সবেমাত্র তখন শাশুড়ির জোরাজুরিতে সাধ খেতে বসেছে মনীষা। একটুও ইচ্ছে করছিলো না। মন চাইছিলো সুনীল বাড়ি এলে বসবে। যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলো সকাল সকাল ফিরবে তাই এই ভারী শরীর নিয়ে সকাল থেকে ঘর বার করছে।জানে আজ বাড়িতে এতো লোক দেরি করার তো কথা নয়। এদিকে শুভক্ষন পেরিয়ে যাচ্ছে তাই ঠাকুরমশাই তাড়া দিতে বসে পড়তেই হলো। বৌয়ের সাধ উপলক্ষে এলাহি আয়োজন করেছে সুনীল। বাড়ি ভর্তি আত্মীয় কুটুম, বন্ধু বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী। হালে পয়সা করেছে তাই দেখনদারি তো চাই।
মনীষা আজ নিজেকে দেখেছে আয়নায় রানীর মতো লাগছে। পরনে বিশ হাজার টাকার বেনারসি সাথে দু’সেট ভারী সোনার গয়না একটা মায়ের নাম করে আর একটা নিজের নাম করে দেওয়া। শুধু বাইরের লোকরাই নয় মনে মনে মনীষাও ভাবছিলো এসব জাঁক জমক , উপহার বৌকে ভালোবেসে নয় বরং চেনা জগৎকে অর্থের দম্ভ দেখাবার ছল মাত্র।মনীষাও জানে সুনীলের এক উপপত্নী আছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নিত্য তাকে নিয়ে অশান্তি। আগেরবার তখন ও পাঁচ মাসের অন্তঃসত্তা সুনীলের সাঙ্গপাঙ্গদের থেকে খবর পায় এক মহিলার সাথে সুনীলের অবৈধ সম্পর্কের কথা। মাঝে মাঝেই তখন থেকে রাতে বাড়ি ফেরে না। প্রশ্ন করলে বলে কাজের চাপ। সেদিন ছিল পঞ্চামৃত খাবার দিন। রাতে বাড়ি ফেরেনি। ভোর রাতে মাতাল হয়ে ফিরতে খালি বলেছিলো মনীষা- এতো তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিলো তোমার রক্ষিতা? এমন মার মেরেছিলো সেইদিন যে বাচ্চাটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। যদিও এরকম বৌ পেটানো প্রায়শই হতো তুচ্ছ সব কারণে কিন্তু সেদিন নেশার ঘোরে বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিলো সামলাতে পারেনি। তবে শুধু পেটানোই নয় বাড়ি থাকলে একটা রাতও বরের সোহাগ থেকে ছুটি মিলতো না। সেবার আর পঞ্চামৃত খাওয়া হয়নি । তারপর শুধু শারীরিক নয় মানসিক রোগ মুক্ত হতেও লেগেছিলো প্রায় কয়েক মাস। বাকি জীবনটা এরকম মুখ বুজেই সহ্য করে যেতে হবে মনীষাকে। একেই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের আট ভাইবোনের একজন। আর দুই দিদির মন্দ নয় গোছের বিয়ে হলেও ওরি এরকম রমরমা অবস্থা। এখন আর বাবা মাও বেঁচে নেই। ভাইরাও যে যার মতো আলাদা। তাই সাত পাঁচ চিন্তা করেই চেষ্টা করে সহ্য করতে কারণ এই আশ্রয়টা হারালে কোথায় গিয়ে উঠবে?
প্রেম করে বিয়ে সুনীল আর মনীষার। কসবায় রেললাইনের ওপারে একটা কলোনিতে থাকতো ওদের দুই পরিবার। আসতে যেতে দেখা হতো। তার থেকে চেনাজানা তারপর প্রেম। সুনীল এক ছেলে হলেও ওর কয়েক বোন আর বিধবা মাও আছেন। বোনেরা ভাইকে রেহাই দিয়ে যে যেমন পেরেছে বিয়ে করেছে। সুনীল শেষ অবধি ম্যাট্রিকটাও পাশ করেনি। আর মনীষার বি এ প্রথম বছর পড়ার সময় বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো। সুনীল সে সময় লেখাপড়া ছেড়ে এক স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার সাথে ঘুরছে।তারই দাক্ষিণ্যে প্রোমোটারের সাইটে যোগান দিতো ইট বালি। আর্থিক অবস্থা তখন ফিরতে শুরু করেছে। বিয়ের আগেই দু’কামড়ার এক ফ্ল্যাট কিনে মাকে নিয়ে উঠে গেলো কসবা রথতলা বড় রাস্তার ওপর একটা বাড়িতে। তারপর ভোজবাজির মতো পাল্টে গেলো জীবনধরণ। বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় গল্ফ গ্রিনে আড়াই হাজার স্কয়ার ফিটের ডুপ্লে ফ্ল্যাটে উঠে এসেছিলো। পুরোনো বাড়িতে থাকতেই আগের সন্তান আর পৃথিবীর আলো দেখেনি। অনেক বার জিগ্যেস করেছে কিসের ব্যবসা কিন্তু কোনো ঠিকঠাক উত্তর পায়নি। কানাঘুষোয় যা শুনেছে তাতে বুক ভয় হিম হয়ে যায়- বাইপাসের ধরে গেস্ট হাউস আছে আর সেখানে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে দিন দুপুরে চলে নানান কারবার। গণ্যমান্য ব্যক্তিরা নাকি শরীর জুড়োতে আসে। তাছাড়া রকসৌল, শিলিগুড়ি আর আর বনগাঁ বর্ডার দিয়ে মেয়ে পাচারের ব্যবসা চলে। কোনটা সত্যি মিথ্যে জানা নেই এও শুনেছে নাকি জাল টাকা তৈরির কারবার আছে। হঠাৎ একসাথে এতো টাকা পয়সা দেখে এতো পয়সার গরম তাই।
পায়েসের চামচটা মুখে তোলার আগেই খবরটা আছড়ে পড়ে, সুনীল মারা গেছে। তারপর আর কিছু জানা নেই। জ্ঞান হারিয়ে পৌঁছে গেছে পার্ক স্ট্রিটের নামকরা প্রাইভেট মেটার্নিটি ও চাইল্ড কেয়ার হসপিটালে। ওখানেই কার্ড করানো ছিল ।
অবস্থা জটিল দিকে যাচ্ছিলো তাই আর দেরি করা যায়নি। জ্ঞান ফিরতে শুনলো সিজার করে মেয়ে হয়েছে। মেয়ে সুস্থ আর মা তখন অনেকটাই ধাতস্ত। ঘাট কাজের আগের দিন বাড়ি ফিরে শুনলো শ্রাদ্ধ চতুর্থীতেই করা উচিত ছিল কারণ অপঘাতে মৃত্যু কিন্তু মা মেয়ের শরীরের কথা ভেবে পুরোহিত তেরো দিনের দিন কাজ করার বিধান দিয়েছেন। যাওয়ার সময় সুনীল বলে গিয়েছিলো নেপাল যাচ্ছে। তখন জানলো কলকাতা ফেরার পথ রোক্সলে সুনীল খুন হয়েছে। কাগজেও একটা ছোট খবর বেরোলো সুনীল সরকারকে কে বা কারা খুন করেছে জানা যায়নি। কারণটা যতদূর সম্ভব টাকা পয়সা বখরা সংক্রান্ত। বহু লোকের টাকা চোট করেছেন এমন অভিযোগ আছে ।
শ্রাদ্ধ ঠিকঠাক হয়ে গেলেও গোল বাঁধলো নিয়ম ভঙ্গের দিন। নিচে কমিউনিটি হলেই ছোট করে আয়োজন হয়েছিল। একদম অল্প বয়সী এক মহিলা দামি গাড়ি চেপে কোলে এক দুধের শিশুকে নিয়ে হাজির। নাম জানালো রত্না অরোরা সরকার । সুনীল সরকারের বাইপাসের অফিসে চাকরি করতো। সেখানেই সুনীলের সাথে প্রেম তারপর বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে দেয়। বর্তমানে যে ফ্ল্যাটে থাকে সেটা রত্না সরকারের নামেই কেনা। সদ্য মেয়ে হয়েছে। হিসেবে কষে দেখা গেলো মনীষার মেয়ের থেকে রত্নার মেয়ে আধ বেলার বড়।
গতকাল স্বামীর পারলৌকিক কাজ মিটিয়ে আজ এসেছে নিজেরটা বুঝে নিতে। রত্না জানে ওর স্বামীর আর এক স্ত্রী আছে তাই এসেছে স্বামীর সম্পত্তির অর্ধেক দাবি করতে। ভালোভাবে মেনে নিলে ঠিক আছে না হলে ও কোর্টে যেতে বাধ্য হবে। গল্ফগ্রিনে ফ্ল্যাট, ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা, হিসেব বহির্ভূত টাকা সব আধাআধি চাই ওনার ।
ব্যাপারটা এতটাও সহজ না যে চাইলো আর দিয়ে দিলো। যথানিয়মে দুজনেই শরণাপন্ন হলো কোর্টের। আইনি মারপ্যাঁচ এখন দারুন আধুনিক। সন্তানসহ রক্ষিতাদের সমান অধিকার আর এতো বিয়ে করা বৌ। নাই থাকতে পারে বিয়ের সইসাবুদের দলিল, বর কনের প্রচুর ছবি আছে বিয়ের সাক্ষী হিসেবে। এছাড়াও বেশ কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি সেই বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন তার প্রমাণ আছে। তাছাড়া হাঁসপাতালে বাচ্চার জন্ম পরিচয় পত্রে লেখা গোটা গোটা করে সুনীল সরকার ও রত্না অরোরা সরকারের কন্যা সন্তান ।
এসব একদিনে মেটাবার নয়। কথায় আছে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা আর উকিলে ছুঁলে? বছরের পর বছর চলতেই থাকে মামলা। মোকদ্দমা এক এক দিন এক এক রকম মোড় নেয়। কোর্টঘরে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি সময় সময় পৌঁছে যায় তিক্ততার চরম সীমায়। দু পক্ষের কেউই এক আধলা ছাড়বার পাত্রী নয়। তাই এ কেসও মেটার নয় ।
ইতিমধ্যে মনীষার মেয়ে রীনা সরকার আর রত্নার মেয়ে বর্ষা অরোরা সরকার অজান্তেই ভর্তি হয়েছে মধ্য কলকাতার একই নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম মিশনারি স্কুলে। বয়স যেহেতু এক তাই ক্লাস ও এক। বেঞ্চে পাশাপাশি দুজনেই বসে। দুজনে অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। দুজনেই স্কুল বাসে যাতায়াত করে তাই ওদের বন্ধুত্বের খবর বাড়ি অবধি পৌঁছোয় না। দুজনেই জানে ওদের বাবা নেই। বাপের সব কীর্তিকলাপের কথা বাচ্চাদের কানে কোনোদিন তোলেনি মায়েরা। তাই বাচ্চাদের এই সম্পর্কটা দু বাড়িতেই ভাবনার অতীত। বেশ একটু বড় হতে কোর্ট থেকে ডাক পড়েছে ওদের ।যাওয়ার আগে নিজেস্ব উকিলরা যথাসাধ্য ব্রিফ করেছে ক্লায়েন্টদের মেয়েদের।
কোর্টে দেখা দুজনের। তখনি জানতে পারে একই বাবার ঔরসে জন্ম দুজনের। কোর্ট ঘর স্তব্ধ। দুজনেই মায়েদের হাত জোর করে ছাড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কি সব কথা বলে জজসাহেবের কাছে আর্জি জানায় কিছু বলার আছে ওদের। বলে, – আমাদের এর মধ্যে টানবেন না। আমরা দুজনে খুব বন্ধু ভালো বন্ধুই থাকতে চাই। আমরা পসথিউমাস চাইল্ড আর হাফ সিবলিং। আমরা দুজনেই এক বাবার সন্তান হলেও আমাদের জন্মের আগে উনি মারা গেছেন তাই ওনার সন্তানের সম্পর্ক আমরা বয়ে নিয়ে যেতে চাই না। সেই ভদ্রলোক আমাদের মায়েদের সঙ্গে কি করেছে তার দায় আমরা দুজনের কেউ নেবো না। মায়েদের কাছে আমাদের অনুরোধ তোমরাও পারলে মিটিয়ে নাও না পারলে আমাদের জড়িয়ো না। আমরা বোন হতে চাই না আমরা বন্ধু থাকতেই বেশি সাচ্ছন্দ্য । দুজনেই বলছো ভদ্রলোক অসৎ চরিত্রের ছিলেন সব দিক থেকে তাহলে তার অর্থের জন্য নিজেদের মধ্যে লড়াই করছো কেন? তোমরা দুজনেই তো আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এসব করছো? করোনা কারণ আমরা নিজেদের ওপর যথেষ্ট আস্থা রাখি। ওই পাপের টাকা আমরা কোনোদিন ছোঁবো না। তখন অবধি দুজনেই স্কুলের গন্ডি পেরোয়নি। জজসাহেব বাচ্চাদুটোর এতো পরিণত বক্তব্য শুনে হতবাক।
বক্তব্য শেষ করে দুজনেই জজসাহেবের কাছে কোর্টরুম ছাড়ার অনুমতি চায় ।
![দেবযানী বসু কুমার](https://irabotee.com/wp-content/litespeed/avatar/4999b063b1299666da6d037d116ac2a0.jpg?ver=1738261087)