Categories
“রোদ্দুর খুঁজে ফিরি”র গল্পগুলো
আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট![সাদিয়া সুলতানা](data:image/svg+xml;base64,PHN2ZyB4bWxucz0iaHR0cDovL3d3dy53My5vcmcvMjAwMC9zdmciIHdpZHRoPSIxMDAiIGhlaWdodD0iMTAwIiB2aWV3Qm94PSIwIDAgMTAwIDEwMCI+PHJlY3Qgd2lkdGg9IjEwMCUiIGhlaWdodD0iMTAwJSIgc3R5bGU9ImZpbGw6I2NmZDRkYjtmaWxsLW9wYWNpdHk6IDAuMTsiLz48L3N2Zz4=)
“বহুদিন পর যেন রোদ আসছে, আসতে দাও
নত হতে দাও আকাশকে
আর একটু নত হোক আলো
আর একটু নির্জন হোক অন্ধকার”
আবুল হাসানের কবিতার মতো রোদ আসছে, যে রোদের খোঁজে ছিলাম এতদিন। মনের গুপ্ত কুঠুরিতে আলো পড়ছে, জানা হচ্ছে অজানা অচেনা প্রান্তের গল্পসমূহ। ফাহমিদা বারীর “রোদ্দুর খুঁজে ফিরি” গল্পগ্রন্থটি পড়তে পড়তে আমিও রোদের আলোর ঝলকানিতে খুঁজে ফিরেছি মানবজীবনের অচেনা গল্পগুলো।
কথাশিল্পী ফাহমিদা বারীর ভাষায়, ”ছোটগল্পের ভূবনটা আমার কাছে সবসময়ই বড়। জীবন বলতে আমি বুঝি আশ্চর্য এক জাদুর আয়না। সেই জাদুর আয়নায় কতভাবেই না প্রতিফলিত হয় নানা রঙের প্রতিচ্ছবি! আর সেই প্রতিচ্ছবিকে অল্প কিছু কারিকুরি মিশিয়ে ঝাঁকিয়ে বাঁকিয়ে ইচ্ছেমত বানিয়ে ফেলা যায় মুখরোচক সব জীবনের গল্প। হয়ত তারা নামেই ছোটগল্প কিন্তু এদের মাঝেই মিশে থাকে সমুদ্রের বিশালতা… ফেনীল গর্জন।”
প্রখ্যাত মার্কিন ছোট গল্পকার এডগার এলেন পোর মতে, Short story should be read in one setting, anywhere from a half hour to two hours.
ফাহমিদা বারীর ‘‘রোদ্দুর খুঁজে ফিরি’’ গল্পগ্রন্থের গল্পগুলো সরস ও এক বসায় পড়ে ফেলার মতো। গল্পগুলো মূলত আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের দেখা-অদেখা অন্ধকারের গল্প। “অন্ধকারের ফুল” গল্পের সুখরঞ্জন কিংবা ‘‘জিজ্ঞাসা’’ গল্পের রোজিনার জীবনের অন্ধকারের গল্পগুলো আবিষ্কার করতে করতে আলোর ফুল ফুটতেও দেখেছি।
‘‘অন্ধকারের ফুল’’ আর ‘‘জিজ্ঞাসা’’ গল্প দুটির প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও দুটি গল্পের আখ্যানে সূক্ষ্ম ধরনের মিল আছে। জীবনের বাঁকবদলের সঙ্গে পাঠককে পরিচিত করানোর জন্যই যেন গল্পকার এ দুটি গল্পে আলো-আঁধারির রহস্য তৈরির করেছেন এবং সুখরঞ্জন ও রোজিনার জীবনের সংকটের সঙ্গে পাঠকের একাত্ম হবার সুযোগও ঘটেছে।
‘‘আমি তোমার সেই বনদেবী হে যুবক…কী বর চাও আমার কাছে…বল? এই দিলাম এক সমুদ্র উদাত্ত কামনা, বৈভব রাশি রাশি…ডুবে যাও লিপ্সাকাতর চিরমন্থনে…’’ খেয়ার বোন কেয়ার লেখা চিঠির এই কটি বাক্যে যেন নিগূঢ়ভাবে ফুটে উঠেছে জীবনমন্থনের গল্প। জীবনের এই গল্পের আনন্দের উল্টোপিঠেই থাকে বিষাদযাপনের গোপন অ-সুখ। খেয়া কিংবা কেয়ার জীবনের সেই বিষাদযাপনের গল্প ‘‘বন্দি বিষাদ’’ পড়ে বিষণ্ন হয়েছি।
“ফাঙ্গাস” গল্পের গাড়িচালক ইদ্রিস মিয়ার জীবনে হঠাৎ করে ফাঙ্গাসের মতো এক উটকো বিপত্তির শুরু হয় যা সে চাইলেও মুছে ফেলতে পারে না। পরিচিত থিমের এই গল্পটি দারুণভাবে উৎরে গেছে গল্পকারের গল্প বলার কৌশলের কারণে।
“তৃতীয় নয়ন” গল্পটি একটি রহস্য গল্প। শহরের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শাহনেওয়াজ কবির মারা গেছেন। তার মৃত্যুকে ঘিরে ঘনিয়ে উঠছে ধুত্রজাল। কবির সাহেবের তিন ছেলে, পুত্রবধু, ভাগ্নে, ভাগ্নে বউসহ অনেকের সাক্ষ্য নিলেও পুলিশ মৃত্যুরহস্য উদঘাটন করতে পারে না। পুলিশ কর্মকর্তা সৌরভ খন্দকার তৃতীয় নয়ন দিয়ে রহস্য উদঘাটন করবেন-এই পর্যায়ে এসে কোনো অভূতপূর্ব ঘটনার আশা করলেও রহস্য উন্মোচিত হলো যেন গৎবাঁধা নিয়মেই তাই গল্পটির নাম “তৃতীয় নয়ন” হলেও এর যথার্থতা একটু লঘুই মনে হলো পাঠক আমার কাছে।
প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী ব্যাখ্যা করা যায় না এমন এক অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী এক কিশোরকে নিয়ে লেখা গল্প ‘অজানা সুরভি’ যে কিশোর সুরভি বা কটু গন্ধ দিয়ে চিনতে শুরু করে মানুষকে, জানতে পারে মানুষের গতিবিধি। কিন্তু যে সৌরভ সে পেতে চায়নি তাও যেন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তার নাসারন্ধ্র ভেদ করে, আর সে জেনে যায় আপনজনের কদর্যতার আখ্যান। গল্পটির বর্ণনা বেশ ধীরেসুস্থে দিয়েছেন গল্পকার, কোনো তাড়াহুড়ো ছিল না। “অজানা সুরভি” পড়ে তাই আরাম পেয়েছি আর চমকে উঠেছি সমাপ্তির টুইস্টে।
“রোদ্দুর খুঁজে ফিরি” গল্পগ্রন্থের পছন্দের একটি গল্প ‘সে কখনো আসেনি।’ গল্পটি একটি মেয়ের অপরিণত বয়সের আবেগ, ভ্রান্তি আর সেই মেয়েটিরই পরিণত বয়সের ভালোবাসার অনুভব নিয়ে লেখা। নির্মল শব্দশৈলীর বুননে গল্পটি লেখা যার সমাপ্তিটা অসামান্য।
গল্পকার ফাহমিদা বারীর গল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তার গল্পের প্রথম বাক্যটিই আটকে ফেলে পাঠককে, তারপর জালে জড়াতে জড়াতে পাঠককে নিয়ে যায় মূল গল্পে। আর তাই খুব পরিচিত বিষয় নিয়ে লেখা গল্পটিও পাঠকের কাছে হয়ে ওঠে হৃদয়গ্রাহী।
সমকালীন লেখকদের মধ্যে স্বকীয়তার গুণে ক্রমশ শাণিত হচ্ছে গল্পকার ফাহমিদা বারীর কলম। ফাহমিদা বারীর জন্য শুভকামনা রইল।
বইয়ের তথ্য:
——————
বই: রোদ্দুর খুঁজে ফিরি
গল্পকার: ফাহমিদা বারী
ধরন: গল্পগ্রন্থ
গল্পসংখ্যা: ১৩ টি
প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত
প্রকাশনী: চৈতন্য
![সাদিয়া সুলতানা](https://irabotee.com/wp-content/uploads/2019/04/FB_IMG_1555786389448-150x150.jpg)