প্রবন্ধ: বাংলাদেশের রবিদাস জনগোষ্ঠীর সমাজ ও সংস্কৃতি । রঞ্জনা বিশ্বাস
সকল সমাজ ও সম্প্রদায়ের মতোই রবিদাস নামে বাংলাদেশে যে জনগোষ্ঠী রয়েছে তাদের নিজস্ব একটি ইতিহাস রয়েছে। বলা হয়ে থাকে রবিদাস জাতির নামকরণ হয়েছে তাদের আদি ধর্মগুরু সন্ত রবিদাসজীর নামানুসারে। এই ধর্মগুরুকে অনেকে রুহিদাস, রৌদাস, রুইদাস, ঋষি প্রভৃতি নামে ডেকে থাকেন। এইচ এইচ রিজলে তার দ্য ট্রাইবস অ্যান্ড কাস্টস অব বেঙ্গল গ্রন্থে জানান, চামার বা চর্ম্মকারগণ রামানন্দের অনুসারী হিসেবে নিজেদর রবিদাস বা রুইদাস হিসেবে পরিচয় দেয়, কোথাও কোথাও তারা ঋষি হিসেবেও পরিচিত (Risley,1891: 177)। ঐতিহাসিক বুকানন ভারতের পুর্ণিয়ায় ‘ঋষি’ নামে একদল উপজাতির সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। বুকাননের মতে, এরা মিথিলার একটি উপজাতি। বঙ্গদেশের চর্মকাররা (চামার) আসল পরিচয় গোপন রেখে নিজেদের ঋষি (ঋষির সন্তান) নামে পরিচয় দিতে এরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত। ১৮৭২ সালের লোক গণনায় ঋষিদের চামার বা মুচি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সেই সময়কার সেন্সাস রিপোর্টে তাদের আধা-হিন্দু উপজাতির পর্যায়ে গণনা করা হয়। তবে রবিদাসরা ভারতে বসবাসকারী চামারদের একটি উপগোষ্ঠীর অংশ। সেখানে চামাররা নিন্ম বর্ণের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী হিসেবে বসবাস করে। তাদের ঐতিহ্যগত পেশা হচ্ছে পশুর চামড়ার শিল্প নিয়ে কাজ করা। তারা পশুর চামড়া থেকে জুতা, বেল্ট এবং অন্যান্য জিনিসপত্র তৈরি করে। বাংলাদেশের রবিদাসদের একটা অংশ মুচির কাজ করে এবং একটি অংশ পরিচ্ছন্নতা কর্মীও কাজ করে থাকে। এদেও কেউ কেউ নিজেদের ঋষি জাতি বলেও পরিচয় দেয়। রিজলে তার বইয়ে ঋষি জাতের উদ্ভব সম্পর্কে একটি উপাখ্যানের কথা তুলে ধরেছেন। প্রজাপতি বা ব্রহ্মার মানসপুত্র, দেবতাদের উদ্দেশ্যে ঘৃতাহুতি দেওয়ার সময় গো-মাংস অর্ঘ্য দিতেন। প্রচলিত নিয়মানুযায়ী বলি দেওয়া মাংস কিছুটা খেলেই বলি দেওয়া পশুটি পুনরুজ্জীবিত হয়ে বনে ফিরে যেত। হঠাৎ একবার প্রজাপতি বলিদান করা পশুটিকে পুনরুজ্জীবিত করতে ব্যর্থ হলেন। ভীতবিহ্বল প্রজাপতি অনেক চেষ্টার পর বুঝতে পারলেন যে, তার গর্ভবতী স্ত্রী চুপিসারে গো-মাংসের একাংশ সরিয়ে রেখেছেন। প্রজাপতির স্ত্রীকে সমাজ থেকে বহিষ্কার করা হলো। পরবর্তীতে প্রজাপতির গর্ভবতী স্ত্রী যে সন্তান প্রসব করলেন সেই হলো মনুষ্যকুলের মধ্যে সর্বপ্রথম ঋষি, চামার বা মুচি।
মি. নেসফিল্ড এর বরাত দিয়ে রিজলে জানান, চর্মকাররা মূলত ডোম, কঞ্জর, হাবরা চেরু প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের আদিবাসী জাতি থেকে এসে থাকতে পারে। (Risley,1891: 175) চামড়ার কাজের সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে এদের চর্মশিল্পী, চর্মকার (চামার), মুচি নামে অভিহিত করা হলেও রবিদাসরা চামার বা মুচি শব্দটিকে ব্যাপকভাবে অসম্মানজনক মনে করে। রিজলের গ্রন্থ থেকে জানা যায়, চামারদের সংস্কৃতির সঙ্গে ডোমদের বহুলাংশে সাদৃশ্য রয়েছে(Risley,1891: 177)।
এ ছাড়াও সমাজে রবিদাসদের নিজস্ব মিথ রয়েছে। একদিন ভগবান শ্রীনারায়ণ বিভিন্ন জাতির লোকদের ডাকলেন। সকলে নারায়ণের বৈঠকখানায় এলো। তিনি সকলকেই নিজ নিজ পছন্দমতো বিভিন্ন পেশা ভাগ করে দিচ্ছিলেন। কিন্তু তখনো রবিদাস সম্প্রদায়ের লোকেরা উপস্থিত হতে পারেনি। সব শেষে রবিদাস জাতি সেখানে উপস্থিত হলে শ্রীনারায়ণ বললেন, ‘সবাইকে তো পেশা ভাগ করে শেষ করে দেওয়া হয়ে গেছে। তোমাদের আর কী দেব? এই লোহার সুচ আর সুতাটুকু নিয়ে যাও। রাস্তায় বসে এটা দিয়ে চামড়া দিয়ে পাদুকা তৈরি ও মেরামতের কাজ করো আর আমার নাম জপ করো। তাতেই তোমাদের দিন চলে যাবে।’ সেই থেকে তারা জুতা সেলাই আর চামড়ার কাজ শুরু করে। জুতা আর চামরার কাজ করে বলে লোকজন তাদের মুচি বা চামার নামে ডাকে। এই মুচি বা চামার সম্প্রদায়ের ঘরে সন্ত রবিদাসজীর জন্ম হয়। আর তার নামানুসারেই পরে এই জাতির নামকরণ হয় ‘রবিদাস’। কেউ কেউ মনে করেন, এরা মূলত নিজেদের রবির (সূর্য) দাস মনে করে ভক্তিভরে সূর্যদেবের পূজা করত বলে তারা রবিদাস হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।
বসতি এলাকা, জনসংখ্যা ও পরিবেশ
বাংলাদেশে বসবাসকারী রবিদাসরা মনে করে, তাদের আদিনিবাস অবিভক্ত বাংলা, বিহার, ওড়িশার দারভাঙ্গা, মুজাফ্ফরপুর, বালিয়া, ছাপড়া, আরে, কনৌজ, পাটনা, মুঙ্গের, ভোজপুর অঞ্চলে। ভারত ছাড়া পাকিস্তান , নেপাল ও ভুটানেও তাদের বসতি রয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলে রবিদাসদের ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এদেশে নিয়ে আসা হয়। পূর্বে রবিদাস সম্প্রদায় রাজদরবারে পালকি বহনের কাজে নিযুক্ত ছিল বলেও কথিত আছে। বর্তমানে কেউ কেউ জুতা তৈরি, মেরামত, চামড়ার কাজ (চামড়ার জুতা, স্যান্ডেল, ব্যাগ, বেল্ট)সহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দের আদমশুমারির বিবরণে রবিদাসরা অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন নামে চিহ্নিত হয়েছে। যেমন : গুজরাটে তারা রবিদাস, রোহিদাস, চামাড়, বাম্বি, আসোদি, বাম্বি রোহিত, মোচি রোহিত, বাম্বি হিরোহিত ইত্যাদি নামে পরিচিত। এছাড়া পাঞ্জাবে তারা বাম্বি চামাড়, জাঠিয়া চামাড়, রামদাসিয়া; রাজস্থানে মেঘ ওয়াল ও মোচি নামে পরিচিত। তবে সমস্ত অঞ্চলেই তারা চামড়ার কাজ করে থাকে। কোথাও কোথাও তারা পরিচ্ছন্নতার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। ভারতে ১৬ লক্ষ ৬৩ হাজার রবিদাস রয়েছে(https://joshuaproject.net/people_groups/20918/IN) এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেও চব্বিশপরগণা, বর্ধমান, মেদেনীপুর, নদীয়ায় এদের প্রায় ৩ লক্ষের অধিক রবিদাস রয়েছে। অন্যত্র চামারদেও সঙ্গে রবিদাসদেও সংখ্যা আরো অনেক বেশি বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশে এক জরিপে প্রায় ১ লক্ষ ২৮ হাজার রবিদাস রয়েছে বলে জানা যায় এবং কেবল ঢাকা জেলাতেই প্রায় ২৪ হাজার ৬৩ জন রবিদাস রয়েছে( মুরমু, ২০১১:২৬৪)।
বর্তমান বসতি স্থান
বাংলাদেশের প্রায় সব জেলায় বিভিন্ন নামে রবিদাসরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে। রবিদাসরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে গ্রাম বা পাড়ার এক প্রান্তে যেমন- পুকুর পাড়ে, নদীর ধারে, দীঘির ধারে অথবা মাঠের কর্নারে বাস করে। মনে করা হয়, তারা গ্রামের একপাশে বাস করে যাতে করে চামড়ার কাজ করার কারণে অন্য জাতির লোকেদের অসুবিধা না হয়। ৷ বাংলাদেশে বড় রবিদাসপাড়া খুব কম চোখে পড়ে। আগে গ্রামের রবিদাসরা মাটির ঘরে বসবাস করলেও ইদানিং টিনের ঘরে তারা বসবাস করে। শহরে যারা পরিচ্ছন্নতা কর্মীও কাজ করে তারা সরকারি কলোনীতে বসবাস করে।
রবিদাস সমাজের সামাজিক কাঠামো ও পরিবার ব্যবস্থা
রবিদাস সমাজ মূলত পিতৃপ্রধান সমাজ তাই পিতাই হচ্ছেন পরিবারের প্রধান। একক পরিবারের স্বামীই হচ্ছেন পরিবারের প্রধান কর্তা এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী। পরিবারের সকল ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সমস্যা মোকাবেলা করেন স্বামী। একক পরিবারের সকল সদস্যই পরিবারের প্রধানের সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করে থাকে।
যেহেতু বেশির ভাগ শহর বা মফস্বল শহরের রবিদাসরা পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে কলোনীগুলোতে বাস করেন তাই তাদের পক্ষে যৌথ পরিবার নিয়ে বসবাস করা সম্ভব হয় না। সেখানকার নির্ধারিত কলোনির ঘরগুলোও তৈরি করা হয় একক পরিবারের বসবাসের উপযোগী করে। ফলে চাইলেই ছেলে বা ছেলের বৌকে একত্রে নিয়ে বসবাস করা সম্ভব হয় না। তবে গ্রামাঞ্চলে পিতা মাতার সঙ্গে তারা একত্রে বসবাস করেন। সেখানে প্রায়শই যৌথ ও বর্ধিত একক পরিবার দেখতে পাওয়া যায়। শহরেও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু বর্ধিত একক পরিবার দেখতে পাওয়া যায়। পরিবারের মহিলারা সাধারণত গৃহিনী। তারা ছেলে মেয়ের লালন পালন করেন এবং রান্নাবান্নার কাজ করে থাকেন। যৌথ পরিবারের খানা প্রধান তার ছেলে মেয়েসহ অন্যান্য ভাইয়ের স্ত্রী সন্তান নিয়ে একত্রে বসবাস করেন। যৌথ পরিবারে একাধিক উপার্জনকারী থাকলেও খানা প্রধান থাকেন একজন। সাধারণত বড়ভাই হন খানা প্রধান। তবে বাবা বেঁচে থাকলে বাবাই হন প্রধান, পরিবরের সকল সিদ্ধান্ত তিনিই নিয়ে থাকেন। পরিবারের সকলে তাদের উপার্জন তার হাতেই তুলে দেন এবং পরিবারের প্রধান সংসারের সকল দায় দায়িত্ব বহন করেন। রবিদাসরা কয়েকটি গোত্রে বিভক্ত।
যেমন : ধুসিয়া, গুরিয়া, ধার, দোহার, জয়সুরিয়া,সারকী তাঁতি, চুনিহার ইত্যাদি।
১. ধূলিয়া : ধুলিয়ারা মূলত চামড়া দিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরী করেন। তারা জুতা তৈরী করেন এবং বিভিন্ন বিবাহ অনুষ্ঠানে বাদকের কাজ করেন। এরা ঋষি নামে সমধিক পরিচত।
২. গোরিয়া : গুরিয়ারা নিজেদের জমিতে কৃষিকাজ করেন। যাদের জমি নাই তারা অন্যের জমিতে ক্ষেত-মজুর হিসেবে কাজ করেন।
৩. ধার : ধাররা অতীতে পালকি বহনের কাজ করতেন।এখন তারা বিভিন্ন ধরনের শ্রমিকের কাজ করে থাকেন।
৪. দোহার : দোহাররা চামড়া দিয়ে জুতা সেলাই করেন। জুতা সেলাই করার সময় তারা কখনোই সূতা ব্যবহার করে না।
৫. জয়সুরিয়া : জয়সুরিয়ারা সহিসের কাজ করেন। ঘোড়া সওয়ার হিসেবে তাদের বেশ নাম ডাক আছে। বাংলাদেশে এদের দেখা মেলে না।
৬. তাঁতি : তাঁতি গোত্রের রবিদাসরা বস্ত্র বয়নের কাজ করেন, তারা মৃত পশু-পাখির মাংস স্পর্শ করেন না।
৭. সারকী : সারকীরা কসাইয়ের কাজ এবং পশুর শরীর থেকে চামড়া খসানোর কাজ করেন।
৮. চুনিহার : চুনিহাররা চুন প্রস্তুতের কাজ করেন। সব চুনিরাই রবিদাস নয়।
বাাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে রবিদাস সম্প্রদায়ের লোকেরা মূলত ইউনিয়ন পরিষদে চৌকিদারের কাজ করতেন। গ্রামাঞ্চলে এখনও অনেকেই চৌকিদারের কাজ করে থাকেন। এই সব গোত্র ছাড়াও তাদের আরও ৯ গোত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন : ১. চর্মকার ২. অসত্মি ৩. জৈমব্র ৪. জনকপুরী ৫. মৌনপুরী ৬. খাটি সাহার ৭. কোরার ৮. লোরকের ৯. মগ-হিয়া পাচ্ছিয়ান। এছাড়া সিলেটে বসবাসকারি রবিদাসদের রয়েছে দুটি উপগোত্র যথা- কচ্ছপ ও নাগ।
জন্ম ( মুরমু, ২০১১:২৬৬) :
রবিদাসদের মাঝে নবজাতকের জন্মের বিষয়টা অধিক আনন্দের সহিত পালিত হয়। নবজাতকের বয়স ছয়দিন পূর্ণ হলে ‘ছট্ বা ছাটিয়ার’ নামক অনুষ্ঠান করা হয়। এই দিন বাচ্চার নামকরণ করা হয়। এই দিন বাচ্চা ও মাকে নতুন জামাকাপড় দেওয়া হয়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাধ্যে কুলায় না বলে শুধু বাচ্চাকেই নতুন জামা দেওয়া হয়। ভালো খাবারের আয়োজন করা হয়। নবজাতকের বয়স বারদিন হলে ‘বরাইয়া’ এবং ২১ দিনে ‘একুশা’ নামে অনুষ্ঠান করা হয়। বাচ্চার জন্ম হলে প্রসূতিকে এবং বাচ্চার পিতাকে ১ মাস পর্যন্ত অপবিত্র মনে করা হয়। তাকে বা তাদের পবিত্র কার জন্য পঞ্চগব্দি খাওয়ানো হয়। এই পঞ্চগব্দি হচ্ছে গোবর, তুলসিপাতা, গোয়ালের মাটি, গঙ্গাজল ও দুর্বা ঘাসের মিশ্রন।
রবিদাস সমাজের বিবাহ প্রথা ( মুরমু, ২০১১:২৬৬)
রবিদাসদের নিজ গোত্রের মধ্য বিয়ে হয়না তবে Cross Cousin বিবাহ চালু প্রচলিত। বিয়ের পাত্র পাত্রী পছন্দ হয়ে গেলে পঞ্জিকা দেখে শুভ দিন ধার্য করা হয়। এই দিনকে বলে ‘পূজাইয়ার’ দিন। বিয়ের আগের দিন গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান হয়। ছেলের বাড়ি থেকে তত্ত্ব আসে। তত্ত্বে থাকে হলুদ শাড়ি, লাল ব্লাউজ, চুড়ি, মেয়েকে সাজানোর অলঙ্কার, হলুদ, মেহেন্দি, দুধ, দৈ, পান সুপারি, আতপ চাল, কাঁচা মরিচ, মাছ, চিড়া, গুড় । হলুদের অনুষ্ঠানে ছেলের বাড়িতে লম্বা একটি বাঁশের কঞ্চি নেওয়া হয়। একে তারা বলে হরিস। ছেলের বাড়িতে গায়ে হলুদে বৈচিত্র দেখা যায়। সেখানে গায়ে হলুদের পর ছেলেকে লাঙ্গলের উপর বসিয়ে গোসল করানো হয়। সেই গোসলের জল বোতলে ভরে মেয়ের বাড়িতে তত্ত্বের সাথে পাঠানো হয়। ছেলের গোসলের পানি মেয়ের গোসলের জন্য রাখা পানিতে মিশিয়ে গোসল করানো হয়। লাঙ্গলের ব্যবহার ও হরিস ব্যবহারের সংস্কৃতি থেকে অনুমান করা যায় তারা অনার্য জাতির মানুষ এক সময় তাদের আদি পেশা ছিল কৃষি কাজ। মেয়ের বাড়িতে বিয়ের মূল অনুষ্ঠান হয়। সেখানে চারটি কলাগাছ পুতে দিয়ে বিয়ের মুল মঞ্চ তৈরি করা হয় যাকে তারা বলে ‘মাড়োয়া’। চারটি কলাগাছে রশি টাঙানো হয়। এই রশিতে ঝোলানো হয় আমপাতা। এই মাড়োয়ার মধ্যে দুটো ঘট রঙ দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়। ঘটকে তারা বলে কালসা। এই কালসার উপরে মাটির পাত্রে সরিষার তেলের পদীপ জ্বালানো হয়। মাড়োয়ার ভেতরে উত্তর বা পূর্ব দিকে মুখ করে মেয়েকে ছেলের বাম পাশে বসানো হয়। পুরোহিত তাদের সামনে বসে ধর্মমতে বিয়ে পড়াবেন। অগ্নি, বায়ু, তুলসী, গঙ্গা, জল ও দেব দেবতা সাক্ষী রেখে সাতপাক ঘুরে মালাবদল হয় এবং সিঁদুরদান পর্ব শেষ হয়। পিতা কন্যাদান করার সময় তাকে টাকা দিতে হয়। রবিদাস সমাজে বহুবিবাহের চল নেই তবে কোন কারনে বিয়ে ভেঙ্গে গেলে দ্বিতীয় বিয়ে করার ক্ষেত্রে সমাজের লোকদের খাওয়াতে হয় ৷
মৃত্যুবিষয়ক সংস্কৃতি( মুরমু, ২০১১:২৬৭)
মৃত্যুকে রবিদাসদের ভাষায় বিলাপ বলা হয়। মৃত্যুর পর সমাজের লোক মৃতের বাড়িতে একত্রিত হয়ে মৃতের উদ্যেশ্যে গুরুমন্ত্র জপ করে। একে তাদের ভাষায় বলা হয় বন্দেগী বাজানো। মৃত ব্যক্তিকে গোসল শেষে সাদা কাফনের কাপড় পরিয়ে আতর ও গোলাপ জল ছিটিয়ে দেওয়া হয়। মৃতকে খাটলিতে করে দক্ষিণ দিকে মাথা রেখে শুয়ে দেওয়া হয়। মৃত ব্যক্তিকে সামনে রেখে পূনরায় বন্দেগী বা গুরুমন্ত্র জপ করা হয়। এই সময় ৫টি মৃত্যু বিষয়ক ভজন গাওয়া হয়। এরপর মৃতের খাটলি শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার সময় পাঁচবার পাঁচটি স্থানে রাখা হয়। সামাজিক নিয়মানুসারে মৃতের বড় বা ছোট ছেলে মুখাগ্নি করে। মুখাগ্নির সময় পাটকাঠিতে ঘি দিয়ে আগুন ধরানো হয়। একে তার বলে সিনুট। এই সনুট নিয়ে ৫ বার তাকে প্রদক্ষিণ করে মুখাগ্নি করা হয়। এই সময় মৃত ব্যক্তির মুখে আতপ চাল, ঘি, মধু, কর্পূর, তৈল ইত্যদি একত্রিত করে দেওয়া হয়। শেষবার গুরুমন্ত্র পাঠ করে মৃতেকে কবরে নামানো হয়। রবিদাসদের কবরকে সিন্ধু কবর বলা হয়। রবিদাসরা মনে করে তাদের গুরু সাধু রবিদাস মহাবৈষ্ণব ছিলেন। তার মুখাগ্নি হয়নি এবং তার দেহ পোড়ানোও হয়নি। যেহেতু রবিদাসরা মহামানব নয় তাই মুখাগ্নি করা হয় এবং দেহটি কবরস্থ করা হয়।
সম্পত্তির মালিকানা
রবিদাস সমাজের সামাজিক প্রথা হিসেবে পিতার মৃত্যুর পর ওয়ারিশ হিসেবে পুত্র সকল সম্পদের মালিক হয়। মেয়েরা পিতার সম্পত্তির মালিক হতে পারে না। তবে মেয়েরা মায়ের সম্পত্তির মালিক হয়। এ থেকে মনে করা যায় এক সময় তারাও হয়তো মাতৃতান্ত্রিক সমাজের ধারক ছিল। তবে যদি কেউ অন্য কোনো জাতিতে বা ধর্মে বিয়ে করে তবে সে পিতার ওয়ারিশ থেকে বঞ্চিত হয়। সম্পত্তি নিয়ে কোনো ঝামেলা হলে তা গ্রাম্য বিচার শালিসের মাধ্যমে মিটিয়ে দেওয়া হয়। অন্যথায় আদালতে হিন্দু আইন অনুসরণ করে মামলা নিষ্পত্তি করা হয়। রবিদাসদের কাউকেই সম্পত্তি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আদালতের দারস্থ হতে দেখা যায় না।
বিচারব্যবস্থা
রবিদাস সম্প্রদায়ের সমাজে নিজস্ব সমাজব্যবস্থা রয়েছে। তাদের মধ্যে কোনো সমস্যা হলে দুই-চারজন সমাজের মান্যগণ্য ব্যক্তি ও মহন্ত সাহেবরা মিলে সেই সমস্যার সমাধান দেন। এতে কারো শাস্তি বা জরিমানা হলে তা ওই ব্যক্তি মানতে বাধ্য থাকবে। রবিদাস সমাজের মহন্ত (রবিদাস সমাজের ব্রাহ্মণ) সামাজিক পূজাপার্বণ ও অনুষ্ঠান করে থাকেন।
দৈনন্দিন জীবন-পরিচয়
বস্তুগত সংস্কৃতির আওতায় আলোচিত হয় জনগোষ্ঠীর টিকে যাওয়া নিদর্শন যেমন- প্রযুক্তি, ঘর-বাড়ি, অস্ত্রপাতি, পোশাক, বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি, তৈজসপত্র, আসবাব, খাদ্য ইত্যাদি। এই সব বস্তুগত সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে মানুষের নিত্য দিনের প্রয়োজন, শিক্ষা-চিকিৎসা, বিনোদন প্রভৃতি দৈনন্দিন জীবনের পরিচয়বাহী সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত হয়।
খাদ্য
বাংলাদেশের বাল্মীকি সম্প্রদায়ের প্রধান খাদ্য হচ্ছে ভাত। বাঙালি সমাজের সাথে সাথে তাল মেলাতে গিয়ে রবিদাসদের খাদ্যাভ্যাসের ব্যপক পরিবর্তন হয়েছে। একসময় তাদের খাদ্যতালিকায় শামুক, ঝিনুক, কাকড়া, শাকালু, শুয়োআলু, বেতফল ইত্যাদি ছিল । বর্তমানে সাধারণ বাঙালিদের মতই ভাত, মাছ, সবজি, রুটি, মাংস ইত্যাদি খায়। রবিদাস সমাজের অনেকে শুকরের মাংস খায় এবং একটি অংশ সেটি পরিহার করে থাকে। ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবে তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার তৈরী করা হয় যেমন : ঠেকুয়া, মনভোগ, শানকা ইত্যাদি। রবিদাসদের মধ্যে সামাজিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান যেমন- নবজাতকের জন্মানুষ্ঠান,বিয়ে ও মৃতের সৎকারের সময় মদ পানের রেওয়াজ আছে। মদকে তারা দারু বা তাপাওন বলে থাকে।
পোশাক-পরিচ্ছদ
রবিদাস পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক হচ্ছে ধুতি, পাঞ্জাবী। এক সময় তারা এই পোশাই পরত। এখন কেবল মাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে এই পোশাকের চল রয়েছে। বর্তমানে পুরুষরা লুঙ্গী, প্যান্ট, শার্ট পরে থাকেন। রবিদাস নারীদের পোশাক শাড়ি। তারা নিজেদের ঐতিহ্যবহী স্টাইলে শাড়ি পরে থাকেন। তারা শাড়ির আঁচল বাম দিক দিয়ে না নিয়ে ডানদিক থেকে নিয়ে থাকে। বর্তমানে রবিদাসদের পোশাকে বাঙালিদের মতো আধুনিকতার ছাপ লক্ষ্য করা যায়। বিয়ের সময় বর ধুতি, পাঞ্জাবী ও একধরনের টোপর বা মুকুট পরেন যার দুইপাশে চারটি লম্বামালা হাটুঁর নিচ পর্যন্ত ঝুলানো থাকে। বিয়েতে কনেরা লাল শাড়ী পরে থাকেন।
অলংকার
রবিদাসদের মধ্যে বিবাহিত মেয়েরা হাতে চুড়ি ও চুড়ি জাতীয় ধাতব খাড়ু পরে থাকেন। এছাড়া শাখা, সিঁদুর, নাকফুল পড়ার পাশাপাশি হামলি নামক এক প্রকার গহনা পরিধান করেন। কপালের উপর শিরবানী বা টায়রা পরেন। বিধবা রবিদাস মহিলাদের বেল বা তুলসী গাছের শুকনো ডাল কুচি-কুচি করে কেটে সুতোয় গেথে পড়তে দেখা যায়। আদিতে সিলেট অঞ্চলের রবিদাস মহিলারা কানে তারকি, বাহুতে মোটা বাজু, গলায় হাইকল, পায়ে গরমল ও কোমরে কোমরদড়ি নামের অলংকার পরতেন।
আসবাবপত্র
রবিদাসদের মাঝে বেত, বাঁশ ও কাঠের আসবাবপত্র ব্যবহারের প্রবণতা বেশী। এক সময় তারা বাঁশ ও বেত দিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরি করতো। বর্তমানে এসব কিনতে হয়। পানি খাওয়ার জন্য অনেকে কাসার ঘটি ও লোটা ব্যবহার করেন।
ধর্ম ও ধর্মীয় উৎসব
রবিদাসদের ধর্মের নাম ‘রবিদাসীয়া’। এরা পূজা নিজস্ব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানাদি সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সহিত পালন করে থাকে। ধর্মগুরুরা ‘সন্ত’ বা ‘মহন্ত’ নামে পরিচিত। পূজা-পার্বণ, বিবাহ, মৃত-সৎকারসহ যাবতীয় ধর্মীয় কার্যাদি মহন্তরাই পরিচালনা করে থাকে। পূজার জন্য রবিদাসরা শোবার ঘরের একপার্শ্বে চৌকি রাখে অথবা সিরহানী বানিয়ে পূজা করে। সিরহানী হচ্ছে শিবলিঙ্গ সমেত একটি আসন। এসারা সমাজের সকলের জন্য একটি নির্দিষ্ট মন্দির থাকে তাকে রবিদাসরা ধামঘর বা গাদী ঘর বলে । রবিদাসদের ধর্মগুরু রবিদাসজীর জন্মজয়ন্তীর দিন মাঘী পূর্নিমা হল তাদের প্রধান উৎসব। এছাড়া গাদী পূজার দিন সব রবিদাস সমাজে সারারাতব্যাপী ভজনকীর্ত্তন গান হয়। এছাড়াও তারা কার্তিক মাসের অমাবস্যার রাতে “দেওয়ালী পূজা”, “ভূতপূজা” ভাদ্রমাসের পূর্নিমায় “ঝুমুর নৃত্যগীত” ফাল্গুন মাসে ফাগুয়া, কালীপূজার পর ছটপবনী বা সূর্যপূজা, বটপূজা, নারায়নীপূজা, শীতলা মায়ের পূজা, নওমী বা রামনবমী, চৈত নওমী, নবান্ন উৎসব, পুষরা বা পৌষপার্বন, পদ্মামাইকে পূজা বা মনসাপূজা করে থাকে। চা বাগানের রবিদাসরা বনশক্তিমা, শিবরাত্রী, বাসনত্মী, হোলীয়া উদযাপন করে থাকে। ফাগুয়াতে রবিদাসরা সবাইকে রং ও কাদা মাখিয়ে আনন্দ করে। রবিদাসরা হিন্দুদের মতো পূনর্জন্মে বিশ্বাসী। তারা মনে করেন, যে পৃথিবীতে পূন্যের কাজ করে সে গুরুর সান্নিধ্য লাভ করে ফলে তাকে আর পূনর্জন্ম নিতে হয় না। তবে যারা পাপ কাজ করে তারাই পূনরায় পৃথিবীতে বিভিন্ন জীবজন্তুর বেশে জন্ম নেয়।
ভাষা
রবিদাসরা নিজেদের মধ্যে নাগরী ভাষায় কথা বলে থাকে বলে তারা জানায়। শিপন রবিদাস জানান, ‘আমাদের ভাষা স্থানভেদে ভোজপুরিয়া, দেবনাগরী, ভূতনাগরী বা দেশওয়ালী ভাষা নামেও পরিচিত।’ গুরুঅন্যাস নামক ধর্মগ্রন্থ দেবনাগরী লিপিতে লিখিত হওয়ায় তারা নিজেদের ভাষাকে নাগরী ভাষা বলে থাকেন বলে জানান নয়ন রবিদাস। বাংলাদেশে রবিদাসদের মধ্যে একটি বড় অংশই নাগরীতে কথা বলে বলে জানান শিপন রবিদাস। হরিজন সম্প্রদায়ের মধ্যে জনসংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীও তারা বলে জানান নয়ন রবিদাস। রবিদাস সম্প্রদায়দের নিজস্ব পুঁথি সাহিত্য রয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে সোরঠী বীরজাভার, সোনকেশিয়া রাণী, বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। হাতে লেখা ধর্মগ্রন্থগুলো হলো―গুরুআন্যাস (মূলগ্রন্থ ও জ্ঞান দীপক), বিলাস, শব্দাবলী, লও পারয়ানা, বারহ্ বাণী, জবাব সওয়াল, ব্রহ্মবিচার, মন্ত্রাওলী, মূলসাগর, জ্ঞানচাচারী, রূপসার।
এদিকে বাংলাদেশের ভাষা সমীক্ষায় রবিদাসদের ভাষাকে সাদরি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ ক্ষেত্র সমীক্ষায় দেখা গেছে, রবিদাসরা তাদের মাতৃভাষাকে নাগরী বলে উপস্থাপন করে থাকে। কোথাও কোথাও তারা একে দেশওয়ালী ভাষাও বলে থাকে।
অন্যদিকে বয়স্করা জানান, তাদের ভাষায় বাংলার পাশাপাশি হিন্দি মিশলেও মূলত তারা ভোজপুরি শব্দই বেশি ব্যবহার করেন। অর্থাৎ হিন্দি মিশ্রিত বা প্রভাবিত ভোজপুরি বা বাংলা প্রভাবিত ভোজপুরি। যেখানে কথক নিজেকে ভোজপুরিভাষী বলে দাবি করছেন, সেখানে তার বক্তব্যকে প্রাধান্য না দেওয়াও একধরনের ভাষিক আগ্রাসন। আমরা রবিদাস সম্প্রদায়ের কিছু ভাষিক নমুনা এখানে বিশ্লেষণের চেষ্টা করব।
রবিদাসদের ভাষার রূপতত্ত্ব (বিশ্বাস,২০২৩:১১৯-১২৫)
বিশেষ্য পদ
যে পদ দ্বারা কোনো ব্যক্তি, বস্তু, গুণ, স্থান, জাতি, অবস্থা প্রভৃতির নাম বোঝায় তাকে বিশেষ্য পদ বলে। রবিদাসীয় নাগরী ভাষায় বিশেষ্য পদের কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না। নিচে নাগরী ভাষায় কতিপয় বিশেষ্য পদের উদাহরণ দেওয়া হলো―
সুমি পিঠা বনইলেরেহে―সুমি পিঠা বানিয়েছিল।
শেখ মুজিব টুঙিপাড়া গ্রামমে জন্মগ্রহণ কইলে রহলন―শেখ মুজিব টুঙিপাড়া গ্রামে জন্মেছিলেন।
হম্ ঢাকা যাইব্―আমি ঢাকা যাবো।
পানিকে আউরি এগো নাম জীবন―জলের অপর নাম জীবন।
সর্বনাম পদ
বাক্যে বিশেষ্য পদের পরিবর্তে যে পদ ব্যবহৃত হয় তাকে সর্বনাম পদ বলে।
রাবিদাসীয় নাগরী ভাষায় সর্বনাম পদকে নিম্নলিখিতভাবে ভাগ করা যায়―
১. ব্যক্তিবাচক সর্বনাম
হম্―আমি।
হমনিকে―আমরা।
তু―তুমি। গুরুজনস্থানীয়দের ক্ষেত্রে।
তু―তুই। সমবয়সী বা ছোটদের ক্ষেত্রে।
রওরা―আপনি।
উ―সে/তিনি। সকল ক্ষেত্রে।
হুকনি―তিনি। গুরুজনস্থানীয় ক্ষেত্রে।
তোনিকে/তোহনলোগ―তোমরা। গুরুজনস্থানীয় ক্ষেত্রে।
২. বস্তুবাচক সর্বনাম
হই―এটা। হই তোহার কলম হ―এটা তোমার কলম।
হউ―ওটা। হউ হকোর বহি হ―ওটা তাঁর বই।
৩. স্থান বাচক সর্বনাম
হিওয়া―এখানে। হিয়া বইঠ্―এখানে বস।
হুয়াওয়া―ঐখানে। হুয়াওয়া সাপ বা―ঐখানে সাপ আছে।
৪. প্রশ্নবাচক সর্বনাম
কে―কে। কে যাতা হ―কে যায়?
কী―কা। তোহার নাম কা হ―তোমার নাম কী?
কেমন―কেইসন। কেইসন বারো―কেমন আছ?
কোথায়―কাহা। কাহা গইল রহল হ―কোথায় গিয়েছিলে?
কারা―কেকুনি। কেকুনি যায়েব্―কারা যায়?
কখন―কব। কব্ অইব্―কখন আসবে?
কার―ককের। ককের কলম―কার কলম?
কেন―কাহে। কাহে যাতিন―কেন যাই?
উপর্যুক্ত নাগরী ভাষার সঙ্গে ভোজপুরিয়া ডোমাই ভাষার তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না। বাংলাদেশের উপভাষাসমূহে ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের চেয়ে রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যই যেমন অধিক প্রাধান্য লাভ করে এবং রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যে সর্বনাম, কারক-বিভক্তি ও ক্রিয়া-বিভক্তির ক্ষেত্রে সর্বাধিক লক্ষ করা যায়। ঠিক একইভাবে বাঁশফোর তথা ডোমাই ভাষার সর্বনামের সঙ্গে রবিদাসদের নাগরী ভাষার সর্বনামে কোথাও কোথাও সূক্ষ কিছু ধ্বনিতাত্ত্বিক পার্থক্য ছাড়া বিশেষ কোনো ভাষিক পার্থক্য লক্ষ করা যায় না। যেমন:
১. ব্যক্তিবাচক সর্বনাম
হম্ (আমি) > হম।
তু (তুমি) > তু।
উ (সে) > উ। সমবয়সী বা ছোটদের ক্ষেত্রে।
উকনি (তিনি) > (উ) হুকনি। গুরুজনস্থানীয় ক্ষেত্রে।
তুলোগ (তোমরা) > (তু) তোহনলোগ।
২. বস্তুবাচক সর্বনাম
ইহ (এটা) > হই।
উহ (ওটা) > হউ।
৩. স্থানবাচক সর্বনাম
হিয়া (এখানে) > হিওয়া (+ও)।
ইয়া (ঐখানে) > (ই) হুয়াওয়া।
৪. প্রশ্নবাচক সর্বনাম
কেহু (কে) > কে।
কা হ (কী) > কা।
কেইছন (কেমন) > কেইসন।
কাহা (কোথায়) > কাহা।
কব (কখন) কব > কব্।
ককের (কার) > ককের।
কাহে (কেন) > কাহে।
ডোমাই ভাষার মতোই রবিদাসীয় ভাষায় সর্বদা সম্মান বা সিনিয়র-জুনিয়রের মর্যাদার ভিত্তিতে সর্বনাম পদের ব্যবহার বৈচিত্র্য রয়েছে। যেমন:
পুরুষ সম্মান ও অবস্থান একবচন বহুবচন
উত্তম নির্দেশিত নয় হম হমনি/হমনিলোগ
সম্মানার্থক/সিনিয়র হম হমনি/হমনিলোগ
মধ্যম পারিবারিক/অনির্দেশিত তু তহোনি/তোহনলোগ
পারিবারিক/ভদ্রোচিত তু তোহনি/তোহনিলগ
ভদ্রোচিত রউরে রওরেসন/রওরনি
প্রথম নির্দেশিত নয় উ (পুং) উহ/উলোগ
নির্দেশিত নয় উ (নারী) অহনিকে/লোগ
সম্মানার্থক হুকনি হুকনিলোগ/হুকনিকে
নির্দেশক
যে সকল শব্দ ব্যবহার করে কোনো কিছুকে নির্দেশ করা হয় সেই সকল শব্দকে নির্দেশক বলে। যেমন: এটা, ওটা, এইগুলো, ঐগুলো ইত্যাদি। রবিদাসীয় নাগরী ভাষায় তেমনই কিছু নির্দেশক রয়েছে। যেমন: হই (এই, এটা), হইকুল (এইগুলো), হওকুল (ঐগুলো), হও (ওটা) ইত্যাদি।
বিশেষণ পদ
যে পদ দ্বারা বিশেষ্য, সর্বনাম প্রভৃতি পদের দোষ, গুণ, অবস্থা সংখ্যা ইত্যাদি প্রকাশ পায় তাকে বিশেষণ পদ বলে। বিশেষণ বিভিন্ন প্রকার―
গুণবাচক বিশেষণ: মিঠা ফল―মিষ্টি ফল। চুকা ফল―টক ফল।
পরিমাণবাচক বিশেষণ: এগো অদমী―একজন লোক।
অবস্থাবাচক বিশেষণ: গরমি ভাত―গরম ভাত। পচল আলু―পচা আলু।
ক্রিয়া বাচক বিশেষণ: সুতল লেইকা―ঘুমন্ত শিশু। উড়ল চিরই―উড়ন্ত পাখি।
ক্রিয়ার বিশেষণ: জলদি আও―তাড়াতাড়ি আস। আচ্ছা সে/নিমন সে কহু―ভালো করে বলো।
ক্রিয়ার বিশেষণের বিশেষণ: বহুত নিমন/আচ্ছা রহনি―খুব সুখে ছিলাম।
সংখ্যাবাচক বিশেষণ: এগো আদমী―একটা লোক।
বিশেষ্যের বিশেষণ: যে বিশেষণের দ্বারা বিশেষ্যর অবস্থা প্রকাশ পায় তাকে বিশেষ্যের বিশেষণ বলে। যেমন:
নিমন নাচ―চমৎকার নাচ।
আচ্ছা আদমী―ভালো লোক।
বিশেষণের বিশেষণ: যে বিশেষণ দ্বার বিশেষণ পদের অবস্থা প্রকাশ পায় তাকে বিশেষণের বিশেষণ বলে। যেমন:
বহুত আচ্ছা অদমী―অনেক ভালো লোক।
বহুত মিঠা ফল―খুব মিষ্টি ফল।
বহুত চুকা ফল―খুব টক ফল।
রবিদাসীয়া নাগরী ভাষায় আরো কিছু বিশেষণ আছে যা দিয়ে বেঁচে থাকা কিংবা শরীরের অবস্থা, স্বাস্থ্য সম্পর্কে ধারণা দেয়। যেমন:
বয়সসংক্রান্ত বিশেষণ: জোয়ান (তরুণ) > জুয়ান; বুড়হা/বুঢ্ঢা (বুড়ো) > বুড়হা/বুঢ্ঢা; নয়া (নতুন) > নায়া ইত্যাদি।
জীবনসংক্রান্ত : জিয়ত/জিন্দা (জিবিত) > জিয়াতা; মরল/মুরদা (মৃত) > মুওল ইত্যাদি।
স্বাস্থ্যসংক্রান্ত : রোগী (অসুস্থ) > রোগী, নিরোগ (ভালো) > রোগ নেইখে ইত্যাদি।
বচন
মৈথিলী, আওয়াধি, হিন্দি, নেপালি এবং ভোজপুরির মতোই রবিদাসীয়া নাগরী ভাষায় বচন দুই প্রকার: একবচন ও বহুবচন। একবচন দ্বারা একটিমাত্র বস্তু বা একজন মাত্র ব্যক্তি বোঝায় এবং বহুবচন দ্বারা একাধিক ব্যক্তি বা বস্তু বোঝায়। ভোজপুরি ভাষায় বিশেষ্য পদের সঙ্গে অন/বন প্রত্যয় যুক্ত করে বহুবচন করা হয়। এ ছাড়া সর্বনাম ও বিশেষ্য পদের সাথে সম্মানার্থে ‘লোগ’ এবং অসম্মানার্থে ‘সব’ যুক্ত করেও বহুবচনে রূপান্তরিত করা হয়।৪ ভোজপুরির মতো ডোমাই ভাষায় একবচন থেকে বহুবচন করতে বিশেষ্য পদের শেষে ‘লোগ’ এবং ‘সব’-এর পরিবর্তে অন/সন/বন প্রত্যয় যুক্ত করা হলেও রবিদাসীয় নাগরী ভাষায় সকল ক্ষেত্রে ‘কুল’ প্রত্যয় যুক্ত করা হয়। অথচ ভোজপুরিতে কেবল প্রাণীবাচক বিশেষ্যের ক্ষেত্রে ‘কুল’ প্রত্যয় যুক্ত হতে দেখা যায়।৫
যেমন:
রবিদাসীয় নাগরী একবচন নাগরী বহুবচন ডোমাই একবচন ডোমাই বহুবচন
মছরি (মাছ) মছরিকুল মছরি মছরিকুল
কওয়া (কাক) কওয়াকুল কৌয়া কৌয়াকুল
ঘইলি (কলস) ঘইলিকুল ঘইলা ঘইলাঅন/ঘইলাসন
অদমী (মানুষ) ঢের আদমী আদমী আদমীলোগ
লেইকা (শিশু) লেইকাকুল লেইকা লেইকাবন/লোগ
দোস্ (বন্ধু) দোসকুল দোস্ত দোস্তলোগ
গাছি (গাছ কাটে যারা) গাছিকুল গাছি গাছিসন
মোওগী (মহিলা) মোওগীকুল মেহ্রারু মেহরারুঅন/লোগ
হাকিম (বিচারক) হাকিমওয়াকুল হাকিম হাকিমলোগ
বহি (বই) বহিকুল কিতাব কিতাব্অন
রবিদাসীয় নাগরীর ক্ষেত্রে ভোজপুরি শব্দের যে পরিবর্তন তা সকল ক্ষেত্রে অনুসরণ না করলেও ভোজপুরির বিশেষ প্রত্যয় যুক্ত করে তা পরিবর্তিত হয়েছে। কাজেই বলা যায়, রবিদাসীয়া নাগরীর বচনের ক্ষেত্রে ভোজপুরির নিয়মকেই অনুসরণ করে থাকে।
পুরুষ
বাংলা-ইংরেজির মতো রবিদাসীয় নাগরী ভাষায় পুরুষ তিন প্রকার: উত্তম পুরুষ, মধ্যম পুরুষ ও প্রথম পুরুষ।
বক্তার নিজের বা নিজেদের সম্পর্কে উত্তম পুরষ, বক্তা যার সঙ্গে কথা বলছে তার সম্পর্কে মধ্যম পুরুষ এবং বক্তা উত্তম ও মধ্যম ব্যতীত অন্য যার সম্পর্কে বলছে সে বা তারা প্রথম পুরুষ।
উত্তম পুরুষ
হম্ (আমি) > হম।
হম্নি (আমরা) > হমনি।
হম্নিকে (আমাদের) > হমনিকে।
মধ্যম পুরুষ
তু (তুমি/তুই) > তু।
তুলোগ/তেলোগ (তোমরা/তোরা) > তোহনি।
তোহারলোগকে (তোমাদের) > তোহনিকে।
প্রথম পুরুষ
উ/ও (সে) > উ।
উকনি (তারা) > হুকনিকে।
ক্রিয়ার কাল
সাধারণ বর্তমান: ডোমাই ভাষায় খাই এবং খাচ্ছির মধ্যে অর্থাৎ সাধারণ বর্তমান বা ঘটমান বর্তমানের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হয় না বা কথক এই দুয়ের মধ্যে কোনো পর্থক্য করতে পারে না। এই একইভাবে রবিদাসদের ভাষাতেও বর্তমান ও ঘটমান বর্তমানের মধ্যে কথক পার্থক্য করে না। বর্তমান কালে নাগরীতে একবচনে -ল, -ইলা, -অস এবং বহুবচনে -সো প্রত্যয় যুক্ত হতে দেখা যায়। যেমন:
হম ভাত খাইলা―আমি ভাত খাই।
হমনিকে ভাত খাইলাসো―আমরা ভাত খাইলাসো।
তু ভাত খালস―তুই ভাত খাস।
তোনিকে ভাত খালোসো―তোমরা ভাত খাও।
উ ভাত খারা―সে ভাত খায়।
হুকুনিকে ভাত খালাসো।
আমরা ভোজপুরি ডোমাই ভাষায় পুরাঘটিত বর্তমান কালের ক্রিয়াপদের শেষে যেমন: লে সন, -লে বারো, -লে বানী প্রত্যয় যুক্ত হতে দেখি, তেমনি রবিদাসীয়া নাগরী ভাষায় -নিও/অ, -নিয়া সো, -লহ, -লহ সন প্রভৃতি প্রত্যয় যুক্ত হতে দেখি। যেমন:
১. হম ভাত খইনিও―আমি ভাত খেয়েছি।
২. হমনিকে ভাত খইনিয়াসো―আমরা ভাত খেয়েছি।
৩. হুকনিকে ভাত খইলোসন―তারা ভাত খেয়েছে।
আমরা ডোমাই ভোজপুরিতে বহুবচনের ক্ষেত্রে ক্রিয়াপদের সঙ্গে -সন প্রত্যয় যুক্ত হতে দেখেছি। এখানে নাগরী ভাষায় সেই রূপমূলের ব্যতিক্রম ঘটেনি। ৩ নম্বর বাক্যে সর্বনাম পদটি বিশেষ্য হওয়ার জন্য ক্রিয়াপদে সন যুক্ত হয়েছে। ২ নম্বর বাক্যের সর্বনাম পদ বহুবচন হওয়ায় ক্রিয়াপদে -সন-এর সংক্ষিপ্ত রূপ -সো যুক্ত হয়েছে।
অতীত কাল : রবিদাসীয়া নাগরী ভাষায় অতীত কাল ও পুরাঘটিত বর্তমান কালের কোনো পার্থক্য লক্ষ করা যায় না। অর্থাৎ ‘খেয়েছি’ ও ‘খেয়েছিলাম’-এর মধ্যে মোটা দাগে কোনো পার্থক্য তারা করে না। ফলে অতীত কালে একবচনে -নিও/অ, -লহ এবং বহুবচনে -নিও সো, -লহ সো/সন যুক্ত হয়। যেমন:
১. হম ভাত খয়নিও―আমি ভাত খেয়েছিলাম।
২. হমনিকে ভাত খয়নিওসো―আমরা ভাত খেয়েছিলাম।
৩. তু ভাত খয়লহ―তুমি ভাত খেয়েছিলে।
৪. তুহনিকে ভাত খয়লসো―তোমরা ভাত খেয়েছিলে।
৫. হুকনিকে ভাত খয়লহসো―তারা ভাত খেয়েছিল।
ভবিষ্যৎ কাল : ভবিষ্যৎকালে নাগরী ভাষাতেও একবচনে -ব, -বে, -বো এবং বহুবচনে -বসো, -বোস প্রত্যয় যুক্ত হয়। যেমন:
১. হম খাইব―আমি খাবো।
২. তু খইবো―তুমি খাবে।
৩. উ খাইবো―সে খাবে।
৪. হমনিকে খইবসো―আমরা খাবো।
৫. তুহনিকে খইবসো―তোমরা খাবে।
৬. হুকনিকে খয়বোস―তারা খাবে।
বাক্যতত্ত্ব ( বিশ্বাস,২০২৩:১২৫-১২৮)
ডোমাই ভাষার মতোই নাগরী ভাষায় বাক্য গঠিত হয় SOV পদ্ধতিতে। তবে ডোমাই ভাষার মতোই বাক্য গঠনের ক্ষেত্রে কর্তা কর্ম ক্রিয়ার অবস্থানের পরিবর্তন হলেও নাগরী ভাষায় সাধারণত অর্থের কোনো পরিবর্তন ঘটে না। ডোমাই ভাষায় না-বাচক বাক্যের ক্ষেত্রে সাধারণত হিন্দির মতো যেমন ‘না’ ক্রিয়ার পূর্বে বসে একইভাবে নাগরী ভাষায়ও ‘না’ ক্রিয়ার পূর্বে বসে। যেমন: হম নত খাইব্―আমি খাবো না। এখানে ভোজপুরি ও ডোমাই বাক্যের সঙ্গে নাগরী বাক্য উপস্থাপন করা হলো।
ক্রমিক বাংলা ডোমাই ভোজপুরি নাগরী/রবিদাসী ভাষা
১ তুমি কেমন আছ? তু কেইসন বারো? তু কা হাল বা? তু কেওসন বারো?
২ তোমার নাম কী? তোহার নাম কা হ? তোহার নাভ কা হা? তুহার নাম কা হ?
৩ আমার নাম রুবেল। হমার নাম রুবেল। হামার নাভ রুভেল হা। হামার নাম রুবেল হ।
৪ আপনার বাড়ি কোথায়? তোহার ঘর কাহা? তু কাহা আন সে হাভ? তুহার ঘর কাহা হ?
৫ আমি ঢাকা থাকি। হম ঢাকা রহেলি। হাম ঢাকা সে হাইন। হম ঢাকামে রহিলা।
৬ আমি তোমাকে ভালোবাসি। হম তোহারকে ভালোবাসতানি। হাম তোহ সে পেয়ার করেইন। হম তোরাকে ভালোবাসিলা।
৭ টয়লেট কোথায়? পাইখানাকে জাগা কাহা? পাইখানা কেন্নে বা? পাইখানাকে জাগা কাহা?
৮ সাহায্য কর। সহযোগিতা করওয়া।
মাদাদ কারা। সহযোগিতা কইদিও।
৯ পুলিশ ডাকো। পুলিসকে বুলাও। পুলিশ কো বুলা আভা। পুলিশকে ডাকু।
১০ আমি জানি না। হম নেয়খে
জানলি/জানোতানি। হাম কে নেইখে মালুম।
হম না জানিলা।
১১ আমি বুঝতে পারছি। হম বুঝে
সকনি হই। হাম সমজ্হাতানি।
হম বুঝতানি।
১২ আপনার মঙ্গল হোক। তোহার মঙ্গল রাহে হ। কিসমত বাদিহিয়া রাহে।
তুহার খুব নিমন হকক।
পশ্চিমবঙ্গে বা বাংলাদেশের বাঙালিরা একই ভাষা সম্প্রদায়ের মানুষ হয়েও যেমন তারা কখনোই একই রকম উচ্চারণ ও ভাষারীতি ব্যবহার করেন না। তেমনিভাবে রবিদাস, বঁশফোর বা ডোম সম্প্রদায় একই ভাষা সম্প্রদায়ের মানুষ হয়েও একই রকম উচ্চারণ বা বাগরীতি ব্যবহার করেন না। এদিকে ভাষাবিজ্ঞানীরা আনুমানিক ২০ কিলোমিটার পরপর বৃহত্তর ভাষা সম্প্রদায়ের ভাষার মধ্যেও বিশেষ পরিবর্তন বা পার্থক্য দেখতে পান। এ কারণেই একই ভাষা সম্প্রদায়ের মানুষ হওয়া সত্তে¡ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যকার ভাষায় ভিন্নতা দেখা যায়। শুধু তা-ই নয়, দেশের জেলাভিত্তিক ভাষাগুলোর মধ্যেও পার্থক্য লক্ষ করা যায়। এই পার্থক্যগুলো হয়ে থাকে শব্দচয়ন এবং উচ্চারণভঙ্গিতে। তাই আমরা ভাষাগুলোকে শনাক্ত করতে এদের বিভিন্ন নাম দিয়ে থাকি। যেমন: ঢাকাইয়া, চাটগাঁইয়া, সিলেটি, বরিশাইল্যা ইত্যাদি। অর্থাৎ প্রতিটি অঞ্চলের ভাষায় মান ভাষার সঙ্গে উচ্চারণগত, ধ্বনিগত ও রূপগত পার্থক্য লক্ষ করা যায়। উপভাষা হচ্ছে মূল ভাষার একটি আঞ্চলিক রূপ। এই আঞ্চলিক ভাষার ভাষারূপটি যদি বৃহত্তর অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর মধ্যে মূল ভাষার সঙ্গে স্বতন্ত্রভাবে পার্থক্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়, তাহলে সেটি একটি আলাদা ভাষা হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যাবে।
বর্তমানে উপভাষা শব্দটি কোনো অঞ্চলের ভাষা বৈচিত্র্যকেই কেবল নির্দেশ করে না ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণি ও পেশার ভাষাও নির্দেশ করে। যেমন: চোরের উপভাষা, মাঝির উপভাষা, জেলের উপভাষা ইত্যাদি। এভাবে প্রতিটি পেশা ও শ্রেণির ভেতর রূপায়িত হয় তাদের ভাষার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কেননা শ্রেণি ও পেশাগত জনগোষ্ঠীর মানুষ একই উপভাষার অন্তর্ভুক্ত হলেও তাদের ভাষায় শ্রেণিগত ও পেশাগত স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান থাকে। এ রকম স্বাতন্ত্র্য আমরা দেখতে পাই ডোম সম্প্রদায়ের মধ্যে। উত্তরাইয়া ডোমদের সঙ্গে মঘাইয়া বা বাঁশফোর সম্প্রদায়ের পেশাগত, শ্রেণিগত স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। ডোম সমাজের সামাজিক স্তরবিন্যাসের ক্ষেত্রে আমরা সেই প্রভাব দেখতে পাব।
এই অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশে বসবাসরত ডোম সম্প্রদায়ের ভাষা যেমন সেন্ট্রাল ভোজপুরি থেকে অনেকাংশে আলাদা হয়ে পড়েছে উচ্চারণ ভঙ্গিতে কিংবা ভাষার রূপগত বৈশিষ্ট্যে তেমনিভাবে রবিদাস সম্প্রদায়ের ভাষাও সেন্ট্রাল ভোজপুরি থেকে এমনকি আঞ্চলিক ভোজপুরি ডোমাইর সঙ্গে কিছুটা পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। আমরা দেখেছি একই জাতিগোষ্ঠীর মানুষ হওয়া সত্তে¡ও মঘাইয়া ও উত্তরাইয়া ডোমদের ভাষার মধ্যে গোত্রভিত্তিক ভাষিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। একইভাবে রবিদাসদের ভাষাকে নাগরী বা দেশওয়ালী বলা হলেও তাদের ভাষায়ও ডোমাই ভাষার মতোই ভোজপুরি ও বাংলার প্রভাব ব্যাপক। মৌলভীবাজারের চা বাগানে ভোজপুরি ভাষার সঙ্গে হিন্দির প্রভাবজাত ভাষাকেও সেই ভাষা সম্প্রদায়ের মানুষ নিজের মাতৃভাষা ভোজপুরি বলে দাবি করে। এটা খুবই স্বাভাবিক যে কোনো জাতিগোষ্ঠী যেখানেই বেড়ে উঠুক না কেনো সে তার মাতৃভাষাকে অস্বীকার করতে চায় না, পারেও না। ফলে দীর্ঘ ২০০ বছরের আঞ্চলিক বিচ্ছন্নতা থাকা সত্তে¡ও এই মানুষগুলো ভোজপুরি ভাষিক অঞ্চলের ভাষাকে নিজেদের মধ্যে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। এই চেষ্টা ডোমদের মধ্যে যেমন দেখা যায়, দেখা যায় রবিদাসদের মধ্যেও। কাজেই রবিদাসদের নাগরী ও ডোমদের ডোমাই ভোজপুরিকে সাদরি বলে কোনোভাবে চালিয়ে দেওয়ার অর্থ হচ্ছে একধরনের ভাষিক আগ্রাসনের অংশ।
আমাদের ভাষাশহিদদের মূল প্রেরণাকে কাজে লাগিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপন করা হচ্ছে। কাজেই ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সকল মানুষের মাতৃভাষা যাতে টিকে থাকে তার জন্য সকল ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাপূর্ণ মনোভাব নিয়ে আমাদের কাজ করে যাওয়া উচিত।
তথ্যসূত্র
মুরমু মিথুশিলাক(২০১১), আদিবাসী অন্বেষণ, নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা।
Risley, H. H(1891), Tribes and Castes of Bengal Vol-1, Bengal secretarial prees, Calcutta.
Lohar, Gopal Thakur.( 2010). A Grammar oF Bhojpuri, T. U. Regd. No. 14176-83 Ph. D. Reg. No. 24/2010 (January), Nepal. Pdf File.

কবি, গবেষক