রজঃস্বলা নারীই প্রজননক্ষম। তাই তারা শক্তিরূপেণসংস্থিতা। বর্ষার বন্দনাও সেই নারীকে ঘিরেই। আমাদের কৃষিপ্রধান দেশে এমনি রীতি। বর্ষার প্রাক্কালে রজঃস্বলা নারীকেই পুজো করা হয় কামাখ্যায়। শস্যসম ধরিত্রীমাতার সন্তানেরা যেন দিকেদিকে ফুলে ফেঁপে ওঠে সেই আশায়। শাকম্ভরী দুর্গার সঙ্গে তার কোনো তফাত নেই। তবে কামাখ্যায় কেন এত ধুম। শক্তিরূপিণীর হেডকোয়ার্টার কামাখ্যায়। পুরাণ বলছে সেইকথা।
রজঃস্বলা মেয়েরাই যুগ যুগ ধরে নারীশক্তির উত্থানের ধ্বজা উড়িয়ে আসে বছরের এই চারটি দিন। মনে করায় আবারো যে সে শক্তিরূপেণ সংস্থিতা।
মানুষের বিশ্বাস অম্বুবাচীর তিনটে দিন রজঃস্বলা মা কামাখ্যা শক্তিরূপিণী হয়ে ওঠেন। বৃষ্টিস্নাত ভূমিতে মায়ের যেন নবজাগরণ হয়। কৃষিভিত্তিক দেশের পক্ষে যা জনহিতকর। তখন যেন দেবী প্রজনন শক্তিস্বরূপা। তাঁর রজঃস্নানের পর ধরিত্রী উর্বরা হয়ে ওঠে। উত্তম ফসল উত্পাদনের আশায় শুরু হয় হলকর্ষণ। দেবী কামাখ্যার অপর নাম কামেশ্বরী, কামরূপিণী বা কামরূপা। তিনি একাধারে শক্তিরূপিণী অন্যধারে কামনা বাসনার দেবী।
সংস্কৃত শব্দ ambuvācī থেকে অম্বুবাচী বা অসমীয়া ভাষায় অমুবাসী শব্দের উৎপত্তি। এর অর্থ হল the issuing forth of water বা জলের উৎস ঘোষণা। অর্থাৎ বর্ষার আগমনে ধরিত্রীর মাটি থেকে জল বেরিয়ে মাটিকে সিক্ত করা।
আষাঢ় মাসের ষষ্ঠ অথবা সপ্তম দিনে সূর্য যখন মিথুনরাশিস্থ মৃগশিরা থেকে আর্দ্রা নক্ষত্রে প্রবেশ করে তখনি শুরু হয় অম্বুবাচী।আমাদের দেশে বর্ষাও মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ঢুকে পড়ে সেইসময়।ঠিক তখনি বীজ রোপণ, চারা লাগানোর প্রকৃষ্ট সময়।তুষ্ট করা হয় ভূদেবী কে। প্রকৃতিরূপিণী কৃষিদেবী মাতৃস্বরূপা।রজঃস্নাতা দেবীর গর্ভধারণের আদর্শ সময় তখনি, এমনি বিশ্বাস। মায়ের গর্ভ প্রস্তুত হয় ধারণের জন্য।কৃষির জন্য প্রস্তুত হয় শস্যক্ষেত্র। উপনিষদ অনুসারে দেবী বসুন্ধরী বা শস্যদেবী শাকম্ভরী দুর্গার পূজারই আয়োজন তখন। তান্ত্রিক মতে কামাখ্যা হলেন দেবী দুর্গার সম্ভোগ রূপ। প্রকৃতি রূপিণী দুর্গা এবং তাঁর পুরুষ শিবের সমন্বয়ে সৃষ্টিলীলার যেন পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটে ।
কামাখ্যাং কামসম্পন্নাং কামেশ্বরীং হরপ্রিয়াম্
কামনাং দেহি মে নিত্যং কামেশ্বরী নমোহ্স্তুতে।
গরুড় পুরাণে কামাখ্যা কে মহাতীর্থ বলা হয়। এটি একান্ন সতীপীঠের অন্যতম। দক্ষযজ্ঞের পর বিষ্ণুর সুদর্শণ চক্রে শিবের দেহ থেকে বিচ্যুত সতীদেহের যোনিমন্ডল এখানে পড়েছিল। মনের দুঃখে ধ্যানস্থ মহাদেবের ধ্যানভঙ্গ করতে দেবতারা কামদেবকে প্রেরণ করলেন। শিবের কোপানলে কামদেব ভস্মীভূত হলেন। কামদেবের পত্নী রতিদেবী তখন শিবের উপাসনা করে তাঁকে শান্ত করলেন। কামদেবকে শিব আদেশ দিলেন নীলপর্বতে পতিত সতীর যোনিমন্ডলের ওপর মন্দির বানাতে। মন্দির তৈরি সম্পূর্ণ হলে কামদেব পূর্বের রূপ ফিরে পাবেন। চৌষট্টি যোগিনী এবং অষ্টাদশ ভৈরবের মূরতি খোদিত পাথরের মন্দির তৈরী হল কিন্তু কালের করালগ্রাসে সেই মন্দির বিল্পুত হয়। তবে কামাখ্যা পরিণত হয় অন্যতম সতীপীঠে।
কামাখ্যে বরদে দেবী নীলপর্বতবাসিনী
ত্বংদেবী জগতংমাতা যোনিমুদ্রে নমোহ্স্তুতে ।
পুরাণে বর্ণিত আরেকটি কাহিনীতে ভূদেবীর কথা পাওয়া যায়।
হিরণ্যাক্ষ নামক দৈত্যের অত্যাচারে স্বর্গ্য–মর্ত্যের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে বিষ্ণুর কাছে কাতরে আবেদন জানাল। সে কথা জানতে পেরে হিরণ্যাক্ষ সমগ্র পৃথিবীকে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করল যাতে বিষ্ণু পৃথিবীকে রক্ষা করতে না পারেন। সে পৃথিবীকে একটা আঙুলে ছুঁয়ে তার অক্ষ থেকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করল। তার স্পর্শে ভুমাদেবী বা পৃথিবীর গর্ভ থেকে উঠে এল এক অসুর। শ্বেত বরাহ অবতার রূপী বিষ্ণু সমগ্র বিশ্বকে আবার পৃথিবীকে স্বীয় অক্ষরেখায় স্থাপন করে নিজের দুই শিঙের মধ্যে ধারণ করলেন। অত্যাচারী হিরণ্যাক্ষকে ধরাশায়ী করে বধ করলেন। এবার ভূমাদেবী তার গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসা অসুর সম্বন্ধে ভীত হয়ে বিষ্ণুর কৃপাপ্রার্থী হলেন। বিষ্ণু এই অসুরের নাম দিলেন নরকাসুর এবং জানালেন সে হিরণ্যাক্ষর থেকে আরো শক্তিমান। ধীরে ধীরে পুত্রটি অসুরের ন্যায় আকৃতি ও প্রকৃতি লাভ করতে লাগল। পৃথিবী কেঁদেকেটে বিষ্ণুর কাছে পুত্রের অমরত্ব ভিক্ষা করলেন । বিষ্ণু নিজে বরাহ অবতারের রূপ ধারণ করে বৈকুন্ঠে গমন করলেন।
পুরাণে আছে নরকাসুরের রাজধানী ছিল প্রাগ্ জ্যোতিষপুরা বা বর্তমানের গুয়াহাটি। ব্রহ্মার বরে নরকাসুর অখন্ড পরমায়ু লাভ হল এবং ব্রহ্মা জানালেন পৃথিবী যদি স্বয়ং তাকে হত্যা করে তবেই সে একমাত্র মৃত্যুবরণ করবে। নরকাসুর হেসে উড়িয়ে দিল কথাটি আর ভাবল, হায়রে! মা কখনো তার ছেলেকে বধ করতে পারে? এবার শুরু হল মা–ছেলের বোঝাপড়া। স্থলপুরাণের মতে মা কামাখ্যা হলেন মায়া রূপিণী পৃথিবী বা ভূ দেবী। শুরু হল নরকাসুরের ভূদেবীর উপাসনা। ভূদেবীকে খুশি করে সে আরো শক্তির অধিকারী হয়ে উঠল। বহু যুগ দাপটের সাথে পৃথিবীতে রাজত্ব করল সে। বাণাসুরের সাথে তার বন্ধুত্ব হল। বাণাসুর তাকে বলল, ভূ দেবী বা কামাখ্যা একজন কুমারী মেয়ে, ইচ্ছে করলেই নরকাসুর তাকে বিয়ে করতে পারে। একদিন রাতে নরকাসুর দেখতে পেল কামাখ্যা মন্দিরে ভূদেবীর নৃত্য। সে এগিয়ে গিয়ে তার পাণিপ্রার্থণা করে বসল। দেবী একগাল হেসে তাকে বললেন, যদি নরকাসুর সুন্দর করে, বিশাল ভাবে নীলাচল পাহাড়ের নীচে দেবীর জন্যে সিঁড়ি বানিয়ে দেয় তবেই তিনি বিয়েতে সম্মত, নয়ত নয়। নরকাসুর তপস্যা, উপাসনা ও মাতৃপ্রদত্ত শক্তির বলে কাজ শুরু করল । কাজটা সম্পূর্ণ হবার আগেই সূর্যোদয়ের ঠিক পূর্বে কামাখ্যাদেবী এক মোরগের গলা চেপে ধরে তাকে চিৎকার করিয়েই ছাড়লেন। মোরগের ডাক শুনে নরকাসুর ভাবল ভোর হয়ে গেছে। তখনো তার সিঁড়ি বানানোর কাজটি অসম্পূর্ণ। দৌড়ে গিয়ে সেই মোরগটিকে ধাওয়া করে মেরে ফেলল। এই স্থানটি কুকুরাকাটা নামে পরিচিত। এবং ঐ অসমাপ্ত সিঁড়িটিকে বলা হয় মেখেলৌজা পথ।
এদিকে নরকাসুর যুগযুগ ধরে রাজত্ব করছিল সেখানে। দ্বাপরে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব হলে তিনি তাঁর পত্নী সত্যভামার সঙ্গে শেষমেশ ঐ দোর্দণ্ডপ্রতাপ নরকাসুরকে বধ করেন।
উত্তর কলকাতায় জন্ম। রসায়নে মাস্টার্স রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। বিবাহ সূত্রে বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। আদ্যোপান্ত হোমমেকার। এক দশকের বেশী তাঁর লেখক জীবন। বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস সানন্দা পুজোসংখ্যায়। এছাড়াও সব নামীদামী বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখে চলেছেন ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ এবং ফিচার। প্রিন্ট এবং ডিজিটাল উভয়েই লেখেন। এ যাবত প্রকাশিত উপন্যাস ৫ টি। প্রকাশিত গদ্যের বই ৭ টি। উল্লেখযোগ্য হল উপন্যাস কলাবতী কথা ( আনন্দ পাবলিশার্স) উপন্যাস ত্রিধারা ( ধানসিড়ি) কিশোর গল্প সংকলন চিন্তামণির থটশপ ( ধানসিড়ি) রম্যরচনা – স্বর্গীয় রমণীয় ( একুশ শতক) ভ্রমণকাহিনী – চরৈবেতি ( সৃষ্টিসুখ) ২০২০ তে প্রকাশিত দুটি নভেলা- কসমিক পুরাণ – (রবিপ্রকাশ) এবং কিংবদন্তীর হেঁশেল- (ধানসিড়ি)।অবসর যাপনের আরও একটি ঠেক হল গান এবং রান্নাবাটি ।