পার্পল জলফড়িং: নিভৃততম সময় যাপনের গাঁথা
বইয়ের উৎসর্গ পাতায় বড় হরফে লেখা ‘সময়’। নিয়ত প্রবহমান সময়কে উৎসর্গ করে লেখা যে বই, তার গল্পগুলোতে সময় নিজেই মূল চরিত্র হয়ে উঠবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। গল্পকার স্মৃতি ভদ্রের তৃতীয় গল্পগ্রন্থ ‘পার্পল জলফড়িং’–এর মলাটবন্দী নয়টি গল্পেই সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে সময় বয়ে গেছে নিরন্তর, যে সময়ের হাত ধরে এসেছে রাজনীতির পটপরিবর্তন, দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা।
স্মৃতি ভদ্রের লিখনশৈলি সুললিত, ভাষা মায়াময়। সেই মায়া বসত করে তার সৃষ্ট চরিত্রদের বুকের ভেতর, লেখা গল্পগুলোর জমিনের ভেতর। ‘পরি ও একজন মালতী–দি,’ ‘গোঁসাইবাড়ির বীথিলতা’, ‘আবর্ত’ প্রত্যেকটা গল্পেই সেই মায়া চারদিক আলো করে থাকে। একইসাথে গল্পগুলো বুনে যায় সময়ের গাঁথা। কোনো গল্প ভীষণ নরম আদুরে সময়, কোনোটাবা গণগণে জাগরণের, কোনোটা বাওরের দেশে একজন অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠবার গল্প বলে যায়।
বইয়ের প্রথম গল্প ‘পরি ও একজন মালতি–দি’তে মমিন সাহেবের অপরাধবোধ আর জাদুবাস্তবতা এক হয়ে গেছে। প্রবীণ মমিন সাহেবের অতীত, চন্দনের গন্ধমাখা এক পরির মতো কিশোরীর পরি হয়ে যাওয়ার সঙ্গেই পাঠকের সামনে এসে হাজির হয় মুক্তিযুদ্ধের আগুন দিনগুলো। অতীত আর বর্তমানের ঘুর্ণি মিলেমিশে পাঠককে ভাবনার অশেষ খোরাক যোগায় এই গল্প।
গোঁসাইবাড়ির বীথিলতার গচ্ছিত জং ধরা টিনের বাক্সের ভেতর পাওয়া একটি ছোট্ট চিঠি, আর কিছু অমূল্য সম্পদ পাঠককে নিয়ে যায় এক অনবদ্য মানবিক গল্পের ভেতর। দাঙ্গা, দেশভাগের রাজনীতির ভেতরেও বুকের ভেতরের পবিত্র অনুভবের পুরো রেশ মেলে ‘গোঁসাইবাড়ির বীথিলতা’ গল্পে।
পদ্মপুকুরে রানী ভিক্টোরিয়ার গল্প শুরু হয়েছে পঞ্চাশের দশকের শুরুতে, আর তার বিস্মৃতি ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত। লেখকের কলম এই গল্পের পরতে পরতে ছড়িয়ে দিয়েছে বিস্ময়ের জগত–
“আশি ঊর্ধ মানুষটি নিজের দ্রুততায় নিজেই খেই হারান। হাত ফস্কে পড়ে যায় রাধাগোবিন্দের মূর্তিটি পদ্মপুকুরে। নীরবতা বিসর্জন হয় জলের শব্দে।
আলোরাণী ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় পদ্মপুকুরের দিকে। ডুবে যাওয়া মূর্তিটির চারপাশে তখনো জলের আলোড়ন।
এ রাতের পর ভাদুরী বাড়িতে ভোরের কাঠটগরের জন্য আর কেউ আঁচল পেতে দাঁড়ায় না। চন্দনের সুবাস ছড়িয়ে কেউ গেয়ে ওঠে না,
ওরে নীল যমুনার জল
বল রে মোরে বল, কোথায় ঘনশ্যাম,
আমার কৃষ্ণ ঘনশ্যাম।
এক রাতের ভেতর বুড়া কীভাবে কষ্টিপাথরের মূর্তি আর আলোরাণীকে বর্ডার পার করালো তা ভেবেই সোবাহান গোলকধাঁধায় পড়ে যায়। তবে বুড়ার সাহস আছে। সবকিছু ওপাড়ে পাঠিয়ে নিজে ঠিকই মাটি ধরে পড়ে আছে।”
‘ডিজ্যাবল লাইফ’ এই বইয়ের অন্যতম শক্তিশালী গল্প। শুধু নিজের মতামত প্রকাশের জন্য বারেবারে ‘ডিজ্যাবল’ হয়ে যাওয়া তিয়াষা, ঝোড়ো সাগরে খড়কুটোর মতো তার অবলম্বন হয়ে ওঠা কল্লোল আর ছায়াসঙ্গী নীরুর দিন যাপনের গল্প এটি।
“আজ তিনদিন ধরে ফেসবুক একাউন্ট ডিজ্যাবল হয়ে আছে। ওই জগতটা থেকে দূরে থাকলে অস্থিরতা বাড়ে তিয়াষার। দূর্দশার এই সময়ে ওই একটাই মাধ্যম পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ রাখার। কীইবা করেছিলো সে? নিজের মনের কথা, বিশ্বাসের কথা অকপটে লিখেছিলো শুধু।
তবুও মানুষগুলো এভাবে লুকিয়ে থাকতে বাধ্য করছে তাকে। খুব বেশিদিন এভাবে বন্দী থাকতে হবে না তিয়াষাকে। ছেড়ে চলে যাবে এই শহর।”
শেষমেষ তিয়াষা কি এ শহর ছেড়ে বেরোতে পারবে? নীরুই বা কতখানি আগলে রাখতে পারবে তাকে? একের পর এক জিজ্ঞাসা নিয়ে পরিণতির দিকে এগিয়েছে এই অস্থির সময়ের গল্পটি।
‘শূন্য সময়’ গল্পে যে সময়ের কথা বলা সে সময় বড় টালমাটাল, তার গতিবিধি বড্ড অন্যরকম। অনেক অনেক দিন, মাস পেরিয়ে যখন তমাল আলো ঝলমল শহরে ফিরেছে, তখন তার ছেড়ে যাওয়া শহর, বাড়ি, বইয়ের তাক, সম্পর্কগুলো কি আগের মতোই আছে? লেখক লিখেছেন–
“তমাল ফিরে এসেছে। পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। মাধবীলতার ঝাড়ে ঝাড়ে লালচে গোলাপি ফুলের নিয়ম মাফিক আগমন, বারবেলায় নদীর জলের ঘোলাটে ঢেউ সব স্বাভাবিক। শুধু এ বাড়ির নিস্তব্ধতাই অনিয়মের গল্প ফাঁদছে। সেই নিস্তব্ধতায় তলিয়ে যেতে যেতেই তমালের ঠোঁট নড়ে ওঠে,
‘ আম্মা, ওরা…..?’”
যাদের কথা তমাল আম্মার কাছে জানতে চায় তাদের সমস্ত শুলুক সন্ধান কি আম্মার কাছেই আছে? যে সময়ে সব পুড়ে যায়, সেই সময়ের খোঁজ রাখার সাধ্য কি আছে কারো? বুকের গভীর থেকে উঠে আসা এমনতর প্রশ্নের সাথে সাথে পাঠক নিমজ্জিত হতে থাকে তমালের নিজস্ব অনুভবের জগতে।
স্মৃতি ভদ্রের কলম প্রশ্ন তুলতে যেমন জানে তেমনি জানে জীবনের গভীরতম যাপনের জলছবি আঁকতে। সেই জলছবির চিত্রকল্প পাঠক হৃদয়ে চিরকালীন ঠাঁই করে নিক।
গল্পগ্রন্থ– পার্পল জলফড়িং
লেখক– স্মৃতি ভদ্র
প্রকাশনী– পেন্সিল
প্রচ্ছদ– নির্ঝর নৈ:শব্দ্য
মূদ্রিত মূল্য– ২২২ টাকা
প্রকাশকাল– অমর একুশে বইমেলা, ২০২০

গল্পকার