নিবু- নন্দুর বই আড্ডা (পর্ব-২)
নিবু আর নন্দু দেখা হলেই সেলফি তোলে। হাহাহিহি করে। এছাড়াও দুজনে সদ্য পড়া বই নিয়ে আড্ডা দেয়। কিন্তু এখন ওরা সামনাসামনি বসে আড্ডা দিতে পারছেনা। করোনার সঙ্ক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিবু নন্দু নিয়ম মেনে চলে। ভিডিও চ্যাটে বাধা নেই, তাই ওরা আজ সেভাবেই আড্ডা দিচ্ছিলো। এবারে ওরা বেছে নিয়েছিলো ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের লেখা রম্যরচনার সংকলন ‘স্বর্গীয় রমনীয়’। বইটি একুশ শতক দ্বারা প্রকাশিত। বিনিময় মূল্য ১০০ টাকা।
নিবু- এই বইটা আমার বেশ লাগে। হিউমার বল, মজা বল, জোকস বল, নির্মল হাস্যরস বল, নানাধরনের রম্যরচনার সমাহার ঘটেছে বলে মনে হয়।
নন্দু- একদম। লেখাগুলোর বিষয়বস্তুর বৈচিত্রও প্রচুর। সমসাময়িক ঘটনার বিষয়বস্তু থেকে শুরু করে পৌরাণিক কাহিনী- নানা আধারে রম্যরস…
নিবু- ভাষাও বিচিত্র গতিময়। সুললিত তৎসম শব্দের প্রয়োগ থেকে শুরু করে কথ্য গ্রাম্য প্রবাদের ভাষা মিলে মিশে গেছে।
নন্দু- হ্যাঁ, এটা অদ্ভুত মুনশিয়ানায় করেছেন ইন্দিরাদি। প্রচুর ইংরেজি শব্দ, যা আমাদের রোজকার জীবনে ব্যবহার হয়, সেগুলোও অনেক জায়গায় আছে, অথচ এতটুকু বেমানান লাগছে না।
নিবু- হ্যাঁ, বেশ একটা আড্ডার মেজাজ আছে অনেক জায়গায়। যেমন, এক জায়গায় জগন্নাথকে ‘জগাদা’ বলে ডাকা হচ্ছে। এটা বেশ একটু ফিচলেমি, কিন্তু একটা মজা তৈরি হচ্ছে।
নন্দু- সত্যিই! তাছাড়া যদিও ভূমিকায় বলা আছে রাজনীতি খোঁজা বারণ, তবুও বেশ কিছু লেখায় অন্তর্নিহিত রাজনীতির সূক্ষ্ম সুর আছে, যেটা রম্যরচনাকে একটা অন্য মাত্রা দিয়েছে।
নিবু- সেটা কোথাও চাপিয়ে দেওয়া মনে হচ্ছে না। রাজনীতি এবং নারীবাদের ভাবনা রম্যরসের মোড়কে পরিবেশিত হয়েছে।
নন্দু- হ্যাঁ, নারীবাদের সুর অনেক লেখায় উপস্থিত। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে গৃহবধূর জবানিতে গোল গোল মজার কথা, কিন্তু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় বেশ গভীর যাপনের কথা।
নিবু- হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস, আমার খুব প্রিয় লেখা এই ‘একুশে যোগ’ ৯৪ পাতায়, দেখ, এখানে এই যে আশ্রমকন্যাদের মত পোশাকে মহিলাদের যোগাভ্যাস করার কথা আর সেটা দেখে যাতে পুরুষরা যোগভ্রষ্ট না হয়, ঘোড়ার মত ঠুলি পরে থাকে- উফফ… হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাবে।
নন্দু- হ্যাঁ, সেই! ভারতীয় তথা বাঙালির রোজকার জীবনযাপনের ভিতরকার হিপোক্রিসি নিয়ে যে রম্যরচনা হতে পারে, এরকম আগে পড়িনি কোথাও। এখানে ১০৯ পাতায় দেখ। এছাড়াও আমার খুব প্রিয় ২১ পাতায় সরস্বতী। এখানেও অন্তর্নিহিত নারীবাদের সুর- ধীশক্তিসম্পন্ন নারীর একা হয়ে যাওয়ার কথা।
নিবু- আমার ভীষণ প্রিয় জগন্নাথ এবং কৃষ্ণকে নিয়ে লেখাগুলি। রথ ১৪ পাতায়, এছাড়াও আরও লেখা আছে। ঈশ্বরকে প্রতিদিনের কথোপকথনের মধ্যে নিয়ে আসা, শুধু হাস্যরস নয়, এও ভক্তির আরেক রূপ।
নন্দু- সত্যি! এছাড়া দুর্গা এবং দুর্গাপূজা নিয়ে লেখাগুলি এই বইয়ের অন্যতম সম্পদ। বাঙালির প্রতিদিনের জীবনের খুঁটিনাটি প্রতিফলিত হয়েছে এখানে।
নিবু- লেখাগুলির বেশিরভাগই আগে উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত।
নন্দু – হ্যাঁ, সেইজন্য অনেক লেখাই আগে পড়া, তবুও বার বার পড়তে ইচ্ছে করে।
নিবু- যেমন এই যে ৯২ পাতায় ‘ভোর ভ্রমণে ভুবনবাবু’ … এখানে দ্যাখ কবিতাটা, ‘ঘষতি ঘষতি নখরাঃ’… কী দারুণ প্রয়োগ! বাঙালি মাত্রেই স্বভাব কবি, সেইজন্য সব পরিস্থিতিতেই তার পদ্য পায়।
নন্দু- যা বলেছিস! আর কিছু লেখায় কিছু অসাধারণ উপমা পেলাম। যেমন, ৬৬ পাতায় এই ‘মেঘ-মেল’ লেখাটায় দ্যাখ… ‘চলনে বিপাশা বসু, বলনে বরখা দত্ত, ভূষণে সেনকো গোল্ড, বসনে মোনাপালি’।
নিবু- উফফ, অসাধারণ! পরের লাইনটা দ্যাখ, মেকাপ সাজগোজের কথার ভাষাটা লক্ষ্য কর!
নন্দু- সত্যি, কালিদাসের উপমা মনে পড়বে একটা আন্তর্জাতিক মেজাজের টানে। আর একটা কথা আমার মনে হয়েছে, বেশ কিছু লেখা শ্রুতিনাটকের জন্য স্ক্রিপ্ট হতে পারে।
নিবু- ঠিক। বেশ একটা বৈঠকি আরাম আছে, ভাবের ওঠাপড়া আছে; সেইজন্য যেকোনো অনুষ্ঠানে পাঠ করা যেতে পারে।
নন্দু- মন ভালো হয়ে যায়, তাই না? আমি তো মন ভারি হয়ে গেলেই ‘স্বর্গীয় রমণীয়’ উল্টে পাল্টে নেবো একবার।
নিবু- একদম। তবে শেষের ‘ডাস্টবিন’ ঐ লেখাটা পড়েছিস? ওটায় কিন্তু হাসতে গিয়েও সেভাবে হাসতে পারছি না।
নন্দু- হ্যাঁ, এটা একটা মারাত্মক স্যাটায়ারধর্মী লেখা। না, আমরা আর বেশি বলবোনা। যারা পড়বে, তারা পড়ে দেখুক, বুঝে দেখুক।
নিবু- এটা সংগ্রহে রাখা যায়, উপহার দেওয়া যায় জন্মদিনে, বিয়ে, বিবাহবার্ষিকীতে।
নন্দু – সত্যি। শুধু প্রচ্ছদ নিয়ে আমার একটা বক্তব্য আছে। বইয়ের মেজাজ সেভাবে প্রচ্ছদে প্রতিফলিত হয়নি। আরও উজ্জ্বল প্রচ্ছদ, যা পাঠকের চোখ টানবে, যেভাবে ভেতরের লেখাগুলি টানছে, সেরকম হলে মানানসই হত।
নিবু- হ্যাঁ, এছাড়াও একটা ব্যাপার যে, বইটির সূচীপত্র নেই।
নন্দু- এটা সত্যিই অসুবিধে হচ্ছে। নানা মেজাজের লেখা, খুঁজে বের করতে সমস্যা হচ্ছে। সূচীপত্র থাকা দরকার ছিল।
নিবু – যাই হোক, আশা রাখি যিনি প্রকাশক, তিনি পরবর্তী সংস্করণে এই বিষয়গুলি নিয়ে যত্নবান হবেন।
নন্দু- হ্যাঁ, এত ভালো একটা বই, সবাইকে সংগ্রহ করতে বলবো আমরা, যাতে এর অনেক সংস্করণ বেরোয়।
পরিচিতি
নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত- জন্ম ৯ই এপ্রিল, ১৯৭৫, মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জে।গৃহবধু।পড়তে ভালো বাসেন।সেই থেকেই লিখতে আসা।বিভিন্ন প্রিন্ট এবং অন লাইন ম্যাগাজিনে গল্প ও কবিতা লেখালেখি করেন।
