| 6 অক্টোবর 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত কবিতা

অসমিয়া তিন কবির কবিতা

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

এক সময় অসমের নাম ‘কামরূপ’ ছিল। আরও প্রচীনকালে কামরূপ ছিল ‘প্রাগজ্যোতিষ’ নামে। উত্তর-পূর্ব ভারতের এই রাজ্যটি হিমালয়ের দক্ষিণে অবস্থিত। এর অভ্যন্তরে রয়েছে ব্রহ্মপুত্র নদ, বরাক উপত্যকা এবং উত্তর কাছাড় পর্বতমালা। উত্তর-পূর্ব ভারতের অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা এবং মেঘালয় রাজ্য দ্বারা অসম বেষ্টিত এবং অসম সহ প্রতিটি রাজ্যই উত্তরবঙ্গের একটি সংকীর্ণ অংশ দ্বারা ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া অসমের আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে ভুটান ও বাংলাদেশের সঙ্গে। চা, রেশম, পেট্রোলিয়াম এবং জীববৈচিত্রের জন্য অসম বিখ্যাত। অসমিয়াদের প্রধান উৎসব হলো বিহু। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে অসমিয়ারা বিহু পালন করে। বিহু তিনটি- ব’হাগ (রঙালি) বিহু, মাঘ (ভোগালী) বিহু আর কাতি (কঙালি) বিহু। অসমীয়া সাহিত্য অন্য সমস্ত ভাষার মতো অসংখ্য উপন্যাস, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ এবং অন্য অন্য বিষয়ক গ্রন্থে পূর্ণ। অসমীয়া সাহিত্য ভাষাটির বর্তমানের সাহিত্য সম্ভার ছাড়াও এর ক্রমবিবর্তনের সময়ে সৃষ্টি হওয়া পুরানো অসংখ্য সাহিত্যের সম্ভারে পরিপূর্ণ, যে ধারার আরম্ভ ৯ম-১০ম শতকের চর্যাপদ থেকে আরম্ভ হয়েছিল বলে ধরা হয়। অজিৎ বরুয়া, অনন্ত কন্দলী,অনিরুদ্ধ কায়স্থ, অম্বিকাগিরি রায়চৌধুরী, আনন্দরাম বরুয়া , ইমরান শাহ, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য্য, জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা, ভোলানাথ দাস, মফিজুদ্দিন আহমদ হাজারিকা, মহেন্দ্র বরা, মাধবদেব, রবীন্দ্র সরকার, রমাকান্ত চৌধুরী, বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা, স্নেহ দেবী, হরিবর বিপ্র, হীরেন ভট্টাচার্য সহ আরো অনেক অসমীয়া ভাষার উল্লেখযোগ্য কবি আছেন। এই সময়ে অসমীয়াতে কি রকম কবিতা লেখা হচ্ছে কারা লিখছেন, এই সময়ের তিন কবির কবিতা নিয়েই আজকের আযোজন। ইরাবতীর পাঠকদের জন্য মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ করেছেন অনুবাদক বাসুদেব দাস।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,তপন বরুয়া
তপন বরুয়া

১৯৬৪ সনে ডিব্ৰুগড়ের টেঙা খাতে জন্ম।ভারতীয় বিমান বাহিনী থেকে অবসর গ্ৰহণ করেন।প্রকাশিত ‘ছাঁর খোঁজ’,’জোনাক জোয়ার’,বিপন্ন নাগরিক আরু অন্যান্য কবিতা’।


এখানে স্বাধীনতা
এখানে স্বাধীনতা একটা শব্দের মতো।
হতে পারে এটা কোনো প্রতিবাদী শোভাযাত্রার
হতে পারে কোনো বন্যা আক্রান্তের
হতে পারে কোনো অসহায় নারীর আর্তস্বর।
 
এখানে স্বাধীনতা একটা শব্দের মতো।
স্বাধীন স্বাধীন বলে মানুষের বয়স কমায়
দাড়ি পাকে চুল পাকে
বিনা বেতনে ষাঠের গণ্ডি অতিক্রম করে
বিদ্যালয়ের শিক্ষাগুরু হয়ে অবসর নেয়,চাঁদ-সূর্য বের হয় লুকোয়
কুড়িবর্ষের আগে দেখা পথটা
সেই ঘাটটায় রঙ বদলাবার শব্দ বের হয় না।
 
এখানে স্বাধীনতা একটা শব্দের মতো।
একমুঠো অন্নের জন্য এক টুকরো রুটির জন্য
হাত পাততে পাততে
দিশাহারা হয় বাতাস,বিবেক-বুদ্ধি-বিচার
মানুষ চোর হয় ডাকাত হয় সন্ত্রাসবাদী হয়
সংশয়মুক্ত হতে পারে না সময়,
ক্ষয় হয় ত্যাগ-বলিদানের বলে অর্জিত
একটা শব্দের বাণী,অর্থ।
 
এখানে স্বাধীনতা একটা শব্দের মতো।
ঘাম-শ্রম-নাম-গন্ধহীন,
কাঁদা ছেটানো,সহজ অর্থ-অর্জন
নতুন নতুন দিনের উদযাপনের
উষ্ম অভ্যর্থনা,শত আয়োজন।
নিজের ছবি নিজের গান নিজের কবিতা ঠিক
বাকি যেন বিসর্জনের উচিত.
 
এখানে স্বাধীনতা একটা শব্দের মতো।
 
এই দেশ মহান,এই দেশের মানুষ মহান
এর ইতিহাস মহান-
এই বৃন্দগান গাইতে গাইতে
গণভোট চাইতে চাইতে
ভুলে যায় পরাধীনতাকালের স্বপ্ন।
ভুলে যায় স্বাধীনতা নয় কেবল একটি
জাতীয় পতাকা,
নয় কণ্ঠ পরিবেশিত স্বদেশপ্রেমের গান
অথবা কবিতা।
 
 
এখানে স্বাধীনতা একটা শব্দের মতো।
স্ব-ইচ্ছায় আমরা যার অর্থ আর উদ্দেশ্য

উন্মোচন করতে চাই না।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,assamese-golden-silk
মুগারে নিৰ্মিত অসমের মেখেলা চাদরের সাথে একটা জাপি

 
 
 
মর্গের দুয়ার মুখে
সময়-অসময় বলে কিছু নেই মেডিকেলটার!
দুয়ারমুখে প্রতিট ওয়ার্ড আর
কক্ষকেই
রোগার্ত জগত একটা
নিশ্বাস রুদ্ধ করে ঘিরে থাকে অহরহ।
নতুন নতুন রোগীর সঙ্গে আত্মীয়-স্বজন
হুড়মুড় করে আসে
আর ঢুকেই প্রত্যক্ষ করে তার
দরজা-দেওয়াল,সিলিং
আর মার্বেলের মেঝের চারপাশে
ঘুরে ঘুরে ধ্বনিত হয়ে থাকা হাজার জনের
হাহাকার আর্তনাদ।
 
দিন দুপুরেই
রোগি দেখাতে এসে এই মাঝরাতে
আমরা কয়েকজন যখন ঠাণ্ডা করিডরটার
দীর্ঘ একটা বেঞ্চে ঠেলা-ধাক্কা করে
তখনই সামনে দিয়ে একটা ষ্ট্রেচার
ওপরে সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা
ঠিক পেছন পেছন বিষাদগ্রস্ত একদল ব্যক্তি
নিঃসন্দেহে। মৃতেরই নিকট আত্মীয়জন।
সোজাসুজি,ওপাশে
অন্ধকারময় একটা কক্ষ
আর দরজাটা মেলে দাঁড়িয়ে কেউ
একজন
যার চোখে
তিরবির করছিল কেবল
সেই ঠেলে নিতে থাকা ষ্ট্রেচারটা।
 
সেখানে নাকি জীবিত মানুষ থাকে না
ঐ মানুষটা নাকি মর্গের রক্ষী!
‘ইস!আমি তো আজ
সাক্ষাৎ মুখ মেলে থাকা অজগরটার
সামনে!’
একটা চিৎকার করে তখন
বিছানায় পড়ল যে পড়লই আমার নীরোগ
কবিতার অনুভব
 

বলার মতো আজই কিছুটা আরোগ্য!


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,প্রণব কুমার বর্মন
প্রণব কুমার বর্মন

১৯৭৯ সনে অসমের নলবাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন।কবি এবং ঔপন্যাসিক হিসেবে জনপ্রিয়।প্রকাশিত কাব‍্যসংকলন গুলির মধ্যে ‘তুমি সাগরিকা বরদলৈ’বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।


 
চল
চল আমরা পুনরায় প্রেমে পড়ি
চোখ থেকে বিদায় নেওয়া বৃষ্টিরঝাঁককে
প্রার্থনার সাহায্যে ফিরিয়ে আনি হৃদয়ে
নিশ্বাস থেকে চলে যাওয়া সুগন্ধি ঋতুর
সবুজ ফড়িঙদের আবার ঘর
তৈরি করে দিই বুকের বাগানে
পদক্ষেপ থেকে হারিয়ে যাওয়া দুব্বোঘাসের
ধূলিগুলি পুনরায় মেখে নিই দুপায়ে
 
চল আমরা আবার প্রেমে পড়ি
কমলার ঝোপের সোনালি ফলগুলির
যার কোষে আমাদের স্মৃতি শুয়ে আছে
চল প্রেমে পড়ি
রূপালি চাঁদনি রাতে পাশে শুয়ে থাকা
গহীন অরণ্যের আর গান গেয়ে সান্ত্বনা দিতে
থাকা ঝিঁঝিঁ পোকাদের
 
চল আমরা আবার প্রেমে পড়ি
মহিলাদের চুল দিয়ে নেমে আসা স্বপ্নকে
নিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির
আমাদের পূর্বজন্মের ছাই দিয়ে উতলা সাগরের
পাহাড়ের বুকদিয়ে আলো বইয়ে
দেওয়া
স্বর্ণাভ সূর্যের
 
চল আমরা পুনরায় প্রেমে পড়ি
নাহলে আমরা মরে যাব।

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,হরেন গগৈ

হরেন গগৈ

১৯৭০ সনে কবি এবং গদ্যকার জন্ম গ্ৰহণ করেন।প্রকাশিত কাব্য সংকলন ‘জোনাকতে জোরণ’,’বকুল তলর গান’,’দুপর টেঙা পাতর দরে’।


 

পানী কুঁয়লী
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস
রাতের ভেতরে
ফুলে ফেঁপে উঠেছে বড়নদীর বুক
 
গাছের
দীর্ঘ ছোট ছোট পাতাগুলি আলোকিত করে তোলা
বিকেলের সূর্যের রঙটা
ধীরে ধীরে গুমোট আকাশটা
ঢেকে ফেলেছে
 
জলে নামা মহিলাটির
জালের আড়ালে
এক ঝাঁক ঠাণ্ডা বাতাস কেঁপে উঠছে
 
বোঝাতে না পারা সোঁ সোঁ শব্দগুলি
বহুদূর পর্যন্ত ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ছে
 
কলার ভেলা একটা ভরপুর জল ভেদ করে
এগিয়ে যেতে দেখেছি
নেড়েচেড়ে দেখি
ফুঁপিয়ে উঠা ফ্যাকাসে হাসির মুখ
 
পাতলা কুয়াশা ঘিরে ফেলেছে
ছোটছোট ঘরগুলির চাল
পানী কুঁয়লী উঠায়
থমকে গেছে বন্যার জল।
 
টীকা-

পানী কুয়ঁলী –বর্ষাকালে নদীর জল বাড়ার সময় যদি নদীর তীরে কুঁয়লীর (কুয়াশার) সৃষ্টি হয়,লোকবিশ্বাস অনুসারে তাহলে নদীর জল আর বাড়ে না।বর্ষাকালে নদীর তীরে সৃষ্টি হওয়া এই কুয়ঁলীকে লোকপরম্পরায় পানী কুয়ঁলী বলে। অসমিয়া বানানে ‘ৱ’ ব্যবহৃত হয়।বাংলায় এই অক্ষরটি নেই বলে তাঁর নিকটবর্তী ‘য়’ব্যবহার করা হয়েছে।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bihu
অসমের মূল বিহু উৎসব বসন্তের শুরুতে উদযাপন করা হয়। রঙ্গালী বিহু যৌবনের উৎসব।

 
অপদেবতায় পাওয়া সময়ের গান
শুনেছি ফুরফুরে বাতাসের একটা গান
ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে কেঁপে উঠছে
খড়ি বিক্রি করা ছেলেটির দুঃখ
 
গ্রামের উঠোনে মূর্ছা গেছে
তোর সবুজ শৈশব
অন্ধকারের ফাঁক দিয়ে বুকের গানগুলি
আগুন হয়ে জ্বলছে
 
মাঝরাতেও কেঁদে উঠা একটা গান শুনেছি
দেখুনতো শিলাবৃষ্টিতে খড়ির ভারটা কীভাবে ভিজছে
বোনের খালি ব্যাগটাতে
ছটফট করছে যন্ত্রণার শব্দগুলি
তোর ঠোঁটে কী গান বাজছে
বলতে চাইনা বিষাদময় কথা
 
স্বপ্নে জেগে উঠছে এক চিলতে আলো
চোখ মেলে তাকিয়ে আছি
শুনছি অপদেবতায় পাওয়া সময়ের গান
 
বাতাসে থমকে রয়েছে
এই শহরের এক অবাক দৃশ্য

 
 
Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,assam
গামোচা অসমীয়া সমাজ জীবনের অতি আদরের বস্ত্ৰ৷ সাধারণত গামোচা চারি দিকে রঙ্গিন সূতায় (বিভিন্ন রঙ্গ থাকে) বোনা একটি সাদা দীর্ঘ কাপড়৷

 
 
 
 ভালোবাসার একটা ঘর
দাদু-দিদা গড়ে যাওয়া ঘরটাতে
এখনও আমরা একসঙ্গে থাকি
উত্তরে হাঁড়ি দক্ষিণে গরু
বিকেলের উনুনে মজার কথা বলে
বন্য স্বপ্নের সঙ্গে খেলা করি
 
পিতা-মাতা গড়েছে একই ঘর
পূর্বে ভাঁড়ার পশ্চিমে খোঁয়ার
না-খাওয়ার দিন উঠোনে বসে
এক টুকরো জমি বাগান করার স্বপ্ন দেখি
 
 
পুরোনো ঘর ভেঙে নতুন ঘর তৈরি করার জন্য
একটা নক্সা আঁকছি
উত্তর থেকে দক্ষিণে
পূব থেকে পশ্চিমে
বাস্তুশাস্ত্র মতে ঘরটা সাজিয়ে দেখছি
 
ছোট শিশুটি দৌড়ে এসে
আমার কানে ফিসফিস করে বলল
নতুন ঘর বানালে তোমাদের জন্য
একটা রুম আলাদা করে রেখ
জীবনের ভাটি বয়সে
বুকের ববচা বনে
প্রেমের শিস দিয়ে মেপে রাখবে সময়।
 
 
 
 
 
 
 
 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত