ্যবান, যারা চাকরি পেয়েছে, তাদের কর্মস্থল আর পরিবারের মাঝের যোজন যোজন ফাঁক জোড়া লাগাতে, রিফু করতে উন্মাদের মতন সারাজীবন ছুটোছুটি করেই যাচ্ছে। তাছাড়া ঘরের মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে না, হলেও সন্তানহীনতা, সন্তান হলে তার পড়াশুনো কেরিয়ার, পরিবারজুড়ে হরেক অসুস্থতা, মৃত্যু! আমাদের বেঁচে থাকা হাহাকারের মিছিল। আর বাড়িয়ে লাভ কী?

কীসের আশার বাঁচবে মানুষ? একটা একটা করে তার আশা মরবে, আর সে পরের আশাটিকে হাতড়াতে থাকবে। সকলেই কৃষ্ণগোপালের কাছে আসে। তাদের হাতের ফলের টুকরিতে, মিষ্টির প্যাকেটে, তাদের মুখের কাতর ভাংচুর  মানচিত্রে, একটাই প্রশ্ন ফলার মতন তীব্র উঠে থাকে, আমার কী হবে? এ প্রশ্ন আমরাও কতোবার কতোভাবে কৃষ্ণগোপালকে করেছি। কৃষ্ণগোপালের জানালার বাইরে সাতভাইয়া পাখি কিচিরমিচির ঝগড়াঝাটি করে। কী সব খুঁটে খুঁটে লাফিয়ে লাফিয়ে খায়। বর্ষার জল পেয়ে জানালার নিচের লতানো গাছ ফনফনে হয়ে ঝাঁপিয়ে জানালার শিকগুলোকে জাপটে ধরতে চায়। মাথার ওপরে ফ্যান বনবন করে ঘোরে। তাতে কৃষ্ণগোপাল খাটের থেকে দু ইঞ্চি উপরে দুলতে থাকেন।

আমাদের একখানাই প্রশ্ন। মনের ভেতরে পাক খায়। গলার পাইপ জুড়ে ওঠানামা করে। জিভের ওপর গড়িয়ে বেরিয়ে যেতে চায়, আবার ফিরে আসে। শেষে তেবড়ে তুবড়ে মূল চেহারা ভুলেটুলে গিয়ে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, আপনার কী হয়েছিল?

কৃষ্ণগোপাল আমাদের সাদা রঙের গাছ দেখান। দুপাশে গাছপালা ছাওয়া একখানা সোজা পিচরাস্তা। মসৃণ। মাঝখানে সাদা দাগ। মানে পোষ্টারে ছবিতে যেরকম দেখা যায় আরকি। তারই মাঝবরাবর, একেবারে মাঝরাস্তার বুকের ওপর কে যেন, মানুষ সমান কি দু মানুষ সমানই হবে, একখানা গাছ পুঁতে রেখেছে। তার কান্ড সারা ডালপালা সাদা পাতা ফুলফল সব ধবধবে সাদা। এই পিচরাস্তা ধরেই হেঁটে হেঁটে ওই গাছের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। যতো এগোবে, গাছ তো ততো বড়ো হবে, এগিয়ে আসবে, না কি? তা আর হয় কই? হাঁটার মনে তুমি হেঁটে যাচ্ছো। গাছ গাছের মতন দাঁড়িয়ে থাকছে। তার বাড়াকমা কিচ্ছুটি নেই। হাঁটতে হাঁটতে সন্দেহ হয়, আদৌ তুমি হাঁটছো তো? আরও হাঁটতে থাকলে, আর কিছু হয় না, শুধু মনের ধন্দ বড় হয়, ওই যে গাছ, সাদা গাছ, ওই গাছের কাছে গিয়ে তাহলে কী হবে? তারপর কী হবে?  হাঁটতে হাঁটতে তো মন থেকে শরীর থেকে বাড়তি ভার ঝরে যাওয়ার কথা। ঝরছে কি? ঝরলেও কী ঝরছে? কী ই বা ঝরার কথা?

এভাবেই তুমি কখন যেন ফেরত পথে হাঁটতে শুরু করেছো। ঠিক কোন মুহূর্তে তুমি এগোনো বন্ধ করে পেছনের দিকে চলতে শুরু করলে, খেয়ালও নেই। তুমি কি আদৌ সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে, না থাক, আর এগোবো না। এগিয়েই বা কী হবে, এরকম কোনও উদাসীনতায় ডুবে গেছিলে বলেও তো মনে পড়েনা। তুমি উলটো পথে ফিরে আসছো। রাস্তার মাঝখানে সাদা গাছ, পেছু ফিরে দেখো, না কি সামনেই দেখো, তোমার সাথেই আছে। সে বাড়েও না কমেও না।

এসব কথা কৃষ্ণগোপাল আমাদের কিছুই বলেন না। কখনও বলেননি। বিকেল ঘনিয়ে এলে আমরা উঠে পড়ি। দু-চারজন তখনও বসে থাকে। আজ ওর পাশে ওর ছেলে বসে নেই। বিদায় নিই। উনি মৃদু হাসেন। মাথার ওপর ফ্যান ঘোরে। তাতে ওঁর ফতুয়া ওড়ে। চুলের গুছি ওড়ে। সারা ঘর জুড়ে ওঁর মৃদু হাসি ওড়ে।  

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত