দুপুরের আগেই খুব মেঘ করে আকাশ কালো হয়ে গেলো। পশ্চিম দিকের বারান্দায় মেলে দেওয়া কাপড়গুলো আর লাগোয়া দরজার পর্দা উড়তে লাগলো পাগলের মত। কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি। তবু, সকাল ছটায় উঠে গাছে পানি, নাস্তা বানানো আর মিশুকে উঠিয়ে স্কুলের জন্য তৈরি করে যখন বাসা ফাঁকা হয়েছে বুঝলাম, তখন, হঠাৎ কেমন একটা ক্লান্তি চোখের পাতায় চেপে বসলো। তাও আধো ঘোরে শোবার ঘর গুছিয়ে টেলিভিশনে খবরের চ্যানেল দিয়ে সোফায় বসে মুখে একটা রুটি তুললাম। খেতেও ইচ্ছে হচ্ছিল না। কখন চোখ লেগে গিয়েছিল বুঝতেই পারিনি। ঠাণ্ডা বাতাস আর পর্দার ঝাপটার আওয়াজে ঘুমে জড়ানো আঠালো চোখ কোন মতে মেলে দেখি এই অবস্থা!
তড়িঘড়ি করে উঠে কাপড়গুলো ঘরে এনে জানলা-দরজা বন্ধ করলাম। তারপর একটা শ্বাস ছেড়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝলাম মিশুর স্কুল ছুটি হতে এখনও পাক্কা একঘণ্টা বাকী। একটু ধাতস্থ হয়ে বসে ভাবলাম কি রান্না করব? মৃগেল, নাকি ছোট মাছ? নাকি মুরগি? বড় মাছ রায়হান পছন্দ করে। মাংস তেমন পছন্দ করে না। আজ যখন ওরা বেরুচ্ছিল তখন আবার মিশু বলছিল, “মা আজ মুরগি খাবো।” ডিপ থেকে মাছ বের করে সিঙ্কে ভিজিয়ে, রোস্টের একটা ছোট মুরগিও ভিজিয়ে দিলাম। দু’পদের আমিষ রান্নায় হাঙ্গামা অনেক। কাটা-বাছাতেই সময় অনেক চলে যায়। আর শুধু রান্না করেই তো কাজ শেষ হয় না। বেচে যাওয়া খাবার রাতে ফ্রিজে জায়গা করে তুলে রাখা, পরেরদিন চুলায় জাল দিয়ে গরম করে না দিলে রায়হান মুখেই তুলবে না। আর যদি জানে বাসি তরকারী, তাহলে তো গজগজ করে উঠেই পড়বে। এজন্য সেটা আঁচ করতে দেওয়া চলবে না। কে রাঁধবে নিত্য-নতুন এত এত রান্না!
রিক্তাও এখন দেশে গেছে। রিক্তা বাসায় কাজে সাহায্য করে। বছর বিশ-বাইশের এক মেয়ে। মনটা ভালো। চেহারায় পুরুষালী ভাব প্রবল দেখেই নাকি তার বিয়ে হয় না। এজন্য যে তার আক্ষেপ আছে তেমনও মনে হয় না। আমি সে নিয়ে যে চিন্তিত তাও না। ও যে আমার বাসায় থাকছে, আমার সংসারটাকে আগলে রাখছে তাতেই আমি খুশি।
রায়হানের ব্যবসার সুবাদেই হোক বা মিশুর বন্ধু বান্ধব, এ বাসায় অতিথি লেগেই থাকে। তখন রিক্তাই ভরসা। আর এখন তো পুরো ‘নাকে মুখে’ অবস্থা। তবু কাল রাতে রায়হানের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আর মিশুর হাত থেকে ট্যাব সরাতে সরাতে প্রায় দেড়টায় যখন বিছানায় পিঠ ছোঁয়ালাম তখন রেডিমেড ঘুম কপালে জুটবে তার কি মানে! এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি দিয়ে চোখ লেগে আসতেই খাপছাড়া সব স্বপ্ন, আধ খ্যাচড়া ঘুমের বেশী আর কিছু জোটেনি…।
কলিং বেলের আওয়াজে কপালে বিরক্তি জমে। নিশ্চয়ই উপর তলার ডি ফাইভে যেতে বি ফাইভে এসেছে। এরকম প্রায় রোজই হয়। এমন মেঘের দিনে আর কে আসবে!
কি হোলে চোখ রেখে এক লোককে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দরজা আধ খোলা করে বিরক্ত জিজ্ঞাসু চোখে তাকাই কেবল। দরজা খোলার আওয়াজ শুনে লোকটাও মুখ তুলে তাকায়। তারপর, প্রথমে একটা অপ্রত্যাশিত মুখ দেখে একটা অপ্রস্তুত ছায়া মুখে ভর করে যেন। ভদ্রলোকের মাথায় কাঁচা পাকা চুল। চশমার মোটা ফ্রেমের আড়ালে যে অদ্ভুত সুন্দর চোখ রয়েছে তা বোধ করি আরও বছর কুড়ি বাদেও আমি চিনতে পারবো।
হ্যাঁ, ইনি আমার পূর্ব পরিচিত। কিন্তু প্রত্যাশিত কেউ নন আর এখন তো হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমি তাকে চিনেছি। কিন্তু মনে হয় তিনি আমাকে চিনতে পারেন নি। উনি বললেন, ’’এটা কি নাভিদ সাহেবের বাসা?” আমি মাথা নেড়ে বললাম। উপরের ফ্লোরে যান” ভদ্রলোক ঘুরে যেতে লাগলেন, আমিও দরজা আটকে দেব, এমন সময় উনি আবার ঘুরে কিছুটা ইতস্তত গলায় বললেন, “আচ্ছা, শুনুন… কিছু মনে করবেন না, আপনাকে পরিচিত মনে হচ্ছে…।“
আমি বলব না বলব না করেও নিজেকে সামলাতে পারলাম না, “আপনি তো আমার কাছে আসেননি আর যেহেতু আমাকে মনে করতেও পারছেন না তখন আমি অপরিচিতই হব।”
আমার গলায় একটা ক্ষোভ জড়ানো কৌতুক ছিল নিশ্চয়ই। তাকে কিছুটা হলেও তা স্পর্শ করলো। ক্ষণিক মাথা নিচু করে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি কি দোয়েল?” আমি হেসে ফেললাম, “অবশেষে মনে পড়েছে আপনার।“ ভদ্রলোকের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। হেসে বললেন, “বাম গালের টোল তো ভোলা যায় না।“ আমার কেমন যেন মেজাজ খারাপ হলো। উনি কি ভেবেছেন, আমি এসব ফ্লার্টিং কথাবার্তা শুনে দরজা খুলে ওনাকে ঘরে এনে গল্প জুড়ব! আমি হেসে দরজা বন্ধ করতে উদ্যত হলাম। উনি এক পা এগিয়েছিলেন। কিছুটা অপমানিত হলেন কি? বললেন, “তোমার বাসায় বসতে বলবে না?” আমি অম্লান মুখে বললাম, ‘আমি তো একটু বাদেই বেরুবো! আর আপনারও তো ওপরতলায় যাওয়ার আছে!” উনি কিছুটা নির্লজ্জের মতই মরিয়া যেন। বললেন, “কোথায় যাবে?” আমি এড়িয়ে যেতে বললাম, “এই কাছেই…।“ উনি বললেন, আমার বেশিক্ষণ লাগবে না। আমি ভদ্রলোকের সাথে দরকার মিটিয়েই আসছি। তারপর একসাথে কি বেরুনো যায়?” আমি চুপ করে হাসছি, আর ভাবছি, এত বছর বাদে আমায় করা অপমান, অবহেলা আর নির্লিপ্ততা একটা অপ্রত্যাশিত জায়গায় পুরনো এক চেনা মুখ পাওয়ায় কৌতূহলে পাল্টে গেলো এভাবে? কই, কখনও তো এত আগ্রহ, এত আলাপ করার উছিলা এই আমার জন্য বা আমার সাথে সেই কুড়ি বছর আগে দেখিনি!
বাবার ছিল বদলীর চাকরী। কখনো মফস্বল কখনো বড় শহর। এই করেই কেটেছে কৈশোর। তারপর স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে যখন ঢাকায় থাকতে আসা হলো, তখন বাবা এল,পি,আরে। মা’ও মনে হয় হাঁপ ছাড়লো। আর কত সয় টানা হেঁচড়ার সংসার। ভাইয়াও দেশের বাইরে চলে গেল ভাল একটা কাজ পেয়ে। খালার বাসার কাছেই একটা বাসায় উঠলাম আমরা। আর সেখানেই স্বপন ভাইয়ের সাথে পরিচয়। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত রসায়ন বা এরকম একটা খটমটে বিষয়ে পড়াশোনা করছেন। অনার্স শেষ করে সবে মাস্টার্সের ক্লাস শুরু করেছেন। যেমন মেধাবী, তেমন সুঠাম সুন্দর, আর তেমনি তুখোড় তার ব্যক্তিত্ব। মারকাটারি সুন্দরী যেকোন অহংকারী তরুণীও বিগলিত হবে এমন যুবকের সামনে। আর আমি তো ধ্যারধ্যারে মফস্বল থেকে আসা নার্ভাস এক কিশোরী। আমার তো তার প্রেমে পড়ে চক্ষু ছানাবড়া হতে বাধ্য ছিল। হ্যাঁ, সেই প্রেম একপাক্ষিক হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। আর এর ব্যাপ্তিকালও অপরপক্ষের আশকারার জল না পেয়ে মিইয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু, অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি স্বপন ভাইয়ের সাথে আমার যে তুমুল প্রেম হয়েছিল তা কিন্তু গড়িয়েছিল বিয়ের আলাপ পর্যন্ত!
আমি দরজা আটকে ঘড়ি দেখলাম। আধা ঘণ্টা মত বাকী মিশুকে আনতে যাওয়ার। রান্নাঘরে রান্নার সরঞ্জাম গুছিয়ে কাপড় পাল্টে নিয়ে নীচে নামতেই দেখি স্বপন ভাই গেটের সামনে দাড়িয়ে আছে। আমি তাকে দেখে খানিকটা অবাকই হলাম। আমার জিজ্ঞাসু চোখ দেখে এগিয়ে এসে বললেন, “তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।“ সেই কুড়ি বছর আগে এই কথা শুনলে হয়তো সারারাত আনন্দে ঘুমই আসতো না। আমি ভাবলাম, জিজ্ঞাস করি, ‘কেন’। কিন্তু কৌতূহলটা মরা কিসিমের। ঠোঁট পর্যন্ত আসার আগেই মিলিয়ে গেল। স্বপন ভাই বললেন, “তুমি তো তোমার বাসায় ঢুকতেই দিলে না। ভাবলাম এখানেই দাঁড়াই। তুমি তো কাছেই যাবে। গাড়িতে নামিয়ে দেবো’খন।“ হালকা একটা রাগ বুকের ভেতর দানা বাঁধছে আমার। আমি বললাম, “প্রয়োজন নেই, আমি হেঁটেই যাব।“
স্বপন ভাই আর জোর করলেন না। শুধু, ‘আচ্ছা’ উচ্চারণ করে তার গাড়ীর দিকে এগিয়ে গেলেন। আমি হেঁটে চললাম উল্টো দিকে।
“দোয়েল… ”ডাক শুনে চমকে তাকালাম পেছনে। স্বপন ভাই আমার পেছন পেছন হেঁটে আসছেন। আমি এবারও অবাক হলাম। এতো উপেক্ষার পরও কি কারণে এতো কৌতূহল আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। যে অপমান, যে জঘন্য প্রতারণা উনি করেছিলেন তার বিন্দুমাত্রও কি ওনার মনে নেই? অপরাধবোধ হয়ত নাই থাকতে পারে, সবার ওটা থাকেও না। কিন্তু, যাকে এক সময় চরমভাবে ঘৃণা ছুঁড়ে দেওয়া যায় তার সাথে কিসের এতো খাতির! আমি থমকে গিয়েছিলাম একটু। আবার হাঁটতে শুরু করলাম। মনের মধ্যে কুড়ি বছর আগের চাপা কষ্ট, ভয়াবহ মানসিক যন্ত্রণার কথা মনে পড়ছে। হ্যাঁ, সেই ভয়ংকর অতীত পেরিয়ে এসেছি। যন্ত্রণাগুলোকেও মাটিচাপা দিতে পেরেছি। কিন্তু স্মৃতিগুলো রয়ে গেছে। আমার স্মৃতিশক্তি আরেকটু কম হলে ভালো হতো!
-“তোমরা মোহম্মদপুরের বাসা থেকে কোথায় শিফট করেছিলে?”
আমি চুপ করে হাঁটছি।
-“তোমাকে একটা সময় অনেক খুঁজেছি।”
বলব না বলব না করেও তীক্ষ্ণ স্বরে বললাম, “কেন?” আমার তির্যক স্বরের ধারেই কিনা জানি না, স্বপন ভাই কিছু বলল না।
“তোমার বর কি করেন?”
-“এসব জেনে আপনার লাভ?”
-“তুমি এত রেগে আছো কেন?”
-“আমার কি খুব আনন্দিত হওয়ার কথা?”
-“এতদিন পরে দেখা হলো, খুশি হওনি?”
আমি থমকে গিয়ে স্বপন ভাইয়ের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবার হাঁটতে লাগলাম। চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শুনাতে পারছি না দেখে রাগে গা জ্বলছে। এই লোকটা আমার মন চিরকালের জন্য নষ্ট করে দিয়ে চলে গেছে। চলে গিয়েও আঘাতের পর আঘাত করেছে। তখনও তাকে কিছু বলতে পারিনি, কিছু করতেও পারিনি। কারণ ভীষণ ভালোবেসেছিলাম। যাকে একবার মন থেকে ভালোবাসা যায় তাকে কি মনের ভুলেও আঘাত করা যায়? এটা কি সত্যি সম্ভব?
স্বপন ভাই আমাদের বাড়িওয়ালার ভাগ্নে ছিল। বাড়িওয়ালা জামশেদ আঙকেলের কোন ছেলে ছিল না। স্বপন ভাই জামশেদ আঙ্কেলকে বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করত। প্রায়ই আসত। আর জামশেদ আঙ্কেলের তিন মেয়ে ছিল। দুজনের বয়স আমার কাছাকাছি। ওদের সাথে তুমুল বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। আর একই কলেজে পড়ার সুবাদে প্রায়ই পড়াশোনার জন্য বাড়িওয়ালার বড় মেয়ে শিউলির সাথে ওদের বাসায় যেতাম। শিউলি যতোটা শান্ত ওর মেঝো বোন তিতলী ততোই দুষ্টু। ছোটো জন বুবলি, বয়স তখন নয়। ও খুব বেশী আমাদের কাছে ঘেঁষতো না। ওর বয়সীদের সাথেই বিকেলটা কাটাতো রান্নাবাটি আর পুতুল খেলায়।
তাই, যত দুষ্টুমির জোগানদার ছিল তিতলি। প্রায় বিকেল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত কাটতো শিউলি তিতলিদের বাসায়। বাড়িওয়ালী আন্টি এটা সেটা বানিয়ে খাওয়াতো। উনিও আদর করতেন খুব। আমিও যেন নিজের বাসায় আছি এভাবেই ওদের বাসায় ঘুরে বেড়াতাম। রান্না ঘরে টুকটাক কাজে সাহায্যও করতাম। কিন্তু যখন স্বপন ভাই আসতো কেমন একটা ভয়ে বুকটা ধুকপুক করত। মাথায় ওড়না টেনে সামনে থেকে পালিয়ে যেতাম। এটা নিয়ে তিতলি খুব খ্যাপাতো। বয়স কম ছিল, তাই আমিও লজ্জায় রেগে যেতাম। তিতলি এক বিকেলে আমায় বলল, “এই দোয়েল, স্বপন ভাইকে দেখে এত লজ্জা পাস, স্বপন ভাই তো মনে হয় তোরে পছন্দ করে!”
-“যাহ! কি সব ফাজলামি কথা!” আমি লজ্জায় কপট রাগ দেখাই। এদিকে মনে লাড্ডু ফুটছে।
-“জ্বি না! কাল যখন আসছিল তখন তোর কথা জিজ্ঞাস করল। বলল ‘ ঐ মেয়েটা, কি যেন নাম, ও কই, দেখছি নাতো!”
-“আজাইরা কথা আর কত বলবি?” আমি মৃদু ধমকাই।
-“আজাইরা না, আমারও মনে হয়। তুই থাকলে কেমনে জানি তাকায়!“ এবার শিউলি বলে।
আমার বুকের ভেতর হৃদ-স্পন্দন বেড়ে গেল। কেমন একটা ভয়, অপার্থিব ভালোলাগায় আমি দুটো দিন গেলাম না শিউলিদের বাসায়। আমি সেই অনুভূতিটা ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারবো না। দুই দিন পর শিউলি এসে আমার হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে চলে গেল। আমি চিরকুট খুলে দেখি একটা ল্যান্ডলাইনের নাম্বার, সেখানে নিচে ‘স্বপন’ লেখা। আমি ‘হাবা গঙ্গা রাম’। ভাবলাম হয়তো স্বপন ভাই নিজেই নাম্বার দিয়েছে। আমি ফোনের কাছে ঘুরি কিন্তু ফোন করতে সাহস হয় না। হয়তো একটু সাহস জমাই তারপর ফোনের নাম্বারটা ডায়াল করে রিং বাজলেই কেটে দেই।
এর মধ্যে এক বিকেলে শিউলি আমাকে ওদের বাসায় নিয়ে যায়। গিয়ে জানতে পারি ওর বাবা মায়ের ম্যারেজ ডে পালন করবে। আমি একটু কাঁচুমাচু করতেই বলে, “তুই তো বাসার মানুষ, তুই আবার কি গিফট দিবি?” আমি ইতস্তত ভাবে ওদের সাথে ঘুরি, খাবার টেবিলে সাজাই। এর মধ্যে স্বপন ভাই আসে। আমার তো অক্কা পাবার দশা। সাজিনি, চুল এলোমেলো। কি বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে! আমি পালানোর পথ খুঁজছি, কোন একটা উছিলায় চলে যেতে হবে। এর মধ্যে তিতলি আমাকে ধরে ওদের ঘরে নিয়ে একটা শাড়ি পরিয়ে, চোখে কাজল টেনে সাজিয়ে দিল। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেরই লজ্জা লাগল। এরকম সাজার কি মানে!
বসার ঘরে যখন গেলাম বাড়িওয়ালী আন্টি সাজের অনেক প্রশংসা করলেন। আমি কারো দিকে তাকাতে পারছিলাম না, কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম স্বপন ভাই আমাকে দেখছে। সে রাতে ঘুম হলো না ভালো। শেষ রাতের দিকে একটা আবছা স্বপ্নে স্বপন ভাইকে স্বপ্নে দেখলাম আমার হাত ধরে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে।
পরদিন একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে। এরকমই মেঘলা ছিল সেই দুপুর। আমাদের বাসায় একটা ফোন আসে। আমি ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে যে ভারী পুরুষ কণ্ঠের মানুষটি আমাকেই চেয়ে বসে, তিনি আর কেউ নন, স্বপন ভাই। আমি কয়েক মুহূর্ত বুঝতে পারি না, এটা কিভাবে সম্ভব! তারপর যখন হ্যালো হ্যালো করতে থাকে তখন আমিও সাহস করে উত্তর দেই। ফোন রাখার পর কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বুঝতে পারি, তার বক্তব্য। শিউলি তিতলিদের বাসার নাম্বার নষ্ট। জামশেদ আঙ্কেলের কাছে তার আসার কথা ছিল কিন্তু আসতে পারছে না, আমি যাতে সেটা জানিয়ে দেই।
এই ফোন কল কোন রোমান্টিক কারণে ছিল না। প্রয়োজনেই, কিন্তু এই প্রয়োজনের কল থেকে আমি কেমন একটা বেমক্কা সাহস পেয়ে গেলাম। স্বপন ভাইকে ফোন করার। এই ফোন পাল্টা ফোন থেকে আস্তে আস্তে আলাপ জমে উঠল। কিভাবে, কেন, এখন আর সেসব ভাবতে ভালো লাগে না। তবে, সেই সময়টা অনেকটা স্বপ্ন বিনিসুতায় বুনতে বুনতে, কল্পনার রঙিন ফানুশ ওড়াতে ওড়াতে বিভোর ছিলাম। বড় মধুর ছিল জীবনের সেই অধ্যায়। মাঝে মাঝেই আমরা রিকশায় ঘুরতাম। কখনো বৃষ্টি এলে ভিজতাম হুড খুলে। হাতে হাত ধরে বিকেলের পার্কে অথবা অধিকারবোধে কোমর জাপটে ধরে রিক্সায় বসতো সে। শরীর যে আমারও ঝিমঝিম করতো না তা নিখাদ মিথ্যে বলা হবে, কিন্তু কি এক অস্বস্তি, এক অজানা ভয়ে সরিয়ে দিতে চাইতাম তার স্পর্শ।
এক ছুটির দিনে ওদের বাসায় ডাকলো আমায়। আমি গিয়ে দেখি বাসায় সে ছাড়া আর কেউ নেই। আমি এক ভীত পাখির মত ফিরে যেতে চাইলাম। কিন্তু সে আমায় সেদিন এমনি এমনি যেতে দেয়নি। জড়িয়ে ধরেছিল। তীব্র চুম্বনে ফুলিয়ে দিয়েছিল অনাঘ্রাত ঠোঁট, চিবুক আর গ্রীবা। তার চাওয়ায় হয়তো আরও অনেক কিছু ছিল। কিন্তু আমি ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম।
“তোমার বাচ্চা কয়জন?”, এতটা সময় চুপ থেকে স্বপন ভাইয়ের কথায় অতীত থেকে ফিরে এলাম।আমি একটা দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে বললাম,” এক মেয়ে।“
-“বাহ”
-“আপনার?” ভদ্রতা করেই প্রশ্নটা করা। স্বপন ভাই কিছু বললেন না। আমিও আর পাল্টা প্রশ্ন করার কারণ পেলাম না। স্বপন ভাই হঠাৎ বললেন, “তুমি এখনো আমার উপর রেগে আছো, তাই না?”
-“কেন?”
-“তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। অপমান করেছি। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।”
-“ আমি এখন এসব ভাবি না।” আমি স্বাভাবিক ভাবেই হাঁটতে হাঁটতে বললাম।
-“ কিন্তু তখন অভিশাপ দিয়েছো নিশ্চয়ই?”
আমি কিছু না বলেই হাঁটতে লাগলাম। হ্যাঁ, উনিশ বছরের মেয়েটার ভালবাসার কথা জানাজানি হয়ে যেতেই প্রথমে কিছুদিন বিরূপ প্রভাব পরেছিল বাসায় কিন্তু বিয়ের ব্যাপারে কথা শুরু হয়েছিল। স্বপন ভাইদের বাসায় আপত্তি করেনি। কিন্তু যেদিন ওদের আসার কথা, বাসায় বিয়ের কথা বলতে, সেদিনই স্বপন ভাই আমাকে ফোন করে ক্যাম্পাসে ডাকলো। আমি টেনশন আর ভালোলাগায় ঘামতে ঘামতে গিয়ে যে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ালাম তা হলো, স্বপন বিয়ে করেছে। তাও প্রায় ছ’মাস আগেই। তার এক ক্লাসমেটকে। সেই ক্লাসমেট আর সে মিলে আমাকে যা নয় তাই অপমান করলো! আমি শুধু তাকিয়ে ছিলাম স্বপনের দিকে। সে বিবাহিত থেকেও যে দ্বৈত সম্পর্ক বজায় রেখেছিল তার চেয়ে আমি কেন স্বপনকে ভালবেসেছি এই অভিযোগে জঘন্য সব কথা আমায় শুনতে হলো।
বাসায় যখন ফিরে এলাম, তখনও বাসায় অতিথি আসার তোড়জোড় চলছে। আমি সবাইকে থামতে বললাম। বললাম পাত্র বিবাহিত। এই বিয়ে সম্ভব না। তারপর ঘরে গিয়ে একটা বালিশ আঁকড়ে ভাবতে লাগলাম, সারা শরীর ফালা ফালা করে দেয় এরকম একটা ব্লেড দরকার। পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে মরলেও এর চেয়ে স্বস্তি পেতাম। বাড়িতে তখন বাবা মা হাউকাউ করছে। কি করছে, না করছে জানি না। এই ভয়াবহ আকাশ ভাঙ্গা সময়ে আমি কোথায় যাবো, কি করব জানি না। ঘটনা এতটুকু হলেও হতো। এর প্রায় সপ্তাহ খানেক পর স্বপন বাসায় আসে, বাসায় কেউ ছিল না। দরজা খুলেই বন্ধ করে দিচ্ছিলাম। স্বপন নির্লিপ্ত গলায় বলল, “দেখ আমার বিয়ে হয়ে গেছে, সো প্লিজ এসব নিয়ে আমার ফ্যামিলিতে নাটক করে আমাদের বিবাহিত জীবন প্রবলেমে ফেলবা না” আমি হতভম্ব গলায় বললাম, “ আমি কি করছি?”
-“তোমার কারণে বাবা মা আমার বউকে একসেপ্ট করছে না। মনে করছ আমি কিছু বুঝি না? নাকি কান্না কাঁদতেছ দিন রাত। এসব আমি বুঝি। আর আমার ওয়াইফ এখানে আসলে যদি উলটা পাল্টা কিছু বল তাইলে দেইখো আমি কি করি!” আমার জন্য তাহলে এই আঘাতও বরাদ্দ ছিল? ভালবাসার মানুষের এই জঘন্য রূপ দেখার চেয়ে মৃত্যুই কি সহজ না? আমি রান্না ঘর থেকে একটা ছুরি নিয়ে ঘরে ঢুকলাম। কয়বার নিজের হাতে পোঁচ দিয়েছিলাম মনে নেই। তবে আমাকে যখন বাবা বাসায় ফিরে হাসপাতালে নেয় তখন দু ব্যাগ রক্ত আর ছয়টা স্টিচ লেগেছিল।
“তোমার মেয়েটা কত বড় হলো?”
আমি আবার ফিরে এলাম, “আট বছর”
-“বিয়ে করেছ কবে?”
-“ বছর বারো”
-“ তুমি সুখে আছো তো?”
আমার হাসি পেলো। সুখ? সেটা আসলে কি? খাওয়া পরা? নাকি ভালোবাসা? ভালোবাসা কি আদৌ হয়? মনের মধ্যে মন মিশে যাওয়া ভালবাসা? নাহ! ওটা সম্ভব না। আর প্রশ্নটা করছে কে? যে এক ভয়ংকর অতীত উপহার দিয়ে গেছে। ভালবাসা? সে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। রায়হান কি তাকে ভালোবাসে? তাদের বিয়ে এক চুক্তির বিয়ে। ভালোবেসে কাছে আসার জেদ ছিল কই? তাই একটা পরিবার গঠনের দায় থেকে এই বিয়েতে ভালোবাসার মত অপার্থিব জিনিস আশা করা শুধু বোকামি নয়, অন্যায়ও।
তবু মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে বলি, “ হ্যাঁ…” এর বেশী আসলে বলা যায় না। স্বপন ভাই থেমে গেছে। আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে বললাম, “আমার পথ শেষ, এবার আপনি আসুন। মেয়েকে নিয়ে বাড়ী ফিরব।“
স্বপন ভাই ক্লান্ত গলায় বললেন, “ তুমি তো আমার কথা কিছু জিজ্ঞাস করলে না?
-“ আপনি তো ভালই আছেন।“
-“ না, কাউকে আঘাত করে যে সুখী হওয়া যায় না তার মর্ম বুঝেছি কয়েক বছরেই। আমার ওয়াইফ আমাকে ছেড়ে চলে গেছে দু’বছর পরই। তারপর পারিবারিক ভাবে যে বিয়ে করতে হলো তাতে…” উনি আর কিছু বলতে পারছেন না।
আমি বললাম, “বাড়ি যান।“ উনি ঘুরে চলে যেতে ধরলেন। তারপর আবার ঘুরে বললেন, “ভালো থেকো দোয়েল। তোমার জন্য তো তোমার সন্তান অপেক্ষা করছে, আমার আর বাবা হওয়া হয়নি।“
আমি চমকে উঠলাম। উনিশ বছরের অর্বাচীন এক তরুণী কোন দেবী ছিল না যে সে অন্যায়কারী এক যুবককে ভস্ম করতে পারে। সে তার প্রেমিকের প্রস্থান মেনেই নিয়েছিল, কিন্তু অপ্রয়োজনীয় অন্যায় আঘাতের তোড়ে অর্ধচেতনে হসপিটালে দিবা রাত্রি সে এই মানুষটিকে অভিসম্পাত করতো। সেই অভিসম্পাত কি সত্যি হয়েছে এই মানুষটার জীবনে? সন্তানহীন আর অসুখী জীবনই কি বয়ে বেড়াচ্ছে এই নিষ্ঠুর অপ্রেমিক?

সঙ্গীত আর লেখালেখি’র সাথে দীর্ঘদিন পথ চলা। বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত শিল্পী ও গীতিকবি। কাজ করছেন অডিও শিল্প, মঞ্চ ও ফিল্মেও। এ পর্যন্ত তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে। জীবিকা নির্বাহে জ্বালানী ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।