| 5 ফেব্রুয়ারি 2025
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতী গল্প: অ-সুখের স্বরলিপি । সরিতা আহমেদ

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

                      

অন্ধকার ঘরে চুপচাপ শুয়ে আছে সুজাতা। ফুরফুরে হাওয়ায় কমলা-বাদামী রঙের চেক ছাপ পর্দাটা দুলছে। ভর সন্ধেবেলা এমন হাওয়ায় একসময় বাইরে হাঁটতে বেরোত সে। কিন্তু মাইগ্রেনে কাবু হওয়ার পর থেকে সেসব অভ্যাস এখন অতীত। সকাল থেকে আবার ব্যাথাটা চাগাড় দিয়েছে। আগে শুনেছিল বয়স বাড়লে নাকি কমতে থাকে এই ব্যামো, কিন্তু বাস্তবে তার হচ্ছে উল্টোটাই। এপাশ ওপাশ করেও কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছে না সে। বিশেষত এখন ওঘরে রেকর্ড প্লেয়ারের গানটা শুনে কপালের দুপাশের রগ যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে যেন। কতবার অতীনকে বারণ করেছে সে, কিন্তু না, ফিরে ফিরে সেই বদখত গানটাই চালায় অতীন।

গানটা যে এত যুগ ধরে এমন হিটের তালিকায় ঝুলে থাকবে তা কেই বা জানত । গানটা  কোনোদিন কলকাতার আড্ডায় শোনা হয় নি তার। যেদিন দিল্লীতে প্রথম সেটি রেডিওতে শুনেছিল চমকে উঠেছিল। “সুজাতাই আজ শুধু সবচেয়ে সুখে আছে…”

সবচেয়ে সুখে!

সবচেয়ে সুখে থাকা কাকে বলে তা জানে ওরা! অবশ্য হ্যাঁ, দামি গাড়ি ,বড় বাড়ি, রইস বর ইত্যাদিই যাদের কাছে সুখের মাপকাঠি তাদের চোখে তো এরকম বিলাসবহুল জীবনই সুখের শেষকথা! একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস চেপে পাশ ফিরে শুল সুজাতা ।তার সম্পর্কে এত হীন ধারণা ছিল রচয়িতার! অথচ এঁদেরই সে কত কাছের বলে জানত। সেই সোনালী অতীতের আড্ডার কথা মনে পড়লে বুকের ভেতরখানা মোচড় দিয়ে ওঠে আজও। মানুষগুলো কী অসাধারণ প্রতিভাশালী ছিল, খ্যাতিও স্পর্শ করেছিল অনেককে, তবু একফোঁটাও অংহকার তাদের বন্ধুত্বকে গ্রাস করতে পারেনি। গ্রুপের সবচেয়ে কনিষ্ঠা সদস্যা সুজাতা কফিতে চুমুক দিয়ে চুপচাপ শুনে যেত ওঁদের ভারিক্কি সব আলোচনা। সেই মেয়েই যখন হুট করে সবার আগে বিয়ের পিঁড়িতে বসল, বেশ অবাক হয়েছিল  সকলেই।

সুজাতার বিয়ের প্রথম জন্মদিনে একরকম জোর করেই তাদের দু’জনকে পুরোনো আড্ডায় ধরে নিয়ে গিয়েছিল নিখিলেশ। অতীন হাজির হয়েছিল নতুন বরের বেশে-পাটভাঙা পোশাকে। কলেজ স্ট্রিট ততদিনে বেশ জমাটি হয়ে উঠেছে। ভিড়ও বেড়েছে আগের চেয়ে। সব্বাই টেরিয়ে টেরিয়ে মালকোঁচা মারা চকচকে ধুতি-পাঞ্জাবীর অতীনকে দেখছিল। হাতে ময়ূরমুখো ছড়ি বাগিয়ে কী দেমাকি হাঁটাচলা তার, বৈভব যেন চুঁইয়ে পড়ছিল তার গোটা শরীর বেয়ে।

-“এ রিক্সা, ঠিক সে সাফা করো।” -হেঁকে সীট সহ পাদানি অবধি কাপড় দিয়ে মুছতে বাধ্য করেছিল বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালাকে, পাছে তার দামী পোশাকে কণামাত্রও নোংরা হয়ে যায়! ছয়জন বন্ধুর সামনে অপ্রস্তুত সুজাতার তখন সে কী লজ্জা! সেই স্মৃতি থেকেই কি এই গানে সুজাতার অমন বর্ননা দেওয়া হয়েছিল! এই বরফ শীতল প্রবাস জীবনে যখন অতীন এই গান মাঝেমধ্যে চালায়, তখন কোনও নস্টালজিয়ার উষ্ণতা নয়, সুজাতার বুকের ভেতরে কুলকুল করে বয়ে চলে কান্নাস্রোত ।

কলকাতা থেকে ফিরে আসার পর থেকেই প্রতিপদে অতীন তাকে বুঝিয়েছে অমন মধ্যবিত্ত ঠুকরে ঠুকরে বেঁচে থাকা বাঙালি যুবা দলের মাঝে সুজাতা কতখানি বেমানান। বিদেশমন্ত্রকের সরকারি গুরুত্বপূর্ণ কাজে তার স্বামীর কত বড়বড় পদাধিকারী মানুষের সাথে ওঠাবসা। বাপের বাড়ির ‘গাঁইয়া’ শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে শাশুড়ি মায়ের অবিরত খোঁটায় প্রথম প্রথম আঘাত পেলেও পরে সুজাতাও মানতে বাধ্য হয়েছে , অতীনের এলেম আছে বৈ কি! বয়সে-অভিজ্ঞতায় তার চেয়ে অনেক সিনিয়রদের পেছনে ফেলে মোটা প্রমোশান বাগিয়ে বয়স চল্লিশের গণ্ডি পেরোবার আগেই অতীন বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পায়, তাও আবার সরকারি বিমান টিকিটে!

“বাবা, অত ছোট প্লেনের ভেতর কি মানুষকে হাত পা মুড়ে ঢুকিয়ে রাখে?” ক্লাস ফোরের সুজাতার প্রশ্নে খাওয়ার টেবিলের সবাই হেসে উঠেছিল। অনেক পরে যখন সিনেমায় দেখল প্লেনের ভেতরের ছবি তখন ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়েছিল তার কাছে।

কী সুন্দর সব পোশাক! কী স্মার্ট তাদের কথাবার্তা, আদব কায়দা! বাবা বলেছিলেন ইউনিফর্ম পরা ওই সুন্দরীদের এয়ারহোস্টেস বলে। আহ, এত মিষ্টি লেগেছিল শব্দটা যে, বরাবর ‘ইয়র এইম ইন লাইফ’ রচনায় ডাক্তার, শিক্ষিকা, অথবা গানের দিদিমনি হতে চাওয়া সুজাতা ঠিক করেছিল এসব বাঁধা গতের জীবন না, বড় হয়ে সে আকাশে ওড়ার জীবন বেছে নেবে।

কলেজে উঠে প্রথমবার সে তার এই স্বপ্নের কথা জানিয়েছিল কাছের বান্ধবী বিমলাকে। সে মেয়ে বেণি বাঁধা থামিয়ে ডাগর ডাগর চোখ মেলে বলেছিল “ওম্মা! এ আবার কেমন ধারা চাকরি সুজু! তুই ঘরবাড়ি ছেড়ে ওভাবে একা একা যেখানে সেখানে থাকবি! লোকে কী বলবে? ঠাকুমা বলেছেন মেয়েমানুষের বেশী উঁচু নজর থাকা ভাল না।”

ভারি মনে সুজাতা বাড়ি ফিরে এসেছিল। হ্যান্ডব্যাগে রয়ে গেছিল একটা লিফলেট যাতে ছিল সেই ইচ্ছে ডানা মেলার আহ্বান-এয়ারহস্টেস ট্রেনিং-এর বিজ্ঞাপন। তখন দু’একটা সংস্থাই মেয়েদের জন্য এমন উদ্যোগ নিচ্ছে। বিদেশিনীরাই নয়, দেশের অনেক মেয়েরাই ততদিনে এগিয়ে এসেছে এমন ছকভাঙা পেশায়। একটু একটু করে দেশ এগোচ্ছে প্রগতির পথে, মেয়েদের সামনে শ্লথ গতিতে হলেও উন্মুক্ত হচ্ছে অর্ধেক আকাশ ছোঁয়ার স্পষ্ট ছায়াপথ। কিন্তু কফি হাউজের বন্ধুদের সেসব কথা জানানোর সাহস পায় নি সুজাতা। ‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল’ –প্রবাদটা মনে পড়েছিল বলেই কি!

সেটা সত্তরের দশকের শেষের দিক। রাজ্য-রাজনীতির পালা বদলের সাথে বাঙালির সাংস্কৃতিক জগতেও আমূল বদল ঘটেছে। সেবার তালতলা উৎসবে সুজাতার সাথে প্রথম দেখা হল রমার। এক নাটকের দলে শকুন্তলার পার্ট করা রমা রায় যেন আলাদা করেই নজর কেড়ে নিয়েছিল সুজাতার। কী অদ্ভুত কণ্ঠস্বর মেয়েটির! কী নির্ভিক স্পষ্ট বাচনভঙ্গী! নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কে শকুন্তলা ওরফে রমার মাইক কাঁপানো দৃপ্ত সংলাপে রাজা দুষ্মন্ত যেন দৃশ্যতই ঝিমিয়ে পড়েছিল। দর্শকাসন থেকে মূহুর্মুহু সিটি আর হাততালিতে ফেটে পড়েছিল মেলা চত্বর। ফেরার পথে বাসস্টপেই আলাপ হয়েছিল রমার সাথে। ঘণ্টা দেড়েকের বাস যাত্রায় টুকরো আলাপেই বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল তাদের। তারপর তো নিখিলেশ একদিন হঠাতই রমাকে হাজির করালো তাদের আড্ডায় – তুতো বোন হিসেবে। মহিলা হিসেবে দলে এতদিন সংখ্যালঘু থাকা সুজাতা রমার মত এমন মিশুকে এবং অত্যন্ত প্রতিভাময়ী বন্ধু পেয়ে তো হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।

মোবাইলটা জ্বেলে একবার সময় দেখে নিল সুজাতা। রাত ন’টা দশ।  খোলা দরজা দিয়ে গানের ভলিয়্যুমটা খানিকটা চড়া স্বরেই তার কানে এল। ভ্রূ কুঁচকে চোখ খুলতেই দেখল দুম করে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকেছে ছেলে। গানের সুরে বিরক্তির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল মাথার যন্ত্রণা। ঘরে ঢুকেই ছেলের চিৎকার  “মোবাইলের চার্জারটা কোথায় রেখেছ মা? কতবার বলি আমার ঘর গুছাবে না। এত গুছিয়ে গুপ্তধনের মত জিনিস রাখার মানে কী!”

অতীনও এল তার খানিক বাদেই – “একি এখনও বিছানায়! সকালে বলেছিলাম না আজ বনফায়ার করব! দুর্দান্ত ম্যাচটা জমে যেত তাহলে। কিন্তু কিছুই তো রেডি করোনি দেখছি। রাত হতে চলল… ধুস! তুমি কি আজ শুয়েই থাকবে নাকি?”

“হ্যাঁ এই তো” বলে কাটিয়ে দেবে ভাবল, কিন্তু ওদের তিক্ত স্বরের উত্তরে ঝাঁঝাল স্বরে বলল, “খেলা দেখছ!তাহলে ওঘরে গানটা শুনছে কে? বন্ধ করতে পারছ না!”

কারোর কানে যায় না ওর কথা। দরজাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেছিল। এবাড়ির কারোর কি সময় আছে নাকি তার কথা, প্রশ্ন ,জবাব এসব শোনার! সে তো কেবল হুকুমের চাকরানি। বাপ-বেটার তাকে ছাড়া চলে না। হাতের কাছে, মুখের কাছে সব কিছুর যোগান না দিলে তাদের মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে ওঠে। এটা অবশ্য অনেক মেয়েকে ‘সুখ’ দেয়, সংসারে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আলাদা গর্ব দেয় ভালবাসার আলাদা মাত্রা যোগ হয় বলেও নাকি এসবে অনেকে ‘সুখি’– কিন্তু সুজাতার মত মেয়েরা যারা শিক্ষা, সম্মান, আত্মমর্যাদা এসবকে ভালবাসার উপরে রাখতে চায়, তাদের কাছে!

একটু বাদেই অতীন ডিনারের জন্য হাঁকডাক করবে। আজীবন দাসদাসী নিয়ে চলা অভ্যেসটা এই স্বাবলম্বী আবহাওয়ার মার্কিন মুলুকেও বদলাতে পারে নি অতীন। বিয়ের প্রথম বছরটুকু বাদ দিলে, সুজাতার মনে পড়ে না, এমন কোনো দিন যায় নি যখন পান থেকে সামান্য চুন খসলেই অতীনের গোঁসা হয় নি।

“দিল্লীতে এরকম সুতির শাড়ি কেউ পরে, সুজু! তোমাকে কতবার বলেছি সিল্ক পর, লাস্ট অ্যানিভার্সারিতে যে শার্টিনের নাইট ড্রেস এনে দিলাম– এখনও ছুঁয়ে দেখনি! সেই আদ্যিকালের গাঁইয়া বউদের মত সুতির জ্যালজ্যালে শাড়ি।“

-কিন্তু আমি তো বরাবর সুতিই পরি। সিল্কের চেয়ে সুতি তো বেশী আরামের।

“কাম’অন, এসব বস্তাপচা এক্সকিউজ দেখিও না। সেদিনের পার্টিতে মিসেস বোসকে দেখেছিলে, কী ওয়ান্ডারফুল ড্রেস কালেকশান! কত গ্রেসফুল লাগছিল ওনাকে! আর সেখানে তুমি তাঁতের শাড়িতে! উফ আমারই লজ্জা হচ্ছিল।”

হ্যাঁ, এতগুলো বিবাহিত বছর পেরিয়ে এসে, মধ্যবিত্তের আটপৌরে সংসারে বড় হওয়া সুজাতার অনেক কিছুকেই ‘গাঁইয়া আদব’ বলে খোঁটা দিতে দিতে হয়ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছে অতীন। কিন্তু সেদিনের পার্টির কথা সুজাতা ভোলেনি, না তার পোশাকের জন্য না। অতীনকে নতুনভাবে চেনার জন্য। সাহেবি পার্টিতে ড্রিংক সার্ভ করতে বলা হয়েছিল তাকে। এমন বড়লোকি আদবে অনভ্যস্ত সুজাতার হাত কেঁপে গ্লাস উলটে এক বিশ্রী অবস্থা, যাকে বাংলায় বলে ‘সিন ক্রিয়েট’, তৈরি হতেই বোধহয় জ্ঞান হারিয়েছিল অতীন। একঘর লোকের সামনে সেই প্রথমবার তার দেড় বছরের বিবাহিত স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছিল সে। নিজের বিবাহিত ‘গাঁইয়া’ বাঙালি বৌকে নিয়ে সে এতই বিব্রত ছিল যে, তারপর অবশ্য কতশত বার যে এমন ‘সিন ক্রিয়েট’ হল– সুজাতা হিসেব রাখে নি। এসব অঙ্ক কষা পোষায় না তার।

বিদেশে এসে সে জেনেছে, গোটা মেয়েবেলা জুড়ে বড়দের শেখানো স্বামীর এধরণের ‘স্বাভাবিক’ আচরণকে আদপে ‘গার্হস্থ্য হিংসা’ বলে। তার জন্য কড়া সাজার ব্যবস্থা আছে পাশ্চাত্য সমাজে ।হয়ত সেই কারণেই এখানে এসে কিছুটা সংযত হয়েছে তার স্বামী। বয়সের ভারে হোক অথবা নির্লিপ্ত ক্লান্তিতেই সুজাতার সাথে অতীনের সম্পর্কটা এখন নিতান্তই কেজো হয়ে দাঁড়িয়েছে। পেল্লাই বাড়ি, খান তিনেক বিলাসী গাড়ি আর নানা ছুতোয় দেওয়া গয়নার বাইরে অন্যকোনো সম্পর্ক পাতানোর জায়গা নেই আর।

আমেরিকা আসার বছর খানেক বাদে নিখিলেশের কাছ থেকেই খবর পেয়েছিল সে, কলকাতার বড় বড় ব্যক্তিত্বের মাঝে মধ্যমণি হয়ে মান্না যেদিন প্রথম গেয়েছিল সেই ইতিহাস সৃষ্টিকারী গানটি, আশেপাশের সবক’টা টেবিলে ছিল পিনপতন নিস্তব্ধতা –মুগ্ধ বিস্ময়ে সকলে ধন্য ধন্য করে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিল।

গানটা যে সত্যই প্রশংসাযোগ্য তা সুজাতা বিলক্ষণ জানে, কিন্তু সুজাতাকে বিন্দুমাত্র না চিনে তার ব্যাপারে কীভাবে এতটা চড়া দাগের শব্দবন্ধ লিখতে পারলেন রচয়িতা এটা তার মাথায় আজও ঢোকে নি! প্রথমবার গানটি শুনে বেশ আহত স্বরেই নিখিলেশের কাছে সে অনুযোগ করেছিল, গানের লাইনগুলোর বিষয়ে রচয়িতার সাথে সে কথা বলতে চায় ।এবার কলকাতা গেলে একবার যেন সুজাতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু মেয়েদের এসব আবদার কেউ কি মনে রাখে! অতীনের যদিও এমন মধ্যবিত্ত নস্টালজিয়া একেবারেই না পছন্দ, তবু এই গানখানা তার ভাল লাগে ।

‘কেন লাগে?’- প্রশ্নটির উত্তরে সরু চোখের চাহনী দিয়ে অতীন বুঝিয়েছিল, এ গানের ক’টি লাইনে আসলে সুজাতা ঠাঁই পায়নি। বরং অতীনের স্ত্রী হয়ে সে যে বাকিদের চেয়ে বেশ খানিকটা উঁচু-জাতে উঠতে পেরেছে, সেই বিজ্ঞাপণই ঝিকিয়ে উঠেছে স্বরলিপি জুড়ে। এ যেন পুরুষের করুণাধারা সিঞ্চিত এক আর্ত নারীর বর্তে যাওয়ার গল্প। বন্ধু হিসেবে সুজাতারা গুণীদলের মধ্যে যেখানেই থাক না কেন তাদের ‘সুখ’-এর সংজ্ঞা তো শেষমেশ লিখবে কোনো এক বিত্তবান পুরুষেরই মহানুভবতা!

অবশ্য এও সত্যি জ্ঞানীগুণী, সৃজনশীল বন্ধুবর্গের মাঝে নিতান্ত কাঁচা বয়সের এক মুখচোরা মেয়ের মনের খবর নিতে তরুণ শিল্পীদের তখন বয়েই গেছে! সেইজন্যই কি নির্লিপ্ত ভোগবাদী অশ্লীলতায় তাকে মুড়ে দেওয়া হয়েছিল ঐতিহাসিক গানের স্বরলিপিতে!

বাঙালি নস্টালজিয়াতে অমর হওয়া সাতজন বন্ধু অর্থাৎ কফি হাউজের সেই প্রবাদপ্রতিম সদস্যরা – গোয়ানিজ গীটারিস্ট ডিসুজা, ঢাকার সাংবাদিক মইদুল, নাট্যকর্মী রমা রায়, আঁকিয়ে নিখিলেশ স্যান্যাল, কিম্বা ক্যান্সার আক্রান্ত কবি অমল- অনেকেই নিজ নিজ করুণরসে পাব্লিকের হৃদয় আর্দ্র করল। অসাম্প্রদায়িক বাঙালির বন্ধুত্বের সংজ্ঞায় নস্টালজিয়ার কোমল রাগ মিশিয়ে যে যুগান্তকারী স্বরলিপি রচিত হল, তাতে যেন ছন্দপতন ঘটাল সুজাতার মত ‘সনাতনী’ ‘আদর্শ ভারতীয় বৌ’–এর চিরাচরিত পুরুষতান্ত্রিক পর্দায় মুখ লুকানো এক মেয়ের ছবি। কবি, রিপোর্টার, গিটারিস্ট, শিল্পী, অভিনেতা ইত্যাদি গুণীজনের গুণগান গাওয়া জনতা জনার্দন কী অবলীলায় মেনে নিল যে, সুজাতারা কেবল নাটকের এক্সট্রা। তাদের কোনো গুণ থাকতে নেই, আড্ডায় কোনো মতামত রাখতে নেই, এমনকি সুজাতাদের কোনো এম্বিশানও থাকতে নেই। তারা এমনই স্বার্থপর, মগজহীন, আড়ম্বরসর্বস্ব শো-কেস বেবি, যাদের ভূত-ভবিষ্যৎ সবটাই গাড়ি-বাড়ি-গয়নার ভোগবাদী প্রাচুর্য দিয়ে কেনা যায় যখন তখন। তারা হীরা জহরতে আপাদমস্তক আচ্ছাদিত হতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসার খোয়াব দেখে, প্রাসাদোপম অট্টালিকা আর বহুমূল্যের গাড়ি পেলে থৈ থৈ ভেসে যায় অতল সুখে !

প্রথমবার গানটি শুনে চমকে গেছিল সুজাতা। চমক কাটলে অতীনের আনা গানের রেকর্ডটি চালিয়ে আরও দু’বার শুনেছিল। তারপর ধাতস্ত হয়ে নিখিলেশকে ফোন করে ফেটে পড়েছিল নিস্ফল আক্রোশে– ‘আচ্ছা সত্যি বলতো দাদা, গানের কথায় যত গুণ বর্ণিত হয়েছে, সবাই সত্যই সেরকম মনন-চিন্তনেরই অধিকারী ছিলে?’

‘আমার কথা নাহয় ছেড়েই দাও, ‘বন্ধু’দের অসুখ, ব্যাথা, কষ্ট, মৃত্যুশোক যদি তোমাদের এতই প্রাণে বাজত তবে কেন কেউ একবারও জানতে চায়নি কাকে ভালোবেসে তোমাদের শিল্পীবন্ধু রমা রায় আজ পাগলা গারদে রয়েছে? নাকি শিক্ষিত, রুচিশীল, সংস্কৃতিমনা মানুষ হলেও সে কেবল মহিলা বলেই সবার অদ্ভুত নির্লিপ্তির শিকার হয়ে থেকেছে!”

-“তুই শান্ত হ, বোন। আমি বুঝতে পারছি তোর মনের মধ্যে কী চলছে।“ নিখিলেশ এর বেশী কিছু বলতে পারেনি।

সুজাতা জানত তার নিখিল দা মিথ্যে বলছে না। বাকি সবাই যাই ভাবুক, রমা আর সুজাতার হাতে ভাইফোঁটা নেওয়া নিখিলেশ তো জানত সুজাতার সত্যিটা, তবে এ গান নিয়ে সে কেন কোনো প্রতিবাদ করেনি! কষ্ট তার এইখানেই বেশি।

সুজাতার চেয়ে বছর দুয়েক বড় রমা তখন সদ্য এক সওদাগরি অফিসে কাজ পেয়েছে। নাম মাত্র বেতনে ঘন্টা পাঁচেকের কাজ। বাকি সময় চুটিয়ে থিয়েটার। ওদিকে সুজাতাও তখন বাড়ির কাউকে না জানিয়ে নিজের জন্য বরাদ্দ হাত খরচা আর বৃত্তির জমানো টাকা দিয়েই ভর্তি হয়েছে এয়ারহস্টেস-ট্রেনিং সেন্টারে। শেষ পরীক্ষার আর মাত্র ছ’মাস বাকি। তারপরেই আসবে তার স্বপ্নের উড়ান। একবার চাকরির চিঠি বাবাকে দেখালে কেউ কি বাঁধা মাস-মাইনের এমন কর্মসংস্থানকে হেলায় ঠেলতে পারবে! কথায় বলে, পেটের ছেলে আর হাটের থলে কিছুতেই লুকানো যায় না। মনে মনে স্বপ্নপূরণের অনাগত দিনের খোয়াব আর বুকের ভেতর অবিরাম বেজে চলা দুরুদুরু ডমরুধ্বনি – এমন মুক্তধারার উচ্ছ্বাস চেপে রাখা খুব কঠিন ।

একসাথে নিত্য যাতায়াতের, ফুচকা আর হাওয়াই মিঠাইয়ের ঝিলিমিলি মোলাকাতের মাস পেরোতে না পেরোতেই রমা জেনে গেল সুজাতার এয়ারহস্টেস হওয়ার খবর ।সবটা শুনে সে কি উৎসাহ রমার ! দিন পার হচ্ছিল যেন প্রজাপতি ডানায় ভর দিয়ে। রমার থিয়েটারের নিয়মিত দর্শক সুজাতা। সাহিত্য অভিনয় জগতের তিলমাত্র ধারণা না থাকা, কমার্স গ্র্যাজুয়েট সুজাতা কোনও এক নিষিদ্ধ কস্তূরীর টানেই বোধহয় রমার ছায়াসঙ্গী হয়ে গিয়েছিল। কোচিঙের পরবর্তী সময়টুকু বাড়ি ফেরার বাসে উঠতে পা সরত না তার। রমার অমন হৃদয় নিংড়ে উঠে আসা উদাত্ত কন্ঠস্বর, অমন নির্ভিক দীপ্তি যেন তুড়ি মেরে জীবনের সব সমস্যাকে হেলায় ছুঁড়ে ফেলা যায়, যে তাকে নিরন্তর শেকল ভাঙার গান শোনায়, যার নির্ভার নিশ্চিন্তির কাছে দুদণ্ড দাঁড়ালে মনে হয় শান্তির খোঁজ বুঝি শেষ হল – সেই রমার এমন দুর্নিবার আকর্ষণের কাছে বারবার নতজানু হতেই বোধহয় পায়ে পায়ে মঞ্চের সামনে এসে দাঁড়াত সুজাতা।

রমার হৈ হৈ করা প্রাত্যহিকী, সুজাতার হাতে কী এক অধিকারে গুঁজে দেওয়া পথ খরচা, কিম্বা নিরর্থক চপলতায় বলে ওঠা “আয়, আরো বেঁধে বেঁধে থাকি” যখন চায়ে ভেজা কবোষ্ণ শীতের দুপুরগুলোকে তুরীয় গতিতে ফুরিয়ে আনতে চাইত শিশির মঞ্চের বাঁদিকের গলি পথে– সুজাতার কানে তখন ট্রাফিকের কোলাহল ছাপিয়ে বেজে উঠল “কিছুক্ষণ আরও নাহয় রহিতে কাছে…”

রমার মত এভাবে তো কেউ হাত বাড়ায়নি তার দিকে। এভাবে তো কোনো বন্ধু মায়াবৃক্ষের ছায়া হয়ে আগলে রাখে নি তাকে । ঠোঁটের কোনায় বাসা বাঁধা একটুকরো শব্দবন্ধ “ভালোবাসি তোমায়” বারবার আগল ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইত সমস্ত নিষেধের আইন ভেঙে।

কফি হাউজের শনিবারের আড্ডায় সেবার যখন ফ্রয়েডের ইডিপাস কমপ্লেক্স নীতি ,ম্যাসিডন রাজ্যের সমকামী শ্বেত অশ্বারোহী সৈন্যবাহিনীর খবর, প্লেটো সহ আরও গ্রীক দার্শনিকদের লিঙ্গবৈষম্যহীন কালজয়ী প্রেম ইত্যাদি বিষয় নিয়ে হৈ চৈ উঠেছিল – তখন ধরা পড়েছিল জ্ঞানীগুণী, খ্যাতিমান, সমস্ত সংস্কারবর্জিত বলে দাবী করা বন্ধুদের মধ্যেও কেমন মতানৈক্য ঘটে । নিজের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় সকলেই কেমন দাঁত নখ বের করে শাসায়! এক অদ্ভুত নিভৃত আশঙ্কায় রমার আঙুলে আঙুল জড়িয়ে চেপে সুজাতা কেঁপে উঠেছিল – প্রেমে পড়াও কি এভাবে বারণ হতে পারে !

কিন্তু বারণ সবক্ষেত্রে কোনও নির্দিষ্ট কারণ মেনে আসে না। এক ছুটির বিকেলে পড়ন্ত গোধূলিতে ধুয়ে যাওয়া খোলা ছাদে একটা একাঙ্ক নাটকের রিহার্সালে রমার সাথে সঙ্গ দিচ্ছিল সুজাতা। একটি দৃশ্যে ঘনিষ্ট হতেই সুজাতার বুকের তন্ত্রীতে যেন রুদ্রবীণার মূর্চ্ছনা ছড়িয়ে পড়ছিল, এতটাই তীব্র ছিল সেই হৃদকম্পন, যেন এবার ডানা ঝাঁপটিয়ে বেরিয়ে আসবে সোনার খাঁচায় বন্দী পায়রা। ঠিক সেই দুর্বল মূহুর্তেই রমা তার ঠোঁটে এঁকে দিয়েছিল ভালবাসার ক্ষতচিহ্ন। গোধূলির আলো মেখে উতল হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাওয়া দুই নারীর গুপ্ত-প্রেমের যবনিকা পতন যে অনিবার্য, তা জানা সত্ত্বেও ঠোঁটের ব্যারিকেড ভাঙা অসাধ্য ঠেকেছিল সুজাতার। হয়ত রমারও। বুকের ভেতরে চলা উদ্দাম রক্তস্রোত, যা এতদিন ছিল স্থবির, যেন আচমকা কোনো মৃত্যুঞ্জয়ী মন্ত্রে চলকে উঠেছিল দুই প্রেয়সীর প্রতিটি রক্তকনিকায়। এমনটা যে হবে কোনো একদিন- তার আঁচ বুঝি টের পাচ্ছিল সুজাতা অনেকদিন ধরেই। কিন্তু এমন অসময়ে যে আসবে কেই বা জানত! কেই বা জানত ঠিক সেই সময়ই চায়ের কাপ হাতে সুজাতার মা এসে দাঁড়াবেন তাদের পেছনে।

পরের ঘটনা অতি সংক্ষিপ্ত। বিস্তর কান্নাকাটি, শাপশাপান্ত ও অশান্তির প্রহর পেরিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই গৃহবন্দী সুজাতার কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা তার উর্দ্ধতন অফিসারের একমাত্র পুত্র অতীনের হাতে সঁপে দিলেন তাকে। কখন যে তার স্বপ্নরবি ডুবেছিল মরা চাঁদের আড়ালে– তার হিসেব রাখা হয়নি সম্ভব অসম্ভবের দোলাচলে দাঁড়ানো সুজাতার।

ষোল বছর হয়ে গেল নিউ ইয়র্কের প্রাসাদপম বাড়িটায়। রাঁচীতে নির্বাসিত রমা রায়ের খবর বহুদিন বাদে জেনেছিল সুজাতা। একমাত্র নিখিলেশই জানত দুই প্রেয়সীর কথা। কে জানে রমাই বলেছিল কিনা। প্যারিসে চলে যাওয়ার পরে নিখিলেশ বহুবার বলেছিল তার বাসায় যেতে। কিন্তু ‘সুখি’ সুজাতার এত স্বাধীনতা কোথায় যে অতীনের অনুমতি ছাড়া সে পুরনো বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে যায়! অথচ নিখিলেশের বাড়ি যাওয়ার জন্য মনে মনে অস্থির হয়ে উঠেছিল সে। রমার খবর নিতেই নিখিলেশকে চিঠি লিখত সুজাতা। কেমন আছে রমা? তুতো বোনের সাথে আর কি দেখা হয় নিখিলেশের? – কতবার জানতে চেয়েছে সুজাতা। কোনো অজানা কারণে সেসব চিঠির জবাব আসেনি তার কাছে।

আজ যখন ‘প্রাইড মার্চে’র মিছিল যায় বাড়ির সামনের রাস্তা জুড়ে, মিডিয়া উপচে ওঠে সমপ্রেমীদের সমর্থনে জনতার অকুণ্ঠ শুভেচ্ছা বার্তায় – খোলা ব্যালকনি থেকে রামধনু রঙা নবপ্রভাত সুজাতাকে ভাবায় ‘আহ, রমার সাথে যদি এমন একটা সকালের সাক্ষী হওয়া যেত!’

                                       

মাথায় বাম লাগিয়ে বিছানা ছাড়ে সুজাতা। ওঘরে রেকর্ড প্লেয়ারটাকে বন্ধ করে এসে ডিনার টেবিলটিকে যত্ন হাতে সাজায়।  লিভিং রুম থেকে বাপ-বেটার হৈচৈ যেন শূলের মত বিধঁছে তাকে প্রতিদিনের মত। আজ ওদের প্রিয় টিমের ফুটবল ম্যাচ ।

আজ রমার জন্মদিনও। নিজে হাতে প্রতিবছর এই দিনে সুজাতা পায়েস বানায়। উপরে ছড়িয়ে দেয় কিসমিস, পেস্তা। তবু ছেলে খেতে চায় না।

ছেলের বাপও তাল মেলায় “এসব গাঁইয়া খাবারে কত ক্যালোরি থাকে জানো?”

আজও পায়েস রেঁধেছে সুজাতা।  সে জানে ওরা খাবে না, তবু বাটি সাজায় প্রতিবারের মত।

ইতিহাস সাক্ষী সুজাতারা এভাবেই কখনো ক্লান্ত বোধিসত্বের ত্রাতা হয়ে পায়েস এনেছে, কখনো বা অনাথ অচ্ছুৎ ব্রাত্যজন হয়েও কেবলমাত্র পালিতাকন্যার দায় পালনেই আর্ত ব্রাহ্মনমাতার জীবনরক্ষায় নিজের রক্তদান করেছে। তারপর সকলের সেবা শেষে নিরালায় একাকী বসে গভীর রাতের তারাদের মাঝে খুঁজেছে হারিয়ে যাওয়া সেই ছায়াপথ – যা তাকে কোনো এক মেয়েবেলায় শিকলি-কাটা-পাখি হওয়ার স্বপ্ন দেখাত।

খেতে বসে অতীন টিপ্পনী কাটে “ব্যাস দিলে তো গানটা বন্ধ করে! এত লেজেন্ডারি গান তাও পছন্দ কর না তুমি? কেন কর না – সেটাও তো এতদিনে জানলাম না। রিডিক্যুলাস !”

ছেলেও মজা করে “আমার বন্ধুরা অবধি বলে, ইউ আর লাকি ব্রো! বাংলার একটা সেরা গানে তোর মায়ের নামেও এক লাইন আছে! ইউ আর ফেমাস, মম! ইয়েট ইউ ডিডন্ট লাইক ইট ,স্ট্রেঞ্জ! কিছু না করেও তুমি ফেমাস হয়ে গেছ। আর কী চাই তোমার?” – বলতে বলতেই সে উঠে গিয়ে আবারও সুইচ অন করে দেয়।

আবার শুরু হয় ওই অসহ্য সরগম। সুজাতার কানে হুল ফোটায় ‘কিছু না করেও তুমি ফেমাস…’! এই তার সুখের নীড়! যে ছেলে ঠিকমত বাংলা বলতেই পারে না, সে কি করে এসব গানের মর্মার্থ বুঝবে! কিন্তু তবু ‘লাইক ফাদার লাইক সান’ –এর ধারা যাবেটা কোথায়!

গানের কথাগুলো সুরের পালকে ভর করে যত ছড়িয়ে পড়ছে, তত দমবন্ধ লাগছে সুজাতার। দাঁতে দাঁত চেপে সে নিজের প্লেট টেনে নেয়। ওদেরকে পায়েসের বাটি এগিয়ে দিতেই আবারও এসব ক্যালোরিযুক্ত গাঁইয়া খাবারদাবার নিয়ে বাপ ছেলের টিপ্পনী শুরু হয়। একবার আড়চোখে লিভিং স্পেসের দিকে তাকাল সুজাতা। দুটো বোতল সেখানে গড়াগড়ি খাচ্ছে সেন্টার টেবিলের নিচে। আজ ওদের টিম জিতেছে বলেই কি বাপ-বেটার এমন লাগামছাড়া উল্লাস ! টিভিতে এখনও চলছে হুল্লোড়।

তাই বোধহয় ডাইনিং টেবিলে সেই হুল্লোড়ের সাথে সুজাতার পেছনে লাগাটাও ওদের বাড়তি আমোদের লিস্টে যোগ হচ্ছে। মাথার ভেতরে একটা আগ্নেয়গিরি যেন আড়মোড়া ভাঙছে। ওদের ফ্যা-ফ্যা হাসি আর নিতে পারছে না সুজাতা । প্রতিবার কি এইভাবে সে কেবল টিটকিরির পাত্রী হয়েই থাকবে!

‘স্ত্রী ও মা হওয়ার পরে মেয়েদের তো সর্বংসহা হতেই হয়’, ‘মেয়েদের এত জেদ থাকলে চলে না’– মেয়েবেলায় শেখা বাক্যবন্ধের কাছে বারবার হেরে যাওয়াটাই কি তার একমাত্র নিয়তি! তার বেঁচে থাকাটা কি অপ্রেমের রুদ্ধসংগীত হয়েই থমকে থাকবে চিরদিন!

‘মম, প্লিজ স্ট্যু-টা পাস কর” ছেলের ডাক কানে গেল না সুজাতার। তার চোখের সামনে তখন অন্য জগত। বন্ধুদের সাথে দীঘা গিয়ে প্রথমবার সমুদ্র দেখা, বালির ঘর বাড়ি, দুর্গ বানানো, যতবার সেগুলোর বেড়া দেওয়া শেষ হচ্ছে ততবার এক রাক্ষুসে ঢেউ তেড়েফুঁড়ে এসে ভেঙে দিচ্ছে সেসব স্বপ্নবাসর। সর্বগ্রাসী এক রাক্ষুসে খিদে নিয়ে সমুদ্রদানব যেন বারবার ক্ষতবিক্ষত করছে..

সশব্দে চেয়ারটাকে ঠেলে উঠে দাঁড়াল সুজাতা। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ওঘরের দিকে।

গানটাকে আর সে সহ্য করতে পারছে না।

সক্কলের ভাললাগার গান তার একেবারেই ভাল লাগে না।

অপছন্দের বস্তুকে বারবার হাসি মুখে সে আর মেনে নিতে পারবে না।

মিথ্যে সুখের সংসারে সে এক নিপাট সং সেজে আর অভিনয় করবে না।

ঘরের চৌকাঠ ডিঙোতেই মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেল তার। তারপর কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওঘরে গিয়ে গানওয়ালা যন্ত্রটাকে টেবিল থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিল। চমকে উঠে অতীন দেখল ঝনঝন শব্দে ছত্রাকার হয়ে যাচ্ছে তার বিদেশী কোম্পানির রেকর্ড প্লেয়ার– তার অন্যতম সাধের ভিণ্টেজ কালেকশান। আর সুজাতা দেখছে গুঁড়ো হওয়া যন্ত্রাংশের সাথে ইতিউতি খসে পড়ছে সুখ-পাখির ডানায় ভর করা খুচরো অহং। হতবাক অতীনকে শক্ত করে আঁকড়ে আছে ছেলে ।তার কটা চোখের তারায় লেগে আছে ভয়ের রেণু।

দৃশ্যটা সুজাতার ভাল লাগছে খুব। খুব শান্তভাবে ফিরে এসে চেয়ারে গুছিয়ে বসল সে। তারপর প্লেট টেনে নিল। অতীন এখনও বিস্ফারিত চোখে তাকে দেখছে। তারপর সংশয়ক্লিষ্ট হাতে তার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে একটা জলের গ্লাস। টিভিটাও বন্ধ হয়ে গেছে এরমধ্যে। ঘরের আনাচকানাচ শান্ত এখন। আর কোনো টিটকিরি ছুটে আসছে না সুজাতার দিকে। তাকে ঘিরে পুঞ্জিভূত এই বিষ্ময়টুকু, বাপ-ছেলের মুখের ভয়টুকু তারিয়ে তারিখে চেখে রুটির টুকরো ছিঁড়ছে সুজাতা । টের পাচ্ছে মাথার কোষে কোষে জেগে ওঠা ভিসুভিয়াসও নিভে আসছে ধীরে ধীরে ।এতগুলো বছর ধরে বুকের মাঝে শক্ত শিকলে বাঁধা এতদিনের তীব্র ‘না’-টাকে মুক্তি দিতে পেরেছে আজ । তার ধমনীর চলকে ওঠা রক্তস্রোতের মাঝে, প্রতিটা শিরার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তন্ত্রীতে গুঁড়ো গুঁড়ো অভ্ররেণুর মত ছড়িয়ে পড়ছে ঝিলিমিলি সুখ। অবশেষে।

 

 

 

 

 

 

        

12 thoughts on “ইরাবতী গল্প: অ-সুখের স্বরলিপি । সরিতা আহমেদ

  1. বাহ্ চমৎকার … কফি হাউসের কোনায় কোনায় জমে থাকা নুন খুব যত্ন নিয়ে জড়ো করেছ। মিষ্টি আবেগের আড়ালে নুনের এই পাহাড়গুলো খুঁজে বার করা পরিশ্রমের কিন্তু জরুরি কাজ। খুবই ভালো হয়েছে।

  2. খুব সুন্দর লাগলো। বিশেষত শেষবেলার ওই অধিকার ছিনিয়ে নেওটার যেন দরকার ছিল। নিরুচ্চার অথচ বলিষ্ঠ।

  3. একটা গানকে মোল্ড করে এভাবে লেখা সম্ভব ভাবিনি! গল্পচ্ছলে অনেকের অনেক কথা বলে দিয়েছেন। ন্যারেশন কখনও কখনও একটু দূর্বল লেগেছে কিন্তু গল্প যত এগোয় অদ্ভুত একটা বিষাদ এসে জড়ো হয়। সে কষ্টটা সুজাতার জন্য, রমা রায়ের জন্য নাকি নিজের জন্য জানি না, সত্যিই তো গানের ওই লাইনটাকে এভাবে তো ভাবিনি… আমি রমা রায়কে পুরুষ ভেবেছি এতদিন। ‘আঘাত পেয়ে’ ‘পাগলাগারদে’ থাকলে সে তো পুরুষই হবে— পুরুষতান্ত্রিক ভাবনা যে আমাদের মজ্জায় মজ্জায়। ধন্যবাদ ভাবনাটাকে বদলানোর জন্য। ভালো থাকুন। আরো অনেক লিখুন।

  4. ভারী সুন্দর। যতবার গানটা শুনি অস্বস্তি হয়। আজ মনটা শান্ত হল। ধন্যবাদ।

  5. হীরে আর জহরতে আগাগোড়া মুড়িয়ে যাওয়া মানুষটা কতটা ভালো আছে তার বন্ধুরা বুঝতে পারেনি। অভিমান স্বাভাবিক। বাঙালির নস্টালজিয়া কফি হাউসের আড্ডার মতোই আমাদের সব আড্ডাতেই অনেক মান অভিমান, ভুল বোঝাবুঝি চাপা থেকে যায়। চাপা থেকে যায় যন্ত্রণাও, সুজাতারা অন্যের চোখে “ভালো” থাকে কিন্তু নীরবে সেই যন্ত্রণা বয়ে চলে।

    1. থ্যাঙ্কিউ ?? অভিমান, যন্ত্রণার একদিন বহিঃপ্রকাশ ঘটে। একদিনের জন্য হলেও না-টুকু বলা, বুঝিয়ে দেওয়া জরুরী হয়ে পড়ে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত