বিসর্জন টুকরো টুকরো করে
শরতের ফুরফুরে বাতাসি মেঘ আর কাশফুলের মৃদু দুলুনি আগমণীর সুর ছড়িয়ে দেয়। আবার আশ্বিনের নবমীর নরম সন্ধের গায়ে বুনো ছাতিমের গন্ধ, মনকেমনের হু হু উদাসী সুর কোথাও যেন বিসর্জনের বাজনা বাজায়। ছোটবেলা থেকে দেখেছি ষষ্ঠী থেকে নবমী যে জাঁকজমক তা যেন এক মুহূর্তে দপ করে নিভে যেত দশমীর সকালে। দশমীর রাতে ঠাকুর দালানের শূন্যতা দেখে মনে হত গভীর গর্ত আর তার তলানিতে ঝিমিয়ে থাকা আমার মন।
কর্মসূত্রে উত্তরবঙ্গে আসা। তাই একবার গিয়েছিলাম কোচবিহার রাজবাড়ির দুর্গাপুজো দেখতে। নবমীর সন্ধেবেলা। মানুষের ঢল উপছে পড়েছে রাস্তায়। নানা রংয়ের পোশাক, আলোর রোশনাই, কত রকমের শব্দ। বৈচিত্র্যতায় গমগম করছে রাজার শহর। উৎসবের শেষ দিন। মাটির মূর্তির কাছে দুঃখ-কষ্টের আর্তি জানানোর শেষ লগ্ন।
দেবীবাড়ির পুজো মানে রাজবাড়ির পুজো। ৫০০ বছরের বেশি পুরনো পুজো। এই পুজোকে কেন্দ্র করে বেশ বড় এক মেলাও বসে। প্রথমেই চোখ আটকায় দেবীমূর্তির গঠনশৈলীতে। রক্তাবর্ণা মাতৃমূর্তি, রাজকীয় সাজসজ্জা। আর সবুজ বর্ণের অসুরের গায়ে হলুদ ছিটছিট্। অনেকটা সোনা ব্যাঙের শরীরের রংয়ের মতো। দেবীর বাহন বাঘ ও সিংহ কামড়ে ধরেছে অসুরের হাত। দেবীর দুপাশে দুই বামা মূর্তি। সখী জয়া ও বিজয়া। নেই লক্ষ্মী, গনেশ। নেই সরস্বতী,কার্তিকও। অপলক তাকিয়ে আছি চোখের দিকে। রক্তাবর্ণা মূর্তি ভেদ করে বেরিয়ে আসছে শক্তি। নারী শক্তি। অসুরের দৃষ্টিও যেন দৃঢ়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্বৈরতান্ত্রিকতা স্পষ্ট। মেলার ভিড়েও গা কাঁটা দিয়ে ওঠে।
মণ্ডপে উনিশ শতকের ইউরোপিয়ান স্থাপত্যের ছাপ। আটটি করিন্থিয়ান থাম, বড় গম্বুজ- মন্ডপটিকে যেন আগলে রেখেছে। সমতল ছাদের কার্নিশের নীচে ত্রিকোণা অলংকৃত জাফরি। এই মন্দির ১৯১৫ সালে মহারাজা জিতেন্দ্রনারায়ণ স্থাপন করেন। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ছোট ভাই শুক্লধ্বজ, বড় ভাই নরনারায়ণকে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন। সেই চক্রান্তের হাত থেকে নরনারায়ণকে রক্ষা করেন রাজ পরিবারের কুলদেবী মা ভবগতী। তাঁর স্বপ্নাদেশেই মহারাজা নরনারায়ণ দেবীর আরাধনা শুরু করেন।
প্রতি বছর শ্রাবণ মাসের শুক্লা অষ্টমী তিথিতে ময়নাকাঠকে পালকিতে চাপিয়ে শোভাযাত্রা করে রাজবাড়ির কুল দেবতা মদনমোহন মন্দিরে রেখে আসা হয়। সেখানে একমাস এই কাঠ পুজো পায়। রাধাষ্টমীর দিন আবার সেই কাঠকে ফিরিয়ে আনা হয় দেবীবাড়িতে। ময়নাকাঠের কাঠামোয় মাটির প্রলেপে ভিন্ন অবয়ব, ভিন্ন সাজ, ভিন্ন নিয়মরীতি মেনে দেবী মূর্তি তৈরি হয়। মহালয়ার দিন দেবীপক্ষের সূচনা লগ্নে দেবীর চোখ আঁকা হয়। কিন্তু চক্ষুদান অর্থাৎ চোখে জ্যোতি দান করা হয় পঞ্চমী ছেড়ে ষষ্ঠীর শুভক্ষণে, স্থানীয়দের কাছে যা ‘বেলবরণ’ নামে পরিচিত। পুজোর রীতিনীতি বিশুদ্ধ পঞ্জিকার নির্ধারিত সময় অনুসারেই সম্পন্ন হয়।
প্রতিমা শিল্পী ও পুরোহিত পদ রাজার আমল থেকে এখনও বংশানুক্রমিক। আগে মহাষ্টমীর দিন নরবলি দেওয়া হত। তবে এখন মোষ ও কবুতর বলি দেওয়া হয়। মেলায় ঘুরতে ঘুরতে স্থানীয় বন্ধুর কাছ থেকে গল্প শুনে মন ভরে উঠল কানায়-কানায়। অতি আশ্চর্যের দৃশ্য দেখা যায় নাকি দেবীবাড়ির প্রতিমা বিসর্জনে। দেখার ও জানার কৌতুহলে থেকেই গেলাম রাতটা।
দশমীর দিন সকাল সকাল পৌঁছে গেলাম দেবীবাড়ি। চারদিকে ভাঙা মেলার চিত্র। গত রাতের আলো ঝলমলে দোকানগুলিতেও বিসর্জনের রূপ। তারা যেন নিরাবরণ,নিরাভরণ। একে একে মহিলারা দেবীকে সিঁদুর পরিয়ে দিচ্ছেন। অত উঁচু দেবীর কপালে সিঁদুর দেয় সাধ্য কার! তাই পায়েই সিঁদুর দিয়ে নিজেরা মেতে উঠেছেন সিঁদুর খেলায়। ধূপ-ধুনোর গন্ধ,উলু-শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত আকাশ-বাতাস।
পুজো কমিটির কর্তৃপক্ষ বিসর্জনের ব্যস্ততায় মগ্ন। আগে দেবীর বিসর্জন হত তোর্সা নদীতে, রাজার হাতি লোহার গাড়ি টেনে নিয়ে যেত। তবে তোর্সা নদীর প্রবাহ স্থান পরিবর্তন ও টেনে নিয়ে যাওয়ার অসুবিধার জন্য এখন লম্বা দিঘিতেই দেবীকে বিসর্জন দেওয়া হয়।
দেবী দশভুজা চলেছেন ঘাটের উদ্দেশ্যে, পেছন পেছন অনেকের সঙ্গে আমিও চলেছি। দাঁড়ালাম লম্বা দিঘির পাড়ে। ঘাটপাড়ে আবার পুজো হল। একে ‘গোপন পুজো’ বলা হয়। ভাটের খইয়ের ভোগ ও শূকর বলির মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয় পুজো। আগে বিসর্জনের ঘাটে খঞ্জনা পাখিকে আকাশে উড়িয়ে দেওয়া হত। পাখি যে দিক পানে উড়ে যেত সেই বছর রাজা ওদিকেই রাজ্য বিস্তারের জন্য যুদ্ধে রওয়ানা হতেন।
এর পরের ঘটনায় আমি বাকরূদ্ধ! কুড়ুল দিয়ে টুকরো টুকরো করা হল দেবীমূর্তিকে। তারপর টুকরো অংশগুলিকে ভাসিয়ে দেওয়া হল দিঘির জলে। ‘বিসর্জন’ মানে তো বাহ্যিক অস্তিত্বের বিলীন, ভাসিয়ে দেওয়া অনন্তের উদ্দেশ্যে! তাও আবার টুকরো টুকরো করে!
শিক্ষক,গদ্যকার