টুনটুনি ও জেনারেল
আমি টুনটুনি পাখি
মুক্ত বিচরণ করি অনুচ্চ সব বৃক্ষে,
গান গাই নেচে বেড়াই, তা ধিন তা ধিন।
আকাশচুম্বী কোন বৃক্ষে
কিংবা উদ্যত কোন শৈল শিখরে
আরোহণের স্বপ্ন দেখিনি।
আমি বরং বাতাসের গান শুনি, ঘাসের নৃত্য দেখি,
ফুলের সাধনা দেখি; মাছেদের গল্প শুনি,
ফড়িং এর সার্কাস দেখি।
সবুজ পাতায় লুকোচুরি খেলি প্রজাপতির সাথে;
রৌদ্রে স্নান করি প্রাণোচ্ছল জলাশয়ে;
শিশুদের বিস্ময়ে সাড়া দেই অবলীলায়,
লেজ নেড়ে চঞ্চল করে তুলি বিশ্বকে।
ভালোবাসি আমার ক্ষুদ্র ডানাকে,
উপভোগ করি আমার মুক্ত সবুজ বিশ্বকে।
ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে অতিথি হওয়ার
কোনো উষ্ণ ইচ্ছে আমার নেই।
আমার পূর্বপুরুষেরা জুলিয়াস সিজার, দারিয়ুস, চেঙ্গিস খান, আলেক্সজান্ডার বা সম্রাট আকবরের মসনদ দেখে লোভাতুর হয়নি নিশ্চিত।
হিরকসজ্জিত অশ্ব বা হস্তীর রাজকীয় আসন
দেখেও লোলজিহ্বারহিত থেকেছে অনুক্ষণ।
কিংবা রাজপ্রাসাদের নর্তকী সেঁজে
দশ সহস্র স্বর্ণ মুদ্রা বখসিসের
নিকুচি করেছে সব সময়।
ক্ষুদ্র ধমনীতে আমার প্রবাহিত প্রাচীন রক্ত,
কোষে কোষে সে কথাই বলে যায়।
তবু কেন জেনারেল উঁকি দাও
আমার আসবাবহীন কুটিরে।
আমি ঈপ্সিত নই, নই ঈর্ষান্বিত, জেনারেল!
আতংকিত বোধ করি না পারমাণবিক হুংকারে
যুদ্ধ-রঙের পোশাক-তলে
স্ফীত ক্রোধ তোমার, রক্তরঙের প্রতিচ্ছবি আঁকে চোখে।
তোমার বক্ষ ও স্কন্ধে শোভিত বিবিধ রঙের রিবন ও মেডেল
শক্তি ও ক্ষমতার সাড়ম্বড় দর্পে ঝিলমিল খেলে যায়।
হঠাৎ ভয়ানক বেগে ছুটে আসে সহস্র দো’নলার বাতাস;
স্তব্ধতার মহাত্রাসে চেপে ধরতে চায় এই ক্ষীণকণ্ঠ।
আমার ছোট প্রাণ, বিপুল প্রাণময়তায় ভরা।
সে প্রাণে আমার মুক্তি, আনন্দ ও প্রেমের
বিগব্যাঙ থিউরি কাজ করে নিরন্তর।
জেনারেলের বসার আসন নেই সেখানে
ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্টস নেই এখানে।
টুনটুনির কাছে তুমি কী চাও, জেনারেল?
টুনটুনির কোন মহাসম্পদ তুমি লুণ্ঠন করতে চাও?
কোন সৌন্দর্যই বা তুমি হরণ করতে চাও?
আর টুনটুনির কী বা আছে ভালোবাসা ও স্বাধীনতা ছাড়া!
কবি, ভয় ও সাহসের তর্ক
বহুজন্ম পূর্বে পৃথিবীর উচ্চতম পাহাড়টি, পাহাড় ছিল না;
সেটা ছিল উইপোকার এক মরা ঢিবি।
আর আঙিনার পাশে আজকে যে অসহায় গ্রাম্য পুকুর দেখা যায়
সেটা ছিল বহুকাল পূর্বের সর্ববৃহৎ কোন মহাসাগর।
অজ্ঞাত অযুতসহস্র কাল পূর্বে
যখন সভ্যতার স্কেচ আঁকছিলেন ঈশ্বর,
তখন একদিন কিরণোজ্জ্বল মধ্যদুপুরে
ভয় ও সাহসের সাথে ভীষণ তর্ক বাঁধে এক ঋষি কবি’র।
সম্ভবত তিনি ছিলেন পৃথিবীর আদিমতম কবি;
হয়তো কবিদের পিতাও।
ভয় ও সাহসের সাথে যিনি
মহাতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
তর্ক আসলে ভয়ই শুরু করেছিল।
উদ্ধত স্পর্ধা, দুর্বিনীত দম্ভ ও আগ্রাসী ক্ষমতায় উন্মাদ ভয়
কবিকে তুচ্ছ জ্ঞান করে গম্ভীর স্বরে বললো,
আমি পুস্কণীকে ভীত আহত করে মহাসাগরে পরিণত করতে পারি ।
কবি বললেন, তুমি বরং বাপু, মহাসাগরকে জড়িয়ে ধরো,
দেখবে ওর আত্মা ক্ষয়ে শুষ্ক, প্রতাপহীন ও ক্ষীণ জলাশয়ে রূপ নেবে।
ত্রাস বললো, তোমার কথা সত্য হলে
হে অকৃতদার কবি, আমি আত্মহত্যা করবো।
সাহস কিছুটা নিশ্চুপ ছিলো,
তর্কে জড়ানোর ইচ্ছেটাও তার ছিলো না।
তাছাড়া ভয়ে তটস্থ সাহস,
পদদলিত পত্রের মত নিঃসাড় থাকলো।
কবিই সাহসের পক্ষে সরব হলেন।
কবি বললেন, সাহস যদি উইপোকার ঢিবিকে চুম্বন করে,
অনুপ্রাণিত করে কিংবা উষ্ণ মধুর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে,
তবে নগণ্য ঢিবি হবে ভূ-মণ্ডলের সর্বোচ্চ শিখর;
যার বুকের মধ্যে সাহস প্রেমের বীণা বাঁজাবে।
অতঃপর ভয় চেপে ধরলো দুর্দান্ত প্রতাপশালী সেই মহাসাগরকে
আর ক্রমেই সে রূপ নিলো ক্ষীণকায় সকরুণ এক গ্রাম্য পুকুরে।
প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভয় আত্মহত্যা করলো।
আর কিবা করার ছিল তার!
মরা পাখির ডানার মত পড়ে থাকলো তার দম্ভ।
এজন্য বোধ হয় পুকুর দেখে আমরা ভীত হই না।
যুগপৎভাবে সাহস কঠিনভাবে
আলিঙ্গন করলো উইঢিবিকে,
বিস্ময়করভাবে জাগিয়ে তুললো তার প্রাণশক্তিকে।
তুঙ্গে উঠলো তার কংকালসার প্রাণ,
উদ্ভাসিত আলোকে ছাড়িয়ে গেল সে
পৃথিবীর সকল উচ্চতাকে।
এরপর সাহস প্রবেশ করলো পাহাড়ের অন্তরে,
সেখানে বসে সে শক্তি-মন্দিরে
আগতজনের প্রার্থনা গ্রহণ শুরু করলো।
এখন রোজ সূর্যের প্রথম আলাপ হয়
চূড়ামনিতে থাকা সাহসের উজ্জ্বল বিন্দুর সাথে।
এ ঘটনার পর একদিন কৃতজ্ঞ সাহস
কবি’র কাছে সনির্বন্ধ প্রার্থনা করলো,
যেন তাকে কবি’র কলমের অগ্রভাগে নিবে রাখা হয়;
যাতে সে কবি’র শক্তির সামান্যই প্রকাশ করতে পারে।
অবশ্য সে বীরের রক্তকণিকায় থাকার
বাসনাও ব্যক্ত করলো,
যাতে সে সময়ের প্রয়োজনে প্রজ্বলিত হয়ে উঠতে পারে।
বৃত্তহীন জীবন
খাতায় বৃত্ত এঁকো
জীবনের জন্য বৃত্ত এঁকো না।
খাতায় বৃত্ত এঁকো
মননে বৃত্ত এঁকো না।
জীবনের বৃত্ত তোমাকে বন্দি করে
মননের বৃত্ত তোমাকে অসম্পূর্ণ করে।
দেখেছো নিশ্চয়ই খাতায় আঁকা বৃত্ত
কত ক্ষুদ্র জায়গা নিয়ে শৃঙ্খলিত দেয়ালে,
পৃথক করে রাখে আপনাকে, অসীম ভূবন থেকে।
বদ্ধ জলাশয়ে অচল দুষিত জলে যেমন
নষ্ট কীটেরা বাঁধে বাসা,
বৃত্তবন্দি জীবন তেমনি তোমাকে
জরাগ্রস্ত করে তোলে নিত্য।
খাঁচায় অন্তরিত পাখি যেমন
বঞ্চিত বিপুল মুক্ত বিশ্ব থেকে
অভ্যস্ত বুলির শব্দতরঙ্গে
ভাসিয়ে দেয় সমার্পিত জীবনের বিক্রিত স্বর;
শিকলবন্দি মনন তেমনি
তোমার চেতনায় দাসত্বের বেড়ি পরিয়ে রাখে।
অভ্যস্ত করে তোলে সংকীর্ণতার উন্মত্ত ছন্দে,
ধ্বংস করে তোমার মুক্ত মনোবিশ্বকে।
যদি বলো, বৃত্তে ভরা সমাপর্ণ,
স্বস্তি, ভালোবাসা ও প্রেম;
তবে ভেবেছো কি কখনো?
কত অল্প তুমি নিতে পেরেছো
তোমার অংকিত অনুবৃত্তে।
আর কত বিস্ময়াতীত অসীম থেকে
বঞ্চিত করেছো আপনাকে।
খাতায় বৃত্ত এঁকো
চেতনায় বৃত্ত এঁকো না
ভেঙ্গে ফেল বৃত্ত জীবন থেকে
মুছে ফেলো বৃত্ত মগজ হতে।
অসীমের সাথে হও লীন
মানসলোক হোক বৃত্তহীন।
![শাহ্জাহান কবীর](https://irabotee.com/wp-content/litespeed/avatar/4cc77574e4a70ac12e6b2ed64a1d8b62.jpg?ver=1738398674)
১৯৮৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলার ঝাঁপাঘাট গ্রামে আমার জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছি। ২০১৩ সালে ৩১তম বিসিএসের মাধ্যমে শিক্ষা ক্যাডারে যোগদান করি। বর্তমানে সরকারি এম এম কলেজ, যশোর-এ ইতিহাসের প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছি এবং নটিংহ্যাম ইউনিভার্সিটি মালেশিয়া ক্যাম্পাসে মাস্টার্স অব আর্টস ইন এডুকেশন বিষয়ে অধ্যয়নরত আছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচক্র-২০১০ এর সদস্য হওয়ার মধ্য দিয়ে সক্রিয় সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠানটিতে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছি এবং ২০১২ সালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত আলো’র সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছি। সাহিত্য, তুলনামূলক ইতিহাস, দর্শন ও বিজ্ঞান আমার আগ্রহের বিষয়। তাড়না থেকে লেখালেখিতে। দ্রোহ, মানবিকতা, সাম্য, আধ্যত্মিকতা, প্রেম, প্রকৃতি ও দার্শনিকতার প্রগাঢ় আবেগ ও আকুতি কাজ করে আমার মধ্যে। ছোটগল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ লিখতে স্বাচ্ছন্দবোধ করি। আগামীতে উপন্যাস এবং নাটক লেখার প্রগাঢ় আগ্রহ আছে। ভ্রমণ, আবৃত্তি, সঙ্গীত এবং ফটোগ্রাফি আমার শখ। সপ্তাহে একটি বই পড়ি আন্দোলনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বই পড়ানোর অভ্যাস করি। এছাড়া যশোরের বিভিন্ন সাহিত্য, মানবিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের উপদেষ্টা, সদস্য ও কর্মী হিসেবে বিজড়িত আছি।
শাহজাহান কবীর অসাধারণ লিখেন, মুক্ত মগজে বৃত্তের খামখেঁয়ালিপণার ক্যানভাস তুলে ধরেন অবলীলায়। প্রথার বেলেল্লাপণা কাব্যের কঠিন বল্লমে সদা আঘাতের চেষ্টা । কবির জন্য শুভকামনা।