| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অসমিয়া অনুবাদ উপন্যাস: অর্থ (পর্ব-৩৯) । ধ্রুবজ্যোতি বরা

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি বরা পেশায় চিকিৎসক,অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক ২৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সনে শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন ।শ্রীবরা ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন ।’কালান্তরর গদ্য’ ,’তেজর এন্ধার‘আরু’অর্থ’এই ত্রয়ী উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। ২০০৯ সনে ‘ কথা রত্নাকর’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাকি উপন্যাসগুলি ‘ভোক’,’লোহা’,’যাত্রিক আরু অন্যান্য’ ইত্যাদি।ইতিহাস বিষয়ক মূল‍্যবান বই ‘রুশমহাবিপ্লব’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’,’ফরাসি বিপ্লব’,’মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ’।শ্রীবরার গল্প উপন্যাস হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মালয়ালাম এবং বড়ো ভাষায় অনূদিত হয়েছে।আকাডেমিক রিসার্চ জার্নাল’যাত্রা’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ।’ কালান্তরর গদ্য’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সনে অসম সাহিত্য সভার ‘ আম্বিকাগিরি রায়চৌধুরি’ পুরস্কার লাভ করেন।শ্রীবরা অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি।


অনুবাদকের কথা

কালান্তর ট্রিলজির তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হল’অর্থ’। সশস্ত্র হিংসার পটভূমি এবং ফলশ্রুতিতে সমাজ জীবনের দ্রুত অবক্ষয়ের মধ্যে বেঁচে থাকার তাড়না এবং বেঁচে থাকার পথ অন্বেষণেই আলোচ্য উপন্যাসের কাহিনী ভাগ গড়ে তুলেছে। সম্পূর্ণ পৃথক একটি দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে অসমের মানুষ কাটিয়ে আসা এক অস্থির সময়ের ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষের অন্বেষণ চিরন্তন এবং সেই জন্যই লেখক মানুষ– কেবল মানুষের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারে।

এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম।আশা করি ইরাবতীর পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবে। নমস্কার।

বাসুদেব দাস,কলকাতা।


 

      তোমরা ওপরমহলের বারান্দার খোলা জায়গাটাতে বসেছিলে।উপরে উঠে যাওয়ার সিঁড়িটার একপাশে দুটি ঘর এপাশের ঘর দুটি খালি— সেখানে দুটি ঘর বানানো হয়নিঃ তারপরে আরও দুটো ঘর আছে। সেই খালি জায়গাটাতে তোমরা বসেছিলে।

      মেঘ-মেদুর আকাশ। গাঢ় কুয়াশার মতো মেঘ চারপাশটা  ঘিরে ধরেছিল। হালকা বাতাসের  কাঁধে চড়ে মেঘগুলি ঘুরে বেড়াচ্ছিল।খোলা জায়গাটার ছাদের নিচে পর্যন্ত মেঘ গুলি ঢুকে ছিল।তোমাদের এরকম মনে হচ্ছিল যেন হাতের তালুতে তোমরা মেঘগুলিকে স্পর্শ করতে পারবে। অনুভব করতে পারবে মেঘের ঘনত্ব।

      গাঢ় মেঘ।ইস গাঢ় মেঘ!

      কিছুক্ষণ আগে তোমরা দুজন দালাই লামার প্রাসাদ থেকে ফিরে এসেছ। স্থানীয়  লোকেরা  দলাই লামা  থাকা বাড়ি এবং বিহারকে দালাই লামা মন্দির বলে থাকে। সন্ধ্যার প্রার্থনার আগে তোমরা গিয়েছিলে।মন্দিরের বাইরের বিশাল বারান্দায় সারি পেতে বসে লামারা প্রার্থনা করছিল। গুরুগাম্ভীর কন্ঠে একজন নাম গাইবার মতো প্রার্থনার শ্লোক বলে যাচ্ছিল, বাকিরা সবাই  সমবেত কণ্ঠে সেটা উচ্চারণ করে যাচ্ছিল। তোমরা সামনের বিশাল বারান্দার সিঁড়িতে বসে তন্ময় হয়ে সেই সমবেত প্রার্থনার ধ্বনি শুনছিলে। চোখ দুটি বন্ধ করে দিবে তোমাদের এরকম মনে হচ্ছিল যেন কুয়াশা ঢেকে রাখা একটা মাঠের একপাশে থাকা নামঘর থেকে নাম কীর্তনের ধ্বনি ভেসে আসছে।

      তুমি মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে নিচ্ছিলে।

মেয়েটি তন্ময় হয়ে অপলক দৃষ্টিতে প্রার্থনা করা লামাদের দিকে তাকিয়ে ছিল ।চারপাশে সুগন্ধি ধূপের সৌরভ ঘিরে ধরেছিল।

       ভোরতাল! ভোর তাল!কোথায় যেন ভোরতাল বাজছিল। তুমি চোখ দুটি মেলে উৎকর্ণ হয়ে শোনার চেষ্টা করছিলে সেই ভোরতালের শব্দ—ঘম- ঘম- ঘম- ঘম-  ঘম…

      প্রার্থনার শেষে তোমরা দেখেছিলে বিহারের সামনে উঠোনে লামারা দুজন দুজন করে জোড় বেঁধে ছিল। একজন মাটিতে গম্ভীরভাবে পদ্মাসনে বসেছিল। অন্যজন সামনে দাঁড়িয়ে থেকে হাত দিয়ে চাপড় মেরে খুব দ্রুত কিছু একটা বলছিল। সুর লাগিয়ে বলছিল। এক বিশেষ ভঙ্গিমায় বলছিল।যেন প্রশ্ন করছে, যেন কোনো পাঠ মুখস্থ বলছে, এরকমই হাবভাব। 

      (তুমি রমেনকেও এই দৃশ্য দেখানোর জন্য নিয়ে এসেছিলে।

      আশ্চর্য হয়ে সে জিজ্ঞেস করেছিল–আবে কে?…(অশ্লীল)ঝগড়া করছে নাকি বে? ঝগড়া করার ট্রেনিং নাকি বে?)

      মেয়েটি তোমার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।

      তুমি তাকে বলেছিলে লামারা বৌদ্ধ দর্শনের ওপরে এখন তর্কবাদ করছে। দর্শনের একটা সূত্র সম্পর্কে একজন নিজের যুক্তি তুলে ধরছে— অন্যজন শুনে যাচ্ছে। তারপরে অন্যজন সেই যুক্তিখন্ডন করার চেষ্টা করবে। এভাবে দর্শনের জটিল এবং বিমূর্ত সূত্রগুলি তাঁরা আয়ত্ত করবে। 

      মেয়েটি তন্ময় হয়ে লামাদের দিকে তাকিয়ে ছিল।

      তোমার হাসি পেয়েছিল, মেয়েটির তন্ময়তায় নয়,রমেন বলা কথাটা মনে পড়ে যাওয়ায়। 

      আবহাওয়া গুমোট  হয়ে উঠতে দেখে তোমরা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসেছিলে। সন্ধ্যাবেলা আকাশ অন্ধকার হয়ে এসেছিল। মেঘাচ্ছন্ন অন্ধকার ।

      বাড়িতে ফিরে এসে তোমরা সেই খালি জায়গায় বসেছিলে।

      বাতাসে শীত শীত ভাবটা ছিল যদিও সেখানে বসে ভালো লাগছিল।তোমার দেওয়া গলাবন্ধটা সে সেদিনও গলায় ঘিরে নিয়েছিল।তোমরা বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলছিলে।নানান ছোটো ছোটো কথা।মেয়েটা এসে মেকলডগঞ্জে দীর্ঘকালের জন্য থাকতে নেওয়ার পরে হওয়া ছোটো ছোটো অভিজ্ঞতার কথা তোমাকে বলেছিল।তাঁর সঙ্গে ট্রেকিঙে আসা দলটি ইতিমধ্যেই ভারতের বিভিন্ন জায়গা দেখে আমেরিকায় ফিরে গেছে।মেয়েটি থেকে গেছে—সারাদিনে শহরের এদিকে ওদিকে একটু ঘুরে বেড়িয়েছে।মাঝখানে মেয়েটি বিপাসনা যোগের একটা কোর্সও করেছে।এখানে থেকে মেয়েটির স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে।মুখের অসুখ অসুখ ভাবটা দূর হয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

      একটা সময়ে তোমরা বৌদ্ধধর্মের বিষয়ে আলোচনা করেছিলে।

      তুমি তাকে বলেছিলে সে এই কথা বোধ করি ইতিমধ্যে জানতে পেরেছে যে বৌদ্ধ ধর্মই হল পৃ্থিবীর এমন একটি প্রধান ধর্ম যেখানে একজন সর্বশক্তিমান ঈশ্বর আছে বলে বিশ্বাস করা হয় না।

      সে বলেছিল সে কথা সে জানে।ইতিমধ্যে সে রামপ্রসাদজী,সুইস সাহেবটি এবং রামপ্রসাদজীর কাছে আসা রিনপোছের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করেছে।আর ঈশ্বরের অবস্থিতি মেনে না নেওয়া বৌদ্ধ ধর্ম তাকে চমৎকৃ্ত করেছে।আগে সে এই কথাটা জানত না।

      তিনজন বুড়ো মানুষ মিলে প্রায়ই সেই খালি জায়গাটাতে বসে আলাপ আলোচনা করে থাকে।তুমিও কখনও সেই আলোচনায় ভাগ নিয়েছ।কিন্তু মেয়েটিও তাঁদের সঙ্গে বসে কথা বলে বলে জানার পরে তোমার এক প্রকার ঈর্ষা হয়েছিল।কন্ঠস্বরে সামান্য শ্লেষের সুর মেখে তুমি তাকে বলেছিলে সারাদিনের আধা সময় তারমানে সে এভাবেই পার করে।

      তুমি সকালবেলাতেই অফিস চলে যাও।আজ কিছুদিন ধরে সিজনের এই শেষের সময়েও ভ্রমণকারী আসছে।ওদের ট্রেকিঙে পাঠানো,মেকলডগঞ্জে সস্তা থাকার জায়গা ঠিক করে দেওয়া,গাড়ি,ঘোড়া,টেন্ট,পোর্টার ইত্যাদি ভাড়া দেওয়া মানুষগুলির সঙ্গে কাথা-বার্তাগুলি ঠিক করা এ ধরনের একশত একটা কাজে তুমি অনেক সময় ব্যস্ত থাক।অফিসে খাওয়া দাওয়া করে এক ঘুম মারার পরে প্রায়ই একজন দুজন করে তোমার পরিচিত মানুষ,বন্ধুরা অফিসে আসে।অফিসের টেবিল-চেয়ারে বসে তোমরা নানা ধরনের কথা বল।এভাবেই প্রায়ই সন্ধ্যা হয়ে যায়।তখন তুমি অফিস থেকে বেরিয়ে জার্মান রুটি-বিস্কুট পাওয়া দোকানটার বাইরের বেঞ্চিতে বসে চা বিস্কুট খেয়ে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে ফিরে যাওয়া।বাড়ি পৌছানোর পরে তুমি বেশিরভাগ সময় গৃহকর্ত্রীর সঙ্গে কথা-বার্তা বলে ,ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে টিভি দেখে সময় কাটানো।একেবারে রাতের দিকে খাওয়া দাওয়া শেষ করে রুমে ফেরা।মেয়েটি এসে থাকার পর থেকে সেও সন্ধ্যাবেলা ঘরে ঢোকার পর থেকে রাতের আহার পর্যন্ত নিচেই কাটায়,তাই বেশি করে গৃহকর্ত্রীর সঙ্গে রান্নাঘরেই ঢুকে থাকে।

      মেয়েটি উত্তর দিয়েছিল যে না,করে না।সারাদিন সে অনেক কাজ করে।সে বৌদ্ধ দর্শনের ওপরে একটা ছোটো কোর্স নিয়েছে।দালাই লামার বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই পরিচয়মূলক কোর্সটা করায়।সে এখন সকালের দিকে এই কোর্সটা করছে।তার তোমাকে     কথাটা জানানো হয় নি।আসলে সেও যে কোর্সটা খুব ভেবে চিন্তে করছে তা নয়।বরঞ্চ হঠাৎ একটা পোস্টার দেখে খোঁজ-খবর করে সে বিশেষ না ভেবেই ভর্তি হয়ে গিয়েছে।অনেকদিন পরে পুনরায় ছাত্রী হয়ে তার ভালো লেগেছে।বিকেলের সময়টা কাটার জন্য সে তিব্বতি টংখা পেন্টিঙের একটা কোর্স ও করছে।আগে সে ছবি আঁকত।ছবি আঁকা সম্পর্কীয় প্রশিক্ষণও নিয়েছিল।আধুনিক আর্টের সে বেশ ভক্ত ছিল।কিন্তু এখন সে এই মিহি ডেকোরেটিভ চিত্রশৈ্লী শিখে ভালো লেগেছে।সে বলেছিল অফিসে গিয়ে খোঁজ না করলে তোমাকে তো সন্ধ্যা পর্যন্ত দেখাই যায় না।

      তুমি তার কথা শুনে কিছুটা আশ্চর্য হয়েছিলে।সে সারাটা দিন ব্যস্ত হয়ে থাকার জন্য এইসব করে নিয়েছে বলে তোমার জানা ছিল না।সে বিরক্ত হয় বলেই তুমি তার থেকে কিছুটা দূরে ছিলে।কিন্তু সেও তোমাকে কিছু না জানানোর জন্য তার মনটা একটু খারাপ লাগছিল।তোমার সঙ্গে একদিন মোটর সাইকেলে বেড়াতে যাওয়া এবং দুদিনের মতো তোমাদের অফিসে আসা ছাড়া তুমি তার সঙ্গে বেশি কথা-বার্তাই বলনি।বাড়িতে সবসময় দেখা হলেও সাধারণ ঘরোয়া কথাই হত।অনেকদিন পরে আজকেই পুনরায় তোমরা কথা বলছিলে,একসঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলে।

      তুমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলে বৌদ্ধ ধর্মের বিষয়ে তাকে সেই লামাটি বা রিনপছে এবং রামপ্রসাদজী কী বলেছে।

      সে বলেছিল –তাঁরা তাকে অনেক জানা-অজানা কথা বলেছে।তাঁদের সঃঙ্গে কথা বলার জন্য তার বৌদ্ধ দর্শনের কোর্স করাটাও সহজ হয়েছে।

      তুমি জানতে চেয়েছিলে বৌদ্ধ ধর্মের কী জানা না জানা কথা তাঁরা তাকে বলেছে।

      সে বলেছিল তাঁরা তাকে বলেছে যে অন্য অনেক ধর্মের মতো বৌদ্ধ ধর্ম একটা প্রকাশিত ধর্ম নয়।

      তুমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলে প্রকাশিত ধর্ম কী জিনিস।

      সে বলেছিল যে পৃ্থিবীর প্রায়গুলি ধর্মেই এই কথা থাকে যে কোনো ঐশ্বরিক শক্তি প্রকাশ করা ধর্মটা প্রকাশ করে এবং প্রচার করে।যেমন যিশুখ্রিস্ট ,যেমন হজরত মহম্মদ।পৃ্থিবীর বেশিরভাগ ধর্মই এই ধরনের।

      তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে বৌদ্ধ ধর্ম নয় নাকি বলে।বলেছিলে কেন বুদ্ধ তো বুদ্ধগয়ায় অনেকদিন তপস্যা করে সত্যের সন্ধান পেয়েছিল।

      সে বলেছিল বুদ্ধকে এই সত্যের সন্ধান কোনো ঐশ্বরিক শক্তি দেয় নি।কোনো ঈশ্বর,দেবদূত এসে বুদ্ধের সামনে এই ধর্মের শিক্ষাগুলি প্রকাশ করেনি।বরঞ্চ বুদ্ধ নিজে বিচার-বিশ্লেষণের দ্বারা বৌদ্ধ ধর্মের সত্যে উপনীত হয়েছিল।সেটা ছিল তাঁর জ্ঞানপ্রাপ্তি বা এনলাইটমেন্ট।বুদ্ধ তাই কোনো ভগবানের বার্তাবাহক নন।কারও বার্তা বা বাণী তিনি পৃ্থিবীর মানুষের জন্য বহন করে আনে নি।তাই বুদ্ধের ধর্মে কোনো ঈশ্বর নেই-নেই কোনো নিরাকার পরম ব্রহ্ম,পরম শক্তি।

      বৌদ্ধ ধর্মে যে ঈস্বর মানা হয় না সে কথা তুমি জানতে কিন্তু বাকিকথাগুলি তুমি আগে জানতে না।বৌদ্ধ ধর্মের বিষয়ে এটা-ওটা আরোপিত কথা তুমি জানলেও এই মুল কথাগুলি তুমি জানতে না।আলোচনাটা তোমার জন্য,তুমি চাওয়ার চেয়ে বেশি গহীন,বেশি গভীর হয়ে পড়তে শুরু করেছিল।হঠাৎ তোমার রমেনের কথা মনে পড়ছিল।বৌ্দ্ধ ধর্মে ভগবান না থাকা কথাটা জানা হলে রমেন কী বলত?

      টপ বুড়া বে ,তোর এই বুদ্ধ!টপ বুড়া বে।ধর্ম থেকে ভগবানকেই বাদ দিয়ে দিল।’রমেন নিশ্চয় এই মন্তব্যটাই করত।তোমার হাসি উঠে গিয়েছিল।

      সে তোমাকে বলেছিল তুমি তার কথা শুনে ঠাট্টা করে হেসেছ বলে।

      তার মুখটা গম্ভীর হয়ে পড়তে দেখে তুমি সন্ত্রস্থ হয়ে উঠেছিলে।

      তুমি দৌড়াদৌড়ি করে তাকে রমেনের কথা বলেছিলে।দালাই লামা সম্পর্কে সে কী বলেছিল,দালাই লামা সম্পর্কে সে কী বলেছিল-এখন বৌদ্ধ ধর্মে ঈশ্বর না থাকা কথাটায় সে কী বলতো সেটা তুমি বলেছিলে।তোমার মুখ থেকে রমেনের কথা শুনে  সেও রমেনকে চিনতে পারার মতো হয়ে গিয়েছিল।সেও এবার তোমার মুখে রমেনের কথা শুনে হেসেছিল।তার হাসি দেখে তুমি আশ্বস্ত হয়েছিলে।

      তবুও বুড়িগুলির বিরুদ্ধে তোমার ক্রোধটা শান্ত হতে চাইছিল না।তুমি তাকে বলেছিলে সেই শুকনো সুইস সাহেবটা বারো বছর এখানে প্রতিবছর আসছেই।এসে দুই তিনমাস থাকে।নিজের দেশে ফিরে গিয়ে নয় মাসের মতো সুইস ব্যাঙ্কে কাজ করে সংসারটাকে বোধহয় ঠকায়  তারপরে এখানে এসে ধর্ম করে।ইউরোপে যত অস্ত্র-শস্ত্রের চোরা কারবারি রয়েছে ,পৃ্থিবীর যুদ্ধ বিগ্রহ ,সংঘর্ষ লেগে থাকা জায়গায় যে সমস্ত বেশি দামে গোপনে মানুষ মারা অস্ত্র শস্ত্র ব্যবহার করে সেই প্রত্যেককেই সুইস ব্যাঙ্কগুলি টাকা ধার দেয়।

      সে বলেছিল তুমি রমেনের মতোই কৌ্তুক করে কথা বলছ।

      তুমি কিন্তু অপেক্ষা করছিলে না –তার কথার মধ্যে নিহিত হয়ে থাকা সামান্য শ্লেষ তুমি ধরতে পারছিলে না।তুমি লামা রিনপছের  বিরুদ্ধে বলেছিলে। বলেছিলে রানা রিনপছে যুবক অবস্থায়  তিব্বত ছেড়ে পালিয়ে এসেছে। না না দালাই লামার সঙ্গে আসেনি। অনেক পরে এসেছে। তিব্বতের সংগ্রাম ছেড়ে পালিয়ে এসে সে এখানে ধর্ম অধ্যয়ন করছে।

      সে মাত্র হেসেছিল। কোনো কিছু বলেনি। 

      তুমি তাকে পন্ডিত রামপ্রসাদ কী বলেছে জিজ্ঞেস করেছিলে। সঙ্গে তুমি বলেছিলে যে সে আসলে হিন্দু না বৌদ্ধ সেই বিষয়ে তোমার ধারনা স্পষ্ট নয়। 

      সে বলেছিল পন্ডিত রামপ্রসাদ নাকি তাকে বলেছিল যে সে ধর্ম এবং ধর্মতত্ত্বের ছাত্র মাত্র, নিজে ধর্ম মেনে চলা ব্যক্তি নয়। সে আরও বলেছিল যে পন্ডিত রামপ্রসাদ তাকে হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মের পার্থক্য এবং সাদৃশ্য গুলির বিষয়ে বলেছিল।

      তুমি এসব কী সেই বিষয়ে জানতে চেয়েছিলে।

      সে ব্যাগ থেকে ছোট্ট একটা নোটবই বের করে মেলে নিয়েছিল এবং তোমার দিকে তাকিয়ে ছিল। তোমার এরকম মনে হচ্ছিল যে তোমার আসলে জানার আগ্রহ আছে কিনা তুমি এমনিতেই জিজ্ঞেস করেছ সেই বিষয়ে যেন সে নিশ্চিত হয়ে নিতে চাইছিল। তুমি তোমার চোখে আগ্রহ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলে। সে হয়তো এবার বিশ্বাস করেছিল, কারণ সে খুব আগ্রহের সঙ্গে তার ছোট্ট বইটাতে লিখে আনা নোট গুলি দেখে তোমাকে ইংরেজিতে বলতে আরম্ভ করেছিল-বুদ্ধ তাঁর পুর্ববর্তী হিন্দু ধর্মীয় দার্শনিকদের কী কী জিনিস ত্যাগ করলেন। সে পড়ে গেল যে বুদ্ধ প্রথমে ত্যাগ করলেন ঈশ্বরের –পরম ব্রহ্মের ধারণাটা-এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটাকে একজন ঈশ্বর একটা নির্দিষ্ট সময়ে সৃষ্টি করেছিলেন এই ধারণাটা তিনি বর্জন করলেন।বর্জন করলেন আত্মার ধারণাটা ।আত্মা গিয়ে পরমাত্মায় বিলীন হয়ে মোক্ষ লাভ করে এই উপনিষদীয় ধারণা তিনি বর্জন করলেন।আত্মা,ঈশ্বর,মোক্ষলাভ এই সমস্ত ধারণা বর্জন করার পরে তিনি কোনো বিশেষ ধর্মগ্রন্থকে ,বিশেষ করে বেদকে একমাত্র সত্য বলে মানতে রাজি হলেন না।

      তুমি তন্ময় হয়ে তার কথা শুনছিলে।কখন রামপ্রসাদজী এবং লামা রিনপছে ওপরে উঠে এসে তোমাদের কাছে  দাঁড়িয়েছিল তোমরা বুঝতেই পার নি।যখন পন্ডিত রামপ্রসাদ কথা বললেন,তখন তোমরা চমকে উঠেছিলে।

      মেয়েটির কথার সূত্র ধরে পন্ডিত রামপ্রসাদ বলে গেলেন –বুদ্ধ যখন বেদকে অভ্রান্ত বলে মানতে রাজি হলেন না তখন তিনি ,বেদ ব্রাহ্মণের সামাজিক অনুশাসন-সমাজ সংগঠনের উপায় হিসেবে বর্ণপ্রথাকে মানতে রাজি হলেন না।পূর্বজন্মের পাপের ফলে মানুষ এই জন্মে নিচকুলে জন্ম হওয়ার কথা তিনি মেনে নিলেন না।জাতপ্রথাকে মানুষ সৃষ্টি করা এক কৃ্ত্রিম বৈষম্য বলে তিন একে পরিত্যাগ করলেন।

      লামা রিনপছে কাছেই বসেছিলেন।তিনি মুচকি হাসছিলেন।তিনি বলেছিলেন বৌদ্ধ ধর্মকে বুঝতে হলে পুনর্জন্ম,কর্ম এবং নির্বাণের ধারণাটা বুঝতে হবে।

      পন্ডিত রামপ্রসাদ বলে গিয়েছিলেন যে মানুষের মনই তার অস্তিত্ব এবং বিশ্বজগতের কেন্দ্র-এই মন থেকেই সমগ্র সৎ চিন্তা  এবং ভালো কাজের উৎপত্তি এই মন থেকেই পুনরায় সমস্ত অসৎ ,সমস্ত খারাপের জন্ম।মনকে বুঝে একে নিয়ন্ত্রণ করে সৎভাবে    জীবন নির্বাহ করাটাই আসল কথা।

      বুড়ো দুজনের উপস্থিতি তুমি পছন্দ করতে না।

      তোমার ধারণা হয়েছিল যে তাঁরা তোমাদের এক পেট্রোনাইজিং সুরে কথা-বার্তা বলছিল।তুমি এই ধরনের মনোভাব সহ্য করতে পারছিলে না।

      সমস্ত জীবের প্রতি করুণা –এই করুণাই হল ধর্মের মূল-লামা রিনপছে গম্ভীর সুরে ঘোষণা করেছিল।

      তোমার এইবার রাগ হয়েছিল।তুমি করুণার ধারণাটিকে আক্রমণ করেছিলে।তুমি বলেছিলে তুমি করুণার কথাটিকে সন্দেহের চোখে দেখ।যে পৃ্থিবীতে করুণার পাত্র হতে পারা গরিব,দুঃখী,শোষিত বঞ্চিত মানুষ থাকবে –সেই পৃ্থিবীতে করুনার প্রয়োজন।পৃ্থিবীটাকে পরিবর্তিত করার চেষ্টা না করে ,দারিদ্র্য দূর করার চেষ্টা না করে কেবল করুণার কথা বলাটা এক প্রকার প্রহসনই কেবল নয়।এটা মানুষের অন্যায়ের অবসানের জন্য প্রচেষ্টা এবং সংগ্রামকে ভোঁতা করে ফেলে মাত্র।

      তোমার কথা পণ্ডিত রামকুমার এবং রিনপছে গম্ভীরভাবে শুনছিল।তারা কিছু বলছিল না।কিন্তু এইবার মেয়েটি বলে উঠেছিল।সে তোমার কথার উত্তর দিয়েছিল।

      সে তোমাকে বলেছিল পৃথিবীতে অসমতা আছে,বঞ্চনা আছে,বৈষম্য আছে,এগুলি তো বাস্তব।কখনও যে এই সমস্ত নাই হয়ে যাবে,বা কেউ দূর করতে পারবে সেরকম নয়।মানুষের জীবনে দুঃখ,দূরবস্থা বঞ্চনা থাকবেই।অত্যন্ত ধনী সমাজের মধ্যেও কি নেই? এরকম পরিস্থিতিতে সমবেদনা বা করুণা এক ভূয়া আবেগ নয়,বরঞ্চ এটা মানুষের এক আন্তরিক প্রতিক্রিয়া-এক জেনুইন এবং মানবীয় কাজ।

      তুমি মনে করেছিলে লামা রিনপছে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ছিল।বড়ো বিষণ্ণ ভাবে তিনি মাথা নাড়ছিল যেন।পন্ডিত রামপ্রসাদের মুখটাও ছিল গভীর এবং বিষণ্ণ।তোমার হঠাৎ মনে পড়েছিল যে এখন সুইস সাহেবটা,শুকনো উবান সুইস সাহেব এসে উপস্থিত হলেই ষোলো কলা পূর্ণ হবে।তোমার তখনও রাগটা কমে নি।তুমি এইবার ধর্ম এবং ঈশ্বরের ধারণাটাকে আক্রমণ করেছিলে।ঈশ্বর ফাকি,ধর্ম ফাকি,ধর্মই ঈশ্বরকে সৃষ্টি করে নিয়েছ সেই বিশেষ ধর্মের নেতাদের সুবিধার জন্য,স্বার্থের জন্য তুমি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলে।বোধহয় এই কথাগুলি তুমি তোমার অন্তরের গভীরে সঞ্চয় করে রেখেছিলে।আজ সুবিধা পেয়ে কথাগুলি সাবলীল্ভাবে তোমার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে।


আরো পড়ুন: অর্থ (পর্ব-৩৮) । ধ্রুবজ্যোতি বরা


      তুমি কিছুটা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেছিলে যে পন্ডিত রামপ্রসাদ এবং লামা রিনপছে দুইজনেই নীরবে মাথা নেড়ে তোমার কথাকে সমর্থন জানিয়েছিল।তাঁদের এই প্রতিক্রিয়ায় তুমি কেবল আশ্চর্য হওয়াই নয়,কিছূটা কনফিউজড ও হয়েছিলে।তোমার কথার ফোয়ারা ক্রমে বন্ধ হয়ে এসেছিল।একটা সময়ে তুমি নীরব হয়ে পড়েছিলে।

      লামা রিনপছে এবার ধীরে ধীরে বলেছিল যে ধর্মের মূল কথা ভগবান এবং মানুষের মাঝখানের সম্পর্ক নয়।পৃ্থিবীর সমস্ত ধর্মেই ভগবান এবং মানুষের মধ্যের সম্পর্ককে প্রাধান্য দেওয়া হয়।কিন্তু বুদ্ধের মতে ধর্মের কেন্দ্রীয় বিষয় হল মানুষ এবং মানুষের মধ্যে সম্পর্ক।ধর্মের উদ্দেশ্য হল মানুষ অন্য মানুষের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক রাখবে তার শিক্ষা দেওয়াটাই যাতে সমস্ত মানুষ সুখে থাকতে পারে।

      পন্ডিত রামপ্রসাদ বলেছিলেন বৌদ্ধ ধর্মই হল একমাত্র ধর্ম যে ধর্ম মানুষ মানুষের জন্য সৃষ্টি করেছে-ঈশ্বর মানুষের জন্য সৃষ্টি করেনি। তাই এই ধর্মে অতি স্বাভাবিকভাবে শান্তি,অহিংসা এবং করুণার ধারণাগুলি এসে যায় এবং খাপ খেয়ে পড়ে।

      তোমার হঠাৎ লেখক উমবার্তো ইকোই বলা একটা কথা মনে পড়েছিল।কিছু একটা ভালো লাগে তুমি উদ্ধৃতিটা কোথাও লিখে রেখেছিলে-তুমি এইবার স্মৃতি  থেকে সেই কথাটা বলেছিলে-সত্যিই ধর্মের ঈশ্বরের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই,জীবন কোথা থেকে উৎপত্তি হল ,মৃত্যুর পরে জীবের কী হয় –এই চিরন্তন রহস্যগুলির প্রতি মানুষের যে সহজাত এবং স্বাভাবিক জিজ্ঞাসা সেগুলিই আনুষ্ঠানিক ধর্মের জন্ম দিয়েছে এবং ধর্ম উপায় না পেয়ে ঈশ্বরের সৃষ্টি করে নিয়েছে।

      পন্ডিত রামপ্রসাদের মুখটা দেখে তোমার এরকম মনে হচ্ছিল যেন তোমার কথা শুনে তিনি ইমপ্রেসড হয়েছেন।তিনি ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে তোমাকে উত্তর দিয়েছিলেন যে তোমরা দুজনে আলাদা আলাদা একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছ।বুদ্ধও সেটাই বলে গেছেন।বুদ্ধের মতে ঈশ্বর কল্পনাই একটা বিপজ্জনক কথা-তা স্পেকুলেশনের জন্ম দেয়,ঈশ্বর দুঃখ মোচন করবে বলে মানুষ পূজা-প্রার্থনায় বিশ্বাস করে আর সঙ্গে সঙ্গে পুরোহিত শ্রেণির জন্ম হয় যে সমস্ত ধরনের অন্ধ বিশ্বাস ,অর্থহীন আচার অনুষ্ঠানের জন্ম দান করে।প্রকৃ্ত ধর্ম হল মানুষ মানুষের সঙ্গে মৈত্রী এবং আনন্দে ,হিংসা এবং পাপপুণ্যরূপে বসবাস করতে শিক্ষা দেয় ধর্ম।

      তোমার ভেতরের ক্রোধ তখনও প্রশমিত হয় নি।ঠিক কিসের জন্য তোমার রাগ হয়েছিল,কিসের জন্য তুমি উত্তপ্ত এবং অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছিলে তুমি বলতে পার না।কিন্তু তোমার মনে এক অকারণ ক্রোধ ,এক ভয়ানক আক্রোশের জন্ম হয়েছিল।সেই আক্রোশের বশে তুমি মেয়েটির দিকেও দেখছিলে না।আর সেই আক্রোশের জন্যই তুমি হঠাৎ ঘোষণা করেছিলে সমস্ত ধর্মই জনসাধারণের জন্য আফিম,আফিমের মতো।

      পন্ডিত রামপ্রসাদ এবং লামা রিনপছে উত্তর দিচ্ছিল না।তাঁরা বিদায় নিয়েছিল।পন্ডিত রামপ্রসাদ তাঁর ঘরে এগিয়ে যাচ্ছিলেন।এবং লামা রিনপছে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গিয়েছিল।তাঁরা যাবার পরেও তোমার ক্রোধ প্রশমিত হচ্ছিল না। বরং এক ধরনের শূন্যতা তোমাকে ঘিরে ধরেছিল।তোমার এরকম মনে হচ্ছিল যে তুমি যেন কোনোজায়গায় হেরে গিয়েছিলে।খারাপভাবে হেরে গিয়েছিলে।কিছু একটা যেন অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছিল।

      তুমি মাথা তুলে মেয়েটির দিকে তাকাতে পারছিলে না।কথা বলতে পারছিলে না।

      মেয়েটি টেবিলের ওপরে থাকা তোমার হাতটার ওপরে নিজের হাতটা রেখে ধীরে ধীরে তোমাকে বলেছিল-এসো আমার করা টংখা পেন্টিংগুলো তোমাকে দেখাব।

      তোমরা তার ঘরে প্রবেশ করেছিলে।

      দরজাটা খুলে ,পাতলা জালের মতো কাপড়ের পর্দাটা ঠেলে তোমরা ভেতরে ঢুকেছিলে।

      পরিপাটি ঘরটির একপাশে থাকা টেবিলটার ওপরে একটা টেবিল লাইট জ্বলছিল।

টেবিল লাইটের ঘূর্ণমান সাদা আলোটা টেবিলের উপর এবং বিছানার একাংশ আলোকিত করে রেখেছিল। ঘরের বাকি অংশ  আলো ছায়ার রহস্যময়তায় ডুবে যাচ্ছিল।

      সে তোমাকে তার টংখাটা দেখার জন্য ডেকেছিল। টেবিলটার নিচের আলোর বৃত্তে সে কয়েকটি অর্ধেক করা টংখার ছবি বের করে দিয়েছিল।

      তুমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলে– দেখেছিলে দুটো গভীর কুয়ো— গভীর এবং রহস্যময়। আর সেই লাইটের ম্লান আলোতে তুমি দেখেছিলে সেই কুয়োর মধ্যে দুটো সোনালি মাছ সাঁতার কাটছে। দুটো সোনালি মাছ। 

      সে তোমাকে এক এক করে টংখা গুলি দেখিয়েছিল। 

      তোমরা দুজনে একে অপরের একেবারে কাছে দাঁড়িয়ে টংখাগুলি দেখছিলে।

      মেয়েটির শরীর থেকে ফুলের হালকা সুবাস ভেসে এসে তোমার নাকে লাগছিল। ঘরটা তিব্বতি ধূপের গন্ধে পরিপূর্ণ হয়েছিল। তুমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলে তার প্রতিটি টংখাই অসম্পূর্ণ কেন ।প্রতিটিই কেন সে অর্ধেক করে রেখেছে —এখনও সম্পূর্ণ করেনি। মেয়েটি ফিসফিস করে বলেছিল যে সে প্রতিটি টংখাই সম্পূর্ণ করবে। মিহি তুলিকায় টানা প্রতিটি আঁচই সে সম্পূর্ণ করবে।

      পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা তোমাদের শরীর দুটো স্পর্শ করেছিল।

 কাপড়ের স্তরের মধ্যে দিয়ে তুমি তাকে অনুভব করছিলে।

       সে দূরে সরে যায়নি। তুমিও দূরে সরে যেতে দাওনি।

      গায়ে গা লাগিয়ে তোমরা নীরবে আধা করা টংখাগুলিকে  দেখছিলে— অনেক, অনেক সময়।

      তুমি তার শরীরের উত্তাপের আভাস পেয়েছিলে। হাতটা তুমি আলগোছে তার পিঠ দিয়ে নিয়ে বাহুতে রেখেছিলে। সে তোমার দিকে হেলে এসেছিল। তুমি তাকে জড়িয়ে ধরে ছিলে। সে একটা লতার মতো তোমাকে ঘিরে রেখেছিল। তুমি হাত বাড়িয়ে টেবিল লাইটের সুইচটা অফ করে দিয়েছিলে।

       ঘরের আলো নাই হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ বাতির আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে থাকা রাতের আকাশের আলো ঘরের কাছের জানলা দিয়ে ঢুকে পড়েছিল এবং ঘরটি এক অপার্থিব নীল আলোতে নীলাভ হয়ে উঠেছিল।

      তোমার ঠোঁট দুটি তার ঠোঁট দুটি খুঁজে নিয়েছিল।

      তুমি অনুভব করেছিলে তার সুডোল গ্রিবা,সুগঠিত বাহু।

      তোমার বুকের লোমের মধ্যে তার আঙ্গুলগুলি ঢুকে পড়েছিল। 

      তোমরা দুজনেই খুঁজে নিয়েছিলে তার কোমল বিছানাটা।

      সে তোমার শরীরের প্রতিটি অংশ  পরখ করে দেখছিল। তুমি সন্ধান করতে আরম্ভ করেছিলে তার সমস্ত পাহাড়, উপত্যকা, প্রতিটি মন্দির ,মালভূমি,সমস্ত অরণ্য— রেশম কোমল বিস্তীর্ণ তৃণভূমি– তার মুখের কোমল  বনফুলের গন্ধ—ঠোঁটের নোনতা স্বাদ– 

      হু হু করে আগুন জ্বলতে থাকা একটা ঘাসের মাঠের মধ্য দিয়ে যেন তুমি দৌড়াচ্ছিলে আর একটা সময়ে সম্পূর্ণ বিবশ হয়ে ছিটকে পড়েছিলে। 

      আর তারপরে তুমি ধীরে ধীরে ডুবে গিয়েছিলে।

       রোদ পড়ে উষ্ণ হয়ে থাকা নিথর জলের একটি গভীর পুকুরে তুমি ধীরে ধীরে ডুবে  যাচ্ছিলে— তার চোখের চেয়েও গভীর একটি পুকুরে— চেতনা থেকে অচেতনায় ,জীবন থেকে জীবনের অন্য কোনো এক অচিন পারে তুমি ধীরে ধীরে ডুবে ভেসে গিয়েছিলে।

      ধীরে ধীরে। খুব ধীরে ধীরে।

 

 

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত