কে এই দেবী বিন্ধ্যবাসিনী
জামাইষষ্ঠীতে পূজিত হন বিন্ধ্যবাসিনী। কে এই দেবী কোথায় পূজিতা হন এই দেবী? এমন জানা অজানা তথ্য জানাতে কলম ধরেছেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়।
জৈষ্ঠ্যমাসের শুক্লপক্ষের অরণ্যষষ্ঠী বা জামাইষষ্ঠীর দিনটিতে বিন্ধ্যবাসিনী পূজিতা হন। দুর্গাপুজোর মতই পুজো চলে। আর পাঁচদিনের মাথায় শুক্লা দশমীতেই গঙ্গাপুজো বা দশহরা বা দশেরা।
আমার জন্মস্থান আড়িয়াদহের অন্যতম বিন্ধ্যবাসিনী তলায় আজ মহা ধুমধাম করে মেলা এবং পুজো হচ্ছে।
কিন্তু কে এই দেবী বিন্ধ্যবাসিনী? ইনি মা দুর্গার আরেক রূপ।
পুরাণ মতে, দ্বাপর যুগে এই দেবী যশোদার গর্ভে কন্যা রূপে জন্ম গ্রহণ করেন।
তখন মথুরার রাজা অত্যাচারী নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী শাসক কংস যিনি নিজের পিতা উগ্রসেনকে বন্দী করে স্তব্ধ করেছেন জনগণের প্রতিবাদ। শুনেছেন দৈববাণী–নিজ ভাগ্নের হাতে তিনি নিহত হবেন।শত্রুর শেষ রাখতে নেই।নিজ ভগ্নী দেবকী আর ভগ্নীপতি বসুদেবকেও কারাগারে নিক্ষেপ করেছেন। ভগ্নীর শিশু সন্তানদের একের পর এক নিহত করে পথের কাঁটা উপড়োতে উদ্যত।দেবকীর বুকফাটা কান্নায় এতটুকু দুর্বল হননি দুর্বিনীত কংস।
এদিকে ভাদ্র মাসের অষ্টমী তিথিতে গোকুলে নন্দপত্নী যশোদার গর্ভে জন্ম নেয় এক অপরূপ লাবণ্যবতী কন্যা। আর ওদিকে মথুরায় কংস একে একে তখন বসুদেব-দেবকীর প্রতিটি সন্তানকে হত্যা করে চলেছেন ।
জমাটবাঁধা গাঢ় অন্ধকার রাতে দেবকীর অষ্টম গর্ভে কৃষ্ণের জন্ম। সেরাতে শঙ্খ, উলুধ্বনি হয়নি । মথুরার চারিদিকে আর্তমানুষের হাহাকার।আকাশে মেঘের ঘোর ঘনঘটা, মুহুর্মুহু বিদ্যুতের ঝিলিক উপেক্ষা করে সেই ঝড়জলের রাতেই দৈবানুগৃহীত হয়ে বসুদেব নিজের মাথায় করে সদ্যজাত কৃষ্ণকে নিয়ে যমুনা পেরুলেন।
কৃষ্ণের জন্মের ঠিক পরেই বসুদেব নিজের পুত্র কৃষ্ণকে গোকুলে রেখে সেই কন্যাটিকে চুপিচুপি নিয়ে আসেন মথুরার কারাগারে। তুলে দেন কংসের হাতে। কংস যখন সেই শিশুটিকে কারাগারের দেওয়ালের শিলায় আছড়ে হত্যা করতে যায়, তখনই তার হাত পিছলে সেই শিশু চলে যায় শূন্যে। দেখতে দেখতে ধারণ করে অষ্টভুজা রূপ। এবং কংসকে কে বধ করবে, সে কথা জানিয়ে চলে যায় বিন্ধ্যাচলে। কন্যারত্নটিকে হত্যা করতে গিয়ে কংস বুঝলেন এ মেয়ে যে সে নয়। কন্যা তখন নিজের পরিচয় দিলেন তিনি যোগমায়া।
আকাশে বাতাসে, দিকে দিগঞ্চলে অনুরণিত হয় “তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে” আর সেই থেকে অষ্টভুজারূপে গোকুলে জাত সেই কন্যা যোগমায়া দেবী বিন্ধ্যাচলে অবস্থান করেন এবং বিন্ধ্যাচলে বসবাস করায় বিন্ধ্যবাসিনী নামে পরিচিত হন।
পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে জগন্নাথ এবং বলরামের মধ্যিখানে উপবিষ্টা সুভদ্রাকেও এই বিন্ধ্যবাসিনী দেবী বলা হয়। ইনি দেবী দুর্গার আরেক রূপ একানংশা। হরিবংশে রয়েছে কংসের কারাগারে শিশুকন্যা থেকে যোগমায়া দেবী রূপে উত্তরণের সেই কথা। ” প্রজাপতির অংশ থেকে এই যোগকন্যার উত্পত্তি কৃষ্ণকে রক্ষা করার জন্যই।চতুর্ভুজা দেবী একানংশা বিদ্যুতের ন্যায় গাত্রবর্ণা, সূর্যের ন্যায় নেত্র বিশিষ্টা, আলুলায়িতকুন্তলা, দিব্যমালাপরিহিতা, সর্বাঙ্গ হারে এবং উজ্জ্বল মুকুটে শোভিতা, নীলপীত বস্ত্র পরিহিতা। দেবীপুরাণে বলা হয়েছে দেবীর নামের ব্যাখ্যা। ইনি সমুদয় লোক ব্যাপ্ত করে আছেন পূর্ণরূপে, এক নয়, অংশরূপেও নয়। ডাঃ সুকুমার সেনের মতে প্রকৃত শব্দটি একানংশা না একানংসা । যার অর্থ কুমারী বা অবিবাহিতা স্ত্রী। এই নাম ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে ভদ্রা বা সুভদ্রায় পরিণত হয়েছে কালেকালে।
আবার অন্য মতে, বিন্ধ্যবাসিনীই কৌশিকী। আদ্যাশক্তির কোষ থেকে উৎপন্ন হওয়ায় তাঁর আরেক নাম কৌশিকী। মহিষাসুর বধের পর দুর্গার তেজ থেকে তিনি আবির্ভূতা হয়েছিলেন এই পর্বত শিখরেই। মহিষাসুর বধের কথা শুম্ভ ও নিশুম্ভ জানতে পারলে তারা দেবীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে বিন্ধ্যাচলে যায়। সেখানে দেবী কৌশিকী (বিন্ধ্যবাসিনী) তাদের বধ করেন।
স্কন্দপুরাণ অনুসারে এই দেবী দুর্গাসুরকে বধ করেন। তিনি সহস্র মহাবাহু।প্রতি হাতে ভীষণ সমরাস্ত্রে সজ্জিত।আবার দেবীপুরাণ অনুসারে তিনি দুন্দভী নামে এক ভয়ংকর অসুরকে নিহত করেছিলেন।
নবদ্বীপ মহা রাসযাত্রায় এই দুটি উপাখ্যান মিলিত হয়ে বিন্ধ্যবাসিনী মাতার রূপ বর্ণিত হয়েছে। এখানে মাতা অষ্টভুজা-ত্রিনেত্রা-নীলবর্ণা। সিংহের উপর পদযুগল রেখে উপবিষ্টা। দুই পাশে দুই সখী, জয়া ও বিজয়া। অষ্টভুজা দেবী শুম্ভ ও নিশুম্ভ অসুর বিনাসে যুদ্ধরত। তবে সব জায়গায় দেবীর গাত্রবর্ণ নীল হয় না।
কেউ বলেন বিন্ধ্যবাসিনী-দুর্গা পদ্মাসনা, ত্রিনয়না ও চতুর্ভুজা। শঙ্খ, চক্র, বর ও অভয় মুদ্রা তার চার হাতে। কপালে অর্ধচন্দ্র।সালংকারা এই দেবীকে ঘিরে স্তব করেন ইন্দ্রাদি দেবতারা। দেবীর বাহন সিংহ পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধযাত্রার প্রাক্কালে অর্জুন যে দেবীর স্তব করেছিলেন সেখানে তিনি বিন্ধ্যবাসিনী।
কুঞ্জিকাতন্ত্রে দুর্গা কবচের মন্ত্রে উল্লেখ আছে
কটিং ভগবতী দেবী দাবৃক্ক বিন্ধ্যবাসিনী ।
শোক ও দুঃখ বিনাশের জন্য নাকি দেবী বিন্ধ্যবাসিনী পূজিতা হন।
আবার দেবী কবচেও এই দেবীর নাম রয়েছে।
কট্যাং ভগবতী রক্ষেজ্জানুনী বিন্ধ্যবাসিনী
জঙ্ঘে মহাবলা রক্ষেত্সর্বকামপ্রদায়িনী।
.
![ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়](https://irabotee.com/wp-content/uploads/2019/11/IMG_20191109_234925-150x150.jpg)
উত্তর কলকাতায় জন্ম। রসায়নে মাস্টার্স রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। বিবাহ সূত্রে বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। আদ্যোপান্ত হোমমেকার। এক দশকের বেশী তাঁর লেখক জীবন। বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস সানন্দা পুজোসংখ্যায়। এছাড়াও সব নামীদামী বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখে চলেছেন ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ এবং ফিচার। প্রিন্ট এবং ডিজিটাল উভয়েই লেখেন। এ যাবত প্রকাশিত উপন্যাস ৫ টি। প্রকাশিত গদ্যের বই ৭ টি। উল্লেখযোগ্য হল উপন্যাস কলাবতী কথা ( আনন্দ পাবলিশার্স) উপন্যাস ত্রিধারা ( ধানসিড়ি) কিশোর গল্প সংকলন চিন্তামণির থটশপ ( ধানসিড়ি) রম্যরচনা – স্বর্গীয় রমণীয় ( একুশ শতক) ভ্রমণকাহিনী – চরৈবেতি ( সৃষ্টিসুখ) ২০২০ তে প্রকাশিত দুটি নভেলা- কসমিক পুরাণ – (রবিপ্রকাশ) এবং কিংবদন্তীর হেঁশেল- (ধানসিড়ি)।অবসর যাপনের আরও একটি ঠেক হল গান এবং রান্নাবাটি ।