অফিসে গুজগুজ ফিসফিস চলছে যে আমাকে হঠাতেই বস এই অফিসে দ্বিতীয় তৃণাকে এনেছেন। ও দেখতে অবিকল আমারই মত। তবে, আমার সাথে ওর কিছু পার্থক্যও আছে। এমনিতেই এই অফিসে সব মিলিয়ে আমরা মাত্র ত্রিশ শতাংশ মানুষ কর্মী আর বাকিটা এই দ্বিতীয় তৃণার মত সব ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স।’ তবে দেখলে একটুও বোঝার উপায় নেই। ২০৫-৬০ এমনকি ২০৬৫ অবধি মানুষ থেকে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সদের আলাদা করাই যেত, এখন একদমই যায় না। এই দ্বিতীয় তৃণাই যেমন। সে ঠিক আমার মতই উচ্চতায়, স্বাস্থ্যে, গাত্রবর্ণে, মাথার চুলে। তবু সে আমি নই। যেমন গরমের দিনে এই এসি অফিসে ঢুকতে ঢুকতে বা ঢোকার আগে এসি গাড়ি থেকে নেমে অফিসে ঢুকতে যে পাঁচ মিনিট সময় নেয় তার ভেতরেই গরমে আমার সূতি জামার বাহুমূলে ঘাম জমে ও আমাকে বডি স্প্রে ব্যবহার করতে হয়। দ্বিতীয় তৃণার দেহে কখনোই ঘামের গন্ধ হয় না। সেটা ওর সাথে রাজধানীর বাইরে দূর-দূরান্তের মাঠের কাজেও দেখেছি। কিম্বা আজ যেমন ঘড়ির কাঁটা ঠিক ন’টা ছুঁই ছুঁই সময়ে অফিসে ঢুকতে গিয়েও রাস্তার উপর একটি জারুল গাছের বেগুনী ফুল দেখে আমি থমকে গেলাম এবং দু’মিনিট ঐ অবস্থায় চলে গেল, দ্বিতীয় তৃণার তা’ কখনোই হয় না। দিদার কাছে শুনেছি যে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও ঢাকায় যখন প্রতি বৈশাখে রাধাচূড়া, জারুল কি গুলমোহরের (ইয়ে…মানে গুলমোহরের বাংলা নামটা টাইপ করতে গেলে আমার ফন্টে ভুল হচ্ছে) বন্যা বয়ে যেত, তখনো এ শহরে অনেক মানুষ ছিল। গাদাগাদি করে থাকতো সবাই। এ ওর গায়ে গা লেগে যেত।
‘আমার মায়ের ছিল ন’টা বাচ্চা। ছয়টা ছেলে আর তিনটা মেয়ে। মা’র তিন মেয়ের ভেতর একা আমি বিয়ে করলাম আর দু’টো মেয়ে হলো আমার। তাদের একজন তোর মা। আমার ছোট দুই বোণ বিয়েই করলো না। সেসময় থেকেই এই দেশে লেখা-পড়া শেখা মেয়েরা চাকরি করবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে এসব করতে করতে অনেকেই একা থাকা শুরু করলো। এতে যেমন আমাদের মানুষ কমতে লাগলো, তার উপর নানা সমস্যার কারণে অনেকে মানুষ কমে গেল অনেক, এছাড়াও অনেকে দেশ ছাড়তে শুরু করলো। ২০৪০-এর পরই মানুষের সংখ্যা কমে হয়ে গেল এদেশের স্বাধীণতা হবার সময়ে যতটা ছিল…সেই ৭/৮ কোটি। আর এখন ত’ মাত্র দু/তিন কোটি,’ কত রকম গল্প করতো দিদা! দিদার কাছ থেকেই বাংলা লিখতে শিখেছিল তৃণা। ভাল ভাবে বলতে ও পড়তেও। এখন ত’ সারা পৃথিবীর মানুষই বলতে গেলে একটি ভাষায় কথা বলে, কাজ করে।
ওহ্- দিদা- জারুল ফুল- কেন যে এসব মাথায় আসছে? তৃণার বস নটরাজন ম্যাককার্থি আজ আবার ঝাড়বে অনেক। নটরাজন ম্যাককার্থির মা জাতে তেলেগু আর বাবা মার্কিনী শে^তাঙ্গ আর তার মায়ের মা বা দিদা ছিল কলকাতার বাঙ্গালী যারা নাকি ১৯৪৭-এর পর বিক্রমপুর থেকে ওপারে চলে যায়। নটরাজনের রংটা চট করে দেখলে শে^তকায় বলে বিভ্রম হলেও খানিকটা কাছে থেকে দেখলে বোঝা যায় যে সে আসলে খানিকটা জলপাই ত্বক। তার চোখ সবুজাভ হলেও চুল কালো। দোসা খেতে ভালবাসে নটরাজন, নাকি সুরে মার্কিনী ইংরেজি বলে আবার মাঝে মাঝে সবাইকে অবাক করে বাংলা কবিতাও আউড়ায়। বাংলা কবিতা অবশ্য এখন ক’জনই বা আর পড়ে? খুব কম মানুষই জানে আজ এই ভাষাটা। তৃণার মতই নটরাজনও তার মা-বাবার বদলে গ্র্যান্ড মমের কাছে মানুষ। অফিসের কেউই বোঝে না যেমন তৃণাও বোঝে না নটরাজনের সে সবচেয়ে পছন্দ বা অপছন্দের পাত্রী- ঠিক কোনটি?
অফিসে যখন দ্বিতীয় তৃণা যোগ দিল দু’মাস আগে, প্রথম তৃণা অবাক হয়নি। এটাই দস্তÍর। কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে যে এই কর্মী তেমন মেধাবী বা পরিশ্রমী নয় বা দু’টো হওয়া সত্ত্বেও যথেষ্ট পরিমাণ বাধ্য বা অনুগত নয় বা কিছুটা বিদ্রোহের কণা আছে তার চারিত্র্যে, তখনি অল্প কিছুদিনের ভেতরেই একজন দ্বিতীয় মোস্তাফিজুর রহমান, দ্বিতীয় আয়েশা সুলতানা, দ্বিতীয় কণিকা রায় বা দ্বিতীয় উত্তম সাহা, দ্বিতীয় রিচার্ড কস্টা এসে হাজির হয়। হুবহু আসল মানুষটার মত দেখতে তবে আসল মানুষটাকে প্রায়ই ছাড়িয়ে যায় পারফর্ম্যান্সে। যেহেতু দ্বিতীয় মানুষটার কখনো সর্দি-জ¦র হয় না, বাহু মূলে ঘাম জমে না, দ্রুত হাঁটতে গেলে চলন্ত গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগে হাঁটু মচকায় না, মেয়েদের মাসের বিশেষ একটা সময় সার্বক্ষণিক রক্তের ভয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয় না, সুখী সংসারী জীবন যাপন করতে করতে কুড়ি বছর পরে সহসা অতীতের এক মানব বা মানবীর কথা ভেবে একটা গোটা কাজের দিনের প্রোডাক্টিভিটি নষ্ট হয় না…দ্বিতীয় মানুষগুলো সদা ঝকঝকে-সুন্দর-সপ্রতিভ…তারপর মাস খানেক কি দুয়েকের মাথায় একদিন প্রথম মানুষগুলোর কাছে একটি সাদা খামে চোস্ত মার্কিনী ইংরেজিতে লেখা চিঠিতে কর্তৃপক্ষ তাকে তার সেবার জন্য অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে দু:খ প্রকাশ করে যে এই মূহুর্তে তাকে প্রতিষ্ঠান আর রাখতে পারছে না তবে তার সব পাওনা মিটিয়ে দেওয়া হবে এবং নিচে থাকে চল্লিশের তরুণ সিইও নটরাজন ম্যাককার্থির স্বাক্ষর।
তৃণাদের এই অফিসে সব মিলিয়ে বাঙ্গালী অবশ্য হাতে গোণা পনেরো জন আর ফরেনার নানা জাতের মিলিয়ে আরো পনেরো। বাকি সত্তর জন…ছিল ত’ বাঙ্গালী-বিদেশী মিলিয়ে আরো সত্তর। কমতে কমতে এখন সত্তর জনই চলে যাওয়া সহকর্মীদের প্রতিলিপি। ফিলিস্তিনের ইয়াসির আবদেলের নামে আছে একজন, রাশিয়ার বরিস রোমানভের নামে আছে একজন, মিয়ানমারের মা শোয়ে নামে আছে একজন…দেখতে দেখতে দ্বিতীয় প্রতিলিপিরা এসে প্রথমদের সরিয়ে দেয়। তৃণা আর কতদিন থাকতে পারবে এ অফিসে কে জানে? আর বড় জোর এক সপ্তাহ?
এই ত’ গতকাল রাতেই তৃণা তার নোটবুকে আত্ম-মূল্যায়ণ লিখছিল:
‘আমাকে আমার সুপারভাইজর নটরাজন ম্যাককার্থি যে যে কারণে পছন্দ বা অপছন্দ করেন:
১. আমার সক্ষমতা হলো চারটা ভাষা দ্রুত গতিতে লিখতে ও বলতে পারা। কম্পিউটারে আমার টাইপিং স্পিড খুব ভাল। পাওয়ার পয়েন্ট মোটামুটি, এক্সেলে বিলো এ্যাভারেজ। বর্তমান বিশে^র যাবতীয় ঘটনাবলী সম্পর্কে অবগত, ই-মেইল বা সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ভাল বুঝি তবে ওয়েব ডিজাইনে গোল্লা। ফেসবুকে বেশি সময় থাকা হয়।
২. অফিসে আমি নতুন নতুন আইডিয়া দিতে পারি। তবে, অফিসে ঢুকতে প্রায়ই আমার পাঁচ থেকে পনেরো মিনিট দেরি হয়। অফিসের যে কোন হাইলাইট করার জন্য ক্যাচি শ্লোগান দিতে বা কমিউনিকেশন টুলস তৈরিতে আমার ভাষা জ্ঞান কাজে লাগে। আমার দূর্বলতা হলো বেশিক্ষণ আড্ডা দিতে পারিনা। আড়ালে কলিগরা আমাকে ‘মুডি’ ডাকে।
৩. নটরাজন মনে করেন যে এই শহরে দুই/তিন প্রজন্ম আগেও যে এ্যাক্টিভিস্ট তরুণ-তরুণীদের কিছু কাল্ট ছিল, সেটা হারিয়ে যেতে যেতেও এখনো যে অল্প কেউ কেউ এ প্রজন্মে টিঁকে আছেন, আমি তাদের একজন। এটাকেই নটরাজন ঘৃণা করেন। তিনি মনে করেন যে একজন দক্ষ কর্মী সারাদিন শুধু অফিস নিয়েই ভাববে। নটরাজন আরো মনে করেন যে আপাত:দৃষ্টে আমাকে শান্ত মনে হলেও ভেতরে ভেতরে আমি খানিকটা অবাধ্য প্রকৃতির।
৪. আমি বাজেট বুঝি না। জুনিয়রদের কন্ট্রোলে রাখতে যতটা টাফ হতে হয়, আমার তার এক কণাও নেই। এগুলো আমার ইনএফিসিয়েন্সি।
৫. আমি গুছিয়ে লিখতে পারি তবে অনেক সময়ই মিটিংয়ে দেখা যায় হাতে নোটবুক আছে তবে কলম নেই। নটরাজন এসব বলতে গেলে ঘৃণা করেন।
দ্বিতীয় তৃণা কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে আমার থেকে এগিয়ে?
দ্বিতীয় তৃণার সবচেয়ে বড় সক্ষমতা হলো মানুষের যে যে সমস্যা থাকে যেমন কোন সহকর্মীর বাজে আচরণে মন খারাপ হওয়া বা রেগে যাওয়া, অভিমান বা কান্নাকাটি করা এসব ওর হয়ই না। ও সারাক্ষণই হাসছে। দ্বিতীয় তৃণার এ মাসে আমার মত ভাইরাল ফ্লুতে দু’দিন ছুটি নিতে হয়নি। গড…কর্তৃপক্ষ আমাকে কেন রাখবে? কেন রাখবে? আমার ষাট দিনে দু’দিন নষ্ট হয়েছে। দ্বিতীয় তৃণার ত’ সেটা হয়নি। দিদার কাছে শুনেছি যে ২০৬০ পর্যন্ত খাঁটি মানবীদের সমাজে একটি দাম ছিল। এখন আর নেই। বিজ্ঞানের অশেষ কৃপায় অতীতের কোটি কোটি মানবীর ডিম্বাণু আর কোটি কোটি মানবের স্পার্ম হিমাগারে সংরক্ষণ করে অত্যাধুনিক সিলিকন জারেই মানব শিশুর জন্ম হচ্ছে গত এক দশক ধরে। নারী মুক্তি পেয়েছে তার গর্ভধারণের বিড়ম্বনা থেকে। দ্বিতীয় তৃণার মত একজন আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের নারীও এখন মা হতে পারবে। তাকে শুধু উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে একটি মানব শিশুর জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকাটি জমা দিতে হবে। তারপর কোন দেশের মায়ের ডিম্বাণুর সাথে কোন্ দেশের বাবার স্পার্ম মিলিয়ে সিলিকন জারে আট মাস রেখে পূর্ণতা প্রাপ্ত মানব শিশু বের করে আনতে হবে, দ্বিতীয় তৃণার পছন্দ-অপছন্দ জেনে নিয়ে সেই দায় কর্তৃপক্ষের। কাজেই একজন মানবী তৃণা এখন থাকলেও চলে, না থাকলেও চলে। মানবী তৃণার ষাট দিনের অফিসে তিন দিন নষ্ট হলেও হতে পারে। দ্বিতীয় তৃণার সেটা একদম হয় না।’
ঘড়িতে ন’টা সাত মিনিট সময়ে তৃণা মুখ কাঁচু-মাচু করে যখন অফিসে ঢুকলো, এই সাত মিনিটেই তৃণা আকাশ-পাতাল এত কিছু ভাবলো। দিদা বলতেন যে এক এ্যানশিয়েন্ট এপিকে মানুষের মন নাকি বাতাসের চেয়েও দ্রুতগামী বলা হয়েছে।
‘মিস বড়–য়া- এ্যাগেইন লেট টুডে?’
পড়বি ত’ পড় নটরাজনের সামনে।
‘তৃ-ণা-টু!’
দ্বিতীয় তৃণা এলো। প্রথম যখন বস্টন থেকে বিমানে বাক্সের ভেতর ওকে আনা হয়, তখন শুধু মার্কিনী ইংরেজি আর স্প্যানীশ ছিল ওর প্লে লিস্টের ল্যাঙ্গুয়েজ এ্যাপসে। এখন দ্বিতীয় তৃণার এ্যাপসে বাংলা ও হিন্দিও ঢোকানো হয়েছে। যেহেতু ও এই রিজিয়নে কাজ করবে।
‘এ্যানুয়াল বাজেটের ফাইলটা কোথায় রেখেছো?’
‘দিচ্ছি- স্যার!’
দূর-অফিসে আসতে না আসতেই ফ্রেশ রুমে একবার যেতেই হয়। এতটা পথ আসা! দ্বিতীয় তৃণার টয়লেটে যেতে হয় না।
ফ্রেশরুম থেকে আসতেই বুড়ো হাকিম আঙ্কল…বাবার বন্ধু ছিলেন…কাছে আসেন। একাউন্টসে ওস্তাদ এই বুড়ো কিকরে যেন আজো টিঁকে আছেন।
‘তোমার আজো দেরি হইলো তৃণা! একদম তোমার বাপের মতই হইছো।’
হাকিম আঙ্কল ফিসফিস করেন।
‘তুমি কি জানো নটরাজন কেন এখনো তোমাকে রাখছে?’
‘কেন?’
‘তোমার বাবা কবি ছিল বইলা তুমিও কবিতা লিখতে পারো। সেই যোগ্যতায় এই অফিসের সব ক্যাচি কম্যুনিকেশন ম্যাটেরিয়ালস তুমি বানাও। কিন্তÍ তুমি দেরি কইরা অফিসে ঢোকো, ফেসবুকে মাঝে মাঝে জ¦ালাময়ী কথা-বার্তা লেখো, খানিকটা ঘাড়ও ত্যাড়া। দ্বিতীয় তৃণার ল্যাঙ্গুয়েজ এ্যাপসে এখন তোমার চেয়েও একটা ল্যাঙ্গুয়েজ বেশি দেয়া হয়েছে। তার টাইপিং স্পিড তোমার চেয়ে বেশি। শুধু সে তোমার মত কবিতা লিখতে পারেনা। তবে সেই ব্যবস্থাও নটরাজন পরীক্ষামূলক ভাবে করতে যাচ্ছে আজ থেকে। এটাতে দ্বিতীয় তৃণা উতরালেই তুমি আউট।’
‘কিরকম?’
‘দ্বিতীয় তৃণাও কবিতা লিখবে।’
‘হি-হি-’
না হেসে পারেনা প্রথম তৃণা।
‘হাইসো না। আমি এই অফিসে এখনো আইসিটি আর একাউন্টস দুইটাতেই কাজ করি। তোমাকে মেইলে একটা জিনিষ পাঠাচ্ছি।’
‘হ্যাঁ- কাজ শুরু করতে হবে। এমনিতেই দেরি হলো আসতে।’
‘ডেস্কে গিয়া মেইলটা দেখো।’
হাকিম আঙ্কল একটা মেইল ফরোয়ার্ড করেছেন। নটরাজনের চিন্তিত মেইল আরো পাঁচ বিদেশী ও একমাত্র বাংলাদেশী হাকিম আঙ্কলকে সিসি করা। কর্তৃপক্ষ তৃণা শাওন্তী বড়–য়ার ল্যাঙ্গুয়েজ স্কিল, হার্ড ওয়ার্ককে পছন্দ করলেও সে ইন্ট্রোভার্ট, স্যুইং ম্যুডের অধিকারী। মাঝে মাঝে খানিকটা বিদ্রোহ প্রবণ, ভাবালু ও কল্পনাবিলাসী। তবে এই কল্পনাবিলাসী সত্ত্বা আবার উল্টো দিক থেকে অফিসকে বেশ কিছু প্রফিটও দেয়। গত দু’মাসে তৃণা-১ দু’দিন ছুটি নিয়েছে যেখানে কিনা তৃণা-২-এর কোন ছুটি লাগে নি। তৃণা-২-এর ল্যাঙ্গুয়েজ এ্যাপসে একটি ভাষা বেশি। তৃণা-১ দেশ-বিদেশের ঘটনাবলী অনেক জানলেও কখনো কখনো পূর্ব ইউরোপের রাজনীতিক রাদোভান কারাজদিচ আর কবি চেসোয়াভ ম্যিউশের ভেতর নাম গুলিয়ে ফেললেও ফেলতে পারে। তার বয়স আরো দশ বছর যখন বাড়বে, তখন এমনটা হবেই। কিন্তÍ তৃণা-২-এর প্লে স্টোরে এমন ভুল কখনো হবে না। তৃণা-১ যদিও সিঙ্গল, উচ্চাকাঙ্খী এবং বর কেন বিদ্যমান কোন প্রেমিকও নেই তার, তবে তার কবিতায় মাঝে মাঝে না পাওয়া কোন কোন যুবার জন্য সত্য বা কাল্পনিক হাহাকার দেখা যায়। দ্বিতীয় তৃণার এমন কোন মনোবৈকল্য নেই। সব কিছু বিচার করে কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছেন যে দ্বিতীয় তৃণাও যেন প্রথম তৃণার মতই এমনকি কল্পনাবিলাসী ও সৃজনীশক্তিসম্পন্নও হতে পারে। সেই চেষ্টারই ফলশ্রুতি হিসেবে দু’সপ্তাহ আগে এদেশের একটি পত্রিকার সাহিত্য পাতায় লেখা প্রথম তৃণার মহাকাশ বা ছায়াপথ নিয়ে লেখা একটি কবিতার মত কোন কবিতা যেন দ্বিতীয় তৃণাও লিখতে পারে, সেজন্য দ্বিতীয় তৃণার এ্যাপসে ছায়াপথ নিয়ে বাংলা ভাষায় অনেক বৈজ্ঞানীক তথ্য, ভারতীয় ও গ্রিক পুরাণের তথ্য এবং কিছু কী ওয়ার্ড দেয়া হয়েছে- প্রথম তৃণার কবিতায় যেসব অনুষঙ্গ বেশি থাকে। এবং দ্বিতীয় তৃণা কবিতা রচনায়ও অবিশ^াস্য সাফল্য দেখিয়েছে। এখানে প্রথম ও দ্বিতীয় তৃণার দু’টো কবিতা পাশাপাশি দেয়া হলো:
তৃণা-১-এর কবিতা:
প্রত্যহ লিখে রাখছি প্রতিটি ব্যর্থতা ও পরাজয়ের
উজ্জ্বল রক্তকরবী গাঁথা,
আজকাল জয় বা সাফল্যের চেয়ে
পরাভব, গ্লানি লিখতেই বেশি ভালবাসি।
জানি আমাকে স্বান্তনা দেবে সপ্তর্ষি মন্ডল,
জানি আমাকে কোলে নেবে অনন্ত আকাশগঙ্গা আর নীহারিকা বীথি।
তৃণা-২-এর কবিতা:
পরাভব, গ্লানি প্রতিদিনকার
লিখছি যেন রক্তোজ্জ্বল ফুল,
ইদানীং জয় বা উল্লাসের চেয়ে ব্যর্থতার ক্কাসিদা
লিখতেই বেশি ভালবাসি।
জানি আমাকে স্বস্তি দেবে কালপুরুষ,
বুঝি আমাকে কোলে নেবে অনি:শেষ নক্ষত্রবীথি।’
মাথাটা ঘুরে উঠলো আমার। একটা ডায়াজিপাম গ্লাসে গুলিয়ে খেলাম। কি করব? নিজেই রেজিগনেশন দেব? ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে দেখি নটরাজন তৃণা-২ এর পিঠের কাছে ঝুঁকে পিসির মনিটরে কি যেন দেখছে! তৃণা-২ খুব কোমল ও অনুগত মুখে তার দিকে চেয়ে আছে। অথচ, নটরাজন যতবার যখনি আমার খুব কাছে এসেছে অফিসে কাজের ছলে, আমার শরীর কেমন শক্ত হয়ে যেত!

কবি,কথাসাহিত্যিক