আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিটচিত্রকলা আর কবিতা দুই-ই সৃষ্টি হয় নিজের অস্তিত্বের ভেতর, গভীর বোধনে, প্রগাঢ় অনুভবে, নিগূঢ় চিন্তায়। সেই সব চিত্রকল্পের মধ্যে প্রকাশ পায় প্রেম, হাহাকার, প্রতিবাদ আর ভাঙনের খন্ড খন্ড দৃশ্য। মনস্তাত্ত্বিক চিন্তা ও বর্ণনায় একজন কবি ও শিল্পী তা নিজের দেখার চোখে আঁকেন, লেখেন । শিল্পী আঁকেন রঙ-তুলি-রেখায়, কবি অক্ষরে-শব্দে-ভাষার শৈল্পিক ভঙ্গিতে।
এবারের বই মেলায় কবি ফরিদ কবিরের ৩১টি প্রেমের কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হলো, ‘প্রেম মন্ত্র’। এই কাব্যগ্রন্থে কবিতা ও চিত্রকলা দুই-ই মিলেমিশে সৃষ্টি করেছে একটি নান্দনিক, শৈল্পিক প্রকাশনা । গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন। বইটি যখন হাতে নিয়েছি, মন ভালো হয়ে গেল মুহূর্তে। মন ভালো হবে যে কারো, এমনই অনিন্দ্যসুন্দর প্রেমময় প্রচ্ছদ এবং বইটির চমৎকার ডিজাইন ।
![Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com](data:image/svg+xml;base64,PHN2ZyB4bWxucz0iaHR0cDovL3d3dy53My5vcmcvMjAwMC9zdmciIHdpZHRoPSIxNjAwIiBoZWlnaHQ9IjEwMzUiIHZpZXdCb3g9IjAgMCAxNjAwIDEwMzUiPjxyZWN0IHdpZHRoPSIxMDAlIiBoZWlnaHQ9IjEwMCUiIHN0eWxlPSJmaWxsOiNjZmQ0ZGI7ZmlsbC1vcGFjaXR5OiAwLjE7Ii8+PC9zdmc+)
কবি ফরিদ কবিরের কবিতার সাথে আমার সখ্যতা সেই কৈশোর বেলায়, নব্বইয়ের দশকে। খুব কাছ থেকে যখন একজন কবির সাথে কথা বলছি, তাঁর কথা শুনছি, তাঁকে কাছে পেলেই নোটবুক এগিয়ে দিয়ে কিছু লিখে দেবার আব্দার করছি তখন এমনিতেই কিশোরী মেয়ের মনে কাব্যিক দৃষ্টিকোণ তৈরী হয়, আমারও হতো। বই মেলা থেকে ছাপার অক্ষরে তাঁর সদ্য প্রকাশিত বইটি নিয়ে রাত জেগে কবিতা পড়ছি, কবিতার ভেতর ডুবে গিয়ে কল্পিত গাছ, পাতার শো শো শব্দে কেঁপে উঠছি। ভাবনারা পাখা মেলে উড়ছে কোথাও.. কবিতা পড়ছি আর ভাবছি, কী ভাবে বরফ গলে নদীর কাছে গিয়ে বন্দনা করে বৃষ্টির জল! কেমন করেই বা ‘ময়ূর শরীরে তুলে দিচ্ছে বৃষ্টিগান’ অথবা ‘তুমি কী দাঁতের ফাঁকে বরফ রেখেছ’ কিংবা ‘তুই সন্ধ্যার নীল পর্দা কেন ছিঁড়লি, কেন আনলি ছিড়েঁ মৌ- মৌ এই আলোতে’ এইসব কবিতার লাইন গুলোতে এসে থেমে পড়ছি! আর ভেসে যাচ্ছি..আমার মনে তখন কবি মানেই অন্য জগতের কেউ। কাছ থেকে কবিকে দেখা আর কাগজের অক্ষরে কবিতা পড়া এর ভেতর একটা আবেগ, আনন্দ, শিহরণ কাজ করতো । কবিতার জন্য সেই অনুরণনটা চিরকাল থাকেই যায়, থেকে গেছে। সেই থেকে কবি ফরিদ কবিরের কবিতার একজন মুগ্ধ পাঠক। তাঁর কবিতাগুলো মনের ভেতর তুমুল নাড়া দেয় আজও। তাঁর কয়েকটি কবিতা পঙক্তি প্রায়ই মনে মনে আওড়াই-
‘ আহ্! গাছ হয়ে যাচ্ছি..
সর্বাঙ্গে সবুজ গন্ধ, পাতা পাতা..
পুরো দেহ ঢেকে যাচ্ছে কঠিন বাকলে’
অথবা,
‘স্বপ্নের গুঁড়ো উড়ে যায়, উড়ে যায়
তুমি তার ডানা কখনো পারোনি ছুঁতে’
কিংবা,
‘কাছাকাছি বসো আজ এইখানে আমার সমুখে
আজ কোনো কথা নয় মনে মনে কথা হোক শুধু’
তারপরও..
‘তোমার সামনে খোলা আছে দু’টি পথ
একটি রাস্তা রাত্রির দিকে গেছে
অন্য পথের স্তম্ভে জ্বলছে আলো’-
প্রতিটি সৃষ্টির ভেতর ‘প্রেম’ দেখতে পাওয়া কবি ফরিদ কবির কবিতায় ও কথনে একজন প্রাণ খোলা সহজ মানুষ। তাঁর কবিতার ভেতর ওড়ে মেঘ, দৃশ্য, শরীর, অগ্নি, জল, সুর,ধ্বনি,পারদ,স্পর্শ, ঘ্রাণ, বৃক্ষ, শূন্য, অতল প্রেম-নৈকট্য, প্রেমমন্ত্র।
কবি ফরিদ কবিরের জন্ম জানুয়ারি ২২, ১৯৫৬, ঢাকায়। তাঁর জীবনের এ দীর্ঘ যাত্রায় বদলেছেন নানান পেশা, ব্যাংকার থেকে সাংবাদিকতা এখন নিবিড় জড়িয়ে আছেন জনসংযোগ পেশায়। আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আমার গল্প’ রচনার মাধ্যমে তিঁনি ভেঙে দেন এ দেশের প্রচলিত রীতি। তাঁর খোলামেলা অকপট সাহসী উচ্চারণের কারনে বইটি সারা ফেলে দেশে। অসংখ্য রিভিউ হয়।
কবি ফরিদ কবির বাংলা কবিতায় যোগ করেছেন নতুন ডিকশন। তিনি প্রবলভাবে নিরীক্ষাপ্রবণ। তাই তাঁর কবিতা হাঁটে নতুন নতুন পথে, তৈরী করে রাস্তা।
অনায়সে বলতে পারেন-
‘আমিই আগুন, আমিই জল। নিজেই জ্বালাই। নিজেই নেভাই। নিজেকেও। তোমাকেও। ‘
‘প্রেমমন্ত্র’ তাই শৈল্পিক চিত্রকলা ও নান্দনিক প্রেমের কবিতার অনন্য উপস্থাপনা। দেশের প্রবীণ- নবীন খ্যাতনামা ৩৩ জন শিল্পী এঁকেছেন ৩১টি চিত্রকর্ম, ৩১টি প্রেমের কবিতার জন্য। প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী শহীদ কবির । কবির প্রতিকৃতি এঁকেছেন বরেণ্য শিল্পী মনিরুল ইসলাম।
জন্ম, বেড়ে ওঠা খুলনায়। শেকড়, চট্টগ্রামের রাউজানে। আর বড় হওয়া, ঢাকায়। বই প্রিয় মানুষ। ভালো লাগে দেখতে-মানুষ ও প্রকৃতি।জীবন দর্শন- গৌতম বুদ্ধ এবং স্বামী বিবেকানন্দের কাছ থেকে প্রাণিত। চারপাশের মানুষ ও প্রকৃতিকে শুদ্ধ, সুন্দরভাবে গড়ে তোলার দায়িত্বশীলতাই তার কর্ম দর্শন।
Related