আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
(এক)
মেয়েটার চেহারাতে ক্লান্তির ছাপ। চেহারাতে একটা আলগা লাবণ্য জড়িয়ে থাকলেও চোখে পড়ার মত কিছু না। পরনে সুতীর সালোয়ার কামিজ, সুতীর ওড়নাটা মাথায় জড়িয়ে জিনিসপত্র নামাবার তদারকি করছে। আমি উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, সঙ্গে পুরুষ মানুষ আছে কিনা! তেমন কারুকে চোখে পড়ল না। মেয়েটা বিবাহিত কিনা সেটাও বুঝতে পারছি না, অবশ্য আজকাল কোন মেয়ে আর বিয়ের চিহ্ন বহন করে ঘুরে বেড়ায়? তবে দিবাকরবাবু অবিবাহিত একলা মেয়েকে ভাড়া দিয়ে আর ভুল করবেন না। হ্যাঁ যা ভেবেছি, মেয়েটির সিঁথিতে এক চিলতে সিঁদুর আছে, ঐ না থাকারই মত। জিনিসপত্র তেমন নেই একটা স্টিলের খাট, আয়না লাগানো আলমারি, ফ্রীজ, কয়েকটা প্লাস্টিকের চেয়ার আর কয়েকটা বস্তা। আশেপাশের লোকজন কৌতূহলী চোখে দেখছে কিন্তু এগিয়ে এসে কেউ আলাপ পরিচয় তো দূর এক গেলাশ জলও এগিয়ে দেবে না। কিন্তু কদিন পরেই হাঁড়ির খবর নিতে হাজির হবে। এদের দেখে দেখে চোখ পচে গেছে।
তারা অফিস থেকে ফিরে রান্নাবান্না সারছিল। সকালেরটাও রাত্রেই বানিয়ে রাখে। সকালে শুধু অফিসের টিফিন আর চা বানায়। আসলে তার ঘুম ভাঙতে চায় না। এই বদ অভ্যাসটা এখানে এসেই হয়েছে। রাত্রে সে নাকি ঘুমতে পারে না। চোখ বন্ধ করলেই কে যেন কানের কাছে সীতারা, সীতারা বলে ডেকে ওঠে। হ্যাঁ ওর আসল নামটা আমি জানি। হিন্দু নাম ছাড়া বাড়ি ভাড়া পেতে অসুবিধা হত। ভাবছেন নিশ্চয় ডকুমেন্টস দেখলেই ধরা পড়ে যাবে। দূর এসব গন্ডগ্রামে কাগজ দেখে বাড়ি ভাড়া দেয় না। নগদে ভাড়া গুনে নেয়। একলা মেয়ে হলে একটু মুশকিল হয়, তবে তারার সিঁথিতে তো সিঁদুর আছে। ও থাকলেই হবে।
তারা ব্যাগের মধ্যে স্টিলের টিফিন কৌটো আর জলের বোতল ঢুকিয়ে বেরিয়ে পড়ল। মাথার উপর ছাতা খুলে, বুকে হলুদ ফাইলটা ধরে পাড়াটা দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে লাগল।
-এখানে কীসের অফিস কে জানে! কোথায় যায় বলত সেজেগুজে? বিলুর কথার মাঝেই তপন হাতটা বাড়িয়ে দিল। বিলু বিরক্ত চোখে তাকাতেই তপন বলে উঠল, ‘মালটা ছাড় আগে, তারপর বলছি’। ওর হাতে বিড়িটা গুঁজে দিতেই দু টান দিয়ে তপন গোপন খবর দেবার মত ফিসফিস করে বলতে শুরু করল, ‘মেয়েছেলেটার পঞ্চায়েত অফিসে বেশ খাতির, তবে ওখানে কাজ করে না। একটা বিদেশী এনজিওর হয়ে কাজ করতে এসেছে। আশেপাশের আরও কয়েকটা গ্রাম নিয়ে কাজ করে। গরীব পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়, কাজটার ব্যাপারে কিছু জানি না বস’।
‘মান্টু সোনা আমার, অনেক খবর যোগাড় করেছ, বাকীটা ওর শোবার ঘরে চা খেতে খেতে ওর মুখ থেকে শুনব।’ তপন বিড়ি টানতে ভুলে গেল, বলে কী! ওর শোবার ঘরে সটান ঢুকে যাবে?
আমি ওদের কথা শুনতে শুনতেই তারার পিছু নিই। এই তো বাঁশ বাগানের রাস্তাটা ধরে ও তরতর করে এগিয়ে চলছে। জায়গাটা বেশ আলো অন্ধকার, সীতারা বলে ডেকে চমকে দেব নাকি? নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠলাম। হাসির শব্দ কি মেয়েটার কানে গেল? কেমন যেন ভীত সন্ত্রস্ত ভাবে দৌড়ে বাঁশবনটা পেরিয়ে গেল।
আজ আমি ছায়ার মত লেগে থাকলাম ওর পিছনে। হত দরিদ্র বাড়িগুলো ঘুরে ঘুরে জিজ্ঞাসাবাদ করে ফাইল খুলে কাগজে নোট করে রাখছিল। অর্ধেক বাড়িতে তো মুখের উপর দরজাই বন্ধ করে দিয়েছে। দুপুর গড়িয়ে যখন রোদের তেজ মিঠে হল, তারা একটা গাছের তলায় বসে টিফিন বাক্স খুলে রুটি তরকারি খেল। তারপর এক ঢোঁকে অনেকটা জল খেয়ে ফেলে বোতলটার দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকাল। মনে হয় ভাবছিল, এখনও অনেক কাজ বাকী, জল না পেলে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে। আশেপাশে একটাও চাপাকল চোখে পড়ল না। লোকালয় ছাড়িয়েও অনেকটা বেরিয়ে এসেছে সে, অবশ্য জল চাইলেই যে লোকে তাকে জল দিত এমন না। তারা উঠে পড়ল, চলতে শুরু করল ওর অন্য গন্তব্যে। মুখের বিমর্ষ ভাবটা দূর করে মুখে যথা সম্ভব স্মার্টনেস ফোটাবার চেষ্টা করল।
(দুই)
ছবি?
প্রশ্নটা বুঝতে না পেরে তারা ফ্যালফ্যাল করে ছেলে দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারার অবস্থা দেখে ওরা হা হা করে হেসে ওঠে। ওদের আস্পর্ধা দেখে তারা অবাক হয়ে যায়। ভর সন্ধ্যা বেলায় ছেলে দুটো কড়া নাড়ল, একগাল হেসে বলল, ‘আলাপ করতে এলাম’। তারাকে লোকাল অফিস থেকে ইন্সট্রাকশন দেওয়াই আছে, লোকাল লোকজনকে না চটাতে। তারা তাই দ্বিধা নিয়েও দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে ওদের ভিতরে আসার সুযোগ করে দিয়েছিল। নিজের চা খাওয়া হয়নি, ওদের সঙ্গেই চা খেতে বসল। তপন নামের ছেলেটা চায়ের কাপ হাতে সটান ঘরে ঢুকে গিয়ে এদিক ওদিক চোখ বোলাচ্ছিল। বিলেই প্রশ্নটা করল। তারার মুখ দেখে তপন এবার বলল, “বুঝতে পারছেন না, তাই না? আপনার ফ্যামিলি ছবি, বিয়ের ছবি দেখতে পাচ্ছি না তো, আপনি তো ম্যারেড’।
‘ছবি নেই, আমি এখানে এক বছরের জন্য এসেছি। এত কিছু নিয়ে আসার দরকার পড়েনি’।
“দিদি তো আবার ফেসবুক করেন না, তাহলে মোবাইলে এক পিস ছবি কি থাকবে না আপনার হাজব্যান্ডের?’ লাল লাল ছোপ ধরা দাঁত বার করে বিলে বিশ্রী ভাবে হেসে উঠল। তারার মুখ চোখ লাল হয়ে উঠছে। এরা পেয়েছে কী! তার ঠিকুজি কুষ্ঠি জানাতে বাধ্য নয় সে। ছেলে দুটো এবার বলে ওঠে ওসব বর ফর নেই বলেই দিন না মাইরি, কেন সতী সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন?’
“বেরিয়ে যাও এখুনি, নাহলে তোমাদের পুলিশে দেব”। চিৎকার শুনে আমি উঁকি মারলাম। তারার এমন রুদ্রমূর্তি আমি দেখিনি। থরথর করে কাঁপছে। বিলেরা একটু ঘাবড়ে গেছে, আধ খাওয়া চায়ের কাপ রেখে বেরিয়ে গেল। তবে আমি জানি ওরা কতটা বিষাক্ত। একা মেয়ে দেখলে ওদের দাঁতগুলো ধারালো হয়ে ওঠে নারী মাংসে কামড় বসাবার জন্য। এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। সেই মেয়েটার মাথায় সিঁদুর ছিল না, তারা তার বাড়িতে কাজের সূত্রে আসা পুরুষটিকে জড়িয়ে নোংরা কথা, দরজার শিকল তুলে দিয়ে গ্রামবাসীদের ডাকা, নানাভাবে হেনস্থার শিকার হয়ে সেই মেয়েটা গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিল। তারার মাথায় সিঁদুরের রেখা দেখে তাই ভেবেছিলাম, মেয়েটা বেঁচে যাবে। ভুল ভেবেছিলাম।
তারা কাঁদছিল, সীতারা থেকে তারা হয়েও তার মুক্তি নেই। হিন্দুর গ্রাম, অজস্র মন্দির ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সীতারার এখানে ঠাঁই হত না। জোনাল অফিস থেকে এও বলেছিল, একা মেয়ে দেখলেই উৎপাত শুরু হবে, বিবাহিতা সেজে যাও। ছ’মাসের মধ্যে এই রকম পঞ্চাশটি গ্রামের দরিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারগুলি থেকে স্ত্রীরোগে ভুগছে এমন মহিলাদের ডেটা তৈরী করে পাঠাতে হবে একটি এনজিও সংস্থাকে। তারপর তাদের আসল কাজ শুরু হবে। তারাদের কাজ শুধু গ্রাউন্ড লেভেলে। ডেটা পাঠাবার পর এক্সপার্ট টিম অ্যানালিসিস করে কাজ শুরু করে দেবে।
তারা ফোনটা ব্যাগ থেকে বার করল। ফেরার পর হাত পা ধুয়ে সবে রান্নাঘরে ঢুকেছে তখনই আপদগুলো এল। দু’বার ফোন করার পরও প্রতীক যখন ফোনটা ধরলনা, একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিল, ‘আরজেন্ট, কল মি’। প্রতীকের ফোন এল রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর। একটু যেন গম্ভীর গলা। ‘সীতারা, বাড়িতে কিছুতেই তোমাকে মেনে নেবে না। আমাদের বরং আর যোগাযোগ না রাখাই ভালো’।
‘একটা শিক্ষিত ছেলে হয়ে তুমি হিন্দু মুসলিম বিভেদ করছ? আমার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার আগে একবারও মাথায় ছিলনা এই বিভাজনের কথা?’ তারা গলার শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করে। প্রতীক, চাকরি পাবার পর থেকেই একটু একটু করে পাল্টে যাচ্ছিল। সীতারার খুব ভয় করত, কিন্তু সে লক্ষ্য করল সাময়িক উত্তেজনার বশে সে চিৎকার করে উঠেছিল ঠিকই কিন্তু এখন যেন ভয়টা একটু একটু করে কমে যাচ্ছে। নিশ্চিন্ত মনে শুয়ে পড়ল, কিন্তু শুলেই কি ঘুম আসবে? একটু পরেই তো কে যেন তার নাম ধরে ডাকবে, ‘সীতারা, এই সীতারা…’। প্রতি রাত্রের মতই সে আতঙ্কে উঠে বসবে, গ্রামের লোকেরা বুঝি জেনে গেল তার পরিচয় গোপন করার কথা? কেউ থাকে না, শুধু বাতাস যেন ফিসফিস করে কানে কানে কী যেন বলে যায়।
কটা দিন ব্যস্ততার মধ্যে কেটে গেল। আসা যাওয়ার পথে বিলে বা তপনকে দেখা যায়নি। ধমকানি খেয়ে অসভ্য ছেলে দুটো শুধরে গেল নাকি? লক্ষণ ভালো লাগছে না। ঝড়ের পূর্বাভাষ নয়তো! বাতাসে কীসের যেন একটা গন্ধ টের পায় তারা। নাক টেনে গন্ধটা বোঝার চেষ্টা করে, তারপর হনহন করে হেঁটে যায়।
ঠিক এক সপ্তাহ পরে এক ঝড় জলের রাতে চোখ দুটো একটু লেগে এসেছিল তারার। ছাদের টালি সরিয়ে ঝুপ ঝুপ করে জনা চার তার ঘরে ঢোকার পর তারার ঘুম ভাঙে। বড্ড দেরী হয়ে গেছে। প্রতিরোধ করার সময়টুকু মেয়েটা পায়নি।
এই প্রথমবার আমি জোরে ডেকে উঠলাম সীতারা…জানি না অশরীরী গলার স্বর কোন মন্ত্রবলে আজ পালটে গেল! মেয়েটা চিৎকার করে উত্তর দিল, হ্যাঁ আমি সীতারা, সীতারা খাতুন। ওরা মনে হয় একটু থামল, তারপর নতুন উদ্যমে মেয়েটাকে ছিঁড়ে ফেলতে লাগল আদিম উল্লাসে। লুঠ হয়ে যেতে যেতে তারা শুধু ভাবছিল নারীর নরম মাংসের কোনও ধর্ম হয় না।

এই সময়ের পরিচিত গল্পকার। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লিখছেন। পেয়েছেন কিছু সাহিত্য পুরস্কার। ছোটগল্পের পাশাপাশি লেখেন উপন্যাস। প্রকাশিত হয়েছে একাধিক গ্রন্থ। পেশায় শিক্ষিকা।