কেমন ছিল প্রাচীন বাংলার শিল্প স্থাপত্যের রূপঃ শিল্পীর বয়ান
যাদুঘরের সংগ্রহশালা বা প্রাচীন লেখমালা ব্যতীত আদতে কি তার কোনো চিহ্ন আছে? যে নিদর্শনগুলো দেখলে পরে সেই জমিদার প্রথা, রাজকাহিনী আর রাজপ্রাসাদের কথা মনে করে দেয় নিমিষেই। তখনকার মানুষের জীবন যাপন প্রণালী, সামাজিক ও রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা, ধর্মীয় চেতনা, জ্ঞানচর্চার পরিধি ইত্যাদি সম্বন্ধে যেনো অনেক কিছুই জানতে পারি।
যুগ যুগ ধরে রাজাদের আগমন ঘটেছে এ উপমহাদেশে। খ্রিষ্টপূর্ব থেকে এ অঞ্চল শাসন করেছে মৌর্য বংশের রাজারা। এরপর খ্রিষ্টীয় চার শতক থেকে কয়েকশো বছর রাজত্ব করেন গুপ্ত বংশ রাজারা। তারপরে পালবংশের রাজারা। এভাবে ধারাবাহিকতায় আসে বর্মণ, সেন, লক্ষ্মণ সেন, মুঘল পিরিয়ড, সুলতানি আমল, এবং শেষ স্বাধীন নৃপতি সিরাজ-উদ্-দৌলাকে পরাজিত করে শেষে আসে ইংরেজ শাসন আমল। কত উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে ঘটে গেছে বহু ঘটনা, রয়ে গেছে তাদের অনেক নিদর্শন।
নীহারঞ্জন রায় এর গ্রন্থের আলোকে যদি বলি, বাংলার রাষ্ট্র ও রাজবংশাবলীর ইতিহাস যতটুকু আমরা জানি তার বেশির ভাগ তথ্য পাওয়া যায় প্রাচীন লেখমালা থেকে। এই লেখমালা, শিলালিপি, তাম্রলিপি, এর বেশি ভাগ ক্ষেত্রেই রাজকবি রচিত রাজার অথবা রাজবংশের কোনো বিশেষ ঘটনা উপলক্ষে রচিত বিবরণ বা কোনও ভূমি দান বিক্রয়ের দলিল, অথবা কোনো মূর্তি বা মন্দিরে উৎকীর্ণ উৎসর্গলিপি। ভূমি দান বিক্রয়ের দলিলগুলিও সাধারণ রাজা অথবা রাজকর্মচারী বা ধর্মগোষ্ঠী বা বণিকগোষ্ঠী নির্দেশে রচিত ও প্রচারিত। এর নানান কারণ নিহিত আছে এখানে, বিভিন্ন বিদেশি পর্যটকরা কখনো রাজ অতিথিরূপে বা রাষ্ট্রের সহায়তায় এ দেশে পরিভ্রমণে আসেন। কেউ এ সম্প্রদায়ের সাথে মিশে গিয়ে এ বাংলায় থেকে যান। আবার কেউ অনেক কিছু লুট করে নিয়েও যান। হাজার বছর ধরে গোটা বাংলা অঞ্চলে কখনো বিভক্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন রাজা ও শাসকদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। রাজারা তাদের খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে বাংলার বিভিন্ন আনাচে-কানাচে রাজবাড়ি নিমার্ণ করেছেন। যেখানে তারা তাদের জমিদারী পরিচালনায় এবং রাজস্ব আদায়ে সহজতর হবে বলে একটি নির্ধারিত স্থানে প্রাসাদ তৈরি করে রাজত্ব করতেন। যে রাজপ্রসাদ গুলোকে সাধারণত রাজবাড়ি বা জমিদারবাড়ি নামেই ডাকা হয়ে থাকে। এক অঞ্চলের সাথে অন্য অঞ্চলের রেষারেষি ও যুদ্ধবিগ্রহ প্রায়ই ছিল। এবং তারা ছিল বিশেষ বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ের গোষ্ঠী।
কারুকাজে সজ্জিত পোড়া মাটির ভগ্নপাত্র, ফলকচিত্র, পাথরের মূর্তি, লোকজ পুরাণ কাহিনীর বিবৃতি, নকঁশি পাথর, পাথরের উৎকীর্ণ লেখা, খিলান স্তম্ভ, পিলার, ভগ্নদশায় ভবন, পোড়া মাটির ফলক, স্নানের পুকুর ঘাট, পাথুরে খোদাই করা ফলক, শিলালিপি ও পিলারগুলোর গঠন ইত্যাদি প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়
বস্তুগুলো বলে দেয় সেই সময়ের রাজাদের শিল্পনৈপুণ্যের রুচিবোধ কেমন ছিল। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাটির স্তূপ ও গড় অঞ্চল খনন করে এরূপ কয়েকটি জনপদের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহীর পাহাড়পুর, কুমিল্লার ময়নামতি, বগুড়ার মহাস্থানগড়, নরসিংদীর জেলার ওয়ারী বটেশ্বরের প্রাচীন সভ্যতা এবং সর্বশেষ আবিষ্কৃত মুন্সিগঞ্জ জেলার টংগীবাড়ী উপজেলার নাটেশ্বর সভ্যতা।
যার অনেক নিদর্শন আমরা যাদুঘর গুলোতে দেখতে পাই। এর অনেক কিছুই পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় আছে আর অনেক কিছুই অবহেলায় অযত্নে ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। হয়ত ভবিষ্যতের প্রজন্মরা ইতিহাসকে জানতে পারবে কিন্তু তাকে অনুভব করতে পারবে কতটুকু সে বিষয়ে সন্দেহ থেকে যায়, যদি না টিকে থাকে নিদর্শনগুলো সঠিকভাবে?
আমার জানার দেখার বোঝার তাগিদে মাঝে মধ্যে ডুব দেওয়ার চেষ্টা করি এসব ইতিহাস বিজড়িত রাজবাড়িগুলোতে বিচরণে। তার রূপ, রস, ঘ্রাণের মধ্যে প্রকৃত সাধ আস্বাদনে মগ্ন থাকার চেষ্টাই থাকি। যদিও কিছুই নেই আমাদের সেই সময়ের তুলনায়, কিন্তু সুন্দর করে ভাবার একটা মন তো আছে আমাদের! আমরাও তো বলতে পারি আমাদের এ বঙ্গেও হাজারো বীর ছিল, তাদের রাজ্য ছিল, রাজবাড়ি ছিল। আভিজাত্যে শিল্পে স্থাপত্যে নিপুণ্যের সংস্কৃতিতেও কমতি ছিলনা।
যে স্থাপত্যেগুলো এখনো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের মাঝে। সে সমস্ত রাজবাড়ি গুলোকে স্মৃতি রোমন্থন করবার জন্য মাঝে মধ্যে তার সংস্পর্শে গিয়ে রঙ আর তুলিতে খুঁজে বেড়ায় প্রাচীন স্থাপত্যের কারুকাজের পোড়া মাটির ফলক, ইট, পাথর, পিলার, লতাপাতায় জড়ানো পেচানো মুঘল আমলের দরজা, লাল ইট তার রঙ হারায় সবুজের ঘেরাডুবের ফাঁদে, স্নানের পুকুর ঘাট ঘিরে নারিকেল গাছের সারি, অলংকৃত বারান্দার আলো ছায়ার খেলা, ধসে যাওয়া ইটের দেওয়াল, সূক্ষ্ম টেরাকোটার অসাধারণ কারুকার্যময় খোদাই করা যক্ষাযক্ষীর ফলক, রামায়ণ মহাভারতের পুরাণকাহিনীর খোদিত প্রাণের রস আস্বাদনে ইত্যাদি বিষয় গুলো সাদা কাগজে তুলে ধরার একটা চেষ্টা।
এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জে আমার বসবাস প্রায় ৬ বছরের বেশি, পুরান ঢাকায় ছবি আঁকার ক্লাস নেওয়ার সুবাদে সেখানকার অলিগলির অভিজ্ঞতা আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। যেখানেই আমার দীর্ঘদিনের যাত্রা, সে জায়গাগুলোর কথায় যদি বলি তাহলে হয়ত তার বর্ণনা বলে শেষ করা মুশকিল। যেমন –ঢাকা সদর ঘাটের আহসান মঞ্জিল,ফরাশগঞ্জের লালকুটি, রূপলাল হাউজ, পুরান ঢাকার বনেদি বাড়ি, ঢাকার নবাব বাড়ি, সূত্রাপুরের রাজবাড়ি, পুরান ঢাকার ছোট্ট কাটরা, বড় কাটরা, লালবাগ কেল্লা, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁর বার ভূইয়ার পানাম নগরের স্থাপত্যেশৈলী, ঐতিহাসিক ইশা খাঁর জমিদার বাড়ি, গোয়ালদি মসজিদ, মুন্সিগঞ্জের পাল বাড়ি, ইদ্রাকপুরের দূর্গ, নরসিংদীর ওয়ারী বটেশ্বর, নরসিংদীর লক্ষণ সাহার, বেলাবরের বডিবন্দের রাজবাড়ি, নবীনগর কাইতলা জমিদার বাড়ি, ইত্যাদি জায়গাগুলো খুব কাছ থেকে দেখার ছোট্ট অভিজ্ঞতা থেকে বলা।
