| 27 এপ্রিল 2024
Categories
দুই বাংলার গল্প সংখ্যা

দুই বাবা এবং বেলগাছ

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comএকটি ঠান্ডা পিস্তলসম নির্জনতার পেটের ভেতর ফুটে উঠতে দেখা গেল ছবিটিকে। ছবিটির ক্যানভাস খুব কিছু বড় নয়। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে একটি ছাদ, তাতে দুজন মানুষ। ছাদের পাশে একটি বেলগাছ। বেলগাছের ভেতর থেকে দুটো পা বেরিয়ে আছে। এই ছবিটি, এই, একেবারেই অকিঞ্চিতকর এবং সহজ ছবিটি জীবন্ত হয়ে গেল হঠাৎ। অতএব, অনিবার্য ধূলিকণা হয়ে তার রোমকূপ ঢেকে দিল কিছু ইতিহাস, কিছু জাগতিক টাকডুমাডুম। সেই ইতিহাস এবং টাকডুমাডুমের ধুলোকে নতুন আলু আর পুরনো আলুর মতো করে বেছেবুছে রাখতে হয়। সেই বাছাই করার সময়ই ছবির ভেতর থেকে শোনা গেল একটি এলেবেলে কনভার্সেশন। যা আমাদের প্রোথিত করল ছবিটির ভেতর।

 

 

ওয়াসিম কাকা আমার নাম ধরে ডাকল। দুবার। আমি দৌড়ে গেলাম। কী হল! ধরে ফেললে নাকি!

(প্রতিটি ডাকের মতো, এই ডাকটির সঙ্গেও লেজুড় হিসাবে রয়েছে একটি কারণ। কয়েকটি ইতিহাস। সেগুলো আমরা এখন দেখব।)

 

 

পুজোর ঠিক পরপর বেলার দিকে মিনিট পনেরো মতো বৃষ্টি হয়ে গেলে আমাদের বাড়ির পশ্চিমদিকের মাটি থেকে টাটকা ফুলকপি দিয়ে মাঠছেঁচা কইমাছের ঝোলের গন্ধ উঠে এসে নাকের ভেতর ঢুকে পলকা দড়ি বেয়ে নেমে গিয়ে বুকের বাঁ-দিকে টোকা মেরে আসে। আধঘন্টা মতো থাকার পর তার উপর চৌকো করে রোদ এসে বসলে সে গন্ধ চলে যায়। গত দুবছর ধরে এই গন্ধটা পাইনি। পুজোর পর বৃষ্টি আসেনি। আজ এল। আগে বুঝতে দেয়নি। একেবারে হঠাৎই। ওয়াসিম কাকা ততক্ষণে বেলগাছটার মাঝ বরাবর উঠে গেছে। আমি আর বাবা বসেছিলাম ছাদে। বাবাকে দুধ-রুটি খাইয়ে দিচ্ছি। বাবা পৃথিবীকে শেষ উল্টেপাল্টে দেখে নিয়েছিল দু-হাজার নয়ের আটই জুন অবধি। কপালের তলার মাঝারি সাইজের কাচের গুলির উপর পর্দা পড়ে গেল তারপর। বাবার নার্স আসেনি আজ। সপ্তাহে একদিন তার ছুটি। আমারও। এইদিনটায় তাই আমি-ই বাবার সারাক্ষণের সঙ্গী। বাবার একটা অদ্ভুত সমস্যা আছে। তার কারণটা জানার জন্য আমি মনোবিদ, ডাক্তার সহ অনেকের কাছেই গিয়েছিলাম। দু-একবার বোধহয় ওঝা-টোঝাও ডেকেছিলাম। তারা চেষ্টাও করেছিল। তবে সমস্যার কোনও সুরাহা হয়নি। গায়ের রং শ্যামলা। সত্তরে এসে চুল সম্পূর্ণ পেকে যাওয়ায় মুখটা একটু ফর্সা লাগে এখন। গালদুটো মাংসহীন। ভেঙে ভেতরে ঢুকে বাটি হয়ে গেছে। সেই বাটির গায়েও চটকদার সাদা ঘাস। বাছুরের সামনে ফেলে দিলে চেটে খেয়ে নেবে। জটিলতর খাঁচার মধ্যে আটকে থাকা আমার বাবার দুর্বোধ্য এই মুখের ভেতরে একটু একটু করে রুটি আর দুধের মিক্সচার ঢুকে যাচ্ছিল।

 

বেলগাছটার বয়স বিয়াল্লিশ বছর। গাছটায় বেল হয়নি দীর্ঘদিন। গাছ পোঁতার প্রায় সতেরো বছর পর প্রথম কুঁড়ি ধরে। আমার ঠাকুমা তখন বেঁচে। বেঁটে ফরসা গোলগাল মহিলা। এতদিন বাদে গাছে কুঁড়ি ধরার খবর পেয়ে আনন্দে শরীরটা ঝাঁঝিয়ে উঠে টানটান হয়ে গিয়েছিল। রোজ সকালে ঘুম ভাঙার পর গাছের তলায় গিয়ে দাঁড়াত। কুঁড়ি থেকে গাছে ফল ধরে যাওয়ার ব্যাপারটুকু বুঝে ফেলা যাবে, এই আশায়। কাকেরা ফ্যামিলি নিয়ে ভোরবেলা ভাঙা চোখে এসে এক পাতা থেকে আরেক ডালে কিতকিত খেলতে খেলতে চলে যেত। কাঠঠোকরা ব্রেকফাস্ট সারত ঠকঠক করে। সূর্যের নির্বোধ কাঁচা আলো বেলপাতার ভিতর দিয়ে ছিঁড়ে এসে পড়ত রাণীবালা দাসীর কপালে। ঈশ্বর বিনোদবন্ধু সেনের দ্বিতীয় পক্ষ। ভদ্রমহিলা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ের মানুষ। আট বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। চিত্তরঞ্জন দাশ তখন কর্পোরেশনের মেয়র। দিনকাল ছিল অন্যরকম। আচমকা চাঁদ উঠে গেলে তার গায়ে লেগে থাকত সস্তার কাশ্মীরি চাদর। খলশে, কালবোস, ফ্যাসার মতো মাছ বিক্রি হয়ে যেত থাউকো ধরে। কিটনাশক দেওয়া সবজি পৃথিবীতে আসেনি তখনও। আমার মা যে বয়সে বাড়ির বউ হয়ে এল, সেই বয়সে রাণীবালা চার সন্তানের মা। পেটে ঢিকির ঢিকির করছে আরও একটা। বিষের চাপে মাথা ভার হয়ে যাওয়া মাদী কেউটে ছোবল মারতে এলে লেজ ধরে মাটিতে আছড়ে আড়াআড়ি থেঁতলে দিয়েছে বহুবার। সেই মানুষ কুঁড়ি থেকে ফল হওয়া দেখবে, এই আশা নিয়ে বেলগাছের তলায় যখন দাঁড়াত, তখন তার আটাত্তর বছর কয়েক মাস বয়স। কুঁড়িগুলোর ছোট সবুজ কাঠের বল হয়ে উঠতে লেগে যায় আরও বেশ খানিকটা সময়। রাণীবালা ততদিনে লেট।

 

এই শূয়োরের বাচ্চা আবার এখানে এলো কোদ্দিয়ে রে! হুরর হুরর হুটট!

ওয়াসিম কাকা একটু চেঁচালো। বৃষ্টির পুরো সময়টা বেলগাছটাকে আঁকড়ে ছিল ও। সবুজ লুঙ্গির কয়েক জায়গায় গর্ত হয়ে গেছে। ওই জায়গাগুলো দিয়ে ভালমন্দ হাওয়া পাস করে প্রায় ষাট কিলোর শরীরটাকে ধরে রেখেছে। রেগুলার প্রায় আঠারো ঘন্টা কখনও টাটকা কখনও ছেনাল-টাইপ রোদ জল খেয়ে গোটা চেহারার এপিঠ ওপিঠ ভালভাবে ভাজা। চামড়ার উপর তামার পয়সা রাখলে হিসাবটা গুলিয়ে যাবে। অল্পবয়সে টিয়াপাখির কামড়ে ডানকানের লতির নরম মাংস হাওয়া হয়ে গিয়েছিল। খালি গায়ে টানটান দাঁড়িয়ে থাকলে বয়স বোঝা যায় না। এই লোকটা আমার ছোটকাকার বন্ধু। ইস্কুলের পড়া শেষ করার আগেই নকশাল হয়ে যায়। ভাল বোম বাঁধত। সেই সময় কয়েকবার পুলিশ ধরেছিল। ছাড়া পাওয়ার পর আবার সেই, অকুতোভয় ইনকিলাব জিন্দাবাদ। শেষের দিকটা একটানা অনেক বছর জেলে কাটায়। পরে সরকার বদলের সময় জেল থেকে ছাড়া পেয়ে একটা রেডিয়ো তৈরির ফ্যাক্টরিতে কাজ করত। সেই ফ্যাক্টরি উঠে যাওয়ার পর ফোর ব্লেডের ফ্যানের ফ্যাক্টরি। সেটাও উঠে গেল এক সময়। তারপর থেকে টানা এই কাজ। বাড়ি বাড়ি জলের ট্যাঙ্ক-নর্দমা পরিষ্কার করা, গাছের বাড়তি ডাল-টাল ছেঁটে ফলটল পেড়ে দেওয়া…এইসব। নকশাল আমলে আমাদের বাড়িতেই থাকত বেশিরভাগ সময়। ছোটকাকা পড়ত ইতিহাস নিয়ে। ডায়েরিতে কবিতা লিখত ( যদিও পরে সেই সব ডায়েরি ঘেঁটে দেখেছি নিতান্তই কাঁচা হাতের লেখা। স্রেফ তেলকলের বাষ্পভরা)। সে যাই হোক, বাড়ির শান্ত এবং পড়ুয়া ছোটছেলের সঙ্গে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে নকশাল হয়ে যাওয়া ওয়াসিম কাকার এত গলাগলি ভাল চোখে দেখত না লেট রাণীবালা। আমাদের বাড়িতে কোনও লোক আসলে আর সেই সময় ওয়াসিম কাকা-ও থাকলে, ‘অসীমবলে ডাকা হত তাকে। কবিতা লেখা ছাড়াও ছোটকাকার একটা অভ্যাস ছিল। হপ্তায় একদিন বাজার থেকে কোনও একটা চারা এনে বাড়ির উঠোনে পুঁতে দেওয়া। এইভাবেই আমাদের বাড়ির সাড়ে দশকাঠা জমিতে গাছ হয়ে একে একে দাঁড়িয়ে গিয়েছে নিম, আম, পেঁপে, পেয়ারা, জামরুল, কাঁঠাল, নারকোল, ডালিম, বাতাবিরা। প্রায় চল্লিশ বছর আগের সেই সকালেও চারা কিনতে গিয়েছিল ছোটকাকা। এই বেলগাছের। বেলচারার সঙ্গে কাগজে গোল্লা পাকিয়ে কিছু মাটির দলাও নিয়ে নিয়েছিল। নকশাল আমল সেই সময় একেবারেই থিতিয়ে এসেছে। তবে পুরোটা থিতোয়নি। এদিক ওদিক থেকে তখনও কিছু খবর আসছে। তার ওপর পুলিশের খাতায় উপরের দিকে নাম থাকা নকশালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সব মিলিয়ে একটা ক্যালকুলেশন করে কাগজে মুড়ে বন্ধুর বানানো পেটো নিয়ে যাচ্ছে’-ভেবে (এমনটাই দাবি করেছিল পুলিশ ) ভরদুপুরে আমাদের বাড়িতে ঢোকার গলির মুখেই পয়েন্ট থ্রি-টু কোল্ট থেকে গুলি চালিয়ে দিল পুলিশ। একটাই গুলি।

সাত দশমিক নয় পাঁচ মিলিমিটার ব্যাসের অল্প ঠান্ডা বুলেট দুশো চল্লিশ মিটার পার সেকেন্ড বেগে হাওয়া কেটে দুই ফুসফুসের মাঝামাঝি জায়গার কয়েকটা পেশিতে আটকে রক্ত সঞ্চালন তক্ষুনি বন্ধ করে দিয়ে পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির শরীরটাকে কাটা সুপুরিগাছ বানিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। মাটিতে পুরোপুরি মিশে যাওয়ার আগে শরীরটা বাঁ-হাত দিয়ে পাশের দেওয়ালটায় ভর দিতে চেয়েছিল। পারেনি। থুতনিটা কেটে গেল তাতে। এই ঘটনার এগারোদিন বাদে ভাইয়ের তথাকথিত শ্রাদ্ধের বদলে ওই বেলচারাটা বাবা উঠোনে পুঁতল।

 

মেজদার জন্য ডাঁসা দেখে কয়েকটা পাড়ছি। ধুর! এ শালা সেই তখন দিয়ে মাথার উপর জিভ বের করে যাচ্ছে! শালার গাঁড় মারি! হুইই হুইই! ফোট!ওয়াসিম কাকা আবার চেঁচাল। বেলগাছ বেয়ে দারুণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে তুড়তুড় করে উঠে পড়ার মানুষ এই উপর নিচে অল্প চাপা গোল সাইজের গ্রহে খুব বেশি নেই বলেই আমার ধারণা। যারা এটা পারে, ওয়াসিম কাকা তাদের মধ্যে একজন। ওর গাছে চরারএকটা বিশেষ ভঙ্গি আছে। প্রথমে খানিকটা অবধি উঠে দু-হাত দিয়ে গোটা গাছটাকে নতুন বান্ধবীর মতো করে প্রাণপণে জড়িয়ে থাকে। এটা চলে মিনিট তিনেক মতো। এই পর্বে ওর চোখদুটো বন্ধ হয়ে যায়। সময়টা পেরিয়ে গেলে ও গোটা শরীরটা একটু ঝাঁকিয়ে নেয়। নিজেরও, গাছেরও। তারপর গাছের সঙ্গে সঙ্গম করার কায়দায় আস্তে আস্তে উপরে উঠতে থাকে। শেষবার যখন ও বাড়িতে আসল, নারকোল আর পেয়ারা পেড়ে দিয়ে তারপর এই গাছে উঠেছিল। বাবা তখন সুস্থ। চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার বাকি আরও বছরখানেক। বাবাকে সেদিন বেলগাছটার গোড়া, ডাল, পাতার গায়ে হাত দিয়ে দিয়ে ও মন দিয়ে বোঝাচ্ছিল কোনটা গাছের পেট, কোনটা নাভি, কোনটা থাই, কোনটা স্তন- এইসব। বোঝাতে বোঝাতেই হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল- জানো মেজদা, সমস্যা খুব। গাছে উঠতে গেলেই নুনুটা খাড়াইয়া যায়। মনে হয় যেন কচি মাইয়াডারে পেলাম”।

বরিশালের লোক। দেশভাগের তিন বছর পর এপারে চলে আসে। কাকা আগে আমাদের পাশের পাড়াতে থাকত। ফ্যামিলি মেম্বার দুজন। ও আর ওর মেয়ে। ইস্কুলের খাতায় মেয়ের নাম রাত্রি ইসলাম। ওরা বলত, আত্তি। মা মরা মেয়েটা পড়তে আসত বাবার কাছে। কমদামী সালোয়ার কামিজ পরা ফর্সা চেহারা অনেকটা তেল দিয়ে চুলটা টানটান করে বাঁধা। ক্লাস সেভেনের হাফ-ইয়ার্লিতে অ্যালজেব্রায় হায়েস্ট পেয়েছিল। কথা প্রায় বলতই না। মায়া মেশানো ঝুরঝুরে মুখের লাজুক মেয়েটাই কাউকে কিছু না বুঝতে দিয়ে সতেরো বছর বয়সে পালিয়ে গেল পাড়ার বীরেন নস্করের ছেলে বাবলুর সঙ্গে। বীরেন চালের আড়তদার। বাবলু বাবার

আড়তেই বসত। পালানোর সময় ওর বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। তিনদিন বাদে বীরেনের বাড়ির লোক দীঘা থেকে দুজনকে ধরে নিয়ে এসে বিয়ে দিয়ে দিল। এসবের মাঝখানে ওয়াসিম কাকা ছিল এক বিতারিত অনুজ্ঞার মতো। মেয়ের বিয়ে হল অথচ বাপ গেল না,
বাপকে ঢুকতেই দেওয়া হল না বিয়েতে- এমন একটা ব্যাপার ঘটেছিল। মেয়েকে দেখতে পেত না বাবা। চাহিদা তার বেশি কিছু ছিল না। মেয়ের চেহারাটায় একটু মাংস লাগল কিনা, রংটা আরেকটু খুলল কিনা- এটুকুই। মেয়ের শ্বশুরবাড়ির পাড়াতেই তার বাড়ি। যেতে আসতে গেলে পথে পড়ে যায়। মেয়েকে দেখতে না পেয়ে তার বাপ মেয়ের শ্বশুরবাড়ির আশপাশে ঘুরঘুর করে, এমনটা যাতে কেউ বলতে না পারে, সেই কারণে ওয়াসিম কাকা এলাকা ছেড়ে চলে গিয়ে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার দূরের নৈনানে চলে যায়। ততদিনে সে পুরোপুরি গাছ-ঝাড়ুনি হয়ে গিয়েছে। এর কয়েক মাস বাদেই পাড়ার একদম শেষ প্রান্তের হরির খালের ধার ঘেঁষে বেগুনি রঙের শাড়ি জড়ানো একটা ফর্সাপানা ফাঁপা খোল সকালের দিকে সকলের চোখের সামনে ভেসে উঠল। খোলটার বিভিন্ন জায়গায় আত্তির নাক-মুখ-চোখ যত্ন করে আটকানো। ও তখন সাত মাসের গর্ভবতী। এসব প্রায় বছর দশেক আগের কথা। তখনও দুটো ব্যাপার পৃথিবীর জল-হাওয়া পায়নি।
এক. বাবার অন্ধত্ব এবং বিটকেল সমস্যা।
দুই. বেলগাছে তক্ষক।
 
 
এই দুই নম্বর ব্যাপারটার দিকে আপাতত নজর দেওয়া যাক। একটা তক্ষক গত সাত-আটমাস ধরে বেলগাছটায় থাকতে শুরু করেছে। বেলগাছটা আমাদের ছাদের দক্ষিণ দিক দিয়ে টানা উঠে গেছে। বাড়িটা দু-তলা। তিনতলা হলে বেলগাছের সঙ্গে মাথায় মাথায় হতো। পুরাণমতে সর্পরাজ আর বিজ্ঞানমতে ক্রিসোপিলিয়া প্রজাতির এই প্রাণীটি ওই মাথারই ব্রহ্মতালুতে থাকে। মাঝেমাঝে ইচ্ছা হলে কপালের দিকে নেমে আসে। তাকে দেখা যায় না কখনও। খুবই লাজুক। বেলার দিকটা নিজের মনে এক ডাল থেকে আরেক ডালে লাফ দিয়ে রেস-টেস করে। তখন পাতার আড়াল থেকে ওর ‘তঁককক’-ডাক হুইসলের মতো বাজতে থাকে। দিনের বাকি সময়টুকু নৈ:শব্দ্য। সেই নৈঃশব্দ্যের আঠালো পিঠে আটকে গিয়ে কখনও টিকটিকি কখনও বাদুড় কখনও ছোট কোনও পাখি সহজ সেমিকোলনের মতো ছ্যাঁতরাতে ছ্যাঁতরাতে জায়গা করে নিতে থাকে তক্ষকটির পাকস্থলীতে। এতদিন ধরে গাছে থাকলেও তাকে আমি দেখিনি। আজ ওয়াসিম কাকার কাছে ধরা পড়ল সে। নাকি, ধরা দিল? কে জানে!
 
 
বললাম, তোমার সৌভাগ্য কাকা! এতদিন ওর আওয়াজ শোনা গেছে শুধু। এই প্রথম আমাদের বাড়ির কেউ ওকে দেখল। অবচেতনে ওয়াসিম কাকাকে ‘আমাদের বাড়ির কেউ’ বলে ফেলার পর খুব ভাল লাগল। তারপর মুহুর্তখানেক ওই তিনটে শব্দকে জিভের একটু ভেতরের দিকে ফেলে কাচের গুলির মতো নাড়াচাড়া করালাম। জিভ খুব পরিষ্কার আমার। সেই কারণেই হবে, শব্দ তিনটে বেশিক্ষণ জায়গায় থাকল না। পিছলে গিয়ে একদম ভেতরে চলে গেল। কিন্তু এ বানচোতকে না সরালে তো কাজ করা যায় না! সারাক্ষণ মাথার উপর লকলক করে যাচ্ছে! হুউউট শালা! সরে যা! যা বাপ! কাজ করতে দে!
 
শেষের দিকটা শব্দগুলো নরম হয়ে পুরোপুরি টাটকা ছানা হয়ে গেল। ওয়াসিম কাকার গলার স্বর থেকে বরিশালকে একেবারে রবার দিয়ে মুছে দিয়েছে কেউ। মগডালের কাছাকাছি উঠে গেছে ও। বেলগাছটার উপরের দিকে অসংখ্যা পাতা। ওর মাথা, গলা,বুক- সবকিছুই সেখানে ঢাকা পড়ে পাতা হয়ে গেছে। কেবল চওড়া কোমর জুড়ে প্যাঁচানো ফুটিফাটা লুঙ্গিটুকু দেখা যাচ্ছে। লুঙ্গির সঙ্গে একটা ছোট চটের ব্যাগ বাঁধা। ওই ব্যাগেই গাছ থেকে পাকা বেল বেছে বেছে নিয়ে রাখছে। গুলতির মতো দেখতে দুটো ডালে পা দুটো আলগা ভাবে রাখা। পা থেকে ডিমের একটু উপর অবধি একটানা খড়ির দাগ। বাবাকে দুধ-রুটি খাওয়ানো শেষ হয়ে গেল। অল্প একটু জিরিয়ে নিয়ে খানিকক্ষণ বাদে চেয়ার থেকে তুলে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে স্নান করাতে হবে। তার মাঝেই হঠাৎ মনে হল, ওই খড়ি ওঠা পায়ে এখন যদি একটা ভাল দেখে পেটমোটা অ্যানোফিলিস স্টিফেনসাই বসে, কাকা তাহলে কী করবে?
 
আমার বাবা ছিল পাড়ার প্রাইমারি ইস্কুলের অঙ্কের মাস্টার। বাড়িতেও প্রচুর ছেলেমেয়ে পড়াত। প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার হলেও পড়াত ক্লাস টেন অবধি। অল্পবয়সে নিয়মিত কুস্তি করত বাবা। পঁয়ষট্টিতে এসেও পেশিতে ঠাসা চওড়া তকতকে কাঠামোটার মধ্যে একমাত্র বুকের পাকা লোমগুলো ছাড়া বয়সের কোনও চিহ্ন ছিল না। সেই লোমের ভেতর যত্ন করে লেপে দেওয়া সময়ের দাগ। ইতিহাস, ভূগোল, মূল্যবৃদ্ধি, ছাপোষা প্রেম সেখানে পাশাপাশি শুয়ে আছে। ওই বয়সেই অন্ধকার এল। পড়ানোর ল্যাটা চুকল তারপর। শুরু হল একেবারে টলটলে এক জীবন। যদিও এই অন্ধত্ব একেবারেই হঠাৎ ছিল না। দৃষ্টিশক্তি কমে আসছিল বেশ অনেকদিন ধরে। মণির ওপর হালকা করে মাখনের গাদ লাগিয়ে দিয়েছে কেউ, এমনটা মনে হতো। অন্ধত্ব সম্পূর্ণ গ্রাস করার পর টানা দু’দিন বাবা কিছু খেল না। তৃতীয় দিন মুড়ি বাতাসা খেল একটু। নিজে নিজেই খেতে পারল। অনেক মুড়ি মাটিতে পড়ল। আমি সেগুলো নিঃশব্দে সরিয়ে দিলাম বাবার নাগালের বাইরে। ফেলে ছড়িয়ে খাওয়া কোনওদিনই পছন্দ করে না মানুষটা। তার বাটি থেকেই মুড়ি পড়ে গেল অনবরত। মুড়ি চিবোতে চিবোতেই একসময় আচমকা বিকটভাবে চেঁচিয়ে উঠল মায়ের নাম ধরে- ওরে রাধা, আমি আর তোকে দেখতে পাচ্ছি না রে! রাধা রে, আমি তোকে দেখতে পাচ্ছি না আর! এরকম কয়েকবার চলল। তারপর মৌন।
 
 
ঘুম কমে গেল। খাওয়া-দাওয়ারও একই দশা। কিছুই মুখে তুলতে চায় না। প্রায় ছ’ফুট লম্বা দেহের শিরাগুলো পুরো অবস্থাটাকে শিকড়ের মতো পেঁচিয়ে রয়েছে। ওদিকে হঠাৎ আলো পড়লে চমকে উঠতে হয়। নিজের বিছানায় শুয়েই থাকে বেশিরভাগ সময়। ওইভাবেই মায়ের নাম ধরে ডেকে ওঠে মাঝেমাঝে। এই সময়গুলোয় মনে হয়, বাবার শরীর ফুঁড়ে ধামা ওলটানো ধুলোয় ভরা প্রাচীন আরেক ‘বাবা’ নিশ্চিন্তে বেরিয়ে এসেছে। যে কোনও সময় সে ঘরের দেওয়াল বা ছাদ ফাটিয়ে টানটান হয়ে আমাদের ছাড়িয়ে বাইরে চলে যাবে। সেই প্রাচীনতার একদম ভেতর থেকে অন্ধত্বের প্রায় তিনমাস বাদে বাবা আমায় ডাকল। ঘরে গিয়ে দেখলাম, বিছানার ওপর থেবড়ে বসে আছে এই ক’দিনে প্রায় কুড়ি কিলো ওজন কমে যাওয়া প্রাক্তন কুস্তিগির। বস্ত্রহীন। আমি ঢুকতেই ঘ্যানঘ্যান করে উঠল- আমার গায়ে একটু ক্লাস এইটের অ্যালজেব্রার ফর্মুলাগুলো সবকটা লিখে দিবি? 
-কেন?
-দে না! কিছু দেখতে তো পাই না। পড়তে লিখতেও পারি না আর। ওগুলোর গায়ে একটু হাত বুলোবো। ওদের সঙ্গে নিয়ে থাকলে আমার আবার চোখ ফুটে যাবে। রাগ হয়ে গেল। প্রচন্ড জোরে চেঁচিয়ে উঠলাম। চ্যাঙড়ামো মারছ নাকি তুমি আমার সঙ্গে! হ্যাঁ! বুড়ো বয়সে চ্যাঙড়ামো মারছ! অভিমান করে সেদিন বাবা কিছু খেল না। চোখ বুজে রইল। ডাকলাম। সারা দিল না। চোখের মরা ডিমটা কেবল বোজা পাতার আড়াল থেকে ছটফট করছিল। পরদিন ভোর ভোর বাবাকে স্নান করিয়ে দিলাম। অন্যদিন বাবা একটু বেলা’র দিকে স্নান করে। আমি অফিস যাওয়ার পর। ততক্ষণে নার্স চলে আসে বাবার। সে-ই সব করিয়ে দেয়। স্নান করানোর পর টানটান করে বিছানায় শুইয়ে একটা মোটা স্কেচ পেন দিয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় অ্যালজেব্রার বিভিন্ন ফর্মুলা লিখে দিলাম। এ প্লাস বি হোল কিউব-টা ডান থাইয়ে, আবার এ কিউব প্লাস বি কিউবেরটা কোমরের কাছে- এই রকম। আমার মনে ছিল না একটাও। বাবা বলে বলে দিচ্ছিল। পেনের খোঁচায় প্রথমে একটু ‘মরে গেলাম রে, ওরে বাবা’ করছিল। তারপর হঠাৎ শান্ত হয়ে গিয়ে শরীরটাকে নৌকোর মতো করে নিয়ে শুয়ে রইল। রাতে বাড়ি এসে নার্সের কাছে শুনলাম, সারাদিন ওই নিয়েই মেতে ছিল। মাঝেমাঝে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ার কায়দায় ফর্মুলাগুলো বলে যেতে যেতে শরীরের যে যে জায়গায় সেগুলো লেখা রয়েছে সেই জায়গাগুলোকে সর্ষের তেল মাখার মতো করে থাবড়ে নাচার ভঙ্গী করে কাটিয়ে দিয়েছে দিনটা। এবং, সারাদিনে একবারও জামাকাপড় পরেনি। অনেক চেষ্টা করেও পরানো যায়নি। অর্থাৎ, বাবা আনন্দে ছিল। একটি বিস্ময়কর আঁধার-নৃত্যে মশগুল ছিল। এটা দরকার। এটুকু দরকার। ঠিক করলাম, এবার থেকে রোজই ফর্মুলাগুলো শরীরে লিখে দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে। তবে, শুধু ঊর্ধ্বাংশে। প্রতিদিন একজন মহিলা নার্সের সামনে নগ্ন হয়ে থাকাটা কোনও কাজের কথা না।
 
এইভাবে বছরখানেক চলার পর আরেক নতুন কিসিমের বায়নাক্কা ধরল বাবা। যখনই আমি বাড়ি থাকব, বাবাকে পিঠে নিয়ে ঘুরতে হবে খানিকক্ষণ। আমি হলাম বাবার পক্ষীরাজ। এমনটাই বিশ্বাস করে লোকটা এখন। আমার আসল নাম আর মনে নেই বাবার। ভুলে গেছে। সারা বাড়ির ঘর-উঠোন-বাগান-ছাদ অন্তত মিনিট চল্লিশ ধরে ঘুরবেই পিঠে চড়ে। রোজ। প্রথমে কয়েকদিন ততটা গুরুত্ব দিইনি ব্যাপারটা। তারপর ‘ব্যাপার’ যখন ‘বিরক্তি’ থেকে ‘সমস্যা’-তে পৌঁছল, তখন বড় ডাক্তার দেখালাম। তিনি ভালভাবে পরীক্ষা করে নিয়ে বললেন, মস্তিষ্ক অত্যন্ত স্বাভাবিক। চিন্তার কিছু নেই। যেমনটা করছেন, চালিয়ে যান। বুড়ো বয়সে অন্ধ হয়েছেন। মনোবিদ বললেন, সম্ভবত ওঁকে ছোটবেলায় এইভাবে কেউ পিঠে নিয়ে নিয়ে
ঘুরে বেড়াত। উনিও ঠিক বায়না করতেন এইভাবেই। সেটাই আবার শুরু হয়েছে এখন। কোনও এক বৃত্ত সম্পূর্ণ করার নেশায় মত্ত উনি। স্কিজোফ্রেনিকদের ক্ষেত্রে এটা হয়। যাক গে, যেভাবে চলছেন ওঁকে নিয়ে সেভাবেই চালিয়ে যান। বার্ধক্য এসেছে। দৃষ্টি ফিরে আসারও আর সম্ভাবনা নেই কোনও। অন্তত এই সহায়তাটুকু ওঁর এই সময় দরকার। আমাদের এলাকার বড় ওঝা পিটু গায়েন এসেছিল। তার জিভটা পুরো কালো। ওই কারণে ভয়ঙ্কর দেখায়। সে ঝাড়ফুঁক করে বলল, বাড়ির পুরনো বেলগাচের মগডাল থেকে বয়স্ক বেম্মদত্যি নেমে এসে তোর বাপের ঘাড়ে চেপেচে। অ্যাদ্দিন সে বাড়ির এই গাচটার মগডালে ছিল। তোর বাপ একন হয়ে গেছে বেম্মদত্যি। আর, তোকে ভাবচে বেলগাচ… এসবের ভিতর দিয়েই আমি চলতে থাকি বাবাকে নিয়ে। কখনও কখনও থেমে যাই। হাওয়া দেয় তখন। বাবা আমার গলা জড়িয়ে থাকে। মাঝেমাঝে দুই হাত ডানার মতো ঝাপটাই। মুখ দিয়ে শব্দ করি, চিঁহি। ধীরে ধীরে ক্ষীণকায় হতে থাকা আমার কুস্তিগীর অঙ্ক-প্রেমী বাবা এই মুহুর্তগুলোয় হেসে ওঠে।হাততালি দেয় আনন্দে।
 
ঠিক এই জায়গায় এসে আমরা আবার ফিরে যাই শুরুতে। ওয়াসিম কাকা আমার নাম ধরে ডাকল। দু’বার। আমি দৌড়ে গেলাম। -কী হল! ধরে ফেললে নাকি!
-কাকে ধরব! কাকার শরীরের কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না আর। আগে যেখানে পা ছিল এখন সেখানে একটা শালিখ বসে আছে।
-তক্ষকটাকে!
-ধুর! ওকে ধরা যায় নাকি! আমি অন্য জিনিস বলছিলাম! নস্করদের বাড়ির ছাদে ওটা…
কে রে! ছেলের বউ?
বীরেন নস্করের বাড়িটা তিনতলা। আমাদের বাড়ি থেকে কয়েক বাড়ি পরেই। ওদের ছাদ থেকে আমাদের ছাদ স্পষ্ট দেখা যায়। সেখানে এখন মাঝবয়সী এক মহিলা কাপড় মেলতে উঠেছে। ম্যাক্সি পরা। মাথায় তোয়ালে বাঁধা। আমি ওদিকে তাকিয়ে বললাম,
-হ্যাঁ।
কবে হল? 
-সে তো অনেকদিন!
 
বেলগাছ থেকে এবার একটা প্রবল ঝটফটানির শব্দ আসতে লাগল। কাকার কোমরে গোঁজা ব্যাগটা ধপ করে পড়ে গেল মাটিতে। বেলগুলো চলে গেল এদিক ওদিক। কাকাকে দেখা গেল একটু বাদেই। এক বৃহৎ সাপের মতো গাছটাকে জড়িয়ে রয়েছে। বেলগুলো যে পড়ে গিয়েছে, তা নিয়ে হেলদোল নেই। লুঙ্গি উঠে গিয়েছে অনেকটা। অণ্ডকোষ বেরিয়ে পড়েছে। তার মধ্যেই ফিকফিক করে হেসে যাচ্ছে প্রাক্তন নকশাল। জিজ্ঞাসা করলাম- কী হল? হাসছ কেন?
 
আমার আত্তির রূপের ধারে কাছেও লাগে না এই মেয়েছেলেটা! বুঝলি না! আবার বেলগাছের পাতার আড়ালে চলে গেল সে। প্রাক্তন জামাইয়ের ‘তত সুন্দরী নয়’ দ্বিতীয় পক্ষকে দেখে কী খুশি! ভাল করে দেখার জন্য মগডালের দিকে যাচ্ছে বোধহয়। পড়ে না যায়!বেলা বাড়ে। ছাদের দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থাকি আমি। নিচের পৃথিবী থেকে কিছু আলাভোলা শূন্যতা সরু তীর হয়ে উঠে এসে নিঃশব্দে বিঁধে ফেলতে থাকে দেহটাকে। বেশি বয়সী বেলপাতাগুলো হাওয়ায় ছিঁড়ে এসে ছড়িয়ে যাচ্ছিল ছাদের এক এক প্রান্তে। তাদের মধ্যেই একখানা কাত হয়ে পড়ে রইল দুধ-রুটির বাটিতে।
  
চেয়ারে বসে বসে এবার ঘ্যানঘ্যান শুরু করল বাবা। আজকে এই প্রথমবার। কী রে! নিবি না নাকি! কত দেরি করবি! পক্ষী! পক্ষিরাজ! কী রে ওই! নে না! ওই! হ্যাঁ! তোর বাপ তো আমি…এমনিতে থম মেরেই থাকে। কিন্তু আমি বাড়িতে থাকলে স্নান করার আগের সময়টা একদম মাথা ঠিক রাখতে পারে না।
 
এইভাবেই একটি চিরন্তন আমোদের দিকে ঢালু জায়গা দিয়ে ধীরে ধীরে গড়িয়ে চলেছিল মজ্জাহীন দ্বিপ্রাহরিক সিল্যুয়েট। তক্ষকটা যে কোনও সময় ডেকে উঠবে।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত