দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর এই একটু সময় লাজু’র নিজের। অন্তত ঘন্টা খানেক নিশ্চিন্ত। চৈত্র মাস প্রচন্ড গরম। ঘরের ঠিক মধ্যিখানে একটা সবুজ রংয়ের সিলিং ফ্যান। ফ্যানটা নানা রকম শব্দ করে ঘুরছে কিন্তু বাতাস যেন কোনোভাবেই গায়ে লাগছেনা। লাজু খাবার দাবার গুছিয়ে মিটসেফের মধ্যে রেখে ফ্যানের নীচে পাতা শীতল পাটিতে বসে খানিক্ষণ জিরোয়। পাশেই মেয়েটা ঘুমুচ্ছে। গরমের ঘুম বড্ড গাঢ়। মোয়েটা ঘুমানোর আগে টিভিতে কার্টুন দেখছিল সেটাই চলছে। লাজু চ্যানেল পাল্টায়। পুরোনো টিভি, জাভেদ কোথা থেকে যে সেকেন্ডহ্যান্ড টিভিটা জোগাড় করোছে কে জানে? টিভিটার সাউন্ড ঠিক থাকলেও কালার পরিস্কার বোঝা যায়না। আজকাল কেউ সেকেন্ডহ্যান্ড জিনিস কেনে? আজকাল কিস্তিতে কত টিভি পাওয়া যায়, এই লোক কেমন করে শুধু টাকা বাঁচাবে তার বাহানা খোঁজে, মনে মনে গজগজ করতে থাকে লাজু।
এইযে একতলা টিনসেড বাসাটায় তারা থাকে সেটাও টাকা বাঁচানোর চেষ্টা। আর এক-দেড় হাজার টাকা বাড়ালেই ভালো একটা বিল্ডিং এ ফ্লাট ভাড়া নেওয়া যায়, কিন্তু সেটা করলে তো? এদিকে বর্ষায় বাসার সামনে পানি জমেআর গরমেও পুড়তে হয়, তার উপরে নীচতলা তাই মশা আর ছিঁচকে চোরের অত্যাচার তো লেগেই আছে। এইতো সেদিনও ষ্টিলের গ্লাস কয়টা ধুয়ে টেবিলে রেখে মেয়েকে গোসল করাতে গেছে এসে দেখে চারটা গ্লাসই উধাও। টেবিলটা অবশ্য জানালার ধারে। জানালার ধারে কিছু রাখতে ইচ্ছা করেনা লাজুর কিন্তু কি করবে বাসাটা এত ছোট! মোটে দোড়টা রুম। একটা বেডরুম, পাশে ডাইনিং, তার একপাশে বাথরুম কাম টয়লেট আর আরেকপাশে ছোট্ট রান্না ঘর। সামনে টানা একটা বারান্দা হাফ দেয়ালের উপরে লোহার নেট লাগানো। ডাইনিংয়ে একটা খাট বসানোর জন্য জায়গাটা আরো ছোট লাগে। আর না বসিয়েই বা কি? জাভেদের গ্রামের বাড়ি থেকে এ ও আসতেই থাকে। এখন কিছুদিন ধরে বিউটি, জাভেদের বোনের মেয়ে, থাকছে। বিউটি এখানকার মহিলা কলেজে এবার উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছে। সবাই বলে এটা নাকি আগে গ্যারেজ ছিল, বাড়িওয়ালা ওটাকেই কোনমতে ঠিকঠাক করে পাশাপাশি ছয়টা ইউনিট বানিয়ে ভাড়া দিয়েছে।
জাভেদ যে চাকুরী করে সেটা খুব একটা খারাপ না, মাসের খরচ শেষে বেতনের অর্ধেকটাই বেঁচে যায় তারপরেও একটু স্বস্তির চেষ্টা করে না। লাজুর বিরক্ত লাগতে শুরু করে।
পোষা বিড়ালটা বেডরুমের জানালা দিয়ে লাফিয়ে নামে, মিউ মিউ করতে করতে লাজুর গা ঘেষে বসে। লাজু উঠে গিয়ে বিড়ালটার জন্য রাখা মাছের কাঁটার ঢাকনা সরিয়ে ওটাকে খেতে দেয়। বিউটির খোঁজে একবার বারান্দায় উঁকি মারে, দেখে পড়ছে। এই এক মেয়ে সারাক্ষন বইয়ের মধ্যে মাথা গুঁজে রাখে।
বাইরে মোস্তফা ফেরিওয়ালার হাঁক শোনা যায়, “এই লেইস, ফিতা ….।” লাজু বারান্দা দিয়ে উঁকি দিতেই মোস্তফা ফেরিওয়ালা সালাম দেয়, বলে,
-আপা কিছু রাখেন
– আচ্ছা আসেন
দরজা খুলে দিলে মোস্তফা ফেরিওয়ালা ভিতরে ঢুকে ফ্লোরে তার কাঁচের ঢাকনা ওয়ালা কাঠের বাক্সটা রেখে আস্তে ধীরে পীঠের ময়লা হয়ে যাওয়া সাদা কাপড়ের বোঝাটা নামায়। ফেরিওয়ালা এসেছে বলে আশেপাশের দু-এক ঘরের মেয়েরা, বাচ্চারা ভীড় করে। লাজু বারান্দায় সবার জন্য জায়গা করে দেয়।
মোস্তফা ফেরিওয়ালা প্রথমে তার কাঁচের ঢাকনাওয়ালা বাক্সটি খোলে। রংবেরঙের পুঁথি, পাথর বসানো কানের দুল, চকচকে সোনালী লকেট সমেত গলার চেইন, পুঁথির মালায় ভর ভরন্ত সেখানে। লাজু গোলাপী পুঁথির একটা মালা তার মেয়ের জন্য আলাদা করে রাখতে বলে ফেরিওয়ালাকে। বাক্সটির ঠিক মাঝ বরাবর রাখা একজোড়া সবুজ পাথরের কানের দুলেচোখ আটকে যায় লাজুর। সেটি হাতে নিলেলাজুর বাবার কথা মনে পড়ে যায়। একবার ঈদের আগে জামার সাথে ম্যাচ করে কানের দুল, মালা, চুড়ি এগুলো কিনতে গেলে একজোড়া সবুজ পাথরের কানের দুল বাবা পছন্দ করে দিয়েছিলেন। দোকানদারকে লাজুকে দেখিয়ে হাসতে হাসতে বলেছিলেন এটা আমার প্রিন্সেস ডায়ানাকেই মানাবে। বাবা তাকে ডায়ানা বলে ডাকে। ক্লাস নাইন এ এস এস সির রেজিষ্ট্রেশন করার সময় যে পাসপোর্ট সাইজ ফটো তোলা হয়েছিল তার এক কপি পুরুনো ম্যাগাজিনের পাতা থেকে নেওয়া প্রিন্সেস ডায়ানার ফটোর পাশে রেখে কত দুপুর শুধু ভেবে কাটিয়েছে লাজু, ”আমি কি সত্যিই এতটা সুন্দর!”কি রকম ছেলেমানুষ ছিলোএখন ভাবলেও হাসি পায়,লাজুর। দুল জোড়াও আলাদা করে রাখতে বলে লাজু মোস্তফা ফেরিওয়ালাকে।
এর পর মোস্তফা ফেরিওয়ালা তার বোঝাটার গিঁট খুলল, সেখানে বেশ কয়েকটা কাগজের বক্সের মধ্যে থরে থরে সাজানো খাজানা। প্রথম বাক্সতে চুলের ফিতা, লেইস, চুলের কাঁটা, আলগা খোপা, বেবি ক্লিপ, হেয়ার ব্যান্ড সহ আরোও কত কি! দ্বিতীয় বাক্সে কাঁচের, ইমিটিশনের আর জয়পুরী চুড়িতে ঠাসা। নিজের হাতের রং জলা চুড়ি দুটোর দিকে লজ্জা লাগতে থাকে তার। সবার অলক্ষ্যে খুলে পাশের টেবিলের উপরে রেখে চুড়ি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একজোড়া ময়ূরকন্ঠি রঙের জয়পুরী চুড়ি খুব পছন্দ হয় তার। লাজু মুগ্ধ হয়ে চুড়ি গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে, মেটালের ফ্রেমের উপরে দুটো ময়ূর মুখোমুখী, সোনালী আলোকচ্ছটা তাদের সারা গায়ে, ময়ূর চোখে, সারা পেখম জুড়ে ছোট ছোট কুন্দনের কারুকাজ, আর পেখম দুটো যে প্রান্তে মিলে গেছে সেখানে একটা নকশী পদ্ম, নাকের কাছে এনে এখুনি ঘ্রান নিতে ইচ্ছা করবে! লাজু আর স্থির থাকতে পারেনা নিজের সাইজমত এরজোড়া নিয়ে হাতে পড়ে ফেলে। চুড়ি জোড়া তার হাতে খুব মানিয়েছে, লাজু নিজের হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে, হাত নাড়িয়ে শব্দ করে। লাজু চুড়ির দাম জিজ্ঞেস করলে মোস্তফা ফেরিওয়ালা বলে ,
জোড়া বার’শ , আপা
একটু বেশী, না?
আপা অরিজিনাল জয়পুরী, কালার নষ্ট হবে না
লাজু দ্রুত হিসাব করে হাতে কত টাকা আছে। জাভেদ আলাদা করে তাকে হাত খরচ দেয় না। বাজারের টাকা যা দেয় সেটাও বেশ হিসাব করে। বাজারে যাওয়ার সময়টা তাই সে হেঁটে যায়, মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে হেঁটে বাসায় ফেরে, এভাবে কয়টা টাকা জমে আর নিজের বাবা, ভাই এলে জোর করে কিছু গুজে দিয়ে যায়। বেশীরভাগ সময়েই তার শখটা স্বপ্নতেই রয়ে যায়, কোনো কোনো সময় প্রয়োজনগুলোও তাই। লাজু দেখল যা টাকা আছে তাতে হয়ে যাবে তাছাড়া গত ঈদের মেয়ের সালামীর টাকাটা আছে ওটা থেকে নিয়ে আবার পরে ভরে রাখলেই হল।
এদিকে মোস্তফা ফেরিওয়ালা ইতিমধ্যে তার বাকী দুটো বাক্স ও মেলে ধরেছেন। একটাতে ওড়না আর থ্রিপিস আর অন্যটাতে থরে থরে রুবিক্রাউন, লাইক মির বাক্স। পাশের বাসার এক ভাবীর ইশারায় লাজু ও রুবিক্রাউনের বক্স থেকে নিজের মত দুটো আলাদা করে। এদিকে আরেক ভাবী একটা ফিরোজা রঙের ওড়না হাতে নিয়ে অনেকক্ষন ধরে আর জামাইয়ের সাথে কথা বলছিল।
লাজুর কানে এল ঐ ভাবী ক্রমাগত তার বরকে জিজ্ঞেস করছে সে সেটা কিনবে কিনা। লাজু আন্দাজ করে ওপাশ থেকে প্রশ্ন আশে কত দাম? ভাবীর উত্তর শোনা যায় তিন’শ পঞ্চাশ টাকা। লাজু জানে এই ভাবী একটা স্কুলে চাকুরী করে। সে ভাবে একটা ওড়না কেনার জন্য মহিলা’র স্বামীর অনুমতির প্রয়োজন পড়ল কেন? লাজু খেয়াল করল ভাবীটা মোস্তফা ফেরিওয়ালাকে ওড়নাটা ফেরৎ দিল। মোস্তফা ফেরিওয়ালা তাকে জিজ্ঞেস করল,
-আপা নিবেন না?
– না দাম বেশী, মার্কেট থেকে নিব
-আপা মার্কেটে আমার থেকে কম দামে দিতে পারবে না, আমার দোকান ভাড়া নাই, সীমিত লাভে বিক্রি করি, আপা পছন্দ হইলে নিয়া নেন।
-না, থাক
ভাবীর গলার স্বরটা কেমন বিমর্ষ শোনায়। উনি নেড়ে চেড়ে দেখতে থাকেন অন্য কে কি নিল। হঠাৎ লাজুর চোখ যায় ময়নার দিকে। এতকক্ষন ময়না একটা রানী কালারের ওড়না গায়ে ফেলে দেখছিল। লাইজু মনে মনে ভেবেছিল ময়নার জন্য সে ওড়নাটা কিনে দেবে। কিন্তু এখন ময়না একটা দেড় হাজার টাকা দামের থ্রিপিস নিয়ে দেখছে। লাজু ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে ময়না বলে,
-দেখেন মামী কি সুন্দর, কিনতে পারলে ভাল হত
-হুম অনেক দাম। অন্য কিছু দেখবা? ওড়নাটা দেখছিলা…
– না অন্য কিছু না, এইটাই পছন্দ হইছে
লাজু ‘র মন এই অবুঝ বালিকার মনে দুঃখ দিতে চায়না। সে মনে মনে হিসেব করে ময়নাকে থ্রিপিসটা কিনে দিতে হলে কি কি বাদ দিতে হবে? ময়ুরকন্ঠী রঙের চুড়ি জোড়া সবার আগে বাদ পড়ল, তারপরে আরও….
মোস্তফা ফেরিওয়ালা চলে গেছে অনেকক্ষন ময়না নতুন থ্রিপিস পেয়ে গুন গুন গান গাচ্ছে। লাজুর চোখে এখনো ভাসছে ময়ূরকন্ঠী রঙের চুড়ি জোড়া। নিজের হাতের রং উঠে যাওয়া চুড়ি দুটো সে আর হাতে পড়ে না। বাবার মুখটা বড্ড মনে পড়ছে আজ।

সায়মা আরজু’র পড়াশুনা ইংরেজি সাহিত্যে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েে। ব্যক্তিগত আগ্রহ থাকার কারনে ল্যাঙ্গুয়েজ লার্নিং ডিজএ্যাবিলিটি বিষয়ে পিএইচডি গবেষণা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রজীবনে পত্রিকায় কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে লেখালেখির শুরু হলেও তার লেখা বেশ ক’টি ছোট গল্প পাঠক নন্দিত। ব্যাক্তি জীবনে তিনি শিক্ষকতা ও গবেষনার কাজে জড়িত।