Categories
শিশুতোষ: বৈশাখ মাসটি কেন নববর্ষ হলো । চন্দ্রশিলা ছন্দা
আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
২০২০ এর মার্চ মাসের আঠার তারিখে শুরু হয়েছিল আমাদের দেশে লকডাউন। এরপর একটি বছর আমরা স্কুলের মাঠ দেখিনি। টিফিনের সময় হুড়োহুড়িতে মেতে উঠিনি। খেলা করিনি। এমন কি ক্লাস ফোর থেকে ফাইভে উঠে গেলাম কিছুই টের না পেয়ে। যদিও অনলাইনে ক্লাস, পরীক্ষা সবই হচ্ছিল। টিচারেরা চেষ্টা করেছেন মজা করে ক্লাস নিতে। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রচনার মত করে নিজেদের অভিজ্ঞতা লিখতে দিয়েছেন। যেমন গতকাল মুনতাসির স্যার বললেন,
-তোমরা বাংলা নববর্ষ বা বৈশাখ নিয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতা রচনা আকারে লিখে আগামী তিনদিনের মধ্যেই পোস্ট দিবে।
রচনা মানে গ্রামবাংলার অপরূপ চিত্র আর গ্রামীণ জীবনের নানাদিক তুলে ধরা। যেটা আমার খুব পছন্দের একটি সাবজেক্ট । কিন্তু মাস দুই আগে যখন আমরা সবাই মিলে গ্রামে একসপ্তাহের জন্য বেড়াতে গেলাম দাদুর বাড়িতে। তো সেই দেখে আসা অভিজ্ঞতার সাথে বৈশাখের ঐতিহ্যের কোন মিল চোখে পড়েনি। সেই ছোট্ট থেকে প্রতিবছর ঢাকায় যেভাবে বর্ষবরণ দেখেছি, রাস্তায় রাস্তায় অসাধারণ আল্পনা আঁকা, মঙ্গল শোভাযাত্রা, ঘটা করে ইলিশ মাছে পান্তাভাত খাওয়ার আয়োজন, আর দিনব্যাপী রমনার বটমূলে উৎসব। সেগুলো বইয়ের রচনায় লেখা থাকে এ কথা সত্য। কিন্তু গ্রামে এখন মাটির বাড়ি কম। দু-চারটা যা আছে, সে সবে আল্পনার বালাই নেই। তাহলে এগুলোকে কেন বলা হয় গ্রাম বাংলার চিত্র। কী যে করি ছাই! তবু চোখ দুটো বন্ধ করে দাদুর গ্রামের দৃশ্যগুলো ভাবতে শুরু করলাম।
হালকা শীতের মিষ্টি আমেজ বাতাসে। মাটি আর বুনোফুলের মাতাল করা ঘ্রাণ। ধানের জমিগুলোতে সবুজ কচি চারা গাছের দোলা। বাঁশের ঝাড়ে বকের বাসা। আর হরেকরকম পাখির কিচিরমিচির। কী অদ্ভুত সেই অনুভূতি। আমরা সবাই মিলে খোলা রিক্সা ভ্যানে করে যাচ্ছিলাম গ্রামের আলপথ দিয়ে। আব্বু বললেন,
-আগে অগ্রহায়ণ মাসে ধান কেটে নেয়ার পর কিছু দিন জমিগুলো ফাকা পড়ে থাকতো। কিন্তু এখন ইরিধান, গম ছাড়াও বিভিন্ন শস্য ফলানো শুরু হয়। ব্যপারটা ভালোই।
আমরা যখন দাদু বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছালাম তখন আমার বয়সী যত ছেলেমেয়েরা মাঠে খেলছিল তারা প্রায় সবাই খেলা ছেড়ে আমাদের ভ্যানের পিছনে পিছনে দৌড়াতে শুরু করলো। হৈচৈ পড়ে গেলো চারদিকে। আর নিমিষেই সবাই আমার বন্ধু হয়ে গেলো। আমাদের সবার ক্লান্তি যেন নিমিষেই দূর হয়ে গেলো। আমি আব্বু, আম্মু প্রতিদিন অনেক ভোরে হাঁটতে বের হয়ে চমৎকার প্রকৃতি দেখতাম। আর আব্বুর চাচা, ফুফুদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখা করে আসতাম। কাউকে কখনো পান্তা ভাত খেতে দেখিনি। গ্রামের খুব গরীব মানুষগুলিও সকালে গরম ভাতে ভর্তা কিংবা শাক দিয়ে খায়। গুড় মুড়িও খায়। অথচ বৈশাখ মানেই যেন পান্তা ইলিশ! বলা হয় এটাই নাকি গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খাবার।
এমন সময় আব্বুর ডাকে চমকে উঠতেই আব্বু বললেন,
-কিরে কী এতো ভাবছিলি?
আব্বুকে সব বলতেই তিনি বৈশাখের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরে বললেন,
-আজ থেকে শত শত বছর আগে ভারতে হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে মোগল সম্রাজ্য পরিচালিত হতো। আর হিজরি পঞ্জিকা নির্ভরশীল ছিল চাঁদের উপর। কিন্তু কৃষকদের কৃষি কাজের সাথে চাঁদের হিসাব মিলতো না। তাই কখনো কখনো তাদেরকে অসময়ে খাজনা দিতে খুব সমস্যায় পরতে হতো। খাজনা আদায়ে কৃষকদের যেন কোনো অসুবিধায় পরতে না হয় এটা ভেবেই সম্রাট আকবর বর্ষ পঞ্জিতে সংস্কার করেন। এবং মার্চের ১০ কি ১১ তারিখকে বাংলা নববর্ষ হিসেবে পালন করা শুরু করেন। বছরের প্রথম দিনে খাজনা , শুল্ক দিতে আসা কৃষকদের জন্য সম্রাট আকবর মিষ্টি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। পাশাপাশি ব্যবসায়ীরা প্রচলন করলেন হালখাতার। পুরাতন দেনা-পাওনা মিটিয়ে হিসাবের নতুন খাতা শুরু হতো। এভাবে সম্রাট আকবরের সময় থেকেই নববর্ষ একটা উৎসবে পরিণত হতে থাকে। গ্রামের প্রধানকে খাজনা দিতে আসা কৃষকদের নিয়ে কোন এক বট গাছের ছায়ায়, নদী বা ঝিলের ধারে কয়েকটি গ্রাম মিলে শুরু হতো বৈশাখী মেলা। ভোরবেলা কৃষকেরা পান্তা ভাত কিংবা পিঠা পায়েস খেয়ে নতুন জামা গায়ে দিয়ে খাজনা দিতে জড়ো হতেন নিদিষ্ট হাটে। সেখানে বিভিন্ন ব্যবসায়ীরাও তাদের পণ্য মেলায় উঠাতেন। কেউ মাছ, কেউ খেলনা, পাঁপড়, চিড়া, মুড়ি, কেউবা শাড়ি-চুড়ি, চুলের ফিতা। ধারণা করা হয় আমাদের ইলিশ মাছ খাবার ঐতিহ্য এই মেলা থেকেই এসেছে।
-কিন্তু গ্রামে তো এখন আর কেউ পান্তা খায় না আব্বু। ইলিশ মাছও না।
– হ্যা, এখন হয়তো খায় না। কিন্তু আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন তো আর এখনকার মত ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না। ফ্রিজ ছিল না। তাই রাতের বেঁচে যাওয়া ভাতে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রেখে পান্তা করে পেয়াজ কাঁচা মরিচ লবন দিয়ে মেখে দারুণ মজা করে খাওয়া হতো। শুধু তাই নয়, আমরা রাতের রেখে দাওয়া শুকনো ভাতও সরিষার তেল আর কাঁচা মরিচ পেয়াজ, লবন দিয়ে মেখে নিয়ে মুঠো করে ভাই বোনেরা খেয়ে বেড়াতাম। এছাড়াও রাতের ভাতকে সকালে তোমার দাদী পেয়াজ মরিচ ভেজে খুব চমৎকার করে বাগাড় দিয়ে ভাত ভাজতেন। এক ভাতেরই কত রকম স্বাদ নিয়েছি ছোটবেলায়।
-বাগাড় দেয়া ভাজা ভাত? মানে ফ্রাইড রাইসও না? আমি খুবই অবাক হলাম আব্বুর কথায়।
– হ্যা জায়ান বাবু। আর সেই পুরাতন রীতি রেওয়াজগুলোকেই ঐতিহ্য হিসেবে ধরা হয়। তাছাড়া তুমি কি জানো যে, রীতিনীতি, ভাষা সাংস্কৃতিকরও পরিবর্তন আছে?
আমি আব্বুর দিকে বিষ্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকাতেই আব্বু মিষ্টি করে হেসে আদর করে আমার গাল টিপে বললেন,
-থাক আমার পাক্কু বাবু, এগুলো আরও পরে জানলেও চলবে। আপাতত যতটুকু শুনলে, ততটুকু নিয়ে তোমার মুনতাসির স্যারের জন্য চমৎকার একটি বৈশাখী রচনা লেখা শুরু করো কেমন?
আব্বু চলে গেলে আমি আবার ভাবতে শুরু করলাম। বৈশাখ নিয়ে কি লেখা যায়! যা নিজের অভিজ্ঞতায় সত্য, সুন্দর আর ইতিহাসের ছোঁয়া মায়ায় ক্লাসের সবার থেকে অন্যরকম সুন্দর একটা রচনা হয়ে উঠবে?
