উত্তরসূরি থাকলেও পূর্বসূরি নেই । ফেরদৌস মাহমুদ
‘কবিতার কোনো মানে থাকে না―এটা সকলে বোঝে না। কোনো কোনো কবিতার হয়তো মানে হয় কিন্তু পাঠের পর তোমার ভিতরে তো একটি অনুভূতি জাগে। সেই অনুভূতিই আসল।’―কবিতায় অনুভূতির চেয়ে অহেতুক মানে খোঁজা কতিপয় লোকের উদ্দেশে কথাটি যিনি বলেছিলেন তিনি বিনয় মজুমদার। প্রয়াত হয়েছেন ২০০৬ সালে। তাঁর মৃত্যুতে ভারত সরকার আলাদাভাবে কোনো শোকসম্মেলনের আয়োজন করেনি, কিন্তু বহু তরুণ বাঙালি কবিই মনে মনে শোকার্ত হয়েছিলেন। শোকার্ত হয়েছিলাম বাংলাদেশে বসে আমরাও, কেউ কেউ। বিনয় মজুমদার চাইলেই বড় ইঞ্জিনিয়ারের জীবনযাপন করতে পারতেন কিংবা ভোগ করতে পারতেন জীবনের অগাধ প্রাচুর্য। কিন্তু তিনি তা করেননি বরং মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে জীবনের অনেকখানি সময় বসবাস করলেন কলকাতা থেকে দূরে কখনো ঠাকুর নগরের শিমুলপুর গ্রামে, কখনো-বা পাগলাগারদে। এরপরও এই বৈরী পরিস্থিতিতে লিখে গেছেন কবিতার পর কবিতা, সাজিয়ে গেছেন পৃথিবীবাসীর উদ্দেশ্যে ভাবনার পিঠে ভাবনা! তাঁর কবিত্বশক্তি আর চিন্তার অভিনবত্বের দিকে তাকালে মনে পড়ে মধ্যযুগে ইউরোপের প্রচলিত কিছু ধারণার কথা। ওই সময়ে ইউরোপে পাগল কিংবা উন্মাদদের ঐশ্বরিক গুপ্তজ্ঞানের অধিকারী ভাবা হতো। ফলে ওই সময়ের জনগণ একটু বাড়তি শ্রদ্ধা-ভক্তি করতেন তাদেরকে ঈশ্বরের পাগল প্রতিনিধি হিসেবে। তখনকার সমাজে কোনো পাগলাগারদ ছিল না, পাগলরা সাধারণ মানুষের মধ্যেই বাস করতো সম্মানের সঙ্গে। কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে দেখা চোখে পৃথিবী যত এগিয়ে আসলো, যুক্তির পৃথিবী থেকে পাগলদের ততই অস্বাভাবিক মনে হতে লাগলো আর তাদের পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো পাগলা গারদে!
বিনয়ের ক্ষেত্রে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, তিনি ছিলেন ঈশ্বরের পাগল প্রতিনিধি। যাকে ভদ্রভাষায় বললে বলতে হয় অসম্ভব প্রতিভাবান একজন মৌলিক কবি ও দার্শনিক। এখানে দুটো শব্দ ‘মৌলিক কবি’ ও ‘দার্শনিক’-এ এসে হয়তো অনেকের চোখ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠতে পারে!
আমি এই লেখায় অল্প কথায় এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করব তিনি যে নতুন ধরনের কবিতা লিখেছেন, ওই কবিতাগুলি পৃথিবীতে কিভাবে নতুন। তবে এর আগে বিনয় মজুমদারের বাংলাদেশে ঘুরে যাওয়া প্রসঙ্গে কিছু কথা লিখতে চাই।
১৯৬৭ সালে একবার বিনয় মজুমদার বিনা পাসপোর্টে এসেছিলেন বাংলাদেশে (তখন বাংলাদেশকে বলা হতো পূর্ব-পাকিস্তান) এবং এখানকার পুলিশ স্টেশনে স্বেচ্ছায় ধরাও দিয়েছিলেন। বিচারাধীন বন্দি হিসেবে এখানকার জেলে কাটিয়েছিলেন ছয় মাস। ধারণা করা হয়, তার আচরণের ওই দিকটা ছিল―জটিল কোনো মানসিক ব্যাধির প্রাথমিক লক্ষণ। এভাবে বিনা পাসপোর্টে তাঁর এদেশে আসাটাকে কি কেবল মানসিক ব্যাধিই বলা ঠিক হবে, নাকি অন্য কোনো বিষয় এর মধ্যে লুকিয়ে ছিল! তাঁর পূর্বপুরুষের শিকড় তো এদেশের মাটিতেই গাঁথা ছিল। তিনি কি তবে মেনে নিতে পারেননি ধর্মের নামে ব্রিটিশদের চতুর দেশভাগ-নীতি; মেনে নিতে পারেননি নিজের ভাষার দেশে আসার জন্য পাসপোর্ট করার রীতিকে! আমরা জানি বাংলাদেশের এবং পশ্চিমবাংলার অনেকে এখনো এই দেশভাগটাকে অভিশাপ হিসেবেই দেখে। আজও অনেকেই স্বপ্ন দেখেন সারা বাংলা ভাষাভাষীদের নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠনের! এমনও অনেক আসাম বা ত্রিপুরাবাসী আছেন যারা বাংলাদেশকে নিজের দেশ ভাবতেই ভালোবাসেন। এদেশে বেড়াতে আসলে তারা আবেগাপ্লুত হয়ে এদেশের মাটিতে চুম্বন করেন। কবি বিনয় মজুমদারের এভাবে বিনা পাসপোর্টে বাংলাদেশে প্রবেশ করে পুলিশের কাছে ধরা দেওয়াটাকে ‘রাষ্ট্র’ সম্পর্কে প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক ধারণার বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ হিসেবেই দেখা যায়। বিনয় মজুমদারের জবানবন্দিতেই বিষয়টা শোনা যাক―‘পূর্ব পাকিস্তানে পালিয়ে থাকার সময় একদিন নিজেই হাজির হলাম পুলিশের কাছে। ওদের বললাম, আমাকে আর ভারতবর্ষে ফিরে যেতে বলবেন না। যদি দরকার হয় আমি মুসলমান হয়েই থাকব এইখানে, যেখানে আমার বাবা জন্মেছিলেন।’ (সূত্র. ‘যোগসূত্র’)
মহান চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকও মেনে নিতে পারেননি বাংলা ভাগের বিষয়টাকে। এই মেনে নিতে না পারার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই তাঁর প্রায় সব সিনেমাতেই। অকাল প্রয়াত মহান মাতাল চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে বিনয় মজুমদারের দেখা হয়েছিল পাগলা গারদে। ঋত্বিক ঘটক বিনয় মজুমদারকে ভাবতেন শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ কবি। তিনি ১৯৭১ সালে বিনয় সম্পর্কে লিখিত আকারে ঘোষণা দিয়েছিলেন―‘বিনয় মজুমদার যা লিখেছেন, তাতে তিনি এ শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ কবি। কবিতার সমস্ত পঙ্ক্তির অর্থ করা হয়তো অর্থহীন, কিন্তু সামগ্রিকরূপে শেষ পর্যন্ত একটা অর্থে আসতে বাধ্য, যখন কবিতাটিকে পড়ে শেষ করা হবে’।
২.
বিনয় হচ্ছেন সেই কবি, যিনি মিডিয়ার প্রচারের বাইরে থেকেও দুই বাংলাতেই গুরুত্বের সঙ্গে গুপ্তভাবে পঠিত হতে থেকেছেন। ষাটের দশকে কবি আবুল হাসানের কাছ থেকে নিয়ে আহমদ ছফা প্রথম পড়েন বিনয় মজুমদারের কবিতার বই। আহমদ ছফা ওই বই পড়ে আলোড়িতও হয়েছিলেন। বলা চলে প্রথম থেকেই বিনয় ছিলেন তার সমসাময়িক বাংলাদেশের তরুণ কবিদের কাছে অবশ্যই পাঠ্যের তালিকায়।
বিনয় মজুমদারের সমগ্র কবিতার দুটি খণ্ড রয়েছে। রয়েছে আলাদাভাবে শ্রেষ্ঠ কবিতাও। প্রথম খণ্ডের মধ্যে পাওয়া যায় তার বিখ্যাত ফিরে এসো, চাকা এবং অঘ্রানের অনুভূতিমালাসহ আরও বেশ কিছু বইয়ের কবিতা। বিনয় বেশি আলোচিত তার এই দুটি কবিতার বইয়ের জন্যই। অনেকের ধারণা এই দুটিই তার সেরা কাজ। এরপরে যা লিখেছেন তা হচ্ছে একধরনের পাগলামি। আর এই পাগলামি বলে পরিচিত কবিতাগুলিই রয়েছে তাঁর কাব্যসমগ্র দ্বিতীয় খণ্ডে।
ফলে অনেককেই দেখেছি বিনয়ের ফিরে এসো, চাকা এবং অঘ্রানের অনুভূতিমালা বই দুটির পরের বইগুলির ব্যাপারে উদাসীনতা দেখাতে। এই দুটি বই অনেকের মতো আমার পছন্দের হলেও বই দুটিকে আমি বিনয়ের পরিপূর্ণ মৌলিক কবিতার বই বলে মনে করি না। এ দুটি বইয়ের মধ্যে অসংখ্য স্মরণীয় পঙ্ক্তি কিংবা প্রচলিত অর্থে মুগ্ধতায় বুদ করে দেওয়ার মতো কবিতা যতখানি আছে, নতুনত্বের ছোঁয়া ঠিক ততখানি নেই। একজন কবি গ্রেট কবির মর্যাদা পান পূর্বসূরিদের ছায়ায় থেকে মনোমুগ্ধকর ভালো কবিতা লেখার জন্য নয়, নতুন ধরনের ভালো কবিতা লেখার জন্যই। বিনয়ের ফিরে এসো, চাকা এবং অঘ্রানের অনুভূতিমালা হচ্ছে জীবনানন্দীয় ধারার কাছাকাছিই অসাধারণ দুটি বই, যেখানে স্মরণযোগ্য বিনয়সুলভ অসংখ্য পঙক্তি আছে, কিন্তু পরিপূর্ণ বিনয় মজুমদার নেই।
পরিপূর্ণ বিনয়ের দেখা পাওয়া যায়, পাগলামি বলে খ্যাত তাঁর কাব্যসমগ্র-২ এর কবিতাগুলির মধ্যে। ওই সমগ্রে পাওয়া যাবে তাঁর প্রায় ১০টি কবিতার বই। যেখানে রয়েছে কবিতার নতুন ধারা। অর্থাৎ যে বইগুলিকে আপাত দৃষ্টিতে পাগলামি মনে হচ্ছে কিন্তু দার্শনিকতায়, নিজস্বতায়, কবিতার আঙ্গিকে, বিষয়বস্তু নির্বাচনে, প্রকাশভঙ্গির সহজতায়, গণিতের প্রয়োগে ওইগুলোই হচ্ছে আমার মতে বিনয়ের শ্রেষ্ঠ কাজ এবং বাংলা কবিতা কেন বিশ্ব কবিতার ক্ষেত্রেই নতুন। এছাড়া বিনয়ের একটি ডায়েরির বইও রয়েছে―ওখানকার বেশ কয়েকটি কবিতা পড়েও আমার মধ্যে মুগ্ধতা কাজ করে। তাঁর কাব্যসমগ্র-২ ও ডায়েরি থেকে কিছু কবিতার লাইন বিনা ব্যাখ্যায় তুলে দেওয়া হলো, কেননা―কবিতাগুলির প্রকাশভঙ্গি এতটাই স্পষ্ট, কবিতার বিচারে রহস্যময় আর অলংকারহীণ যে এখানে কবিতাগুলি অনুভূতিপ্রবণ পাঠকের কাছে নিজেই নিজের ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির। হাজির আত্মবিলাপরত শিশুর মেধাবী সারল্যে নতুন চিন্তাকে উস্কে দিয়ে―
‘পাখিরা যেসব কাজ করে থাকে
মানুষেরা তা করতে চায়।
পাখিরা ওড়ে―মানুষও উড়তে চায়।
পাখিরা আকাশ ভালোবাসে
মানুষ আকাশ হতে চায়।
মানুষ কি পাখিদের দুঃখ বোঝে।
মানুষ কি পাখিদের কাছে যেতে পারে।
মানুষের আছে অহংকার―শিল্পের বাসনা
পাখিদের আছে মুক্ত হাওয়া।
পাখিরা কি মানুষদের কাজ করতে চায়।
পাখিরা পদ্ধতি দেখে মানুষের―
মানুষদের বানানো ঘরবাড়ি দেবতার,
মানুষদের কবরখানা চিতার আগুন।
মানুষ কলতলায় দাঁত মাজে।
পাখিদের সমাজে এ দাঁত-মাজা আচরণ নেই
দাঁত-মাজা ব্যাপারটা তাই পাখির অজানা।’
[পাখি ও মানুষ : বিনয় মজুমদারের ডায়েরি থেকে]
২.
যে সব উদ্ভিদ, তরুলতা, আনাজ
ইত্যাদি আমরা প্রাণীরা খাই সেইসব
খাদ্যগুলি গাছ থেকে কাটবার কালে,
ছিড়বার কালে গাছ ব্যথা পেতে পারে।
সুতরাং আমাদের খাদ্য উদ্ভিদ-এর ফল, লতা
আমাদের নখের মতো করলেই হয়। [যেসব উদ্ভিদ : কাব্যসমগ্র―২]
৩.
মানুষের গায়ে এক কেজি মাংস হতে লাগে পুরো
আট কেজি চাল ধরা যাক।
আট কেজি চাল পেতে বত্রিশ টাকা লাগে, মানে
মানুষের শরীরে এক কেজি মাংস গায়ে থাকা অবস্থায়
মূল্য হলো বত্রিশ টাকা।
[মাংসের দাম : কাব্যসমগ্র―২]
৪.
যত দিন ডাব গাছে থাকে
ততদিন ডাবের জলের প্রাণ আছে
যতদিন কমলালেবু গাছে থাকে
ততদিন কমলালেবুর রসে প্রাণ আছে।
[যতদিন গাছে থাকে : কাব্যসমগ্র―২]
৫.
পৃথিবীর ঘাস, মাটি, মানুষ, পশু ও পাখি―সবার জীবনী লেখা হলে
আমার একার আর আলাদা জীবনী লেখা না-হলেও চ’লে যেত বেশ।
আমার সকল ব্যথা প্রস্তাব প্রয়াস তবু সবই লিপিবদ্ধ থেকে যেত।
তার মানে মানুষের, বস্তুদের, প্রাণীদের জীবন প্রকৃতপক্ষে পৃথক পৃথক
অসংখ্য জীবন নয়, সব একত্রিত হয়ে একটি জীবন মোটে; ফলে
আমি যে আলেখ্য আঁকি তা বিশ্বের সকলের যৌথ সৃষ্টি এই সব ছবি।
[এ জীবন : কাব্যসমগ্র―২]
৬.
মানুষের খাদ্য সব প্রকৃতিতে আপনিই হয়―
ধান গম শাক কচু প্রভৃতি প্রকৃতি থেকে পাই।
মানুষের খাদ্য সব প্রকৃতিতে আপনিই হয়।
তবে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের কিছু কাজ যুক্ত হয়ে যায়―
যেমন ধানের গাছ পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে রুয়ে দেয়
মানুষেরা ধানক্ষেতে জল দেয়―এইভাবে বিশ্বের প্রকৃতি
এবং মানুষ মিলে তবে খাদ্যশস্য পাই প্রকৃতি থেকেই।
এইসব খদ্যদ্রব্য―ভাত রুটি সুক্তো ডাল ভাজা
আহার করার পরে কিয়দংশ শরীরের মাংস রক্ত হয়।
এই অবিস্মরণীয় খাদ্য দেহে থেকে যায় মৃত্যু অবধিই
মাংস রূপে অস্থি মজ্জা রূপে।
মাঝে মাঝে মনে পড়ে এইসব চিরায়ত খাদ্যসমূহকে।
[মানুষের খাদ্য : কাব্যসমগ্র―২]
বিনয় কবিতায় গণিতের জ্যামিতিক ফর্মুলা ব্যবহার করেছেন। আশপাশের পরিচিত কোনো বিষয় ও বস্তুর দিকে খুব সাধারণ দৃষ্টিতে না তাকিয়ে, বিজ্ঞানী কিংবা দার্শনিকের দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন। পরিচিত দৃশ্যের অচেনা অংশটুকুকে আবিষ্কার করে নিজের কাছে নিজেই দার্শনিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিলেন। এবং এর উত্তরের খোঁজে বের হয়ে তিনি ওই পরিচিত বিষয়টার মধ্য থেকে নতুন কিছু আবিষ্কার করেছিলেন।
আমরা জানি, একই পৃথিবীতে আমরা মানুষেরা যেমন বসবাস করছি তেমনি আমাদের সঙ্গে বাস করছে অসংখ্য গাছ-পশু-পাখি এবং প্রাণীও। কিন্তু এই পৃথিবী সম্পর্কে এই ভিন্ন প্রাণীদের ভাবনা কি এই বিষয়টা আমরা কখনো ভাবি না, কিন্তু বিনয় ভেবেছিলেন। তিনি নিজেকে এইসব প্রাণিজগৎ থেকে জীবনযাপন এবং চিন্তায় কখনো আলাদা করে ভাবেননি। যে কারণে এই পৃথিবীকে কখনো পাখির দৃষ্টি দিয়ে, কখনো গাছের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে কিংবা কখনো জড়বস্তুর জায়গা থেকে দেখেছেন।
বিজ্ঞানীদের কল্যাণে আমরা জেনেছি―মানুষেরা খালি চোখে যে সমস্ত বস্তু দেখে এবং বিশ্লেষণ করে তার মধ্যে বিশাল ঘাপলা থাকতে পারে। প্রতিবেশী প্রাণীদের চোখ দিয়ে দেখেও যে পৃথিবীর অনেক কিছুর ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে এটা আমরা কখনো ভাবি না। যেমন―মৌমাছি পৃথিবীর সমস্ত কিছুকেই দেখে বেগুনি রঙের; গরুর চোখে সবই সাদা-কালো, মুরগি আকাশের চাঁদটাকে গোল নয় দেখে চারকোণা। এখন পৃথিবীকে বেগুনি রঙের দেখা চোখে নিশ্চয় মৌমাছির দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের চেয়ে ভিন্ন রকমের, যে সবুজ ঘাস দেখে আমরা মাঝে মাঝে মুগ্ধ হই―সারা জীবন তার মধ্যে থেকেও একটা গরু নিশ্চয় ওই সবুজটাকে বুঝতে পারে না! তাঁর কাছে আম পাতার সবুজ আর জাম পাতার সবুজের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আবার যে গোল চাঁদের দিকে তাকিয়ে মা তার শিশুকে ঘুম পাড়ায়, সেই চাঁদটাকে যদি মুরগির দৃষ্টির মতো হঠাৎ দেখতে পাই চারকোনা নিশ্চয় আমাদের প্রতিক্রিয়াটা হবে ভিন্ন রকমের।
আমার কাছে মনে হয়েছে বিনয় মজুমদার কখনো কখনো গাণিতিক নিয়মে এইসব বৈজ্ঞানিক সূ²তা কবিতায় আনতে চেয়েছেন। যে কারণে পাখির দৃষ্টিতে দেখা মানুষের ঘরবাড়িসহ দাঁত মাজার প্রসঙ্গও হয়ে যায় তাঁর কবিতার বিষয়। তাঁর ভাবনার বিষয় ডাবের পানির প্রাণ আছে কি নেই এসব। তাঁর ভাবনার বিষয় হয় গাছ থেকে ফল ছিঁড়লে গাছ ব্যথা পায় কিনা―তিনি লক্ষ করেন চুল কাটলে কিংবা নখ কাটলে মানুষ ব্যথা পায় না। তিনি লক্ষ করেন প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের কাজ মিশে কীভাবে তা প্রকৃতির অংশ হয়ে যায়।
এই যে তাঁর কবিতায় এভাবে তুচ্ছ একটি বিষয়কে ধরে গভীর কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা, মনে হয় না বিনয়ের আগে কেউ এ কাজটি কবিতায় অন্তত করেছেন। আর এই কারণে বলা যায়, বিনয় মজুমদার কাব্যসমগ্র-২ তে এসে একজন সম্পূর্ণ মৌলিক কবি। এক্ষেত্রে তাঁর কোনো উত্তরসূরি থাকলেও পূর্বসূরি নেই!
গ্রহণ : মাদুলি, বিনয় মজুমদার সংখ্যা, এপ্রিল ২০১০, সম্পাদক : অরবিন্দ চক্রবর্তী।

বিশ্বের সর্বশেষ খবর, প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, সাক্ষাৎকার, ভিডিও, অডিও এবং ফিচারের জন্যে ইরাবতী নিউজ ডেস্ক। খেলাধুলা, বিনোদন, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং স্বাস্থ্য সহ নানা বিষয়ে ফিচার ও বিশ্লেষণ।