| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: একাকিনী শেষের কথা (পর্ব-১৭) । রোহিণী ধর্মপাল

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
ভীম গভীর ভাবে ঘুমিয়েছিলেন। তবুও দক্ষ যোদ্ধার মতোই দ্রৌপদী ঘরে পা রাখা মাত্রই তাঁর মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠেছিল। তিনিও দ্রৌপদীকে জড়িয়ে ধরলেন।
 “কী হয়েছে কৃষ্ণা? এত রাতে তুমি পাকশালার ঘরে? কী হয়েছে”?
“তুমি জিজ্ঞেস করছ ভীম? কী হয়েছে? তবে আমি আর কোথায় যাব”!
“অস্থির হয়ো না পাঞ্চালী। স্থির হও”। 
“স্থির হতে বলছ আমাকে! তোমরা নিজেরা এত স্থির আছ কী করে! তোমার দাদা এত উদাসীন শীতল আছেন কী করে! স্ত্রীকে বারবার চূড়ান্ত অপমানিত হতে দেখেও তিনি নীরব! নিজের পরিবারকে যিনি বারবার বিপদে ফেলছেন, তিনি সাম্রাজ্য সামলাবেন কিভাবে! এই দমবন্ধ করা অজ্ঞাতবাস পর্ব শেষ হলে প্রতিশোধ নেবেন কী করে! আবার হয়ত দুর্যোধন কর্ণ মিলে আর একটা জঘন্য পরিকল্পনা করবে আর তোমরা দাদার পিছু পিছু সেই ফাঁদে পা দেবে”! 
“পাঞ্চালী! দয়া করে মাথা ঠাণ্ডা করো। তোমার ক্ষোভ বুঝতে পারছি। কিন্তু এবার সংযত হও”।
 
“ভীম! কোনও এক রাতে, ইন্দ্রপ্রস্থে, তুমিই আমাকে জানিয়েছিলে কেমন করে তোমরা বারাণবতের জতুগৃহ থেকে পালিয়েছিলে। তোমরা নিজের হাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলে সেখানে। আগে থেকে প্রস্তুত সুড়ঙ্গে তোমার সাহায্যে বাকিরা সহজেই সেই বিপদ থেকে পার হয়েছিল। তুমি কি খবর রেখেছিলে পরে কী হয়েছিল? কেন দুর্যোধনরা আমার স্বয়ংবর সভার আগে তোমাদের খোঁজ করার কথা ভাবেই নি! বরং নিশ্চিন্ত ছিল যে তাদের পথের কাঁটা সরে গেছে! তোমরা মারা গেছ! পাঁচ ভাই আর মা কুন্তী পর্যন্ত”! 
“জানব না কেন কৃষ্ণা! অদ্ভুত ভাবে ওই আগুনে পাঁচ নিষাদ ভাই আর তাদের মা পুড়ে মারা গেছিল। নেহাতই দুর্ঘটনা! তবে আমাদের লুকিয়ে থাকতে সেই খবর সত্যিই সাহায্য করেছিল। কিন্তু এখনকার ঘটনার সঙ্গে হঠাৎই এই পুরোনো কথা কেন তুললে তুমি”?
 
“তুলছি। এটা বোঝাতে যে তুমি সত্যিই সহজ মানুষ। তোমার দাদা তেমন নন। এমনকী কুন্তী মাও নন। যদিও তাঁর মনে তখন শুধুই নিজের ছেলেদের বাঁচানোর চিন্তা। পরে তাঁর কতটা অনুতাপ হয়েছিল, জানিও না। কিন্তু মহারাজ যুধিষ্ঠির পরেও একেবারেই শান্ত ছিলেন। এই ভয়ানক পরিকল্পিত হত্যা, নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে, তাঁকে কখনও বিচলিত করে নি”।
“কী বলছ কী তুমি! হত্যা! নিরীহ মানুষকে! মহারাজ! মা! তুমি কি উন্মাদ হয়ে গেলে” ??
“না মধ্যম পাণ্ডব। শোনো তবে। কাউকে বলিনি কখনও একথা। ছোটবেলা থেকে বাবা আমাকে লাঠিখেলা শিখিয়েছিলেন। মাছ ধরতে শিখিয়েছিলেন। জঙ্গলে কিভাবে বেঁচে থাকতে হয়, আমি আর ভাই ধৃষ্টদ্যুম্ন, দুজনেই জানি। সেই সময়ে জঙ্গলের মানুষদের সঙ্গে আমি মিশেছি। মাছ ধরা আমাদের শিখিয়েছিল নিষাদ গোষ্ঠীরই এক মা। তখন তাদের পরিবারের সঙ্গেও আমরা মিশেছি। ভাবতেও পারবে না কী সহজ জীবন। কী সাধারণ যাপন। কত অল্পেই খুশি। তাদের বুঝি আমি। তোমাদের থেকে অনেক ভালো করে। সেই নিষাদদের মধ্যে এমন একটি পরিবার খুঁজে বার করা হয়েছিল, যেখানে শুধু মা আর তাঁর পাঁচ ছেলে। ঠিক তোমাদের মতোন। বেচারাদের কেউ তো নেমন্তন্ন করে। তাদের আলাদা করে ভালো খাবার খাওয়ানোর পর অঢেল পানীয় খাওয়ানো হয়েছে। যাতে তারা অচেতন হয়ে পড়ে। তারপর সেই ঘুমন্ত নিষাদ পরিবারকে রেখে আগুন ধরিয়ে তোমরা পালিয়েছ! আগুনে ভয়ঙ্কর আঁচ গায়ে লেগে নিশ্চয়ই তাদের নেশা কেটে গেছিল। ছটফট করে এদিকে ওদিকে দৌড়ে বেরিয়েছিল। কিন্তু তখন তো চারিদিক দাউদাউ করে জ্বলছে। লেলিহান সেই শিখায় তোমরাই উজ্জ্বল হলে। আর ওরা পুড়ে মরল”। 
হাঁপাচ্ছিলেন কৃষ্ণা। একে তো সারা অন্তরে ক্ষোভ। তারপর এতদিন পরে গোপনীয়তা বজায় রেখেও নিজের ছোটবেলার কথা বলে দিলেন। তাঁর মনে হয় ওই নিষাদ মা তো তাঁর মাও হতে পারত। কোনও দিন যদি যুধিষ্ঠির জানেন, তিনি আসলে কে, তবে তাঁকেও মেরে ফেলতে হয়ত দ্বিধা করবেন না!

আরো পড়ুন: একাকিনী শেষের কথা (পর্ব-১৬) । রোহিণী ধর্মপাল
 
 “হে ভীম! তোমাদের শক্তি অপরিসীম। বিশেষ করে তোমার আর অর্জুনের। কিন্তু আজ দেখো, মহারাজ যুধিষ্ঠিরের জন্য তোমরাও কেমন বিড়ম্বিত জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। তোমরা তোমাদের দাদাকে এত ভালোবাসো, শ্রদ্ধা করো, তোমাদের হয়ত কিছু মনে হয় না। কিন্তু আমার তো সেটাও খারাপ লাগে। আর সত্যিই বলছি, সকলে মনে করে আমি সম্রাজ্ঞী। অথচ এখন আমি রাণী সুদেষ্ণার কথায় ওঠবোস করি। রাণীর কথাতেই তো আমাকে কীচকের ঘরে যেতে হয়েছিল। তুমি কি মনে করো এমন অপমান আমার প্রাপ্য”? 
ভীম মাথা নিচু করে শুনছিলেন। তাঁর ভেতরটা দ্রৌপদীর দুঃখে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিল। দ্রৌপদী চুপ করলে তাঁর হাত দুটো ধরলেন ভীম। দুটি হাতেই কড়া পড়ে গেছে। চন্দন বাটা থেকে আরও বিভিন্ন অনুলেপন তৈরি করতে করতে নখগুলি কালচে হয়ে গেছে। পদ্মফুলের মতো নরম হাত দুটি এখন কর্কশ। সেই হাত দুটি ধরে ভীম বললেন, “পাঞ্চালী, বিশ্বাস করো, তোমার প্রতিটি অপমান আমার বুক আগুনের মতো পোড়ায়। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার শক্তি আর অর্জুনের অস্ত্রশিক্ষাকে ধিক্! কী হবে এত জোর আর শিক্ষা নিয়ে! নিজের কাছের মানুষকেই যদি রক্ষা করতে না পারি! সভায় আজ মনে হয়েছিল কীচকের গুষ্টির তুষ্টি করি! মেরে মেরে হাড়মাংস এক করে দিই। কিন্তু তা করলে সত্যিই ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যেত! এতগুলো বছর যে আমরা এত কষ্ট করলাম, তা মুহূর্তে নষ্ট হয়ে যেত! তুমি দয়া করে আর পনেরোটা দিন ধৈর্য্য ধরো। তারপরেই এই ভয়ানক অসভ্যতার ফল কীচক পাবে”। 
“অপেক্ষা! এবারেও!! পনেরো দিন! আমার তো একটা মুহূর্তও সহ্য হচ্ছে না আর! এমন কত লাঞ্ছনা আমাকে মানতে হবে? আর কত অপমান লোকে আমাকে করবে? আর যুধিষ্ঠির বসে দেখবেন! অর্জুন শুধু ব্রাহ্মণের গরু বাঁচাতে অস্ত্র তুলবেন! আর তুমি বিরাটের মনোরঞ্জন করবে কুস্তি লড়ে আর রান্না করে খাইয়ে! বরং কীচক আবার আমাকে ধরুক, আবার আমাকে তার শয্যাসঙ্গিনী হতে বলুক, আমি না বলি, আর মার খাই! আমি মরে গেলেও বা কী এসে যায় তোমার! তোমাদের! এই কীচক যদি কাল সূর্য ওঠার পরেও বেঁচে থাকে, তাহলে জেনো আমি আত্মহত্যা করব। বিষ খাব! তোমার সামনেই। তুমি দেখো, তোমার প্রিয়া, তোমার বুকেই শেষ নিঃশ্বাস ফেলবে”!!
error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত