| 18 অক্টোবর 2024
Categories
উৎসব সংখ্যা ১৪৩১

উৎসব সংখ্যা গল্প: সুখপ্রীত এ্যাট ব্রুকলীন । অদিতি ফাল্গুনী

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

বড়া হুয়া তো ক্যা হুয়া? য্যায় সে পে খেজুর!

পন্থি কো ছায়া নাহি, ফল লাগে অতি দূর।

(তুমি অনেক বিত্তশালী বা প্রতাপশালী বড় মানুষ হয়েছে তো কি? এ ত’ মরুভূমির খেজুর গাছের মতোই যা না দেয় পথিককে ছায়া আর ফলও নাগালের বহু বাইরে।-গ্রন্থ সাহেব)।

প্রতিদিনের মত আজও সকাল সাড়ে ন’টার ভেতর ব্রæকলীনের এই দশ জাতির মানুষের বসতির মাঝখানে তার ছোট্ট, একটেরে তবে ছিমছাম পার্লারে ঢুকে সবার আগেই কাউন্টারের মাথার উপর টাঙ্গানো গুরু নানকের ছবির সামনে ধূপকাঠি ধরিয়ে আর দু’টো ফুল রেখে নিজের মনেই গ্রন্থ সাহিব থেকে দু’টো লাইন মনে মনে বিড়বিড় করে আওড়ায় সুখপ্রীত। গ্রন্থ সাহিব অনেকটাই মুখস্থ তার।

ম্যাডাম- চায়ে!

বিলকিস বানো ততক্ষণে চা নিয়ে এসেছে। পাকিস্থানের মেয়ে বিলকিস- সুখপ্রীতের মতই সে-ও পাঞ্জাবি। দু’জনেরই মাতৃভাষা পাঞ্জাবি। ফলে অফিসে কাজের ফাঁকে কথা-বার্তা ভালই হয় তাদের। সত্যি বলতে পাঞ্জাবি বলতে পারে বলেই খোদ ইন্ডিয়ার একটি তামিল মেয়ে ও আর একটি ইউপিওয়ালী মেয়েকে নাকচ করে দিয়ে বিলকিসকে কাজে নিয়েছে সুখপ্রীত। এছাড়া বিলকিসের হাতের কাজও খুব ভাল। ভ্রু থ্রেডিং বা নানা স্তরের কেশ বিন্যাসে বিলকিসের জুড়ি নেই। ছোটখাটো তবে ফর্সা ও লাল টুকটুকে বিলকিসের চোখে ঘন কাজল, পরণে জিন্সের ট্রাউজার আর শর্ট কামিজ, তবে মাথায় হিজাব আর সেটাই তার স্তনের উপরিভাগও খানিকটা আচ্ছাদন করে থাকে। নিছক বুক ঢাকতে বাড়তি কোন ওড়না নেই। খোদ দিল্লি শহরের মেয়ে হলেও অমৃতসরের যেই না রক্ষণশীল শ্বশুরবাড়িতে বিয়ে হয়েছিল সুখপ্রীতের, তাতে এই নিউইয়র্ক না আসা হলে আজো দেশে থাকলে ঢিলেঢালা সালোয়ার, কামিজ আর শাশুড়ি মায়ের মতই লম্বা দুপাট্টা পরে থাকতে হতো সুখপ্রীতের নিশ্চিত। এদেশে তারা আসলো যেন কবে? সে আর তার বর বলবিন্দর নিউইয়র্ক যেদিন প্রথম পা রাখলো, তখন তার বড় মেয়েটা কোলে। দেড় বছর বয়স। সেই মেয়ে এখন হাই স্কুল শেষ করে, কলেজ করতে করতে দুপুরের পর এসে মা’র ক্যাশবাক্স সামলায়। ক্লায়েন্টও কিছুটা সামলায়। সুখপ্রীত তখন মেয়ের হাতে দোকান দিয়ে মাঝে মাঝে আধা ঘন্টার জন্য দশ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে বাসায় যায়। ছোট ছেলে পরমবীর হাই-স্কুল শেষ করে আসে। তাকে কিছু খেতে দিয়ে আবার সন্ধ্যার আগেই দোকানে ফেরে সুখপ্রীত। দোকান চলে আর রাত আটটা পর্যন্ত। তার বর বলবিন্দর অতি সম্প্রতি এখানে একটি ছোটো-খাটো অফিসে কাজ থেকে অবসর নিয়েছে। সুখপ্রীতের বয়সও ত’ পঞ্চাশ হলো। বিয়ের পর তিন/তিনটা বাচ্চা কে জানে কেন এ্যাবর্শন হয়েছিল সুখপ্রীতের। একবার ত’ ভয়ই ধরে গিয়েছিল যে আর বোধ হয় বাচ্চা হবে না। বলবিন্দর বাবা-মা’র সাথে তর্ক করেই অপয়া, বাচ্চা ধরে রাখতে না পারা’ বউকে ছাড়ে নি। এই করে করে বাইশে বিয়ে হওয়া সুখপ্রীতের প্রথম যে সন্তান আট মাস পূর্ণ করে পৃথিবীতে পা রাখলো, সে এই বড় মেয়ে সারিকা। সারিকা কাউর। ততদিনে সুখপ্রীতের বয়স ত্রিশ হয়ে গেছে। একে আট বছর দেরিতে প্রথম বাচ্চা, তাতে মেয়ে! এরপর শ্বশুরবাড়ির যা চেহারা- উঁহু- শুধুই কি শ্বশুরবাড়ির চেহারা? আরো অনেক কিছু।

‘ম্যাডাম- টিভি?’

উশখুশ করে বিলকিস বানো। হেসে ফ্যালে সুখপ্রীত। আজ ইন্ডিয়া-পাকিস্থানের নৈশকালীন একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ। এখনো খদ্দেররা আসা শুরু করেনি। টিভিতে ম্যাচ দেখার সময় বিলকিস পাকিস্থানের প্রতি তার সমর্থন লুকায় না, সুখপ্রীতও ভারতকে সমর্থন করে। ভারতকে সমর্থন…হ্যাঁ, সমর্থন ত’ বিলকুল করতেই হবে! সাতচল্লিশে সুখপ্রীতের দাদা লাহোরে বড় মকান লেকিন নিজের ঘরের পাশে এইটুকুনি ছোট্ট একটি গুরুদুয়ারাও ফেলে চলে এসেছিলেন দিল্লি। তখন কি কষ্ট কি কষ্ট! যতদিন না আর সুখপ্রীতের বাবা ইন্ডিয়ান আর্মিতে জয়েন করেছিল! বাপ তার আর্মিতে চাকরি পাবার ছ’মাসের মাথাতেই সুখপ্রীতের জন্ম। আর্মির খুব উঁচু পদে নয়- জওয়ান পদেই চাকরি- প্রথম পোস্টিংই ছিল বছরের অনেকটা সময় বরফে ঢাকা কাশ্মীরে। যেখানে যখন-তখন নাকি বোমা ফাটে। বাবা সেই বরফ ঢাকা কাশ্মীর থেকে প্রতি মাসে পোস্ট কার্ড বা চিঠি পাঠাতো আর সাথে মানি অর্ডার- তখনো আজকের মত এত ই-মেইল, ফেসবুক, হোয়াটস-এ্যাপ বা মেসেঞ্জার ছিল নাতো! ছোট চাচাই দিল্লি কলেজে বিএ পড়তে পড়তে প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহেই পোস্ট অফিসে গিয়ে সব নিয়ে আসতো। হাতে টাকা এলেই দাদা-দাদির মাসের ওষুধ, বাড়িঅলার ভাড়া, মাসের চাল-ডাল-গম সব কেনার পর সুখপ্রীতের জন্য সবার আগে মা ছুটতো দর্জিবাড়ি কোন নতুন জামার অর্ডার নিয়ে। বাবার বাড়িতে সুখপ্রীতের তাই ছিল আলাদা আদর। যৌথ পরিবারের সংসারে ছোট চাচা, দাদা-দাদি সবার কোলে কোলে সুখপ্রীত যেন এক আদরের রাজকুমারী। সুখপ্রীতের দশ হতে হতেই বাবা দু’টো প্রমোশন পেয়ে গেছে। ততদিনে কাশ্মীরে মেয়াদ শেষ করে বাবার পোস্টিং হয়েছে মণিপুরে। ছ’মাসে একবার দিল্লি এসে সুখপ্রীত আর তার ছোট ভাই হরভজন, সুখপ্রীতের মা গুলাবী আর ছোট চাচা গুরুশরণকে দেখেই আবার খুশি মনে পোস্টিংয়ের জায়গায় ফিরে যেত বাবা। তবে বাবা চাইতো- খুব চাইতো যে তার দুই ছেলে-মেয়েকেই ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করা হোক। ইংরেজি মিডিয়ামে পড়লে ছেলে-মেয়ে বখে যাবে কিনা, বাড়ির বড়দের কথা মানবে কিনা, গুরু আর গ্রন্থ সাহেবে মন থাকবে কিনা, রোটি-সব্জি ছেড়ে বার্গার-স্যান্ডউইচ খাবে কিনা- দাদা-দাদির এমন সব কথা হেসে উড়িয়ে দিত বাবা। যা দিন-কাল এসেছে, তাতে হিন্দি আর পাঞ্জাবি পড়ে ছেলে-মেয়ের যেন তার হাল না হয়! ইংরেজি মিডিয়ামের পাশ হলে এতদিনে আর্মিতে সে কোন্ পজিশনে থাকতো! এত দূর-দূরান্তে পড়ে থাকতে হতো না!

উত্তরে পিতামহ অসহায়ের মত বলতেন যে লাহোর থেকে পালিয়ে এসে তেরো বছরের ছেলেকে বাবার সাথে সংসারের দায় নিতে গিয়ে নিজেরও ভাল লেখা-পড়া শেখা হয়নি। ছোট একটি মুদির দোকানের টাকায় ছেলেকে তার ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানো হয়নি। বাবা তখন দাদার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলতো যে তাঁর পিতাজি’ তাঁর জন্য কম করেননি। কিন্ত এখন ছোট ভাইটাকে ভাল ভাবে ইংরেজি সাহিত্যে পাশ করাতে হবে আর ছেলে-মেয়ে দু’টোকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াতে হবে।

সুখপ্রীতকে তাই ভর্তি করা হলো ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে। এসময়ে…এসময়েই…ইন্দিরা গান্ধি মারা গেলেন। অথবা তাঁকে হত্যা করা হলো। কে হত্যা করেছে? শিখ দেহরক্ষী ভিন্দ্রানওয়ালে। সেদিন দুপুরেই সুখপ্রীতদের স্কুল ছুটি হয়ে গেছিলো। ক্লাসের অন্য সব মেয়েরা কেমন চোখে সুখপ্রীতের দিকে তাকাচ্ছিল। দু/একজন বলেই বসলো- খাস ইংরেজিতে- ‘হেই ইউ খালিস্থানী পিপল- হোয়াই ডোন্ট ইউ গো টু পাকিস্থান!’ স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মুখও থমথম করছে। সুখপ্রীত ভয়ে ভয়ে স্কুলের বাইরে এসেই দ্যাখে ছোট চাচা তার জন্য অপেক্ষা করছে।

‘চাচা’-

সুখপ্রীত দৌড়ে গিয়ে ছোট চাচার হাত ধরতেই চাচা ফ্যাকাশে হেসে ওর হাতটা মুঠোয় ভরে, শক্ত একটা চাপ দিয়ে শুধু বলেছিল ভয় না পেতে।

বাসা থেকে খুব দূরে নয় স্কুল। মিনিট পনেরোর পথ। কত সময় সুখপ্রীত একা বা প্রতিবেশী কয়েকটি মেয়ের সাথে হেঁটেও যাতায়াত করে। কিন্তÍ আজ ক্লাসের হিন্দু মেয়েরা কেউ তার আশপাশে এলো না। মুসলিম আজমেরির বাসা অনেক দূরে। সে শুধু যাবার সময় একবার ফিসফিস করে বলেছিলো, ‘সাবধানে যেও।‘ ছোট চাচা বুঝি সেসব ভেবেই বা মা’র অনুরোধে আজ তাকে নিতে এসেছে।

ছোট চাচা কত লম্বা! বাবার চেয়েও লম্বা! তবে বাবাই তাকে আর্মিতে ভর্তি না হতে বলে বিএ অনার্স পড়তে বলেছে।ভাইকে নিয়ে বাবার অনেক স্বপ্ন। ছোট চাচার ইংরেজিতে মাথা ভাল। ইংরেজি সাহিত্যে বিএ অনার্স পাস করে চাচা ল’ইয়্যার হতে পারে বা আইসিএসে পরীক্ষা যদি দেয়? সামান্য জওয়ানের জীবন হতে হবে না তার! ছোট চাচার হাত ধরে সুখপ্রীতের ভয় একটু যেন কমে এলেও তারা দু’জনেই পা ফেলে কয়েক গজ সামনে না যেতেই ‘শালে খালিস্তানী! বেঈমান! তুমলোগ হামকো মাঈকি মার ডালা?’ বলেই তাদের ঘিরে ধরলো একটি ট্রাক থেকে ত্রি-রঙা পতাকাবাহী একটি ট্রাক থেকে লাফিয়ে নেমে পড়া কিছু যুবক।

‘যা শালী রেন্ডি!’-

দশ বছরের লম্বা হতে থাকা সুখপ্রীতকে একটি ধাক্কা দিয়ে সামনে ফেলে দিলো দু’টো ছেলে। ভ্যাবা-চ্যাকা খেয়ে, কোনমতে উঠে দাঁড়িয়ে আত্মরক্ষার বোধ থেকে সামনে দৌড় দেবার সময়েই সুখপ্রীত লক্ষ্য করে যে ছোট চাচা খুব রেগে গিয়ে ছেলেগুলোকে ‘খা-মো-শ’ বলছে আর অমনি ‘কুত্তে কমিনে’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়লো অন্তত: জনা পাঁচেক ছেলে। সুখপ্রীত- তখনো তার স্তন ওঠেনি খুব অল্প বয়সেই স্তন হতে থাকা ক্লাসের আর দু/একটি মেয়ের মত- রেন্ডি শব্দের অর্থও তখনো সে জানত না- তবে সে লম্বা হয়ে উঠছিল আর গোটা ঘটনার আকষ্মিকতায় প্রচন্ড ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করতে করতেই দ্যাখে দাদা আর দাদিও ভীরু পায়ে এদিকেই আসছে।

ত্রি-রঙা পতাকাবাহী ট্রাকে ততক্ষণে পাগড়ি-দাড়িঅলা গুরুশরণকে টেনে-হিঁচড়ে তোলা হচ্ছে আর দাদা তাদের সামনে গিয়ে জোড় হাতে বোঝাচ্ছে যে তাঁর পরিবার খালিস্থান সমর্থক নয়। শিখরা গরম মাথা বলে ভুলে গেছে যে পাকিস্থান থেকে কত লাখ লাখ খুন আর আওরতদের বে-ইজ্জতির পর তাদের এখানে আসতে হয়েছিল আর ভারতেই তারা আশ্রয় পেয়েছে। সারাজীবন সে তাই কংগ্রেসকেই ভোট দিয়েছে। তার বড় ছেলে সেনাবাহিনীতে কাজ করে!  কিন্ত সেসব কথা কিছুই না শুনে ট্রাকটি চলে গেলো।

বাবার চাকরি নিয়ে টানাটানি শুরু হলো। খালিস্থান আন্দোলনের সাথে তার সম্পৃক্ততা আছে কিনা সেটা তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল যে কমিটি তাকে সাময়িক ভাবে বরখাস্ত করেছিল। আর বাবার সম্মানবোধে খুব ঘা লাগায় সে নিজেই তখন সাফ জানিয়ে দিল যে চাকরি ফেরত পেলেও সে আর করবে না। দিল্লি ফিরে এসে দাদার যে ছোট দোকানটা এতদিন পাড়ার একটি গরীব ছেলেই কর্মচারী হিসেবে চালিয়ে নিচ্ছিল, সেখানেই বসতে শুরু করলো বাবা। আর ছোট চাচা তিন মাস পর যখন ছাড়া পেলো, তখন সে অন্য মানুষ। ম্যাডোনার ইংরেজি গান শুনতো ছোট চাচা, শিখদের ভেতর সব ছেলেরই লম্বা চুল-দাড়ি রাখা একটি কুসংস্কার বলে গজগজ করতো। কত মুসলিম ছেলেও এখন ক্লিন শেভড! আর শুধু শিখ ছেলেদেরই কিনা লম্বা চুল-দাড়ি রাখতে হয়। মা মুচকি হেসে দাদিকে একদিন বলছিল যে আসলে বোধ হয় কলেজে কোন হিন্দু লেড়কিকে পছন্দ হয়েছে আর সেই মেয়ে হয়তো ক্লিন শেভড ছেলে পছন্দ করে। কিন্ত সেই যে ছোট চাচা ফিরে এলো- ম্যাডোনার সব ক্যাসেট ফেলে দিয়ে সারাদিন গ্রন্থ সাহেব পাঠ করা শুরু করলো সে আর সত্যিই যোগ দিলো খালিস্থান আন্দোলনেই।

চিরদিনের শান্ত মানুষ বাবা যে এত জেদি কেউ ভাবেনি। দাদা-দাদি কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারলো না যে চোরের উপর রাগ করে লাভ কী? এতে তার ছেলে-মেয়েরই ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার খরচ উঠবে না। বরং তদন্ত কমিটির সামনে ভাল ভাবে আত্ম-পক্ষ সমর্থন করে চাকরিটা টিঁকিয়ে রাখাই ভাল। বাবা একথায় শুধু উদাস ভাবে বলেছিল যে কাশ্মীরে ডিউটি করার সময় একবার পায়ে গুলি লেগে বিছানায় পড়ে ছিল টানা ছয় মাস আর মণিপুরে থাকতেও একবার মাথায় আঘাত লাগে- কোমায় গিয়েও ফিরে এসেছে শুধু গুরুর জোরে- কিছু শিখ খালিস্তান আন্দোলন করলেও সে ত’ আজীবন ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিশ্বস্ত সদস্যই ছিল! যে দেশ তাকে এত কিছুর পরও বিশ্বাস করলো না, সে দেশে সে আর তার ছেলে-মেয়েকে কি পড়াবে? না হয় তারা সস্তার হিন্দি বা পাঞ্জাবি স্কুলেই পড়বে, রোটি-সব্জিই খাবে আর গুরুর নামেই প্রার্থনা করবে। তার আর কোন উচ্চাশা নেই।

‘কিন্ত কোথায় যাবি- কি করবি? এদেশ যদি আমাদের দেশ না হয়, যে দেশ ছেড়ে এসেছি- সেখানেই কি আর ফিরতে পারব?’

বাবা সেকথার উত্তরে আবার উদাস ভাবে মাথা নেড়ে শুধু বলেছিল যে দিল্লিতে প্রতিদিনই কোন না কোন শিখ খুন হচ্ছে। এই শহরে খরচও বেশি। অমৃতসরের কোন গ্রামের দিকে চলে যাওয়া ভাল। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। সুখপ্রীত আর তার ছোট ভাইকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ছাড়িয়ে ভর্তি করা হলো অমৃতসরের কুসুমমন্ডি গ্রামের এক পাঞ্জাবি মাধ্যম স্কুলে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের হাল-ফ্যাশনের স্কার্ট ছেড়ে ‘গাঁও কি লেড়কি’-র মত আবার তার গায়ে উঠেছিল সালোয়ার-কামিজ। আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে ছোট চাচা যোগ দিলেন খালিস্থান আন্দোলনেই। তার হিন্দু প্রেমিকা ঘৃণ্য খালিস্তানীর সাথে সম্পর্ক রাখতে না চেয়ে শেষ চিঠি পাঠিয়েছিল। বিয়েও হয়ে গেছিলো মেয়েটির- এসব গল্পই সুখপ্রীত বড় হয়ে তার মা’র কাছ থেকে শুনেছিল। ছোট চাচা পাঞ্জাবের বর্ডার থেকে পালিয়ে গেছিলো পাকিস্থানের লাহোরে। অনেক খুঁজে খুঁজে তাদের পুরণো বাড়িতেও গেছিলো আর ছবিও পাঠিয়েছিল গোপণে- পাকিস্থানের এক শিখ তীর্থে তীর্থ করতে যাওয়া তবে তীর্থের পর ভারতে ফিরে আসা এক শিখ পরিবারের হাতে। তবে লাহোরেও বেশি দিন থাকেনি ছোট চাচা। সেখানেও তার এই চুল-দাড়ি, শিখ নাম…বহু কষ্টে আর নিউইয়র্ক চলে গেছিলো ছোট চাচা। ইংরেজি সাহিত্যের বিএ ক্লাসের ছাত্র এক পাঞ্জাবি রেস্টুরেন্টে চাকরি নিয়ে, কখনো ট্যাক্সি ড্রাইভারি করে কাটিয়েছে বাকি জীবন। তবে বিয়ে হবার পর আট বছরের ভেতর তিনটি এ্যাবর্শন শেষে প্রথম সন্তানই কন্যা সন্তান হওয়ায় বিরক্ত শ্বশুর-শাশুড়ি, বরের ব্যবসায় একাধিক লসের পর তারা যখন শেষমেশ সিদ্ধান্ত নেয় যে পশ্চিমে বা আমেরিকায় চলে এসে ভাগ্য বদলাবে, তখন নিউইয়র্কে এসে ছোট চাচার বাড়িতেই শুরুতে কিছুদিন ছিল তারা। এখানে ছোট চাচার ক্যারিবীয় স্ত্রী বা আধা-পাঞ্জাবি, আধা-ক্যারিবীয় চাচাতো ভাই-বোনদের ব্যবহার যেমনই হোক, চাচা শুরুর দু/তিন মাস তাদের থাকতে দিয়েছিলেন। তবে দশ বছর পর্যন্ত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ার সুবাদেই সুখপ্রীতের এদেশে এসে পথে-ঘাটে চলতে-ফিরতে অন্তত: ভাষাগত কারণে কোন সমস্যা হয়নি। ছোট চাচাই তাকে বুদ্ধি দিয়েছিল আওরত হয়েও নিজে থেকে কিছু একটা করতে। আর তখনি তার নিজেরই মনে হয়েছিল যে বারো ক্লাস পরীক্ষার পর সে ত’ কিছুদিন একটি পার্লারে ‘বিউটিশিয়ান কোর্স’ করেছিল। তাহলে একটি পার্লার খুললে কেমন হয়? সেই ভাবনা মাথায় আসার সাথে সাথেই সে যে খুলতে পেরেছিল তা’ নয়।কারণ কোলের মেয়েটির বয়স মাত্র দেড় তখন। তারপর আর একটি ছেলে হলো। তবে ওরা একটু বড় হতে হতে তার বর বলবিন্দরই বললো যে সে চাইলে একটি পার্লার চালু করতে পারে। দু’জন মিলে একটু ভাল ভাবে চলা যাবে তখন। প্রথম দিন পার্লার খোলার আগে নাম কি দেবে সেটা ভাবতেই নাজেহাল হয়ে গেছিলো সে। একদা ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছোট চাচা তখনো বেঁচে। তিনিই পরামর্শ দিয়েছিলেন ‘সুখপ্রীত এ্যাট ব্রæকলীন’ নামের এই পার্লারটি খুলতে। গত বছর চাচার মৃত্যুর পর নিউইয়র্কে চাচার শেষকৃত্যে যোগ দেবার পর আর সেই ক্যারিবীয় চাচী বা আধা-পাঞ্জাবি, আধা-ক্যারিবীয় কাজিনরা যারা এক অক্ষরও পাঞ্জাবি বলতে বা বুঝতে পারেনা, তাদের সাথে সুখপ্রীতের আর কোন সম্বন্ধ নেই। পাশের ভারতীয় কলোনী থেকে চাচার বন্ধু কিছু শিখ বা হিন্দুও যোগ দিয়েছিলেন- আজ এত বছর পর সেই খালিস্থান আন্দোলনের রক্ত-অশ্রু কিছু যেন আর কারো গায়েই লেগে নেই- শুধু জীবনটা যেমন হতে পারতো সুখপ্রীতের তেমন হয়নি আর কি!

‘ম্যাডাম-’

‘বিলকিস – তুম লাহোরকা বেটি হুঁ, না?’

বিলকিস একথায় হেসে মাথা নাড়ে। তার গল্পটাও কম মজার নয়। তার দাদা যদিও ছিল দিল্লির মুসলিম, কিন্ত দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্থানের ঢাকায় ছিল তাঁর পোস্টিং। রেলওয়েতে স্টেশন মাস্টারের চাকরি। লেকিন বিলকিসের বাবা ঢাকাতেই বড় হয়েছে। বাংলা সিনেমা দেখে, বাংলা গান শুনে বড় হয়েছে- উর্দূ বা পাঞ্জাবির পাশাপাশি। আব্বিজান ত’ মৃত্যুর সময়েও ঢাকার রহমান-শবনমের সিনেমার কথা বলতো। শবনমজি অবশ্য বাংলাদেশ হবার পরও পাকিস্থানে বহু দিন সিনেমা করেছেন। আব্বিজান এমনকি সেদেশের মশহুর শায়ের রভিন্দরনাথ টেগোরের গানও বাংলায় গাইতে পারতেন। ঢাকাতেই বেশ জমিয়ে বসেছিলেন। পূর্ব পাকিস্থানেই ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ সহ কয়েক জায়গায় ট্রান্সফার হয়ে রিটায়ারমেন্টের পর কি ঢাকার মোহাম্মদপুর না অমন কোন এক মহল্লায় বাড়িও বানিয়েছিলেন। কিন্ত এই সময় শুরু হলো যুদ্ধ। ১৬ই ডিসেম্বরের পর দাদাজান তাড়া-হুড়ো করে তার যে চাচাতো ভাই ততদিনে দিল্লি থেকে লাহোরে সেটেলড হয়েছে, সেখানেই চলে গেলেন। যাবার সময় এক বাঙ্গালীকে পানির দামে বাড়ি বিক্রি করে, কোনমতে লাহোরে যান। কিন্ত দাদার সেই চাচাতো ভাই দাদাকে বহুতই ঠকিয়েছে। পানির দরে বাঙ্গালীকে বাড়ি বিক্রি করে আসার পরও দাদিজানের যতটুকু যা সোনা-জহরত ছিল, দাদাজানের যেটুকু টাকা-কড়ি জমানো ছিল, সরল মনে লাহোরে একটু জমি কেনা বা একটি দোকান কেনার জন্য সেই টাকা সেই চাচাতো ভাইয়ের হাতে তুলে দিলে সে সবটাই খেয়ে ফ্যালে। তখন আব্বা মাত্র স্কুল পাশ করে কলেজে উঠেছে। আর তার পড়া-শুনা হলো না! ছোট দুই বোন আর মা-বাবাকে দেখতে টাঙ্গা চালানো শুরু করলো। তার মেয়ে বিলকিস স্কুলে নাইন পর্যন্ত পড়ে বিয়ে হলো এক খুচরো ব্যবসায়ীর সাথে। সেই খুচরো ব্যবসায়ী কি মনে করে একবার ডিভি-১-এ আবেদন করে নিউইয়র্কে চলে এলো। ইয়ে ত’ হ্যায় বিলকিসকো জিন্দেগি কা কহানী! এখানে এসে তারা দু’জন- মরদ আর আওরত মিলে সংসার ত’ চলে না- তখনি একদিনে ব্রæকলীনের আরব পাড়ার পাশে তাদের এক কামরার ঘর থেকে বের হয়ে একদিন সামনে বের হয়ে সব্জি কেনার জন্য হাঁটতে হাঁটতে বিলকিসের কাণে আসে পাঞ্জাবি কথার স্বর। এক মা আর মেয়ে কথা বলছে। ইন্ডিয়ান নাকি? দু’জনেই জিন্স আর শার্ট পরা। প্রথমে কথা বলবে না বলবে না ভেবেও চারপাশে এত সাদা ফিরিঙ্গি, ল্যাটিন, চীণে আর মুসলমান ভাই হলেও পাশের আরব কলোনীর আরবদের সাথে এক অক্ষরও আরবি বলতে না পারা বিলকিস (মানে কোরানের সুরা বা আয়াতগুলো মুখস্থ থাকা আর খানিকটা ঐ বিসমিল্লাহ-ইনশাল্লাহ-আলহামদুলিল্লাহ বলতে পারা ছাড়া প্রতিদিনের কথা বলার মত আরবি) তখনো কাজ চালানোর মত ইংরেজিও শিখে উঠতে পারেনি। ভারত-পাকিস্থান-বাংলাদেশের মানুষের মত চেহারার কাউকে দেখলেই বুক তার হু হু করে ওঠে।তাতে খোদ পাঞ্জাবি বাত? এক লহমা চুপ করে থেকেই তাই সুখপ্রীতের কাছে ছুটে গেছিলো বিলকিস। আর বিলকিসের মুখে খাস পাঞ্জাবি কথা শুনে প্রচন্ড খুশি হয়েছিল সুখপ্রীত।

‘তুম পাঞ্জাবি হো? পাঞ্জাবি? লাহোর কি লেড়কি? বহোত খুব!’

বিলকিস বানো সাথে সাথেই বিস্তারিত শোধরাতে শুরু করে যে তাদের আসলি মুল্লক কিন্তÍ দিল্লি’ নয়- লাহোর! যেমন তাঁর আব্বিজান মুলক কোথায় এমন সওয়ালের উত্তরে সবসময়ই শুরু করতো তাদের দেশ আসলে দিল্লিতে আর সেখান থেকে দাদাজানের সেই ইস্ট পাকিস্থানে রেলওয়েতে চাকরি আর শেষমেশ কিনা লাহোরে গিয়ে ঠাঁই গাড়ার গল্প দিয়ে- বিলকিস বানোও তেমনটা শুধরে দেয় যে আসলে তাদের দেশ ছিল দিল্লি।একথার উত্তরে সুখপ্রীতও মুচকি হেসে জানায় যে আসলে তাদের দেশ ছিল লাহোর। দেশভাগের সময় কিনা তারা লাহোর থেকে দিল্লি এসেছিল। 

‘হ্যালো- মে উই কাম ইন?’

লম্বা করে বাংলাদেশী মেয়েটা এসেছে। অনেক লম্বা বলেই দেখলে পাঞ্জাবি বলে মনে হয়- বাঙ্গালী বলে মনে হয় না।সুখপ্রীত কিন্ত কলকাতায়ও ছিল কিছুদিন। বিয়ের আগে আগে। বাবা ইংরেজি স্কুলে পড়া বন্ধ করিয়ে, গ্রামে পাঞ্জাবি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করালে দিশেহারা মা সুখপ্রীতকে বড় মামার বাড়ি পাঠিয়েছিল- কলকাতায়। বড় শহরগুলোর ভেতর কলকাতাই তখন শিখদেও জন্য নিরাপদ। এছাড়া বড় মামার ওখানে একটি মটর পার্টস সারাইয়ের বড় ব্যবসা ছিল। সেখানে যদি সুখপ্রীত একটু কোন ভাল স্কুলে পড়তে পারে- মা’র এমনটাই ভাবনা ছিল। তবে মামীর আচরণে বছর খানেক থেকে সে ফিরে আসে। বাংলা শব্দ এখনো তার এক/দু’টো মনে আছে। এই বাংলাদেশী মেয়েটি লম্বা ও পাতলা গড়নের। কাঁধ অবধি চুল। চোখে-মুখে এক ধরণের দৃঢ়তা আছে। মেয়েটি মাঝে মাঝে তার পার্লারে আসে ওর সাথে একটি ছোট ছেলে বা মেয়েকে নিয়ে। তিনটি বাচ্চা মেয়েটার। এখানে একটি বিদেশী এনজিওতে কাজ করে। যেমনটা হবার কথা ভাবতো সুখপ্রীত তার শৈশবে বা কৈশোরেও। পরে সেই জীবন অনেকটাই দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। তবে অনেক সংগ্রামের পর এখন সে আর বলবিন্দর মোটামুটি সুখী। বলবিন্দরের পাঞ্জাবি রেস্তোরাঁ আর তার পার্লার মিলিয়ে মাসে ভালই আয় তাদের। দু’টো ছেলে-মেয়েই কলেজে আর স্কুলে পড়ছে। না-ই বা হওয়া হলো অফিসার এক জীবনে! কিন্ত আজ এই মেয়েটির সাথে অন্যজনা কে? এই মেয়েটি অত লম্বা নয়। অত পাতলাও নয়। তবে এক মাথা চুল এলোমেলো হয়ে আছে। চোখে কাজল। দেখতে নরম সরম গোছের। একে দেখে খাঁটি বাঙ্গালীই মনে হচ্ছে। তত লম্বা নয়। একটু আলাভোলা।

হু ইজ শী? ইওর সিস্টার?

নো- মাই সিস্টার-ইন-ল ফ্রম ঢাকা। শি উইল স্টে হেয়ার ফর সাম ডেইজ।

হাঁ- হাঁ-ঢাকা মে বহোত ক্যাওস হুয়া থি রিসেন্টলি? আপকা প্রাইম মিনিস্টার শেখ হাসিনা ম্যাডাম জি- প্রতিদিনের নানা নৈমিত্তিক ঝামেলার ভেতর থেকে সুখপ্রীত পাশের দেশের নারী প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর দেশ ছাড়তে হলো কি হলো না বা হলেও কেমন হলো বা কি ধরণের অপমানের ভেতর দিয়ে তাঁকে যেতে হলো…টিভি বা পত্র-পত্রিকা বা মুঠোফোনের কোথাও দেখা-আধা-দেখা-অদেখা এসব ফুটেজের চক্করে পড়ে যেতে যেতে পুরো বাক্যটি স্পষ্ট করতে পারেনা। কিন্ত হুট করে গলা চড়ায় বিলকিস বানো। ইংরেজি তার তত সড়গর নয়। তবে দূর্দান্ত হিন্দুস্থানী (হিন্দি বা উর্দূতে) সে বলতে থাকে যে বাঙ্গালীরা এত অদ্ভুত কেন? পাকিস্থানে তারা খেতে পায় না। আর হাসিনা ম্যাডামের আমলে বাঙ্গাল লোগো কি হাল পাকিস্থান ত’ বটেই, ভারতের চেয়েও নাকি ভাল হয়ে গেছিল! অর উনি বুরা আওরতও (মন্দ নারী) যদি হন, ওনার ব্রা কেন দেখালো ওনার বেটা বা নাতিনকো উমরকি (নাতির বয়সী) বেটারা?

লেকিন উনকো ঘর কি মা-বেহিনো নেহি হ্যায়?

অবাক হয়ে দুই বাংলাদেশী নারীর দিকে এক লহমা তাকিয়ে বিলকিস বানু হাতে সুতা পাকাতে শুরু করে।

আইয়ে- আপকো কোই আই ব্রো প্লাকিংকি জরুরত হ্যায় ত’ মুঝকো বাতাও!

দ্বিতীয় বাংলাদেশী মেয়েটি ততক্ষণে চেয়ারে রাখা প্লাস্টিকের বালিশে তার আলুথালু মাথাটা এলিয়ে, প্রচন্ড ক্লান্তিতে চোখ বুঁজেছে। মেয়েটিকে দেখেই মনে হচ্ছে যেন অনেক দাঙ্গা-যুদ্ধ-আতঙ্ক-রক্তের দৃশ্যাবলীর ভেতর থেকে সে এসেছে। আরে- ঘুমিয়ে পড়লো নাকি? সময় শেষ হয়ে আসছে। আর আধা ঘন্টা পরেই তার পার্লার বন্ধ করে দিতে হবে। এরা এত দেরি করে এলো কেন? তবে বেশি কাজ নিয়ে আসেনি। এখনো সূর্যের আলো আছে।

ইওর সিস্টার-ইন-ল ইজ ফলিং এ্যাস্লীপ!

ইয়েস- শি ইজ ভেরি টায়ার্ড- রিসেন্টলি আওয়ার কান্ট্রি পাসড থ্রু আ ওয়্যার লাইক সিচ্যুয়েশন!

সুখপ্রীত গভীর ভাবে শ্বাস ছাড়ে। এই উপমহাদেশের মানুষের ভাগ্যই যেন কেমন! সেই ১৯৮৪ সাল…দশ বছরের সুখপ্রীতের স্কুল যাওয়া…স্কুল আগে আগে ছুটি হয়ে গেলো…স্কুল থেকে ফেরার পথেই ছোট চাচার এ্যারেস্ট…সেই থেকে কত পথ পাড়ি হয়ে আজ এই নিউইয়র্কের ব্রুকলীনে ঠাঁই গাড়া…সুখপ্রীতের পিতামহ তারও বহু আগে লাহোর থেকে দিল্লির পথে পাড়ি দিয়েছিলেন আর বিলকিসের দাদা দিল্লি থেকে লাহোরে যাবে ভেবেও চাকরির জন্য গেছিলো ঢাকা আর সেখান থেকে লাহোর- আর ঢাকার দুই বঙ্গালী লেড়কি আজকের দিনে তার দোকানের শেষ কাস্টোমার- তাদের দেশেও নাকি কি সব রক্তারক্তি চলছে! মানুষে মানুষে এত মারপিট, এত জুলুম কেন?

বুরা যো দেখান মে চালা, বুরা না মিলিয়া কোয়ে

যো মুন খোঁজা আপনা তো মুঝসে বুরা না কোয়ে..

(খারাপ মানুষ খুঁজতে কত পথই না হাঁটলাম! তারপর নিজের মনের দিকে তাকিয়ে দেখে বুঝলাম যে আমার মত  মন্দ কেউই নয়)।

দুই বাঙ্গালী আওরতের কাছ থেকে নেওয়া দিনের শেষ কয়েকটি ডলার কাউন্টারের ড্রয়ারে ভরে, লক করতে করতে মা’র মুখে শোনা জপজি সাহিবের একটি লাইন মনে মনে আউড়ে একটি কর্ম দিবস শেষ করে সুখপ্রীত।

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত