আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিটস্টেশান থেকে নেমে অটো স্ট্যান্ডের দিকে যেতেই একটি ছোকরা মতন ছেলে ডাক দিলো, কোন দিকে? বললাম, ঝাঁপপুকুর। উঠে আসুন বলায় ড্রাইভারের বা-দিকে বসার সুযোগ হল। সেই ছোকরাই চালক।
ছেলেটি বেশ মজার। এক বয়স্ক ভদ্রলোককে বললে, ‘কাকা যা দেবে অঙ্গে তাই যাবে সঙ্গে’। কী প্রসঙ্গে বলল কথাটা শোনা হয়নি আমার। এক মহিলা আসাতে ছেলেটি বললে, লেডিস ফার্স্ট, কাকা তুমি আমার সামনে ডানদিকে চলে আসো।দেখলাম ছেলেটি অবলীলায় আপনি থেকে তুমিতে সহজেই চলে এলো।
একটু এগিয়ে ব্যান্ডেল সাবওয়ের সামনে আটো থেমে গেল। কাজ হচ্ছে। শুনলাম আরো দু-মাস এমন চলবে। ফলে জ্যাম। একটা পথ দিয়েই যাতায়াত।
ছেলেটির বয়স সাতাশ-আঠাশ হবে। উচ্চতা পাঁচফুটের একটু বেশি। হেলদি চেহারা। কথাবার্তায় চৌখস। গত চার মাস ধরে এ পথে যাচ্ছি, কোনো অটোঅলা স্বেচ্ছায় এত কথা বলে না। ছেলেটি নিজের কথাই বলতে শুরু করলে। কে যেন আঁধার কার্ড নিয়ে ফোনে কথা বলছিল।
সেই শুরু। ছেলেটি বললে, এই আঁধার কার্ডের জন্য কত প্রেমিকা কেটে গেল। কারণ সে অনেক সিম তুলতে পারছে না। এক যাত্রী বললে, এখন আবার আঁধার কার্ড লাগছে না।
– আগে সে কী খিল্লি, ব্যাঙ্কে। ব্যবসার টাকা লেনদেনের সময়–কত সময় নষ্ট। এই জমা দেও, ওই জমা দাও। সরকারের যখন যা ইচ্ছে তাই করছে। আজ আঁধার কার্ড কাল নোট বাতিল। সেই বয়স্ক কাকা বললেন, তুমি আবার ব্যবসা কর নাকি?
– হ্যাঁ তো । অটোটা টাইম পাস। পুজোর সময় এক্সট্রা ইনকাম। বসে থেকে কী হবে। অটো নিয়ে বেরুলেই ইনকাম।
– আচ্ছা । কী ব্যবসা তোমার? বললেন ওই কাকা।
ওই ছোটদের খেলনার। বাড়িতে কারখানা আছে। সে সঙ্গে জুড়ে দিলো, আমার দুটো অটো মার্কেটে ভাড়া খাটে। আরো দুটো কিনব ভাবছি। অথচ দেখো কাকা বিয়ে করব , একটা মেয়ে পাচ্ছি না।
– সে কী মেয়ে পাচ্ছ না? বললাম আমি।
– না দাদা, কত মেয়ে দেখলাম। দু-তিনটে ঠিক হতে হতে ভেঙে গেল। এক চুলের জন্য ভেঙে গেল। বলে মুখটা এমন করল যে ভারী দুঃখ হয়েছে যেন।
– কেন ভাঙলো কেন , জিজ্ঞেস করলে একজন যাত্রী।
ছেলেটি মেন রোডে অটো নিয়ে উঠেছে এইবার। স্পীড বেড়েছে। বললে, সেখানেই তো গল্প । বললাম, শুনি তোমার গল্প তবে।
কাকা বললে, একটু সামলে বাবা।
সে বললে একটা নার্সকে দেখতে গেছিলাম। মেয়ের মা বললে, কত রোজগার মাসে? বললাম, সব মিলিয়ে হাজার ত্রিশের মতো।
– সব মিলিয়ে বলতে , কী আছে তোমার?
আমি বললাম, দুটো অটো আছে। আরো দুটো কিনব ভাবছি। বাড়িতে ব্যবসা আছে। বছরে দু’তিনবার মাল নিয়ে বাইরে বাইরে যাই।
– বাইরে বলতে কোথায়, জানতে চাইল মেয়ের মা।বললাম, পাঞ্জাব, উড়িষ্যা, আসাম। এইবার মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, অটো চালান?
– হুম। চালাই।
– সামনে লোক নেন।
– নিই। ডাইনে বায়ে লোক বসে।
– বসে।
– মেয়েরা বসে?
– হ্যাঁ বসে। তো সমস্যা কী?
– না মা এই ছেলেকে আমি বিয়ে করব না।
– কেন বিয়ে করবে না কেন? দোষটা কোথায়?
– এদের চরিত্র ভালো হয় না। এর থেকে ভালো রিক্সাঅলাকে বিয়ে করা।
মেয়েটাকে আর বিয়ে করা হল না। বয়স্ক কাকা চুপ করে শুনছিলেন। বললেন, সত্যিই কী যে হচ্ছে আজকাল। বলে বললেন, এই যে ভাই দাঁড়া বাপু , ওই যে বিয়ে বাড়ি এসে গেছে , আমি এবার নামব।
ছেলেটি বিয়েবাড়ির সামনে অটো দাঁড় করাল। বয়স্ক লোকটি নেমে যেতে বললে, কাকা, বয়স হয়েছে। সাবধানে খাবে। বিয়েবাড়ির নিচে ওষুধের দোকান আছে। একটা হজমের ট্যাবলেট খেয়ে নেবে। শুনে লোকটি হাসল।হাত নাড়িয়ে বললে, ঠিক আছে ঠিক আছে।
অটোতে আবার চলতে শুরু করল। আমিই বললাম, তার মানে নার্স মেয়েটিকে তোমার পছন্দ হয়েছিল।
সে আর বলতে দাদা। হেব্বি দেখতে। বললে বলতে ছেলেটির চোখ আলোময় হয়ে উঠল।
অটো চলছে। সে বললে, এরপর আরেক জায়গায় ঠিক হল। কী ব্যাড লাক দাদা। পাত্রীর ঠাকুমা কেসটা গুবলেট করে দিলো।
– সেটা কী রকম? জিজ্ঞেস করলে আরেক জন যাত্রী। অটো এবার ডাইনে বেঁকে মোড় ঘুরল। ঝাঁপপুকুর ঢুকছে। মুখে একটু জ্যাম ।
ছেলেটি বলতে থাকে, সব ঠিকঠাক ছিল। মেয়ের এক বুড়ি ঠাকুমা- চিতায় এক ঠ্যাং এগিয়ে রেখেছে, সে আমাদের বাড়িতে এলো, ছেলের বাড়ি কেমন তা দেখতে। দেখে-টেখে বললে, ছেলের বাড়িতে বাস্তুদোষ আছে। এই বাড়িতে হারান তোর মাইয়্যার বিয়া দেওন যাইব না। বৃদ্ধার গলা নকল করলে যেন ছেলেটি। হাসি পেল আমাদের, আবার ঘটনা বেদনারও বটে। বললে, ওই বুড়ি জ্যোতিষচর্চা করত আগে। মুখ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে সমবেদনা জানাল আটোতে বসা একমাত্র মহিলা যাত্রীটি। আহা রে!
– বললাম , বোঝ কান্ড !
– তারপর কী হল ভাই? জানতে চাইলে সেই যাত্রী।
– কী আর হবে সেই বাধ্য ছেলে হারান আর বিয়ে দিলো না আমার সঙ্গে তার মেয়ের। ভাগ্যটা দেখলে আমার? এতটাকা রোজগার করে একটা মেয়ে পাচ্ছি না বিয়ে করার। মেয়ের বাবাকে এও বলেছিলাম, আমার কিস্যু লাগবে না। কোনো চাহিদা নেই। যা আমার আছে তা যথেষ্ট । সত্যিই খুব সমস্যা আজকাল দেখেশুনে বিয়ে করা।
– বললাম, তুমি ভাই এমন সুন্দর একটা ছেলে, এত টাকা রোজগার করো, ফেসবুকের যুগ। একটা মেয়ে খুঁজে পাচ্ছো না? সে একটুও অবাক না হয়ে বললে, – দাদা চেষ্টা কী আর করিনি, সবাই বলে আমার কিন্তু বয়ফ্রেন্ড আছে। এইটে বললে মেয়েদের কণ্ঠ নকল করে। একজন আমার পাশের সীটে বসা লোকটি বললে,
– এখন ক্লাস ফাইভের থেকেই মেয়েরা এনগেজড হয়ে যায়। এখন লাইফ খুব ফার্স্ট। সব কিছু এখন ওদের হাতের মুঠোয়। ছেলেটি আবার বললে,
-আমার আরেকটি মেয়ে দেখার কেস আছে । সেইটে হল হিন্দুস্থান-পাকিস্থান কেস।
– মানে, বুঝলাম না। বললাম আমি।
– সে বললে, তাহলে সেই গল্পটা শুনতে হবে।
– আমি তো ভাই আর শুনতে পারব না। এই তো আমার গন্তব্য এসে গেছে।
– আপনি এখানেই নামবেন? আহা রে, শোনানো হল না দাদা। বলে দুঃখ প্রকাশ করলে অটোঅলা ছেলেটি। ভাড়াটা হাতে দিয়ে বললাম,
– আরেকদিন শুনব ভাই। এই রুটেই তো যাই। ঠিক তোমার সঙ্গে একদিন দেখা হয়ে যাবে।
সে বললে, হ্যাঁ দাদা। আবার যেদিন আমার অটোতে উঠবে, গল্পটা কোথায় শেষ করেছিলাম, মনে করিয়ে দিও।বলে হুস করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে অটো নিয়ে সোজা চলে গেল। আমি ধোঁয়ার ভিতর দাঁড়িয়ে থাকলাম অদ্ভুত এক বিস্ময়ে। সম্বিত ফিরল এক ছাত্রীর ডাকে। স্যার, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? পড়াতে যাবেন তো…!
কবি , গল্পকার ও প্রাবন্ধিক । জন্ম-কর্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়াতে । পড়াশুনো হাবড়া হাই স্কুলে। শ্রীচৈতন্য মহা বিদ্যালয়ে কলেজ জীবন । বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর । পেশায় গৃহশিক্ষক , নেশায় লেখক । কিছু কবিতা , ছোটগল্প , অণুগল্প ও প্রবন্ধের বই প্রকাশিত । এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ২৫টি । সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে কাব্যোপন্যাস ” পাখি-যাপনের জার্নাল ” । ২০১৯ এ প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ” বিষাদ-সুন্দরী ও লালপদ্ম ” গল্পগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন ” অনিলা দেবী সাহিত্য সম্মান ” । এছাড়াও পেয়েছেন বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ পুরস্কার , সুতরাং সাহিত্য সম্মান , টেগোর ভিলেজ সাহিত্য পুরস্কার সহ আরো কিছু পুরস্কার ও সম্মান । ১৯৯৬ সাল থেকে সম্পাদনা করে আসছেন ‘ অবগুণ্ঠন সাহিত্যপত্র’টির । প্রকাশিত হয়েছে নির্বাচিত কবিতা ” নির্বাচিত ১০০” । মূলত লিটিল ম্যাগাজিনের লেখক বলতেই গর্ববোধ করেন । তবে বেশ কিছু বানিজ্যিক কাগজেও লিখেছেন । অণুগল্পের বই ” ছক্কুমামা , কর্নেল কাপুর ও অন্যান্য গল্প ” যথেষ্ট জনপ্রিয় ।
Related