মৃণাল
তোমাকে দেখলে একটা সাপ নড়ে ওঠে মাথার ভেতরে। তোমার শিশু আমপাতার মতো দুচোখে চকচক করছে আমার সেই সাপের বিষ। অবশ্য তোমারও নিজস্ব বিষ আছে। সেই বিষের স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন আছে শরীরের মুলে, যেখানে অর্বুদের মতো ফুটে আছে অন্য সব যন্ত্রনা, রেচনের আধার কিংবা পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ার মতো অমোঘ বিস্ফোরণ। একদিন এই দুই আলাদা আলাদা শরীরের বিষ দুটো পরাক্রান্ত মাছের মতো পরস্পরের মুখোমুখি হয়। স্থির হয়ে থাকে। যেন বোঝার চেষ্টা করে এ অন্যের মস্তিষ্কের রক্ত চলাচল অথবা শিরার কম্পন। অথবা কে কেমন বিষ জড়ো করে এনেছে গাত্রপটে, যা অচিরেই ছুড়ে দেওয়া হবে আগুন ও ঘৃণার সঙ্গে। দুটো মাছ তাদের প্রাচীন পিচ্ছিল মুখ দু জোড়া শ্যাওলার ঘনান্ধকারে থাকা চোখ এইসব বিভিন্ন বিষয় বুঝে নেবার চেষ্টা করে
কখনও অপ্রত্যাশিতভাবে দুটো শরীরের বিষ পিছিয়ে আসে। তারা আবার তাদের গ্রন্থীতে ফিরে যায়। জলের ভেতরে একটি আসন্ন ঝঞ্ঝার আবহ সরে গিয়ে সূর্যের প্রতিসরিত আলো ঝিলমিল করে। আমার মাথার ভেতরে থাকা সাপটি আমপাতার মতো চোখ থেকে তার সংগোপনে রেখে আসা বিষের জেলি ফিরিয়ে নেবার জন্য ব্যস্তপদে হাড় ও শিরার ভেতর দিয়ে নেমে আসে। জঙ্ঘার ছিদ্র দিয়ে নামে বর্তুল ঘাসের ওপরে। তারপর ন্যূনতম দূরত্ব অতিক্রম করে ক্লান্ত পড়ুয়ার মতো এবং তোমার ফর্সা পায়ের সানুদেশে পৌঁছনোমাত্রই সে উন্মাদের মতো তোমার রবার নলের মতো অভ্যন্তর রক্ত মাংশপেশী পাখির মতো নরম হাড় অতিক্রম করে করে তোমার চোখের সামনে এসে কর্তব্যরহিত হয়ে যায়। যেন তার জলে ভয়, ঢেউয়ের আড়ালে থাকা হাঙরের ভয় অথবা অঙ্গহানির পর সে কোথায় লুকোবে- তার গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়ানো বাজরাখেতের মতো ভয়
তোমার আমপাতার মতো চোখ নিবিড় মুগ্ধতায় আরও একটু যেন ছোট হয়ে আসে
গোলাপ
এইমাত্র আমরা পৃষ্ঠা মুড়ে রেখে যে যার মতো তুষারের দিকে এগিয়ে গেলাম। তুষারে আমাদের অন্যজন্মের আত্মীয় স্বজন আছে। অন্য মাপের পোশাক ও ঘুরে বেড়ানোর রাস্তা আছে। কারও চোখ পড়ে নি এমন নম্র স্তনযুগল আছে। ক্ষুদ্র তুলসী চারার মতো ক্ষণ পদের লিঙ্গ আছে। এইসব দুষ্প্রাপ্য অতীতের কথা, আদুরে হলুদ ফুলের মতো অতীতের কথা আমরা মুখের ছায়া একবার বেসিনের আয়নায় দেখে এসে ভাবি। দুজনেরই মস্তিষ্কে এখন কিছুটা বালি রামধনু রঙে ছেয়ে আছে, তাতে ছোট ছোট ঢেউ মরুদেশের মতো। কিছুটা জলধারার মতো নিষ্কাম রক্ত চলাচল এবং কিছুটা দুর্বোধ্য নুড়ি। এইমাত্র আমরা একবার দৃষ্টি বিনিময় করলাম নিরুত্তর দাহকর্মীর মতো। হাতের আঙুল তার নিজের মতো অগোচরে মুড়ে দিল পৃষ্ঠার কোণ। অনেকটা যেন চিহ্ন রেখে যাবার মতো, গুপ্ত সংকেত রেখে যাবার মতো
তুষারের দেশে আমরা চলে যাব। যেন সহজ ট্রেনযাত্রা। দুটো স্টেশন পেরিয়েই আমাদের অখ্যাত জগত। তুষারে তুষারে সাদা। স্টেশনমাস্টার আমাদের আত্মীয় শাখার কেউ। রিকশা চালকও আমাদের আত্মীয় শাখার কেউ। দুপাশে যারা আগুন জ্বালিয়ে বসে গল্প করছে তারাও অথবা পান ও বিড়ির দোকানেও যে গলার অসুখ নিয়ে শুধু চামড়ার চাদরে ঢাকা মানুষটি বসে আছে, সেও আমাদেরই আত্মীয় শাখার কোনও অভিমুখ। অ্যাতো মানুষের সমাগম, অ্যাতো পদাতিক আমাদের ঘিরে আছে বলেই আমরা এ অন্যেকে ভয় করি কম। একবার তুষারের ভেতর ঢুকে গেলে মনে হয় এখনও তো নতুন করে ফিরে আসা শুরু করা যায়। ধরা যাক ফিরে এলাম এমন একটি বাড়িতে, যা আগের মতো নয়। যেখানে ফুলদানির মতো একটা রান্নাঘর। প্রতিটি দেওয়ালের গায়ে অসংখ্য হাত এবং অপর মানুষটি অ্যাতো স্বচ্ছ- যেন অশরীরী। দু-কদম এগোতেই সদাহাস্যময়ী সব সহচরী কল
অথচ প্রতিবারই আমরা আবারও সেই একই বাড়ি, একই আঁচ এবং কুঠারের মতো একই শরীরের কাছে ফিরে আসি
সরোদ
সেই যে দেখলাম তুমি একটি ভাঙা, ভেঙে পড়া আলোকস্তম্ভের ওপর আড়াআড়ি কনুই রেখে শুয়ে আছো, মুখে বিষণ্ণ বর্ষাকাল। একটি সবুজ ব্যাঙ তোমাকে লাফিয়ে টপকে যেতে গিয়ে প্রতিবারই ব্যর্থ হয়ে আবার তার পুরনো জায়গায় ফিরে আসছে, পুনরায় আরও একটা লাফের জন্য–সেই তোমার সঙ্গে আমার কাতরতম শেষ দেখা। আমি এখন আমার নিরুপদ্রব সাদা সাদা আঁশে ঢাকা গাছের গুঁড়ির মতো খোলে ফিরে এসেছি। এখন আমি গলা থেকে পায়ের আঙুল অবধি টানটান করে মেলে রাখি আমার চৌকোনা আয়ুর মধ্যে। গোল একটা আলো আমার পা থেকে মাথা আবার মাথা থেকে পায়ের প্রান্ত অবধি জরিপ করে, যেন রাজকীয় কোনও জাহাজ আসবে এবং নোঙর ফেলবে। মূল্যবান জুতোর নীচে শুধু থাকতে হবে অতি শুভ্র বালি আর পলায়নপর সরীসৃপ। একটি সসম্মানে কুকড়ে যাওয়া গুল্ম , রঙিন কচ্ছপের পিঠ
ভালো আছি এই নির্দোষ কথাটা অনেকবার তোমার দিকে ঠেলে গড়িয়ে দিতে চেয়েছি। জ্বলন্ত মোমের বনে চাঁদের ভাইব্রেন্ট আলোয় মাখা দু-কাঠা জলাশয়ের মতো ভাল আছি শুধু এই অতিসামান্য সামাজিক একটি কথা। অবশ্য তা তুমি তেমনভাবে জানতে পার নি। তোমাদের গেট থেকে যে পাথর ছড়ানো অনেকটা রাস্তা বাড়ির মূল অবধি পৌঁছয়, সে রাস্তায় তোমাদের রোমশ গাড়িটা দাঁড়িয়ে থাকে রক্তবর্ণ ফুলের মতো দুটি চোখ আর ঘ্রাণশক্তি নিয়ে। পাতাও পড়লে তোমাদের বাড়ির পঞ্জরে, অন্ধকারে একটি লাল শিখার মতো বাতি জ্বলে ওঠে আর সিঁড়িতে দৌড়ে আসা সৈন্যসামন্তের আওয়াজ পাওয়া যায়, হিংস্র আতসবাজির আকাশে ফুটে উঠে মিলিয়ে যাওয়া দেখা যায়। শীতে তোমাদের বাড়ির সামনের মাঠে গাছগুলি শুকনো খটখটে কঙ্কাল হয়ে এ-অন্যকে আঁতিপাঁতি করে খোঁজে। এখনও কি খোঁজে?
শেষবার দেখেছিলাম তোমার স্তন আশ্চর্যভাবে মঞ্জরীত হয়েছে। রঙ করা কাঠের খুঁটির মতো তার বহুদূরব্যাপী গন্ধ। তখন তোমার ভেতরে নিশ্ছিদ্র একটি হ্যাজাক জ্বলছিল আর চারদিকে টাঙানো ছিল যাত্রামঞ্চের মতো কাপড়। আমি দেখেছিলাম খড়খড়ে বাজনা শেষ হতেই একজন কালো পোশাক পরা মানুষ সেখানে লাফিয়ে পড়ল। তোমাকে কোমর থেকে চুমুক দিতে দিতে এগিয়ে গেল গলার খাড়াইয়ের নীচে। তারপর আমি চোখ বুজে ফেলেছিলাম। চারপাশ থেকে একটা বিচারসভা হইহই করে উঠছিল। একটি পরিণামদর্শী কণ্ঠস্বর কেবলই বলছিল-অনভিপ্রেত অংশগুলি বাদ দিয়ে এগোও। বাস্তবটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগোও। আলো তোমার পিঠের ওপরে
আমার স্বমেহনের আর্তি হয়তো আসা উচিৎ। ঝাঁকে ঝাঁকে মাছির মতো উড়ে আসা উচিৎ। কিন্তু কোথাও একটা সরোদের তার আপ্রাণ বেঁকে গিয়ে কোনও চারমহলা বাড়ির কোনও একটা ঘরে বেজে উঠছে। একটিই মাত্র ওটার স্বপ্নে নম্র তুষারপাতের মতো গাঢ় যোজন বিস্তৃত শব্দ
কবি