| 29 মার্চ 2024
Categories
দুই বাংলার গল্প সংখ্যা

দৃশ্যস্রোতের এপারে

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comবরাবর মাজহারউদ্দিন মাথা নিচু করে চলা পুরুষ। এখন মধ্যবয়সে পৌঁছেও সে মাথা আর উঁচু হলো না। আঠারোতে তার বাজান তাকে প্রথমবার শাদি করান এক অপরূপার সাথে। সে সংসার টেকেনি। সন্তান প্রসবের সময় সেই যে বউ বাপের বাড়ি গেল আর ফিরল না। স্ত্রী বিয়োগের ভার মাজহারউদ্দিনের মাথা নিচু করে দিল। যে গেল সে তো চলেই গেল। কিন্তু যাকে রেখে গেল তাকে মাজহারউদ্দিন দূরে রাখে কী করে! দু’ চার পা হাঁটতে শিখলে মেয়েকে নিয়ে এল নিজের কাছে। তখনও এ বাড়িটা বাজানের। মা জীবিত। মার কোলে কন্যাটিকে ফেলে মাজহার নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিল। কিন্তু তার বাজান তা বুঝলেন না। বছর তিন পরে বাজান দেখে-শুনে মাজহারের জন্য আবার একটা বউ আনলেন। এই বৌয়ের গায়ের রংটাই যা ফর্সা। কটা চোখ, দাঁত উঁচু এবং তা এতটাই উঁচু যে মুখ বন্ধ রাখলেও বন্ধ মুখ ঠেলে দাঁতদুটো বাইরে বেরিয়ে থাকে। মাজহারের ধারণা আবার যদি মাজহারের কপালে দুর্দশা লাগে সে ভেবেই বাজান হয়ত আর সুশ্রী মেয়ে খোঁজেন নি। অগত্যা ভাগ্যে যা মিলেছে তাই সই। কিন্তু কেবল কি দাঁতই উঁচু, তার মেজাজও প্রবল চড়া। বিয়ের রাতে মা যখন মা মরা মাজহারের মেয়েটাকে নতুন বউয়ের কাছে নিয়ে গেল তখনই সে এতটাই উচ্চস্বরে বিরক্তি প্রকাশ করেছিল যে মা মরা মেয়েটা ভয়ে কেঁদে ওঠে। ক্রমে তার চিৎকারে ঘর ছাড়িয়ে বাইরে চলে গেল। চিল চিৎকারে এক সময় দাওয়ায় পাখিদের কিচির মিচিরও বন্ধ হয়ে গেল। মেজাজ উঁচু তারে বাঁধা বলে শুরু থেকে দূরে দূরেই থাকত মাজহারউদ্দিন। তবু কী করে যেন এ ঘরেও পর পর আরও দুটি কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। শেষ সন্তানটির জন্মাবার পরই বউ ‘পোড়া মিনসের মুখে ঝামা ঘষে দিই’ বলে তাকে শোবার ঘর থেকে অন্য ঘরে ঠেলে দিল। সেই থেকে মাজহারউদ্দিন ভিন ঘরের এক প্রতিবেশি।

মাজহারউদ্দিনের বাড়িটা বেশ পুরনো ধাঁচে গড়া। চারপাশে টিনের ঘর। মাঝখানে উঠান। গ্রাম পঞ্চায়েত হবার আগ পর্যন্ত মাজহারউদ্দিনের বাজান ছোট এই মফস্বলে, এই বাড়িতেই বাস করতেন। নানা রকম ব্যবসা ছিল তার। এক নামে দশ গাঁয়ের লোক তাকে চিনত। গ্রাম পঞ্চায়েত হবার পর গ্রামে ফেরার আগে বাজান মাজহারকে বাজারে চালু একটা মনোহারি দোকান, একটা জুতার দোকান এবং সাথে একটি উঁচুদাঁতি বউ দিয়ে বুদ্ধির সাথে চালাতে বলে গেলেন। মাজহারও ঘাড় নিচু করে বাজানের কথায় সায় দিল কিন্তু  তার বুদ্ধি যে নিতান্তই কম সে কথা তার বাজানও জানতেন। বাজানের দেয়া কোনো কিছুই সে ঠিকমত চালাতে পারেনি। মনোহারি দোকানটা গেছে।মাজহার সু স্টোর, তার জুতার দোকান। সেটা কোনোরকম ধুঁকেধুঁকে চলে। সে টাকায় কন্যাদের পড়ালেখা, খাওয়া খরচ চালানো এই দিনে খুব কঠিন। ভাগ্য ভালো যে মাজহারের বউয়ের বাপেরবাড়ি থেকে বছরকার ধান আসে। ভাতের চিন্তাটা অত নেই। তাতে অবশ্য মাজহারের নিচু মুখ আরও নিচের দিকেই নামে। দিনে একবার বেরুবার মুখে সে মাথা গুঁজে দেয় ভাতের থালায়। রাতে ফিরে ফের পাকঘরে ঢুকে অবহেলায় বেড়ে রাখা ভাতের থালাটি মিটসেফ থেকে বের করে, পিঁড়ি পেতে  নীরবে খেয়ে নেয়। পাকঘরে বিদ্যুতের আলো নেই। কুপিই। খেতে বসলেই সেও সমানে ফ্যাঁতফোঁত শব্দ করে সাফ জানিয়ে দেয়, তাড়াতাড়ি সেঁটে নাও  বাপু! আমার জ্বালানি কমে এসেছে। সাদা মেনিটা অবশ্য ওর জন্য জেগেই থাকে। উচ্ছিষ্ট নয়, পাতের খাবার থেকেই ও ভাগ পায় রোজ। মাজহারের ভালোই লাগে। হোক বিড়াল, প্রাণ আছে, সঙ্গ দিচ্ছে, এটুকু ভাগ্যই ক’জনের হয়। খাওয়া শেষ হলে পিঁড়ি তুলে বাসন মেজে, বড় করে একটা ফোঁৎ শব্দ করে সলতে নিভিয়ে পাকঘরের দরজায় শিকল তুলে দেয়।তারপর উঠোনে বসে একটা বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে আকাশ দেখে। এই সময়টায় ওর মাথাটা অবশ্য সটান আসমান বরাবর থাকে।

মাজহারউদ্দিনের মেয়েগুলো গায়ে গতরে, পড়াশুনোয় বেড়েছে সব কটাই। বিয়ের যোগ্য হয়ে উঠেছে। বড়টার নাম স্নিগ্ধা। পরের দুজনের নাম রাধা, শিখা। শিখা আর রাধা কলেজের এগারো, বারো ক্লাসে।স্নিগ্ধা এইবারে বি এ ক্লাসে ভর্তি হবার কথা। গায়ের রঙটা যদিও চাপা তবু নাক চোখ একহারা গড়ন সব মিলিয়ে দেখতে শুনতে আকর্ষনীয়। কিন্তু বি, এ ক্লাসের চাইতে তার বিয়ে হওয়াযে আপাতত বেশি দরকার সে বুঝেই সে আর কলেজে ভর্তি হবার আবদার করেনি। বাড়িতেই থাকে। রাধা আর শিখা যত চঞ্চল, স্নিগ্ধা তা নয়। কথা বলে কম। সংসারে টানাটানি ব্যাপারটা বোঝে, ভয় পায় মায়ের চড়া মেজাজকে আর বাপটাকে ভালোবাসে। বাবার জন্য তার বড্ড মায়া হয়।কোনোদিন নতুন মা বাবাকে ভালোবেসে একটা শব্দ খরচ করল না। সারাক্ষণ কথার খোঁটা। কেবল কি বাবা, স্নিগ্ধাকেও কত কী শুনতে হয় যে… এই যে তাদের বাবা সেই সকালে বেরিয়ে যায় একেবারে রাত হলে ফেরে তা নিয়েও স্নিগ্ধার মা গজগজ করে।এত রাতে বাড়ি ফেরা মানে দ্যাখগে, মেয়েছেলে রেখেছে কোথায়, নয় জুয়ার আড্ডায় বসে পয়সা ওড়াচ্ছে। মেয়েছেলের কথা শুনলে রাধা, শিখা মুখ টিপে একে অন্যের চোখের দিকে তাকিয়ে হাসে। স্নিগ্ধার কান লাল হয়। বড্ড সাদাসিধা এই বাপকে নিয়ে এ ধরণের ইঙ্গিতে সে অপ্রতিভ হতে থাকে ।যেমন আজ সকালে মাথা নিচু করে যখন মাজহার খেতে বসল, মেয়েদুটো তখন কলেজে। কেবল মাজহার না স্নিগ্ধার কানের পাশ দিয়েও তখন ওই কথাগুলোই শিস কেটে গেল। স্নিগ্ধা হঠাৎ কোথা থেকে এসে বাপের পাতে এক টুকরো বাড়তি মাছ ফেলল ঝপ করে। বাপ চমকে তাকাতেই, ইশারায় চুপ করতে বলে আবার নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। মাজহারউদ্দিনের চোখটা আর্দ্র হলো। বিড়ালটা গা ঘেঁষে বসে আছে। মাছের টুকরো সে বিড়ালকে দিয়ে উঠে পড়ল। আঁচিয়ে উঠে বেরুবে বলে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে চোখে পড়ল রমজান এসেছে। বারান্দায় তাকে চেয়ার পেতে বসতে দিয়েছে স্নিগ্ধার মা আতরি। রমজানের সামনে একটা কাচের গ্লাসে লেবুপাতা ভাসানো সরবত। রোয়াকে চালতার আচার শুকাতে দিচ্ছে আতরি। আতরির রুক্ষ মুখটা আশ্চর্য রকমের টলটলে লাগছে। নিজেকে কিছুটা আড়াল করে মাজহার দোকানে যাবার জন্য তৈরি হতে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়। খুব গরম পড়েছে। ভাদ্দর মাসের গরম।

-বড্ড গরম পড়েছে গো ভাবি।

রমজান রুমাল বের করে মুখ মোছে। তোমার ঘরে গিয়া একটু বসি। উত্তরে স্নিগ্ধার মা আতরি কিছু বলে না। চালতার আচার গুলোকে উল্টেপাল্টে রোদ খাওয়ায়। উঠানে শুকাতে দেওয়া ধান বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে পা দিয়ে এপাশ ওপাশ করে। তারপর রমজানকে দেওয়া সরবতের গ্লাসটা তুলে কুয়াতলায় যায়। চৌবাচ্চায় পানি নাই। মেয়েগুলা যে যার মত পানি খরচ করে কলেজে চলে গেছে। থাকার মধ্যে স্নিগ্ধা। সে নবাবের বেটি তো নিজের ঘর ছেড়ে কুটোটাও আলাদা করতে চায় না। পোড়ার মিনসে গোসল করল অথচ পানি তুলল না। আপনমনে গজগজ করে। তারপর স্নিগ্ধাকে গলা তুলে ডাকতে থাকে। স্নিগ্ধা এসে দাঁড়ালে আতরি বলে, এই যে নবাবজাদি, রমজান ভাই দুপুরে খাবে। তুই ভাত ডাইল নামা চটপট। রাতা মোরগটা যে আনা হইছে সেইটা জবাই দিই। কুইটা-বাইছা নিবি আমি গোসল কইরা রান্দুম। স্নিগ্ধা যেমন এসেছিল তেমন চলে যায় ওর ঘরের দিকে। ফিরেও আসে চটজলদি। তারপর রান্নাঘরে ঢুকে হাতা কড়াই নিয়ে উনুন ধরাতে ব্যস্ত হয়।

আতরি একবার তার ঘরে ঢোকে। রমজান তার ফিনফিন সাদা পাঞ্জাবিটা আলনায় মেলে দিয়ে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে আছে। আতরির রোদ লাগা লালচে মুখটায় আরও একটু লালচে আভা পড়ে। লোকটা কী আহ্লাদে এই বাড়িটাকে যে নিজের বাড়ি বানিয়ে ফেলেছে। যখনই আসছে হাতে কিছু না কিছু নিয়ে আসছে। এই টিমটিমে আলোর শহরে রমজান এক বড় ব্যবসায়ী। রাইস মিল থেকে শুরু করে হেন ব্যবসা নাই যা তার নাই। কিন্তু কথায় বলে না, মানুষেরে সব দিলেও ইচ্ছা করেই একটু কম রাখে আল্লাহ। তারও তাই। বয়স মাজহারউদ্দিনের মত না হলেও কাছাকাছিই হয়ত। ছোটবেলাতেই বাপ মা হারিয়ে একা একা এতটা পথ এসেছে। অত লড়াই করতে করতে হয়ত বিয়েটাই আর করা হয়নি তার। পড়ালেখা খুব নেই, কিন্তু অর্থ আছে। এই ছোট এলাকায় তার নাম ডাক আছে। মানী মানুষটার জন্য তার কেমন মায়া হয়ে গেছে।তাদের মতো গরিবের ঘরে এই যে লোকটা এখন বিশ্রাম নিচ্ছে, তা আতরির খুব ভালো লাগে। ইচ্ছা করে কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। একবার সে নিচু গলায় ডাকে রমজান ভাই। রমজান উত্তর দেয় না। মাথার ওপর ফ্যানটা ঘটাং ঘটাং করে ঘুরতে থাকে। বাইরে গনগন করছে রোদ। আতরি দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে ফিরে আসে। উঠোনে মোরগটাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। স্নিগ্ধাকে বটি আনতে বলে সে আর স্নিগ্ধা মিলে মোরগটা জবাই দেয়। শরীর লেগে থাকা ছিন্ন ধড় নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে কাটা মোরগটা ছটফট করে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে সহসা নীরব হয়ে যায়। স্নিগ্ধা বটি নিয়ে কুয়া তলায় বসে একমনে মোরগ কাটে। কুয়া তলার পাশে মানকচুর ঝোপ। বড়সড় দেখে একটা পুষ্টকচু তুলে এনে আতরিও বটি নিয়ে বসে। মালাবড়া বানাবে। কচু লম্বালম্বি ভাবে কেটে মাছের পেটির মত পিস করে তার দু ধারে ঝিরঝির করে কাটে আতরি। তারপর নুনমেশানো পানিতে চুবিয়ে রাখে। কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রেখে চিপে তুলে কায়দা করে টান দিলেই দৈর্ঘ্যে কচু আরও দীঘল হয়ে উঠবে। মোরগটাকে কেটেবেছে ধুয়ে দিয়েছে স্নিগ্ধা। আতরি গোসল সেরে রাঁধতে চেয়েছিল এখন মত বদলেছে। রান্নাটাই মন দিয়ে করে। যদিও আগুনের শিখা আজ ভেতর বাহির দুদিক থেকেই প্রকাণ্ড হয়ে আতরিকে জড়িয়ে ফেলতে চায়। সে আগুন সামলে সে নামিয়ে ফেলে মোরগের গাঢ় লাল ঝোল। মানকচুর মালা বড়া গুলো চালের গোলায় ডুবিয়ে সোনালি করে ভেজে তোলে। বড়াগুলো দেখতে দেখতে রুই মাছের লালচে ভাজা পেটি হয়ে ওঠে। রান্না শেষে উনুনে পড়ে দুধের কড়াই। ভালো করে জ্বাল করে সেই দুধে ফেনা তুলে তুলে নিভু উনুনের ওপর রেখে রান্নাঘরের জানলা বন্ধ করে দরজায় শিকল তোলে আতরি। মেনিটার লোভের তো শেষ নেই।

ভিজে, শাড়ি তারে মেলতে মেলতে আতরির কানে ভেসে আসে রেডিওর বাজনা। রমজান ভাইয়ের ঘুম ভাঙল। ঝটপট এলুমুনিয়ামের জগে পানি ভরে ও। পাটি পাতে নিজের শোবার ঘরের মেঝেতে। তারপর খেতে দেয়। রমজান খেতে বসে। তোমার হাতের রান্নার খুব সোয়াদ গো ভাবি। এই বাড়ির পাতের লোভ ছাড়া বড্ড কঠিন তাই। পরক্ষণেই বলে, কিন্তু এই যে মাঝে-মইধ্যেই পাত পাড়ি এইখানে তুমি কি বিরক্ত হও ভাবি? মুখ ঠেলে বেরিয়ে থাকা দাঁতদুটো যথাসম্ভব আড়াল করতে করতে আতরি হাসে। মুখে বলে, খুব বিরক্ত। ঘরে এইবার বউ আনলেই তো পারেন। তারপর দু’হাতা ভাত ফেলে প্লেটে। নুন এগিয়ে দেয়। এক টুকরো গন্ধরাজ লেবু। রমজান খেতে বসে নানা রকমের গল্প, নির্দোষ রসিকতা করে। রসিক মানুষটাকে আতরির ভালো লাগে। রমজানের খাওয়া হলে আতরি প্লেট গ্লাস তুলে এগিয়ে দেয় দুধের বাটি। দুধের ওপর পুরু হলদেটে সর ভেসে আছে।

খেয়ে উঠে রমজান ফের আতরির বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। আতরি, মেয়েকে নিয়ে খেয়েদেয়ে কাজ গুছিয়ে নেয়। স্নিগ্ধা নিজের ঘরে ঢুকে গেলে আতরি রমজানের জন্য পান সাজে। তারপর কাছে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে। রমজান আধশোয়া হয়, প্লেট থেকে পান তুলে নিয়ে বলে, আরে অত দূরে বসলা যে আতরি ভাবি? এইখানে আসো। জায়গা আছে তো। আমরা এখন এক নাওয়ের যাত্রী। আসো এইখানে বইসা গল্প কর। আতরির বুক ঢিপঢিপ করে। তাদের এই বাড়িতে রমজানের আসা যাওয়া অনেক দিনের। কিন্তু কোনোদিন তো রমজান তাকে এভাবে আহবান করে নাই। আতরি মনে মনে কতদিন চেয়েছে। প্রশ্রয়ও দিয়েছে। এতদিন পর রমজান তাহলে..

-কী হইল আসো তো!

রমজানের ডাক স্বত্তেও আতরি ঝিম মেরে বসে থাকে। যদিও আতরি ঠিক করেছে আজ, সে রমজানের কাছে নিজেকে খুলে দেবে তবু আতরি এ ডাকের পরও ঠিক ততটা সাহস করে উঠতে পারে না। স্নিগ্ধার দুপুরের ভাতঘুম পছন্দ। আরও একটু সময় যাক।

মাজহারের শরীরটা কেন জানি আজ ঠিক লাগে না। দুপুরের ভাপ ওঠা মারা গরমে মাজহার বাজারের ইতিউতি ঘোরে। আজ মনটা কেবল বাড়ির দিকে যেতে চায়। কিন্তু সে তো বাড়ি যাবে না। রমজানকে দেখে আসার পর থেকেই তার আর কিছুই ভালো লাগছে না। ওর বাড়িতে রমজানের আসা যাওয়া নতুন নয়। তবে আজকাল তো আর রমজার তার কাছে আসে না। এমন সময় আসে যখন মাজহার বাড়ি থাকে না। দু চারজন আড়ালে আবডালে এ নিয়ে কথাও বলে। আর মেয়েটাও বড় হয়ে উঠেছে। এভাবে রমজানের যখন-তখন তার বাড়ি চলে যাওয়া মাজহারের পছন্দ হচ্ছে না কিন্তু সে কথা সে বলবে কাকে? হঠাৎ মাজহারের কেমন অসহায় লাগতে শুরু করে। সেটা কমাতে সে মন দেয় অন্য কাজে। এক গাছিকে ডেকে দোকানের সামনে বেড়ে ওঠা নারকেল গাছ থেকে কচি ডাব, ঝুনো নারকেল পাড়ে। গাছিকে দিয়ে গাছটা পরিষ্কার করিয়ে নেয়। গরমে সারা গায়ে বিজবিজ করে ঘাম। ডাবের স্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে তার মনে হঠাৎ প্রশ্ন জাগে, আচ্ছা কচি ডাবের শ্বাস না কি পরিপূর্ণ নারকেলের স্বাদ কোনটা তার প্রিয়। মনে করতে পারে না। প্রিয় বলে কোনো কিছুই হয়ত তার তালিকায় নেই। আজ কেন যেন খিদে পাচ্ছে। রুটি বিস্কুটের দোকান থেকে সে একটা বাটার বন নেয়, সাথে একটা চা। দুপুরে খিদে পেলে এটুকুই তার আহার।বনটায় একটা কামড় দেবার পর খাবার ইচ্ছে চলে যায়। গরমে ধুঁকতে থাকা কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকা কুকুরটির দিকে সে বন ছুড়ে দিয়ে। তারপর মাজহার সু-স্টোরের সামনে ডাবের স্তুপের ওপর বসে থাকে। খদ্দের এই সময় কখনই আসে না। কাজেই বেচাকেনার ব্যাপার নেই। কর্মচারি রতন ক্যাশবাক্সের পাশে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। রোজই ঘুমায়। আজ কেন যেন ঘুমন্ত রতনের পাছায় একটা কষে লাথি মারতে ইচ্ছে করে ওর। ইচ্ছে করে মাজহার সু-স্টোরে আগুন ধরিয়ে দিতে। দাউদাউ আগুন জ্বলবে ও দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে। বস্তুত মনের এইসব অস্থির ভাবনা গাছি সামনে এসে দাঁড়াবার পর কমেও যায়। ক্যাশবাক্স খুলে গাছিকে তার পারিশ্রমিক দেয়। সাথে গোটা পাঁচেক ডাব। দুটো ঝুনো নারকেল। রতনকে ডেকে তুলে ডাবগুলো দোকানঘরে তুলতে বলে। তারপর আবার চুপ হয়ে যায়।

ঠিক তখনই হন্তদন্ত হয়ে স্নিগ্ধা আসে। অবিন্যস্ত চুল। বাড়ির জামা পরেই দোকানে এসেছে। মাজহার তার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা গোলমাল টের পায়। তবে কি সে যে আশঙ্কা করছে সেরকমই কিছু.. মাজহার তাকে প্রশ্ন করতে সাহস করে না। মেয়েও কিছু বলছে না। কেবল ঠোঁট কামড়ে, মাথা নিচু করে ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা অকারণ চটিতে ঘসছে। মাজহার কেবল একবার বলে, স্নিগ্ধা? স্নিগ্ধা মুখ তোলে না। মুখ নিচু করে যেমন এসেছিল তেমন আবার ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যায়।

একটা গুমোট অস্বস্তির মধ্যে মাজহার তার ক্যাশবাক্সের সামনে মাথা নিচু করে বসে থাকে। ধীরে ধীরে দুপুরের তীব্র ঝাঁঝ কমে আসে। প্রসন্ন বিকেল নামে। স্কুল, কলেজের কলকল করতে থাকা ছেলেমেয়েরা তার দোকানের সামনে দিয়ে বাড়ির ফেরে। অন্য দিনগুলোতে এই সময়টা তার খুব ভালো লাগে। আজ অপ্রসন্নতার ভারে মুখের ভেতরটা কেমন তেঁতো হয়ে আসে। মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে পড়তে চায়। অনভিপ্রেত কিছুর মুখোমুখি হতে সে ভয় পায় বরাবর… আজ কেবল তা নয়, কেউ যেন তার শিকড় ধরে টান মেরেছে। এক প্রবল বোবা যন্ত্রণায়সে ভেতর ভেতর ছটফট করত থাকে। বিকেল গড়ায় চাকার মতো। দোকানে একজন দুজন করে খরিদ্দার আসে। রতন সামলায়। সে কেবল যন্ত্রচালিতর মত ক্যাশবাক্সে টাকা রাখে অথবা খুচরো টাকা খরিদ্দারের হাতে তুলে দেয়। দু’একজন পরিচিত আড্ডাবাজ আসতে যেতে ঢুঁ মারে ওর দোকানে। আজ তাদের দেখে সে নিজেকে আড়াল করতে চায়।

পুরো বাড়িটা আজ এক প্রবল নীরবতায় ভর করে একলা ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। উঠোনে বড় বড় গাছগুলোর ডালপালা ছড়ানো দীর্ঘ ছায়া পড়েছে। উঠানের ধান, রোয়াকে শুকাতে দেয়া চালতার আচার, দুপুরে শুকাতে দেওয়া শাড়ি যে যার মত একলা পড়ে আছে। মেনিটার ছায়াও কোথাও নেই। পাকঘরের দরজায় শিকল তোলা। রাতের রান্না হয়নি। আতরির ঘরে আলো জ্বলেনি। স্নিগ্ধার ঘরও অন্ধকার। কেবল কলেজ থেকে মেয়ে দুটো ফিরে স্বভাব চঞ্চলতায় কলকল করে, পরে বাড়ির থমথমে আবহাওয়া টের পেয়েই হয়ত সময়ের আগেই আজ যে যার মত পড়তে বসেছে।

আতরি ঘর ছেড়ে রোয়াকে এসে বসে। একটু একটু হাওয়া ছেড়েছে। গরম ভাবটা তত নেই।  স্নিগ্ধার ঘরের দিকে তাকিয়ে আতরির হঠাৎ হাহাকার জাগে। সেই কবে বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে এসেছিল সে। বাপ মরা সংসারে দাঁত উঁচু মেয়েটাকে যেনতেন উপায়ে পার করতে মা যেন একপায়ে দাঁড়িয়ে তখন। মাজহার নামের দোজবরের সাথে বিয়ের প্রস্তাব আসার সাথে সাথেই মা তা লুয়ে নেয়। আতরি প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু পেরে ওঠেনি। তাই বিয়ে মেনে নিলেও মাজহারকে আতরি মন থেকে কখনই মানতে পারে নি। কেমন ঘাড় ঝুলে পড়া মিনমিনে এক পুরুষ। তার ওপর মরা সতীনের ছায়া ওই স্নিগ্ধা। অন্যের ফেলে যাওয়া সংসার সে কখনও করতে চায় নি। মা কেন হাত পা বেঁধে তাকে এভাবে দোজবরের কাছে তুলে দিল। তিরিক্ষি স্বভাব দিনে দিনে আরও বেড়েছে। স্নিগ্ধার ওপর অতটা নয়, যতটা রাগ গিয়ে আছড়ে পড়েছে বারবার স্নিগ্ধার বাপের ওপর, তাতে কতদিন সে মাজহারের শরীর আঁচড়ে দিয়েছে তার হিসেব নেই। প্রবল অসূয়ার মাঝেও হঠাৎ বৃষ্টির মত মনের মধ্যে কী করে যেন জন্য ঢুকে পড়েছিল রমজান। রমজানকে সে যখন যত্ন করে খেতে দিত তখন মনের ভেতর উপচে পড়ত ভালোবাসা। আজ দুপুরেই তো তাকে যথাসাধ্য আপ্যায়ন সে করেছিল। পাশে বসে হাওয়া করতে করতে এগিয়ে দিয়েছিল দুধের বাটি। নিজেই আজ এগিয়ে যাবে বলে স্থির করেছিল।

রমজানও তাকে কাছে গিয়েই বসতে বলেছিল। আতরি যায়নি।

রমজানই তখন বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। এক পা দু পা করে আতরির দিকে এগিয়ে আসছে। যত কাছে আসছে ততই আতরির বুকের ভেতরটা হাপরের মত ওঠা নামা করছে। আগুন জ্বলছে যেন ভেতরে। কন্ঠনালী শুকিয়ে খরখরে। রমজান কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসল। আতরির দুটো হাত নিজের হাতে নিয়ে খুব নরম করে বলল, আতরি ভাবি। আজ তোমার কাছে একটা জিনিস যদি চাই, দিবা?

আতরির সারা শরীর জুড়ে তখন প্রবল রিমঝিম। সে রিমঝিমের ভেতর দিয়েই রমজান আরও একটু কাছে এসেছে। মুখটা দু’হাতে ধরে ফের বলেছে,

-কথা দাও। কও ফিরাবা না আমারে?

বহু দূর থেকে আতরির কথা ভেসে আসে।

-কী রমজান ভাই? কী চাও?

-কথা দ্যাও আতরি তোমার কসম লাগে…

-তোমারে ফিরাবার সাধ্যি আমার নাই রমজান ভাই…

দূরে কোথাও এই প্রবল রোদেও বজ্রপাত ঘটে গেল যেন। সে শব্দে আতরি ঠিকঠাক শুনতে পেল কি না বুঝতে না পেরে চোখে মেলে রমজানের চোখের দিকে তাকালো। রমজান আবারও তাকে ওই কথাগুলোই বলল

-আমারে ফিরাবা না কথা দিছো তুমি আজন্ম ঋণী থাকব তোমাদের কাছে। তোমাদের কোনো অভাব আমি রাখব না..তোমাগো স্নিগ্ধারে আমার হাতে তুইলা দাও ভাবি।

আরও কী কী বলছিল রমজান, আতরি শুনতে পায়নি। সর্বাঙ্গে বিছুটির জ্বালা তখন। চোখদুটো জ্বলছে। এক ঝটকায় সে রমজানের হাত দুটো সরিয়ে তীব্র চোখে তাকিয়ে বলে, এ্যাততো লোভ? থুতু দেই তোমারে আমি…

তারপর স্নিগ্ধাকে ভাতঘুম থেকে হ্যাঁচকা টানে তুলে নেয়। ওর চুল ধরে টানতে টানতে নিয়ে যায় রমজানের সামনে। বলে, তলে তলে এ্যাতকিছু? পুরুষ ভুলানি কবে শিখলি এত? নে এহন মন ভইরা নে… বলেই ও হনহন করে বেরিয়ে এসেছিল বাইরে। সারা শরীর রাগে ঝমঝম করছে। রোয়াকে বসেই দেখেছিল স্নিগ্ধা বেরিয়ে যাচ্ছে। রমজান কখন চলে গেছে আতরি আর জানে না।

অবসন্ন শরীরটাকে টেনে তোলে আতরি। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে উঠানের মিটমিটে আলোটা জ্বালিয়ে দেয়। তারপর স্খলিত পায়ে স্নিগ্ধার ঘরের দিকে যায়। এখন কেন যেন আর স্নিগ্ধার ওপর তার রাগ হয় না। নিজের প্রতিও না। কোথাও গিয়ে যে দুজনেই পরাজিত সে বোধটিই তাকে স্নিগ্ধার ঘরের দিকে নিয়ে যায়। দরজা ঠেলতেই দরজা খুলে যায়। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। হাতড়ে হাতড়ে ও স্নিগ্ধার টেবিল পর্যন্ত আসে। ঘরে কেবল স্নিগ্ধা একা নয়। চেয়ারে নিঃশব্দে বসে আছে কেউ। কে!

চোখ ততক্ষণে অন্ধকার সয়ে নিয়েছে। চেয়ারে বসে আছে মাজহারউদ্দিন। বিছানায় বসে স্নিগ্ধা। আতরি ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই মাজহারউদ্দিন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর ধীরপায়ে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যায়।

আতরি স্নিগ্ধার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। এই প্রথম সে স্নিগ্ধার মাথায় হাত রাখে। দু’জন শব্দহীন আর্ত নারীর চোখ বেয়ে নোনা নামছে।

বাইরে এখন আর হাওয়া নেই। গুমোট গরম।

উঠানের মাঝখানটায় মাজহারউদ্দিন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত