ব্রহ্মপুত্র ও বরাকের গল্প: গরর । কান্তারভূষণ নন্দী
অস্পষ্ট ধরনের খরখর একটা শব্দ অনিমেষের গলা ভেদ করে উঠে এল আবারও। উঠে এল ঠিক তখন যখন কালো হলুদ ডোরাকাটা স্পর্টিং পরা যুবকের শক্তিশালী হাতের ধাক্কা সামলাতে শূন্য অন্ধকারে চরকির মতো দু-পাক ঘুরে জীর্ণ পান দোকানের বাঁশের খুঁটি আঁকড়ে ধরেছে সে কোনও মতে, কিন্তু স্টিলের চুড়ি অথবা আংটি তার ঠোঁটে গেঁথে যাওয়া আটকাতে পারেনি বলে বাঁ হাতের চেটোতে লালা আর রক্তের ফিকে মিশ্রণ উঠে এসেছে, আর তরঙ্গবাহিত ‘কেলা বাংলাদেশী’, ‘কেলা বঙাল’ শব্দগুলি তার অর্ধজাগ্রত চেতনাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই জেগে উঠতে গিয়ে, উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবারও ঠাণ্ডা-নরম শব্দটা শুনতে পেল অনিমেষ। পান দোকানের সামনের বাঁশের বেঞ্চিতে বসে পড়ল সে। এদিক-ওদিক তাকাল চোরা দৃষ্টিতে। নিশ্চিন্ত হল, কেউ তার দিকে তাকিয়ে নেই। সবার দৃষ্টি ফুটপাতে। সেখানে এখনও হালকা জটলা। দুটো পুলিশ হম্বিতম্বি করছে। কিশোর-যুবক এবং মাঝবয়সী কয়েকজন এখনও হাঁপাচ্ছে। এদের হাত-পা এতক্ষণ পকেটমারকে শিক্ষা দিতে সক্রিয় ছিল। নিখুঁত যন্ত্রের মতো এদের হাত-পা উঠেছে, নেমেছে। পকেটমার ছেলেটা কি বেঁচে আছে এখনও? অনিমেষ গুটি গুটি পায়ে জটলার দিকে এগোল। পাতলা গোলাপি শিফন শাড়ি পরা মহিলা উত্তেজিতভাবে পুলিশের সঙ্গে কথা বলছেন আধা অসমিয়া আধা ইংরেজিতে। উনিশ-কুড়ির পকেটমারটি ওর ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে তিরিশ হাজার টাকার মোবাইল প্রায় নিয়েই ফেলেছিল, উনি খপ করে তার হাতটা ধরে ফেলে চিৎকার জুড়ে দেওয়ায় বাছাধন আর পালাতে পারেনি।
একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়ে যাওয়া বলতে যা বোঝায়। ছেলেটার কালো ক্ষয়াটে চেহারার মধ্যে একটা চোর-চোর ভাব রয়েছে, এরকমটা তার আগেই মনে হয়েছিল এবং সেজন্য সতর্কও ছিলেন তিনি। কলো-হলুদ ডোরাকাটা আর গোলাপি শিফন এবার পুলিশ প্রশাসনকে নিয়ে পড়ল। নিরাপদ দূরত্বে সরে এসে অনিমেষ সিগারেট ধরাতে চেষ্টা করল। কম্পিত আঙুল তিনটে কাঠি নষ্ট করল। চার নম্বরে অবশ্য ভুল হল না। সিগারেটে টান দিয়ে মনে হল, সে কি ডোরাকাটাকে ভয় পাচ্ছে? শুধু ডোরাকাটা, নাকি লাল, নীল, হলদে, ডেনিস, পিউমা, লিভাইস— এমনকি স্লিভলেস গোলাপি শিফন পরিহিতাকেও? ফু! শব্দ করে একরাশ কালো ধোঁয়ায় তার ভয় বা আশঙ্কাকে অনিমেষ উড়িয়ে দিতে চাইল। ফুটপাথে, বাসস্ট্যান্ডে এখন অন্য মানুষের ভিড়। অন্য গল্প। অন্য ফিসফাস। টেনশন মুক্ত হতে হতেও প্রবল বিরক্তিতে তার মুখটা তেতো হয়ে গেল। এই যে দশদিনের মধ্যে দু-বার ‘কেলা বঙাল’ শুনতে হল, তার জন্য সে নিজেও খানিকটা দায়ী, হঠাৎই মনে হল অনিমেষের।
গত দশ দিনের মধ্যে একটা রাতও সে ভালো করে ঘুমোতে পারেনি। অথচ, তপতী, তার বউ, বারোটা অবধি টিভি দেখে অ্যান্টি এজিং ক্রিম মেখে নিশ্চিন্তে ঘুমোয়। হায়ার সেকেন্ডারি সেকেন্ড ইয়ারে পড়া ছেলে আকাশ যতক্ষণ বাড়িতে থাকে, নিজের ঘরে জাস্টিন বিবার বা হোয়াটস অ্যাপে ডুবে থাকে। কখনও অনিমেষের মুখোমুখি হয়ে গেলে আকাশ শূন্য দৃষ্টিতে তাকায়। সেই দৃষ্টিতে কোনও প্রশ্ন থাকে না, উত্তর থাকে না, মান-অভিমানও নয়। মেয়ে টুসি ডিগ্রি সিক্সথ সেমিস্টার। ছেলে যতটা মা-র কাছাকাছি, মেয়ে ততটাই বাবার। অন্তত এরকমটা ভাবতে ভালোবাসে অনিমেষ। দাঁড়াবার জন্য একটু শক্ত মাটি খোঁজা আর কি। সেই ঘটনাটার পর বিরক্ত, ক্লান্ত, বিধ্বস্ত অনিমেষের হাতের ওপর তার শান্ত স্নিগ্ধ হাত রেখে আত্মজা ভরসাবাণী শুনিয়েছে, ওরকম দু-একটা ছিঁচকে বদমায়েশের কথাকে গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই, ভয় পাওয়ারও কিছু নেই। সেই মুহূর্তে, একটুক্ষণের জন্য হলেও ঠাণ্ডা একটা বাতাস কি তাকে ছুঁয়ে যায়নি? ঘটনাটা আগাগোড়া, কমা-দাড়ি-সেমিকোলন সহ কারও কাছে উগরে দিতে চেয়েছিল অনিমেষ। অথচ ভরসাযোগ্য একটা মুখও মনে পড়ছিল না। শেষে খানিকটা মরিয়া হয়েই দুম করে যোগেশদার কাছে চলে গেল। যোগেশ কলিতা অ্যাকাউন্টসে আছেন।ইউনিয়নের বড় নেতা। একসময় মার্কামারা কমিউনিস্ট ছিলেন। এখন কী বোঝা যায় না। তবে রাজনীতিকদের ঢালাও খিস্তি করেন। এককালে বেশ সাহিত্য-টাহিত্যও করতেন। সেসময় অনিমেষও নিয়মিত লেখালেখি করত। সেই থেকেই হালকা একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। অফিস ছুটির পর অনিমেষ অ্যাকাউন্টসে গিয়ে যোগেশদাকে ধরল। ক্যান্টিনে দু-কাপ চা নিয়ে দশ দিন আগের ঘটনাটা আনুপূর্বিক বর্ণনা করল অনিমেষ।
এক সন্ধ্যায় দশ-বারোজনের একটি দল থিয়েটারের সিজন টিকিট বিক্রি করতে এসেছিল আবছা চেনা কয়েকটা মুখ, অচেনাই বেশি। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের দু-একজন দলের সামনের দিকে, টিকিট হাতে এদের একজন, টাক মাথা, ফ্রেঞ্চকাট, অসমিয়াতে গড় গড় করে বলে গেল, নতুন নামঘরের সাহায্যার্থে থিয়েটার এনেছে। তিন দিনে তিনটে নাটক। ব্যাপক খরচ! তাই আনিমেষের মতো বিশিষ্টজনদের সিজন টিকিট গছানো ছাড়া গত্যন্তর নেই৷ নানান উৎসব-অনুষ্ঠানে এরা চাঁদা নিয়ে যায়। লটারির টিকিট গছিয়ে যায়। অনিমেষ বিরক্ত হয়, রেগে উঠতে চায় কখনও কখনও৷ এরকম ক্ষেত্রে তপতী ঠিক ফাটা রেকর্ডটি বাজায়, নিয়ে নাও না। ওদের চটানো ঠিক হবে না। ছেলেও সায় দেয় মায়ের কথায়। ফলে রেগে কাঁই হয়ে যাওয়া যাকে বলে অনিমেষ সেরকমটি কোনওদিন হতে পারেনি। নানান যুক্তি তর্ক-ক্যালকুলেশনের তলায় চাপা পড়ে যায় তার যাবতীয় অহং, অহংকার। কিন্তু সেদিন, হঠাৎই তিন হাজার টাকার তিনটে রঙিন টিকিট তাকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল। ফ্রেঞ্চকাটের চোখে চোখ রেখে সে সরাসরি বলেছে, অত টাকা তো দিতে পারব না।
— কেন পারবেন না? কিয় নোয়ারে? কয়েকটি কণ্ঠ নানা স্কেলে বেজে উঠেছিল মুহূর্তেই।
—কেন মানে? পারব না, তাই পারব না। দাঁতে দাঁত চেপে আরও অনেক কথাকে চেপে দিতে দিতে অনিমেষ বলেছে— তাছাড়া, আমরা কেউ অত রাতে নাটক দেখতে যাই না। যাইনি কখনও।
এরপরই কোরাস ও কলরব।
—সে কী, আমাদের নাটক দেখেন না।
—আমাদের পবিত্র নামঘরের কথা ভাববেন না একবারও।
—জিনিস পত্রের দাম, আমাদের হেভি খরচের কথা ভাবুন।
—অত টাকা ইনকাম করেন স্যার, আর নামঘরের বেলায়…।
—এটা কিন্তু ঠিক করলেন না কাকু।
ওদের কথায়, শরীরী ভাষায় প্রচ্ছন্ন হুমকি। অনিমেষ নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছিল। ছেলেগুলো ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে, টের পাচ্ছিল সে। একসময় ফ্রেঞ্চকাট এগিয়ে এসে তিনটে টিকিটই তার হাতে গুঁজে দিয়ে অস্বাভাবিক শীতল কণ্ঠে বলেছে— সবাই পারছে যখন, আপনিও পারবেন। আসছে রোববারের পরের রোববার এসে টাকাটা নিয়ে যাব, ঠিক আছে? তারপর তার দলের দিকে তাকিয়ে বলেছে, চলরে সব। ফালতু হুজুতি ভালো লাগে না।
প্রস্তর মূর্তির মতো স্থির দাঁড়িয়ে থেকে অনিমেষ বাক্রুদ্ধ, ফুটন্ত শরীরগুলোর বিকট শব্দ করে লোহার গেট খুলে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া দেখছিল আর অন্ধকারের ভেতর থেকে ছিটকে আসা ‘নিদিব? কেলা বঙাল’ শব্দগুচ্ছ তার শরীর ঘিরে ঘুরে ঘুরে তাকে অসাড়তার দিকে ঠেলে দিয়েছিল ক্রমশ। তারপর দুর্বোধ্য আঁধার এক ছেয়ে ফেলেছিল চারদিক। তারপর আর কোথাও কোনও শব্দ নেই। পৃথিবীর শেষতম শব্দটিও যেন বহুকাল আগেই উচ্চারিত হয়ে গেছে। ঠিক তখনই একটা দৃশ্য তার মনে পড়ে গিয়েছিল। কত বছর আগে মনে নেই, তিরিশ বা পঁয়ত্রিশ হতে পারে, এ রকমই এক খাপছাড়া সন্ধ্যা, এ রকমই সব মানুষজন, এ রকমই আগুনে সংলাপ সব। বাবা দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রস্তরবৎ, আজ যেমন, যেখানে-সে। দরজার আড়ালে থাকা ভয়ার্ত কিশোর অনিমেষের কানে উড়ে এসেছিল শুধু বাড়তি একটা সংলাপ—উঠাই লই যাম।
পুরো ঘটনাটা শুনতে শুনতে দু-কাপ লাল চা খেলেন যোগেশ কলিতা। অনিমেষের হাতের ওপর হাত রেখে বললেন—এত ভাবছিস কেন ব্যাপারটা নিয়ে?
—কিছুই কি তাহলে বদলায়নি যোগেশদা? অনিমেষের জিজ্ঞাসায় আকুতি মিশে যায়।
বদলেছে তো অনিমেষ।
—কোথায় আর বদলালো৷ বদলালে কি এই কথাগুলো শুনতে হত আমাদের?
দু’জনে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা দিল। যোগেশদা অনিমেষের চোখে চোখ রাখলেন সরাসরি, সত্যি করে বল তো, বাড়িতে, ঘনিষ্ঠ মহলে আজও কি তুই বা তোরা খার খাওয়া অসমিয়া বলিস না? আমরা-ওরা বিভাজন রেখা টানিস না জেনে-না জেনে?
অনিমেষ চোখ নামায়, কিন্তু ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে, তাই বলে বাড়ি বয়ে এসে হুমকি দিয়ে যাবে? কেলা বঙাল বলবে?
যোগেশদা সিগারেটের টুকরো জুতোর তলায় পিষে দিতে দিতে বললেন, খুব অন্যায় মানছি। তোর খারাপ লাগাটা স্বাভাবিক। তবু বলি অনিমেষ, পরিস্থিতি বদলেছে, মানুষ অনেক বদলেছে মানতেই হবে। মিলনের প্রয়াস চলছে দু-পক্ষেই, অস্বীকার করতে পারবি? অনিমেষ তুই-ই না একদিন ‘রাগ থেকে অনুরাগ ও সম্পর্কের হিসেব নিকেশ’ নামে অসমিয়াতে প্রবন্ধ লিখেছিলি? মিলনের কথা লিখেছিলি সেখানে, ভুলে গেলি?
—লিখতে হয় বলে লেখা। অনিমেষ রীতিমতো বিরক্ত বোধ করল। গলার ঝাঁঝটা বজায় রেখে বলল, কিছু বদলায়নি বোধ হয়। যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা।
—না, বদলেছে। কেউ যদি বদলটা দেখতে না চায়, সেটা তার সমস্যা। যোগেশদার গলায় অপ্রত্যাশিত তেজ। যোগেশদার দৃষ্টি লাল সূর্যের দিকে। যোগেশদা তার কাঁধে ঘনিষ্ঠ হাত রাখা থেকে ভিড় বাসে সুট করে সেঁধিয়ে যাওয়া অবধি অনিমেষ দাঁড়িয়ে থাকে একা। নিঃসঙ্গ এবং খানিকটা বিধ্বস্তও। তারপর, যোগেশ কলিতা তো আর বাঙালি নন, সমস্যাটা বুঝবেন কেন? এ রকম কিছু ভেবে উঠতে গিয়ে, মুখের তেতো ভাবটা সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে যখন, অনিমেষ তখন আবছা খরখর শব্দটা আবারও শুনতে পেল।
চায়ে চুমুক দিতেই ঠোঁটে প্রচণ্ড জ্বালা অনুভব করল অনিমেষ। তবু খেল আর খেতে খেতে ঘটনাটা বর্ণনা করল কানাটানা মেরে। তপতীর গলায় উদ্বেগ ফুটে উঠল স্বাভাবিক কারণেই— কেন এ সব ঝামেলায় যাও? সবাই কি গেছিল? তুমিই বা এগিয়ে গেলে কেন? টুসি একটাও কথা বলেনি। অনিমেষের মনে হল, টুসি চোখ মুখ শক্ত করে একটা কান্নাকে চাপা দিতে চাইছে। তপতী রান্নাঘরে চলে গেলে অনিমেষ খবরের কাগজটা টেনে নিয়ে অর্থহীন চোখ বোলাল৷ টুসি ফাস্ট এড বক্স থেকে ওষুধ বের করে ঠোঁটে লাগিয়ে দিয়ে তার চুলে হাত বোলাতে শুরু করল। ঘুমের মতো একটা আরাম অনুভব করে সে, অনেকদিন পর। মা-মেয়ের সম্পর্ক এই মুহূর্তে বেশ শীতল। মাসখানেক আগে গভীর রাতে তার কানে ফিসফিসিয়েছিল তপতী, টুসি একটা অসমিয়া ছেলের সঙ্গে প্রেম করছে। ‘অসমিয়া ছেলে’ না কি ‘প্রেম করছে’, কোনটার ওপর জোর দিচ্ছে তপতী, বুঝে উঠতে পারেনি অনিমেষ। তপতী ছেলেটাকে চেনানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল, অনির্বাণ ডেকা।শ্যামলা, লম্বা চেহারা, কোঁকড়া চুল, চশমা। হতভম্ব অনিমেষের চোখের সামনে একগাদা ছেলের মুখ ভেসে উঠেছিল। ধোঁয়াটে, অস্পষ্ট সেসব ছবি। শেষপর্যন্ত কোনও একটা ছবি স্পষ্টরূপ নিয়ে ফুটে ওঠেনি।ঠিক তখনই তপতীর কাতরোক্তি ‘বড় ভয় হয় মেয়েটার জন্য’ কাঁপিয়ে দিয়েছিল তাকে, একটুক্ষণের জন্য হলেও।
তপতী এখন রান্নাঘরে। টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে রান্নাঘর থেকে। এই শব্দ চাপা ও মাপা! অনেকদিন যাবৎ। বাজার চলিত হিন্দি গানের সুর তপতীর গলা থেকে হারিয়ে গেছে, অনেকদিন যাবৎ। তপতীর টেনশনের শেষ নেই। হুমকির ঘটনা আর টুসির প্রেম নিয়ে চাপা টেনশনের সঙ্গে অনিমেষের ওপর একটা অভিমান, প্রকৃতার্থে রাগই জমাট বেঁধে আছে ওর মনে, বোঝে অনিমেষ। নাটের গুরুটি হচ্ছে তপতীর ছোট ভাই অতুল। অতুল কলকাতায় একটা বিদেশি ব্যাঙ্কের উঁচু চেয়ারে অধিষ্ঠিত। রাজাবাজার না রাজারহাট কোথায় যেন শ্বশুরবাড়ির কাছে মস্ত ফ্ল্যাট কিনেছে। এবার দিদির ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে ইদানীং বড়ো ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। তার ফ্ল্যাটের কাছাকাছি একটা ফ্ল্যাট দেখেছে দিদির জন্য। চল্লিশ লক্ষ টাকা দাম। মাত্র চল্লিশ লাখে ওই ফ্ল্যাট পাওয়া স্বর্গ হাতে পাওয়ার সামিল এবং এই মওকা হাত থেকে যেতে দেওয়া মূর্খামি ছাড়া কিছু নয়। প্রতি রাতে ফোন করে দিদিকে বোঝায় অতুল। ফ্ল্যাটের খুঁটিনাটি জানায়, সেই সঙ্গে নিজের ফ্ল্যাটের গ্যারেজ থেকে কমোডের ছবি হোয়াটস্ অ্যাপে পাঠায়। তপতী স্বপ্নের জাল বোনে, স্বপ্নে নিত্যনতুন রঙের পোঁচ দেয়।‘শেষমেশ ওদিকেই তো যেতে হবে’! দু-একদিন গভীর রাতে জীবনের সার কথাটা বোঝানোর চেষ্টা করেছে তপতী। এই মাটি থেকে শিকড় উপড়ে ফেলা আর সম্ভব নয় বুঝিয়েছে অনিমেষ। শান্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে একদিন টুসিও বলেছে মাকে যে যেখানে ইচ্ছে যাও, আমি এখানেই থাকব। তারপর থেকেই তপতী যেন একটা খোলসে ঢুকে গেছে। অনিমেষ তার নাগাল পায় না কিছুতে। মাঝে মাঝে টেলিফোনে ভাই-বোনের ফিসফিসানি আর তারপর তপতীর ভারী শ্বাসের শব্দ টের পায় সে। অনিমেষ না বোঝার ভান করে।
অনিমেষের চুলে টুসির শুভ্র, শান্ত আঙুল ঘুরে বেড়ায়। ঘুরে বেড়ায় না, আসলে হয়তো পথ খোঁজে। টুসি, টুসিরা হয়তো একদিন পথ খুঁজে পাবেও। কিন্তু অনিমেষ? অনিমেষরা? এইভাবে ভয় পেতে পেতে, অপমানিত হতে হতে, ধুঁকতে ধুঁকতে নিজ নিজ খোলসে সেঁধিয়ে যাওয়া, এই শামুকজীবন অসহ্য মনে হয় তার। শামুকও তো তার চলার পথে সূক্ষ্ম জলরেখা তৈরি করে যায়, আর— সে দিকচিহ্নহীন, দিশাহীন একটা মানুষ শুধু। সে অনিমেষ দত্ত! নিরালম্ব প্যারাসাইট বৈ তো নয়। অনেক- অনেকদিন পর তপতীর জন্য হালকা একটা দুঃখ অনুভব করে সে। কী এমন বড় দাবি রেখেছে। তপতী জীবনের কাছে, অনিমেষের কাছে? শেষ জীবনে বেঙ্গলে একটা স্থায়ী আস্তানা, কোন বাঙালি এমন স্বপ্ন দেখে না? শেষমেষে ওদিকেই তো যেতে হবে। কিছু ভুল বলেনি তপতী।
খাওয়া-দাওয়া, রান্নাঘরের কাজ শেষ করে তপতী আয়নার সামনে হালকা প্রসাধনে ব্যস্ত, প্রতিদিন যেমন। ফিনফিনে নাইটি তার নির্মেদ শরীরের প্রতিটি রেখা স্পষ্ট করে তুলেছে। অনিমেষ তার আহত ঠোঁট চেপে ধরে তপতীর ঠোঁটে। তপতী নির্বিকার, প্রশ্রয়হীন।শূন্য চোখের তলায় বিবাদচিহ্ন।অনিমেষ তপতীকে বিছানায় টেনে নিয়ে এসে বলল, অতুলকে বলো আমরা ফ্ল্যাটটা কিনছি। কাল ওর সঙ্গে কথা বলব। তুমি ঠিক বলেছিলে তপতী, শেষমেশ ওদিকেই তো যেতে হবে আমাদের।
দীর্ঘ ও সফল সঙ্গমের ক্লান্তি তপতীর ঘুমন্ত শরীরে লেপটে আছে। ইউথইনফিনিটির অভ্যস্ত প্রলেপ ছাপিয়ে অদৃশ্য এক স্বপ্ন-সুখ তার শরীরময় খেলা করে বেড়াচ্ছে। অনিমেষের ঠোঁট এখন আরও একটু রক্তাক্ত। অনেকটা সময় নিয়ে তিন পেগ লার্জ হুইস্কি শেষ করে গভীর রাতে সে সুজনদাকে ফোন করল। সুজনদা এখন দু-পেগ বিদেশি মদ খেয়ে কবিতা লিখছে, সে নিশ্চিত জানে। সুজনদা, মানে সুজন সেনগুপ্ত। একসময় তার ফ্রেন্ড, ফিলোজফার অ্যান্ড গাইড ছিলেন। কো-অপারেটিভে কাজ করেন। তিনটে কবিতার বই আছে। এই মাটির ঘ্রাণ, এতদঞ্চলের বাঙালির শিকড় সন্ধান, অসমিয়া-বাঙালি সম্পর্ক তাঁর কবিতায় ঘুরে ফিরে আসে। অধ্যাপক-গবেষকরা তার কবিতা নিয়ে প্রচুর প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। মানুষটি প্রায় অজাতশত্রু। স্নিগ্ধ একটা হাসি সারাক্ষণ ঠোঁটের কোণে ঝুলেই আছে। সুজনদা ফোন তুলতেই বিনা ভূমিকায় আক্রমণে গেল অনিমেষ।
—এই যে তুমি একটার পর একটা মিলনের কবিতা লিখে চলেছ, তোমার ক্লান্তি আসে না সুজনদা?
—মিলনের কবিতা? সুজনদা যেন বিষয়টা ধরতে পারেন না।
—এই যে তুমি লেখো— আমার একদিকে জুবিনের গান, অন্যদিকে রবীন্দ্রসঙ্গীত, এইসব কথা হৃদয় থেকে লেখ তুমি? নিজে বিশ্বাস করো?
—তোর আজ কী হয়েছে অনিমেষ? সুজনদার কণ্ঠে অকৃত্রিম উদ্বেগ।
— অনিমেষের গলা এবার আরও ঝাঁঝালো হয়, আমরা সবাই মিলে এই যে মিলনের ঢোল পেটাচ্ছি, সেটা একরতফা নয়? ওরা মিলন-মিলন বলে উদ্বাহু নাচছে আমাদের মতো? আমরা আসলে শুধু তেল দিয়ে যাচ্ছি সুজনদা।
—না অনিমেষ, তুই ভুল বলছিস। ঝগড়াঝাটির ইতিহাস ভুলে গিয়ে মিলনের ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করার কথা এখন সবাই ভাবছে। নিজের জন্যই ভাবছে, নিজের অস্তিত্বের জন্য ভাবছে।
—তাহলে আজও ‘কেলা বঙাল’ শুনতে হয় কেন? তোমরা এ সব শুনতে পাও? জোর করে জোড় দিলে জোড়টা খুব বিশ্রি হয়ে ভেসে যাবে সুজনদা।
সুজনদা ফোনের ওপারে মৃদু হাসলেন বোধ হয়। শান্ত স্বরে বললেন, তোর নেশা হয়েছে অনিমেষ। এখন ঘুমো। অন্যদিন কথা বলব না হয় এ নিয়ে। ‘এমন মিলনের পেছন মারি আমি’ বলে অনিমেষ শব্দ করে ফোনটা রেখে দিল।
পরের ফোনটা একসময়ের বন্ধু প্রাবন্ধিক সমুদ্র ভট্টাচার্যকে। সমুদ্র বাংলার অধ্যাপক। স্ত্রী অসমিয়া। সেজন্য বাংলা ও অসমিয়া দুটো ভাষাতেই অবিরাম লেখে। প্রবন্ধের কাগজ সম্পাদনা করে। ফোন তুলেই অনিমেষ বলল, ইতিহাসের কৃমি খুঁটে খুঁটে বাঙালির ভুল আর কত বের করবে বস? এবার সত্যিটা বুঝতে ও বলতে শেখো।
—কী বাজে বকছ? সমুদ্র তেঁতে উঠছে জেনেও অনিমেষ বলে যায়, এইসব আলবালছাল মিলনের গান গাইলেও তুমি বাঙালি, তুমি বাঙাল এবং তুমি বাংলাদেশী হে বন্ধু। তুমি অসমের জমি বাংলাদেশকে দিয়েছ। তোমার জন্য ডি-ভোটার, ডিটেনশন ক্যাম্প, এনআরসি। তুমি এখনও কেলা বঙাল।‘কেলা’ শব্দটা বাঙালি ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে ম্যাচ করে না, জানো… তুমি?
—অনিমেষ, এতরাতে মাতলামি করো না। ফোন রাখো। সমুদ্র লাইনটা কেটে দেবার পরও অনিমেষ একে-তাকে ফোন করেই গেল, যতক্ষণ তার কথা আর ল্যান্ডফোনের তার জড়িয়ে-মরিয়ে গিয়ে সে বিছানাতে ধপাস করে পড়ে গেল।
‘নবাঙ্কুর’ ক্লাবের গেটের মুখে ওয়ার্ড কমিশনার মধুসূদন ঘোষকে বসে থাকতে দেখে থমকে গেল অনিমেষ। এত কাছ থেকে মধুসূদন ঘোষকে কোনওদিন দেখেনি সে। নীল জিন্স, গেরুয়া পাঞ্জাবি পরনে। গলায় বিশাল বকলেসের মতো সোনার চেন। চৌকো মুখে বসন্তের দাগ। সোনালি চশমা। হাতে সাত-আটটা লাল-নীল সবুজ আংটি। কয়েকজন সুইপার নর্দমা পরিষ্কার করছে, মধুসূদন ঘোষ তার তদারকি করছেন।
মধুসূদন ঘোষের সঙ্গে আলোচনার পরামর্শ বা বুদ্ধি তপতীর। তপতী বলেছে, মধুসূদন ঘোষ সামনের বিধানসভা ইলেকশনে রুলিং পার্টির টিকিট পাবেন এবং জিতবেনও।মুখ্যমন্ত্রীর কাছের মানুষ। এই অঞ্চলের ষণ্ডা-গুণ্ডা, মস্তানরা ওর মুঠোয়। তাছাড়া বাঙালি হাজার হোক। সমস্যাটা বুঝবেন নিশ্চয়ই, সুতরাং…৷ অথচ দিনটা শুরু হয়েছিল কী ফুরফুরে মেজাজে। রবিবার বলে বেশ দেরিতে ঘুম থেকে উঠেছে অনিমেষ। ঘুমো চোখে উঠোনে কমলারোদে দুটো শালিকের ওড়াওড়ি দেখছিল সে। বেশ লাগছিল। হঠাৎই আকাশ এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। লাল শার্ট, কালো জিন্স৷বুকপকেটে সানগ্লাস, হাতে মোবাইল৷ শান্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছে আকাশ— আজ থিয়েটারের টাকা নিতে আসবে, মনে আছে? তিনটে-চারটে যা দেয়, রেখে দিও। ফালতু ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই কিছু। ছেলেগুলো ভাল নয়।
আপাদমস্তক নড়ে উঠেছে অনিমেষ। আকাশ যেন মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামিকে ফঁসির দিনক্ষণ নির্ভুলভাবে জানিয়ে দিল। দিনের প্রথম তেতো চা-টা শেষ করতে করতে তপতী ও টুসির সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পর্বটি সেরে নেয় সে। টুসি বলেছে, কারও কাছে যাবার প্রয়োজন নেই বাবা। আমাদের সমস্যা আমরাই মেটাতে পারব। টুসির আড়ালে কান্নাভেজা কণ্ঠে তপতী বলেছে, বড় ভয় করে আজকাল, মেয়েটা বড় হচ্ছে…। শেষপর্যন্ত তপতীর কান্না ও কাপুনি ছুঁয়ে গেছে তাকে। শেষপর্যন্ত তপতীর পরামর্শ গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে অনিমেষের। তারপর মধুসূদন ঘোষের খোঁজে বেরনো ছাড়া অন্য কোনও পথ খোলা ছিল না তার সামনে। এক সিগারেটে ঘন ঘন কয়েকটা টান দিতেই তার মনে হল, সে বেশ সাহসী হয়ে উঠেছে। মধুসূদন ঘোষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দু-হাত তুলে নমস্কারের ভঙ্গি করে অনিমেষ বলল, দাদা, আমাকে চিনতে পারছেন? আমি…।
হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে মধূসূদন ঘোষ বললেন, চিনি আপনাকে।বসুন।
প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে নিয়ে জড়সড় হয়ে বসে অনিমেষ বলল, দাদা, একটা সাহায্যের জন্য, না মানে একটা পরামর্শের জন্য এসেছিলাম।
—এ সবের জন্যই সবাই আসে। ধাতব কণ্ঠ মধুসূদন ঘোষের। দৃষ্টি দূর শূন্য আকাশে। তাড়াতাড়ি বলুন। অনেক কাজ আছে।
অনিমেষ দ্রুত কিন্তু পুরো ঘটনাটাই বর্ণনা করল। সব শুনে মৃদু হেসে মধুসূদন ঘোষ বললেন— কেলা বঙাল শুনেই এত রাগ হয়ে গেল আপনার? আরে মশাই, অসম আন্দোলনের দিনগুলিতে কত কথা শুনতে হয়েছে আমাদের। মারধোরও কম খাইনি বুঝলেন। এখন তো আর সেদিন নেই।
—কিন্তু এখনও তো ওই কথাগুলোই শুনতে হচ্ছে। অনিমেষ কথার পিঠে কথা চাপায়।
—অত রিঅ্যাক্ট করছেন কেন দত্তবাবু? অত অধৈর্য হলে চলে?
—না মানে, আজ টাকাটা নিতে আসবে তো। যদি কিছু? অনিমেষ কথা শেষ করে ইচ্ছে করেই।
ইন্ডিয়া কিং ধরিয়ে এক গাল কলো ধোঁয়া ছেড়ে মধুসূদন ঘোষ বললেন— ভয় পাচ্ছেন? নিয়ে নিন না মশাই দু-তিনটে টিকিট। আর না হলে থানায় রিপোর্ট করুন।
—সেটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না?
—হবেই তো। তাছাড়া আর কী-ই বা করবেন।
অথৈ জলে পড়ে গেল অনিমেষ। খড়কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টা করল এবার- বলছিলাম কি মধুসুদনদা। ছেলেগুলো আপনাকে তো খুব মানে টানে।আপনি একবার যদি ওদের একটু বলে দিতেন।
মধুসূদন ঘোষ এবার সাঁৎ করে চেয়ারশুদ্ধ ঘুরে অনিমেষের ঠিক মুখোমুখি বসে বললেন, শুনুন ভাই, আমি বাঙালি, আপনি বাঙালি। বাঙালির প্রতি বাঙালির টান থাকবে, সহানুভূতি থাকবে। আমারও আছে। আপনার সমস্যাটা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার দিকটাও তো আপনাদের ভাবতে হবে নাকি? এই ওয়ার্ডের পঞ্চাশ শতাংশ ভোটার ওরা, জানেন তো? ওরাই আমাকে ভোটে জিতিয়েছে, আগামী দিনেও জেতাবে। ওদের চটাতে যাব কেন বলুন তো?
—নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। ঠোক্কর খেতে খেতে বলে অনিমেষ— কিন্তু আমার ওপর, আমাদের ওপর আক্রমণ হলে আপনি দেখবেন না মধুসূদনদা?
মধুসূদন ঘোষ টুসকি মেরে সিগারেটের টুকরো ছুড়ে ফেলে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন। খানিকক্ষণ কিছু একটা ভেবে নিয়ে গলা খাদে নামিয়ে বললেন— দত্তবাবু, বিষয়টা কতটা সেন্সেটিভ আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। এ সব নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাটি করাটা কি ঠিক হবে? তাছাড়া, গুণ্ডা গুণ্ডাই। গুণ্ডার কোনও জাত হয় না, তাই না?
হতভম্ব অনিমেষের মুখের ভয়ঙ্কর কাছে নিজের মুখটা এনে ফিসফিস করলেন মধুসূদন ঘোষ- বাড়িতে ইয়ং মেয়ে আছে আপনার। কেন নিজের পরিবারটাকে সমস্যায় ফেলছেন। গত পরশুই তো কয়েকটা ছেলে মিলে একটা আদিবাসী মেয়েকে গ্যাংরেপ করে নদীর পারে ফেলে রেখে গেছে, শোনেননি? আদিবাসীরা খেপে গেছে। আজ পরিস্থিতি কী হয় দেখুন। যান, বাড়ি যান। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন আরেকবার।
একটা শীতল ভয় তাকে আমূল কাঁপিয়ে দিল। মধুসূদন ঘোষ বিষয়টা এড়াতে চাইছেন। সেজন্য কায়দা করে ভয় দেখাচ্ছেন। সে সব কিছু পরিষ্কার বুঝতে পারছে তবু যেন হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। মধুসূদন ঘোষ আরও কিছু বলছেন। কিন্তু কিছুই আর সে শুনতে পাচ্ছে না। উঠতে গিয়ে শরীরটা টলে গেল। একদলা থুতু মধুসূদন ঘোষের চৌকো মুখে ছিটিয়ে দিতে ভীষণ ইচ্ছে হল তার।…সে চিৎকার করে উঠতে চাইল। কিন্তু তুলতুলে নরম একটা শব্দ তার বুক থেকে গলায়, আর গলা থেকে বুকে ওঠানামা করে। মিলিয়ে গেল। বড় নরম, আয়েসি, হিসেবি আর পোষমানা এই শব্দ। লোমাবৃত পোষা। বেড়াল বা কুকুরছানার মতো৷এ-শব্দ সামান্যও তরঙ্গ তুলতে পারে না, এ-শব্দ কোথাও আঘাত করে না, কোথাও গিয়ে পৌঁছয় না শেষপর্যন্ত। অন্য কোনও শব্দ তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে কেন উঠে আসে না? অনিমেষের কান্না পেয়ে গেল। অবশ্য শরীরটাকে টেনে-হিঁচড়ে বাড়ি অবধি নিয়ে এসে টুসিকে জড়িয়ে ধরে অনিমেষ কান্নায় ভেঙে পড়ল।তার মাথায়, পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে আত্মজা অভয়বাণী উচ্চারণ করল যেন, এখানে-ওখানে, যেখানেই যাই, যেখানেই থাকি আমাদের উঠে দাঁড়াতে হবে, রুখে দাঁড়াতে হবে বাবা। এত ভয় নিয়ে বাঁচা যাবে না। আমরা কোথাও যাব। এখানেই থাকব। এখানেই থাকব, আর লড়তে লড়তে বাঁচব৷ অনিমেষ ভাবল, টুসি হয়তো ঠিকই বলেছে। এক শরীরময় ভয় নিয়ে কোথায় যাবে সে, তারা? না, কোথাও যাবে না। এখানেই থাকবে। বিবর্ণ, নিষ্প্রাণ শামুকজীবন ছেড়ে উঠে দাঁড়াবে, রুখে দাঁড়াবে। লড়তে লড়তে বাঁচবে। এই হিংস্র গুণ্ডা দলের পাশাপাশি মধুসূদন ঘোষদের বিরুদ্ধে তো লড়ে যেতে হবে।
প্রায়ান্ধকার ঘরে নিশ্চুপ, নিশ্ছল তিনটি ছায়ামূর্তি। সোফায় তপতী ও অনিমেষ। জানালার পাশে টুসি। আর স্তব্ধ, বোবা সময়। আর জমাট অন্ধকার। এখনই হয়তো কেউ গেট খুলবে। কলিং বেল বাজাবে কেউ। অর্থহীন বসে থাকে তারা। আর জমাট অন্ধকার।বন্ধ দেয়ালঘড়ির পাশে একটা টিকটিকি বেগুনি-কালো রঙের একটা পোকাকে ধরবে বলে ওঁৎ পেতে আছে। পোকাটা দু-পা এগোল। টিকটিকিও। পোকাটা এবার এদিক-ওদিক একটুক্ষণ ওড়াওড়ি করে টিকটিকির কাছাকাছি এসে বসল।টিকটিকির ল্যাজটা শক্ত হয়ে শূন্যে আস্ফালন করল দু-একবার। টিকটিকি পোকাটার ওপর এবার ঝাঁপিয়ে পড়বে। অনিমেষ চোয়াল শক্ত করে সেই মুহূর্তটার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু এ কী! পোকাটা হঠাৎ! একদম হঠাৎই ছোট ধূসর পাখা হাওয়ায় ফরফরিয়ে টিকটিকিটার দিকে তেড়ে যাওয়ার ভঙ্গি করল আর টিকটিকিটা থতমত খেয়ে কয়েক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে থেকে সুড়সুড় করে বন্ধ দেয়ালঘড়ির পেছনে গিয়ে আশ্রয় নিল। অনিমেষের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা দেখা দিল, অনেকদিন পর এবং হয়তো তার নিজেরই অজান্তে।
ঘড়াং ঘড়াং করে গেটে বেসুরো শব্দ হল। তপতী শক্ত করে অনিমেষের একটা হাত চেপে ধরল। টুসি উঠে গিয়ে পর্দা ফাঁক করে বাইরের দৃশ্য দেখে নিয়ে বলল, ওরা এসে গেছে।
অনিমেষ বোবা দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে নিষ্পলক তাকালো— তোমরা বসে থাক। আমি যাচ্ছি। টুসির স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর বিন্দুমাত্র টোল খেল না।
কলিং বেল অস্থির হয়ে বেজে চলেছে। অনিমেষের হাতের আঙুল মুষ্টিবদ্ধ হল। দাঁতে দাঁত চাপল সে। চোয়াল শক্ত হয়ে এল আর তার নাভি হয়ে, বুক হয়ে একটা শব্দ বেরিয়ে এল—গর্র গর্র৷ বেহিসেবি, বিচ্ছিরি, হিংস্র, মাংশাষী কিছু শব্দ যেন দলা-পাকিয়ে তার গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে।।
—গর্র… গর্র…। অনিমেষ, শুধু অনিমেষই সেটা শুনতে পাচ্ছে।
—কেউ না, আমি যাব। হুংকার ছাড়ে অনিমেষ। তার এই কণ্ঠস্বর তপতী ও টুসির কাছে অচেনা ঠেকে।
শক্ত পায়ে উঠে দাঁড়াল অনিমেষ। তার সমস্ত শরীর জুড়ে শব্দটা বাজতে থাকে… গর্র গর্র।
অনিমেষ সশব্দে দরজা খুলল। এবার সে ঝাঁপিয়ে পড়বে।